নাটক থেকে ফিল্মে
তার মানে একটা থেকে আর একটায়? কী বুঝলাম আমি নিজেই জানি না। তবু যেটুকু আমার বুদ্ধিতে বুঝেছি সেটুকুই লেখবার চেষ্টা করছি।
১৯৪৮-৪৯ সাল। আমাদের একটা দল ছিল, নাম ‘বন্ধু মহল’। সেই দলে ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (পি.এল.টি), ভোলা দত্ত, অশোক ঘোষাল, প্রেমাশিস সেন এবং আমি। আমাদের কাজই ছিল কোনও বাড়ির একটা ফাঁকা ছাদ খুঁজে বেড়ানো—কেননা রিহার্সাল দিতে হবে। আমরা সবাই ছিলাম এক্সপেরিমেন্টালিস্ট, যা চলছে তাকে কখনই গ্রহণ করতে পারতাম না, অর্থাৎ গতানুগতিক অভিনয় এবং শিল্পকে আমরা আমলই দিতাম না। তখনকার কালে একমাত্র শিশিরকুমার, নরেশ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রভৃতিকে ছাড়া আর কাউকেই আমরা ঠিক প্রথম শ্রেণির শিল্পী বলে ভাবতে পারতাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই রিহার্সালই আমাদের হত, মঞ্চ পর্যন্ত আমাদের দৌড় আর পৌঁছোত না, কারণ আমাদের পয়সা ছিল না, অপর কেউও দিত না।
১৯৫১* সালে প্রেমাশিস সেনের সঙ্গে আমি আর সত্য উৎপল দত্তর কাছে যাই এবং এল.টি.জি-তে সঙ্গে সঙ্গে যোগদান করি। মনে হল ঠিক মনের মতো নাটক করার গুরু বোধহয় একজন পাওয়া গেল। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একটানা আমার অবস্থান এল.টি.জি-তে। এই দীর্ঘ ক’টা বছর আমার জীবনে কখনও আর ফিরে আসবে না। নাটক সম্পর্কে যা কিছু আমার অভিজ্ঞতা সবটাই এখান থেকে। গুছিয়ে কিছু লিখতে বা বলতে আমি পারি না, তাই আমার অগোছালো ভঙ্গিতেই যেটুকু পারি লিখছি।
পেশাদার হব বলে আমরা থিয়েটার করতে যাইনি। ওটা ছিল একটা অকৃত্রিম নেশা। অভিনয়ের শেষ কোথায় এবং সত্যটা কী এই অন্বেষণই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা রিহার্সাল দিতাম রোজ সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে ম্যান্ডেভিল গার্ডেনস (বর্তমান সাউথ পয়েন্ট স্কুল)-এ। আমাদের পরিচালক ছিলেন উৎপল দত্ত, সেক্রেটারি রবি সেনগুপ্ত এবং প্রেসিডেন্ট সতীকান্ত গুহ। কঠোর নিয়ম যে কী জিনিস প্রথম জানলাম এল.টি.জি-তে এসে—অন্তত অভিনয়ের ব্যাপারে। উৎপলদা টিপিক্যাল ন্যাতা-জোবড়া বাঙালি নন, বরং একটু সাহেব প্রকৃতিরই বলা চলে। আর রবি সেনগুপ্ত বাঙালি হয়েও কঠোর নিয়মে বিশ্বাসী। এই দুয়ে মিলে বুঝতেই পারছেন এবার অবস্থাটা। সাড়ে ছ’টা বেজে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রিহার্সাল ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। যদি কারও দেরি হয়ে যেত তবে সেদিনটা তাকে বাইরেই বসে থাকতে হত। রিহার্সাল হত ঠিক ন’টা পর্যন্ত। তারপর আড্ডা ‘পানীয়ন’ রেস্টুরেন্টে। এইভাবেই চলল থিওরেটিকাল ও প্র্যাকটিকাল শিক্ষা একসঙ্গে। আমি মশগুল হয়ে গেলাম। অভিনেতাকে যে এত রকমের ব্যাপার জানতে হয় সেটা আগে কখনও শুনিনি। শরীর, অঙ্গভঙ্গি, চালচলন, কণ্ঠস্বর, উচ্চারণশৈলী, শব্দ নির্বাচন এবং সকলের ওপরে অভিব্যক্তি সম্বন্ধে শুনতাম—প্র্যাকটিস করতাম, আবার প্র্যাকটিস করতাম এবং আবার প্র্যাকটিস করতাম। যতক্ষণ না সম্পূর্ণ রপ্ত হত বারবার এইভাবেই চলত। সারাদিনে আর অন্য ভাবনা ছিল না এগুলো ছাড়া। অভিনয়-অঙ্গ ছাড়াও আমার বেশি আগ্রহ ছিল স্টেজের কাজকর্মে। আমাকে উৎপলদা স্থায়ী স্টেজ ম্যানেজার করে দিলেন। আগে রিহার্সাল দিতাম ছাদে, স্টেজে কখনও যেতে পারতাম না। এখন রিহার্সাল দিই একটা সুন্দর ঘরে এবং অনবরত মঞ্চে নামি। কত বিচিত্র ধরনের নাটকই যে আমরা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। তবে সব নাটকই ছিল ওজনে ভারী। ভারী জিনিস নাড়াচাড়া করতে যেমন ভয় লাগত তেমনি মনের মধ্যে সব সময় একটা চ্যালেঞ্জের ভাবও থাকত। যেমন ধরুন একবার আমরা ‘অচলায়তন’ করি। বিশাল ব্যাপার, তেত্রিশটা চৌকি দরকার এবং সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক আর যা যা সব। উৎপলদার সব ব্যাপারটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং তৎপরতাপূর্ণ। একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। আমাদের প্রথম নাটক ‘সাংবাদিক’ এবং আমি ছিলাম স্টেজ ম্যানেজার। তৎসহ একটা ছোট্ট ভূমিকা ছিল আমার। পনেরো সেকেন্ড মঞ্চ-পরমায়ুর একটা পার্ট করেছিলাম ওই নাটকে। রোলটা ছিল একজন হকারের। বিরাট সেটিং আর প্রচুর চেঞ্জে ভরা স্টেজ। সেই প্রথম আমি পুরোদস্তুর স্টেজ ম্যানেজার। একদিন উৎপলদা আমার নোট বইটা দেখতে চাইলেন। আমি জানালাম যে আমি কোনও ডায়েরি রাখি না। উৎপলদা অবাক! সেটা প্রথম ‘শো’-এর মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। আমি ওঁকে বললাম যে সবটাই আমার মুখস্থ আছে। উৎপলদা গ্রুপের সবার সামনে আমার পরীক্ষা নিলেন। আমি প্রত্যেকটা দৃশ্যের ‘প্রপস’ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সম্পর্কে মুখস্থ বলে গেলাম। উৎপলদা তারপর বলে দিলেন আমি যেন আমার মেথডেই কাজ করি। ওই নাটকে পনেরো সেকেন্ডের পার্টের জন্য বর্তমান প্রখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেন ‘ইউনিটি’ কাগজে আমার সম্বন্ধে এক প্যারা লিখেছিলেন।
‘অচলায়তন’-এর মতো আমাদের সব প্রাোডাকশনই ছিল ওজনে খুব ভারী। নিজে কখনও আমি খুব একটা বড়ো পার্ট করতাম না, কারণ স্টেজে আমার অন্যান্য কাজ এত বেশি থাকত যে বড়ো কিছু করা সম্ভব হত না। এই ব্যাপারটা পরোক্ষভাবে আমার উপকার করল। বসে বসে সকলের রিহার্সাল দেওয়া দেখতাম, ফলে অভিনয়ের নানা রকম দোষ এবং গুণ আমার মাথার মধ্যে ঢুকতে লাগল। উৎপলদার রিহার্সাল-পদ্ধতি পাক্কা বিজ্ঞানসম্মত। প্রতিটি অভিনেতাকে একেবারে বেসিক থিওরি থেকে শেখাতেন। প্রয়োজন হলে নিজে অভিনয় করে সবটা দেখিয়ে দিতেন। আমার এই সময় কাজ ছিল উৎপলদাকে সাহায্য করা। উৎপলদা মাঝে মাঝে খুব চটে যেতেন রিহার্সাল দিতে দিতে। সেটাও সামলাবার দায়িত্ব ছিল আমার ওপরে। দেখতাম অধিকাংশ অভিনেতাই উৎপলদার ঢং-টাকে ধরতে পারছে না। ছোটো পার্ট করলেও উৎপলদার আমাকে কোনওদিনই একবারের বেশি কিছুই দেখিয়ে দিতে হয়নি। এই সময় সত্য আর আমি খুব পড়াশোনা করতাম—অভিনয়, নাটক এবং থিয়েটারের ব্যাপার নিয়ে। আমার পড়াশোনার আগ্রহ বেশি ছিল অভিনয় আর স্টেজ ক্র্যাফট-এর ওপর। উৎপলদা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ওয়ার্ল্ড থিয়েটার এবং ওয়ার্ল্ড ড্রামার ওপর বলে যেতে পারতেন। দিনের মধ্যে মাত্র খাওয়া-দাওয়া আর সামান্য একটুক্ষণ ঘুমোনো ছাড়া অন্য সমস্ত সময়টাই কাটত এই নাটক—নাটক আর নাটকে।
কমিউনিস্ট পার্টি তখন একটাই। সোজাসুজি যোগাযোগ এখানকার সব বড়ো বড়ো কর্তাদের সঙ্গে এল.টি.জি-র ছিল। তার মূল কারণ অবশ্য আমাদের সম্পাদক রবি সেনগুপ্ত। নাটক এবং থিয়েটার সম্পর্কে সমস্ত জগৎটা যেন আমার আর দলের সকলের সামনে অন্যভাবে খুলে গেল। আগে আমাদের নাটক সম্বন্ধে ধ্যানধারণা যা ছিল সেটা যেন একটা ছোট্ট ঘরের মতো। কমিউনিস্ট পার্টির মহান সব পণ্ডিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে আমাদের সামনে নাট্যজগতের দিগন্ত অনেক প্রসারিত হয়ে গেল। সেই সময় আমাদের রিহার্সালরুমে এমন সব ব্যক্তিরা এসে বসে থাকতেন যাঁদের অনেকেই এখন রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। এইভাবে চলল একদিকে ক্র্যাফট, একদিকে কনটেন্ট আর একদিকে ফর্মের পরীক্ষা। প্রায় সব সময় এই নিয়েই মশগুল থাকতাম—পৃথিবীতে অন্য আর কিছু যে করবার বা ভাববার আছে সেটা কেয়ারই করতাম না। দিনে দু-তিন ঘণ্টা বাড়িতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম ভাবভঙ্গি প্র্যাকটিস করতাম। কখনও মা হঠাৎ দেখে ফেললে একটু গালাগালিও খেতাম। কিন্তু থামতাম না। তখন এমন একটা অবস্থা হয়েছিল যে, এখানকার প্রফেশনাল কোনও কাজকর্ম দেখলে হাসি পেত (শরীরে অল্প শক্তি এলে এমনটা হয়)। আগে যাদের নাম করেছি সেই ক’জন বাদে আর কাউকেই অভিনেতা বলে ভাবতে পারতাম না।
১৯৫৫ কী ‘৫৬** ঠিক মনে নেই, উৎপলদা আমাকে একটা নাটক পরিচালনা করতে বললেন। প্রচণ্ড ভয় থাকা সত্বেও ঝুলে পড়লাম। উৎপলদার যখন আমার ওপর আস্থা আছে তখন আমার চিন্তার কোনও কারণ নেই। নাটকটা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘শোধবোধ’। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিল ভোলা দত্ত ও সুনন্দা গুহনিয়োগী। অনেকগুলো শো হয়েছিল। এরপর আবার একটা একাঙ্ক নাটক পরিচালনা করলাম—বনফুলের ‘নব সংস্করণ’। এটা অনেকদিন চলেছিল। এরপর আমার মনের একটা দরজা বেশ পরিষ্কারভাবে খুলে গেল। অর্থাৎ থিয়েটারটা যে মোটামুটিভাবে আমার দ্বারা হতে পারে এই বিশ্বাসটা এল। কিন্তু সব চাইতে আমি নিশ্চিত ছিলাম সম্ভবত এই কারণেই যে তখনও পর্যন্ত আমার ঘাড়ে বড়ো কোনও ‘রোল’ চাপানো হয়নি। তখন আমাদের অবসর সময় কাটত ক্ল্যাসিকাল গান শুনে, ক্ল্যাসিকাল নাচ দেখে—এবং যা কিছু ক্ল্যাসিকাল তার প্রতিই একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতাম তা বুঝি আর না বুঝি। সব সময় তিনজন একসঙ্গে থাকতাম, উৎপলদা, শেখর চ্যাটার্জি আর আমি। এই সময় এক মহৎ গুণী ব্যক্তি শ্রীকমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে আলাপ হয়। দীর্ঘদিন তাঁর কাছ থেকেও বহু কিছু শিখেছি। অভিনয় শিখতে গেলে কেবল অভিনয় নিয়ে পড়ে থাকলেই যে চলে না একথা উৎপলদা এবং সে সময় যেসব গুণী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিলেম তাঁরা সবাই বলতেন। অ্যালায়েড আর্ট-কেও জানতে হবে বা খানিকটা তার সম্বন্ধে ধারণাও রাখতে হবে। বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য আমরা মেতে থাকতাম উচ্চাঙ্গ সংগীতে ও ‘ভরতনাট্যম’ নৃত্য নিয়ে। এই সময় শ্রীকমলকুমার মজুমদারের নির্দেশে প্রথম ‘বালা সরস্বতী’৩কে দেখতে যাই নিউ এম্পায়ারে। সেটা ১৯৫৩ কী ‘৫৪ সাল। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিনের জন্য। কমলদার হয়তো আজ সে কথা মনে নেই। অর্থাৎ সে সময় কলকাতার বুকে কোনও ভালো শিল্পবস্তু—সেটা যাই হোক না কেন—আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারত না; অবশ্য এখনও পারে না। এই মুক্ত এবং মুগ্ধ দৃষ্টি অভিনেতার যে কতখানি উপকারে লাগে সেটা আজ বুঝতি পারছি।
১৯৫৭*** সালে এল.টি.জি-র ফেস্টিভেল হয়। ‘ছায়ানট’-এ ডিরেক্টরের রোল আর গিরিশ ঘোষের ‘সিরাজদৌলা’য় দানসা ফকিরের রোল উৎপলদা আমার ঘাড়ে চাপালেন। এর আগে অনেককে দিয়ে এই রোলে চেষ্টা করিয়েও যখন সন্তুষ্ট হলেন না উৎপলদা আমাকে আর রেহাই দিলেন না। তখনও আমি স্টেজ ম্যানেজার, সুতরাং অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম উৎপলদাকে কিন্তু কোনও ফল হল না। চিরকালই আমি অভিনয়ের ব্যাপারে একটু ফাঁকি দিতে পারলে মজা পাই—এখনও।
এই শুরু হল আমার প্রকৃত অভিনেতার জীবন। এরপর আর রেহাই পাইনি বড়ো রোল থেকে। তাই বাধ্য হয়ে আর একটি ছেলেকে স্টেজ ম্যানেজার হিসেবে তৈরি করতে শুরু করলাম। তার নাম বিধান মুখার্জি। সেও খুব দক্ষ স্টেজ ম্যানেজার তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
১৯৫৯ সালের জুন মাসে আমরা মিনার্ভা থিয়েটার পেলাম। সদলবলে লেগে গেলাম একটা কিছু কাণ্ড করার জন্যে। এই সময় আমার মঞ্চ সম্পর্কে একটা পুরোদস্তুর আত্মবিশ্বাস এসে গিয়েছিল। অর্থাৎ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাই বুঝতে পারতাম। কিন্তু পাঁচ মাসের মধ্যে অতীতের সব ধ্যানধারণা একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। পেশাদারি মঞ্চে নিয়মিত দর্শকের চেহারাটা একেবারেই আলাদা। এতদিন যাঁরা আমাদের ভূয়সি প্রশংসা করে এসেছেন এবং মাথায় তুলে নেচেছেন—বুঝলাম সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য। নিয়মিত অভিনয়ের চক্রে পড়ে আমাদের দিব্যচক্ষু খুলে গেল। চিন্তাবিদ রথী মহারথীরা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। কী করা যায়? বাজারে তখন প্রচুর দেনা হয়ে গেছে। অন্যান্য পেশাদার রঙ্গমঞ্চে যা হয় সে সব বস্তাপচা রাস্তায় আমাদের পক্ষে যাওয়া যে একেবারেই অসম্ভব! অন্যান্য থিয়েটারের কর্তারা তখন আমাদের নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা দমলাম না। ‘নীচের মহল’-এর শেষ কয়েকটা শো বাকি, তার পরেই আমাদের পাততাড়ি গোটাবার কথা। এমন সময় হঠাৎ একদিন পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমাদের নাটক দেখতে এলেন। হলে সেদিন সাকুল্যে জনা পঞ্চাশেক লোক ছিল। কিন্তু রবিশঙ্করকে উদ্দেশ্য করেই সেদিন এমন একটা পারফরম্যান্স হল সবার যে বলবার নয়। শো শেষে রবিশঙ্কর ব্যাক-স্টেজে এলেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে রবিশঙ্করকে দেখলাম। তিনি হঠাৎ বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের একটা নাটকে মিউজিক করতে চাইলেন। ব্যস আবার চাকা ঘুরে গেল। আমাদের তৎকালীন কমার্শিয়াল ম্যানেজার কমল মুখার্জির মাথায় এল ঘটনাস্থল বদল করে নাটক করার মতলব। আলোচনায় নাটকের লোকেশন স্থির হল কয়লাখনি। আবার দুরূহ কার্যসূচি তৈরি হতে লাগল। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘অঙ্গার’ প্রথম মঞ্চস্থ হল। রবিশঙ্করের সংগীত একদিকে—উৎপল দত্তর অসাধারণ প্রাোডাকশন স্কিম একদিকে—তাপস সেনের আলোর ঝলকানি একদিকে, আর অন্যদিকে আমাদের সভ্যদের সমবেত অভিনয় প্রচেষ্টা, আমাদের টিম ওয়ার্ক। যেন আগুন জ্বলে উঠল চারদিকে। হইহই করে দাপটে তিনশো রাত্রি আমরা ফুল হাউস পেয়েছিলাম। বছরের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে আমাকে একটা বিরাট প্রাইজও দেওয়া হল। অন্যান্য স্টেজে তখন অনেক নামজাদা অভিনেতারাই ছিলেন, তবু এল.টি.জি থেকে একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পাওয়াটা তখনকার দিনে একটা কাণ্ডই।
‘অঙ্গার’-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েও একটা ব্যাপারে তখন থেকেই আমার মনের মধ্যে কেমন খটকা লাগতে লাগল। এই প্রথম উৎপলদা সম্পূর্ণ রকমে আঙ্গিকের কবলে পড়ে গেলেন। অনেক আলোচনা, অনেক তর্ক, সে সময় হয়েছিল কিন্তু সাফল্যের টান আমাদের সব চিন্তাকে ভাসিয়ে দিল। শেষ দৃশ্যে আমাকে একটা দীর্ঘ সংলাপ বলতে হত। কিন্তু পরে প্রায়ই সেই সংলাপের কয়েকটা কথা বলে আমি থেমে যেতাম অথচ তার দ্বারা আঙ্গিকের কোনও অঙ্গহানি ঘটত না। একদিন তাপসদার সঙ্গে তর্কের মধ্যে বলেই ফেললাম, ‘দেখুন দাদা, টেকনিক্যাল কারবারের ওপরে হিউম্যান ভয়েস উইন করতে পারে না, সুতরাং আমি আর চেঁচাতে পারব না।’ শব্দ এবং আলোর এমন একটা ম্যাজিক তৈরি হত যে লোকে সে সময় ওইটি দেখতেই ব্যস্ত থাকত। যখন আমরা জলে ডুবে মরছি তখন জলের খেলা দেখে লোকে হাততালি দিয়ে উঠত। উৎপলদা কিন্তু আমার বক্তব্যটা ফেলেও দেননি আবার তাপসদাকেও অস্বীকার করতে পারেননি।
‘অঙ্গার’ এল.টি.জি-র ভাগ্য ফেরাল এবং একই সঙ্গে তার কবরও তৈরি করে দিয়ে গেল। আমাদের কর্তারা সব কেমন যেন হয়ে যেতে লাগলেন। এক বছর পর প্রথম আমি এল.টি.জি ছেড়ে চলে এলাম। আসার সময় একটা কথাই শুধু উৎপলদাকে বলে এসেছিলাম যে এল.টি.জি-র মধ্যে কোথায় যেন কী একটা ঢুকে গেছে এবং মাত্র এক বছরের মধ্যেই এল.টি.জি ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। হলও তাই। আজ এল.টি.জি আর নেই। সবাই আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম।
এখনও যখন উৎপলদার কোনও প্রাোডাকশন দেখতে যাই আমার খারাপ লাগে। খারাপ লাগে এই দেখে যে টেকনিকের প্রাচুর্য তাঁকে চক্রের মতো ঘিরে ফেলেছে। তখন অনিবার্যভাবে মনে পড়ে সেই একদা কালের ‘সাংবাদিক’ নাটকের শেষ দৃশ্যটা, যেখানে উৎপলদার দেড় পাতা সংলাপের পরে শেষ যবনিকা নেমে আসত। প্রেক্ষাগৃহ থেকে দর্শকরা বেরিয়ে আসতেন নি:শব্দে। মনে পড়ে ছেঁড়া পর্দার সামনে মফসসলে উৎপলদার ‘ম্যাকবেথ’ অভিনয়। তখন হয়তো কোনও ঐশ্বর্য আমাদের ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের স্পন্দন ছিল, প্রাণের প্রাচুর্য ছিল। মনের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট অনুভব করি। আজকের এত টেকনিকের আতিশয্যে সেদিনের সেই প্রাণটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। মনে পড়ে সেই মহান শিল্পীর বাণি—’বত্রিশ পাটি দাঁত চিবুতে চিবুতে শক্ত হয়ে উঠল কিন্তু জিভের স্বাদ গেল মরে।’
এই বক্তব্যটা একান্তভাবেই আমারই। এর জন্য অন্য কারও ওপর যেন কেউ দোষারোপ না করেন।
১৯৬১ সালে মনমেজাজ খুব খারাপ। সংসারে প্রচণ্ড টানাটানি চলছে। এই অবস্থায় কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম একটা চাকরিবাকরি নিয়ে বাইরে কোথাও চলে যাব। আসলে শিল্পের জগতে ঠিক অ্যাডজাস্ট করতে পারছিলাম না। এমন একটা সিস্টেমের মধ্যে আমরা তৈরি হয়েছিলাম যে অন্য কোথাও পেশাদার অভিনেতা হিসেবে কাজ করাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। পেশাদার লোকদের কথাবার্তা চালচলন বুঝতেই পারতাম না।
ঠিক এমনি সময়ে তপন সিংহের কাছ থেকে ডাক এল ছবিতে কাজ করার জন্যে। ছবির নাম ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। প্রচণ্ড অভাবে তখন দিন যাচ্ছে আমার, কিন্তু তবু মনে হল ঠিক বায়োস্কোপের অভিনয় তো আমার জানা নেই। আমার দ্বারা কি সম্ভব হবে? তপনদাকে বললাম, ফিল্মের অভিনয়ের ঢংটার ব্যাপারে আমাকে আগাগোড়া গাইড করতে হবে।
এই শুরু হল আমার জীবনে আর একটা অধ্যায়। আবার আরম্ভ হল নানা ধরনের প্র্যাকটিস। একটা কনভেকস লেন্সের আয়না কিনে ফেললাম মুখের সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি স্টাডি করার জন্য। পাগলের মতো পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ বায়োস্কোপের অভিনেতাদের অভিজ্ঞতা পড়তাম আর নোট করতাম। এই সময়েই ‘নোটস অফ এ সোভিয়েট অ্যাকটর’ আমাকে প্রচণ্ডভাবে প্রেরণা দেয়। চেরকাসোভ-ও স্টেজ থেকে ফিলমে আসেন এবং দুটো মিডিয়ামই দাপটের সঙ্গে রপ্ত করেন।
তপনদার সঙ্গে কাজ করতে করতে এল সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে ডাক এবং সেটা চলতে চলতে এল অসিত সেনের কাছ থেকে ডাক। আমি একসঙ্গে বাংলা তথা ভারতের তিনজন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের কাছে পেশাদারিভাবে বায়োস্কোপের কাজ শুরু করলাম। সবার কাজের ধারাই বসে বসে দেখতাম ছাত্রের মতো। কখনও কখনও মনে হত কেমন যেন স্টেজ আর ফিল্ম মিডিয়াম গুলিয়ে যাচ্ছে। সব চিন্তার সমাপ্তি ঘটল যখন মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) কাজটা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ লক্ষ করতে লাগলাম। কখনও কোনও জায়গায় মানিকদার ‘শট টেকিং’-এ বা অভিনয় করানোর ব্যাপারে স্টেজের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই থাকত না। খুব মজা লাগতে লাগল। বাড়ির লোকেরা সন্তুষ্ট হল অর্থনৈতিক দিকটা একটু ভালো হল দেখে, আর আমি মজে রইলাম তিনজন শীর্ষস্থানীয় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার আনন্দে। তিনজনেরই কাজের ধারা তিন ভিন্ন রকমের, ফলে প্রথম ধাক্কাতেই আমার বায়োস্কোপ-ধারণার সমস্ত জটগুলো খুলে গেল। এই তিনজনের কাছে বিশেষ করে মানিকদা ও তপনদার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব।
থিয়েটারে আমার করায়ত্ত ছিল বডি-মুভমেন্ট, জেস্টিকুলেশন, ডেলিভারি অফ ভয়েস, রিফ্লেক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। বায়োস্কোপে এসে দেখলাম এক্সপ্রেশনটাকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তে আনতে না পারলে কিছুই করা যাবে না। ‘অ্যানাটমি অফ দি ফেস’ নিয়ে দীর্ঘ প্র্যাকটিস করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। থিয়েটারে সবটাই একটা সীমায়িত গণ্ডির মধ্যে আর চলচ্চিত্রে ব্যাপারটা অসীম। থিয়েটার প্রকৃতই অভিনেতার জায়গা আর ফিল্ম হচ্ছে ‘এসেনসিয়্যালি এ ডাইরেক্টরস মিডিয়া’। অবশ্য আমাদের এখানে সচরাচর যা হয়ে থাকে সেটা ঠিক ফিল্ম মিডিয়ামের মধ্যে পড়ে না। আমি বলতে চাইছি বিজ্ঞানসম্মতভাবে যেটা হচ্ছে। থিয়েটারে আমার দর্শকের সঙ্গে দূরত্ব সব সময় এক কিন্তু ফিল্মে আমি কখন কোথায় সেটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে পরিচালকের চিন্তার ওপর। ফিল্মে অনেকদিন ধরে একটা জায়গায় পৌঁছোনো হয় আর থিয়েটারে মাত্র তিন ঘণ্টায়। থিয়েটারে সবটাই যেন অ্যাকশনবহুল আর ফিল্মে রি-অ্যাকশন ছাড়া অন্য কিছু করলেই সেটা যেন বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। থিয়েটারের ব্যাপারটা যেন বহির্মুখী আর ফিল্মে যেন সবটাই অন্তর্মুখী। ঠিক বোঝাতে পারলাম কি না জানি না। মাথার কাছে ‘বুম’ অর্থাৎ সাউন্ডটা যার মধ্য দিয়ে যায় সেটা দেখলেই আমার গলার আওয়াজ আপনা থেকেই সংযত হয়ে যায়। অথচ থিয়েটারে স্টেজে দাঁড়ালেই সেই একই গলা কেমন অন্যভাবে চলতে থাকে।
তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বুঝতে পেরেছি যে, বর্তমান অভিনেতাদের আর মিডিয়ামে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। মিডিয়ামকে উত্তীর্ণ হতে হবে। যতগুলি মিডিয়ামে অভিনেতাকে দরকার সবটাই তাঁর নখদর্পণে থাকতে হবে। আমি ওখানকার, আর তিনি এখানকার, এটা আর চলবে না। এখান আর ওখান—এই সবটাকেই এক করে ফেলতে হবে। এত সত্বেও ফিল্ম কিন্তু ফিনিশড প্রাোডাক্ট-এর জায়গা, আর থিয়েটার হল প্র্যাকটিসিং ফিল্ড। প্রথম একটা ছবিতে নেমেই কারও হয়তো খুব নাম হল, কিন্তু তিনি যদি মনে করে বসেন আমি অভিনেতা হয়ে গেছি তাহলেই বিপদ। প্রথম ছবিতে নেমেই নামের পেছনে প্রধান লোক হলেন পরিচালক—কখনই অভিনেতা নন। এরকম এক-দু’বছর নাম থাকার পর আর সেই অভিনেতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন নজির প্রচুর আছে। এই ধরনের অভিনেতাদের উচিত সঙ্গে সঙ্গে কোনও একটা ভালো গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দেওয়া, অভিনয়ের সূক্ষ্ম ভাবগুলি প্র্যাকটিস করা। কেন না ফিল্মে কাজ করতে গেলে আপনার প্র্যাকটিসের জন্য এক মুহূর্ত সময় বা র-ফিল্ম নষ্ট করতে রাজি হবেন না প্রযোজক। এখানে সময়টা টাকার হিসেবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
থিয়েটারের বয়স কয়েকশো বছরের আর ফিল্ম হচ্ছে সবচেয়ে বয়:কনিষ্ঠ শিল্প মাধ্যম। থিয়েটার একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে কিন্তু ফিল্মের সূক্ষ্মতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা একমাত্র পৃথিবীর মহান চিত্রনির্মাতারাই বলতে পারেন। সুতরাং এখনও সব সময় মনে মনে অভ্যাস করি যাতে আরও সূক্ষ্মতায় পৌঁছোতে পারি ফিল্মে অভিনয় করার সময়। থিয়েটার নিয়মিত করি না কিন্তু থিয়েটার করার অভ্যেসটা এখনও আছে এবং থাকবেও। ভারতবর্ষের সবচাইতে বড়ো পরিচালক ফিল্মে যিনি তাঁকেও সন্তুষ্ট করেছি, আর এখনও স্টেজের সবচাইতে বড়ো পরিচালক যিনি তাঁকেও এককালে সন্তুষ্ট করেছি। সুতরাং ‘নাটক থেকে ফিল্মে’ আমার কোনওই অসুবিধা হয়নি। আমি আগেই বলেছি যে, অভিনয়ের ব্যাপারে আমি একটু ফাঁকিবাজ। অভিনয় ব্যাপারটা জানতে ও তার তথ্য অনুসন্ধানেই আমার আনন্দ—সব সময় অভিনয় করায় নয়। ফিল্মের ব্যাপারে এখন যেটা চলছে সেটা অভিনেতার পক্ষে খুবই পীড়াদায়ক। ব্যবসায়ী মহল যা কায়েমি স্বার্থ একটা অদ্ভুত জায়গায় পুরো ফিল্ম শিল্পটাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সেনসরি নার্ভকে ধাক্কা মেরে কাহিনি তৈরি করা হচ্ছে এবং অভিনয় পদ্ধতিও সেই অনুযায়ী হচ্ছে। ‘বাবা মার্কা’ বা ‘বন্দুক মার্কা’ ছবির দৌড় কিন্তু বেশিদিন থাকে না। শিল্পগুণান্বিত ছবিই শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। আরও রাগ হয় যখন দেখি কিছু সমালোচক এইসব ছবির অভিনয় দেখে অনেক কিছু বলেন। অবশ্য যেসব বিশেষণ সমালোচকরা এক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, সেগুলো একান্তভাবে তাঁদেরই তৈরি—কোনও বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার মধ্যেই পড়ে না। কোনও এক প্রথম শ্রেণির (ব্যবসায়িক দিক থেকে) বম্বের অভিনেতাকে একদিন বলেছিলাম, ‘বন্দুক আর ঘুঁষি দেখিয়ে কতদিন চলবে? ওসব দেখিয়ে চাড্ডি পয়সা হবে কিন্তু ইতিহাসে তোমার নাম উঠবেই না। গ্যালারি অ্যাক্টিং-এ যেও না—ভেতরে ঢোকো—লোকের চিন্তাকে আন্দোলিত কর। বর্তমানকালের স্নোকতুনভস্কি১ বা বার্টন২ বা মিফুন৩ তুমি কোনওদিন হতে পারবে না।’
ছেলেটি অতি করুণভাবে বলল, ‘দাদা, কোথায় পাব এমন রোল?’ আমার কথা হচ্ছে, সস্তায় বাজি মাত করা যায় না, এটাই ধ্রুব সত্য। যে দশজন লোক বোঝেন তাঁদের কথা মাথায় রেখে অভিনেতার অভিনয় করা উচিত। শিল্পক্ষেত্রে নব্বই জনের শুধু আকাঙ্ক্ষাই থাকে কোনও শিল্পগত আশা থাকে না। সুতরাং শতকরা ওই দশজনকে লক্ষ করে এগোলে বাকি নব্বই জনের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। কিন্তু নব্বই জনের সন্তুষ্টির কথা ভাবলে ওই শতকরা নব্বই একদিন আপনাকে ছুড়ে ফেলে দেবে। কমার্শিয়াল ফিল্ম জগতে এটা বারে বারে হচ্ছে— লক্ষ করে দেখবেন।
আর আমি সব ফিল্ড-এ একরকম খেলায় বিশ্বাসী নই। ছোটো ফিল্মে আমি জানলেও কখনও প্রথম শ্রেণির খেলা দেখাব না। যেরকম জমি হবে ফসলও ঠিক সেই রকমই হবে। অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত রীতিকৌশল। এক বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘I am never good in every film, but in most of the films I protect myself from bad acting.’ এটার জন্য কোনও পরিচালকই আমার ওপর কখনও অসন্তুষ্ট হন না, বা হবার রাস্তা থাকে না।
একটা কথা বলেই শেষ করি। কোনও একজন জুনিয়র অভিনেতাকে বলছিলাম একদিন, ‘প্রচুর প্রচুর কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম করেছি এবং এখনও করি এই অভিনয় শিল্পটাকে জানবার জন্যে। এখন মনে হচ্ছে শিল্প কী—সেই সিঁড়ির প্রথম ধাপটা একটু একটু দেখতে পাচ্ছি। পৌঁছোতে এখনও অনেক বাকি।’
আমি সারাজীবন ছাত্র হয়ে থাকতে পারলেই আনন্দিত। বস্তুতান্ত্রিক সফলতা দেখে কখনও শিল্পীকে বিচার করা উচিত নয়, ওটা মূর্খতা। শিল্পগুণ ও মেটিরিয়াল সাকসেস শতাব্দীতে একটা লোকেরই হয়। আমাদের যুগে যেমন স্বর্গত স্যার চার্লস চ্যাপলিন-এর হয়েছিল।*
* অনবধানবশত সময়ের উল্লেখে ত্রুটি হয়ে গেছে মনে হয়। সালটা হবে ১৯৫২।
** সালটা ১৯৫৮ রবীন্দ্র জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে।
*** ছায়ানট হয় ১৯৫৮ সালে।
দেশ, ১৭ জুন, ১৯৭৮।
টীকা
১) স্নোকতুনভস্কি—পুরো নাম ইনোকেন্টি স্নোকতুনভস্কি (১৯২৫-১৯৯৪)। এক বিশ্বখ্যাত রাশিয়ান অভিনেতা। সাইবেরিয়ার গ্রামে জন্ম। সোভিয়েত দেশের অভিনয়ের ‘রাজা’ বলা হত তাঁকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লালফৌজে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে ক্রাসনোয়ারসক-এ প্রথম থিয়েটারে যোগ দেন। ১৯৫৭-য় মস্কো আসেন। জর্জি তবস্তোনোগভের আমন্ত্রণে লেনিনগ্রাডের বলশয় থিয়েটারে যুক্ত হন। ডস্তয়েভস্কির ‘ইডিয়ট’-এর নাট্যরূপে প্রিন্স মিসকিনের চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেন। ১৯৬১ সালে মিখাইল রোমের ‘নাইন ডেজ ইন ওয়ান ইয়ার’ ছবিতে প্রথম চলচ্চিত্রাবতরণ। ১৯৬৪ সালে কোজিনেৎসভের রাশিয়ান ছবি ‘হ্যামলেট’-এর মুখ্য ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করে খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন স্নোকতুনভস্কি। ‘সোলজারস’ (১৯৫৬), ‘স্টর্ম’, ‘Beware of the Car’ (১৯৬৬), ‘Crime and Punishment’ (১৯৭০), ‘Dead Souls’ (১৯৮৪), ‘Mother’ (১৯৮৯) ইত্যাদি এই অভিনেতার অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি।
২) বার্টন—প্রখ্যাত ইংরেজ অভিনেতা রিচার্ড বার্টন (১৯২৫-১৯৮৪)। ওয়েলস-এ জন্ম। ইংল্যান্ডের নাগরিক। ১৯৫০ থেকে নাটকে অভিনয়। মূলত শেক্সপীয়ারের নাটকে অভিনয়ে খ্যাতি কুড়োন। ‘হ্যামলেট’-এ অসাধারণ অভিনয় করেন। প্রথম ছবিতে অভিনয়—’My cousin Rachel’ (১৯৫২)। এছাড়া, ‘The Robe’, ‘Bachet’, ‘Where Eagles dare’, ‘The Spy who came in from the cold’ ইত্যাদি বার্টন অভিনীত অনেক ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত, স্টার অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের সঙ্গে তাঁর বারদুয়েক বিয়ে ও বিচ্ছেদ হয়।
৩) মিফুন—জাপানের এক বিখ্যাত অভিনেতা হলেন তোসিরো মিফুন (১৯২০- ১৯৯৭)। প্রায় ১৭০টা ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ‘রসোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘থ্রোন অফ ব্লাড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছবি সহ প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার ১৬টা ছবিতে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়াও বন্ধুর আমন্ত্রণে ১৯৪৭ সালে ‘তোহো’ প্রোডাকশনে যোগ দিয়ে সহকারী ক্যামেরাম্যানের কাজও করেছেন।