মঞ্চ ও পর্দা
ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত
পরিশিষ্ট ১
পরিশিষ্ট ২

কমেডি বা হাস্যরস

কমেডি বা হাস্যরস

কমেডি বা হাস্যরসকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা কিন্তু সহজসাধ্য নয়। প্রয়োজন সুদক্ষ চালকের। সে গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেই হোক, আর চিত্র-মঞ্চেই হোক। প্রয়োজনের একটু বেশি হলেই কমেডির সার্থকতা ক্ষুণ্ণ হয়। হয় সৌন্দর্যহানিও। সে অবশ্য সব কিছুর বেলাতেই। বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে যথার্থ রূপ থাকে না। কমেডির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হলে তাকে ঠিক কমেডি বলা যায় না। বাংলায় একটা শব্দ আছে— ‘ভাঁড়ামো’। কমেডি তখন ভাঁড়ামোতে রূপান্তরিত হয়। জোর করে হাসানোর প্রচেষ্টা চলে। আমি নিজেকে একজন চরিত্রাভিনেতা বলে মনে করি। মঞ্চ থেকে এসেছি। মঞ্চে সব চরিত্রেই ছিল অবাধ গতি। ফিলমের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম। প্রথম ছবি ‘অভিযান’ থেকে আমি কমেডিতে সাকসেসফুল। একনাগাড়ে কমেডি অ্যাক্টিং করে চলেছি। বাংলা ছবির কমেডিয়ান রূপে চিহ্নিত হয়ে গেছি। অবশ্য কমেডি অ্যাক্টিং আমার ভালো লাগে। আমাদের আগে যাঁরা বাংলা ছবির কমেডিয়ান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে নবদ্বীপ হালদার, তুলসী চক্রবর্তী, ভানু ব্যানার্জি, শীতল ব্যানার্জি—অভিনয়ের গুণে আজও উজ্জ্বল। তবে সে সময়ের থেকে আমাদের সময়ে কমেডি অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, ভানুদার বাঙাল ভাষায় বা শীতলদার গলার স্বরে সে সময় দর্শকরা কমেডি খুঁজে পেত। আমাদের সময়ে কিন্তু এগুলো ঠিক চলেনি। আমার ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘গুগা বাবা’, ‘গল্প হলেও সত্যি’— সবই কমেডি। প্রত্যেকটা চরিত্রের ইমেজ আলাদা। চরিত্রগুলোতে কাজ করে তৃপ্তি পেয়েছি। একেকটা চরিত্র একেকটা অ্যাঙ্গলের। প্রত্যেকটা চরিত্রের আলাদা লক্ষণ আছে। আছে টোটাল ছবিগুলোতে একটা সুন্দর বক্তব্য। এই চরিত্রগুলো রূপায়ণের জন্য আমাকে ভাবতে হয়েছে, অনুশীলন করতে হয়েছে। ‘গল্প হলেও সত্যি’র চরিত্রটাতে এত শেডস আর কালার রয়েছে যে ভাবিয়ে তুলবেই। আমি মঞ্চেও নিয়মিত কমেডি অ্যাক্টিং করে থাকি। এখন সৌমিত্রর ‘ঘটক বিদায়’ করছি। বিদেশি কাহিনি থেকে নেওয়া। সৌমিত্র এত সুন্দর সাজিয়েছে যে দর্শকরা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে। অভিনয় করেও ভালো লাগছে। দীর্ঘদিন অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে যেটুকু বুঝেছি, যে আমার কমেডি দর্শকদের গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমি কখনও প্রয়োজনের অতিরিক্ত করি না। ভালোও বাসি না। এ জন্য মানিকদাও আমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। আমি চরিত্র রূপায়ণের সময় কাহিনি ধরে ধরে সিচুয়েশন ধরে এগোই। পরিচালক যেভাবে চরিত্রের কাঠামো বুঝিয়ে দেন, আমি আমার আঙ্গিকে, বাচনভঙ্গিতে ঠিক তারই প্রতিফলন ঘটাই। আমার মতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কমেডিয়ান চার্লি চ্যাপলিন। তিনি পর্দায় যা করে দেখাতেন, আমরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম। তাঁর ধারেকাছে যাবার ক্ষমতাও আমাদের নেই। কেউ যদি মনে করেন আমার অভিনয়ে কখনও চ্যাপলিনের প্রভাব পড়েছে, আমি তাহলে বলব যে আমার অজান্তেই এটা হয়েছে। শুধু আমি নয়, চ্যাপলিনের অভিনয়ে যাঁরা মুগ্ধ, তাঁদের প্রত্যেকের অভিনয়েই চ্যাপলিনের প্রভাব তাঁদের অজান্তেই পড়েছে। চ্যাপলিনকে দেখেই আমি শিখেছি অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করলে সার্থক চরিত্র সৃষ্টি করা যায় না। মানিকদার থেকেও শিখেছি অনেক। মানিকদা পুরো অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘আগন্তুক’—যত বড়ো অভিনেতাই হোক, মানিকদা সমানভাবে প্রত্যেককে অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। তাঁর অভিনয়ের সিকি ভাগ করাও যে কোনও অভিনেতার পক্ষে খুবই কঠিন। ছবির গল্প, টাইমিং, পজ, ডেলিভারি, ক্যামেরা, সংগীত— একটা ছবির সব দিকে সত্যজিৎ রায় ছিলেন মাস্টার। এ ব্যাপারে আরেকজনের নামও করতে হয়— তপন সিনহা। তপনদার ছবি করার সময়ও লক্ষ করেছি তিনি টোটাল ছবিটার দিকে, খুঁটিনাটির দিকে লক্ষ রাখতেন। এখন সত্যজিৎ রায় বা তপন সিনহার মতো পরিচালক কোথায়? যোগ্য পরিচালক, কাহিনির অভাবেই এখন কমেডি ছবি হয় না। আগের ছবিতে ভালো গল্প থাকত। থাকত মজার সব চরিত্র। এখনকার ছবিতে কমিক চরিত্রগুলো জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কাহিনির গতির সঙ্গে যার কোনও মিল নেই, নেই গল্পের জোর। নতুন যাঁরা পরিচালনায় আসছেন, তাঁদের এদিকে দৃষ্টি রাখা দরকার।

এসব এবিসিডি পরিচালকদের প্রযোজকরাই নিয়ে আসছেন। তাঁরা, ছবি করতে হবে, সবাই করছেন, তাই করেন। ছবি ভালোবাসেন না। তা ছাড়া এখন সেরকম লেখকই বা কোথায়, যাঁরা সমাজ থেকে কমেডি লেখার মধ্যে তুলে আনতে পারবেন? কমেডি কোথায় নেই? মন্ত্রীমাল্লা, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন— জীবনধারণের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে কমেডি। বিশেষত আজকের দিনে। কলমের সেই জোর কোথায় যে এগুলো তুলে ধরতে পারবে লেখার মাধ্যমে? একেক সময় ভাবি, সমাজের এইসব দুরবস্থার ব্যঙ্গচিত্র বিভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে তুলে ধরা যায়। এতে সাধারণ মানুষও দেশের হালচাল বুঝতে পারবে। আবারও বলছি, সেই লেখক কোথায় যে এসবের স্পষ্ট ছবি তুলে ধরবে? আমি দেখি, শুনি, বুঝি—সবই। অভিনয় করতে পারি। পারি ডিরেকশন দিতেও। কিন্তু লিখতে যে অক্ষম, তাই আমার ভাবনাচিন্তা আমার মধ্যেই থাকছে। বাইরের পাঁচজনকে তা জানাতে পারছি না। তাই এসব বক্তব্যহীন ছবিতে অভিনয় করে যেতে হচ্ছে। এখনকার পরিচালকরা শুধু বোঝেন গান, ফাইটিং, লোকেশন। সিরিয়াসনেসের বড্ড অভাব। এ জন্যই এখনকার ছবি হিট হয় না। লোকে দ্যাখে না। দেখবে কেন? মানছি, আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোক অশিক্ষিত, তবুও তারা তো পাঁচালি বোঝে। বোঝে রামায়ণ-মহাভারতও। তাদের উদ্ভট কিছু দেখালে দেখবে কেন? আমি ছবি দেখব, হাসব, সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাব। সেটা কিন্তু কমেডি নয়। ছবি দেখব, হাসব, সঙ্গে সঙ্গে ভাববও। বক্তব্যটা ভাবাবে, তবেই ষোলো আনা সার্থকতা। আমি বিশ্বাস করি কোনও জিনিস থেমে থাকতে পারে না। সাময়িকভাবে কমেডির ক্ষেত্রে এখন বন্ধ্যা যুগ চলছে। হিন্দি ছবি থেকেও কমেডি টোটাল আউট। তবে দিন ফিরবে। এত সংগীত তো বেরোচ্ছে, তা-ই বলে উচ্চাঙ্গসংগীত কি মুছে গেছে? তেমনি কমেডিও মুছে যাবে না। আবার আসবে। থাকবে স্বমহিমায়। হাসি ছাড়া জীবন বাঁচে নাকি? প্রযোজক-পরিচালকরা যদি একটু সিরিয়াস হয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছবি করেন, ছবি নিশ্চয়ই ভালো হবে। লোকে দেখবে। ‘সংকল্পে যে সুদৃঢ়, প্রতিজ্ঞায় যে অবিচলিত, যাবতীয় সিদ্ধি তার করতলগত।’ আমি কী করেছি, আর কী করতে পারিনি, তার বিশদ বিবরণের থেকেও জরুরি আগামী দিনে কী করা যেতে পারে, সে বিষয়ে ভাবা। তাই আমি আগামী সময়ে যাঁরা বাংলা ছবির কমেডির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন, তাঁদের জন্য বলি, কমেডি খুব সিরিয়াস অ্যাক্টিং। কঠিনও বটে। তবে এ জন্য ব্যক্তিগত জীবনে মজার মানুষ হতে হবে এমন নয়। নিষ্ঠাটাই আসল। টাইমিং, পজ, এক্সপ্রেশন— তিনের সমন্বয় না হলে সার্থক কমেডি হয় না। দরকার বডির ফিটনেস। মুভমেন্টের সময় কাজে লাগে। ব্যাস, এইভাবে অনুশীলন করলে সার্থক কমেডিয়ান হতে আটকাবে কে?

‘আজকাল’ (২১ জুন ১৯৯২)

টীকা

১) নবদ্বীপ হালদার—বর্ধমানের সোনপলাশী গ্রামে ১৯১১ সালে জন্ম এই অসামান্য কৌতুকাভিনেতার। এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বরের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের কর্মী ছিলেন। ১৯৩০ সালে দেবকী বসুর ‘পঞ্চশর’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। এরপর ‘মানিকজোড়’, ‘কালোছায়া’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘হানাবাড়ি’, ‘পাত্রী চাই’, ‘শহর থেকে দূরে’ ইত্যাদি বহু ছবিতে অভিনয় করেন। মঞ্চেও অভিনয় করেছেন। রেকর্ডে কৌতুক নকশার জন্য সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পান। যার মধ্যে ‘পাঁঠার গরম’, ‘রসগোল্লায় ইঁদুর, ‘যাত্রার বায়না’, ‘কাপড়ে আগুন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হাসির গানও করতেন।

২) তুলসী চক্রবর্তী (১৮৯৯-১৯৬১)—সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। গান-নাচে পারদর্শী ছিলেন। জ্যাঠামশাই পাবলিক থিয়েটারে অভিনয় করতেন। তাঁর জন্য প্রতিদিন থিয়েটারে খাবার নিয়ে যেতে যেতে তুলসীবাবু অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাড়ি থেকে পালিয়ে ‘বোসেজ সার্কাস’-এর সার্কাস দলে যুক্ত হয়ে দেশে ঘোরেন। কলকাতায় ফিরে স্টারে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে সারাজীবন গুরু মানতেন। প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত ‘পুনর্জন্ম’ (১৯৩২) ছবিতে। এছাড়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘সমাপিকা’, ‘অঞ্জনগড়’, ‘শ্রীতুলসীদাস’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘পরশপাথর’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেছেন।

৩) শীতল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৭-১৯৮৩)—এই বিশিষ্ট কৌতুকাভিনেতার জন্ম ২৪ পরগণার নারায়ণপুর গ্রামে। ইন্ডিয়া ফ্যানে চাকরি করতেন। চিত্রপরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায়ের যোগাযোগের কারণে, চিত্রপরিচালক সত্যেন বসুর ‘বরযাত্রী’ (১৯৫১) ছবিতে কানা পুরোহিতের চরিত্রে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। প্রথম ছবি থেকেই নজর কাড়েন। ‘শ্রীতুলসীদাস’, ‘পাশের বাড়ি’, ‘রিকশাওয়ালা’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘দুই ভাই’, ‘মিস প্রিয়ংবদা’, ‘আশিতে আসিও না’ ইত্যাদি বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। বেতারে নিয়মিত অনুষ্ঠান করা ছাড়াও রেকর্ডে হাস্যকৌতুক পরিবেশন করেছেন। প্রসঙ্গত, বহু সংগীত শিল্পীকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *