আপসহীন সংগ্রামী
১৯৫৬ কি ‘৫৭ ঠিক মনে নেই—উল্টোরথের বিরাট অনুষ্ঠান রূপবাণী সিনেমা হলে। এলটিজি থেকে আমরা সেই অনুষ্ঠানে একটা ছোটো প্রাোগ্রাম করি। ঘটনাটা শেক্সপিয়ারের ‘টুয়েলভথ নাইট’-এর একটা অংশ। আমি, সত্য, অরুণ, নীলিমাদি, শোভাদি এবং উৎপলদা ছিলাম অংশগ্রহণকারী। মনে আছে হল ফেটে গিয়েছিল। প্রায় সমস্ত নামজাদা বায়োস্কোপের লোকই সেখানে ছিল। তখন বায়োস্কোপের কোনও লোকজনদেরই চিনতাম না। মাত্র একজন মঞ্চের পিছনে এসে আমার খুব প্রশংসা করে গেলেন—তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিজেও বায়োস্কোপে যোগদান করার পর আবার নতুন করে ভানুদার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল। এক ধরনের লোক থাকেন যাঁদের মধ্যে হতাশা মাঝে মাঝে এলেও কখনও বাসা বাঁধতে পারে না, ভানুদা হচ্ছেন সেই ধরনের।
১৯৬৯ সাল। সমস্ত ফিল্ম জগৎ জুড়ে একটা বিরাট আন্দোলন হয়। একদিকে ‘সংরক্ষণ সমিতি’ এবং অপর দিকে আমাদের ‘অভিনেতৃ সংঘ’। কায়েমি স্বার্থের লোকেরা খুব সুন্দরভাবে আন্দোলনটাকে ভেস্তে দেয়। যে সমস্ত প্রবীণ শিল্পীরা ছিলেন আমাদের সঙ্গে সবাই একে একে সরে পড়লেন। কেউ কেউ আমাদের পিছন থেকে ছুরিও মারলেন। একমাত্র নব্য-শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলল ভানুদা। বিরাট ভিকটিম হয়ে পড়লেন ভানুদা। কায়েমি স্বার্থ এত জঘন্য যে তারা ভানুদাকে ফিল্ম কেরিয়ার সম্পর্কেও ভয় দেখাল। ভানুদা সব ছেড়ে দুম করে যাত্রায় যোগদান করল।
নতুন করে আবার অন্য জায়গায় শুরু হল ভানুদার কেরিয়ার এবং এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল ভানুদা বহাল তবিয়তেই আছেন। অনুপকুমার একবার আমায় বলেছিল—’বুঝলে রবি, বাঙ্গাল না হলে এই শক্তি পাওয়া যায় না। ভানুদা যেটা করল সেটা আমার দ্বারা সম্ভব হত না।’ কথাটা খাঁটি কথা। ভানুদা বাঙ্গাল, ভানুদা কঠোর, ভানুদা উচিত বক্তা, আবার প্রচণ্ড নরমও।
বর্তমানে যার সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা হয় সে হচ্ছে ভানুদা। বহুদিন বায়োস্কোপে কোনও কাজ করেননি ভানুদা। বোধহয় অভিমানটাই সেখানে বেশি ছিল। কিন্তু বায়োস্কোপের লোকের প্রয়োজনেই আবার ভানুদাকে ফিরে আসতে হল। বর্তমানে ভানুদা প্রচুর ছবি করছেন।
আসলে ভানুদার মধ্যে একটা প্রচণ্ড জীবনীশক্তি আছে এবং সেখানটায় কোনও ফাঁকি নেই। ব্যক্তিগত জীবনে ভানুদা রাজনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রের বহু স্টলওয়ার্টদের দেখেছেন ছোটোবেলা থেকে। আমি জানি প্রফেসর বোস ভানুদাকে কি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। কিন্তু বায়োস্কোপে এসে ভানুদা এটাকে কিছুতেই মেলাতে পারেননি। সমস্ত ইন্ডাস্ট্রিতে তাই ভানুদার সবচাইতে প্রিয়জন ছিলেন ছবি বিশ্বাস। বর্তমানে আমরাও কয়েকজন—অবশ্যই যদি ভানুদা আপত্তি না করেন।
ভানুদা সম্পর্কে ঘটনা বলতে গেলে পাতার পর পাতা ভরে যাবে। তাই একটা কথা বলেই থেমে যাচ্ছি—সেটা হল ভানুদাকে দেখে সব শিল্পীরাই যেন একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন যে শিল্পীর ক্ষেত্রে মিডিয়াম বলে কোনও কথা নেই। কেননা ভানুদা প্রমাণ করেছেন—অভিনয় করতে জানলে মঞ্চে, যাত্রায় এবং বায়োস্কোপে সমানভাবে খ্যাতি অর্জন করা যায়।
‘পুবের ভানু’/সংকলন—গৌতম ব্যানার্জি
(বিশ্ববাণী প্রকাশনীঃ ৪ জানুয়ারি, ২০০৩)