মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

পেশাদারি মঞ্চ ও আমি

পেশাদারি মঞ্চ ও আমি

পেশাদারি মঞ্চে প্রথম আসি ১৯৬৩/৬৪ সালে মিড উইকে ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে শকুনির পাট করতে। গায়ে তখনও গ্রুপ থিয়েটারের গন্ধ ঠিকরে বেরুচ্ছে। একটু বুদ্ধি খোঁজবার চেষ্টা করছিলাম শকুনির রোল-এ—ব্যাস কাত। দর্শক থেকে একজন বললে, ‘বাড়ি যা।’ মাত্র এগারো রাত্রির পর ছেড়ে দিলাম। তখনকার দিনের আকাদেমির ডিন প্রফেসার সাধন ভট্টাচার্য আমার ইন্টারপ্রিটেসানের খুব প্রশংসা করেছিলেন লিখিতভাবে।

তারপর বেশ কয়েক বছর পর কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে আবার যাই ‘সওদাগর’ নাটক করতে। প্রধান নারী চরিত্রে ছিলেন তৃপ্তি মিত্র। পরিবেশটা বেশ সুন্দর—নাটকটাও সাদামাটা কিন্তু চলল না। শুনলাম পেশাদারি মঞ্চের প্যাঁচপয়জার নাকি এতে নেই। এই সময় দুটো প্যাঁচ বাজার-চলতি ছিল। একটা প্রচণ্ড নাটকীয়তা কাম ক্যাবারে, অন্যটা আলোর প্যাঁচ। যাক এটাও চুকল।

তারপর দীর্ঘদিন থিয়েটার করিনি। ১৯৭৩/৭৪ সালে সমর মুখার্জির অনুরোধে থিয়েটারে নামলাম নিয়মিতভাবে। নাটক ‘বিবর’। তারপর করলাম ‘ছদ্মবেশী’ রংমহলে। তারপর এলাম ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ করতে বিজন থিয়েটারে। এবার মালিক গ্রুপ থিয়েটার। এটা চলার পর কিছুদিন ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ করলাম দক্ষিণ কলকাতায় সুজাতা সদনে। ১৯৮৪/৮৫-তে গেলাম সারকারিনায় ‘কনেবিভ্রাট’ করতে। ১৯৮৬-তে সারকারিনায় আবার নামালাম বিপরীতমুখী এক নাটক—’ছায়ানট’। চলল না বা চালানো হল না। বোধহয় পেশাদারি মঞ্চ সম্পর্কে খানিকটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এবং যেটুকু ধ্যানধারণা হয়েছে তার ভিত্তিতেই কিছু মন্তব্য করব।

মালিকের চরিত্র

কদাচ পেশাদারি মঞ্চে একজন, সুস্থ-শিক্ষিত-রুচিবান মালিক মেলে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই জুটেছে। জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় একদা পেশাদারি মঞ্চগুলো গজিয়ে উঠেছিল। শুনেছি এই শ্রেণির লোকদের মধ্যে রুচিবোধ ছিল। তাঁরা আবার উচ্চাঙ্গ সংগীতও শুনতেন। পেশাদারি মঞ্চগুলো একদা ভরপুর ছিল বলিষ্ঠ অভিনেতা/অভিনেত্রীতে, বলিষ্ঠ নাটকে। এখন পেশাদারি মঞ্চ বেশিরভাগই চালায় স্থূল ব্যবসায়ীরা (traders)। এঁদের ব্যবসার মধ্যে ধর্ম একটাই—যেনতেনপ্রকারেণ টাকা প্রচুর লাভ করা। কিন্তু সেই লাভের টাকা কখনই তাঁরা খরচ করেন না থিয়েটারের কোনও উন্নতিকল্পে। এক্ষেত্রে একমাত্র বিরল ছিলেন সলিল মিত্র মহাশয়। এই ভদ্রলোক ভদ্র থিয়েটার ব্যবসায় বহুকাল ছিলেন। পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে তিনি থিয়েটার ত্যাগ করে চলে গেলেন। ‘বিবর’-এর মালিকরা একদা আমায় পাগল করে দিয়েছিলেন একটা ক্যাবারে নাচ ব্যবহারের জন্য। কিন্তু পারিনি। কোনও কোনও মালিককে দেখেছি যে কিছুদিনের জন্য একটু ইয়ার্কি মারতে এলেন থিয়েটার ব্যবসা নিয়ে। এটা ঘটেছিল ‘ছদ্মবেশী’ নাটকে। এই শ্রেণির লোকেরা বোঝেন না যে, পরিশ্রমটা হয় কেবলই কলাকুশলীদের। যেন মনে হয়, এঁদের হাবভাব এইরকম—কিছু উদ্বৃত্ত টাকা রেসের মাঠে না ঢেলে; ঢাললাম থিয়েটারে। একটু আর্টও করা হল কিন্তু টাকাও এল। থিয়েটারকে ভালোবেসে বোধহয় বর্তমানে কেউই আসেন না।

তবুও বলব ‘কনেবিভ্রাট’-এর প্রশান্ত বসু সুস্থ ব্যবসা করতে এসেছিলেন। কিন্তু সারকারিনার ভয়ানক চক্র তাঁকে দ্বিতীয়বার থাকতে দিল না। আর দুইজনকে পেয়েছিলাম সুস্থ এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণে রুচিবান। তাঁরা হচ্ছেন বীথি গঙ্গোপাধ্যায় এবং উত্তম ঘোষ। সর্বশেষ সারকারিনায় যাঁদের পেলাম তাঁরা অতীব নীচ প্রকৃতির। প্রায় দু’বছরের ওপর সারকারিনায় থেকে বুঝলাম না, এই থিয়েটারের মালিক কারা বা কে! অথচ এই শহরের ওপর বামফ্রন্ট সরকার থাকা সত্বেও এমন একটা বেআইনি থিয়েটার দিনের পর দিন চলছে। আমার মনে হয়, থিয়েটার ব্যবসা নিয়ে পয়সাওয়ালা মানুষরা ভাবেনই না। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসায় পা বাড়ালে হয়তো চেহারাটা ফিরলেও ফিরতে পারে। পৃথিবীর সব দেশেই তাই হয়েছে।

আর একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল থিয়েটার ইউনিটের হয়ে ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ করতে এসে। গ্রুপ থিয়েটার যতদিন লড়াই করে বেশ থাকে। টাকার মুখ দেখলেই এঁদের সর্বনাশ। হলও তাই। ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’র প্রভূত টাকা ওদের তছনছ করে দিল। শেখর চ্যাটার্জি আমার পুরোনো সহযোদ্ধা। তাই তাঁর অনুরোধেই গিয়েছিলাম। সরকার গ্রুপ থিয়েটারকে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। একমাত্র তফাত সেই থিয়েটারে যেটা অভিনেতারা চালায় মালিক হয়ে। মাত্র এইসব জায়গায় পাওয়া যায় সত্যিকারের সুস্থ পেশাদারি মঞ্চের পরিবেশ। এক্ষেত্রে একমাত্র অগ্রণী হচ্ছে তপন থিয়েটার। শ্যামবাজার পাড়ায় ‘ছায়ানট’ নাটক নামানোয় বেশ কিছু ব্যক্তি সাধুবাদ দিয়েছিলেন কিন্তু আমি জানতাম এর দশা কী হবে। আসলে পেশাদারি মঞ্চের মালিক আমার মাধ্যমে বারো লক্ষ টাকা লাভ করতে ভালোবাসেন। কিন্তু ভালোবেসে আমার জন্য বারো পয়সা নষ্ট করতে রাজি নন। কারণ এঁরা বেশিরভাগই দোকানদারি বৃত্তির মানুষ।

দর্শকের চেহারা

পেশাদারি মঞ্চে দর্শক হচ্ছে হেটোরোজিনিয়াস। অর্থাৎ মাস দর্শকই এখানে বেশি। এই দর্শকরা আসেন কেবলই মজা পাবার জন্য। মজাটা এবার আপনি যেভাবেই পরিবেশন করুন। কোনও জ্ঞান বা তত্বকথা শুনতে এখানে কেউ আসেন না। স্রেফ আড়াই ঘণ্টা আমাকে জমিয়ে রাখুন—এটাই পেশাদারি মঞ্চের দর্শকের মূল চাহিদা। তবে কিছু সংখ্যক দর্শক চান একটু ভালো—সাহিত্যনির্ভর, সু-অভিনয়ী নাটকও হোক। এঁদের সংখ্যা এত কম যে তাতে নির্ভর করে ব্যবসা চলে না। গত দশ/পনেরো বছরে পেশাদারি মঞ্চের দর্শকের চেহারা একেবারে বদলে গেছে। মঞ্চে বায়োস্কোপের কোনও লোককে দেখাটাই তাঁদের মূল বাসনা—তার সঙ্গে আর অন্য কিছু। অনবরত চারিদিকের পরিবেশ গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে, যার জন্য সাধারণ মানুষের মনটাও হয়ে পড়ছে গোলমেলে। এই অবস্থায় ধীর স্থির কিছু দেখতে তাঁদের ভালো লাগে না। মাস দর্শক সম্পর্কে চ্যাপলিনের খুব সুন্দর একটা মন্তব্য আছে—’They are headless monsters’। এখন কেবলমাত্র থিয়েটারের দর্শক বলে কিছু নেই। এখন মুড়ি/মিছরি এক হয়ে গেছে। এখন সবাই এক জায়গায় ঢুকে যেতে পারে। সুতরাং দর্শককে দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই। কোনও জ্ঞান তারা আর শুনবে না—তারা চায় কেবলই কিক। আপনি যদি কিক-এর মাধ্যমে তাঁদের বেদ/বেদান্ত বোঝাতে চান ঠিক শুনবে। আসলে সবটাই অভ্যাস। অভ্যাসও এক ধরনের যোগ। এবার ভেবে নিন—সাধারণ দর্শকদের অভ্যাসটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? এবং এর জন্য দায়ী কে বা কারা?

সমালোচকদের চেহারা

পেশাদারি মঞ্চের সমালোচকদের মন্তব্যের কোনও মূল্যই নেই। এঁদের কথা কেউ গ্রাহ্যই করে না। না মালিকশ্রেণি, না দর্শকবৃন্দ। যদি সত্যিই গ্রাহ্য করত, তাহলে পেশাদারি মঞ্চে এতদিনে যা সব হচ্ছে কিছুই চলত না। সমালোচকদের ডাকা হয় একটা নিয়মরক্ষা পালনের জন্য। এটা চলে আসছে বহুদিন যাবৎ—তাই ডাকা। সমালোচনা দিয়ে কোনও পেশাদারি মঞ্চের কোনও হিট নাটকের আরও উপকার হয়েছে বলে জানা নেই। Orson Wells-এর ‘Moby Dick’ নাটকের সমালোচনা করেছিলেন Keneth Tynan। নাটকের Stage Decor,— lighting-music-অভিনয়— choreography সব কিছুর চূড়ান্ত প্রশংসা করলেন। শেষ লাইনে লিখলেন, ‘It’s very nice to stay under the Niagra falls for a while.’ অর্থাৎ imperfection-ও শিল্পের একটা অঙ্গ হওয়া উচিত। এটাই বোঝালেন।

সুতরাং পেশাদারি মঞ্চ ইজ পেশাদারি অ্যান্ড পেশাদারি মঞ্চ। ৫০/৬০ দশকেও পেশাদারি মঞ্চের চেহারা ছিল অন্য রকমের। আজ তার অন্য রূপ।

শিল্পীদের চেহারা

এখানে যদি শিল্পী বিবর্তন বা আন্দোলনের কথা ভাবেন তাহলে সেটা হবে মূর্খতা। পেশাদারি মঞ্চে যেসব শিল্পীরা দর্শকের বাহবা একটু বেশি পান তাঁরাই একটু আনন্দ উপভোগ করেন এই যা। যাঁরা বাহবা পান না,— তাঁদেরও কিছু এসে যায় না। কারণ এটা তো চাকরি। দুশো/ তিনশো/হাজার নাইট চলা মানেই নিয়মিত মাইনে। আর তাহলে কী নিয়ে চিন্তা করবে! সুতরাং সবাই এই গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। ভানুদা বলতেন, ‘ভাবনা-চিন্তাওয়ালা জিনিসপত্তর এখানে একটু কম করিস। ভাবনা-চিন্তাওয়ালা নাটকের জন্য অন্য জায়গা আছে।’ পেশাদারি মঞ্চে কাজ করা মানে স্রেফ চাকরি করা, মাধ্যম অবশ্য শিল্পকর্ম—এই যা!

‘রবি ঘোষ স্মারক সংকলন’ (প্রদ্যোতকুমার ভদ্র ও রানা দাস সম্পাদিত, ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮)

টীকা

১) ‘কর্ণার্জুন’—অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা এক বিখ্যাত নাটক। প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯২৩-এর ৩০ জুন স্টার থিয়েটারে। এই নাটকেই ‘বিকর্ণ’ চরিত্রে রূপদানের মধ্যে দিয়ে প্রথম মঞ্চে পা রাখেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া অন্য যাঁরা সেদিন অভিনয় করেন, তাঁদের মধ্যে অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশচন্দ্র মিত্র, তিনকড়ি চক্রবর্তী, নীহারবালা, নিভাননী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

২) Orson Wells (১৯১৫-১৯৮৫)—আমেরিকার একজন প্রখ্যাত নাট্যকার-প্রযোজক-অভিনেতা। রেডিয়ো, থিয়েটার ও ছবির জগতে ছিলেন। ফেডেরাল থিয়েটার প্রোজেক্টে নতুনভাবে মঞ্চস্থ করেন ‘ম্যাকবেথ’। এছাড়া ‘The Cradle will rock’ (১৯৩৭), এইচ.জি. ওয়েলসের ‘The War of the Worlds’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রথম চলচ্চিত্র—’Citizen Kane’ (১৯৪১)। ‘Moby Dick’ এনার একটি বিখ্যাত নাট্য প্রযোজনা।

৩) কেনেথ টুরান—১৯৪৬-এ জন্ম আমেরিকার এই নাট্য ও চিত্র সমালোচকের। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Master of Professional Writting Programme। এছাড়া, National Public Radio-র ‘মর্নিং এডিশন’-এর সঙ্গেও যুক্ত। ‘For the love of Movies : The Story of American Film Criticism’ নামক তথ্যচিত্রে ‘টাইটানিক’ ছবির পরিচালক জেমস ক্যামেরনের সঙ্গে টুরানের তর্ক হয়েছিল। কারণ, ‘লস এঞ্জেলস টাইমস’ কাগজে (যেখানে টুরান ১৯৯১ সাল থেকে চিত্রসমালোচক হিসেবে যুক্ত ছিলেন) ‘টাইটানিক’ ছবিটির একটি বিরূপ সমালোচনা লিখেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *