মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

ফেলুদাদা ও লালমোহনবাবু

ফেলুদাদা ও লালমোহনবাবু

তখনও ফেলুদা’র প্রথম গল্পটা ‘ফেলুদার গোয়েন্দিাগিরি’ লেখা হয়নি, ফেলুদাদার সঙ্গে আমার আলাপ ১৯৬২ সালে। তারপর ঝাড়া ৩০ বছর ফেলুদাদার ভাবনা-চিন্তা ও কাজের সঙ্গে, আমার জীবনের স্বপ্ন আর বাস্তব ঘেঁটে গেল!

খুলে বলি ব্যাপারটা।

আমরা হলাম পূব বাংলার বরিশালের লোক, যদিও আমার জন্ম কলকাতায়। বাবা, কাকা, জ্যাঠামশাই সকলেই ছিলেন ছা-পোষা গেরস্ত। সকালের বাজারটা সেরে, সর্ষের তেল মেখে চান-টান করে, তরিবৎ করে ডাল-ভাত খেয়ে, ব্যাস, পান চিবুতে চিবুতে আপিসে যেতেন। এদিকে আমি কিন্তু ইশকুলের লেখাপড়াকে তাচ্ছিল্য করে, গল্পের বই আর নাটক-ফাটকেই মাথা ঘামালাম বেশি।

কিছু পাগল ছেলে জোগাড় করে দল পাকালাম। ‘বোম্বাট অ্যাসোসিয়েশন’ না কি যেন নামটা! সে দল উপে গেলে, আবার ক’জনকে জুটিয়ে ‘শনিচক্র’ বলে আর একটা ক্লাব খুললাম। দুটো গ্রুপেই নাটক-ফাটক যা কিছু করলাম, সবই এক্সপেরিমেন্টাল! একটা থাকে না কাঁচা বয়সে—ট্র্যাডিশনাল কিছু করব না, ব্রেক হবে। ডি. এল. রায়ের ‘সাজাহান’ করব স্টেজে, তা-ও একটু অন্য কায়দায়!

কী অক্লান্ত আর নিখুঁতভাবে রিহার্সাল দেবার চেষ্টা করতাম, যেন পরশুই প্লে! কিন্তু কোনও নাটকই স্টেজড হল না। তারজন্যে যে টাকাকড়ি দরকার, সেটা আমরা জোগাড় করতে পারিনি কিছুতেই। আমার জীবনে তখনও কোনও ফেলুদাদা আসেনি!

তবে নাটকের রিহার্সালের সময়টুকু বাদে, আমরা খুব ব্যস্ত থাকতাম সিনেমা-থিয়েটার নিয়ে গম্ভীর সব আলোচনায়। কী আলোচনা, ভগবান জানে! মাথা নেই, মুন্ডু নেই! তাবলে আমাদের সিরিয়াসনেস এবং গাম্ভীর্য কখনও এতটুকু টসকায়নি।

এমনকি আড়াই টাকার টিকিটে, বেঞ্চিতে বসে দেখলাম শিশিরকুমার ভাদুড়ির থিয়েটার। আজ কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়, ওখান থেকেই তো আমাদের স্বপ্ন দেখা শুরু! শিশির ভাদুড়ি, নরেশ মিত্তির বা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর একটা প্রভাব সরাসরি পড়ল। বিশেষ করে অ্যাক্টিং-এর টাইমিং।

তাছাড়া কাঁচা বয়সেই ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’তে ভিড়ে গিয়ে, আমাদের লাগাম-ছাড়া স্বপ্ন আরও মাথা-চাড়া দিল। পল মিউনি, চার্লস লটন, অলিভিয়ে বা রোনাল্ড কোলম্যান-এর ছবি দেখার পর বেশিরভাগ বাংলা সিনেমাই অসহ্য, কুচ্ছিৎ মনে হল। আর দেখলাম চ্যাপলিন-এর মাথা-ঘুরে-যাওয়া সব ছবি, নির্বাক ও সবাক। অবিশ্যি চার্লি চ্যাপলিনকে ঠিক ফেভারিট লেভেলে রাখি না। ওঁকে ধারণ করে রাখতে হয়!

সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কলেজে ঢুকেছি, ১৯৪৯ সাল, আচমকা আলাপ হল উৎপল দত্তের সঙ্গে। ভারী ইন্টারেস্টিং মানুষ। ভালো লেগে গেল। ক’দিন পরেই আমি আর আমার বন্ধু সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ঢুকে পড়লাম উৎপল দত্তের ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’-এর ইংরিজি সেকশনে। ইংরিজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করিনি, তাই বেজায় ভয় পেলাম। প্রথম দিনেই উৎপল দত্ত আমাদের ইংরিজি উচ্চারণের নমুনা নিলেন। সে এক কেলেঙ্কারি! কোনও কিছুই উচ্চারণ না-করে, কী আর বলব তোমাদের, স্রেফ লিপ-মুভমেন্ট দিয়ে গেলাম! তবু শেক্সপীয়ারের ‘ওথেলো’ নাটকে ছোট্ট একটা চরিত্রে অভিনয় করতে হল। কিন্তু উৎপল দত্তকে হরদম বোঝালাম, ইংরিজিতে নাটক-ফাটক করে কিস্যু হবে না। ফরফর করে যে ইংরিজি বলছেন, এ-দেশে বোঝে ক’জন?

‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’-এর বাংলা নাটকেও এন্তার পার্ট করেছি। কিছু মৌলিক নাটক, বেশিরভাগই অ্যাডাপটেশন, এমনকি বাংলায় শেক্সপীয়ার করলাম। প্রায় সবই ছোটোখাটো রোল, বড়ো চরিত্র চাইলাম না কখনও। যতটা পারা যায় অভিনয়টা এড়ানোর চেষ্টা! বসে বসে রিহার্সাল দেখতে দেখতে বা উৎপল দত্তের ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে, দিব্যি ‘থিয়েটার’ শেখা হয়ে গেল। কিন্তু ফেলুদাদার দেখা না-পেলে, আমার স্বপ্নের পৃথিবীকে চিনব কী করে?

উৎপল দত্তের পাঠশালায় বছর দশেক ছিলাম। তারই মধ্যে বায়োস্কোপে চান্স পেলাম, ১৯৫৯ সালে। কিন্তু সেভাবে আমাকে পাত্তা দিতে চাইলেন না বাংলা সিনেমার মস্ত পরিচালকরা। এদিকে পুলিশ কোর্টের কেরানির চাকরি আর পোষাচ্ছিল না। বছর ছয়েকের ফালতু চাকরিটা ঝপ করে ঝেড়ে ফেলার ক’দিন পরেই আচমকা পরপর বাবা ও জামাইবাবু মারা গেলেন। চারদিক থেকে সাংঘাতিক চাপে পড়লাম, বাপ রে, সে কী অর্থনৈতিক সংকট!

ইতিমধ্যে ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’-এর সঙ্গেও সম্পর্ক ঘুচে গেছে। সময়টা কীরকম যেন টানাপোড়েনের মধ্যে কাটতে লাগল। কোনও কিছুই ভালো লাগছিল না। সবই কেমন যেন তেতো! সিনেমা-থিয়েটার ঘিরে আমার সব স্বপ্নকে মাঝ-গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে, চাকরি-বাকরি যা-হোক কিছু জুটিয়ে কলকাতা থেকে কেটে পড়ার তাল খুঁজতে লাগলাম। হেনকালে ফেলুদাদার সঙ্গে আলাপ! নিম্ন মধ্যবিত্ত ছা-পোষা বাঙালি পরিবারে জন্মেও অনেক স্বপ্ন দেখা অতি সামান্য একটা ছেলে ‘আত্মহত্যা’ না করে, এ-জন্মের মতো ‘বেঁচে’ গেল।

সেটা ১৯৬২ সালের গোড়ার দিক। লোকে মোটেও চেনে-টেনে না আমাকে। বাসে-ট্রামে স্মার্টলি চড়ে বেড়াই। একদিন সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ দোতলা বাসে চেপে এসপ্ল্যানেড থেকে কালীঘাটে ফিরছি, বাসের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল ভানু ঘোষের সঙ্গে। ভানু আমার ছোটোবেলার বন্ধু, একসঙ্গে ইশকুলে পড়তাম। হাঁউমাঁউ করে ভানু বলে উঠল, ‘কোথায় ছিলি অ্যাদ্দিন? শিগগিরি চল, মানিকদা তোকে খুঁজছেন।’

ভানুর মানিকদা হলেন সত্যজিৎ রায়, আমার ফেলুদাদা। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার দলে ভানু তখন বে-পরোয়া প্রাোডাকশন ম্যানেজার। ওই রাত্তিরেই ভানুর সঙ্গে গেলাম লেক টেম্পল রোডের সেই তেতলার ফ্ল্যাটে।

কোনও ভূমিকা না করেই, আমার স্বপ্নের জগতে ঢোকার পাসপোর্টটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন ফেলুদাদা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে ‘অভিযান’ ছবি হচ্ছে, ট্যাক্সি-ড্রাইভার নরসিং হচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তার সাকরেদ রামা-র চরিত্রে আমাকে ভেবেছেন! উৎপল দত্তের নাটকে আমাকে দেখেছেন তিনি। ভানুর কাছে আমার বায়োডাটা পেয়েছেন। আমাকে আর একবার চাক্ষুষ দেখামাত্র, ফাইনাল সিলেকশন হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তেই, ফেলুদাদার মতো একজন বিরল মানুষকে আজীবনের বন্ধু পেলাম।

‘অভিযান’ থেকে ‘আগন্তুক’—৩০ বছরে সত্যজিৎ রায়ের সাতটা ছবিতে অভিনয় করেছি, খালি বাঘা বাইনের ভূমিকায় দু’বার। ভারী আশ্চর্য আর রহস্যময় এই পার্থিব জীবনে ‘বেঁচে’ থাকার অ-আ শিখেছি ফেলুদাদার কাছেই। তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করেই নিজেকে বারে বারে শুধরেছি, তিলে তিলে গড়ে তুলেছি, নিজেকে ‘মানুষ’ বানিয়েছি। এমনকি ও-রকম তুখোড় আড্ডাবাজ লোক, এ-জন্মে আর দেখলাম না!

ফেলুদাদার সঙ্গে সেই আড্ডার শুরু ১৭২ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটে, ‘সন্দেশ’-এর ছবির শুটিংয়ের সময়, ১৯৬২ সাল, ‘সন্দেশ’-এর আপিসটাই তখন সত্যজিৎ রায় প্রাোডাকসন্স-এর কার্যালয়। শুটিং না থাকলেও হরদম চলে যেতাম সেই ‘সন্দেশী’ গন্ধময় দোতলার আড্ডাখানায়। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই জমপেশ খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে কী রোমাঞ্চকর ফিল্মি আড্ডা! এমনও হয়েছে, আচমকা গিয়ে দেখি আপিস ফাঁকা, একমনে নিজের উপন্যাসের প্রুফ দেখছেন ‘সন্দেশ’ সম্পাদক সত্যজিৎ রায়! ওখানে ঝলমলে ‘সন্দেশী’-আড্ডাতেও বার কয়েক গিয়ে পড়েছি। পরে যখন ফেলুদাদার বাড়ির আড্ডায় পাকাপাকি ঠাঁই পেলাম, আমার স্বপ্নের পৃথিবীটা তিলে তিলে বাস্তবের মাটি পেল।

স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, জন্মগত দোষ-গুণ বা বংশধারার চাইতে, পরিবেশের প্রভাব বেশি জোরালো। …এ-কথাটা যে কত সত্যি, নিজের জীবনে দিব্যি টের পেয়েছি। নইলে বাজার করা, চান-খাওয়া-ঘুম, পান চিবুনো আর মাছি-মারা কেরানিগিরির বাইরেও যে পৃথিবীতে অনেক কাজ আছে, সেটাই তো জানতেন না আমার বাবা-কাকা-জ্যাঠারা। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই আমি খুঁজে পেয়েছি বা বানাতে পেরেছি সেই পরিবেশ, যেখানে আলো করে আছেন আমার কিছু বন্ধু ও প্রিয়জন, উৎপল দত্ত এবং আমার ফেলুদাদা সত্যজিৎ রায়।

কেন যে সত্যজিৎ রায়কে মনে মনে ফেলুদাদা বলে ডাকি, সেটা খোলসা করে বলা দরকার। ছোটোবেলা থেকেই আমি গল্পের বইয়ের সাংঘাতিক পোকা। রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, রাজশেখর বসু (পরশুরাম), সৈয়দ মুজতবা আলী আর লীলা মজুমদার হলেন আমার চিরকেলে প্রিয় সাহিত্যিক। ১৯৬০ দশকের গোড়ায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার দৌলতে, সেই তালিকায় জুড়ে গেলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর সব ছোটোগল্প, শঙ্কু-কাহিনি, তারিণীখুড়োর গল্প আর ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার বহুবার পড়েছি, বেশ ক’টা বই আমার হাতের কাছেই থাকে। সত্যজিৎ রায় যা হয়েছেন এবং আরও যা হতে পারতেন, কিন্তু কোনও কারণে বা নিজের ইচ্ছেতেই হননি, ফেলুদা তারই প্রতিচ্ছবি। ফেলুদার গল্প-উপন্যাসগুলো বারে বারে পড়তে বসে মনে হয়েছে—পারিবারিক পরিচয় সমেত, ফেলুদা লোকটা সত্যজিৎ রায়েরই দ্বিতীয় একটা সত্তার প্রাোজেকশন, অলটার ইগো!

ফেলুদার বাবা জয়কেষ্ট মিত্তিরের কথাই ধরা যাক। ভদ্রলোক ছিলেন অঙ্ক আর সংস্কৃতর মাস্টার। মুগুর-ভাঁজা শরীর। ক্রিকেট, ফুটবল, সাঁতার, কুস্তি—সব ব্যাপারে দুর্দান্ত। এ তো সারদারঞ্জন রায়ের বর্ণনা, যিনি সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের দাদা। জয়কেষ্ট মিত্তির ছিলেন দু:সাহসী। শেয়ালের গর্তে হাত ঢুকিয়ে, শেয়ালের বাচ্চা চুরি করতেন। কাঁচা বয়সে ঠিক এই কাণ্ডটাই করেছেন উপন্দ্রেকিশোরের ভাই কুলদারঞ্জন রায়। ফেলুদা ন’বছর বয়সে বাপকে হারিয়েছে, সত্যজিৎ রায় আড়াই বছরে। ফেলুদা মানুষ হয়েছে কাকার বাড়িতে, সত্যজিৎ রায় মামাবাড়িতে।

ফেলুদার হাইট কত? ছ’ফুট দু’ইঞ্চি। ছাতি? ৪২ ইঞ্চি। সুদর্শন, প্রখর দৃষ্টি, ভ্রূকুটি থেকেই বোঝা যায় বিরক্ত হয়েছে কিনা। চাপা উত্তেজনার সময় বাঁ-হাতের তেলোর চাপে ডানহাতের আঙুল মটকায়। মুখ দেখে মোটেই মনের অবস্থা ঠাওর করা যায় না। অনেক রাতে ঘুমোলেও, সূর্য ওঠার আগেই উঠে পড়ে। খাদ্যরসিক। সব রকম খাবারে সড়গড় হলেও, বাঙালি-খানাই বেশি পছন্দ। চায়ের সঙ্গে ডালমুট না-হলে চলে না। সেই ডালমুট আসে নিউমার্কেটের কলিমুদ্দির দোকান থেকে। বাইরে কোথাও গেলে, স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে ভোলে না। …ফেলুদার এতসব পরিচয়ের প্রায় সবই যে মিলে যাচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে!

ফেলুদা যোগব্যায়াম করে। সবচাইতে প্রিয় খেলা ক্রিকেট, স্লো-স্পিন বোলার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে একবার লখনউ, আর একবার বেনারসে খেলতে গেছে। একশো রকম ইন্ডোর গেমস জানে। তাসের ম্যাজিক জানে। রাইফেল কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিল। যুযুৎসু ও ক্যারাটেতে চৌকশ।

সত্যজিৎ রায়-ও শরীর ফিট রাখতে এককালে যোগব্যায়াম করতেন। দুর্দান্ত স্লো-স্পিন বোলার হিসেবে খেলেছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের হয়ে, এমনকি যদ্দূর জানি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলেও। তাসের ম্যাজিক বা একগাদা ইন্ডোর গেমসেও তেমনি ওস্তাদ। রাইফেল কম্পিটিশনে ফার্স্ট না হলেও, ছোটোবেলায় বন্দুক ছোঁড়ায় তুখোড় ছিলেন। ক্যারাটে শেখেননি, কিন্তু যুযুৎসু-চর্চায় মেতেছেন কাঁচা বয়সে।

ফেলুদার মতোই সত্যজিৎ রায়কে দেখেছি গুন-গুন করে সুর ভাঁজতে, খালি গলায় গান গাইতে। বাংলা স্বরলিপি আর সব রাগ-রাগিনীও তেমনি মুঠোয়। ফেলুদার মতোই চমৎকার ছবি আঁকার হাত। একবার দেখেই সেই লোকটার ফাটাফাটি পোর্ট্রেট আঁকতে পারতেন। পুরোনো দুষ্প্রাপ্য বই ও পুরোনো পেন্টিংয়ের প্রিন্ট সংগ্রহের বাতিক, প্রকৃতি চর্চা, নানারকম বই পড়ার অভ্যেস, বইয়ের যত্ন—সবই তো মিলে যাচ্ছে। পুরোনো আসবাব ও পুরোনো পোর্সিলিন, বাংলা ও ইংরিজি টাইপোগ্রাফি, লেখালেখির শখ, ধাঁধা-হেঁয়ালি-ক্রশওয়ার্ড পাজল কিংবা গ্রিক ভাষার চর্চা—সবেতেই দু’জনেই বেশ বড়ো। এমনকি ভালো এবং মন্দ সিনেমার চিত্রনাট্যের কী তফাত, তাতেও দু’জনেরই টনটনে জ্ঞান!

পুরোনো নিউমার্কেটের বাড়িটা ভেঙে ফেলা, শহিদ মিনারের চুড়োয় লাল-রং করা কিংবা দূরদর্শনে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ খামচে দেখেই ফেলুদা মহা বিরক্ত, সেটা যে আসলে সত্যজিৎ রায়েরই মনের ভাব—বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। দু’জনেই ভারী আত্ম সচেতন। সহজে ঘাবড়াবার পাত্র নন। দুর্দান্ত রসবোধ, তীক্ষ্ণধী, সময়নিষ্ঠ। দু’জনেরই ধারণা, মনটা খোলা না-রাখলে, মানুষকে বোকা বনতে হয়!

দু’জনের মধ্যে যেটুকু অ-মিল, তারও ন্যায্য কারণ আছে। সত্যজিৎ রায় যে-সব বিষয়ে জানতেন না, বা জানলেও চর্চার অভাবে মুঠোয় নেই, অথচ সে-সব বিষয়ে জানা বা শেখার আগ্রহ কখনও টসকায়নি, সেই সমস্ত বিদ্যেতেও ফেলুদাকে তিনি দক্ষ করে তুলেছেন। সুযোগ বা সময়ের অভাবে যে-সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি সত্যজিৎ রায়ের, ফেলুদার মধ্যে তিনি সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো মিটিয়ে নিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের একগাদা দু:খ ভুলিয়েছে ফেলু মিত্তির।

মোট কথা, ফেলুদাকে যেহেতু নিজেরই আদলে গড়েছেন সত্যজিৎ রায়, নিজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচি ও রসবোধকে ঢেলে দিয়েছেন ফেলুদার মধ্যে, তাই ফেলুদা-কাহিনি পড়তে বসলে কিংবা সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ফেলুদাকে দেখলেও, আমার মন জুড়ে দেখতে পাই সত্যজিৎ রায়কে। তার চেয়েও বড়ো কথা, সেই ফেলুদাদার কাছেই আমার জীবনের তিরিশটা বছর কেটেছে। ফেলুদাদার কাছেই আমি ‘মানুষ’ হয়েছি। আমার স্বপ্ন আর বাস্তবের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লাগসই ছন্দটাকে চিনতে শিখেছি।

ফেলুদা ক’জন হতে পারেন? ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা— ফেলুদার আপামর ভক্তরা বেশিরভাগই দেখি হতে চায় ফেলুদার সহকারী তোপসে। যদিও বাস্তব-জীবনে তোপসে হয়ে ওঠাও চাট্টিখানি কথা নয়। ছেলেটা কী বুদ্ধিমান, চৌকশ, তেমনি ধারালো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। বই পড়তে ভালোবাসে। চমৎকার বাংলা ও ইংরিজি জানে, বেড়ে লেখে গল্পগুলো।

তোপসেনয়, আমি বরং নিজেকে খুঁজে পাই লালমোহনবাবু-র মধ্যে। আমি তো ওরকমই ছা-পোষা গেরস্ত ঘরের লোক, সব-সময় যোগ্য মানুষের কাছে কিছু শেখার আগ্রহ, ওরকমই ফুর্তিবাজ, আড্ডা-রসিক। জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলি হলেন ফেলুদার একমাত্র খাঁটি বন্ধু, আমি অবিশ্যি ততটা ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে পারিনি ফেলুদাদার। তবে আমার মিডিয়ামে আমিও একজন ‘বেস্ট সেলার’, রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের মতো হাস্যরসের অভিনয়ও আম-জনতার সঙ্গে অতি সহজে সাঁকো বানায়। এমনকি নিজের কাজে হরদম ভুল করে, আমিও গাদা গাদা ‘শিক্ষা’ নিয়েছি আমার ফেলুদাদার কাছে।

দুই ফেলুদাদারই রসবোধ, বুদ্ধি-শুদ্ধি বা মাপটা, এক্সসেলেন্সটা আর সবার থেকে আলাদা থাকের, অন্য পর্যায়ের। উপেন্দ্রকিশোর, কুলদারঞ্জন, সুকুমার ও সুবিনয় রায় থেকে পূণ্যলতা চক্রবর্তী, সুবিমল রায়, লীলা মজুমদার, কল্যাণী কার্লেকর১০—সেই পারিবারিক ট্র্যাডিশন বজায় রেখে, কিংবা রক্তের ধারায় ব্যাপারটা আরও বেড়ে গিয়ে, সত্যজিৎ রায় ওরফে ফেলু মিত্তিরের জীবনে ও কাজে, মেলামেশা ও স্বপ্নে অমন যে সরসতার নদী, তার তুলনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল! সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে, বৈদগ্ধ আর ক্যালিগ্রাফিতে, ইনলাসট্রেশন ও প্রচ্ছদপটে, সাহিত্য আর সংগীতে সবচেয়ে জোরালো যে গুণপনা—সেটা আর কিছু নয়, স্রেফ সরসতা! এমন ফেলুদাদার পাল্লায় পড়ে, আমার হাস্যরসময় অভিনয় জীবনটা যে বর্তে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!

একটা চরিত্রকে ঘিরে দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা, বাংলা সিনেমায় খুব কম অভিনেতাই পেয়েছেন। যেমন ‘গুপী গাইন’ তপেন চট্টোপাধ্যায় বা ‘মন্দার বোস’ কামু মুখোপাধ্যায়১১, তেমনি ‘জটায়ু’ সন্তোষ দত্ত১২। কী আর বলব, সন্তোষ দত্ত হলেন একেবারে অরিজিন্যাল, আর কারও মতো নয়, সবার থেকে আলাদা। তাঁর অভিনয়ে ভ্যারাইটি এবং ডেপথ, দুটোই বেশি। দিব্যি চরিত্রের অনেক গভীরে ঢুকতে পারতেন। সেন্স অব টাইমিংটা দারুণ। খুব পাওয়ারফুল, বড়ো অভিনেতা। মাথা ঘামিয়ে অভিনয় করতেন। তেমনি রসবোধ, চাঁচাছোলা, স্পন্টেনিয়াস।

অবিশ্যি সন্তোষ দত্ত অভিনীত কী চমৎকার সব চরিত্র ছাপিয়ে, ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই তিনি চিরকেলে লালমোহনবাবু! অমন আশ্চর্য অভিনয়-প্রতিভায় সন্তোষ দত্ত যেমন আদ্যোপান্ত জটায়ু হয়ে গেছিলেন, তেমনি গল্পের জটায়ুকেও সন্তোষ দত্ত হয়ে ওঠার জন্য তিলে তিলে নিজেকে বদলাতে হয়েছে, সেটা খেয়াল করেছ?

১৯৭১ সালে ফেলুদার যে উপন্যাসে জটায়ুর আবির্ভাব, সেই ‘সোনার কেল্লা’য় জটায়ুর চেহারার বর্ণনা দিয়েছে তোপসেঃ ‘অত্যন্ত নিরীহ, রীতিমতো রোগা, আর হাইটে নির্ঘাত আমার চেয়েও অন্তত দু’ইঞ্চি কম।’ এক্ষুনি ‘সোনার কেল্লা’ বইয়ের পাতা উলটে দ্যাখো, সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবিতে লালমোহনবাবুর কেমন রোগা টিংটিঙে চোহারা, মাথায় চুল, চোখে চশমা, গোঁফ-টোফ নেই! তার মানে, ফেলুদার গল্প নিয়ে ছবি করার ভাবনাটা তখনও পাকেনি। অন্তত জটায়ুর চরিত্রে সন্তোষ দত্তকে ভাবা হয়নি। এদিকে আমি তখন নিজেকে সিনেমার জটায়ু ভেবে বসে আছি, যদিও ফেলুদাদাকে সে কথা বলার সাহস নেই!

১৯৭২ সালের ফেলুদা-উপন্যাস ‘বাক্স রহস্য’তে তোপসের বর্ণনায় জটায়ুর শরীরটা ‘চিমড়ে’ হলেও সঙ্গে ইলাসট্রেশন দেখে বেজায় ভড়কে গেলাম! লালমোহনবাবু মোটেই চিমড়ে নন, বেশ স্বাস্থ্যবান! নাকের ডগায় চশমা থাকলেও, কপাল চুল কমে গেছে!

তারপর ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ (১৯৭৩) উপন্যাসে তোপসে লিখেছে, ‘ভদ্রলোকের চোহারা বেশ খোলতাই হয়েছে।’ ছবিতে দেখি, ‘খোলতাই’ চেহারা তো বটেই, তবে জটায়ুর চোখে চশমা নেই, আতিপাতি খুঁজে দেখলাম—তোপসে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। কাণ্ড দেখে আমার থুতনি ঝুলে পড়ল, কিন্তু ফেলুদাদাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হল না। ১৯৭৪-এর ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’তে, আহা, লালমোহনবাবু আবার চশমা এঁটেছেন। অবিশ্যি তদ্দিনে চরিত্রটা আমার কাছ থেকে বেমালুম ফসকে গেছে!

মনে আছে, ১৯৭৩ সালের পুজোর সময় গুজব শুনলাম, ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে জটায়ু সাজবেন সন্তোষ দত্ত। ক’দিন পর দেখি সত্যি তাই, জোর কদমে শুটিং শুরু হয়ে গেল। আর ১৯৭৪-এর বড়োদিনে ছবিটা রিলিজ করতেই সন্তোষ দত্তের নাম পাকাপাকি লালমোহন গাঙ্গুলি হয়ে গেল!

তখন মনে খটকা লাগল! তাহলে কি ১৯৭২ সালে ‘বাক্স রহস্য’ লেখার সময়েই সন্তোষ দত্তের কথা মনে এসেছিল ফেলুদাদার? তাই অতি গোপনে পাঠকদের খুব একটা টের পেতে না দিয়ে জটায়ুকে সন্তোষ দত্ত বানাবার কাজ শুরু করেছিলেন? মোটকথা, ১৯৭৫ সালের উপন্যাস ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ লালমোহনবাবু পুরোপুরি সন্তোষ দত্ত বনে গেলেন! সেই টাক, সেই গোঁফ, সেই চেহারা! ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাসে জটায়ু পরতেন শার্ট-প্যান্ট, এখন বেশিরভাগ সময় ধুতি-পাঞ্জাবি!

ধরো, আজ যদি হঠাৎ সন্দীপ রায় বলে বসেন, ফেলুদার অমুক গপপোটা ছবি হচ্ছে, আমাকে জটায়ু সাজতে হবে? হলপ করে বলতে পারি—সন্তোষ দত্তের লালমোহনবাবুকে মাথা থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তোমরাও পারবে না, আমিও না।

‘সন্দেশ’ পত্রিকা : ফেলুদা সংখ্যা (অগ্রহায়ণ ১৪০২)

টীকা

১) ফেলুদা—সত্যজিৎ রায়ের লেখা রহস্য গল্পের গোয়েন্দা। অসম্ভব জনপ্রিয় পাঠকসমাজে। ভালো নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্র। প্রথম ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিতের কাহিনি—’ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। যা ১৯৬৫-৬৬ সালের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

২) ‘সন্দেশ’ পত্রিকা—এক ঐতিহ্যশালী জনপ্রিয় ছোটোদের পত্রিকা। ১৯১৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদনায়। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র সুকুমার রায় সম্পাদনা করেন। ১৯২৩ সালে সুকুমারের অকালপ্রয়াণের ফলে তাঁর ভাই সুবিনয় রায় ‘সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। কিন্তু মাত্র দু’বছর (১৯২৩ থেকে ১৯২৫) স্থায়িত্ব পায় পত্রিকা প্রকাশ। অনেক পরে ১৯৬১-তে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায় যৌথভাবে সম্পাদনা করে নতুন করে ‘সন্দেশ’ প্রকাশ করেন। পরে সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন লীলা মজুমদার ও নলিনী দাস। সেই থেকে নানা সম্পাদক পালটে আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে এই পত্রিকা। বর্তমানে পত্রিকার সম্পাদক সন্দীপ রায়।

৩) সারদারঞ্জন রায় (১৮৫৯-১৯২৬)—উপেন্দ্রকিশোরের বড়দা। গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। অসামান্য ক্রিকেটার। বাংলার ক্রিকেটের শুরু এবং প্রসারের ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছিলেন। জন্মস্থান বাংলাদেশের মসুয়ায় থাকাকালীনই ক্রিকেট খেলার শুরু। দীর্ঘ শ্মশ্রু-গুম্ফ সংবলিত অসাধারণ ক্রিকেটার সারদারঞ্জনকে ‘বাংলার ডব্লিউ. জি. গ্রেস’ বলা হত। ১৯২০ সালে ‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব’ তৈরি হলে তার প্রথম সভাপতি হন সারদারঞ্জন রায়।

৪) কুলদারঞ্জন রায় (১৮৭৩-১৯৪৮)—উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আপন ভাই। বাবার নাম শ্যামসুন্দর রায় (মুন্সি)। কুলদারঞ্জন ছিলেন একাধারে ফোটোগ্রাফার, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সুলেখক। এছাড়া দুর্ধর্ষ ক্রিকেট খেলতেন। হকি খেলাতেও পারদর্শী ছিলেন। ছোটোদের জন্য তাঁর অনুবাদ ‘আশ্চর্যদ্বীপ’, ‘অজ্ঞাতজগৎ’, ‘বাস্কারভিলের কুকুর’ ইত্যাদি আজও জনপ্রিয়। এছাড়াও লিখেছিলেন, ‘ছোটোদের বেতালপঞ্চবিংশতি’, ‘কথাসরিৎসাগর’, ‘ছেলেদের পঞ্চতন্ত্র’ ইত্যাদিও।

৫) ‘তোপসে’—সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা গল্পের গোয়েন্দা ফেলুদার সহকারী ও তাঁর খুড়তুতো ভাই। পুরো নাম তপেশরঞ্জন মিত্র। এরই বয়ানে ফেলুদা-কাহিনিগুলি রচিত।

৬) ‘লালমোহনবাবু’—ফেলুদা-কাহিনির সবচেয়ে আকর্ষক ও জনপ্রিয়তম চরিত্র। পুরো নাম ‘লালমোহন গাঙ্গুলি’। ‘জটায়ু’ ছদ্মনামে রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের গল্পলেখক। এনার বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হট কেকের মতো বিক্রি হয়ে যায়। বইগুলির নামও অদ্ভুত—’দুর্ধর্ষ দুশমন’, ‘সাহারায় শিহরণ’, ‘হণ্ডুরাশে হাহাকার’ ইত্যাদি। ‘সোনার কেল্লা’ কাহিনিতে প্রথম এনার আবির্ভাব। বুদ্ধিমান, কিন্তু সব ব্যাপারে অতিরিক্ত উৎসাহের ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সব গণ্ডগোল করে ফেলেন। অসম্ভব মজাদার ও আকর্ষণীয় চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনেতা সন্তোষ দত্ত-র অভিনয় ইতিহাস হয়ে আছে।

৭) সুবিনয় রায় (১৮৯০-১৯৪৫)—উপেন্দ্রকিশোরের চতুর্থ সন্তান। ভালো গান গাইতে পারতেন। ছোটোদের জন্য অনেক কিছু লিখেছেন। দাদা সুকুমার রায়ের ১৯২৩ সালে অকালমৃত্যু হলে, দু’বছর (১৯২৩-১৯২৫) ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সুবিনয় রায় রচিত বইগুলির মধ্যে ‘আজব বই’, ‘খেয়াল’, ‘কাড়াকাড়ি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৮) পূণ্যলতা চক্রবর্তী (১৮৮৯-১৯৭৪)—উপেন্দ্রকিশোরের মেয়ে। বই লিখেছেন ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’, ‘ছোট্ট ছোট্ট গল্প’, ‘একাল যখন শুরু হল’ ইত্যাদি।

৯) সুবিমল রায় (১৮৯৭-১৯৭৪)—ডাক নাম ‘নানুক’। উপেন্দ্রকিশোরের পঞ্চম সন্তান। ইনি ছিলেন উদ্ভট রসের ভাণ্ডারী। সুবিমল রায়ের লেখা ‘প্রেতসিদ্ধের কাহিনি’ বইটি শিশুসাহিত্যের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় গ্রন্থ। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। পড়াতেন মির্জাপুর স্ট্রিটস্থ (বর্তমান সূর্য সেন স্ট্রিট) সিটি ইস্কুলে।

১০) কল্যাণী কার্লেকর (১৯১১-২০০২)—পূণ্যলতা চক্রবর্তীর মেয়ে। উপেন্দ্রকিশোরের নাতনি। সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। সারাজীবন নানারকম সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে নিজের সমাজসেবামূলক সংস্থা ‘ক্যালকাটা সোশ্যাল প্রজেক্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। গোবিন্দ বিষ্ণুকার্লেকরকে বিবাহ করেন।

১১) কামু মুখোপাধ্যায়—প্রতিভাবান অভিনেতা। প্রথম অভিনয় করেন ‘কখনো মেঘ’ (১৯৬৮) ছবিতে। অচিরেই সত্যজিৎ রায় ইউনিটের অপরিহার্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। ‘সোনার কেল্লা’-র ‘মন্দার বোস’ চরিত্রাভিনয় তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে অনেকগুলি চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। এছাড়া ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘হংসরাজ’, ‘ফটিকচাঁদ’, ‘মর্জিনা আবদুল্লা’ ইত্যাদি বেশ কিছু ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। টেলিভিশন-সিরিয়াল ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’-তে তিনি অভিনয় করেছিলেন।

১২) সন্তোষ দত্ত (১৯২৫-১৯৮৮)—অবিস্মরণীয় অভিনেতা। কলকাতায় জন্ম। পেশায় উকিল ছিলেন। মহারাষ্ট্র নিবাস হলে ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ নাটকে ‘ভবদুলাল’ চরিত্রে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দেখে সত্যজিৎ রায় ১৯৫৮ সালে তাঁর ‘পরশপাথর’ ছবিতে একটি ছোটো চরিত্রে তাঁকে সুযোগ দেন। যদিও সন্তোষ দত্ত-র প্রথম চিত্রাবতরণ ঘটে ‘দিনের পর দিন’ (১৯৪৯) ছবিতে। এছাড়া ‘হেডমাস্টার’, ‘তিনকন্যা’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘যদুবংশ’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘চারমূর্তি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। সত্যজিতের দু’টি ফেলুদা চিত্রে ‘জটায়ু’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সন্তোষ দত্ত সম্ভবত সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়ে আছেন দর্শকমনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *