এই বই নিছক কোনো ঘটনার সাধারণ বর্ণনা নয়। এখানে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি লাখ লাখ মানুষের নির্যাতনের, নিপীড়নের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যে কী অমানুষিক নির্যাতন করা হয়, সেই গল্পই তুলে ধরা হয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নামক দোজখ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে আসা এক ব্যক্তির জবানীতে।
এইসব ক্যাম্পের ভয়ঙ্কর অত্যাচারের কথা বিভিন্ন লেখায় ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে। কমবেশি সবাই তা জানেও। কিন্তু এই গল্পে প্রতিদিনকার ছোট ছোট বিভিন্ন খুটিনাটির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সহজ করে বলতে গেলে, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে একজন বন্দির প্রতিদিনের জীবন কেমন ছিল, তার মনে এ ঘটনাগুলো কীভাবে প্রভাব ফেলেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।
এখানে অখ্যাত অনেক ছোট ছোট ক্যাম্পের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেগুলো বিখ্যাত ক্যাম্পের ঘটনার আড়ালে রয়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত বীর বা বন্দিদের উপর নির্যাতন বা হত্যার গল্প এখানে বলা হয়নি। বলা হয়নি বিখ্যাত কাপোদের কথা। যেসব বন্দি ট্রাস্টি হবার কারণে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়েছে অথবা যেসব বন্দি ইতোমধ্যেই সুপরিচিত, তাঁদের কথাও বলা হয়নি এখানে।
তাহলে কাদের কথা বলা হয়েছে এখানে?
বলা হয়েছে সেই সব সামরিক বাহিনীর লোকদের কথা, সাধারণ মানুষদের কথা, যাদের আত্মত্যাগ লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে। কাপোদের সাথে এই বন্দিদের জীবনযাপনে ছিল বিস্তর ফারাক। কাপোদের কখনো না খেয়ে থাকতে হতো না। অথচ এইসব বন্দিরা ঠিক মতো খাবার পেত না, খাবার পেলেও সেই খাবারে অনেক সময়ই পেট ভরতো না। অবাক করা বিষয় হলো, এসব কাপোদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবন যতটা না আরামে কাটিয়েছে, তার চেয়ে বেশি আরামে কাটিয়েছে এই ক্যাম্পে। বন্দিদের প্রতি এসব কাপোরা গার্ডের চেয়ে কঠোর এবং এসএস সদস্যদের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আচরণ করতো। মারধোর করত।
বন্দিদের মাঝ থেকে তাদেরই কাপো হিসেবে নির্বাচন করা হতো, যারা সব সময় অনুগত থাকবে। উপর মহলের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। যদি কেউ কখনো তাদের কথা অমান্য করতো, সাথে সাথেই শাস্তিস্বরূপ তাদের অপদস্থ করা হতো।
এইসব কাপোরা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই এসএস সদস্যদের মতো আচরণ করা শুরু করতো। বলা চলে এসএস সদস্যদের মানসিকতা এবং তাদের মানসিকতা একই রকম হয়ে যেত।
বাইরের মানুষের বন্দিজীবন সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকে। কারণ তারা সহানুভূতি এবং কৃপার চোখে তাদের দেখে। একজন বন্দিকে বেঁচে থাকার জন্য যে ভীষণ সংগ্রাম করতে হয়, তা অনেকেই জানে না। বুঝতে পারে না, সামান্য রুটির জন্যেও তাদের কত অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হয়।
বন্দিদের এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সাধারণ গাড়ীগুলোও ছিল একেকটি বিষাক্ত গ্যাস চেম্বার। দুর্বল, কাজে অক্ষম কয়েদিদের একটি কেন্দ্রীয় ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হতো। ভাবছেন, সেখানে চিকিৎসা দেয়া হতো? ভুল। সেটি ছিল বিষাক্ত গ্যাস চেম্বার। সাক্ষাৎ শ্মশান।
কয়েদিদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে, এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের লড়াই বাঁধিয়ে দিয়ে অক্ষম, দুর্বল কয়েদি নির্বাচন করা হতো।
সবারই চেষ্টা থাকতো নিজের বা নিজের কাছের লোকদের নাম যেন এ তালিকায় না ওঠে। তবে সবাই জানতো, একজনের নাম বাদ পড়লে সে জায়গা অন্য আরেকজনের নাম উঠবেই।
প্রতিবারই গাড়িতে করে নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েদি নিয়ে যাওয়া হতো। কখনোই তার কম হবার জো ছিল না। এটি যেন মামুলি ব্যাপার। কারণ কয়েদিরা সেখানে ছিল নিছকই একটি সংখ্যা। সংখ্যা ছাড়া তাদের কোনো পরিচয় ছিল না।
ক্যাম্পে নিয়ে আসার পর কয়েদিদের কাছ থেকে তাদের বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাথে সব ধরনের কাগজপত্রও নিয়ে নেয়া হতো।
তবে এক্ষেত্রে বন্দিদের ভুল নাম, ঠিকানা দেয়ার সুযোগ ছিল। অনেকেই তা করতো। কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ে মাথা ঘামাতো না। তারা শুধু দেখতো সংখ্যাটা ঠিক আছে কি না? এসব সংখ্যা প্রায়ই তাদের শরীরে ট্যাটু করে লিখে দেয়া হতো অথবা জামা, প্যান্ট কিংবা কোটে সেলাই করে লাগিয়ে দেয়া হতো। কোনো প্রহরী যদি কোনো বন্দির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইতো, তাহলে সে এক পলক বন্দির নম্বরটি দেখে নিত। নাম জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
আগের কথায় ফেরত আসা যাক। সেখানে নীতি, নৈতিকতার কোনো বালাই ছিল না। সেখানে সবার একটিই চিন্তা ছিল। কীভাবে পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়া যায়! কীভাবে বন্ধুদের রক্ষা করা যায়! কোনো দ্বিধা, গ্লানি ছাড়াই এক কয়েদি অন্য কয়েদির নাম বা সংখ্যা বসিয়ে দিত এই পরিবহনের যাত্রীদের তালিকায়।
ইতোমধ্যেই বলেছি, নেতিবাচক পদ্ধতিতে কাপোদের নির্বাচন করা হতো। যারা সবচেয়ে বেশি হিংস্র, নিষ্ঠুর, তারাই কাপো হবার জন্য নির্বাচিত হতো (তবে ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়)। এসএস বাহিনী দ্বারা পরিচালিত এই নির্বাচন প্রক্রিয়া ছাড়াও নিজেদের মধ্যেও এক ধরনের বাছাই প্রক্রিয়া ছিল। অনেক কয়েদিই ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে বন্দি জীবন কাটিয়ে স্বাভাবিক অনুভূতি হারিয়ে ফেলত। তারা শুধু বুঝতো বেঁচে থাকতে হবে। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভালো কিংবা মন্দ সব ধরনের উপায়ই তারা গ্রহণ করতো। প্রয়োজনে প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতো। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাগ্যের সহায়তায় কিংবা অলৌকিক উপায়ে বেঁচে যেত ঠিকই, কিন্তু তাদের বদলে কাউকে না কাউকে জীবন দিতে হতোই। তবে যারা খুব সহজ-সরল, তাদের বেঁচে থাকাটা ছিল কষ্টকর।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অনেক ঘটনাই ইতোমধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বন্দিদের অভিজ্ঞতাগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সেই প্রকৃত ঘটনাগুলোকেই সহজ করে তুলে ধরা হবে। তুলে ধরা হবে সেইসব বন্দিদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা। যারা কখনো বন্দি জীবন কাটাননি, তারা বুঝতে পারবেন না, কেন বন্দি মানুষগুলো পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারতো না। ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা গুটিকয়েক ভাগ্যবান মানুষের অভিজ্ঞতা শুনলে হয়তো তাদের কষ্টের ধরণ কিছুটা বুঝতে পারবেন।
বন্দিজীবনে কাটিয়ে আসা এইসব মানুষগুলোকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘বন্দি জীবন নিয়ে কথা বলতে একদম ইচ্ছে করে না। কারণ কোনো ভাবেই তা বোঝানো যাবে না। তাছাড়া কেউ বুঝতেও পারবে না, আমরা সেখানে কেমন ছিলাম, এখনই বা কেমন আছি।’
বিষয়টি পদ্ধতিগত ভাবে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা কঠিন কারণ মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি ব্যাখ্যা করার জন্য একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন। কিন্তু একজন ভুক্তভোগীর পক্ষে কি কখনো সম্ভব নিরপেক্ষ হওয়া? হয়তো কোনো বাইরের মানুষ এই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে তবে তার পক্ষে দূরে থেকে ক্যাম্পের আসল ঘটনা অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। কখনোই না। কেবল ক্যাম্পে অবস্থানকারীর পক্ষেই কয়েদিদের মানসিক অবস্থা বোঝা সম্ভব। হয়তো তার পক্ষে পুরোপুরো বস্তুতান্ত্রিক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এছাড়া গতিও নেই। এই ধরনের বইয়ে ব্যক্তিগত বিরূপতা এড়িয়ে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা খুবই কঠিন। তাছাড়া একান্ত অভিজ্ঞতা বলার জন্যেও অনেক সময় সাহসের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমি ছদ্মনামে কারাগারের কয়েদি-নম্বর উল্লেখ করে এই বইটি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ করলাম, মনে হল, ছদ্মনামে বইটি প্রকাশ করলে অর্ধেক মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তাছাড়া সত্য বলার সৎ সাহস আমার আছে। এইজন্য নিজের কথা বলা অপছন্দের হওয়া সত্ত্বেও অনেক অংশই রেখে দিয়েছি, বাদ দেইনি, যেন মূলসুর না কেটে যায়।
এ লেখায় আমি দাঁড়িকমা সমেত বিভিন্ন ঘটনা পাঠকের জন্য রেখে গেলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা কয়েদিদের মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণের জন্য এই তথ্যগুলো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। এ সময় এক ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। যেটা ‘কাঁটাতার অসুস্থতা’ লক্ষণ হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণেই আমরা জনসাধারণের এই মনোরোগ সম্পর্কে জানতে পারি।
এই বই আমার বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। কিছুটা গর্ব করে বলতে পারি, শেষের কিছু সপ্তাহ ছাড়া আমি সেখানে সাইকোলজিস্ট বা ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম না। আমার কিছু সহবন্দিদের কপাল বলতে হবে যে, তাদের মারাত্মক জখমে আমি ময়লা কাগজ দিয়ে ব্যান্ডেজ করতে পেরেছিলাম। তবে আমিও বন্দি ছিলাম। ১১৯১০৪ সংখ্যাটি ছিল আমার একমাত্র পরিচয়। আমার অধিকাংশ সময়ই কাটতো রেল লাইনের রাস্তা খোড়াখুড়ি করে এবং সেখানে রেল লাইনের পাত বিছিয়ে। এক সময় আমাকে রাস্তার নিচ দিয়ে পানি যাবার জন্য ট্যানেল খুঁড়তে দেয়া হয়। সেখানে আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ ছিল না। তবে আমার কাজ একেবারেই বিফলে যায়নি। এজন্য ১৯৪৪ সালে ক্রিসমাসের আগে আমাকে তথাকথিত ‘প্রিমিয়াম কুপন’ পুরস্কার দেয়া হয়। আমাদের যারা ক্রীতদাস হিসেবে কিনে নিয়েছিল, তারাই এই পদ্ধতি চালু করেছিল। প্রতিষ্ঠানটি কয়েদিদের পারিশ্রমিক ক্যাম্পের কমকর্তাদের হাতে তুলে দিত।
আমরা যে কুপনগুলো পেতাম সেগুলোর মূল্য ছিল ১৫ পেনি একটি কুপনের বিনিময়ে ছয়টি সিগারেট পাওয়া যেত। যদিও সপ্তাহখানেক পরে এর কোনো মূল্য থাকতো না। তবে কুপনটি পেয়ে খুবই গর্বিত হয়েছিলাম। কারণ সেটির বিনিময়ে বারোটি সিগারেট পেয়েছিলাম। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, সেই সিগারেটগুলোর বিনিময়ে বারো পেয়ালা স্যুপ পেয়েছিলাম। ক্ষুধার্ত অবস্থায় এই বারোবাটি স্যুপ ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো।
কাপোরা ধূমপান করার সুযোগ পেত কারণ কাপোদের কুপন পাবার একটি কোটা বরাদ্দ ছিল। সে কুপন দিয়ে তারা ধুমপান করতো। এছাড়া যেসব কয়েদি- যারা ফোরম্যান হিসেবে বিভিন্ন গুদামে বা ওয়ার্কশপে কাজ করতো, বিপদজনক কাজের বিনিময়ে তারা মাঝেমধ্যে সিগারেট পেত।
এছাড়া যেসব বন্দি জীবন সম্পর্কে আশা হারিয়ে ফেলেছিল, বেঁচে থাকার শেষদিনগুলো আনন্দে কাটাতে চেয়েছিল, তারাই ধূমপান করতো। তবে সেটা ব্যতিক্রম ঘটনা। তাই যখন দেখতাম, কেউ তার তুলে রাখা সিগারেট টানছে, ধরে নিতাম, জীবন সম্পর্কে সে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মনোবল ভেঙে গেছে তার। আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেশক্তি একবার হারিয়ে গেলে তা ফিরে পাওয়া অসম্ভবই ছিল বলা যায়।
কেউ যদি কয়েদিদের বন্দিকালের পর থেকে তাদের অবস্থা এবং অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে বন্দিদের তিনটি পর্যায় দেখতে পাবে। যখন সে বন্দি হয়ে ক্যাম্পে এসেছে তখন প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ক্যাম্পের জীবনযাপনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর থেকে। আর ক্যাম্প থেকে মুক্ত হবার পর শুরু হয় তার তৃতীয় পৰ্যায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে যে বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা হলো প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা। তবে অনেক সময় ক্যাম্পে আসার আগেই এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমি নিজের কথাই বলতে পারি।
পনেরো শ’ বন্দিকে ট্রেনে করে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হচ্ছিল। প্ৰতি বগিতে আশিজন লোক। পা ফেলার জায়গা নেই। এভাবে আমাদের বেশ কয়েকদিন ট্রেনে কাটাতে হয়েছে। প্রায় সবাইকেই তাদের বাক্সপেটরার উপরই শুয়ে, বসে সময় কাটাতে হতো। ওই বাক্সপেটরাই ছিল তাদের শেষ সম্বল। বগিতে এত লোকজন ছিল যে, ট্রেনের সবচেয়ে উপরের জানালা দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করতে পারতো। সবাই আশা করতো ট্রেন হয়তো কাছেই কোনো সামরিক কারখানায় থামবে, যেখানে তাদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। যদিও জানতাম না, আমরা কোথায় আছি, সালিসিয়াতে নাকি পোল্যাণ্ডে? ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে কেমন অদ্ভুত শব্দ হতো। মনে হতো কোনো জনমদুঃখী সাহায্য চেয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
এক সময় ট্রেনের গতি কমে এলো। সামনেই স্টেশন। হঠাৎ কোনো একজন চিৎকার করে উঠলো। ভয়ে। তার বুকফাটা শব্দে কেঁপে উঠলো ট্রেনের বগি। স্টেশনে বড় করে লেখা ‘অশউইজ’। মুহূর্তের মধ্যে সবার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল। অশউইজ— নামটি সবার জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াল। কারণ এটি সাক্ষাৎ দোজখখানা।
কী নেই এখানে?
গ্যাস চেম্বার, মানুষকে পুড়িয়ে মারার চুল্লি— সবই আছে এখানে। গণহত্যার জন্য কুখ্যাত। ট্রেনটি খুব আস্তে আস্তে চলতে লাগলো, যেন অশউইজ শব্দটি থেকে যাত্রীদের সে রক্ষা করতে চায়।
.
ভোরের আলো জাগলো।
আলোতে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো বিশাল ক্যাম্প। দেয়ালের উপরে কয়েক সারিতে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া। ওয়াচ টাওয়ার। বিশাল বিশাল সার্চ লাইট। আর ছিল লম্বা সারিতে ছেঁড়াফাড়া পোশাক পরে শুয়ে থাকা অসংখ্য বন্দি।
ভোরের হালকা আলোয় কেমন অস্পষ্ট, ধূসর দেখাচ্ছিল তাদের আমরা জানতাম না আমাদের গন্তব্য কোথায়? কোথায় গিয়ে আমাদের পথচলা থামবে।
বিচ্ছিন্ন চিৎকার, বাঁশির শব্দ ভেসে আসছিল। আমরা জানতাম না এগুলোর মানে কী? আমি যেন কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম, ফাঁসির দড়িতে মানুষের শরীর ঝুলছে। আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাতে হয়তো ভালোই হয়েছিল। কারণ আস্তে আস্তে আমরা এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম।
শেষ পর্যন্ত ট্রেন এসে স্টেশনে থামলো। এতক্ষণ যে নীরবতা ছিল, তা দূর হয়ে গেল। হর্তাকর্তারা এসে কর্কশ স্বরে আমাদের বিভিন্ন আদেশ দিতে লাগল। আমরা ভয়ে তটস্থ হয়ে সব আদেশ মেনে নিতে লাগলাম। আদেশ পালন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও ছিল না কারো। তাদের গলার শব্দ মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ চিৎকারের মতো ছিল। যদিও কিছু পার্থক্য তো ছিলই। কেমন কর্কশ? বারবার মার খেয়ে যেমন শব্দ গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে তেমন।
এমন সময় বগির দরজা খুলে গেল। কয়েকজন কয়েদি ভিতরে এসে ঢুকলো। লম্বা চেকের পোশাক পরা। মাথা ন্যাড়া। তবে স্বাস্থ্য বেশ ভালো। তারা যথাসম্ভব ইউরোপিয়ান ভাষায় আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করে কথা বলতে লাগল। যা ওই পরিস্থিতিতে খুবই বেমানান। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চেষ্টা করে, আমার মনেও কেমন একটা আশা জাগল। এই কয়েদিদের দেখে বেশ ভালোই মনে হচ্ছিল। মুখেও হাসি। কে জানে, আমিও হয়তো ওদের মতো ভালো অবস্থানে থাকবো।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘ডিলুয়েশ অফ রিপ্রাইভ’ বলে। যেমন ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামীও মনে মনে ভাবতে থাকে শেষপর্যন্ত হয়তো তার ফাঁসি হবে না। কেউ তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে। আমার অবস্থাও তেমন হয়েছিল। মনের মধ্যে একটি আশা জাগছিল, শেষমেশ আমার সাথে হয়তো খারাপ কিছু হবে না। সেই লোকদের টকটকে লাল গাল, গাট্টাগোট্টা শরীর দেখে আমার মনে একটা আশার জন্ম দিয়েছিল। আমরা ভুলেও চিন্তা করিনি, এটা একটা স্পেশাল ফোর্স। যাদের কাজই হলো প্রতিদিন নতুন আসা বন্দিদের স্টেশন থেকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া। তারা নতুন কয়েদিসহ তাদের সহায়সম্পত্তি মানে বাক্সপ্যাটরা, অলঙ্কারের দায়িত্ব বুঝে নিল। যুদ্ধের শেষ বছর অশউইজ ইউরোপের মধ্যে একটি রহস্যময় স্থানে পরিণত হয়েছিল। সোনা, রূপা, প্লাটিনাম, হীরায় ভর্তি হয়ে উঠেছিল এর গুদামঘরগুলো। শুধু গুদামঘরই নয়, এসএস সদস্যদের কাছেও এসব মূল্যবান জিনিসপত্রে বোঝাই ছিল। যার কোনোটাই হালালভাবে কামাই করা নয়। সবই অন্যদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল।
ছোট্ট একটা ছাউনিতে প্রায় পনেরোশজন লোক এনে রাখা হয়েছিল। অথচ সেটা ছিল বড়জোড় দুইশজন লোক থাকার জায়গা। শীতে, ক্ষুধায় আমরা কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। এই অবস্থায় একটু শোয়া তো দূরের কথা, হাঁটুমুড়ে বসার জায়গাও ছিল না সেখানে। তখন মাত্র পাঁচ আউন্স ওজনের রুটি দেয়া হতো আমাদের চারদিন খাওয়ার জন্য।
শুনতে পেলাম দুজন পুরোনো বন্দি নিজেদের মধ্যে টাই-পিন নিয়ে দামাদামি করছে। টাই-পিনটি ছিল প্লাটিনাম আর হিরার তৈরি। তারা আমাদের ছাউনির দায়িত্বে ছিল। অবশ্য তাদের লাভের বেশির ভাগই ব্যয় : হতো ‘স্ন্যাপস’ নামক মদের পেছনে। এখন অবশ্য মনে নেই, বিশেষ সন্ধ্যার রঙতামাশার জন্য কত হাজার টাকার ‘স্ন্যাপস’ কেনা হতো। তবে এটা ঠিক ঠিক মনে আছে, এই বিশেষ ধরনের মদ ছাড়া পুরানো বন্দিদের যেন চলতোই না। তাদের এটা লাগতোই। এ অবস্থায় তাদের দোষারোপ করারও কিছু নেই। তাদের ছাড়া আরেক দল অগাধ মদের জোগান পেত। তারা ছিল গ্যাস চেম্বার আর মরা পোড়ানো চুল্লির তদারকি দায়িত্বে থাকা পুরানো বন্দি। অবশ্য তারা জানতো, এ দায়িত্ব নতুন কারো হাতে চলে যাবে। তখন তারাই হবে এর জীবন্ত বলি।
.
ট্রেনে আমার সব সহযাত্রীদেরই মনে একটি সুপ্ত আশা ছিল, হয়তো তাদের সাথে খারাপ কিছু হবে না।
কোনো না কোনো ভাবে তারা মুক্তি পেয়ে যাবে। আমাদের সামনে যে কী ঘটতে যাচ্ছে, ঘুণাক্ষরেও কেউ চিন্তা করতে পারিনি তখন। আমাদের বলা হয়েছিল, সব ব্যাগব্যাগেজ ট্রেনেই রেখে দেয়ার জন্য। তারপর দুই লাইন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এক লাইন হবে পুরুষের, অন্য লাইন মহিলাদের। লাইনে থাকা অবস্থাতেই আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হবে। এ সময় আমি একটি দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম। আমার ব্যাগটি লুকিয়ে ফেললাম কোটের নিচে। একজন অফিসারের সামনে দিয়ে আমাদের লাইনের লোকেরা এগিয়ে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, অফিসারের কাছে যদি ধরা পড়ে যাই, তাহলে আমার চিন্তার চেয়েও কঠিন শাস্তি পেতে হতে পারে। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, ধরা পড়লে আর কিছু না হোক, মাটিতে ফেলে ইচ্ছামতো বুট দিয়ে লাথি দিতে থাকবে তারা।
আমি যখন অফিসারের কাছাকাছি চলে এসেছি তখন সটান হয়ে হাঁটতে চেষ্টা করলাম। যেন অফিসার বুঝতে না পারে আমার কোটের নিচে কোনো ভারী জিনিস আছে। আমি অফিসারের কাছাকাছি চলে এসেছি। একজনের পরই তার সামনে আমি দাঁড়াবো। অফিসারটি বেশ লম্বা। এক হারা গড়ন। পোশাকে আশাকে দারুণ ফিটফাট। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি, ঘামে একাকার হয়ে আমাদের অবস্থা ছিল তথৈবচ। তার সামনে আমাদের বেশ বেমানান লাগছিল। তার কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ডান হাতের কনুই বাম হাতের তালুতে রেখে আরাম করে বসে ছিল। আর যেই তার সামনে দাঁড়াচ্ছে, তখন তিনি ডান হাতের শাহাদাৎ আঙুল উঁচু করে এদিক সেদিক নির্দেশ করছিলেন। যদিও তিনি কী বোঝাতে চাইছেন, আমি ঠিক মতো বুঝতে পারছিলাম না।
আমার পালা চলে এলো।
পেছন থেকে কেউ একজন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘যাকে ডানে যেতে বলছে, সে সুস্থ। কাজের উপযুক্ত। যাকে বামে যেতে বলছে সে কাজের অনুপযুক্ত। তাই তাকে এখানে রাখা হবে না। পাঠানো হবে বিশেষ ক্যাম্পে। আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন এই প্রক্রিয়া শেষ হবে।
কোটের নিচে ভারী ব্যাগটির জন্য আমি কিছুটা বায়ে ঝুঁকে ছিলাম। তারপরও সোজা হয়ে হাঁটতে চেষ্টা করলাম। এসএস অফিসার কী ভেবে যেন আমার কাঁধে তার হাত রাখলেন।
আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। এক সময় অফিসার আমার কাঁধ ডান দিকে ঘুরিয়ে দিল। আমি ওদিকে ঘুরে এগিয়ে গেলাম।
এভাবে শেষ হয় আমাদের প্রাথমিক বাছাই পর্ব।
সেইদিন সন্ধ্যায় জেনেছিলাম এসএস অফিসারের আঙুলের ইশারার মানে। ওই আঙুলের ইশারার উপরই নির্ভর করছিলো আমাদের জীবন-মরন। বাঁচা, না বাঁচা। ট্রেনের বেশির ভাগ যাত্রী অর্থাৎ শতকরা ৯০ জনের ভাগ্যেই সেদিন মৃত্যু লেখা হয়ে গিয়েছিল। যে মৃত্যু কার্যকর করা হয়েছিল পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।
যাদের বাদিকে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তাদের স্টেশন থেকে সরাসরি শ্মশানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই দালানে যেখানে মানুষদের পুড়িয়ে মারা হতো, কাজ করতো এমন একজন পরে আমাকে বলেছিল, দরজায় ইউরোপের অনেকগুলো ভাষায় ‘বাথ’ কথাটি লেখা ছিল। ওই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই বন্দিদের হাতে এক টুকরো সাবান ধরিয়ে দেয়া হতো। এবং তারপর…
থাক, আমি আর বিস্তারিত বলবো না। কারণ ইতোমধ্যেই এই বিভৎস, রোমহর্ষক ঘটনার উপর অনেক ধরনের লেখা হয়েছে।
আমরা যে অল্প কয়জন বেঁচে গিয়েছিলাম, সেদিন সন্ধ্যাতেই আমাদের এসব ঘটনা জানানো হয়।
এক পুরানো বন্দিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার সহকর্মী এবং এক বন্ধুর সম্পর্কে। তারা কোথায় আছে, জানতে চেয়েছিলাম।
পুরানো বন্দি তখন আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, ‘তাদের কি বাম দিকে পাঠানো হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম।
সে বলল, “তাহলে তুমি তাদের ওইখানে পাবে।’
তার কথা না বুঝতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘কোথায় পাবো?’
সে আমাকে আঙুল তুলে বেশ দূরে একটি চিমনির দিকে দেখালো। চিমনি দিয়ে অনবরত ধোঁয়া বের হচ্ছিল, আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছিল। চিমনির ধোঁয়ায় ভরে উঠেছিল পোল্যান্ডের আকাশ। মনে হচ্ছিল, এক খণ্ড কালো মেঘ এসে ভীড় করেছে সেখানে।
‘ওখানে আছে তোমার বন্ধু। হয়তো এতক্ষণে বেহেশতে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে।’ এই ছিল তার উত্তর।
সত্যি বলতে কি সরাসরি বুঝিয়ে না বলা পর্যন্ত আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। হয়তো বুঝতে পারলেও কোনো লাভ হতো না। আমি খুব তাড়াতাড়ি করেই ঘটনাগুলো বলে ফেললাম। কিন্তু বিষটা এত সহজ নয়। মনস্তাত্তিক বিষয়টি দেখলে বোঝা যাবে, ভোরে ট্রেন স্টেশন থেকে রাতের ঘটনা পর্যন্ত সময় অনেক দীর্ঘ। কারণ একটু পর কী হবে তা ছিল অজানা। প্রতি মুহূর্তে ছিল মৃত্যুর হাতছানি।
আমাদের আরও কয়েকবার বিভ্রম হয়েছিল।
এসএস বাহিনির লোকদের কেমন আপন মনে হয়েছিল প্রথম প্রথম। মনে হচ্ছিল, তারা আমাদের প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। অবশ্য আসল কারণটা কিছুক্ষণ পরই জানতে পেরেছিলাম। যতক্ষণ আমাদের হাতে হাতঘড়ি ছিল, ততক্ষণ তারা আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। আসলে সেগুলো হাতিয়ে নেবার ধান্ধায় ছিল তারা
আমাদের একটি ছাউনিতে নিয়ে আসা হলো। সেখানে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর এসএস সদস্য এসে একটি চাদর বিছিয়ে দিল।
বলল, আমাদের সাথে রাখা যত মূল্যবান জিনিসপত্র আছে, সব সেখানে রাখার জন্য।
আমাদের মধ্যে কয়েকজন খুব সহজ সরল লোক ছিল। তারা পুরানো বন্দিদের কাছে জিজ্ঞেস করলো, বিয়ের আংটিটা নিজেদের কাছে রাখতে পারবে কি না?
লোকগুলোর কথায় তারা যেন বেশ মজা পেল। তখনো আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের সবকিছুই তারা নিয়ে নিবে।
আমি পুরানো এক বন্দির সাথে খাতির জমাবার চেষ্টা করলাম। সবার চোখ এড়িয়ে তার কাছে গেলাম।
কোটের নিচে লুকিয়ে রাখা এক তাড়া কাগজ দেখিয়ে বললাম, এগুলো একটি বৈজ্ঞানিক বইয়ের খসড়া। আপনি হয়তো বলবেন, এখন জীবন বাঁচানো ফরজ, এগুলোর কথা পরে ভাবলেও চলবে। তারপরেও আমি বলবো, এটা আমার কাছে রাখতে হবে। আমার সারা জীবনের পরিশ্রম এটা। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা?’
পুরানো বন্দির মুখে আস্তে আস্তে হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে হলো, তিনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।
কিন্তু তার হাসি ধীরে ধীরে তাচ্ছিল্যে রূপ নিতে লাগল। এক পর্যায় ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠলো তার চেহারা।
তারপর তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘শিট!’ বন্দি জীবনের বহুল পরিচিত শব্দ এটি।
তখন যেন আমার বোধোদয় হলো। বুঝতে পারলাম, আমি আমার পেছনের জীবনকে ফেলে অনেক দূর চলে এসেছি। এখানে আমার ইচ্ছানুসারে কিছুই হবে না।
হঠাৎ এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো আমার সহযাত্রীদের মধ্যে। এতক্ষণ তারা অসহায়ের মতো আতঙ্কিত মুখে তর্ক করছিল।
এমন সময় আমরা আবার আদেশ পেয়ে কিছু এসএস সদস্যদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
একজন আমাদের হুকুম করলো, ‘তোমাদের দুই মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে পরনে যা কিছু আছে সব খুলে যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, সেখানেই রাখবে। জুতা, বেল্ট বা মোজা বাঁধার ফিতে আর ট্রাস ছাড়া সাথে অন্য কিছুই রাখা যাবে না। আমি ঘড়িতে সময় ধরলাম। দুই মিনিট মানে দুই মিনিট। এখনই সময় শুরু।
যে যত তাড়াতাড়ি পারে পরনের জামাকাপড় খুলতে লাগল। মনে হচ্ছিল ঘোড়ার মতো দৌড়ে সময় চলে যাচ্ছে। অস্থির হয়ে গায়ের জামাকাপড় টানতে লাগলো সবাই।
এমন সময় ‘সপাৎ’ করে শব্দ হলো। চাবুকের শব্দ। খালি গায়ে চাবুক পড়ার শব্দ।
সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলো আরেকটা ঘরে। চুল কাটার জন্য। যখন চুল কাটা হলো, মাথা তো মাথা শরীরেও কোনো চুল ছিল না। চুল কাটা শেষ হতে না হতেই আরেক রুমে নিয়ে যাওয়া হলো গোসল করার জন্য।
কেউ কাউকে ঠিক মতো চিনতে পারছিলাম না। তবে কল থেকে পানি পড়তে দেখে আমাদের মনে কিছুটা প্রশান্তি জাগল। গোসলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজেদের নগ্ন শরীর নিয়ে কেমন অস্বস্থি হচ্ছিল।
কিছুই ছিল না আমাদের সাথে। এমন কি মাথার চুল, শরীরের লোমও ফেলে দিতে হয়েছে।
আবরণহীন দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সাথে যা আছে, তা আমাদের নগ্ন অস্তিত্ব। পূর্বের জীবনের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। আমার কাছে ছিল শুধু চশমা আর বেল্ট। পরে বেল্টও একটু রুটির জন্য বিক্রি করে দিয়েছিলাম।
ছাউনিতে ফিরে এলাম। সেখানে দেখি ট্রাসের মালিকদের আলাদা কদর করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় এক পুরানো বন্দি এলো আমাদের এখানে।
সে আমাদের স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘যারা ট্রাসের সাথে টাকা পয়সা বা মূল্যবান পাথর সেলাই করে রাখবে, ধরা পড়ার সাথে সাথে ওই বিমের সাথে ঝুলিয়ে তাদের ফাঁসি দেবো। নিজের হাতে ফাঁসিতে ঝোলাবো তাদের।’ এই কথা বলতে বলতে হাত দিয়ে উপরের বিম দেখালো।
সে বেশ অহঙ্কার করেই বলল, পুরানো বন্দি হিসেবে এই ক্ষমতা আমার আছে, মনে থাকে যেন।
আমাদের জুতো নিয়েও তার আপত্তি ছিল। যদিও জুতো সাথে রাখার অনুমতি আগেই দেয়া হয়েছিল। যাদের জুতো একটু ভালো বা নতুন ছিল, সেই জুতোগুলো নিয়ে তার বদলে পুরানো, ছোট জুতো ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আদতে যা ঠিক মতো তাদের পায়ে হতো না। এরমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে। কিছু পুরোনো কয়েদিদের বুদ্ধি মতো অনেকেই তাদের নতুন জুতো কেটে সেখানে সাবান লাগিয়ে রেখেছিল। পুরোনো কয়েদিদের বুদ্ধি তখন তাদের খুবই মনে ধরেছিল। কিন্তু ফলাফল হলো এর সম্পূর্ণ উল্টো। এসএস সদস্যরা যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। যারা জুতো কেটে এই কাজ করেছে, তাদের সবাইকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সেই ঘর থেকে ভেসে আসতে থাকে চাবুকের সপাং সপাং শব্দ আর মজলুমদের বুকফাটা চিৎকার। চাবুক বা চিৎকারের শব্দ যেন থামছিলই না।
এভাবে আমাদের ভুল ধারণা, মোহ কেটে গেল।
আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের মনে এক ধরনের স্থূল রসিকতা দেখা দিল। ওই আজব রসিকতা ছাড়াও আরেকটা জিনিস আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখছিল, আর তা হলো- কৌতূহল। আগেও অনেক ধরনের আজব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের কৌতূহলের সম্মুখীন হয়েছি আমি।
একবার পাহাড়ে উঠার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হই। তখন একটা জিনিস অনুভব করতে পারছিলাম আর তা হলো- সেই কৌতূহল। আমি কি আদৌ এটা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় বেঁচে ফিরবো, নাকি কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটার পর, অঙ্গহানি হওয়ার পর ফিরব, তা নিয়ে ভাবনা খেলা করছিল মনে।
অশউইজে থাকার সময়ও এমন একটা কৌতূহল সব সময় মনের
মধ্যে কাজ করতো। যার ফলে ক্যাম্পে থেকেও মন অন্য কোথাও চলে যেতো। কোনো ভাবনায় ডুবে যেত। আমি আলাদা হয়ে পড়তাম ক্যাম্পের পরিবেশ থেকে।
পরবর্তী সময়ে আমি এ বিষয়ে অনেক ভেবেছি।
মূলত একজন কয়েদি এ ধরনের মানসিক অবস্থাটা লালন করত নিজেকে রক্ষা করার জন্য। পরে কী হবে এবং তার ফল কী হবে এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে চিন্তিত হয়ে পড়তাম আমরা। যেমন ঠান্ডা হাওয়া খোলা বাতাস এর মধ্যে পানিতে ভেজা নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা। পরের কয়দিন তা আমাদের কৌতূহলের বিস্ময়ে পরিণত হল, যখন আমাদের কোনো ধরনের সর্দি-কাশি হলো না এত কিছুর পরেও। এক ধরনের বিস্ময় জমা হয়েছিল আমরা যারা মেডিকেলে পড়াশোনা করেছি, তাদের জন্য।
তখন বুঝতে পারলাম, ‘বইয়ের সব কথা সত্য নয়।’
পাঠ্যবইয়ে লেখা ছিল, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ঘুম ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। এটা অনেকাংশেই ভুল। আমি নিজেকে বুঝিয়ে ছিলাম যে, এটা ছাড়া বাঁচবো না, এটা ছাড়া ঘুমাতে পারবো না- এমন মানসিকতা রাখলে ক্যাম্পে টিকে থাকা যাবে না।
সারি সারি সাজানো বিছানাতেই অশউইজের প্রথম রাত কাটিয়েছিলাম আমরা। প্রতিটি সারিতে (এক একটা সারি সাড়ে ছয় থেকে আট ফুট লম্বা ছিল) নয় জন করে বন্দী ঘুমাতাম। কোনো তোষক ছিল না। সরাসরি শক্ত কাঠের বোর্ডের উপরে ঘুমিয়ে ছিলাম আমরা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাত্র দুটো চাদর নয়জনকে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়েছিল। প্রচণ্ড ঠান্ডা। তাই নয়জন প্রায় জড়াজড়ি করেই শুয়েছিলাম। জুতো নিয়ে বাঙ্কে ওঠা নিষিদ্ধ ছিল। তারপরেও অনেকে জুতোকে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কাদামাখা জুতো নিয়েই ঘুমোতে গিয়েছিল। নইলে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমোতে হতো। তারপরেও যে কথাটি বলতে হয়, ঘুমের জন্যই সেই দোজখের আজাব থেকে কয়েক ঘণ্টা মুক্তি পেতাম।
আমরা সেখানে অনেক কিছুই মানিয়ে নিয়েছিলাম। বলা ভালো, মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। দুয়েকটি উদাহরণ দেই— নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার না করা কিংবা কোন ভিটামিন না পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের দাঁতের মাড়ি যেন আগের থেকে আরো ভালো হয়ে উঠেছিলো। একই শার্ট প্রায় ছয় মাস ব্যবহার করেছিলাম যতদিন না তা পরার অযোগ্য হয়ে উঠেছিল; যদিও অনেক দিন ধরে হাত ধোয়ার এতোটুকু সুযোগও ছিল না, তবুও আমাদের হাতে ফোস্কা-ফোঁড়াগুলো পেকে যায়নি। অথবা এমন কোনো বন্দির কথা ধরা যাক, যার হয়তো ঘুম প্রচণ্ড পাতলা- একটু শব্দেই ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু দেখা গেল সে মানুষটিই এখন পাশে থাকা বন্দির নাক ডাকার শব্দ শুনেও নিশ্চিন্তে মড়ার মতো ঘুমাতে পারে।
তখন যদি কেউ এসে জিজ্ঞেস করতো, মানুষ এমন এক প্রাণী, যে কিনা যেকোনো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে- দস্তয়ভস্কির এই উক্তি সত্য কি না?
তাহলে দ্বিধাহীন ভাবেই আমরা উত্তর দিতাম, ‘হ্যাঁ, একজন মানুষ যে কোনো পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তবে আমাদের জিজ্ঞাসা করবেন না, সেটা কিভাবে?’
আমাদের মানসিক অবস্থা তখনো ততদূর পৌঁছায়নি, ওতোটা বুঝদার হয়ে ওঠেনি। তখন আমরা মানসিক দশার প্রথম স্তরে পৌঁছেছিলাম মাত্র। তখনও অসংখ্য যন্ত্রণা- বিভৎসতা, কদর্যতা দেখা বাকি ছিল।
নিদেনপক্ষে একবারের জন্য হলেও আত্মহত্যার কথা সবারই মাথায় এসেছিল। এর পেছনে কাজ করছিল- পরিস্থিতির মুখে অসহায়ত্ব, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আসন্ন মৃত্যুর হাতছানি, আশেপাশের অসংখ্য মৃত্যুপথযাত্রীর করুণ অবস্থা। এসব কিছু দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ‘কাঁটাতারের দিকে’ কখনোই দৌড়ে যাব না। ‘কাঁটাতারের দিকে দৌড়ে যাওয়া’ কথাটি ব্যবহৃত হতো ক্যাম্পে আত্মহত্যার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যমকে বোঝানোর জন্য। কারণ বিদ্যুৎবাহী কাঁটাতারের মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়া মানেই কয়েক মিনিটের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু। অমানুষিক নির্যাতনের পরও আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেইনি। কারণ বন্দি জীবনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও খুব কম ছিল। তাই আত্মহত্যার কোনো মানে ছিল না আমার কাছে। কারণ যেকোনো মুহূর্তে, যেকারো নির্দেশে আমাকে হত্যা করা হতে পারে। তাছাড়া নানান ধরনের বাছাই শেষে যারা বেঁচে যেতো, তাদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব চলে আসতো। গ্যাস চেম্বারের ভয়াবহতার সাথেও তারা অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য আত্মহত্যার দিকে কেউ সাধারণত পা বাড়াতো না।
পরে এক সময় আমার বন্ধুদের সাথে যখন দেখা হয়েছিল, তারা বলেছিল, বন্দি জীবনের প্রথম ধাক্কায় যাদের উপর বিষণ্নতা ভর করেনি, আমি তাদের একজন।
তাদের কথা শুনে আমি শুধু হেসেছি।
মনে পড়েছিল, সেই কসাইশালায় প্রথম রাত কাটানোর পর যে ভোর এসেছিল, সে ভোরের কথা।
আমাদের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল নিজেদের জায়গা বা ব্লক ছেড়ে বের হওয়া যাবে না। তারপরেও আমার এক বন্ধু লুকিয়ে এসেছিল আমাদের রুমে। এসেছিল, আমাকে সান্ত্বনা দিতে। সাহস দিতে।
হাসি, ঠাট্টার ছলেই বলতে লাগলো, “ভয় পেয়ো না। এইসব বাছাই পর্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা করে ঘুম হারাম করার কিছু নেই। ড. ম (তিনি এসএস মেডিকেল বাহিনির প্রধান) এর মনে ডাক্তারদের জন্য কিছুটা সহানুভূতি আছে।’ (এ কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। হয়তো আমার বন্ধু আমাকে সাহস দেবার জন্যই বলেছিল। কারণ ষাট বছর বয়েসী এক ডাক্তার আমাকে বলেছিল, তার ছেলেকে গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর নির্দেশ পরিবর্তন করার জন্য ড. ম-কে অনেক অনুনয়বিনয় সে করেছিল। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। খুব রূঢ়ভাবে তার মুখের উপর না বলে দিয়েছিল। )
‘আর একটা অনুরোধ তোমাকে করি’, সে বলতে লাগলো। ‘প্রতিদিন দাড়ি কামাবে। যেভাবে সম্ভব হয়। প্রয়োজনে এক টুকরো কাচ দিয়ে করতে পারো, যদি তাও সম্ভব না হয়, তোমার খাবার রুটির শেষ টুকরো দিয়ে হলেও দাড়ি কামানোর চেষ্টা করবে। এতে তোমাকে তরুণ দেখাবে। গালে একটা লালচে ভাব থাকবে। মনে রাখবে, সব সময় নিজেকে ফিটফাট রাখার চেষ্টা করবে। নিজেকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও, তাহলে একটাই উপায় আছে। নিজেকে সব সময় কাজের উপযোগী করে প্রমাণ দেখাতে হবে। ধরো, তোমার পায়ে ফোসকা পড়েছে। তুমি এজন্য খুড়িয়ে হাঁটলে। এসএস বাহিনিদের চোখে তোমার এই খুড়িয়ে হাঁটা চোখে পড়লেই তারা তোমাকে এক পাশে সরিয়ে রাখবে। আর পরদিন তোমার গন্তব্য হবে গ্যাসচেম্বারের দিকে। তুমি কি জানো ‘মোসলেম’ বলতে কী বোঝায়? এর অর্থ কী? যে ব্যক্তি দেখতে দুর্দশাগ্রস্ত, অসহায়। শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে দুর্বল। অসুস্থ। কাজকর্ম করতে অক্ষম। সেই হলো মোসলেম। প্রতিটি মোসলেমের পরিণতি কী জানো? জানো, তাদের গন্তব্য কোথায়? তাদের গন্তব্য গ্যাস চেম্বার। তাদের পরিণতি চুল্লির ধুঁয়োর সাথে আকাশে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই পরিণতি থেকে বাদ যাবে না একটি মোসলেম। শোনো আবার বলি, শেভ করবে। সোজা হয়ে স্মার্টলি চলাফেরা করবে। তাহলে তোমাকে গ্যাস চেম্বারের ভয়ে আধমরা হয়ে থাকতে হবে না। এখানে সবার সাথে যখন দাঁড়াবে আমার কথা যদি পালন করতে পারো, তাহলে কোনো ভয় নেই। হয়তো তুমি মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে এসেছো। তাতে ভয় পাবার কিছু নেই।
তারপর আমার দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বলল, ‘খোলাখুলি কথাগুলো বললাম। আশাকরি তুমি কিছু মনে করোনি।’
‘আবারও বলি’ সে বলল। ‘তুমি বা এখানে যারাই আছো, বাছাইপর্বে শুধু মোসলেম টাইপের লোকদেরই চিন্তা করা দরকার। অতএব বন্ধু, কোনো চিন্তা করো না। নিশ্চিন্তে থাকো।’
তার কথা শুনে আমি শুধু হাসলাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই কাজ করতো।
আমার লেসিংয়ের একটি উক্তি মনে পড়ল। সে বলেছিল, ‘যা কিছু হারিয়ে ফেলো সেটা তোমার কারণেই। যা কিছু হারিয়ে ফেলো না, সেটাও তোমার কারণেই।’
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক আচরণ করাই স্বাভাবিক।
এমনকি আমরা মনোবিদরা, পাগলা গারদে আসা অসুস্থব্যক্তিদের আচরণ পরিস্থিতির বিপরীতে অস্বাভাবিক হবে বলে ধরে নেই। তেমনি করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আসা কয়েদিদের যে প্রতিক্রিয়া হবে, তা অস্বাভাবিক; কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই আচরণ স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হবে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো কিছুদিনের মধ্যে পরিবর্তিত হতে লাগল।
কয়েদিরা মানসিক ধাক্কায় প্রথম থেকে দ্বিতীয় স্তরে উন্নীত হলো।
সে-স্তরে মনের আবেগ অনেকটাই কমে যায়। সব কিছুর প্রতিই কেমন একটা অনীহা চলে আসে। আগে বলা প্রতিক্রিয়া ছাড়াও বন্দিদের আরো অনেক কষ্টদায়ক আবেগ দমিয়ে রাখতে হত। অনেকটা যেন আস্তে আস্তে মনের ভেতর মাটিচাপা দেয়ার মতো। প্রথম কারণ, নিজের পরিবার- পরিজনের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে এই অনুভূতি এতই প্রগাঢ় হয়ে উঠত যে, সে এই আশঙ্কায়, আকাঙ্ক্ষায় বুঁদ হয়ে যেত। তারপর ছিল ঘৃণা; আশেপাশের সব নোংরামির প্রতি এমনকি চোখে দেখা সব অত্যাচার- কষ্টের প্রতি এক ধরনের তীব্র ঘৃণা কাজ করতো। বেশিরভাগ বন্দিদের এতো ছেঁড়াফাড়া, ময়লা কাপড় দেয়া হতো যে, তার তুলনায় যেন কোনো কাকতাড়ুয়ার জামাকেও রীতিমতো লাটসাবের পোশাক বলে মনে হবে।
ক্যাম্পের প্রতিটি ছাউনিই ছিল ভীষণ নোংরা। এটা কেউ পরিষ্কার করতে গেলে সে নিজেই নোংরা হয়ে ফিরতো। ক্যাম্পে একটি অলিখিত নিয়ম ছিল- নতুন যারা আসবে, তারা টয়লেট আর নর্দমা পরিষ্কার করবে। সাধারণত যা হয়ে থাকে, যদি নর্দমার নোংরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়ার সময় নোংরাগুলো ছিঁটে মুখে এসে লাগতো কোনো বন্দির, তখন কেউ যদি ওয়াক করতো, মুখ বিকৃত করতো বা মোছার চেষ্টা করতো, তা হলেই সর্বনাশ। কাপোদের মার জুটতো তার কপালে। তাই মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াগুলো সবাই ভুলে থাকতে চেষ্টা করতো।
দেখা গেছে, প্রথম প্রথম যে ব্যক্তি কোনো দলের বন্দিদের শাস্তির প্যারেড দেখলে চোখ সরিয়ে নিতো কষ্টে, যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাবুকের আঘাত খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে থাকা ব্যক্তিদের কষ্ট সহ্য করতে পারতো না- সেও কিছুদিন পর নির্লিপ্তভাবে নির্দোষ বন্দিদের মার খাওয়া দেখতো। এটা তার কাছে অক্সিজেন নেবার মতোই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হতো।
.
একদিন ভোরের কথা বলি।
তখনও অন্ধকার ঠিক মতো কাটেনি। এক কয়েদি প্যারেডের জন্য অপেক্ষা করতে করতে উদাসীন চোখে তাকিয়ে দেখছিল, কীভাবে তার সহচরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছিল এক কাপো এবং উঠিয়ে আবার ধাক্কা দিচ্ছিল। ইচ্ছে মতো লাথি দিচ্ছিল।
এর কারণ কি?
তার এই শাস্তির কারণ ছিল- তার জ্বর হয়েছে। অসময়ে সে ক্যাম্পের হাসপাতালে গিয়ে ছিল। অর্থাৎ সে নিজের কাজের সময় কেন কাজ রেখে হাসপাতালে গেল, এতে সে কাজে ফাঁকি দিয়েছে। এই ফাঁকি দেওয়ার জন্য, নিয়ম না মানার জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
এ ঘটনা দেখেও ওই কয়েদির মনে বিন্দুমাত্র করুণা জাগেনি। মূলত এই পরিবেশে থেকে থেকে পাথর হয়ে গিয়েছিল আবেগ।
যেসব বন্দি মানসিক অবস্থার দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল, তারা তখন আর এইসব দৃশ্য দেখে চোখ সরিয়ে নিত না। এর মধ্যেই তাদের আবেগ-অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল, অবিচলিতভাবে তারা সেটা দেখে যেত।
আরেকটা ঘটনা বলি।
এক কয়েদি হাসপাতালের লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল এই আশায় যে, সে আঘাত বা অঙ্গ ফুলে যাওয়ার কারণে দুই দিনের জন্য পারতপক্ষে কম ভারী কাজ যেন পায়।
একবার বারো বছরের এক ছেলেকে নিয়ে আসা হয়েছিল হাসপাতালে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে বাইরের বরফে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, কাজ শেষ করার জন্য। এ পুরোটা সময় সে খালিপায়ে ছিল কারণ ক্যাম্পে তার পায়ে লাগে এমন জুতা ছিল না। তার পায়ের পাতার আঙুলগুলো ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। কর্তব্যরত ডাক্তার যখন এক এক করে পচতে থাকা কালো আঙুলগুলো চিমটা দিয়ে তুলে ফেলছিল, তখন সেখানে অন্য যেসব কয়েদিরা উপস্থিত ছিল, তারা কোনো মায়া বা ঘৃণা খুঁজে পাচ্ছিল না নিজেদের মনে; তাদের সেই ক্ষমতা আর ছিল না।
রোগে ভুগতে থাকা ক্লিষ্ট মানুষ- মৃতপ্রায় ব্যক্তির যন্ত্রণা আর মৃত্যুর দৃশ্য এত বেশি দেখেছিল যে, তাদের প্রতি করুণা বা সহানুভূতি অনুভব করার মানসিকতা আর ছিল না কারো। এ যন্ত্রণা, কষ্ট যেন কোনো প্রভাবই ফেলত না কারো মনে।
আমি কিছুদিন সাংঘাতিক জ্বরে ভোগা রোগীদের ছাউনিতে কাটিয়েছিলাম। জ্বরে তাদের গা পুড়ে যাচ্ছিল, অনেকেই প্রায় বিকারগ্রস্থ ছিল। বেশিরভাগই ছিল মৃতপ্রায়। একজনের পর একজনকে মারা যেতে দেখেছিলাম, কোনো ধরনের বিকার ছাড়াই।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর, মৃত ব্যক্তির লাশের দিকে এগিয়ে যেত বাকিরা। কেন জানেন? কেউ কেউ তার সেদিনের খাবার ভাবলেশহীন ভাবে পাশ থেকে তুলে নিত। কেউ মৃত ব্যক্তির ভালো জুতোজোড়া নিজেরটার সাথে পাল্টে নিত। কেউ হয়তো তার কোটজোড়া নিয়ে খুশিমনে চলে যেত। মৃত্যুর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাকে আবার নতুন করে সব হারাতে হতো।
আমি উদাস ভাবে এইসব কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একবার এরকম এক জ্বরে ভোগা বন্দির মৃত্যু পর একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল; আমি সেখানকার নার্সকে বলেছিলাম, মৃতদেহটা সরিয়ে ফেলার জন্য।
প্রথমে সে খাট থেকে পা ধরে টেনে তাকে মেঝেতে নামালো। তারপর রোগীদের দু’সারি বিছানার মাঝের সরু, উঁচু-নীচু জায়গা দিয়ে টানতে টানতে দরজার দিকে নিয়ে গিয়েছিল; যা পার হলেই খোলা জায়গা। দরজার সামনে ছয় ইঞ্চির দুটো ধাপ ছিল আর তা পার হওয়া আমাদের জন্যই রীতিমতো শ্রমসাধ্য ছিল যদি না নিজেদের পলকা দেহ দরজার ফ্রেম ধরে টেনে না তুলতাম। কারণ এত মাস ক্যাম্পে থাকার কারণে আমরা পেটভরে খেতে না পারার জন্য সবসময় দুর্বল থাকতাম। সামান্য এ কাজটাও আমাদের কাছে কষ্টসাধ্য বলে মনে হত। লাশ টেনে নেয়া লোকটি দরজার সামনে পৌঁছানোর পর যেন একটু থামল। ক্লান্তভাবে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে মৃতদেহটার পা ধরে টেনে ওঠাতে শুরু করলো। প্রথমে পা, তারপর মাথাটা। একটা অদ্ভুত শব্দ করে মাথাটা প্রতিটা সিঁড়ির ধাপে ঠোক্কর খেতে থাকে। ধপ্পাস ধপ্পাস আওয়াজ হতে থাকে। আমি ছাউনির উল্টো দিকে মেঝের কাছাকাছি জানালার পাশে বসে ছিলাম। আমার ঠান্ডা হাতে ধরা গরম স্যুপের বাটি থেকে লোভীর মতো খেতে খেতে হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ পরেছিলো। যে লাশটাকে সরানো হয়েছিল তার কিছুক্ষণ আগে, সেই নিষ্প্রাণ ঘোলা চোখ দুটি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। দুই ঘণ্টা আগেই এই লোকটির সাথে কথা হয়েছিল আমার; শান্তভাবেই আমি স্যুপে চুমুক দিতে লাগলাম। তখন যদি আমার পেশাদারিত্বের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার আবেগের অনুপস্থিতিকে বিস্মিত না করে থাকতো, তাহলে আমি তা মনে রাখতে পারতাম না; কারণ এখানে কোনো আবেগেরই উপস্থিতি ছিল না।
কয়েদিদের মানসিক অবস্থার দ্বিতীয় ধাপের লক্ষণ হচ্ছে অনীহা, আবেগ শূন্যতা আর সবকিছুর প্রতি অনাগ্রহ দেখানো। এ সবকিছুই একজনকে প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টার অত্যাচারকে সহ্য করার ক্ষমতা সৃষ্টি করে দেয়। এ আবেগহীনতা দিয়ে একজন বন্দি নিজের চারপাশে প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষার আবরণ তৈরি করে নিত। এর ফলে কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতো না। এ পথ অবলম্বন করা ছাড়া নিজের মানসিক স্থিতি রক্ষার কোনো উপায় ছিল না। বন্দীদের মাঝে বেশিরভাগ সময় ছোটখাটো কারণে, এমনকি কোনো কোনো সময় কারণ ছাড়াই মারামারি লেগে যেতো। যেমন: রেশনের রুটি নেয়ার জন্য আমাদেরকে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতে হতো। একবার আমার পেছনের লোকটি একটু এদিকে হেলে দাঁড়িয়েছিল বলে সারিটা একটু বাঁকা হয়ে গিয়েছিল আর এতেই বিরক্ত হয়েছিল দায়িত্বে থাকা এসএস সদস্য। পেছনের লাইনের কী অবস্থা ছিল বা রক্ষীর মনে কী চলছিল তার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। হঠাৎ করেই আমি মাথার পেছনে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক এসএস সদস্য। হাতের লাঠি দিয়েই সে আমার মাথায় দুটো বাড়ি মেরেছিলো। জানারও প্রয়োজন মনে করেনি, আমার কোনো অপরাধ আছে কি না? ওই সময় ব্যথায় যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি অন্যায় আচরণে।
একটা কথা কী, কখনো কখনো গায়ে আঘাত না লাগলেও গায়ে ব্যথা পাওয়ার চেয়ে বেশি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই মুহূর্তে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
প্রচণ্ড তুষার ঝড় হচ্ছে। সেই তুষার ঝড়ের মধ্যেই আমি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলাম। বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। বন্ধ করার কোনো অনুমতি ছিল না। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রেললাইনে এনে নুড়ি পাথর ঢালছিলাম। তীব্র শীত থেকে বাঁচার এই একটি বিকল্প রাস্তাই জানা ছিল তখন আমার। পরিশ্রমের কারণে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এমন সময় জিরিয়ে নেবার জন্য বেলচার উপর ভর দিয়ে একটু দাঁড়াই। কপাল খারাপ। ঠিক তখনই একজন এসএস সদস্যের দৃষ্টি পড়ে আমার উপর। সে ধরেই নেয়, আমি কাজ না করে ফাঁকি দিচ্ছি। তবে সে আমাকে তখন কোনো গালি দেয়নি। শারীরিকভাবে কোনো কঠিন আঘাতও করেনি। হয়তো তার মনে কিছুটা দয়া জেগেছিল। হতে পারে আমার মতো হ্যাংলাপাতলা মানুষটাকে কোনো ধরনের আঘাত করার উপযুক্ত মনে করেনি।
সে যেটা করেছিল, ছোট্ট একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে ঢিল ছুঁড়ে ছিল। মানুষ যেভাবে তাচ্ছিল্য করে ব্যাঙকে, কুকুরকে ঢিল ছোঁড়ে। সেভাবে।
আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল, সামান্য একটি পশুর সাথে আমার কোনো ফারাক নেই। ওই সৈনিকের কাছে আমি সামান্য একটি ইতরবাচক পশু। সে আমাকে কোনো আঘাত করেনি, গালি দেয়নি, শুধু তার ঢিল ছোঁড়া, চোখের চাহনি দেখে আমার এত খারাপ লেগেছিল, এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে, অনেক আঘাত পেয়েও তেমন কষ্ট পাইনি আমি। মারধোরের চেয়ে বেশি ছিল সেই নুড়ি পাথরের ঢিল। তাচ্ছিল্যভরা চোখের চাহনি।
এ রক্ষীবাহিনীদের দেয়া শাস্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক অংশ ছিল- তারা যে অপমান করত, সেটি।