মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

যাত্রা

যাত্রা

যাত্রা-যাত্রা-যাত্রা,

বহুকালের বাসনা ছিল এই জগৎটা দেখার। এল মাখন নট্ট—যাত্রা জগতের দিকপাল, বহু আলোচনার পর রাজি হলাম। পরিচয় হল পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ইনিও একজন দিকপাল যাত্রা জগতের লেখক/পরিচালক হিসেবে। কাহিনির সারাংশ শোনালেন। বুঝতে পারলাম না। কিছুদিন পর শোনালেন পালার প্রথম দিকটা। সেটাও কেমন যেন লাগল। জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ‘যাত্রার পালা নাকি হয় এইরকমই। আমাদের থিয়েটারে যা হয়,— যাত্রায় তা নাকি হওয়া উচিত নয়। মহলা শুরু হল— একটা দৃশ্য লেখা নিয়ে। অভিনেতা/অভিনেত্রী কেউ জানতে পারল না স্ব স্ব চরিত্র পুরো পালাটার। পরিচালকের কথা মতো যে যার চরিত্রের কথাগুলো আউড়ে যেতে লাগল। আবার জিজ্ঞাসা করলাম— এ কেমন ধারা। জবাব দিলেন ভৈরববাবু— এটাই নাকি যাত্রার নিয়ম। আশ্চর্য, শিল্পী তার চরিত্রে রূপ-রস না জেনেই মহলা দেবে? চলতে শুরু করলাম। আমার নিজের চরিত্রের মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না,— কিন্তু মহলা দিয়ে চলেছি। বহুকাল আগে গ্রুপ থিয়েটারে যেসব কোরিওগ্রাফি বা কম্পোজিশন করতাম সেগুলো দেখলাম ভৈরববাবুর পালায় হয়ে উঠেছে প্রধান অঙ্গ হিসেবে। যাত্রায় তো চারিদিকে লোক বসে তাহলে এই ধরনের composition চলে কী করে? জবাব যেটা পেলাম সেটা খুব জোলো। মহলা চলতে চলতে একদিন প্রশ্ন করলাম,— যে দৃশ্য থেকে দৃশ্যে যাচ্ছি কিন্তু তার কোনও link খুঁজে পাচ্ছি না। জবাব শুনে আমি হতবাক। বললেন যে মাঠের দর্শক যদি গল্প একবার বুঝতে পারে তাহলে উঠে পড়বে। সুতরাং প্রতিটি দৃশ্যতেই একটা আলাদা গল্পের স্বাদ আনতে হবে। আমার বহুদিনের ধ্যান-ধারণা একেবারে গুলিয়ে গেল। বৃহৎ দর্শকের কাছে আমার যাবার অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। অবশ্য থিয়েটারের ভঙ্গিতে। কিন্তু কখনও দর্শককে উঠে যেতে দেখিনি। যুক্তিটা মানতে পারলাম না। মহলা প্রায় শেষের দিকে,— তখনও শেষ দৃশ্য এসে পৌঁছোয়নি। জিজ্ঞাসা করতে জানলাম,— এটাই নাকি যাত্রার নিয়ম। বহুকাল আগে শুনেছিলাম, সিনেমায় নাকি এরকম হত। দিনের দিন scene লিখে আনা হত। Complete script বলে কিছু থাকত না। এখন এই কারবারটা একেবারেই চলে না। কিন্তু বর্তমান যাত্রা জগতে এসে দেখলাম সেই theory চালু আছে। মহলা প্রায় শেষ, শেষ দৃশ্য এল, পালা মঞ্চস্থ হবার দু’দিন আগে। শিল্পীদের নিষ্ঠা যাত্রা জগতে একটা দেখবার জিনিস। একদিনের মধ্যে এরা পার্ট মুখস্থ করে ফেলে। কথাগুলো ঠিক ঠিক আউড়ে যাওয়া এদের কাছে খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু দেখলাম কেউই নিজের নিজের চরিত্রের পরিধি অর্থাৎ dimension ধরতে পারছে না। কিন্তু পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী কথাগুলো চিৎকার করে উগড়ে যাচ্ছে। অবশেষে গল্পটা দাঁড়াল একটা high melodrama,— যার মধ্যে clymax-এর ছড়াছড়ি। এমন নয় যে, পরিণতিতে clymax ধরে ক্রমশ নাটক এগিয়ে যাচ্ছে। এই অঙ্কটা একমাত্র পাওয়া যায় কমার্শিয়াল হিন্দি ছবিগুলোতে। অর্থাৎ ক্রমশ দর্শককে গুলিয়ে গুলিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় যে লেখকের পক্ষে তখন ব্যাপারটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। মানে জড়িয়ে যাওয়া গল্পটাকে আর গুটিয়ে উঠতে পারে না। তখন যেমন তেমন করে একটা পালার পরিণতি টানতে হয়। প্রায়ই দেখা যায় যে, পরিণতির অনেক আগেই দর্শক নড়তে চড়তে শুরু করে। সাড়ে তিন ঘণ্টা বর্তমান যুগে একটু বেশি সময়। পালার সময়টা হওয়া উচিত আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। কারণ এত বেশি সময় ধরে কথার কচকচানি লোকের আর ভালো লাগে না। বড়ো কথা এত বলা হয়ে গেছে যে আর বড়ো কথা না বলাই ভালো। সাধারণ মানুষ যাত্রা দেখতে আসে একটু আনন্দ পাওয়ার জন্য। আনন্দ কম হয়ে যদি বাণী বেশি হয় তাহলে একটু পরে লোকের বিরক্তি এসে যায়। মাঠে মাঠে ঘুরে যেটা বুঝলাম সেটা হল—সাধারণ দর্শক যাত্রায় প্রথমেই চায় একটা নিটোল গল্প। সেই গল্পের সঙ্গে নটা রস—অর্থাৎ যেটাকে নব রস বলে— সেগুলোকে পেতে চায়। ছোটো রসের ব্যবহার, অতীব সূক্ষ্ম রসের ব্যবহার চলবেই না। কারণ, বর্তমান কালের আসরে দর্শক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় আট হাজার থেকে পনেরো হাজার পর্যন্ত। এত লোকের সমাগম সেখানে এবং সমাগমটা হেটেরোজিনিয়াস যখন তখন সূক্ষ্ম বা খুব সূক্ষ্ম কোনও কিছুই সেখানে কাজ করবে না।

সাধারণ মানুষকে নিয়ে যে যাত্রায় ব্যাপকভাবে একটা সৎ ব্যবসা হচ্ছে সেটা আমি মনে করি না। বর্তমান যুগটা একটা কিক-এর যুগ। সুতরাং এই কিকটা লোক কালচার বা যাত্রায় প্রবলভাবে ঢুকে গেছে। এখানে লেনিনের জীবনী থেকে শুরু করে মিথলজির কাহিনি পর্যন্ত দেখানো হয়। লোকশিক্ষা কতখানি হয় বলতে পারব না— তবে নিশ্চয়ই লোকরঞ্জন হয়। লোকরঞ্জন এবং লোকশিক্ষা এই দুয়ের মিল যেদিন হবে সেদিন যাত্রা হয়ে উঠবে সার্থক যাত্রা।

ব্যবসাঃ এমন একটা বৃহৎ এবং বিরাট ব্যবসা কোনও show business-এ নেই। বলা যেতে পারে যে মাটি থেকে টাকাগুলোকে চেঁচে তুলে নিয়ে যান এঁরা। গরিবদের জন্য ভেবে কোনও যাত্রার আসর তৈরি হয় না। বরং গরিবদের পকেটে যেটুকু আছে সেই শেষ সম্বলটুকুও নায়েকদের পকেটে চলে যায়। সবচেয়ে কম টিকিটের হার হয় এখানে সাত টাকার, জানি না এই টাকাটা গরিবদের পক্ষে বেশি না কম। শহরের থিয়েটারগুলোতে পাঁচ টাকার আসন থাকবেই। কিন্তু মাঠে ময়দানে প্রায়ই এই টিকিটের হার দেখা যায় না। হয়তো এমনও হতে পারে যে, নট্টর পালা যেদিন থাকে সেদিন টিকিটের হার বেড়ে যায়। কারণ নট্টকে নিতে হলে দিতেও হয় প্রচুর। Entertainment-এর ব্যাপারে গ্রাম বাংলায় এবং industrial town-এ, —বা coal belt-এ যাত্রাকে কেউ ঘায়েল করতে পারবে না। যাত্রার টানটা কেন এত বেশি সেটা কোনও তরুণ শিক্ষাবিদের research করা উচিত। সমস্ত ধ্যান-ধারণা এবং সংবাদপত্র পড়ে আছে শহরের বা রাজধানীর culture নিয়ে। আজ পর্যন্ত একজনও সাংবাদিককে দেখলাম না—এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা সমীক্ষা বের করতে। আমার নিজের এত বছরের culture কাজ কর্মে কখনও এই জিনিস দেখিনি। মাঠে না নামলে বোধহয় এই জ্ঞানটা অপূর্ণ থেকে যেত। এক একটা district—এক এক রকমের। তবে বিশেষ করে বলব— মেদিনীপুর district-এর কথা। এখানকার লোকেদের যাত্রা সম্পর্কে একটু বিশেষ ভালোবাসা আছে। যাত্রার আসরে এত শান্ত হয়ে বসে থাকতে এবং পালাকে উপভোগ করতে এঁদের তুল্য কেউ নেই। আর একটা জায়গা হচ্ছে coalbelt,— এই জায়গাগুলো একেবারে বড়োলোকদের। গরিবরাও কিছু আছে— কিন্তু বড়োলোকই বেশি। এখানে চেয়ারের দর্শক খুব বেশি। এই belt-টাতে বাংলা এবং বিহারের culture কেমন মিশ খেয়ে গেছে। বহু অবাঙালি যাত্রা regular দেখে থাকেন। এঁদের কাছে থিয়েটারের নীরস আস্বাদ-বিস্বাদের মতন। যাত্রায় যে একটা variety পাওয়া যায় সেটা আমাদের বর্তমান থিয়েটারগুলোতে একেবারেই নেই। থিয়েটারগুলো ‘বাবুদের’ সন্তুষ্ট করতে করতেই শেষ হয়ে যাবে। কলকাতার শহরের সেই ‘বাবু’ culture আর বোধহয় টিকবে না। কারণ শহর কলকাতাতেও যাত্রার দাপট ক্রমশই বাড়বার মুখে। যাত্রার ব্যাপারটাই হচ্ছে— high strung অর্থাৎ চড়া সুরে ধরা। বহু সময় দেখা যায় যে এই চড়া সুরের ধরতাই শেষ পর্যন্ত maintain করতে পারে না। তখন ব্যাপারটা একটু এলোমেলো হয়ে যায়। আমার মতে চড়া সুর এবং সূক্ষ্ম সুরের একটা সমন্বয় আনা যেতে পারে। তবে সেটা নিয়ে একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে।

ধারণাঃ যত জায়গায়, অর্থাৎ গ্রামে, গঞ্জে এবং Industrial town ও Coal belt-এ, দুটো poster খুব চোখে পড়ে। একটা হিন্দি ছবির এবং অন্যটা যাত্রার। বহু যাত্রা দলের poster poster-এ দেয়াল ছেয়ে গিয়েছে। যেমন ছেয়ে গিয়েছে হিন্দি ছবির poster-এ। কদাচ বাংলা ছবির poster এই সব জায়গায় দেখা যায়। আর একটা জিনিস, পত্র-পত্রিকার কোনও সাংবাদিককে এইসব জায়গায় বিচরণ করতে দেখা যায় না। এত বড়ো একটা মিডিয়াম প্রায় সংবাদপত্রের কাছে উপেক্ষিত। শহরে বসে সংবাদপত্র যে সমস্ত শিল্প medium-কে তোলবার চেষ্টা করছে বা প্রচার করার চেষ্টা করছে,— সেগুলো গ্রাম বাংলায় পৌঁছোবেই না কোনওদিন। আবার এসে পড়ছে সেই ‘বাবু’ culture। মধ্যবিত্ত কিছু সংগঠন চেষ্টা করছে শহরের থিয়েটারকে গ্রাম বাংলায় popular করার জন্য কিন্তু কোনওই ফল পাওয়া যাচ্ছে না। Popularity-র দিক থেকে যত থিয়েটারগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে, যাত্রা এগিয়ে যাচ্ছে ততোধিক পরিমাণে। একটা সময় আসবেই যখন শিক্ষিত সম্প্রদায়কে ভাবনা-চিন্তা করতেই হবে জনগণের মধ্যে পৌঁছোনো যায় কীভাবে। সংবাদপত্রের প্রচার মাধ্যম এবং লোকের মুখে মুখে ছড়ানো এই দুইয়ের মধ্যে তফাত প্রচুর।

সুতরাং শহরে বসে যদি কেউ ভাবেন যে আমার কাজের মাধ্যম ঠিকই আছে তাহলে বোধহয় বিরাট ভুল করবেন। বহুকাল আগে I.P.T.A.-এই জনগণের মাধ্যমে নেমেছিলেন,— কিন্তু আজ বহুদূরে চলে গেছে। এখন থিয়েটার আন্দোলন যারা করে তাদের তাকিয়ে থাকতে হয় সরকারি অনুদানের ওপর। জনগণের অনুদান না পেলে আমার ধারণায় সে কাজ ব্যর্থ।

পরিশেষে একটা কথা বলা দরকার। সেটা হল already popular বা বর্তমানে popular কোনও শিল্পীর পক্ষে যাত্রায় যাওয়া একটু অসুবিধে। Film glamour-এর জন্য দর্শকের চাপের সৃষ্টি হয় আসরে ঢোকা এবং বেরুনোর সময় তখন একমাত্র ঈশ্বরই সহায় থাকেন। একটা নিয়মিত protection-এর কোনও ব্যবস্থা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। সুতরাং film glamour রয়েছে এমন কোনও শিল্পীর যাত্রায় আসা একটু মুশকিল।*

* ডায়ারি থেকে, মে, ১৯৮৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *