বাংলা ছবিতে হাসি
‘বাংলা ছবিতে হাসি’—এই বিষয়টা খুব একটা ভেতরে ঢোকার মতো বিষয় নয়। কারণ হাসির ছবির খুব একটা ধারাবাহিক মুভমেন্ট বাংলা ছবিতে দীর্ঘদিন নেই। খুব বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এখন হাসির ছবি করে থাকেন সাধারণভাবে যাঁরা হাসির ছবি সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না বা জানেন না। একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় বহু পরিচালকের মুখে যে—’ভাবছি এবার একটা হাসির ছবি করব।’ এত সহজে এবং সারল্যের সঙ্গে কথাগুলো বলেন যে শুনলে মনে হয় সব চেয়ে সোজা হাসির ছবি করা। অথচ বিলি ওয়াইল্ডারকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আপনি ব্যাঙ্গাত্মক ছবি করা ছেড়ে একেবারে সিরিয়াসধর্মী ছবি করেন কেন? উত্তরে তিনি ব্যাঙ্গাত্মক ছবির প্রসঙ্গে বলেছিলেন—’To make such films is more challenging.’ কিন্তু বাংলায় হাসির ছবি করার সময় এই ধরনের মনোভাব কারও থাকে না। তাই সত্যিকারের হাসির ছবি এখানে এত দীর্ঘদিনে মাত্র কয়েকটা হয়েছে। তাও সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরিচালকরা হলেন সবাই প্রথম শ্রেণির। দু-একজন হয়তো ছিটকে একটা বা দুটো মোটামুটি ভালো হাসির ছবি করে ফেলেছেন। কিন্তু এই হাসির ছবি করার ব্যাপারে কেউ স্পেশালাইজ করেননি। স্পেশালাইজ করেন না—তার কারণ হয়তো, ‘হাসির ছবি’ করার জন্য যে পরিমাণ পড়াশোনা, ধ্যান-ধারণা দরকার সেটা কারও আয়ত্তে নেই বা আয়ত্তে আনবার আগ্রহও নেই। তার চাইতে একটা প্যাচপেচে কান্না, অতিনাটক এবং সঙ্গে মাঝেমধ্যে একটু রগড় দিয়ে বাজার তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ একটা হাসির ছবি করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এখানে কখনওই হয়নি তেমনভাবে। তবুও যা কিছু হয়েছে আজ পর্যন্ত তাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় :
১) ইনটেলিজেন্ট অর্থাৎ বুদ্ধিদীপ্ত হাসির ছবি।
২) সামাজিক বক্তব্যওয়ালা হাসির ছবি।
৩) কেবলই স্থূল ঘটনা দিয়ে তৈরি হাসির ছবি।
প্রথমেই বলা দরকার, হাসির চল কতখানি রয়েছে আমাদের দেশে। আমার ধারণায় খুব বেশি নয়। লোকসংখ্যার অনুপাতে দেখা যাবে বেশিরভাগ লোকই একটু কাঁদতে ভালোবাসে। কান্নাটা আমাদের এখানে একটা কাল্ট-এ পরিণত হয়েছে। সর্ব ব্যাপারেই আমরা একটু কেঁদে নিতে পারলে শান্তি পাই। বোধহয় একটা ইকনমিক ব্যালান্স সমাজে না এলে মানুষের মধ্যে হাসির ইচ্ছাটা তেমনভাবে আসে না। বহু শাস্ত্রকাররা হাসিকে নিন্দনীয় পর্যায়ে ফেলে দিয়েছিলেন; অর্থাৎ সমাজে কুলটা নারী এবং নিম্নবর্ণের লোকেরাই হাসি-ঠাট্টা করবে এবং বাকিরা গুরুগম্ভীরভাবে থাকবে। বর্তমানেও যে হাসির প্রবাহ আমরা দেখি সেটাও ঊনবিংশ শতাব্দীর খিস্তিখেউড়ের থেকেই এসেছে। সেই সময় কর্তাদের (বাবু-কালচার) এবং তাঁদের সাহেব প্রভুদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কিছু হাসির সরঞ্জাম তৈরি করা হত। যদি বলা হয় বর্তমান যুগটা রবীন্দ্রত্তোর যুগ তাহলে আমার একটু খটকা লাগবে। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর পরিবারবর্গের লোকেরা ইনটেলিজেন্ট হাসির খোরাক প্রচুর জুগিয়েছেন এ দেশে। কিন্তু কী হল? সমস্ত ব্যাপারটাই এখন সীমাবদ্ধ রবীন্দ্রসদনে, টিভিতে এবং অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে। সাধারণের মধ্যে কতখানি ঢুকতে পারল? আমি মাঠে-ঘাটে শিল্প-কর্ম করে বেড়াই—কদাচ, রবীন্দ্রনাথকে শুনতে পাই। দেখতে তো পাইই না। ছবি করা হয় সাধারণ দর্শকদের কথা চিন্তা করে, সুতরাং সাধারণ দর্শকের রুচির কথাটাও সেখানে এসে পড়ে। সেই খিস্তি-খেউড় থেকে খুব একটু বেশি এগুতেও কিন্তু আমরা পারিনি—তাই বেশিরভাগ হাসির ছবি বলতে যেগুলোকে আমরা বুঝি সেগুলো হাস্যস্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা সম্পূর্ণভাবে আমার ব্যক্তিগত মত। একটা সোসিও-পলিটিক্যাল অবস্থা স্টেবল না হলে সমাজে লোকের গ্রহণ শক্তি বাড়ে না। এটা শিক্ষিত লোকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোথায় যেন একটা ভয় মনের মধ্যে উঁকি মারতে থাকে—ফলে অনেক ঘটনা দেখেও হাসতে ভরসা পায় না। ধরুন না, এই যে আমাদের দেশে একটা বিরাট হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল—সেটার একটা বিরাট সিরিয়াস দিক আছে। আবার একটা বিরাট হাসির দিকও রয়েছে। হাসির দিকটা হল—প্রশাসন ব্যবস্থা—ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট—মহা মহা গোয়েন্দাদের কার্যকলাপ। এইসব লোকদের চলাফেরা-চিন্তাভাবনা-কার্যকলাপের পদ্ধতি খুবই সিরিয়াস—কিন্তু তবুও দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘরের লোকের হাতে গুলি খেয়ে মারা যান, এটার চাইতে হাস্যস্পদ ঘটনা ভারতবর্ষে আর কিছু নেই। প্রথম কথা, এই পারস্পেকটিভ থেকে ছবি করতে কেউ ভরসাই পাবে না। যদি করে—ডিস্ট্রিবিউটার ছবি নেবে না। যদিও ডিস্ট্রিবিউটার ছবি নেয় এক্সিবিটার ছবি দেখাবে না। যদি এক্সিবিটার ছবি দেখায় প্রশাসন এসে বন্ধ করে দেবে। সুতরাং হাসির ছবি এদেশে হওয়া খুব কঠিন।
‘হীরক রাজার দেশে’ ছবি দেখে বহু রাজনৈতিক নেতারা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কেননা ‘মগজ ধোলাই’ ব্যাপারটা খুব পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছিল ছবিতে। এটা বহু লোকই ভালো চোখে দেখেনি। সাধারণ মানুষ গান এবং হালকা হাসির দিকটাই বেশি গ্রহণ করেছিল। আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে এবং তাই দেখে আমিও উপভোগ করছি—এ অবস্থাটা আমাদের এখানে আসতে অনেক দেরি।
সুতরাং বাংলা ছবিতে ‘হাসি’—বলতে গেলে বেশ হাতড়াতে হয় কী লিখব তাই নিয়ে। বাংলা ছবিতে হাসিকে ব্যবহার করা হয় ক্যাটালিটিক এজেন্ট হিসেবে। অর্থাৎ ভীষণ সিরিয়াস ছবি—ভীষণ কান্না—ভীষণ নাটক কিন্তু তবুও ঝুলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ঠিক এই ঝুলে যাওয়া মুহূর্তগুলো বাঁচাবার জন্যই হাসিকে ব্যবহার করা হয় বাংলা ছবিতে। মাত্র হাতে গোনা যায় এমন কয়েকজন বাদে প্রায় সব পরিচালকই এটা করে থাকেন। আমি নিজে কমেডি রোল করে থাকি—সুতরাং এ সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। সারা বছরে বেশিরভাগ ছবিই আসে, যেখানে একটু হাসাবার দায়িত্ব আমার থাকে। আর কাঁদাবার দায়িত্ব সবার—মানে যৌথভাবে সবাই কাঁদাবার দায়িত্ব নেন। হাসিকে এইরকম অবিবেচকের মতন ব্যবহার করা হয় বাংলা ছবিতে। আবার হাসির জোগান দেওয়া হয় এমন সব চরিত্রের মাধ্যমে যেগুলো হয় চাকর—কিংবা ঠাকুর—কিংবা বাচাল। ইদানীং ওড়িয়া চরিত্র নিয়ে হাসাহাসিটা একটু কমেছে। সব সময় দেখা যাবে চতুর্থ শ্রেণির চরিত্রগুলো নিয়ে হাসির খোরাক তৈরি করা হয় বাংলা ছবিতে। বহুবার বহু পরিচালককে এই প্রশ্ন করায় তারা সঠিক কোনও জবাব দিতে পারেনি। এটা অক্ষমতা না সামাজিক কোনও নিষেধ ঠিক বুঝতে পারি না। আমার মনে হয় সামাজিক বিধি-নিষেধ। প্রতিষ্ঠিত বা অর্থের দিক থেকে সফল কোনও চরিত্র নিয়ে ব্যঙ্গ বা হাসির কিছু করতে আমাদের বাংলা ছবির পরিচালকরা বোধহয় দ্বিধা বোধ করেন। তাই এখানে হাসির ঘটনা ঘটায়—হয় একজন বাড়ির চাকর—কিংবা একজন তোতলা বন্ধু—কিংবা একজন মোটা অন্য সম্প্রদায়ের চরিত্র। একজন মন্ত্রীর কার্যকলাপ—বা প্রশাসনের বড়ো কর্তারা বা বিরাট পয়সাওয়ালা লোক—কিন্তু রুচিহীন বা এমন কিছু সমাজের কর্তারা—যাঁদের নিয়ে প্রচুর হাসির খোরাক রোজই আমরা কাগজে পড়ি—এই শ্রেণিদের নিয়ে কখনই হাসির ঘটনা ঘটে না বাংলা ছবিতে। ‘রাজা’কে এবং তার পারিষদবর্গকে নিয়ে মানিকদা ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে যে পরিমাণ হাসি জুগিয়েছেন—তা এস্টাব্লিশমেন্টের বহু জনেরই ভালো লাগেনি। আমি নিজেই যে কত রকমের চাকরের পার্ট করেছি তার কোনও ইয়ত্তা নেই। হয় চাকর—হয়তো সহৃদয় এক বন্ধু—যাঁর বুদ্ধি কম—কিংবা বেশি চালাক এবং যে অকারণে ছবিতে আসে এবং অকারণে মিলিয়ে যায় ছবিতে। সাধারণভাবে বাংলা ছবিতে হাসি এইভাবেই তৈরি হয়।
প্রথম শ্রেণির যে হাসির ছবি বললাম তার সংখ্যা বড়োই কম। সেই ‘রজত জয়ন্তী’— তারপর ‘বরযাত্রী’—তারপর ‘পরশ পাথর’ এবং তারপর কী, মনে পড়ছে না আর। এগুলো উইট এবং হিউমার-এর পর্যায়ে পড়ে। এই ছবিগুলোর মধ্যে বুদ্ধির ছাপ বেশ রয়েছে। সিচুয়েশনও অত্যন্ত পরিষ্কার এবং স্মার্ট। তবে এগুলো সর্বজনগ্রাহ্য কিনা বলতে পারব না। উইট এবং হিউমার বুঝতে গেলে বোধহয় শিক্ষার একটা ব্যাপার এসে পড়ে। অর্থাৎ শিক্ষিত এবং রুচিবান দর্শক ছাড়া এর পূর্ণ রস সবাই বুঝতে পারবে না। শুধুই পাণ্ডিত্য থাকলে চলবে না। সঙ্গে একটু রসবোধও চাই। উইট এবং হিউমার কিন্তু আবার ভিন্ন ধরনের হয়। শিক্ষিত এবং রুচিবান এবং সম্পদওয়ালা লোকজনদের উইট এবং হিউমার এক ধরনের। মধ্যবিত্তদের উইট এবং হিউমার আবার একটু অন্য ধরনের। আবার সাধারণ গ্রাম বাংলার উইট এবং হিউমার আর এক ধরনের। আবার সবার ওপরে এক ধরনের উইট এবং হিউমার আছে সেটা সব শ্রেণিকেই আনন্দ দিতে পারে। যার একমাত্র অধিকারী ছিলেন চ্যাপলিন। কিন্তু স্লিক ছবি বলতে যা বোঝায় বাংলায় সেগুলো খুবই কম হাসির ব্যাপারে। ওপরে যে ছবিগুলোর নাম করলাম সেগুলোকে স্মার্ট এবং স্লিক বলা যায়।
এর পরের পর্যায়ে যে ছবিগুলো আসে—তার মধ্যে খানিকটা সামাজিক বক্তব্য থাকে। যেমন—’যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’১, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ বা আর অন্য কোনও ছবি এই ধরনের। এই ছবিগুলোকে শুধুই হাসির ছবি বলা যাবে না। এই ছবিগুলো পূর্ণাঙ্গ হাসির ছবি। কিন্তু একটা কটাক্ষ রয়ে গেছে গল্পের মধ্যে। মাঝে মাঝে সুন্দর স্ল্যাপস্টিকের ব্যবহারও আছে। অভিনয় এসব ছবিগুলোতে বেশ উঁচু পর্যায়ের হয়। অর্থাৎ হাসির ছবিতে বিশেষভাবে যেটা প্রয়োজন সেটা হল টাইমিং-পজ-গ্যাপ। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এগুলোকে খুব স্লিকধর্মী বা শুধুমাত্র উইট এবং হিউমার-এর ছবি বলা যায় না। আমি নিজে একটা পূর্ণাঙ্গ হাসির ছবি করেছিলাম—’সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’।
প্রধানত স্ল্যাপস্টিককে ভিত্তি করে। বিগ গ্যাংস্টারইজমকে ব্যঙ্গ করে ছবিটা করা হয়েছিল। এই ছবিটাও এই দ্বিতীয় পর্যায়ে পড়ে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের হাসির ছবির মোটামুটি একটা চাহিদা প্রায় সব শ্রেণির মধ্যেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই ছবিগুলো দেখলে কখনই খুব ঝকঝকে তকতকে মনে হয় না। একটু কোথাও যেন কিছু অগোছাল রয়ে যায়। এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ হাসির ছবিও খুব কমই হয়েছে এখানে।
তৃতীয় পর্যায়ের ছবি অর্থাৎ নিছকই হাসির ছবি হয়েছে প্রচুর। এই ছবিগুলো করার পিছনে কোনও অঙ্ক নেই। আমাদের বহু পরিচালকের ধারণা (ইদানীং ডিস্ট্রিবিউটারতাড়িত) কয়েকজন নামকরা কমেডিয়ানদের নিয়ে একটু হাত-পা নাড়াচাড়া এবং মাঝেমধ্যে কিছু চটুল বাক্যের প্রয়োগ করতে পারলেই লোক বা দর্শক খুব হাসবে। এই অঙ্ক বেশিরভাগ সময়ই নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয় আবার কয়েকটা লেগেও যায়। যেমন—’পাশের বাড়ি’২, ‘কানামাছি’৩ ইত্যাদি। এই ছবিগুলো প্রচুর ব্যবসা করেছিল। কিন্তু এইসব ছবিগুলোতে কোনও বুদ্ধির ছাপ বা শিল্পগত কোনও ছাপ পাওয়া যায় না। ছবি করার পেছনে সবচাইতে বেশি যাঁর অবদান—তিনি হলেন পরিচালক। এই ধরনের ছবিতে পরিচালকের চাইতে প্রাধান্য বেশি পায় অভিনেতারা অর্থাৎ কমেডিয়ানরা। এই ধরনের কিছু ছবিতেও আমি কাজ করেছি। অভিজ্ঞতা যা সঞ্চয় করেছি সেটা নিদারুণ।
শাস্ত্রকারদের কথা এখনও সত্য প্রমাণ হয়। তাঁরা বলতেন—তিন শ্রেণির দর্শক আছে—১) রাজন্যবর্গ, ২) বিদ্বৎজন, ৩) নাগরিক। এই তিন শ্রেণিরই তিন রকমের রসবোধ। হাস্যরস তাই তিনজনের কাছে তিনভাবে পৌঁছোয়।
বাংলা ছবিতে হাসির ব্যবহার দেখে বর্তমান রাজ্যবর্গরা মোটেই মাথা ঘামান না। বর্তমান রাজন্যবর্গরা যদি দেখেন যে তাঁদের বিপরীত পক্ষকে নিয়ে কোনও ব্যঙ্গবিদ্রুপ হচ্ছে তাহলেই তাঁরা ছবির রস গ্রহণ করেন। কিন্তু এই ধরনের হাসির ছবি বাংলায় বিরল। দু-নম্বর হল বিদ্বৎজন অর্থাৎ ইনটেলকচুয়ালরা। সংখ্যায় এঁরা এতই কম যে এঁদের ভেবে বাংলায় হাসির ছবি খুবই কম হয়। শেষে রইল নাগরিক অর্থাৎ সাধারণ দর্শক। ছবিতে হাসি বা হাসির ছবি মূলত করা হয় এদের কথা ভেবে। এরা চায় ‘রগড়’। সেই রগড়টাও স্লিকভাবে পরিবেশন করা যায় ছবির মাধ্যমে কিন্তু আমাদের পরিচালকেরা এই স্লিক কথাটাকে কোনও পাত্তাই দেয় না। হাসির ছবিতে ক্যামেরার কাজ এবং শট ডিভিশনই বিশেষভাবে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ বাংলা হাসির ছবিগুলোই তৈরি হয়েছে নিম্নমানের কারিগরি গুণ দিয়ে।
আমাদের বিষয় ছিল বাংলা ছবিতে হাসি। বাংলা ছবিতে হাসিকে কখন কীভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেটা আগেই বলেছি। পূর্ণাঙ্গ হাসির ছবি বাংলায়—তাও খানিকটা আভাস দিলাম। এবার হাসিকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা কতখানি এখানে হয় সেটা একটু বলা দরকার। বাংলা ছবিতে হাসির খোরাক জোগায় কমেডিয়ানরা। এমন ছবি এখানে কেউ ভাবেই না যেখানে গল্পটাই রাখা হবে কমেডি ফর্ম-এর মাধ্যমে। দু-একবার এই ধরনের কাহিনি নিয়ে ছবি করেছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। কিন্তু সেখানে সামাজিক কোনও ঘটনাকে ব্যঙ্গ করে নয়। নিছকই মনগড়া কীর্তি একটা উইসফুল থিংকিং-এর গল্প। যেমন ‘দাদার কীর্তি’৪ বা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’। এই ছবিগুলোর মধ্যে টেকনিক্যাল পলিশ খুব সুন্দর রয়েছে—কিন্তু বিষয়ের দিক থেকে খুব একটা স্ট্রং নয়। একটা দুরূহ বিষয় যেটা সবাই খুব সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা করছে সেটাকে নিয়ে কমেডি করার ক্ষমতা এখানে প্রায় দেখাই যায় না। আমাদের সমস্ত বাংলা বায়োস্কোপ জগতে একটা কথা চালু আছে যে ‘দাদা শেষে একটু চোখের জল ফেলবার চেষ্টা করবেন।’ ‘চোখের জল’ বাংলা ছবির একটা ক্যাপিটাল। এর কারণটা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। আগেই বলেছি—’ভয় এবং সংশয়’ আমাদের কাছে বিরাট বাধা—হাসির ছবি করার ক্ষেত্রে। আর এক ধরনের ছবি হয়েছে বাংলা ছবিতে সেটা খানিকটা সিরিয়ো কমিক। এই ধরনের ছবিতে হাসির অংশ বেশ খানিকটা থাকে কিন্তু গল্পের মোড় অবশেষে নেয় অন্য দিকে। বাংলায় সিরিয়ো কমিক ছবি অনেক আছে—সেগুলোকে বেশ সাকসেসফুলও বলা চলে। কিন্তু আমাদের বিষয় সেটা নয়। আমাদের বিষয় হল—’বাংলায় হাসির ছবি’ বা বাংলা ছবিতে হাসি।
একটা ভিন্ন স্বাদের ছবি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই ছবিটির নাম ‘জন-অরণ্য’। এটা যে ডার্ক কমেডির পর্যায়ে পড়ে সেটা একমাত্র বিদেশের ক্রিটিকরাই বলেছিল। এই ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম। আজ পর্যন্ত এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। হাসির মাধ্যমে যে একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের চেহারাকে দেখানো যায় সেটা মানিকদা দেখিয়েছেন। প্রথম দৃশ্যেই পরীক্ষার হলে শিক্ষক ঘুমোচ্ছেন—ছাত্ররা টুকছে। শিক্ষক তাকালেন এবং বললেন—’কী হচ্ছে ভাই’। জবাব এল ছাত্রদের থেকে—’পরীক্ষা হচ্ছে ভাই’। এইখানে প্রচুর হাসি ওঠে দর্শকের মধ্যে—কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা ভীতিরও সঞ্চার হয়। অর্থাৎ লেখাপড়ার হাল আমাদের কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই ছবিটা রিলিজ না-করতে দেবার জন্য তৎকালীন সরকার প্রচুর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি কারণ ছবিটা ‘সত্যজিৎ রায়ের’ বলে।
প্রসঙ্গত একটা কথা বলি—সেটা হল আমাদের সাংবাদিকদের কথা। এঁরা অধিকাংশই কমেডি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সব সময় এই রসটাকে স্থূল রস বলে লিখে রেহাই পান। কমেডিটা যে একটা ফর্ম এবং তার একটা স্ট্রাকচার আছে—কালার আছে—শেড আছে সেটা প্রায় কোনও সাংবাদিকেরই কিন্তু জানা নেই। অন্তত তাদের মন্তব্য পড়ে আমার তাই মনে হয়েছে। ধরুন ‘জন-অরণ্য’ যে একটা ডার্ক কমেডি সেটা এখানকার কোনও সাংবাদিকই লিখতে পারেনি। ধরুন ‘গল্প হলেও সত্যি’ যে একটা সামাজিক স্যাটায়ার সেটা কোনও সাংবাদিকই লেখেননি। ধরুন ‘অরণ্যের দিন-রাত্রি’ যে একটা নিট-স্ল্যাপস্টিক রোম্যান্টিক কমেডি সেটা কেউ লিখতে পারেনি। ধরুন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ বা ‘হীরক রাজার দেশে’ একটা মিউজিক্যাল স্যাটায়ার সেটা কেউ মন্তব্য করেনি।
অবশ্য লিটল ম্যাগাজিনে যদি কেউ লিখে থাকেন সঠিক মন্তব্যগুলো—তাঁর কথা বলতে পারব না। দৈনিক পত্রিকা বা সাপ্তাহিক কোনও কাগজে আমি হাসি সম্পর্কে কোনও সঠিক মন্তব্য আজও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। সব সময়ই হাসি ব্যাপারটাকে এখানে সাংবাদিকরা দেখেন সেই পুরোনো শাস্ত্রকারদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। যেন হাসির ব্যাপারটা নিয়ে বেশি কিছু মন্তব্য করলে জাতে ছোটো হয়ে যাবেন। সেই পুরোনো বক্তব্য আমার—অর্থাৎ ইকনমিক একটা স্টেবিলিটি না হলে হবে না। হাসির ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন— ঠাকুর বাড়ি, সুকুমার রায়। পরবর্তীকালে রাজশেখর বসু৫ প্রমুখেরা। ইদানীং সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়৬ বেশ ভালো। কিন্তু সাংবাদিকরা যেই এঁদের লেখা ছবিতে দেখবেন তখন তাঁরা কেমন গুটিয়ে যাবেন। এটা আমার মতে এক ধরনের অক্ষমতা। যদি মনে করেন আমি মোটামুটি হাস্যরস পরিবেশন করতে পারি—তাহলে আমার মন্তব্য শুনুন—ভালো কি মন্দ কোনও হাসির ছবি করে আমি কোনও দিন কোনও সাংবাদিকের সুমন্তব্য পাইনি। তাঁদের মন্তব্যর ভিতর দিয়ে কখনও তাঁরা বলেন না যে এই হাসির ছবিটা কোন সংজ্ঞায় পড়ে। অর্থাৎ ফর্ম স্ট্রাকচার মুড ইত্যাদি নিয়ে কখনই তাঁরা লিখতে পারেন না। বাংলাদেশে হাসির ছবি করলেও তার কোনও সঠিক সমালোচনা হয় না। এটা আমার মতে একটা অক্ষমতা সাংবাদিকদের তরফ থেকে। অথচ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘জন-অরণ্য’-র হাসির ব্যাপার নিয়ে যে সব বিদেশি সমালোচনা পড়েছি সেটা সত্যিই মনে রাখার মতো।
পরিশেষে বলব মিউজিক্যাল কমেডির কথা। মিউজিক্যাল কমেডি হয়তো এখানে হয়েছে কিন্তু তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কিছু মনে পড়ছে না গত বিশ বছরের মধ্যে। একমাত্র ‘গুগাবাবা’ বা ‘হীরক রাজা’ ছাড়া আমার এই মুহূর্তে আর কোনওটাই মনে পড়ছে না। বাংলাদেশ গানের দেশ অথচ পুরোপুরি গানকে ভিত্তি করে একটা হাসির ছবি করা এখানে খুব কমই হয়। আমার নিজের খুব ইচ্ছে আছে একটা ডার্ক কমেডি করবার। আমার চারপাশের পরিস্থিতি একটু সুবিধেজনক হলেই শুরু করব।
(১৯৮৬ সালে সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা আয়োজিত ঋত্বিক স্মারক বক্তৃতায় রবি ঘোষ লেখাটি পাঠ করেন।)
টীকা
১) ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ একটি জনপ্রিয় হাসির সিনেমা। যা অনেক বিষয়ে নজর দেওয়ায় আমাদের। অনন্ত সিংহ (‘চট্টগ্রাম বিদ্রোহ’ খ্যাত) প্রযোজিত প্রফুল্ল চক্রবর্তী পরিচালিত ও শ্যামল মিত্র সুরারোপিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৮। মুখ্য চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এ ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেন। ছবির কাহিনিকার ছিলেন অভিনেতা হিসেবে পরিচিত গৌর শী।
২) সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত জনপ্রিয় কমেডি ছবি ‘পাশের বাড়ী’ মুক্তি পায় ৭ মার্চ ১৯৫২। সলিল চৌধুরী সুরারোপিত অসামান্য গানগুলি গেয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয়ে ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপ্তি রায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
৩) ‘টাস ইউনিট’-এর পরিচালনায় শৈলেশ দে-র কাহিনিনির্ভর ‘কানামাছি’ ছবিটি মুক্তি পায় ৮ ডিসেম্বর ১৯৬২। ছবিতে সুরারোপ করেন নচিকেতা ঘোষ এবং চিত্রনাট্য লিখেছিলেন মৃণাল সেন। অভিনয়ে ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, জহর রায়, পাহাড়ি সান্যাল, অনুপকুমার, পদ্মা দেবী, সুনন্দা ব্যানার্জি, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ।
৪) শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনিনির্ভর তরুণ মজুমদার পরিচালিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত ‘দাদার কীর্তি’ ছবিটি মুক্তি পায় ২৯ নভেম্বর ১৯৮০। তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবশ্রী রায়, অনুপকুমার, কালী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনীত ছবিটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়।
৫) রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০)—বর্ধমানের এক গ্রামে জন্ম এই প্রখ্যাত সাহিত্যিকের। রসায়নে এম.এ সঙ্গে আইন পাশ করেছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালে উচ্চপদে চাকরি। ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে রঙ্গ-ব্যঙ্গ হাস্যরসের গল্প লিখে বিখ্যাত। বন্ধু যতীন্দ্রনাথ সেনের অলঙ্করণের সঙ্গে পরশুরামের গল্প এক অন্য মাত্রা নিত। ‘রাজশেখর বসু’ নামে দু’টি কালজয়ী সৃষ্টি—’চলন্তিকা অভিধান’ ও ‘মহাভারত’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিভাষা সংসদের সভাপতি ছিলেন। অনেক প্রবন্ধও লিখেছেন।
৬) সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়—১৯৩৬-এ জন্ম এই জনপ্রিয় সাহিত্যিকের। মূলত হাস্যরসাত্মক রচনার জন্যই পরিচিত। ‘শ্বেতপাথরের টেবিল’ নামে গল্পটি এই লেখককে প্রথম আলাদাভাবে চেনায়। ‘লোটাকম্বল’ নামে উপন্যাসটিই তাঁর প্রথম দীর্ঘ রচনা, যা তাঁকে ঔপন্যাসিক হিসেবে জনপ্রিয় করে। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁর অনেক বইয়ের মধ্যে ‘কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই’, ‘লোটাকম্বল’, ‘রসেবশে’, ‘স্বামী বিবেকানন্দ এক অনন্ত জীবনের জীবনী’, ‘ভৈরবী ও শ্রীরামকৃষ্ণ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।