প্ৰথম পৰ্ব
দ্বিতীয় পৰ্ব

অস্তিত্ব-শূন্যতা

অস্তিত্ব-শূন্যতা

অস্তিত্ব শূন্যতা বিংশ শতাব্দীর একটি বহুল পরিচিত ঘটনা। এটি স্বীকার করতে হবে যে, আদিম মানুষ থেকে সভ্য মানুষ হয়ে উঠার জন্য মানুষকে তার দুটো গুণ ত্যাগ করতে হয়েছে। মানব সভ্যতার শুরুতেই মানুষের মধ্যে যে পশুর প্রবৃত্তি ছিল, সে সেটা ত্যাগ করেছে। তবে পশু কিন্তু তার প্রবৃত্তি ত্যাগ করতে পারে না। অর্থাৎ একটি কোকিল সব সময়ই কোকিল। গান গাওয়া তার স্বভাব। এটি সে পরিবর্তন করতে পারবে না। তেমনি একটি বাঘ সব সময়ই হিংস্র। মানে প্রতিটি পশুরই নির্দিষ্ট কিছু ধর্ম আছে, প্রবৃত্তি আছে। যা সে পরিবর্তন করতে পারে না। এবং এই প্রবৃত্তির জন্যই সে নিরাপদ। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন মানুষ বেহেশতে নিরাপদ ছিল। কিন্তু এখন বেহেশতো থেকে বিতাড়িত হয়ে গেছে। অথচ বেহেশতে পুনরায় যাবার জন্যই এখন তার যতো আয়োজন। এবার দ্বিতীয় যে জিনিসটি হারিয়েছে, তার কথায় আসি। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলে মানুষ তার ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছে। বিসর্জন দিচ্ছে। ফলে সে অনেকটা ঐতিহ্য শূন্য মানুষ হয়ে গেছে। এখন প্ৰবৃত্তি তাকে বলছে না কী করতে হবে? ঐতিহ্য তাকে বলে দিচ্ছে না, কী করা উচিত। মাঝেমধ্যে নিজেই বুঝতে পারে না সে কী করতে চাইছে? ফলে অন্যে যা করে, দেখাদেখি সেও তাই করে (এটাকে আমার কনফরমিজম বা প্রথানুবর্তিতা বলতে পারি); অন্যলোকজন তাকে দিয়ে যা করাতে চায় সে সেটাই করে (একে বলে টোটালিজম)।

সম্প্রতি আমার ইউরোপিয়ান শিক্ষার্থীদের উপর একটি জরিপ করা হয়েছিল। দেখা গেছে, তাদের মধ্যে শতকরা ২৫ জন অস্তিত্ব শূন্যতায় ভুগছে। আমার আমেরিকান শিক্ষার্থীদের এই সংখ্যাটা কিন্তু ২৫ নয়। সংখ্যাটা হলো ৬০। হ্যাঁ, আমেরিকান শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৬০ জন শিক্ষার্থী অস্তিত্ব শূন্যতায় ভোগে। মানুষের জীবনে যখন একঘেয়েমি চলে আসে, তখনই সে অস্তিত্ব শূন্যতায় ভোগে। অর্থাৎ অস্তিত্ব শূন্যতা নিজেই মানুষের মাঝে একঘেয়েমি আকারে প্রকাশ পায়। এখন বুঝতে পারি, শোপেনহাওয়ার কেন বলেছেন, মানব জাতির জন্য দুটো চরম শাস্তি হলো সীমাহীন হতাশা এবং একঘেয়েমিতা। সত্য বলতে কি, এই একঘেয়েমিতা বা বিরক্তিই মানুষকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যায়। হতাশার চেয়ে একঘেয়েমিতাই এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যাগুলো দিনে দিনে বেড়েই চলছে। আরও বড় আকারে সংকট তৈরি করছে। এই যে ক্রমাগত উন্নয়ন, এর ফলে অনেক শ্রমিকেরই অবসর সময় বেড়ে যেতে পারে। তাদের জন্য করুণা হয়, কারণ তাদের অনেকেই বুঝতে পারবে না, তাদের এই অবসর সময় কীভাবে কাটাবে, কীভাবে কাজে লাগাবে।

চলুন, একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। ‘সানডে নিউরোসিস বা রবিবারের যন্ত্রণা’। একজন শ্রমিক সারা সপ্তাহ গাধার খাটুনি খাটার পর যখন সে দেখে রবিবারে তার কোনো কাজ নেই। সে বুঝতে পারে না, কীভাবে দিন কাটাবে। তখন তার এক ধরনের শূন্যতা জাগে। এ ধরনের সমস্যায় মানুষ অবশ্য আত্মহত্যা করে না। এছাড়া অধিকতর পরিচিত যেসব লক্ষণ যেমন হতাশা, আগ্রাসন বা আসক্তি আমরা বুঝতে পারবো না, যতক্ষণ তাদের মধ্যে অস্তিত্বের শূন্যতা চিহ্নিত করতে না পারবো। এই কথা অবসর প্রাপ্ত বা বয়স্ক লোকের জন্যেও সত্য। এছাড়া বিভিন্ন মুখোশের আকারে এই অস্তিত্বের শূন্যতা প্রকাশ পেতে পারে। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে হতাশার জন্ম হয়। সেটা হতে পারে ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা থেকে (এই ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি), টাকা-পয়সার পাওয়ার ইচ্ছা থেকে। অন্যদিকে আনন্দ পাওয়ার ইচ্ছে থেকে হতাশা জন্ম নেয়। অস্তিত্ব শূন্যতা অনেক সময় যৌনবিকৃতি ঘটায়। কারণ আমরা দেখেছি, মানুষ যখন হতাশায় ভোগে, অস্তিত্ব শূন্যতায় ভোগে, তখন তার মাঝে যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়।

স্নায়বিক সমস্যার সময়ও যৌন চাহিদা বেড়ে যায়। এ বিষয়ে নানা মতামত আছে, যা আমরা পরে আলোচনা করব। কেউ বারবার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারেন। এই লক্ষণবিজ্ঞান (সিম্পটোমাটোলোজি) অস্তিত্ব শূন্যতার মধ্যে আক্রমণ করে এবং ক্রমাগত বিস্তার ঘটায়। যখন আমরা এই ধরনের রোগী পাই, তখন তাকে নুজেনিক নিউরোসিস পদ্ধতিতে চিকিৎসা করি না। তবে এসব ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি চিকিৎসার সাথে যদি লোগোথেরাপি চিকিৎসা না করতাম, তাহলে কখনোই আমরা সফল হতে পারতাম না। এই অস্তিত্বের শূন্যতা দূর করা হয় যেন রোগী ভবিষ্যতে একই রকম কষ্ট না পায়। তাই বলা যায়, লোগোথেরাপি শুধু নুজেনিক ক্ষেত্রেই কাজ করে না, উপরে বর্ণিত সমস্যার ক্ষেত্রেও কাজ করে। এছাড়াও সাইকোজেনিক ক্ষেত্রে এবং কখনো কখনো সোমাটোজেনিক নিউরোসিসের ক্ষেত্রেও কাজ করে। এক্ষেত্রে মাগদা বি. আর্নল্ডের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য, ‘প্রতিটি থেরাপিই নানা উপায়ে কাজ করে। তা তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কাজ করে। লোগোথেরাপির জন্যেও একই কথা প্রযোজ্য।’

আসুন তাহলে এবার চিন্তা করা যাক, রোগী যদি জীবনের অর্থ জানতে চায়, তাহলে কী উত্তর দেবো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *