প্ৰথম পৰ্ব
দ্বিতীয় পৰ্ব

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা – ২

আরেকবারের ঘটনা বলি।

আমাদের বিশাল ভারী কড়িকাঠ বহন করে নিয়ে যেতে হয়েছিল বরফ ঢাকা রাস্তার ওপর দিয়ে। যদি একজনও পিছলে পড়তো তাহলে শুধু সে-ই না, একই কড়িকাঠ বহন করা বাকি সবাইকেও পড়তে হতো।

আমার এক বন্ধুর জন্মগত ভাবেই কিছু সমস্যা ছিল। ওর কোমরের হাড় কিছুটা স্থানচ্যূত ছিল। তবুও সে তার কাজ করতে পেরে খুশি ছিল কারণ যারা পঙ্গু ছিল তাদেরকে বাছাই পর্বেই বাদ দেয়া হত। বাছাইয়ের সময়ই তাদের মৃত্যু নির্ধারিত হয়ে যেত।

আমি খেয়াল করলাম যে আমার বন্ধু অনেক ভারী একটা কড়িকাঠ নিয়ে খোড়াচ্ছে এবং এমন একটা অবস্থা হয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে তার সাথের কাঠ বহনকারীদেরকে নিয়ে পড়ে যেতে পারে।

তখন আমার মাথায় কোনো কাঠ ছিল না। তাই কোনো কিছু না ভেবে আমি তাকে সাহায্য করতে দৌড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে আর সাহায্য করতে পারিনি। এসএস সদস্যদের লাথি আর ডাণ্ডার আঘাত এসে পড়তে থাকে আমার শরীরে। সেই সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু হয়। বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে দিতে আমাকে বলা হয়, নিজের জায়গা ফেরত যাওয়ার জন্য।

মজার বিষয় কী জানেন? আমাকে আঘাতকারী সদস্যই একদিন আমাকে বলেছিল, আমাদের মতো শুয়োরদের মধ্যে নাকি বন্ধুত্বসুলভ আচরণের বড়ই অভাব।

বনের মধ্যে ঘটে যাওয়া আরও একটি ঘটনা বলি। সেদিন তাপমাত্রা ছিল মাত্র দুই ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই ঠান্ডার মধ্যে আমাদের দলকে মাটি খুঁড়তে দেয়া হয়েছে। পানির পাইপ বসানো হবে। ঠান্ডায় মাটি জমে ঝামা ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে। তারপরও আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। ওই সময় আমি শারীরিক ভাবে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কাজ করছি, এমন সময় ফোরম্যান এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। চেহারাটা বেশ গোলগাল, গোলাপী রঙের। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, গলার উপরে ওর নিজের মাথার বদলে একটি শুয়োরের মাথা এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজ করতে করতেই খেয়াল করলাম, ওর হাতে এক জোড়া সুন্দর হাতমোজা পরা। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল পশমের হাতমোজা জোড়া বেশ আরামদায়ক হবে। কয়েকবার ওর হাত মোজার দিকে আমার চোখ চলে গেল। সে চুপচাপ বিষয়টি খেয়াল করল। বুঝতে পারলাম, আমার কপালে শনি আছে। যতটুকু মাটি খুঁড়েছিলাম, আমার সামনেই তা স্তুপ করে রাখা ছিল।

এক সময় সে বলে উঠলো, ‘এই শুয়োরের বাচ্চা শুয়োর, তোর কাজকর্ম তো দেখছি আমি। কাজ কী ভাবে করতে হয় আমি তোকে শিখাবো বাঞ্চোত। এখন তুই দাঁত দিয়ে কামড়ে মাটি খুঁড়বি। আমি তোকে কুত্তার মতো মারবো, দেখিস। দুই দিনের মধ্যেই দুনিয়ায় তোর হিসাব শেষ করবো। লাটের ব্যাটা লাট, মনে হচ্ছে জীবনে হাত দিয়ে কোনো কাজ করিসনি? কিরে লাটের ব্যাটা, নবার পুত্তুর, শুয়োর কোথাকার, কী করতি আগে, ব্যবসা?’

আমি তার কথায় কান না দিয়ে পারলাম না। যদিও তা করার দরকার ছিল।

সে আমাকে মৃত্যুর হুমকি দিয়েছিল। চাইলে সে আমাকে হত্যা করতে পারতো। তারপরও কী ভেবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললাম, “আমি একজন ডাক্তার ছিলাম- স্পেশালিস্ট!’

‘কিহ? ডাক্তার? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তুই মানুষের বহুত টাকা নয়ছয় করে মেরেছিস।’

‘তোমার যা খুশি মনে করতে পারো। তবে কথা হলো আমি গরীবদের জন্য তৈরি করা একটি ক্লিনিকে কাজ করতাম। এবং অধিকাংশ সময়ই মানুষের কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নিতাম না। বিনামূল্যে তাদের সেবা দিতাম।’

আমি হয়তো একটু বেশিই বলে ফেলেছিলাম।

সে রাগে ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে আমার উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। সে আমাকে আরও কী কী বলেছিল, এখন আর মনে নেই।

এই ঘটনার কথা এজন্যে বললাম, কিছু কিছু সময় আসে যখন শক্ত মনের বন্দিও অপমানের কারণে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। বিদ্রোহ করে বসে।

আমার মাথায় সেদিন রক্ত উঠে গিয়েছিল। কারণ এমন এক লোক আমার কাজ নিয়ে কথা বলছে, যার এ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণ নেই। স্বাভাবিক অবস্থায় এই পিশাচটাকে আমার নার্স হয়তো হাসপাতালের ওয়েটিং রুমেও ঢুকতে দিত না।

যাই হোক, ভাগ্যক্রমে আমাদের দলের দায়িত্বে থাকা কাপো আমাকে ভালোই পছন্দ করত। অবশ্য তার পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতাম। সে আমাকে তার প্রেম কাহিনী, বৈবাহিক জীবনের সমস্যার কথা বলেছিল। কাজে যাওয়ার সময় লম্বা যাত্রায় সে আমাকে এসব কিছু বলতো। অভিজ্ঞতার সাহায্যে মনোরোগ বিশ্লেষণ করে, তার চরিত্র বিশ্লেষণ করে, তাকে নানা ধরনের উপদেশ দিয়ে তার মন জয় করে ছিলাম। এই কারণে সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল এবং এ সুবিধাটি অনেক কাজে এসেছিল। সকালে এসেম্বেলিতে সে তার পাশে অথবা প্রথম পাঁচ সারির মধ্যে আমার জন্য জায়গা রাখতো। সেখানে প্রায় দুইশ আশি জন দাঁড়াতো। ফলে আমার প্রতি তার এই ফেবার বা টান আমাকে খুব উপকার দিয়েছিল।

ভোর হবার আগেই আধো আলো-অন্ধকারের মধ্যে আমাদের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হতো। পেছনের সারিতে পড়ার ভয়ে কেউই দেরি করার সাহস পেত না। তারা আতঙ্কিত থাকতো কারণ, সিনিয়র কাপোদের যখনই কোনো অপ্রীতিকর বা ঘৃণিত কাজের জন্য লোক লাগতো, সাধারণত পেছনের সারি থেকেই মানুষ নিয়ে যেতো। তাদেরকে কোনো ভীতিপ্রদ কাজের জন্য অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো এবং ভয়ঙ্কর সব সৈন্যদের অধীনে কাজ করতে হতো। অবশ্য মাঝে মাঝে প্রথম পাঁচ সারি থেকে বন্দীদের নির্বাচন করা হতো। কেউ চালাকি করে কি না, তা দেখার জন্য। সব প্রতিবাদ আর অনুনয়বিনয়ের সমাধান ছিল কষে কয়েকটা লাথি মারা। বাছাই করা বন্দিদের চিৎকার করে, মার দিতে দিতে কাজে নেয়া হতো। যতদিন আমার কাপো মন খুলে আমার কাছে কথা বলছিলো, ততদিন আমার এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। তার পাশে সবসময় এক সম্মানের জায়গা ছিল আমার। আরও একটা সুবিধা আমি পেয়েছিলাম। বাকি সব বন্দিদের মত আমার হাত-পা ফুলে গিয়েছিল। এতই ফুলে গিয়েছিল যে, আমি হাঁটুও ভাঁজ করতে পারতাম না। জুতো পরে জুতোর ফিতা আটকাতাম না। মোজা থাকলেও তা পরার জন্য জায়গা থাকত না। পা ফুলে যাওয়ার কারণ আমার জুতোর আংশিক খোলা অংশ বেশিরভাগ সময় ভেজা থাকত। সে জায়গার ওপর সব সময় বরফ জমে থাকত। তাই পায়ে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ঠান্ডায় জমে থাকা পা নিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হত। প্রতিটা কদম ফেলতে যেন জীবনটা বেরিয়ে যেত। বরফে ঢাকা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বরফ দলা হয়ে জমে যেত। বারবার হোঁচট খেয়ে অনেক বন্দি পড়ে যেত। তখন পেছনের সারি তাদের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। ফলে মার্চ করে যাওয়া সবাইকেই কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়তে হতো। তখন দায়িত্বে থাকা কেউ এগিয়ে এসে পড়ে যাওয়া বন্দিদের রাইফেলের বাট দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করতো, যেন তাড়াতাড়ি উঠে আবার হাঁটতে শুরু করে। যত সামনের সারিতে থাকা

,

যেত, তত কম থামতে হতো। ফলে হারানো সময় রক্ষা করার জন্য পায়ে ব্যথা নিয়ে দৌড়াতে হতো না।

মহামান্য কাপোর নিজস্ব ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এবং প্রথম সারিতে থাকতে পেরে আমি তাই বেজায় খুশি ছিলাম।

আমার সেবার বিনিময়ে অতিরিক্ত বেতন হিসেবে সে আরও একটা কাজ করে দিতো। যখন আমাদের কাজের জায়গায় খাবারের আয়োজন করা হতো, আমি এটা জেনে নিশ্চিত থাকতাম যে, আমার স্যুপ নেয়ার পালা আসলে সে পাত্রের নিচ থেকে আলাদা করে মটরশুঁটি ঢেলে দিবে। এমনকি ওই ফোরম্যান, যার সাথে আমার ঝামেলা হয়েছিল, সেও সাহস করে তার কানে কানে বলেছিল, আমাকে অধিক ভালো শ্রমিক হিসেবেই সে জানে। সেটা হয়তো বা কাজে আসেনি কিন্তু তাও সেদিন সে আমার জীবন বাঁচিয়েছিল (অনেকবারের মধ্যে একবার)। ফোরম্যানের সাথে ওই কাহিনী ঘটার পরের দিন সে আমাকে অন্য এক শ্রমিকদলে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

অনেক ফোরম্যান ছিল যারা আমাদেরকে করুণা করত। আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করত যেন আমাদের কষ্ট কম হয়। অন্য কোথাও না হলেও কাজের জায়গায় তা করার চেষ্টা করত। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিতো, একজন সাধারণ শ্রমিক এর চেয়ে কম সময়ে আরও বেশি কাজ করতে পারে। তবে তারা এটা বললেও বুঝতো যে, একজন শ্রমিক মাত্র দশ বা বারো আউন্স ওজনের রুটি (তার চেয়েও কম পেতাম আমরা) আর ১-৪ পেয়ালা পাতলা পানসে স্যুপ খেয়ে থাকে না। তাছাড়া তাদের প্রতিদিন এমন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও কাটাতে হয় না। পরিবার-পরিজন বেঁচে আছে, না কি তাদের মেরে ফেলা হয়েছে?— সে ব্যাপারে সারাদিন, সারাক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় না। প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যুর হুমকি পেতে হয় না তাদের।

আমি একবার এক দয়ালু ফোরম্যানকে বলেছিলাম, ‘আমি যত তাড়াতাড়ি আপনার কাছ থেকে এই কাজগুলো করতে শিখেছি, ততো তাড়াতাড়ি আপনি আমার কাছ থেকে মস্তিষ্কের অপারেশন শিখতে পারেন, তাহলে আপনার জন্য আমার অনেক শ্রদ্ধা জন্মাবে।’ এটা শুনে সে হা হা করে হেসে দিয়েছিল।

মানসিক অবস্থার দ্বিতীয় ধাপের যে উপসর্গ তাহলো ‘অনীহা। আর এটা এক ধরনের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বাস্তবতা থেকে সে আলাদা হয়ে যায়। তার সবকিছু শুধু একটা কাজের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে- নিজের এবং বন্ধুদের জীবন রক্ষার চেষ্টা। বন্দিদের কাজের জায়গা থেকে ক্যাম্পে দল বেঁধে যাওয়ার সময়, সন্ধ্যার অন্ধকারে একটি কথা প্রতিদিনই শোনা যেত, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবাই বলছে, ‘যাক, আরেকটা দিন শেষ হল।

কয়েদিদের বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা, দৈনন্দিন জীবনের প্রচণ্ড মানসিক চাপ তাদের জীবন স্পৃহাকে আদিম প্রবৃত্তিতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল। যেমন করেই হোক, টিকে থাকতে হবে। বাঁচতে হবে।

আমার যেসব সহকর্মী মনোরোগ বিশ্লেষণে আগ্রহী ছিল, তারা আমাকে প্রায়ই ‘রিগ্রেশন’ বা প্রত্যাবৃত্তির কথা বলতো। এর ফলে মানসিক অবস্থার এক আদিম রূপে চলে যেত তারা। স্বপ্নের ভেতর তাদের ইচ্ছা-বাসনা প্রকাশ পেত।

এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, বন্দিরা কী নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখতো? তারা স্বপ্নে দেখতো রুটি, পিঠা, চুরুট আর আরামদায়ক গরম পানিতে গোসল করার দৃশ্য।

সাধারণ এই ইচ্ছেগুলো পূরণ না হওয়ার জন্যেই স্বপ্নের মাঝে দেখা দিত তাদের সুপ্ত বাসনা হিসেবে। এই স্বপ্নের ফলে কোনো লাভ হতো কি না, সেটার কথা আলাদা। তাদের স্বপ্ন ভেঙে গেলেই দেখতে পেতো বন্দি জীবনের সাথে স্বপ্নের বৈপরীত্য।

আমি কখনো সেই রাতের কথা ভুলবো না।

একরাতে আমার সহবন্দির গোঙানির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে দেখলাম, দুঃস্বপ্ন দেখে সে ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে। দুঃস্বপ্ন দেখে প্রলাপবকা মানুষদের জন্য আমার খারাপ লাগত, আমি তাই তাকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখনই আমি তাকে উঠাতে যাচ্ছিলাম, বুঝতে পারলাম, কী একটা ভয়ঙ্কর কাজ করতে যাচ্ছি। মনে হলো দুঃস্বপ্ন যত ভয়ঙ্কর হোক না কেন, তা এই দোজখখানার থেকে বেশি কষ্টকর নয়। অথচ এই নরকেই তাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছিলাম আমি।

কোনো বন্দি পুষ্টিসম্মত খাবার পেতো না তাই তাদের চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণটা জুড়েই থাকতো খাবার। বেশিরভাগ সময় যখন কোনো গার্ড কাছে থাকতো না, তখন আশেপাশে কারাবন্দিরা এক হয়ে খাবারের ব্যাপারে আলোচনা করত। একজন বন্দি পাশে কাজ করতে থাকা বন্দিকে জিজ্ঞেস করত, তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার কোনটা? তখন তারা সে খাবার রান্নার রেসিপি একে অন্যকে দিত। আর কল্পনা করতো, অদূর ভবিষ্যতে তারা মুক্তি পেলে কীভাবে আনন্দ উৎসব করবে, তাদের খাবারের তালিকায় কী কী থাকবে, তা ঠিক করতো। তারা এসব বলতে থাকতো যতক্ষণ না কেউ ইশারা, ইঙ্গিতে বা কথায় বলতো, “চুপ, গার্ড আসছে।’

খাবার দাবাড় নিয়ে এরকম মুখরোচক আলোচনাকে আমার কাছে বিপদজনক মনে হতো। এতো অল্পপরিমাণ খাবার খেয়ে এরকম সুস্বাদু খাবারের কল্পনা করা ভুল নয় কি? হয়তো এতে সাময়িক তৃপ্তি আসতে পারে কিন্তু এতে যে মানসিক বিভ্রম তৈরি হবে, তার ফলাফল ভয়ঙ্কর।

বন্দিজীবনের শেষ দিকে আমরা খাবার হিসেবে পেতাম ছোট এক টুকরো রুটি, পানির মতো পাতলা এক পেয়ালা স্যুপ। খাবার হিসেবে যা খুবই সামান্য। তাছাড়া দেয়াও হতো দিনে মাত্র একবার। এর সাথে অতিরিক্ত ভাতা হিসেবে পাওয়া যেত অল্প একটু মাখন, বাজে মানের পনির বা মধু কিংবা এক চামচ পানির মতো ঢলঢলে জ্যাম। এগুলো শুধু নামমাত্র পেতাম। তাও প্রতিদিন সব দেয়া হতো তা না। একেকদিন একেকটা দেয়া হতো।

তীব্র শীতের মধ্যে ফিনফিনে পাতলা কাপড় পরে হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই খাবার ছিল খুবই সামান্য আমাদের জন্য। পেটের এক কোণাও ভরতো না এতে।

যে সব ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ‘বিশেষ সেবা’র অধীনে থাকতো, তাদের অবস্থা ছিল আরও তথৈবচ।

আমাদের চামড়ার নিচে মেদের লেশমাত্র ছিল না। আস্তে আস্তে ত্বকের নীচে থাকা সব মেদ তখন মিলিয়ে গিয়েছিল।

আমাদের ছেঁড়া কাপড় পরা, চামড়ায় ঢাকা কঙ্কাল ছাড়া কিছুই মনে হতো না। আমরা আমাদের দেহের ভেঙে পড়া দেখতে লাগলাম। দেহের সকল মাংস ভেঙে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শরীর থেকে সব মাংস উধাও হয়ে যাচ্ছিল। শরীরের নিজে নিজে ক্ষয়পূরণে ক্ষমতা একেবরাহে শেষ হয়ে গিয়েছিল। একের পর এক আমাদের ছাউনির সব বন্দিরা মরতে লাগল। আমরা যেন বুঝে গিয়েছিলাম, কার পর কে মারা যাবে। অনেক দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করার ফলে লক্ষণ গুলো ধরতে পেরেছিলাম। তাই ভবিষ্যৎ বাণীগুলো প্রায়ই ফলে যেত।

একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে বলতাম, ‘ও বেশিদিন বাঁচবে না’ বা ‘এবার ওর পালা। কিছুদিনের মধ্যেই পটল তুলবে।’

প্রতিদিন নিজের নগ্ন শরীর সন্ধ্যার আলোছায়ায় দেখে ভাবতাম, ‘এই শরীরটা আমার! এই সেই শরীর? ইতিমধ্যে মরার মতই হয়ে গিয়েছে… কী থেকে কী হয়ে গেছি?’

তবে আমি ছিলাম অনেক অনেক মানব দেহের মাঝে একজন মাত্র। অল্পসংখ্যক মাটির ঘরে গাদাগাদি করা, ক্যাম্পের কাঁটাতারের পেছনে শত শত মানবদেহের মাঝে একজন আমি। যার মধ্যে অনেক দেহই পচে গিয়েছিল, পচতে থাকা আত্মাছাড়া দেহের কাঠামো ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

আগেই বলেছি, একটু অবসর পেলেই মনের মধ্যে রাজ্যের খাবারের কথা এসে ঢুকতো। ঘুরঘুর করতো। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্ত মনের মানুষটাও ভালো খাবারের জন্য অপেক্ষা করতো। এমন নয় ভালো ভালো খাবার খেয়ে সে শরীরকে মোটা তাজা করে তুলবে এজন্য ভালো খাবারের প্রত্যাশা করতো, ভালো খাবারের প্রত্যাশা বা ভাবনা যা-ই বলি না কেন? আদিম প্রবৃত্তির বশেই ঘুরে ফিরে মাথায় আসতো। নিজের অস্ত্বিতকে টিকিয়ে রাখার জন্যই খাবারের চিন্তা মাথায় আসতো।

দিনের পর দিন ক্রমাগত খাবারের চিন্তা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। একজন না খাওয়া, ক্ষুধার্ত মানুষের মনে যে তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব চলে, ইচ্ছাশক্তির যে বিরোধ চলে তা কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যারা এর মধ্য দিয়ে যায়নি, তাদের পক্ষে তো নয়ই।

পরিখায় দাঁড়িয়ে পরিখা কী, আমরা বুঝতাম না। আমরা শুধু বুঝতাম, কখন খাবারের সময় হবে। কখন রুটি দেবার জন্য ঘণ্টা বাজানো হবে। কখন ঘড়িতে সাড়ে নয়টা, দশটা বাজবে। আমাদের সাথে যদি কোনো ভালো ফোরম্যান পড়তো, তাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম, কয়টা বাজে। আর কত দেরী?

কখনো কখনো কোটের পকেটে রাখা রুটির টুকরোতে গভীর মমতায় হাত বুলাতাম। আমাদের হাতমোজা ছিল না। ঠান্ডায় আঙুল জমে যেত। সেই জমে যাওয়া আঙুল দিয়ে রুটির টুকরো আলতো করে স্পর্শ করতাম। এমন ভাবে ছিঁড়তাম যেন রুটিও কষ্ট না পায়। হয়তো এক টুকরো রুটি মুখে পুরে মনের বিরুদ্ধে জেহাদ করে বাকি রুটিটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতাম বিকেলে খাবার জন্য। পেটের মধ্যে ক্ষুধার আগুন দাউদাউ করে জ্বলতো।

বন্দিজীবনের শেষ দিকে এসে এই সামান্য রুটিই কীভাবে খাওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা বিতর্ক করতাম।

আমাদের মধ্যে দুই ধরনের লোক ছিল। এক ধরনের লোক হলো যারা রুটি পাওয়ার পরপরই সবটা খেয়ে ফেলতো। তাদের যুক্তি দিনের একটা সময় কিছুটা হলেও তো ক্ষুধার কষ্ট কিছুটা কমলো! তাছাড়া রুটি চুরিরও কোনো ভয় থাকলো না।

আরেক দল রুটি ভাগ করে রাখতো পুরো দিনের জন্য। সম্পূর্ণটা খেতো না। আমি ছিলাম এই দলে।

দিনের মধ্যে সবচেয়ে কষ্টের কাজ ছিল সকালে ঘুম থেকে ওঠা।

অন্ধকার থাকতেই বাঁশি বেজে উঠতো। বাঁশির তীক্ষ্ম সুর আমাদের ঘুম এবং স্বপ্নের দুনিয়া থেকে নিষ্ঠুর ভাবে কান ধরে বাস্তবজগতে নিয়ে আসতো।

তারপর শুরু হতো জুতো পরার হ্যাপা। ভেজাজুতো নিয়ে আমরা টানাটানি করতে লেগে পড়তাম। ব্যথায় ফুলে উঠা পা দিয়ে জুতো কিছুতেই ঢুকতে চাইতো না। ছোটখাটো বিষয় নিয়েও অনেকে অনেক সময় অস্থির হয়ে পড়তো। ব্যাকুল হয়ে যেতো।

একদিন সকালে এমন একজন লোককে কাঁদতে দেখলাম যাকে আমি বেশ শক্ত মনের মানুষ বলেই জানতাম। তিনি বেশ গম্ভীরও ছিলেন। তো দেখি একদিন তিনি কাঁদছেন। কারণ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পা ফুলে যাবার কারণে জুতো জোড়া পায়ে হচ্ছে না। এখন তাকে খালি পায়ে কাজে যেতে হবে। এ কষ্ট তিনি দমিয়ে রাখতে পারেননি। তখন তার কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেনি। কারণ আমি তখন রুটি চাবানোর আনন্দে বিভোর ছিলাম।

ক্ষুধা, অপুষ্টি, খাবারের চিন্তা আমাদের মাথায় এমন ভাবে ঝেঁকে বসে ছিল যে যৌন আবেগের জায়গাই ছিল না আমাদের জীবনে। খাবার ছাড়া আর সব চাহিদাই মরে গিয়েছিল। প্রথম ধাপে মানসিক ধাক্কা খাওয়া ছাড়া আর যে বিষয়টি মনোবিজ্ঞানীদের নজরে পড়বে, যৌনবিকৃতি থাকেই না বললে চলে।

একজন বন্দির জীবনে যৌনতার কোনো জায়গা ছিল না। এমনকি তার স্বপ্নেও যেন এর কোনো ঠাঁই ছিল না। বরং তার হতাশা আর বিক্ষুব্ধ ভাবনায় এসব বিষয় কিছুটা প্রকাশ পেত। বেশিরভাগ বন্দির ক্ষেত্রেই জীবন বাঁচানো ছাড়া কোনো চিন্তা ছিল না। তার সব ধ্যান ধারণাই ছিল কীভাবে বেঁচে থাকবে হবে, এই ভাবনাকে ঘিরে। বাকি সব প্রয়োজনের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা কাজ করতো। বেঁচে থাকার এই আদিম প্রবৃত্তির উপস্থিতি অন্যসব আবেগ, অনুভূতি মুছে ফেলার জন্য দায়ী।

অশউইজ ক্যাম্প থেকে আমাকে যখন দাচাও ক্যাম্পে বদলি করে নেয়া হয়েছিলো, তখনই আমি বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলাম। মধ্যরাতে প্রায় দু’হাজার বন্দি বহনকারী ট্রেনটি দিয়ে ভিয়েনা রেলস্টেশন থেকে যাত্রা করছিলাম আমরা। এই লাইনটা আমার জন্ম যে রাস্তায়, যে বাড়িতে আমি বন্দি হবার আগপর্যন্ত কাটিয়েছিল, তার পাশ দিয়েই যাবে বলে জানতাম। আমাদের বগিতে দুটো ছোট জানালার মতো ছিল। ছোট কম্পাউন্ডে আমরা এত লোক ছিলাম যে, মেঝেতে শুধু একদলের হাঁটু গেড়ে বসার জায়গা ছিল, অন্য দলকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। তারাই ওই দুটো জানালার আশেপাশে জড়ো হয়েছিল। জানালার কবাটের ফাঁক দিয়ে অন্যদের মাথার উপর দিয়ে সেই পরিচিত শহরের এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলাম। যদিও বাইরের সব কিছু তখন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের হাতে আর মাত্র এক বা দুই সপ্তাহ আছে। কারণ আর কিছুই নয়। আমাদেরকে মাথাউসেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমার ছোটবেলার সেই শহরের বাড়ি, অলিগলি সবকিছু আমি যেন এক মৃতপ্রায় ব্যক্তির চোখ দিয়ে দেখছিলাম, যে কিনা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে এবং এক নিশ্চল, প্রাণহীন শহরের সম্মুখীন হয়েছে।

কয়েক ঘণ্টা দেরি করেই ট্রেনটি স্টেশন ছেড়েছিল। তখনই দেখতে পেয়েছিলাম- আমার বাড়ির রাস্তা। যেসব তরুণেরা ছিল ওখানে, তাদের হাতে হয়তো আরো কয়েক বছর ছিল। আমি তাদেরকে অনেক অনুনয়বিনয় করেছিলাম যেন আমাকে এক মুহূর্তের জন্য জানালার সামনে দাঁড়াতে দেওয়া হয়। আমি তাদেরকে বোঝাতে চাইছিলাম যে, জানালা দিয়ে শেষবারের মতো আমার পরিচিত জন্মভূমিটি দেখতে চাই।

তারা আমার অনুরোধের প্রত্যুত্তরে খুব নিষ্ঠুর ভাবে বলেছিল, ‘এত বছর এখানে ছিলেন না আপনি? তাহলে তো যথেষ্ট দেখা হয়েছে আপনার। আর কী দেখতে চান?’

ক্যাম্পের মধ্যে একটা কালচারার হাইবারনেশন ছিল। তবে মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল দুটি বিষয়ে- রাজনীতি এবং ধর্ম। রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা বলতে গেলে সব সময় হতো আর এগুলোর ভিত্তি ছিল উড়ো খবর যা কিনা রংচং মেখে সবার কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। মিলিটারিদের সম্পর্কে বিভিন্ন উদ্ভট উদ্ভট খবর আসতো। একের পর এক যেসব খবর আসতো, তা বন্দিদের মনের কৌতূহল, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে তুলতো। অনেকেই জীবন সম্পর্কে সব ধরনের আশা হারিয়ে ফেলেছিল। তবে আবার বেশি আশাবাদী যারা, অতি-উৎসাহী, তাদের আচরণও ছিল খুবই বিরক্তিকর।

ধর্মের প্রতি বন্দিদের যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, তা ছিল পুরোপুরো নির্ভেজাল। সেখানে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। ক্যাম্পে যারা নতুন আসতো, পুরোনোদের মধ্যে ধর্মের প্রতি এই আন্তরিক বিশ্বাস তাদের মাঝে বিস্ময় সৃষ্টি করতো। কাজ থেকে ফিরে আসার সময় গবাদি পশু বহন করার ট্রাকের পেছনে বসেই ক্ষুধার্ত অবস্থায় ছেঁড়াকাপড়েই প্রার্থনা করতে বসে পড়তাম। কিংবা অন্ধকার ছাউনির ঠান্ডা মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে সবাই একসাথে প্রার্থনা করতাম।

১৯৪৫ সালে শীত এবং বসন্তকালে বন্দিদের মাঝে টাইফাস’ নামক রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। যেসব দুর্বল রোগীদের কাজ না করে উপায় ছিল না, মৃত্যুর সংখ্যা তাদের মাঝেই ছিল বেশি। রোগীদের জন্য ওষুধপথ্য কিছু ঠিক মতো ছিল না। যা ছিল তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। রোগীদের মাঝে কিছু লক্ষণ দেখা যেত, যার মধ্যে দুয়েকটি ছিল খুবই ভয়াবহ। খাবারের প্রতি তীব্র অনীহা জন্মাতো রোগীদের। জ্বরের ঘোরে অনেকেই প্রলাপ বকতো। এ প্রলাপ বকার সবচেয়ে করুণ অবস্থা দেখেছিলাম আমার এক বন্ধুর মাঝে। জ্বরের ঘোরে তার মনে হচ্ছিল সে মারা যাচ্ছে। তাই জীবনে শেষবারের মতো প্রার্থনা করতে চাচ্ছিল। এতটাই ঘোরে চলে গিয়েছিল, কী বলবো, ঠিকমতো বুঝতে পারছিল না কিছু। এমনকি শব্দগুলোও ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারছিল না। এ ধরনের ঘোর যেন তৈরি না হয়, প্রলাপ যেন বকতে না হয় এজন্য সারা রাত জেগে থাকার চেষ্টা করতাম। আমার মতো অনেকেই জেগে থাকার চেষ্টা করতো। সময় কাটানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতার কথা চিন্তা করতাম। মাথার মধ্যে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বক্তৃতা তৈরি করতাম। অশউইজে বইয়ের যে খসড়া হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা আবার পুনরায় লেখার চেষ্টা করলাম। বইয়ের মূল বিষয়গুলো যখন যা মনে আসতো কাগজের ছোট ছোট টুকরোতে তা লিখে রাখতাম। এভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম তখন।

কখনো কখনো বৈজ্ঞানিক আলোচনা শুরু হতো ক্যাম্পে। এইসব বৈজ্ঞানিক আলোচনায় এমন কিছু বিষয় ঘটতো যা আমি কখনো দেখিনি। যদিও আমার পেশার সাথে বিজ্ঞানের যোগসূত্র ছিল। তারপরও আত্মা নামানোর সাথে বিজ্ঞানের কী যোগ আছে আমি বুঝতে পারিনি। একবার তেমনই এক সভায় ক্যাম্পের চিফ ডাক্তার আমাকে ডাকলেন। যদিও তিনি আমার মতোই বন্দি। তিনি জানতেন আমি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

অসুস্থ রোগীদের কোয়ার্টারের ছোট্ট এক রুমে এ সভার আয়োজন করা হয়। বেশি লোক ছিল না সেখানে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল অবৈধ স্যানিট্যাশন স্কোয়াডের ওয়ারেন্ট অফিসাররা।

সভা শুরু হবার পর এক ব্যক্তি নানান কায়দা কানুন করে আত্মাকে আহ্বান করতে লাগল। ক্যাম্পের যে কেরাণি, সে কোনো কারণ ছাড়াই একটি সাদা কাগজ সামনে নিয়ে বসে ছিল। পরবর্তী দশ মিনিট ধরে সে কাগজে কিছু একটা লিখলো। নিতান্তই অনিচ্ছার সাথে তার পেন্সিল কাগজের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার লেখা শেষ হলে কাগজের লেখা দেখলাম। কোনোমতো পড়া যায়, এমন ভাবে লেখা আছে “VAE V.” পরে শুনে অবাক হয়েছিলাম যে, এই কেরাণি একটুও ল্যাটিন ভাষা শিখেনি। ল্যাটিনের ‘ল’ও সে জানে না। তাছাড়া সেখানে লেখা ‘পরাজিতের জয় হোক’ এ কথাটিও সে আগে শোনেনি। এরপর পরই আমাদের আড্ডা ভেঙে যায়। কারণ মিডিয়ামের উপর আর আত্মা ভর করেনি। যাক, আগের কথায় ফিরে আসি, যুদ্ধ শেষ হবার কয়েক মাস আগে সে যে ল্যাটিন না জেনেও একটি ল্যাটিন বাক্য লিখলো, আমার মতে এই শব্দটা তার আত্মায় (অবচেতন মনের মধ্যে ছিল) চলে এসেছিল।

ক্যাম্পের এই শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের কারণে মানুষ আধ্যাত্মিক বিষয়আশয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সেখানে যারা বুদ্ধিজীবী ছিল, তাদের শারীরিক কষ্ট একটু বেশিই পোহাতে হয়েছিল। কারণ তারা শারীরিক পরিশ্রমে একদমই অভ্যস্ত ছিল না। তবে তারা মানসিক ভাবে দৃঢ় ছিল। ভেঙে পড়েনি। তাছাড়া শক্তসমর্থ লোকের চেয়ে সংবেদশীল মানুষ সহজে ক্যাম্পের জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল।

এক্ষেত্রে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। সকালবেলা মার্চ করতে করতে যখন কাজে যেতাম, কী হতো একটু বলি।

চিৎকার করে একজন কমান্ড করতো, ‘ডাটাচমেন্ট, আগে বাড়ো। লেফট টু-থ্রি-ফোর, লেফট টু-থ্রি-ফোর। বায়ে যাও, বায়ে বায়ে বায়ে যাও।’

শব্দগুলো এখনো আমার কানে বাজছে। আমরা যখন ক্যাম্পের গেট অতিক্রম করতাম, তখন বলতো ‘ক্যাপস অফ’। আমাদের উপর সার্চ লাইটের আলো ঘুরতো। যে ঠিক মতো মার্চ করতে পারতো না, তার বরাতে জুটতো বুট জুতোর লাথি। তাছাড়া শীতের কারণে যারা বলার আগেই ক্যাপ পরে ফেলতো তাদের আরও দুরবস্থা হতো।

ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসা রাস্তা দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে জলকাদা ডিঙ্গিয়ে, বড় বড় পাথরের সাথে উস্টা খেতে খেতে আমরা এগিয়ে যেতাম। আমাদের সাথে থাকা গার্ডেরা ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতো আর রাইফেলে বাট দিয়ে দ্রিম দ্রাম করে আমাদের সজোরে আঘাত করতো।

এসব হজম করেই যাদের পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল, তারা পাশের জনের উপর ভর দিয়ে হাঁটতো। ঠান্ডা বাতাসের কারণে আমাদের কথা বলার সুযোগ ছিল না একদমই। শীতে জমে যেতাম আমরা। আমার পাশে হাঁটতে থাকা এক বন্দি কী ভেবে যেন একবার বলেছিল, “আমাদের স্ত্রীরা যদি আমাদেরকে এখন দেখতে পেত! আশা করি তারা তাদের ক্যাম্পে ভালই আছে। কে জানে, আমাদের কোনো খবর তারা জানে কী না?’

তার কথা শুনে আমার নিজের সহধর্মিনীর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে, বরফের উপর কত বার যে আমরা হোঁচট খেয়ে পড়েছি, তার লেখাজোখা নেই। একে পড়ে গেলে অন্যরা তাকে টেনে তুলতাম। কিন্তু কোনো কথা হতো না। এভাবে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আমরা হেঁটে যেতাম। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকাতাম। আকাশের তারাগুলো একে একে মিলিয়ে যাচ্ছিল। কালো মেঘের পিছন দিয়ে সূর্য গোলাপি আভা ছড়িয়ে যাচ্ছিল পুরো আকাশে। একটি নতুন দিনের শুরু।

সেদিন বারবার আমার স্ত্রীর কথা মনে পড়ছিল। তার চেহারাটা ভেসে উঠছিল চোখের পর্দায়। অদ্ভুতভাবে আমি তার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম। সত্যি কিনা জানি না, তবে আমার মনে তার চেহারা সদ্য ওঠা সূর্যের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছিল।

বুঝতে পারলাম, যুগ যুগ ধরে কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় কেন ভালোবাসার বন্দনা করে আসছে? জীবনের এই চিরন্তন সত্য সেদিনই আমার কাছে প্রথম মূর্ত হয়ে উঠলো। ভালোবাসার মধ্যেই মানুষের মুক্তি। ভালেবেসে এবং ভালোবাসার মাঝেই মানুষের পরিত্রাণ। নিদারুণ দুঃসময়েও মানুষ একটু সুখ পেতে পারে তার ভালোবাসার মানুষের কথা ভেবে। হোক না সেটা খুব অল্পসময়ের জন্য। যখন একজন মানুষের কোনো আশা থাকে না। সবকিছুই তার বিরুদ্ধে চলে যায়। যখন সে একা হয়ে পড়ে। চরম নিঃসঙ্গতায় ভোগে, যখন কষ্ট স্বীকার করা ছাড়া তার অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না, তখন প্রিয়জনের কথা ভেবে সে বাঁচার প্রেরণা পেতে পারে। প্রিয়জনের ছবি মনে এনে, কল্পনা করে সুখ পেতে পারে। ভুলে যেতে পারে তার চারপাশের সব ঘটনা। ভালোবাসার জন্যই মানুষ সব কিছু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারে। ভালোবাসা তার মনে এনে দিতে পারে অসীম শক্তি। জাগিয়ে তুলতে পারে অসীম সম্ভাবনা। জীবনে প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছিলাম ‘ফেরেশতারা অসীম শক্তিকে ভালোবেসে নিজেকে বিলীন করে দেয়’ এই কথার মানে।

আমার সামনে এক বন্দি হঠাৎ করে পড়ে গিয়েছিল। সে পড়ে যেতেই তার পেছনে হাঁটতে থাকা অনেকে এসেই তার ওপর হোঁচট খেয়ে পড়েছিল। গার্ড কোত্থেকে চিলের মতো উড়ে এসে সপাৎ সপাৎ করে চাবুক মারতে লাগলো। এই ঘটনা দেখে কিছুক্ষণের জন্য আমার চিন্তা বাধা পড়ে। তবে সেটা কিছুক্ষণের জন্য মাত্র। আমি আবার আমার কল্পনার জগতে হারিয়ে যাই। ভুলে যাই, আমি এক বন্দি। আমি তাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। সে উত্তর দিচ্ছিল। আবার সে আমাকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করছিল, আমি ভালোবেসে তার কথা উত্তর দিচ্ছিলাম।

‘দাঁড়াও!” কাজের জায়গায় এসে পৌঁছুতেই বাঁজখাই কণ্ঠে হুকুম

এলো। সবাই তড়িঘড়ি করে অন্ধকার রুমের দিকে ছুটে গেলো ভালো যন্ত্রপাতি নেয়ার জন্য। সবাই যার যার সুবিধা মতো কোদাল, কুড়াল নিয়ে এলো।

‘এই শুয়োর, শরীরে কি চর্বি জমেছে নাকি? তাড়াতাড়ি করতে পারিস না?’

এ চিৎকার শুনে আমি তাড়াতাড়ি যেখানে কাজ করছিলাম, সেখানে নেমে পড়লাম।

আমার কোদালের আঘাতে জমে যাওয়া মাটি উঠে আসতে লাগল। আগুনের ফুলকি ছুটতে লাগলো।

মানুষ চুপ থাকলেও তার মস্তিষ্ক সবসময় সচল থাকে। কিছু না কিছু করতেই থাকে।

আমার মন জুড়ে তখনো আমার স্ত্রীর ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। কাজ করতে করতেও আমি বুঁদ হয়েছিলাম আমার স্ত্রীর চিন্তায়। হঠাৎ করেই একটি চিন্তা আমার মাথায় বিদুৎত্তের মতো খেলে গেল।

‘আচ্ছা, আমার স্ত্রী বেঁচে আছে তো?’

তবে আমি একটা জিনিস তখন বুঝতে পেরেছিলাম, বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম, ভালোবাসার মাঝে দূরত্ব কোনো বাধা নয়। শারীরিক ভাবে মানুষটি যেখানেই থাকুন না কেন, এতে ভালোবাসা কমে না। বরং বেড়ে যায় কখনো কখনো। আর এটাই প্রকৃত ভালোবাসা। নিজের আত্মা, অস্তিত্বের মাঝে অন্যকে উপলব্ধি করার নামই ভালোবাসা। সে কোথায় আছে? কেমন আছে? বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে, ভালোবাসার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃত প্রেমিকের কাছে এসবের কোনো মূল্যই নেই। ওই মুহূর্তে আমার কাছেও ছিল না। স্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানোর, তার খবর নেয়ার কোনো উপায় ছিল না আমার কাছে। তবে তখন এমন একটা মানসিক অবস্থা হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, কোথায় আছো, কীভাবে আছো এসব জেনে কী লাভ, ভালোবাসি তোমাকে এটাই আমার কাছে বড় সত্য। আর কিছু নয়।’

তখন যদি জানতাম, সে মারা গেছে, তাতেও আমি এক বিন্দু বিচলিত হতাম না। কারণ মনে হচ্ছিল সে আমার সাথেই আছে। তার সাথে কাল্পনিক কথপোকথন আমার কাছে ছিল বাস্তবের চেয়ে বাস্তব। মনের মধ্যে আমার একটি গানের সুর বারবার বেজে উঠছিল, ‘ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ, তোমার মনের মন্দিরে। কেননা ‘ভালোবাসা মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী।’

বন্দি জীবনের একাকীত্ব, শূন্যতা, হাহাকার থেকে মুক্তি পেতে অতীত জীবনের সুখের স্মৃতিতে ডুব দেয়ার মতো এমন ওষুধ আর নেই।

যখন মন একটু ফুসরৎ পেতো, চলে যেতো অতীতের কোনো দিনে। ছোট ছোট ঘটনাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতো। ছোট ছোট বিষয়ও অনেক বড় হয়ে, মহান হয়ে দেখা দিত তখন। মনে হতো অনেক আগে, প্রায় ভুলতে বসা ঘটনার মায়া এখনো রয়ে গেছে।

নিজে নিজে আমি মাইন্ড গেইম খেলতাম। কল্পনা করতাম, আমি বাসে উঠেছি। এপার্টমেন্টের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবি দিয়ে তালা খুলছি। টেলিফোনে কথা বলছি। শিশিরের শব্দের মতোন সন্ধ্যা নেমে এলে, ঘরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দিতাম একে একে। ঘুরে ঘুরে এ স্মৃতিগুলো মনে জাগতো। ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো বারবার বাজতো। নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসতো। চাইলেও আটকে রাখতে পারতাম না।

যত দিন যাচ্ছিল, বন্দিজীবনের সাথে লোকজন যতই অভ্যস্থ হয়ে পড়ছিল, ততই সে আশেপাশের সৌন্দর্যের দিকে নজর দিতে লাগল। সচেতন ভাবে উপভোগ করতে লাগলো আশেপাশের সৌন্দর্যকে। আশেপাশের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যেত যে, ক্যাম্পের ভয়াবহতাকেও ভুলে যেতে পারতো।

আমরা যখন অশউইজ থেকে ট্রেনে করে বাভারিয়ান ক্যাম্পে যাত্রা করেছি, তখন শেষ বিকেল। অস্তগামী সূর্যের সোনারং রোদ এসে পড়েছে দূরের পাহাড়ের চূড়ায়। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন সোনা দিয়ে সালজবার্গ পাহাড়ের চূড়াগুলো বাঁধিয়ে দিয়েছে।

ট্রেনের জানালা দিয়ে আমরা অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছি, প্রকৃতির এই অপার্থিব সৌন্দর্য। কেউ যদি তখন আমাদের মুখ দেখতো, চিন্তাও করতে পারতো না আমরা কতটা জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। কতটা সঙ্গীন আমাদের অবস্থা, কতটা করুণ। তার কাছে মনে হতো, আমাদের মতো সুখী, দুশ্চিন্তাহীন মানুষ আর এই দুনিয়ায় নেই। মূলত জীবনের এই সংকটকে ভুলে থাকার জন্যই আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্যের দিকে তাকাতাম।

এমনও হয়েছে, কাজ করার সময় আমরা একজন অন্যজনকে সূর্যাস্তে অপরূপ সৌন্দয দেখার জন্য ডাক দিতাম।

বেভারিয়ান জঙ্গলের ওপর দিয়ে দেখা যেত অসম্ভব সুন্দর সে দৃশ্য। একদিন আমরা সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছি। হাতে স্যুপের বাটি। এমন সময় একজন বন্দি দৌড়ে আসলো আমাদের মাঠে ডেকে নিয়ে যাবার জন্য। সূর্যাস্ত দেখাবে।

বাইরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে আলোকিত অদ্ভুত মেঘ দেখতাম। পুরো আকাশ জুড়ে ছিল রঙের খেলা। সূর্যের আলো গিয়ে পড়ছিল মেঘের উপর। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল মেঘের রং। আমাদের ছাইরঙা মাটির ঘরগুলোকে বড্ড বেমানান লাগছিল সেই রঙিন আকাশের পটভূমিতে। মাঠে জমে থাকা পানিতে রঙগুলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, মাঠের পানিতে কেউ রং মিশিয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপ করে আকাশ দেখার পর নিঃশব্দতা ভেঙে একজন আরেকজনকে বলতাম, ‘পৃথিবীটা সুন্দর, তাই না?’

.

আরেকদিনের ঘটনা।

আমরা পরিখায় কাজ করছিলাম। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কেমন কিশোরী নববধূর মতো সুন্দর হয়ে উঠেছিল পৃথিবী। মাটিতে জমে থাকা বরফ, ছেঁড়া কাপড় পরা বন্দিদের এমনকি আমাদের চেহারাও বড্ড বেমানান লাগছিল তখন। আমি মনে মনে আমার স্ত্রীর কথা ভাবছিলাম। তার সাথে কল্পনায় কথা বলছিলাম। হয়তোবা আমি আমার কষ্ট, আসন্ন মৃত্যুর কারণ বুঝতে চাচ্ছিলাম। মৃত্যুর কথা মনে হতেই কোত্থেকে এক রাশ শক্তি এসে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মনে হলো হতাশা, বিষণ্নতাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। এর লক্ষ্য আরও বিশাল, আরও মহান। মন থেকে উত্তর এলো, হ্যাঁ। আমরা দেখতে লাগলাম, সূর্য আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। পাহাড়ের চূড়া ডিঙিয়ে আলো এসে পড়ছে দূরের কৃষকদের ঘরের উপর। মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে অসংখ্য আলোর রিবন নেমে এসেছে। “Et lux in tenebris lucet”- এবং জ্বলতে থাকা আলো আঁধারের মাঝে অপার্থিব লাগছিল সেই ছবি। কৃষকদের গ্রামের সাথে সাথে আমার মনটা কেউ যেন আলোকিত করে তুলছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি মাটি কাটছিলাম সেদিন। দায়িত্বরত গার্ড আমাকে গালি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সে যাবার পর আবার আমি আমার প্রিয়তমার কথা মনে করতে শুরু করলাম। সময়ের সাথে সাথে আমার মনে হচ্ছিল যে, সে আমার আশেপাশেই আছে। আমার মনে তার উপস্থিতি এতই তীব্র ছিল যে মনে হচ্ছিল আরেকটু হাত বাড়িয়ে দিলেই আমি তাকে ধরতে পারবো, তাকে ছুঁতে পারবো। আঙুলে উঠে আসবে তার শরীরের উষ্ণতা। অনুভূতিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলছিল। মনে হচ্ছিল, ও এখানেই আছে। আমার ঠিক পাশেই। নড়তে গেলেই শরীরে শরীর লেগে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছোট পাখি ডাল থেকে নেমে আমার খুঁড়ে রাখা মাটির উপর এসে বসল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

শুরুর দিকেই আমি শিল্পের কথা বলেছিলাম। এখন প্রশ্ন হতে পারে এই দোজখখানার সাথে শিল্পের কী সম্পর্ক? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে বুঝতে হবে শিল্প কী? কারণ শিল্প একেক জনের কাছে একেক রকম। একেক জন একেক ভাবে বুঝে থাকে তাকে।

মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পের খালি ঘরে আসর জমতো। একটি ছোট ঘর কিছুক্ষণের জন্য খালি করে সেখানে অনেকগুলো বেঞ্চ একত্র করে মঞ্চ বানানো হতো। সেখানেই অনুষ্ঠান হতো। অনুষ্ঠানগুলো হতো সন্ধ্যার সময়। ক্যাম্পে যাদের অবস্থা কিছুটা ভালো তারা সেখানে উপস্থিত থাকতো। যেমন কাপোরা। এছাড়াও যেসব বন্দিদের মার্চে যেতে হবে না, কিংবা ক্যাম্প থেকে কোনো কারণে দূরে পাঠানো হবে না, তারাও থাকতো। এখানে তারা আসতো হাসার জন্য, কাঁদার জন্য। কিছুক্ষণ সবকিছু ভুলে থাকার জন্য। এখানে এসে সবাই দোজখের আজাব থেকে অল্প সময়ের জন্য হলেও মুক্তি পেত। এইসব অনুষ্ঠানে কেউ গান গাইতো, কেউ কবিতা পড়তো। কেউ কেউ কৌতুক বলে সবাইকে হাসাতো। গান, কবিতা, কৌতুকে মাঝেমধ্যে ক্যাম্প নিয়ে বিদ্রূপ থাকতো। সবকিছুর মূলে ছিল অল্প সময়ের জন্য ক্যাম্পের দুঃসহ জীবনকে ভুলে থাকার প্রচেষ্টা। নিঃসন্দেহে এ প্রচেষ্টা ছিল সফল।

এ ছোট আয়োজনগুলো এতই কাজে দিত যে, এমন অনেক বন্দি যারা কিনা তাদের ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে খাবার সংগ্রহ করার জন্য যেতে পারত না, তারাও সেখানে উপস্থিত হত নিয়মিত। এতে তারা উজ্জীবিত হতো।

দুপুরে খাবারের বিরতির আধঘণ্টার মধ্যে আমাদের স্যুপ দেয়া হতো (যা কিনা অল্প টাকাতেই কন্ডাক্টররা সরবরাহ করতো)। সে সময়টুকুতে একটা ইঞ্জিন রুমে জড়ো হওয়ার অনুমতি ছিল আমাদের। ইঞ্জিন রুমটি তখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ঢুকতেই সবাইকে চামচভর্তি করে পানসে স্যুপ দেওয়া হতো। সেই পাতলা পানসে স্যুপ তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতেই আমরা দেখতাম, কোনো এক বন্দি পুরনো ফেলে রাখা টবের উপর দাঁড়িয়ে ইতালীয় গান গাইছে। সত্যি বলতে আমরা গান গুলো উপভোগ করতাম। এতটাই উপভোগ করতাম, যে বন্দী গান গাইতো, তাকে বলে দেয়া হয়েছিল, পুরো গান শোনালে তার বিনিময়ে তাকে শিমের বিচি সুদ্ধ আরো এক চামচ স্যুপ দেওয়া হবে।

এখানে শুধু গায়ক বা বিনোদনকারীদেরই পুরস্কার দেয়া হতো না, যারা হাততালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দিতো, তাদেরও পুরস্কৃত করা হতো। যেমন আমি তালি দেয়ার কারণে ক্যাম্পের সবচেয়ে বদমাইশ, খারাপ কাপোর কাছ থেকে মাফ পেয়েছিলাম। তার উপাধি ছিল, ‘খুনী কাপো। ভাববেন না, তাকে এমনিতেই এই উপাধি দেয়া হয়েছিল।

যাইহোক আমার সাথে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তা বলি।

কোনো এক সন্ধ্যায় আত্মা নামানোর অনুষ্ঠানে আমার আবার ডাক পড়ে। আমি গেলাম। সেই ডাক্তার এবং সেই আগের বন্ধুরা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়ারেন্ট অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। যদিও সেই অফিসারদের থাকার অনুমতি ছিল না। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, এমন সময় সেই খুনী কাপো হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে পড়ে। তাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখন আত্মা নামানোর পর্ব শেষ হয়ে গেছে। তাই সবাই তাকে তার বিখ্যাত কবিতা পড়ে শোনার জন্য অনুরোধ করলো।

দ্বিতীয়বার অনুরোধ করার আগেই সে কোত্থেকে একটা ডায়েরি বের করে তার কবিতা পড়তে লাগলো। একের পর এক পড়ছে তো পড়ছেই। তার একটা প্রেমের কবিতা শুনে আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলাম। হাসি চেপে রাখতে রাখতে মুখ ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। পরে বাধ্য হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলাম। অনেক কষ্টে সেদিন হাসি আটকে রেখে ছিলাম। বলা ভালো, নিজের জীবন বাঁচিয়ে ছিলাম। তার কবিতা পরিবেশনার শেষে আমি হাততালি দিয়েছিলাম। এতে সে বেশ খুশি হয়। আমার দিকে তখন তার সুদৃষ্টি পড়ে। যাই হোক, অমন রক্ত পিপাসু কাপোর কাছে ভালোভাবে পরিচিত হওয়াটা আমার জন্য লাভজনকই ছিল। ক্যাম্পে কোনো ধরনের শিল্পচর্চা পাগলামি বটে, উদ্ভটও কিছুটা। তারপরও এই চর্চা চলতো। আর এই চর্চা আমাদের কীভাবে যে আচ্ছন্ন করে রাখতো, তা বলে বোঝানো যাবে না।

আমি কখনো ভুলব না, কিভাবে আমার বন্দি জীবনের দ্বিতীয় রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম গানের শব্দে। ক্যাম্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক তার ঘরে গানের আসর বসিয়েছিল। তার ঘরটা ছিল ঠিক আমাদের ঘরের সামনেই। মাতাল কিছু মানুষের গলার স্বর ভেসে আসছিল সেখান থেকে। চিৎকার করে বিচ্ছিরি সুরে গান গাইছিল। সুরের কোনো আগামাথা ছিল না। গানের কথা যাচ্ছিল এক দিকে, সুর যাচ্ছিল আরেক দিকে। তারপর হঠাৎ করেই সব বদলে গেল। চারিদিক কেমন নীরব হয়ে গেল। সেই নৈঃশব্দের মাঝে হাহাকার করে বেজে উঠলো এক করুণ সুর। বেহালার সুর। বেহালাবাদক যেন বেহালার সুর দিয়ে তার জীবনের সব দুঃখকে সে রাতের আঁধারে মেলে ধরছিলেন। মনে হলো সেই সুর আমার মনের গহীন থেকে দুঃখ-কষ্টকে টেনে বের করে আনছে। অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি। হুহু করে কেঁদে ছিলাম তখন। কারণ ওই দিন ছিল কারো চব্বিশতম জন্মদিন। যে আমার খুব কাছের, নিঃশ্বাসের মতো করে যাকে ভালোবাসি, অথচ কতই না দূরে ছিল আমার কাছ থেকে। হয়তো অশউইজ ক্যাম্পের কোথাও ছিল সে। এত কাছে তবুও যেন নাগালের বাইরে। চাইলেই তার কাছে আমি ছুটে যেতে পারতাম না। স্পর্শ করতে পারতাম না। সেই মানুষটা আর কেউ নয়। আমার স্ত্রী, আমার জীবনসঙ্গিনী।

ক্যাম্পে শিল্পচর্চার কথা শুনে যদি কেউ অবাক হোন, তাহলে তার চোখ দুটো বিস্ময়ে কপালে উঠবে যখন শুনবে সেখানে হাসি-ঠাট্টা, মশকরাও চলতো। হতে পারে তা কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটের জন্য। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে রসিকতা করা ছিল আরেকটি কৌশল। এটা সবারই জানা যে, বাকি সবকিছুর চেয়ে রসিকতাই পারে আশেপাশের দুঃখ, যন্ত্রণা আর কদর্যতাকে ভুলিয়ে দিতে। পারে কোনো পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে যেতে। হোক না তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। ক্ষতি কী? আমি বলতে গেলে এক বন্ধুকে হাসিঠাট্টার বিষয়ে ট্রেনিং দিতাম। আমি তাকে দিয়ে ওয়াদা করে নিয়েছিলাম যে আমরা প্রতিদিন এমন কোনো মজার ঘটনা বানাবো যা কিনা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের এই দুঃখ কষ্টকে ভুলিয়ে দেবে। সে একজন সার্জন ছিল। বন্দি হবার আগে বড় একটি হাসপাতালে সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিল।

একবার আমি তাকে হাসার চেষ্টা করেছিলাম এই বলে যে, ‘মুক্তি পাওয়ার পর যদি তুমি ক্যাম্পের অভ্যাস না ছাড়তে পারো, তাহলে কী হতে পারে, বলতে পারবে?’

সে বললো, ‘কী হবে?’

আমি বললাম, ‘আমরা যখন কাজ করি, এখানে কী হয়? কোনো কর্তাব্যক্তি আমাদের কাজকর্ম দেখতে এলে ফোরম্যান তখন আমাদের বলতে থাকে, ‘কাজ করো। তাড়াতাড়ি কাজ করো। শরীরে জোর নাই শুয়োর কোথাকার। তাড়াতাড়ি করো। কুইক

এখন তুমি ধরো মুক্তি পাওয়ার পর হাসপাতালে ফিরে গেলে। একদিন অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলছে। তোমার সিনিয়র কোনো ডাক্তার এসে উপস্থিত হলো সেখানে। তখন তুমি কী করবে? তুমিও এখানের ফোরম্যানের মতো তোমার জুনিয়র চিকিৎসককে বলবে, “তাড়াতাড়ি অপারেশন করো। তাড়াতাড়ি। শরীরে জোর নাই শুয়োর কোথাকার। হাত চালিয়ে অপারেশন করো। কুইক।’

মাঝে মাঝে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মজার মজার সব কল্পনা করতাম। যেমন কল্পনা করতাম, কখনো কোনো রাতের দাওয়াতে গেলে সেখানের গৃহকর্ত্রীকে কিভাবে অনুরোধ করবো?

‘দয়া করে বাটির নিচ থেকে শিমের বিচিসহ একটু স্যুপ দিন আমাকে (ক্যাম্পে থাকতে থাকতে এ অনুরোধ করা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল)।

ঠাট্টা রসিকতা করে এবং সব কিছুকে এক ধরনের রসিকতা আলোকে দেখাটা ছিল এক ধরনের কৌশল। এ কৌশল বেঁচে থাকার জন্য। এ কৌশল অসহনীয় যন্ত্রণাকে ভুলে থাকার জন্য।

ক্যাম্পে শত দুঃখ, কষ্ট থাকলেও তার মধ্যে বেঁচে থাকা যায়, এটা আমরা কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলাম।

একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। মানুষের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা গ্যাসীয় পদার্থের মত। যদি নির্ধারিত পরিমাণের গ্যাস একটা কামরায় পাম্প করে দেয়া হয়, তাহলে ওই কামরা যতই বড় হোক না কেন, গ্যাস পুরোটাই ভরে ফেলবে। তেমনি মানুষের কষ্টও তার মনকে, আত্মাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে ফেলে, তা যত ছোট কষ্টই হোক না কেন? আসলে মানুষের জীবনে দুঃখকষ্ট আপেক্ষিক। একটা ছোট কষ্ট যেমন মানুষকে কাতর করে ফেলতে পারে আবার ছোট ছোট আনন্দ, প্রাপ্তিও আমাদের সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *