আমার চোখে সৌমিত্র
একটা লোকের চেহারার সঙ্গে তার চরিত্রের অনেক সময় মিল থাকে না। সুন্দর চেহারার লোক যে সবসময় স্বভাবেও সুন্দর হবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু সৌমিত্র একটু অন্যরকম। যেমন সুন্দর তার চেহারা, স্বভাবটাও তেমনি সুন্দর। কথায়, চালচলনে সে সবসময় একটা মর্যাদাসম্পন্ন লোকের ভাব বজায় রাখে। অনেক সময় অনেকে এই ভাবটাকে উন্নাসিক ভাবে। ভাবুক। কিছুই যায়-আসে না। বর্তমান সমাজে ভদ্রবেশধারী এত বেশি ছোটোলোক গজিয়ে গেছে যে ভদ্রলোক প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। সৌমিত্র কবি, লেখক, সুন্দর কথা বলে, সুন্দর পরিমিত মদ্যপান করে, সুন্দর আড্ডা মারতে ভালোবাসে এবং সর্বোপরি সংসার নাটক জায়গাটাকে কখনও অবহেলা করে না। তবে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, সে কি সর্বত্র অর্থাৎ সর্বস্তরের লোকের সঙ্গেই মেলামেশা করে— তাহলে বলব, না। কিংবা বলব অনেক স্তরের লোকেরাই তাকে আপন না-ও ভাবতে পারে। একটা বিশেষ শ্রেণির লোকজনদের মধ্যে চলাফেরা করতেই সৌমিত্র পছন্দ করে। এটা তার ব্যক্তিগত রুচি। এমন লোক আছেন, যিনি নামকরা হয়েও সর্বস্তরে চলাফেরা করে থাকেন। যেমন আমাদের মধ্যে ছিলেন একসময় উত্তমকুমার বা ছবি বিশ্বাস।
এইটাই সৌমিত্রর সর্বপ্রথম এবং প্রধান পরিচয়। টিপিক্যাল স্টার গ্ল্যামার বলতে যেটা বোঝায়, সেটা হয়তো সৌমিত্রর নেই বা থাকলেও খুব বেশি নয়। কিন্তু সে একজন বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ অভিনেতা। ‘অপুর সংসার’১ দেখেই আমাদের মনে খুব আনন্দ হল যে সত্যজিৎ রায় একটা বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেকে বাজারে ছাড়লেন। হিরো বলতে যে ম্যাড়মেড়ে একটা ধারণা ছিল, সেটা সৌমিত্রকে দেখে কাটল। তবে ম্যাড়মেড়ে গাছের ডাল ধরে গান গাওয়া হিরোদেরও তখন খুব কদর ছিল। আমাদের কাছে একেবারেই ছিল না। আমরা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছি একটা চমকপ্রদ মুখ বা চেহারা, যাকে দেখলে মনে হবে লোকটা স্বাভাবিক। সৌমিত্র ‘অপুর সংসার’-এ আবির্ভাব হয়ে সেই আশাটা দেখাল। কিন্তু উপায় নেই, জাঁতাকলে পড়লে বেরোনো মুশকিল। পরবর্তীকালে হয়তো দায়ে পড়ে এরকম ডাল ধরা অ্যাক্টিং করতে হয়েছে সৌমিত্রকে। তবে যতদূর মনে হয়, এই ধরনের টিপিক্যাল অভিনয়ের ব্যাপারে সৌমিত্র খুব সহজ থাকত না। দর্শক এই ধরনের অভিনয়ে বোধহয় বেশি পছন্দ করত উত্তমকুমারকে। সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যেক ছবিতেই সৌমিত্রকে দেখা যায় খুবই সুন্দর এবং স্বাভাবিক। এর একটা কারণ হয়তো এই যে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই জানেন সৌমিত্রর দোষগুলো—এবং, সেটা তিনি সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারতেন। তবে সব সত্বেও বলব যে সৌমিত্র একজন বুদ্ধিমান অভিনেতা এবং বিশেষভাবে চরিত্রাভিনেতা।
মঞ্চেও সৌমিত্র বেশ ভালো। খুব একটা সাড়া জাগানো কিছু না ঘটালেও, সৌমিত্রর কাজ মঞ্চে খুব পরিচ্ছন্ন। তার নাটক, বিশেষ করে ‘নীলকণ্ঠ’২ বেশ ভালো। এই নাটকে তার অভিনয়ও খুব উঁচু মানের। ‘ঘটক বিদায়’ নাটকে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। এই নাটকের মহড়া থেকে মঞ্চস্থ হওয়া পর্যন্ত খুব কাছ থেকে ওকে আরও দেখতে পেলাম। প্রতি পদক্ষেপেই ওর প্রশংসা করা ছাড়া উপায় নেই।
বায়োস্কোপে আমার সবচেয়ে পুরোনো এবং কাছের বন্ধু সৌমিত্র। বন্ধুত্ব হওয়ার কারণ বোধহয় ওর সঙ্গে আমার মতবিরোধ নানা ব্যাপারে থাকলেও, রুচিতে কোনও অমিল নেই। পেশাদারি মঞ্চে কখনও কারও পরিচালনায় আমি নিজে অভিনয় করিনি, একমাত্র উৎপল দত্ত ছাড়া। কিন্তু যখন সৌমিত্রর পরিচালনায় অভিনয় করার অনুরোধ এল, তখন সেটাকে প্রত্যাখ্যান করিনি। বেশ ভালোই লাগছে এখন। আশা করছি বহুদিন ‘ঘটক বিদায়’কে বিদায় দিতে পারা যাবে না।
‘সৌমিত্র’ (অলক চট্টোপাধ্যায় ও মানস চক্রবর্তী সম্পাদিত), সৃষ্টি প্রকাশনা : জানুয়ারি ২০০১
টীকা
১) ‘অপুর সংসার’—সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ ছবিটি মুক্তি পায় ১ মে ১৯৫৯। অপু ট্রিলজির শেষ ছবি। প্রসঙ্গত, ছবির নায়ক-নায়িকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর দু’জনেরই এটি প্রথম অভিনীত ছবি।
২) ‘নীলকণ্ঠ’—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকটি তাঁরই নির্দেশনা ও অভিনয়ে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৫ জুলাই ১৯৮৮ রঙমহল থিয়েটারে। অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল ঘোষ, সায়নী মিত্র, গৌতম চক্রবর্তী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এ নাটকে অভিনয় করেন।