মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

অপরাজিত ‘মানিকদা’

অপরাজিত ‘মানিকদা’

একটা মানুষ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রশান্তিতে না পৌঁছতে পারে তাহলে সে খুবই দুর্ভাগা। আর যিনি ক্রমশ উত্তীর্ণ হন এবং প্রশান্তিতে চলে যেতে পারেন তিনি ভাগ্যবান। মানিকদা হলেন তেমনি একজন ভাগ্যবান লোক। তিনি ক্রমশ উত্তীর্ণ হচ্ছেন এবং প্রশান্তিতে চলে যাচ্ছেন। ‘শাখা-প্রশাখা’ দেখার পর আমার এইরকম একটা ধারণা হল। ধারণাটা আরও দৃঢ় হল ‘আগন্তুক’-এ কাজ করে এবং পুরো স্ক্রিপ্টটা শুনে। মানুষের মনটাকে কোথায় যেন মানিকদা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন বহু বিদগ্ধ জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে—যাঁরা একবাক্যে বলেছেন, ‘শাখা প্রশাখা’ দেখার পর সত্যজিৎ রায়কে আবার নতুন করে আবিষ্কার করা গেল। ‘আগন্তুক’ স্ক্রিপ্টের শেষের দিকটায় সত্যিই দর্শকরা চোখের জল রাখতে পারবেন না।

১৯৬১/৬২ সালে প্রথম মানিকদার সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখা হয় এবং ছবির কাজের ব্যাপারে কথা হয়। ছবির নাম ‘অভিযান’। ভানু ঘোষ-এর সঙ্গে রাস্তায় দেখা, সে বলল, ‘মানিকদা তোকে খুঁজছে।’ বাস—সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলাম। এর আগে মানিকদাকে বহুবার দেখেছি—কিন্তু সব সময় একটু তফাৎ থেকে। দেখলেই মনে হত ভীষণ গুরুগম্ভীর এবং রাশভারী। সব সময় মনে হত হয়তো আমাদের মতো লোকদের সঙ্গে কথাই বলবেন না। কিন্তু সব ধারণাটাই কেটে গেল সেই সন্ধের প্রথম সাক্ষাতেই। যেভাবে মানিকদা ঘরের ভেতর ঢোকবার জন্য আপ্যায়ন করলেন সেটা আমার আজও মনে আছে। মনে হল একজন খাঁটি উন্নত বাঙালি দেখলাম। এক মুহূর্তে আমার মনে হল যেন আমার মানিকদার সঙ্গে বহুদিনের আলাপ। মানিকদার ছবিতে যে কোনও শিল্পীই যে দারুণ অভিনয় করেন তার প্রধান কারণ হচ্ছে মানিকদা নিজে। এত সহজ করে দেন শিল্পীকে যে সেই শিল্পীর অজান্তেই ভালো কাজটা বেরিয়ে আসে। মানিকদা পরিচালক—কিন্তু কখনই ডিকটেটর নন। অনেক পরিচালকই (ভালো) দেখেছি যারা অযথা শিল্পীকে অ্যান্টাগোনাইজ করে ফেলেন এবং তাতে শিল্পীর কাজও খারাপ হয়ে যায়।

১৯৬১/৬২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একাধিক ছবিতে মানিকদার সঙ্গে কাজ করেছি। প্রতি ছবিতেই একটা করে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। উইট এবং হিউমার মানিকদার নখের ডগায়। এমন সূক্ষ্ম সব কাজ দেখান যেটা করতে বেশ বেগ পেতে হয়, কিন্তু করার পর প্রচণ্ড আনন্দ হয়। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে এরকম কত যে মজার মজার মুহূর্ত ছিল সেগুলো এখন নস্টালজিয়ার মতো মনে হয়। ‘গুপী-বাঘার’ কথা তো ছেড়েই দিলাম। এই ছবিটা যেন মনে হয় সর্বকালের। আবার ‘জন-অরণ্যের’ মতো ছবির কথা ভাবলে মনে এখনও একটা চাঞ্চল্য অনুভব করি। এই ছবিতে অভিনয় পদ্ধতিটা একেবারেই ভিন্ন-ধর্মী ছিল। অভিনয় যে কতখানি অন্তর্মুখী হতে পারে এই ছবিতে অভিনয় করার সময় সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। এক কথায় মানিকদা যখন অভিনয় করে দেখান তখন মনে হয় যেন মানিকদা ভারতবর্ষের এক নম্বর অভিনেতা।

মানিকদার ওপরে কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নেই। তাই আমার কাজের অভিজ্ঞতার কথাই লিখলাম। দেশে-বিদেশে মানিকদাকে নিয়ে প্রচুর বই লেখা হয়েছে এবং আরও হবে। এইটাই স্বার্থপরের মতো আমার সান্ত্বনা যে সেখানে দু-একটা কথা আমার সম্বন্ধে থাকবেই। বিদেশে মানিকদার সঙ্গে ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত থেকেছি। সেসব জায়গায় ওনার স্থান যে কত উঁচুতে সেটা নিজের চোখে দেখে এসেছি। মানিকদারই এক বন্ধু (আর. পি. গুপ্ত) কথায় কথায় বলেছিলেন যে তিনজন বাঙালিকে নিয়ে আমরা বিশ্বের দরবারে গর্ব করতে পারি বর্তমানে, তার মধ্যে একজন হলেন মানিকদা—অপর দু’জন হলেন রবিশঙ্কর এবং নীরদ সি. চৌধুরি।

গুণ বা উপাধি পাওয়া লোক আমরা অনেক পাই এবং পাবও। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা কাজের মানুষও হওয়া চাই। মানিকদা হচ্ছেন খুব কাজের মানুষ, যাঁকে উপযুক্ত সময় এবং উপযুক্ত স্থানে ডাকলেই পাওয়া যায়। কিন্তু কোনও ফালতু ডাকে মানিকদা কখনই সাড়া দেবেন না। এই জন্যই আমার মনে হয় মানিকদা যেন ‘রেঁনেসা’ যুগের শেষ প্রতীক।

সত্যজিৎ রায় সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি
(বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড, সেপ্টেম্বর ১৯৯২)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *