একটি লোগোড্রামা
একটি গল্প বলি, শুনুন। যদিও এটি গল্প নয়, সত্য ঘটনা।
একটি ছেলে এগারো বছর বয়সে মারা যায়। ছেলেকে হারিয়ে মা পাগলের মতো হয়ে যায়। একপর্যায়ে ছেলেটির মা আমাদের হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। হাসপাতালে ভর্তি হবার আগে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। সফল হয়নি। ডা. কার্ট কোকৌরেক মহিলাটিকে একটি থেরাপিউটিক গ্রুপে আমন্ত্রণ জানায়। আমি হাঁটতে হাঁটতে এক রুমে গিয়ে উপস্থিত হলে, দেখি, সেখানে ডাক্তারের পরিচালানায় একটি সাইকোড্রামা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওই রুমেই মহিলার সাথে আমার পরিচয় হয়। তখন সে আমাকে তার জীবনের গল্প শোনায়। ছেলের মৃত্যুতে মহিলা ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। যদিও তার আরেকটি ছেলে ছিল। সেই ছেলেটি ছিল পঙ্গু। ছোটবেলায় প্যারালাইলিস হয়ে তার এ অবস্থা হয়ে যায়। দুঃখী এই ছেলেটির সবসময় হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করতে হতো। তারপরও তার মা ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে ছিল। কিন্তু তার এগারো বছর বয়সী ছেলে যখন মারা গেল, সে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে। সে ছেলে নিয়ে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যখন সে ছেলেকে নিয়ে আত্মহত্যা করবে তখন এই পঙ্গু ছেলেটি বাধ সাধে। কারণ সে বাঁচতে চায়। তার কাছে জীবন ভীষণ অর্থময়। তাহলে তার মায়ের কাছে কেন জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে?
এই অবস্থায় আমরা তাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমি তখন তার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার পর, উপস্থিত অন্যান্য মহিলাদের কিছু প্রশ্ন করেছিলাম।
আমি সেই মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বয়স কত?’ সে বললো, ‘ত্রিশ।’
আমি বললাম, “মনে করুন, আপনার বয়স ত্রিশ নয়, আশি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন। এবার আপনার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মরণ করুন। আপনার কোনো সন্তানসন্তানদি নেই। তবে আপনার টাকা পয়সার কমতি নেই। সমাজে বেশ প্রতিপত্তি আছে। ‘
আমি তাকে বললাম, এ বিষয়টা একটু কল্পনা করুন, দেখুন তো এই অবস্থায় কেমন লাগে।
আমি বললাম, ‘আপনি কি বিষয়টি বুঝতে পারছেন? এখন বলুন, এই অবস্থায়, আপনি আপনাকে কী বলবেন?
মহিলাটি এই উত্তরে আমাকে যা বলেছিল, তা টেপে ধারণ করে রেখেছিলাম। সেখান থেকে হুবহু উদ্ধৃত করছি।
‘হুম, আমি একজন কোটিপতিকে বিয়ে করেছি। প্রচুর টাকা পয়সা আমার জীবন যাপনকে সহজ করে দিয়েছে। আমি এটি উপভোগ করছি। পুরুষদের সাথে ফ্লার্ট করছি। ঠাট্টা-মশকরা করছি। কিন্তু এখন আমার বয়স আশি বছর। নিজের কোনো সন্তানাদি নেই। এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দেখার কেউ নেই। আমার এখন যৌবন কালের আরাম, আয়েশ, ফূর্তির কথা কিছু মনে পড়ছে না। সত্য বলতে কী, মনে হচ্ছে আমার জীবনটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
এবার আমি সন্তান হারানো মাকে আগের মহিলার মতো কল্পনা করতে বললাম। বললাম, এবার আপনার কেমন লাগছে, বলুন।
তিনি সেদিন কী কী বলেছিলেন তা টেপে ধারণ করা অংশ থেকেই শোনা যাক।
‘আমি সন্তান কামনা করেছিলাম। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার কোল জুড়ে সন্তান এসেছে। এক ছেলে মারা গেছে। অন্য ছেলে পঙ্গু। তাকে আমি একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ আমি সেই পঙ্গু ছেলেটির যত্নআত্তি ঠিক মতো করতে পারছিলাম না। যদিও সে পঙ্গু। অসহায়। তবু সে আমার সন্তান। আমার সব কিছু। তাই আমি তার জন্যে যতটুকু সম্ভব, একটা সুন্দর জীবন দিতে চাই। আমি চাই আমার ছেলে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠুক।’
এ কথা বলার সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। সে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘এখন আমি যখন পিছনে ফিরে তাকাই, মনে হয় শান্তিতেই জীবন কাটিয়েছি। এজন্য আমার কোনো খেদ নেই। আমি বলতে চাই, অর্থহীন ভাবে আমার জীবন কাটেনি। একটি অর্থ ছিল আমার জীবনের। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য। আমি সব সময় আমার সেরাটা দেবার চেষ্টা করেছি। আমি আমার ছেলের জন্য যতটুকু করা সম্ভব করেছি। আমরা জীবন ব্যর্থ নয়।’
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে যখন তিনি অতীতের কথা ভাবছিলেন, হঠাৎ করেই যেন তার জীবনের অর্থ খুঁজে পেলেন। বুঝতে পারলেন, সুখ-দুঃখ নিয়েই জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। সেই সাথে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, জীবন বড়ই ছোট। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তার মৃত ছেলের কথা। অল্প সময়ের জন্য এ ছেলেকে পাওয়ার কারণেই আশি বছরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় সন্তানহীন জীবনের চেয়ে এই জীবন বেশি অর্থময়।
এরপর আমি সেখানে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমি বললাম, মনে করুন, পোলিও টিকা পরীক্ষা করার জন্য একটি বানরকে নিয়ে আসা হলো। এরপর তার শরীরে একের পর এক সূঁচ ফোটানো হলো টিকা পরীক্ষা করার জন্য। এই যে যন্ত্রণা দেয়া হচ্ছে, বানরের কাছে কি এই যন্ত্রণার কোনো অর্থ আছে?
উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলল, না, বানরের কাছে এই যন্ত্রণার কোনো অর্থ নেই। তার সীমিত বুদ্ধি দিয়ে মানুষের পৃথিবীর কিছুই সে বুঝতে পারবে না। অর্থাৎ এই যন্ত্রণা তার জন্য কোনো অর্থ বহন করে না।
এবার আমি সমবেত সবার উদ্দেশ্যে আরেকটি প্রশ্ন করলাম, ‘মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি কী হবে? আপনারা কি মনে করেন, মহাজাগতিক বিবর্তনের ফলে মানুষের পৃথিবীই শেষ কথা? না, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ পৃথিবীতে আরও নানান ধরনের প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। মানুষের জগতের বাইরেও আরও জগত রয়েছে। সে জগতে কি মানুষের চূড়ান্ত দুর্ভোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে?