মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

প্রসঙ্গ : সাইকোলজিক্যাল প্লে

প্রসঙ্গ : সাইকোলজিক্যাল প্লে

সাইকোলজিক্যাল প্লে-র হিড়িক

‘নেই কাজ তো খই ভাজ’— এটা একটা বহুকালের প্রবাদ। নাটকের একটা জোয়ার এসেছে বাংলাদেশে অনেকদিন থেকেই। ধরা যেতে পারে ‘নবান্ন’ থেকেই। তারপর এল কত গ্রুপ—বহুরূপী, এলটিজি, আইপিটিএ (টুকরো শাখায়)। বহুরূপী এবং এলটিজি শুরু করল প্রথম খুব জোরের সঙ্গেই অনুবাদিত নাটক করতে। অবশ্য সব সময়ই আমরা অ্যাডভার্টাইজ করি অ্যাডাপ্টেশন বলে। কিন্তু আসলে যা আমরা করে থাকি, সেটাকে পরিবর্তিত বা পরিবর্ধিত অনুবাদ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।

মাঝেমধ্যে কিছু কিছু রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে— কেবলমাত্র ভদ্রতার খাতিরে। উপরের দুটো নামকরা সংস্থাই কিন্তু বর্তমানে তাদের স্ব স্ব রাস্তা বেছে নিয়েছে। বহুরূপী করে থাকে সৎ নাটক এবং এলটিজি করে বিপ্লবী নাটক। বহুরূপীর লাইন হল মানুষকে আনন্দ দেওয়া নয়, তাদেরকে সৎ চিন্তায় উদবুদ্ধ করা, যেমন করে থাকেন রিলিজিয়াস লিডাররা। আর এলটিজি-র উদ্দেশ্য হল— ধরে ধরে প্রত্যেকটা মানুষকে বিপ্লবী তৈরি করা। এলটিজি-র বর্তমান নেতারা বিশ্বাস করে মানুষ সর্বসময়ই সশস্ত্র বিপ্লব করে যাবে— পিস থাকা সত্বেও। বহুরূপীয় সৎ নাটকগুলোর বেশির ভাগই হল ভয়ংকর সাইকোলজির উপর। যদি কোনও চরিত্র সাইকোলজিক্যালি মুভ না করতে পারে তো খুবই বিপদ হয়। এলটিজি-র নাটকে আবার কোনও চরিত্র যদি মারাত্মকভাবে বিপ্লবী না হয়— তো খুবই মুশকিল।

এই দু’টি বিশিষ্ট দলের ছাপ বাংলাদেশে নাটুকে গোষ্ঠীগুলোর উপর খুব বেশি পরিমাণে দেখা যায়।

বিপ্লব, আন্দোলন ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে নাটক সবসময় করাটা বোধহয় ভালো দেখায় না, তাই অধিকাংশ দলই বহুরূপী লাইন ধরাটাকেই সমীচীন মনে করল। এর থেকেই শুরু হল ‘সাইকোলজিক্যাল’ নাটক করার হিড়িক।

এরা যে সাইকোলজি নিয়ে ডিল করে, তার সঙ্গে সমাজব্যবস্থার কোনও সম্পর্ক নেই। রাজনীতির তো নেইই। ধরুন যদি ধরা যায় যোগেশ (‘প্রফুল্ল’ নাটকে) একটা বিরাট চরিত্র বা নিমচাঁদ একটা রিয়্যাল সাইকোলজিক্যাল চরিত্র অথচ এরা কেউই সমাজব্যবস্থার বাইরে নয়— তাহলে কী দাঁড়ায়? আমাদের স্টেজে অতীতে সব নাটকই হত। কিন্তু অহৈতুক সাইকোলজিক্যাল নাটকের গল্প কখনও কারও কাছে শুনিনি বা পড়িনি।

কী অদ্ভুত এক সাইকোলজি নিয়ে নাড়াচাড়া করা হয় আজকাল গ্রুপ থিয়েটারগুলোতে— ভাবলে অবাক হতে হয়।

একটা মানুষ, সে তার পৃথিবীর সমস্ত দায়দায়িত্ব মেরে নিজেকে নিয়েই পড়ে আছে— এটা কীরকম সাইকোলজি? কেবলমাত্র নিজেকে নিয়ে যে পড়ে থাকে, সে তো পশু। তাহলে আমরা কাদের সাইকোলজি দেখছি? সাইকোলজিক্যাল নাটকের নামে সেটা প্যাথোলজিক্যাল হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে নবনাট্য আন্দোলনের শুরু ‘নবান্ন’ দিয়ে। ‘নবান্ন’ আজ ধাক্কা খেতে খেতে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ হয়ে গিয়েছে প্রচণ্ড বিপ্লবী এবং আর এক ভাগ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সৎ সাইকোলজিতে; এর পরিণতি কোথায় কেউ জানে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কি চিন্তার দিক থেকে মৃত হয়ে গিয়েছি? কী প্রয়োজন আমাদের একটা ব্যক্তির বিশেষ মুহূর্তের কতকগুলো বিশেষ ঘটনাকে চর্বণ করে?

আমাদের যদি কোনও ক্লাসিক নাটক থেকে থাকে, সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করাটা কি অপরাধ?

সকলে যদি নিজের দেশকে জানবার চেষ্টা করে, নিজের পরিজনদের জানবার চেষ্টা করে— তাহলে ‘সাইকোলজিক্যাল অ্যাবারেশন’গুলো মাথায় আর চেপে বসবে না।

থিয়েটার পত্রিকা

টীকা

১) ‘বহুরূপী’—নাট্যজগতে এক যুগান্তসৃষ্টিকারী নাট্যদল। ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় এই দলের। শম্ভু মিত্র-র ১১এ, নাসিরুদ্দিন রোডের বাড়িতে শুরু। শম্ভু মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, অশোক মজুমদার, অমর গাঙ্গুলি, কলিম শরাফি সহ আরও কয়েকজন মিলে তৈরি করেন নাট্যদলটি। প্রথমে নাম ছিল ‘অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায়’ পরে হয় ‘বহুরূপী’। ‘চার অধ্যায়’, ‘রক্তকরবী’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘রাজদর্শন’, ‘মৃচ্ছকটিক’, ‘মিস্টার কাকাতুয়া’ ইত্যাদি অজস্র অসামান্য প্রযোজনা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে উপহার দিয়েছে এই নাট্যদল। যার ধারা আজও অব্যাহত। প্রসঙ্গত, এই দলের হাত ধরেই নাট্যজগতে শম্ভু মিত্র যুগের শুরু হয়।

২) আই.পি.টি.এ—পুরো কথাটি ‘ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’। বামপন্থী ভাবধারার একঝাঁক নবীন বুদ্ধিজীবীর দল মিলে ১৯৪৩-এর ২৫ মে প্রতিষ্ঠা করেন এই সংগঠন। শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতিজগতের তরুণ প্রতিভার এক উন্মেষ ঘটেছিল সংগঠনকে ঘিরে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, সুচিত্রা মিত্র, বিনয় রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রবিশঙ্কর, গোপাল হালদার, চিন্মোহন সেহানবীশ, গুরুদাস পাল ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতীরা ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন গণনাট্য সংঘ। গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গান-নাটক-কথনের মাধ্যমে নিম্নস্তরের মানুষদের ওপর অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদের বার্তা ছড়িয়ে দিত সংগঠনের শিল্পী-সাহিত্যিকরা। যদিও ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকে অনেকেই একে একে সংগঠন ছাড়তে থাকেন।

৩) ‘প্রফুল্ল’—নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচিত এক বিখ্যাত নাটক। স্বয়ং গিরিশচন্দ্র থেকে পরবর্তীকালে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার পর্যন্ত অনেকেই প্রযোজনা করেছেন এই নাটক। এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র—’যোগেশ’ (বড়োভাই)। গিরিশবাবু, দানীবাবু, শিশিরবাবুদের মতো দিকপালেরা নানা সময়ে অসাধারণ অভিনয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন এই চরিত্রে।

৪) ‘নিমচাঁদ’—দীনবন্ধু মিত্র রচিত বিখ্যাত ‘সধবার একাদশী’ নাটকের মুখ্য চরিত্র হল ‘নিমচাঁদ’। বহু বছর ধরে অগুনতিবার অনেক বিরাট মাপের অভিনেতাদের এই চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে।

৫) ‘নবান্ন’—তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি বিখ্যাত নাটক। নাট্যকার—বিজন ভট্টাচার্য। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যর যৌথ পরিচালনায় প্রথম মঞ্চস্থ করে এই নাটক। গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাসে এক নতুন দিকের সন্ধান দেয় ‘নবান্ন’। পরে ‘বহুরূপী’ নাটক গোষ্ঠীও এই নাটক প্রযোজনা করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *