মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

অনবদ্য অনুপ

অনবদ্য অনুপ

অনুপকুমারের অভিনয়জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি আমাদের সকলের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আমার ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পী হিসেবে পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে আর একজনকে মাত্র দেখেছি— তিনি হেমন্ত মুখার্জি। আমাদের অভিনয়জগতে অনুপ খুবই কম বয়স থেকে অভিনয় করা শুরু করেছিল—ভাদুড়িমশাই, দেবনারায়ণ গুপ্ত প্রমুখের কাছে। এটাও কম কথা নয়। তা ছাড়া এই ঘটনা এই কারণেই যে অনুপের যে জনপ্রিয়তা— আমি ব্যক্তিগতভাবে যাত্রা করতে গিয়ে দেখেছি, গ্রামে-গঞ্জে— সেটা সত্যিই বিস্মিত হবার মতো জিনিস। তরুণ শিল্পীদের ওর কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সে এতদিন নিজের অভিনয়ক্ষমতাকে কী করে ধরে রেখেছে— সত্যিই এটা শেখার বিষয়। এটা মোটেই ম্যাজিক নয়, এটা পরিশ্রমের ফল। এত অধ্যবসায়, এত বিচক্ষণতা সত্যিই ভাবা যায় না।

অনুপকুমারের শৈল্পিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করা আমার কাজ নয়— যাঁরা সমালোচক বা কমপারেটিভ স্টাডি করেন, এটা তাঁরা করবেন। আমি শুধু বলতে পারি, সে যে কতখানি ট্যালেন্টেড, তার পরিমাপ করা কঠিন। এ প্রসঙ্গে একটা কথাই বলব, অলরাউন্ড একটা ট্যালেন্টেড আর্টিস্ট বলতে যা বোঝায়, অনুপ তা-ই। অনুপ জীবনে এত বিচিত্র ধরনের চরিত্র করেছে, খুব কম অভিনেতার জীবনে এরকম সুযোগ আসে। একটাই আক্ষেপের কথা— আমাদের সময়ের যাঁরা বড়ো মাপের পরিচালক, তাঁরা যদি ওকে নিয়ে ছবি করতেন, ওর শৈল্পিক দক্ষতাটা তাহলে আরও বেশি প্রকাশ হত; এ আমার ধারণা। ও যত ধরনের চরিত্র করেছে— কি কমেডি, কি ট্র্যাজেডি, কি সিরিয়ো-কমিক— এত বিচিত্র ধরনের চরিত্র আর কোনও অভিনেতা করেছেন কি না আমার জানা নেই। অতীতে হয়তো করেছেন ভানুদা, জহরদা— কিন্তু ওর মতো এত বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ কেউ পাননি, আর সেখানে ও অত্যন্ত সফল। এটাই একজন অভিনেতার সবচেয়ে বড়ো সাফল্য যে তাকে যে কোনও চরিত্রই দেওয়া হোক না কেন, সেখানেই সে স্বত:স্ফূর্তভাবে নিজের ক্ষমতাকে প্রকাশ করতে পারে। দর্শকের ভালো লাগাটাই তো আসল; ওর যে জনপ্রিয়তা, সেটাই একজন অভিনেতার ইতিবাচক গুণ।

অবশ্যই অনুপকে লোকে বেশি চেনে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তবে অনুপ তো আসলে মঞ্চ থেকে উঠে এসেছে। মঞ্চই তার ‘পেরেন্টাল’ জায়গা, যেখান থেকে ও এসেছে। যেহেতু ও শক্তিশালী অভিনেতা, তাই পরে যে কোনও মাধ্যমকেই গ্রহণ করতে ওর অসুবিধে হয়নি। আর যে মুহূর্তে ও মাধ্যমটাকে হাতের মুঠোয় পেয়েছে, যেমন শুনেছি যাত্রাতেও— মাঠ একেবারে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। দর্শকের ভীষণ ভালো লেগেছে। এটাই তো মাধ্যমের ওপর দখল রাখা। কিন্তু মূল অভিনয়টা ও শিখেছে মঞ্চ থেকে। সেটা যখন কেউ শিখে ফেলতে পারে, তখন তার পক্ষে অন্য যে কোনও মাধ্যমে সফল হওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। আসলে মূল কথাটা হল অভিনয়শিক্ষা। শুনেছি অনুপ অনেক অল্প বয়স থেকেই ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছে। তারপর বড়ো বড়ো শিল্পীর কাছে শিখেছিল, সেটা তো বিরাট সৌভাগ্য। যা হোক, সিরিয়ো-কমিক, এমনকি সিরিয়াস চরিত্রেও আমি অনুপের কাজ দেখেছি—তরুণ মজুমদার-এর ছবিগুলোতে খুবই অসাধারণ অভিনয় করেছিল। অনুপের যে ট্যালেন্ট, তাতে কেন যে ওকে বারবার একই ধরনের চরিত্র দেওয়া হয়— এটা বিস্ময়ের বিষয়। ওর অভিনয় একেবারে ভিন্ন মাত্রা পেতে পারে যে অভিনয়ে, সেটা হচ্ছে সিরিয়ো-কমিক চরিত্রে, যেখানে কমেডি এলিমেন্টও থাকবে, আবার সিরিয়াস এলিমেন্ট দিয়ে শেষ হবে। এরকম চরিত্রে অভিনয় অনুপের অনেক দেখেছি এবং এখানে ওর যে ট্যালেন্ট, সেটা প্রকাশ করার অনেক সুযোগ থাকে।

অনুপকুমারের ওপর পূর্বসূরিদের কতখানি প্রভাব পড়েছে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আবারও বলছি, যে কোনও মানুষ কাজ করতে গেলে পূর্বসূরিদের ছাপ একটু পড়বেই—যেটাকে ইন্টেলেকচুয়ালি বলে ‘ক্লিশে’, সেটা কাটিয়ে ওঠা যায়। ওর আসল ব্যাপারটা হচ্ছে ওর জনপ্রিয়তা। আজকেও, ১৯৯৩-৯৪ সালেও যে ধরনের জনপ্রিয়তা ওর গ্রামে-গঞ্জে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও যেখানে সিনেমা দেখতে গেলেও চার কিমি দূরে গিয়ে দেখতে হয়, সেখানেও কিন্তু বাংলা ছবির একজনকে সবাই এক নামে চেনে—সে হচ্ছে ‘অনুপকুমার’। উত্তমদাকে তো সবাই চেনে, তা ছাড়া আগে আর একজনকে সবাই চিনত—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ভানুদার পরেই অনুপকুমারের জনপ্রিয়তা দেখেছি। সেটা তো তার নিজস্ব ক্ষমতা—ও সমস্ত ‘ক্লিশে’ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, সেটাই ওর ক্ষমতা। একটা ব্যাপার সত্যি, এতদিন পর্যন্ত একজন শিল্পীর পপুলারিটি লেভেলে যখন পারসিসটেন্স থাকে, তখন তার বিশেষ ক্ষমতা আছে বলতেই হবে, তা না হলে আজকের জেনারেশন তাকে গ্রহণ করছে কী করে— এই প্রশ্নই সবচেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়ায়।

অনুপের সামাজিক দায়বোধ, আমি ঠিক রাজনৈতিক দায়বোধ বলছি না, এক কথায় অসাধারণ। ব্যক্তিগত জীবনে এবং সিনেমার আশপাশের লোকজনের নানান কাজকর্মে, আমাদের সংঘের যে কোনও ব্যাপারে অনুপ সবসময়ে তার নেতৃত্ব দিয়েছে, সবাইকে সংঘবদ্ধ করেছে, আলোচনা করেছে। সামাজিক দায়িত্বটা ওর চিরকালই ছিল। এতগুলো বছর তো দেখে আসছি এবং এখনও দেখছি। এগুলো ভালো লাগে দেখতে— যে জন্যে অনেক অভিনেতা ‘জেঠু’ বলে ডাকে ওকে। ‘জেঠু’ শব্দের কিন্তু দুটো মানে আছে। ‘জেঠু’র একটা মানে অভিভাবক। তাই শুভেন্দুরা বলে, ‘কোনও কিছু ঝুটঝামেলা হলে জেঠুকে খবর দাও। জেঠু এলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ সেদিক দিয়ে ও ভীষণ দায়িত্ববান ছেলে।

আমি আর অনুপ যখন আলোচনায় বসি, পুরোনো দিনের অভিনয় সম্পর্কে আলোচনা করি, আমার খুব ভালো লাগে। ও পুরোনো দিনের সব গল্প করে, সেগুলো খুব ফ্যাসিনেটিং— ছোটোবেলার অভিজ্ঞতার কথা, যাদের কথা ও বলে, তাদের দেখিইনি স্টেজে কোনও দিন, আমার তাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও হয়নি কোনও দিন। তাই এসব পুরোনো কথা শুনতে আমার অসম্ভব ভালো লাগে। কোনও আজেবাজে আলোচনা করে না ও কখনও, অন্তত আমার সঙ্গে। গল্প করতে বসলে বেশির ভাগ সময়েই থিয়েটারের অভিনয় নিয়ে, তখনকার দিনের অভিনয় নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা করে। এখনকার ছেলেরা কী সব নানারকম করে-টরে, এরা বোঝেই না যে আমাদের মিডিয়ামটা হচ্ছে পপুলার মিডিয়াম। এখানে যদি অভিনয় করে দর্শককে আনন্দ দান না করতে পারি, তবে সবই বৃথা।

এভরিথিং উইল বি জাজড বাই টু-ডে’জ আফটারনুন অডিয়েন্স। অডিয়েন্স বা দর্শক যদি গ্রহণ না করে আমাকে, আমি যত বড়োই নিজেকে মনে করি না কেন, বা কাগজওয়ালারা আমাকে যতই দাম দিক না কেন, তার কোনও সার্থকতা নেই। যা হোক, সবচেয়ে বড়ো কথা, শৈল্পিক যে একটা বাড়াবাড়ি বা উন্নাসিকতা অনেকের মধ্যে থাকে তা একদম ওর মধ্যে নেই। সংযমশাসিত অভিনয়েরই অন্য নাম অনুপকুমার।

‘আনন্দ বৈরাগী’ : অনুপকুমারের অভিনয়-জীবনের পঞ্চাশ বছর (শিল্পায়ন, জুলাই ১৯৯৪)

টীকা

১) ভাদুড়িমশাই—নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি (১৮৮৯-১৯৫৯)। বাংলা নাট্যজগতে একজন যুগপ্রবর্তক। মেট্রোপলিট্যান কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। প্রথমে অপেশাদার থিয়েটার করলেও ১৯২৪ সালে পাকাপাকিভাবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে যোগ দেন। ‘সীতা’, ‘রঘুবীর’, ‘আলমগীর’, ‘নরনারায়ণ’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে অভিনয় ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে এক নবধারা আনেন। নাট্যদল নিয়ে আমেরিকা সফর করেছিলেন। চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। প্রসঙ্গত, উৎপল দত্ত তাঁর ‘সমাজ বিপ্লব গণনাট্য’ রচনায় শিশির ভাদুড়িকে ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় অভিনেতা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

২) দেবনারায়ণ গুপ্ত (১৯১০-২০০০)—এই বিশিষ্ট নাট্যকার-পরিচালকের জন্ম নদিয়ার রানাঘাটে। প্রথম জীবনে ‘ভাণ্ডার’, ‘ভারতবর্ষ’ ইত্যাদি নামি পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর আসেন নাট্যজগতে। টানা ২৩ বছর স্টার থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। নাট্যরূপ-নাট্যপরিচালনা-নাট্যরচনা সবমিলিয়ে অজস্র নাটকের জন্ম দিয়েছেন। ‘শ্যামলী’, ‘শর্মিলা’, ‘প্রেয়সী’, ‘সীমা’ ইত্যাদি এরকমই কিছু নাটক। চলচ্চিত্র-পরিচালনাও করেছেন।

৩) তরুণ মজুমদার—এক প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক। শচীন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে তৈরি করেন চিত্রপরিচালক গোষ্ঠী ‘যাত্রিক’। এই গোষ্ঠীর পরিচালনা করেন ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৫৯) ও ‘পলাতক’ (১৯৬৩)। এরপর গোষ্ঠী থেকে তরুণবাবু বেরিয়ে এসে ‘বালিকা বধূ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ফুলেশ্বরী, ‘গণদেবতা’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘দাদার কীর্তি’ ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় ছবি পরিচালনা করেন। হিন্দি ছবিও পরিচালনা করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *