মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

ষাটে শক্তি শক্তিমান

ষাটে শক্তি শক্তিমান

পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি থেকে শক্তিকে চিনি। তখন লিটল থিয়েটার করি— তথা নাট্য আন্দোলন করি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে তখন খুব আড্ডা দিতাম। নানা জগতের রথী-মহারথীরা আসতেন। সব্বাইকে দেখতাম এবং তাঁদের কথা শুনতাম এবং নিজে প্রায় মুখ বুজেই থাকতাম। একটা টেবিলে সাহিত্যিকদের আড্ডা ছিল। সেখানে অনেকেই আসতেন— সবাইকে চিনতাম না। মনে হয় সেই আড্ডায়ই প্রথম শক্তিকে দেখি। সেখানকার মধ্যমণি ছিলেন— সমরেশদা অর্থাৎ সমরেশ বসু। পূর্ণেন্দু পত্রী আমার বহু পুরোনো বন্ধু— সেও সেখানে আড্ডা দিতে আসত। ওঁর কাছেই প্রথম শক্তি সম্পর্কে শুনি। পদ্য বা কবিতা আমার খুব একটা আসে না, সুতরাং তা-ই নিয়ে কখনও কথাও বলি না। শুধু শুনে যাই— তবে যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে। এই সময় এক ভদ্রলোক, যাঁকে সাহিত্যজগতে সবাই বেশ সমীহ করতেন, তিনি কেন জানি না আমায় খুব ভালোবাসতেন। তাঁর নাম কমলকুমার মজুমদার। কমলদাকে একদিন শক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘ছেলেটার লেখার মধ্যে ইমেজারি আছে।’— ব্যাস। বহু লোক বলেছিলেন, কমলদার পক্ষে এটুকু বলাই নাকি যথেষ্ট।

তারপর বহুদিন কেটে গেছে— হঠাৎ শুনলাম শক্তি নাকি ফাটাফাটি কবিতা লিখছে এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর মালও খাচ্ছে। একদিন ‘অঙ্গার’ নাটক দেখতে এল এবং আবার নাকি অভিনয় হবে—এটাও বলে গেল। তারপর আবার যোগাযোগ হল অভিনেতা রবি ঘোষ হিসেবে। তখন শক্তি তুঙ্গে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে। দেখা হলেই প্রচণ্ড গালিগালাজ আগে করত, তারপর যাবার সময় থুতু মাখানো একটা চুমু খেয়ে যেত। মদ্যপান একসঙ্গে বহুদিন করেছি, কিন্তু ওর সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষমতা আমার থাকত না। বোধহয় শক্তি শাক্ত বলে আর আমরা বৈষ্ণব বলে। কিন্তু নানা অবস্থায় তার মাথাটা কিন্তু সজাগ থাকত। কোনও মদ্যপায়ী লেখক বা গুণী ব্যক্তি হলফ করে বলতে পারবে যে তাকে একদিন রাত্রে গভর্নমেন্ট স্টেট বাস ড্রাইভার বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে? পারবে না। নামকরা লোকজন বাড়ি পৌঁছোবার জন্য দামি গাড়ি আনতে পারে—অনেক কিছু আনতে পারে— আনতে পারে লরি, কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটা আস্ত খালি স্টেট বাস আনতে পারে। কারণ— সেই স্টেট বাসের ড্রাইভার শক্তির কবিতার ভক্ত।

সে কারণেই বলছি, শক্তির শক্তি বোঝার মতো ক্ষমতা আমার নেই— তবে তাকে বন্ধু হিসেবে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার আছে।

‘শক্তির কাছাকাছি’ (সমরজিৎ ও ইনা সেনগুপ্ত সংকলিত ও সম্পাদিত দেজ পাবলিশিং, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬)

টীকা

১) শক্তি—প্রখ্যাত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩-১৯৯৫)। বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি গ্রামে জন্ম। এই অসাধারণ কবি প্রথমে গদ্য লিখতেন। ‘কুয়োতলা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। কবি হিসেবে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘সোনার মাছি খুন করেছি’, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ ইত্যাদি প্রায় ৪২টি কাব্যগ্রন্থ আছে তাঁর। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজের সম্পাদনায় কিছুদিন প্রকাশ করেন ‘সাপ্তাহিক বাংলা কবিতা’ পত্রিকা। শেষ জীবনে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছিলেন।

২) সমরেশদা—প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮)। ঢাকার এক গ্রামে জন্ম। আসল নাম সুরথনাথ বসু। বাড়ি থেকে পালিয়ে নৈহাটির শ্রমিক বস্তিতে ওঠেন। ডিম, তরিতরকারি বিক্রি, কারখানায় চাকরি ইত্যাদি নানা জীবনসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে চলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৮-এ পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে জেলে যান। ছাড়া পেয়ে গভীরভাবে সাহিত্যচর্চায় মন দেন। প্রথম উপন্যাস ‘শ্রীমতী কাফে’ এবং প্রথম গল্প ‘আদাব’। এরপর ‘বি. টি. রোডের ধারে’, ‘গঙ্গা’, ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ ইত্যাদি অনেক উপন্যাস ও গল্পের গ্রন্থ আছে তাঁর। ‘কালকূট’ ছদ্মনামেও লিখেছেন ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘শাম্ব’ ইত্যাদি বেশ কিছু উপন্যাস গ্রন্থ। শেষ জীবনে রামকিঙ্কর বেইজের জীবন নিয়ে লিখছিলেন অসাধারণ উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটি শেষ হয়নি। ‘মহানগর’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা, ছবি আঁকা, বাঁশি বাজানোয় দক্ষতা ইত্যাদি নানাদিকে বিচ্ছুরিত হয়েছে তাঁর প্রতিভা।

৩) পূর্ণেন্দু পত্রী (১৯৩১-১৯৯৭)—হাওড়ার উলুবেড়িয়ার নাকোল গ্রামে জন্ম। একাধারে কবি-গদ্যকার-অঙ্কনশিল্পী-চলচ্চিত্রকার। কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘কথোপকথন’ কাব্যগ্রন্থটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বইয়ের প্রচ্ছদ-অলংকরণে এক নতুনত্বের দাবিদার। মঞ্চেও স্থাপত্য নির্মাণের কাজ করেছেন। পরিচালনা করেছেন ‘স্বপ্ন নিয়ে’ (১৯৬৫), ‘স্ত্রীর পত্র’ (১৯৭৩), ‘ছেঁড়া তমসুক’ (১৯৭৪), ‘মালঞ্চ’ (১৯৮২), ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ (১৯৮৭) ছবিগুলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *