রবি ঘোষ একটা সময়ের নাম – শর্মিলা ঠাকুর
রবি ঘোষ, রবিদা আসলে আমার কাছে একটা সময়ের নাম।
কলকাতায় যখন আমি অভিনয় শুরু করি, তখন আমার খুবই কম বয়স। সেই সময় রবিদা ছিলেন আমার শিক্ষক, মেন্টর (এই কথাটার বোধহয় তেমন বাংলা হয় না)। যাকে বলে আমার ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড। একসঙ্গে আমরা প্রচুর মজা করেছি। প্রচুর ভালো সময় কাটিয়েছি। অসাধারণ সেন্স অব হিউমার ছিল রবিদার। অভিনয়ের অনেক কিছু শিখেছিও তাঁর কাছে। যেমন ‘ছায়াসূর্য’-র সময়ে। লোকেশনটা এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু ট্রেনের মধ্যে একটা দৃশ্যে আমায় হাসতে হবে। যাকে বলে বাঁধনহারা হাসি। চিত্রনাট্যে তাই আছে এবং আমি হাসতে পারছি না। কাট… কাট… কাট… কাট…। রবিদা শিখিয়েছিলেন কীভাবে হাসতে হয়! কীভাবে নিজের ভেতরে একটু একটু করে আবহটা তৈরি করতে হয়। ঘটনা যা হল, আমি তারপর হাসি আর থামাতে পারি না। এমন টুকিটাকি সাহায্য রবিদা কতবার যে করেছেন আমার অভিনয়ের জীবনে!
প্রথম কবে রবিদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মনে নেই। সম্ভবত অশোক ঘোষালের মাধ্যমে আলাপ হয়েছিল। ওঁরা দু’জন খুবই বন্ধু ছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে দেখলাম, রবিদার বন্ধু, আত্মীয়, পরিজনেরা আমার বন্ধু হয়ে গেলেন। রবিদার বাড়ি হয়ে গেল ‘সেকেন্ড হোম’। যখন খুশি যেতাম-আসতাম। এইভাবেই রবিদা আমার বন্ধু হয়ে গেলেন। তখন দু-তিনদিন অন্তর অন্তর কথা হত।
কোন কোন ছবিতে রবিদার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি, তাও আর মনে পড়ে না। কারণ, রবিদা আমার যতটা না সহকর্মী ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন বন্ধু। প্রচুর ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছি তো বটেই, কিন্তু ওঁর সঙ্গে অভিনয় করা কোনও দৃশ্যের কথা, কেন জানি না, মনে পড়ছে না। যদিও খুবই মনে পড়ে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র সময়টা। আমি, রবিদা, সৌমিত্র, শুভেন্দু—আমরা সকলে একসঙ্গে। অসম্ভব মজা হয়েছিল। সেই দৃশ্যটা এখনও মনে আছে—মেমরি গেম খেলার সময় রবিদা আমার কালো চশমাটা পরে বলছেন, ‘অতুল্য ঘোষ’। পুরো ইউনিটের সঙ্গে ছিপাদোহরে গিয়েছিলাম শুটিংয়ের জন্য। প্রচণ্ড গরম ছিল তখন। আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল একটা কুলার-লাগানো ঘরে। আর রবিদারা ঘুমোতেন গরমের মধ্যে। দিনের পর দিন শুটিংয়ে এসে বলতেন, ‘ভাপা হয়ে এসেছি।’ কিন্তু সময়টা খুব ভালো কেটেছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সাঁওতাল পল্লিতে চলে যেতাম। ওদের গান শুনতাম, নাচ দেখতাম, কখনও কখনও নাচতামও সবাই মিলে। আসলে রবিদার সঙ্গে কাজ করা নয়, মনে পড়ে কাজের বাইরে কাটানো সময়গুলোর কথা। একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, প্রচুর প্রচুর আড্ডা মারা, সাহিত্য পড়া, নাটক আলোচনা, সিনেমা দেখা—আমার স্মৃতিতে এগুলোই অনেক বেশি জীবন্ত। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র শুটিং সেরে ফেরার সময় যেমন রাঁচি স্টেশনে এক বিশাল জনতা, তা প্রায় পাঁচ-ছ’শো লোকের হবে, আমাদের ট্রেন আটকে দিয়েছিল। সম্ভবত আমাকে দেখার জন্যেই। তখন সবে ‘আরাধনা’ রিলিজ করেছে। লোকেরা লাইনের ওপরে শুয়ে পড়েছিল। রবিদারা সকলে মিলে স্থানীয় লোকেদের বুঝিয়ে শুনিয়ে বলাতে ছাড়া পেয়েছিলাম। এমন কত যে স্মৃতি।
রবিদা আমার বন্ধু ছিলেন—এটুকু বললে কতখানি বলা হয় জানি না। যদিও ওঁর সঙ্গে আমার নিয়মিত চিঠি লেখালেখি বা ফোন করা… তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু রবিদার মৃত্যুর পরে মনে হয়েছিল, আমার এক বন্ধুকে আমি হারালাম। আসলে যোগাযোগ রাখাটাই জরুরি নয়। এখন যদি আমি চলে যেতাম, উনি রয়ে যেতেন, আমি নিশ্চিত, রবিদাও আমার মতো করেই আমার সম্বন্ধে ভাবতেন। রবিদার কাছে আমার এবং আমার কাছে রবিদার—বরাবরই একটা আলাদা জায়গা ছিল। আমার জীবনের প্রত্যেকটা মাইলস্টোনঃ টাইগারের সঙ্গে বিয়ে, সঈফের জন্ম—প্রতিটায় রবিদা নিজের মতো করে শরিক হয়েছেন।
মানুষ রবিদাকে দেখার একটা ঘটনা আমায় ছুঁয়ে গিয়েছিল। যখন ওঁর ভগ্নিপতি মারা গেলেন। সম্ভবত জলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। এবং রবিদা ওঁর পরিবারের পুরো দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। স্বেচ্ছায়। আরও একটা ব্যাপার ছিল রবিদার মধ্যে। অনেকদিন নাটকের জগতে কাজ করেছেন। কিন্তু কখনও নাটকের জগতের রাজনীতিতে নিজেকে জড়াননি। এবং টাকাপয়সার প্রতি অনীহা, তখন যেটা একটা ফ্যাশান ছিল, তেমন আরোপিত কিছু রবিদার মধ্যে আমি দেখিনি। আসলে রবিদার শিকড়টা ছিল বাস্তবের মাটিতে। সেটা বোঝা যেত ওঁর পরিচয়ের গণ্ডি দিয়েও। কত ছড়ানো জগৎ যে ছিল ওঁর বন্ধুত্বের। শুধু সিনেমার লোকেরা নন। ডাক্তার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, এগজিকিউটিভ—কে নয়? মনে পড়ে, যখন আমার দাঁতের সমস্যা হয়েছিল, রবিদাই ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। রবিদা সকলের সঙ্গে সমানভাবে মিশতে পারতেন। অনায়াসে। যেমন টাইগারের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হল। কোনও ইগো দেখিনি। ওই অনেকে যেমন করেন কমপ্লেক্স থেকে—তুমি ক্রিকেটার, তা হলে আমিও বাপু অভিনেতা। টাইগারেরও তাই খুব ভালো লাগত রবিদাকে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। বাইরের লোকের মধ্যে রবিদাই ওঁকে ‘টাইগার’ বলতেন। টাইগারকে বিয়ে করেছি শুনেও খুব খুশি হয়েছিলেন। আসলে আমার কোনও কাজ নিয়েই রবিদা কখনও সমালোচনা করেননি। ১৯৬৩ সালে আমি যখন মুম্বই (তখন বোম্বাই) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। রবিদা কিন্তু আমায় সমর্থন করেছিলেন। সঈফের বিয়ের সময় চিন্তিত হয়ে ফোন করেছিলাম ওঁকে। উনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সাহস দিয়েছিলেন। আমি যে মুম্বইতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলাম তাতে রবিদা খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
রবিদার সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়গুলোও যেন হারিয়ে গেল। সেই সময়, যখন কোনও টেনশন ছিল না। পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল প্রবল। কত বড়ো ছিলেন রবিদা আমার চেয়ে? ১২/১৩ বছরের হবে। কিন্তু আমার সব সময়েই মনে হত, উনি আমার চেয়ে অনেক বড়ো। আসলে যখন আপনার নিজের বয়সই ১৫ বা ১৬, তখন ১০ বছরের বড়ো একজনকেই অনেক বড়ো বলে মনে হয়। তাই রবিদার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল, সম্ভ্রম ছিল। কিন্তু আবার দূরত্বটা ছিল না। যেমন ছিল মানিকদার সঙ্গে। মানিকদা এলেই আমাদের কথা বন্ধ হয়ে যেত, উঠে দাঁড়াতাম। মানিকদাকে আমি দেখতাম শুধু শ্রদ্ধা নিয়েই। একজন শিক্ষকের মতো। এক আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্বের মতো। কিন্তু বংশীদা (বংশী সেনগুপ্ত), রবিদা ছিলেন বন্ধুর মতো, যাঁদের সঙ্গে নানারকম হাসিঠাট্টাও করা যায়। কোথায় বুদ্ধিজীবী মানসিকতার কমল মজুমদার, কোথায় আমি—সদ্য কনভেন্ট স্কুল পাস করা মেয়ে, আর কোথায় মানিকদা—সবার সঙ্গেই তিনি তাল মেলাতে পারতেন।
তবে সবচেয়ে বেশি জমত উৎপলদার (উৎপল দত্ত) সঙ্গে। রবিদা ছিলেন এক নিখাদ উৎপল-ফ্যান। অনেক সময়েই আমরা অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আলোচনা করেছি। নটী বিনোদিনী, গ্রেটা গার্বো, ব্র্যান্ডো, পল মুনি, সুচিত্রা সেন, ছবি বিশ্বাস, শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে আলোচনা হত। তবে সবসময়েই রবিদার আলোচনায় সবচেয়ে বেশি সময় পেতেন উৎপল দত্ত। ওঁর জন্য রবিদার মনে সবসময়েই একটা আলাদা জায়গা ছিল।
অনেকেই হয়তো বলবেন, অভিনেতা হিসেবে রবিদাকে আমি কোথায় রাখি? বলতে পারব না। কারণ, রবিদার কাজের মূল্যায়ণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, ওটা আমার কাজও নয়। রবিদা বা মানিকদাকে যখন প্রথম দেখেছি, আমি তখন নেহাতই খুকি। বয়:সন্ধির সময় সেটা। তাঁদের কাজের মূল্যায়ণ আমি কী করে করব? ওঁরা যা করেছেন, যা বলেছেন, সেটাই ঠিক। ওঁর সঙ্গে তো আমি আর কাজ নিয়ে তর্ক করার মতো কোনও জায়গায় ছিলাম না। হয়তো অমল পালেকরের সঙ্গে করতে পারতাম, বাসু ভট্টাচার্যের সঙ্গেও। বা অন্য কোনও সহকর্মীর সঙ্গে। কিন্তু রবিদার সঙ্গে নয়।
শেষ দেখা হয়েছিল অনেক বছর আগে। যখন ‘আই উইটনেস’ ভিডিয়ো ম্যাগাজিনে মানিকদাকে নিয়ে তথ্যচিত্র তোলার সময় রবিদার ইন্টারভিউ করেছিলাম। বৈশাখীকেও সেই প্রথম দেখলাম। তারপর আরও একবার বোধহয় দেখা হয়েছিল কলকাতায়? নাকি এখানে? রবিদাই বোধহয় দিল্লি এসেছিলেন। ইসমাইল মার্চেন্ট যখন সৌমিত্রকে নিয়ে ছবি করছিলেন, তখন কলকাতায় গিয়েছিলাম। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে গেলাম। তপনকাকু, সৌমেন্দু, সৌমিত্র অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। রবিদা সেইদিনই স্টুডিয়োতে আসেননি। রবিদাকে নিয়ে আলোচনা হল অনেকের সঙ্গেই। কিন্তু রবিদার সঙ্গে দেখা আর হল না। এখন মনে হয়, তখন যদি একবার দেখা করে আসতাম। রবিদার মৃত্যুর খবরটা পাই সকালের কাগজে। টাইগার পড়ে শুনিয়েছিল। কতটা আঘাত পেয়েছিলাম সেটা বোঝানো মুশকিল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হয়েছিল, কাজ করতে করতে সেট থেকে চলে যাওয়া; এটা রবিদাকেই মানায়। ওঁকে যতটা চিনতাম, অথর্ব হয়ে অন্যের মুখ চেয়ে বেঁচে থাকার পক্ষপাতী ছিলেন না। যেতে হলে এইভাবে যাওয়া উচিত বোধহয়। স্বচ্ছন্দে, প্রায় বিনা যন্ত্রণায়।
এত স্মৃতি যে কোনও একটার কথা মনে করে বলতে পারি না। শুধু বলতে পারি, রবিদা ছিলেন একজন অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। যদি তাঁর চরিত্রে অন্য কোনও দিকও থাকে, জানি না। জানতে চাইও না। আমার সামনে কেউ কখনও রবিদাকে অভিনেতা বা মানুষ হিসেবে খারাপ বলেননি। কারণ, সকলেই জানতেন রবিদা আমার বিশেষ বন্ধু। বন্ধুত্বের সুবাদে আমরা কিন্তু একে অন্যকে পেশাদারি প্রয়োজনে কোনওদিন ব্যবহার করিনি। আমাদের বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। যোগাযোগ ছিল না? তাতে কী? রবিদা সবসময়েই আমার কাছে ছিলেন। এখনই যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ান, নিশ্চিত জানবেন, শুরু করতে পারব আবার শেষ দেখা হওয়ার সময় থেকে।
লেখার প্রথমেই বলেছিলাম না, রবিদা আমার কাছে একটা সময়ের নাম। ওটাই আসল। যখন আমরা মধ্যবয়সে পৌঁছই, তখন আচমকাই অতীতটা আমাদের কাছে অনেক দামি হয়ে পড়ে। তখনকার মানুষেরা একের পর এক চলে যেতে থাকলে মনে হয়, সেই দিনগুলোও যেন জীবন থেকে মুছে যাচ্ছে। মনে হয়, সেই সময়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
রবিদা, আমার একান্ত নিজের বন্ধু, আপনজন, সেই সময়টা সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছেন।
প্রদ্যোতকুমার ভদ্র ও রানা দাস সম্পাদিত ‘রবি ঘোষ স্মারক সংকলন’ (রবি ঘোষ স্মৃতি সংসদ, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) গ্রন্থ থেকে ডা. বারীণ রাযের অনুমতিক্রমে পুনর্মুদ্রিত।