মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

মজার জগতে থাকতেন তিনি

মজার জগতে থাকতেন তিনি

তখন সবে ‘বরযাত্রী’ রিলিজ করেছে। সারা শহরময় হইচই। একটাই কথা সবার মুখে— দেখে এসো গনশার ভূমিকায় কালী ব্যানার্জিকে। সে যুগের নামকরা বহু লোকই ছিলেন, কিন্তু কালীদা যেন একমেবাদ্বিতীয়ম। সেই প্রথম কালীদাকে চিনলাম। তখনও আলাপ হয়নি। ১৯৫২-৫৩ সালে নাট্য আন্দোলনে যোগদান করি উৎপল দত্তর সঙ্গে। এর পরই কালীদা সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারি উৎপলদার কাছ থেকে।

১৯৫৯ সালে ‘অঙ্গার’ নাটক দেখতে এলেন কালীদা। ব্যাকস্টেজে শো-এর পর জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করলেন। এই সময় কালীদা মঞ্চ এবং চিত্রজগতের একজন অতিকায় লোক। অভিনেতা হিসেবে কত বড়ো মাপের ছিলেন কালীদা, তার হিসেব সবার জানা। সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহার মতো পরিচালকরা তাঁকে খুব উঁচু জায়গায় আসন দিতেন। কালীদার আসন সাধারণ ব্যাবসায়িক ছবিতেও কমতি ছিল না। বুদ্ধিদীপ্ত উপলব্ধিতে সহজগ্রাহ্য করে তুলতে পারতেন যে কোনও কঠিন চরিত্রকে, খুব বড়ো মাপের অভিনেতা না হলে এই কাজটা করা যায় না।

ছবিতে আমার সঙ্গে প্রথম কাজ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’য়। তপন সিনহা পরিচালক। কী অসাধারণ এক একটা শট দিতেন— হাঁ করে দেখতাম এবং বোঝবার চেষ্টা করতাম। আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন এবং বলতেন, চালিয়ে যা রবি, তোর হবে।

কালীদার সঙ্গে একটা সময় দীর্ঘদিন বম্বেতে ছিলাম একসঙ্গে হৃষীদার বাড়িতে। মানে পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জি। ১৯৭৩ সালে ‘সবসে বড়া সুখ’ ছবি করেছিলাম হিন্দিতে। কী অধ্যবসায় কালীদার— দেখলাম অনর্গল হিন্দি লিখছে এবং পড়ছে। আমি কিছুই করতাম না। একদিন বলল, না রে, বম্বেতে থাকা যায় না। এখানে কুস্তিটা বেশিই হয়, অভিনয়টা কম হয়। সত্যিই চলে এলেন আবার স্বভূমিতে এবং চুটিয়ে অভিনয় শুরু করলেন।

কালীদা বামপন্থী বহু যুগ আগে থেকে। কিন্তু সবসময় একটা মজার জগতে থাকতেন। অসম্ভব কর্মক্ষমতা ছিল, আবার মেজাজ বিগড়ে গেলে সব কাজ বন্ধ করতেও পারতেন। এই ক্ষমতাটা পেয়েছিলেন নাট্য আন্দোলন থেকে। নতুন কিছু হচ্ছে শুনলেই লাফিয়ে উঠতেন, আবার প্রতিক্রিয়াশীল কিছু দেখলেই গুম মেরে থাকতেন। চলে যাবার দু’দিন আগেও রাত পর্যন্ত শুটিং করে গেছেন। ইদানীং খুব কালারফুল জামাকাপড় পরতে ভালোবাসতেন। বলতেন, মনটাকে ইয়াং রাখবি, তাহলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণ আলেখ্য গ্রন্থ (ডিসেম্বর ১৯৯৪)

টীকা

১) ‘বরযাত্রী’—সত্যেন বসু পরিচালিত সলিল চৌধুরী সুরারোপিত ‘বরযাত্রী’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় রচিত তোতলা গণেশ, ঘোঁতনা, রাজেন, ত্রিলোচন, কে. গুপ্ত, গোরাচাঁদ চরিত্রদের কাণ্ডকারখানা সংবলিত দামফাটা হাসির কাহিনি-নির্ভর এই চিত্ররূপে চরিত্রগুলিতে রূপদান করেন যথাক্রমে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ চৌধুরী, ভবেন পাল, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনুপকুমার।

২) কালী বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২১-১৯৯৩)—শক্তিশালী অভিনেতা। মঞ্চে ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। কলকাতার কালীঘাটে জন্ম। কলেজে পড়ার সময় ‘কেদার রায়’ নাটকে ‘কার্ভালো’ চরিত্রে অভিনয় করে নজর কাড়েন। ১৯৪৫ সালে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে এক রাত্তিরের জন্য অভিনয় করেন ‘তাইতো’ নাটকে। মহেন্দ্র গুপ্ত-র সান্নিধ্যে স্টারে ‘টিপু সুলতান’-সহ অনেকগুলি নাটকে অভিনয় করেন। প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় ‘বর্মার পথে’ (১৯৪৭) ছবিতে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন হওয়ায় যোগ দেন ‘আই.পি.টি.এ’-তে। কমিউনিস্টদের একাংশ রবীন্দ্রনাথকে ‘বুর্জোয়া কবি’ বলাতে তার প্রতিবাদে কালীবাবুরা মঞ্চস্থ করেন ‘বিসর্জন’। অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। অজস্র অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘বরযাত্রী’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘পরশপাথর’, ‘বাদশা’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘দাদার কীর্তি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *