শিশির ভাদুড়ি

শিশির ভাদুড়ি

যতদূর মনে পড়ছে শিশিরকুমার ভাদুড়ির থিয়েটার প্রথম দেখেছিলাম ১৯৫১ সালে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছি। কলকাতার থিয়েটার দেখার শুরু সেই সঙ্গে সঙ্গেই। একটা বড় ভাগ্য বলতে হবে যে কলকাতায় থিয়েটারে প্রথমেই যা দেখেছিলাম তা শিশির ভাদুড়ির অভিনয়। ভাগ্য এই কারণে বলছি যে, অভিনয়ের উৎকর্ষ, অভিনয়ের মান, অভিনয়ের ব্যাপারে রুচি, অভিনয়ে অনুসরণযোগ্য পথ গোড়াতেই পাওয়াটা ভাগ্যের কথা বইকি। ছাঁচ-না- পড়া কমবয়সে সজীব মনের ওপর অত উঁচুদরের অভিনয় প্রভাব সৃষ্টি করেছিল তাই খুব সম্ভবত আমার আশৈশবের নেশাটাকে পেশা করে নেওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় তাগিদ লাগিয়েছিল।

থিয়েটার, সিনেমার অন্যান্য অনেক অভিনেতাও মনকে টেনেছেন বইকি। কিন্তু আমার কাছে শিশিরকুমারই ছিলেন সর্বোত্তম। তাই আছেন। এত সব মনীষী জ্ঞানীগুণী শিশিরকুমারকে মহাপ্রতিভাধর বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, আমার এ-কথা নতুন কিছু সূচনা করে না; তবু বলছি কারণ, ত্রিশ বছরের ওপর পেশাদার হিসেবে কাজ করছি, দেশ ও বিদেশের অনেক অসামান্য অভিনয় দেখা হয়েছে, কিন্তু শিশিরকুমারের অভিনয়ের ঐশ্বর্য আজও আমার কাছে ফুরায়নি। বরং বারবার নতুন করে বিস্মিত করে।

শিশিরকুমারের অভিনয় প্রথমবার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ১৯১১ সালে। কবির পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে সাহিত্য পরিষদের সংবর্ধনায় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট-এর সভ্যরা ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই অভিনয় দেখেছিলেন। পরে অমল হোমের চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন—

কল্যাণীয়াসু,

তোমার চিঠি পেলাম।

তোমার ইনস্টিটিউটের বন্ধুদের জানিও তাঁদের অভিনয় আমার খুব ভাল লেগেছিল। বৈকুণ্ঠের খাতার এমন সুনিপুণ অভিনয় এক আমাদের বাড়িতে গগন-অবনদের ছাড়া কারুরই পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ওই পার্টে আমার যশ ছিল।

২৩শে মাঘ, ১৩১৮

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বলাই বাহুল্য, কেদারের ভূমিকায় ছিলেন শিশিরকুমার। তখনও কিন্তু শিশিরকুমারকে রবীন্দ্রনাথ চিনতেন না।

১৯২৪ সালে মনোমোহন নাট্যমন্দিরে সীতা নাটকের অভিনয় দেখতে যান। কিছু লোক রটনা করতে থাকে, সে অভিনয় রবীন্দ্রনাথের নাকি ভাল লাগেনি। শিশিরকুমারের বন্ধু রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সর্বক্ষণই ছিলেন সীতার অভিনয় দেখার সময়। তাঁর চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:

কল্যাণীয়াসু,

কাগজে নিজের জবানীতে অভিনয় সম্বন্ধে কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। তুমি লিখে দিতে পার যে, শিশির ভাদুড়ির প্রয়োগ নৈপুণ্য সম্বন্ধে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। সেই কারণেই ইচ্ছাপূর্বক আমার দু-একটা নাটক অভিনয়ের ভার তাঁর হাতে দিয়েছি। সীতা বইটিকে আমি একটুও পছন্দ করিনি। ওটা নাটকই নয়। এই জন্যই এ নাটক অবলম্বন করে অভিনয়ের উৎকর্ষ দেখানো কঠিন— তৎসত্ত্বেও শিশিরবাবু নিজের ক্ষমতার জোরে এই বইটিকেও চালিয়ে দিতে পেরেছেন। তুমি আমার কাছ থেকে এ-সব কথা শুনেছ বলে লিখতে পার। ইতি

১২ই ভাদ্র, ১৩৯১

রবিদাদা

এইসব চিঠি ছাড়াও আরও অনেক জায়গায় ছড়ানো রয়েছে শিশিরবাবু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্নেহের ও গুণগ্রাহিতার পরিচয়। ‘আমাদের নটরাজ শিশির ভাদুড়ি’ বলেও উল্লেখ করেছেন। সীতার অভিনয় দেখে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন লিখেছিলেন, ‘আমি আমার কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম শ্রীমান শিশিরকুমার ভাদুড়ি জগতের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম। আজ আমি রামের ভূমিকায় তাঁহার অভিনয় দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম যে তাঁহারা অতি সত্য কথাই বলিয়াছিলেন।’

শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন— ‘বিগত দুই-রাত্রি উপর্যুপরি আদ্যোপান্ত মুগ্ধ হইয়া আমি সীতা নাটকের অভিনয় দেখিয়াছি। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে ইহার তুলনা নাই। আশ্চর্য এই স্বল্পকালের মধ্যে শিশির কি করিয়া তাঁহার দলের নতুন লোকগুলিকে এমন মানুষ করিয়া তুলিলেন। বিশেষ করিয়া তাঁহার নিজের অভিনয় দেখিবার সময় বহুবারই মনে হইয়াছে, এই বাংলাদেশের সমস্ত অভিনেতাই যে সবিনয়ে ইঁহার কাছে আপনাদের শিশু বলিয়া মনে করেন, তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছু নাই। এবং সত্য স্বীকার করায় তাঁহাদের গৌরব আছে।’

এইসব প্রশংসা ইত্যাদির উল্লেখ করার এমনিতে কোনও দরকার বোধ করতাম না। কিন্তু শিশির ভাদুড়ির মৃত্যুর পর তিরিশ বছর অতীত হয়েছে। ইতিমধ্যে একাধিক নতুন প্রজন্ম এসেছে। তাঁদের অনেকের কাছেই শিশিরকুমার ভাদুড়ি একটা বিশ্রুত বিস্মৃতপ্রায় কিংবদন্তি ছাড়া কিছু নয়। বিতর্কিতও বটে। কেমন ছিলেন তিনি নট হিসেবে? কতখানি সার্থক? কতখানি গৌরবের দাবি তাঁর পরিচালক বা প্রয়োগকর্তা হিসেবে? উত্তরকালের জিজ্ঞাসু এসব প্রশ্নের সামনে দাঁড়ালে প্রথমেই তো তাঁকে খুঁজতে হবে পূর্বগামীর রেখে যাওয়া সাক্ষ্য। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, দেশবন্ধুর মতো অলোকসামান্য মানুষের সাক্ষ্যের থেকে প্রমাণ আর কী হবে এই ভেবে এইসব প্রশংসার কিছুটা উদ্ধার করলাম।

তবে নট হিসেবে যত অসামান্যই হোন না কেন, বাংলার রঙ্গালয়ে শিশির ভাদুড়ির অনন্য দান নিঃসন্দেহে প্রয়োগকর্তা হিসেবে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা স্মর্তব্য যে, নাটকের মঞ্চায়নে ‘প্রয়োগ’ শব্দটা আধুনিক অর্থে সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যবহার করেছিলেন শিশিরকুমারের কাজ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে। নাটকের যূথ অভিনয়, দৃশ্যপট, আলোকের ব্যবহার, ধ্বনি, সঙ্গীত সব নিয়ে সমগ্র থিয়েটারের ধারণা শিশিরকুমারের প্রয়োগের মধ্য দিয়েই বাংলা রঙ্গালয়ে প্রথম সার্থকভাবে দেখা দিয়েছিল। এ বিষয়ে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের ‘নাচঘর’ পত্রিকায় লেখা একখানি চিঠি প্রামাণ্য সাক্ষ্যরূপে সবটাই উদ্ধার করতে ইচ্ছে করে। স্থানাভাবে তার কিছুটা করছি।

‘সে বছরে আমি আর একদিন কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে গিয়ে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় শিশিরবাবুর অভিনয় দেখার সুযোগ পেয়েছিলেম। সেবারে দেখেছিলেম শিশিরবাবু একা সমস্ত অভিনয় ব্যাপারটা পরিপূর্ণ করে আছেন, তাঁর সহচর নেই। সমকক্ষ অভিনেতাও নেই সেবারের রঙ্গমঞ্চে। (যে অভিনয়ের কথা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সেটা ছিল ম্যাডান থিয়েটারে ক্ষীরোদপ্রসাদ রচিত ‘আলমগীর’ নাটকের কথা।) এবারে মনোমোহন নাট্যমন্দিরে গিয়ে দেখলেন, যে-সব অভিনেতা অভিনেত্রীকে শিশিরবাবু নিজের হাতে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন, আস্তে আস্তে তাঁরা যাতে তাঁর সমকক্ষতা করতে পারেন; তার কারণ, নিজের অভিনয়পটুটা তিনি ইচ্ছে করেই সম্পূর্ণ প্রকাশ না করে অন্যের অভিনয়টিকে অনেকখানি ফুটে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন। বড় যে, সে ছোটদের কল্যাণ কামনা করে, নিজের বৃহৎ আওতা অনেকখানি সরিয়ে নিয়েছে। এটুকু আমার কাছে ভারী নতুন লাগল। ইতিপূর্বে— বাংলার কোন রঙ্গালয়ের কর্তারা নিজেকে একপাশ করে রেখেছেন দেখেছি বলে তো মনে হয় না।’

অবনীন্দ্রনাথের এই সাধুবাদের সঙ্গে আরও অনেক জ্ঞানীগুণীর উচ্ছ্বাস এইখানে উদ্ধৃত করা যেত কিন্তু তা না করে শুধু শম্ভু মিত্রর একটি মন্তব্য এখানে আনছি।

‘কে বলে ভাল অভিনেতা নেই আমাদের দেশে? মনে করুন শিশিরকুমারের নাদির শাহ, আলমগীর, রঘুবীর অভিনয়ের কথা। মনে করুন তাঁর ‘দিগ্বিজয়ী’, ‘রমা’, ‘সীতা’ নাটকের প্রয়োগ-নৈপুণ্যের কথা। রাতের পর রাত দেশের সমস্ত লোকের কল্পনাকে জ্বালিয়ে দিয়ে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটা অসহ ঔজ্জ্বল্য নিয়ে এই নবযুগসূচক আবির্ভূত হয়েছিলেন মঞ্চে। কলেজের ছাত্রদের মনে হত রবীন্দ্রনাথ আর শিশিরকুমার, একই পংক্তির যেন দুটো নাম।’

এইসব উচ্ছ্বাস, সাধুবাদ, প্রশংসা, ভক্তির অপর্যাপ্ত নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও শতবর্ষের প্রাক্কালে এসেও শিশিরকুমারের পরিচয় অনেকটাই দেখি ঢাকা পড়ে রয়েছে অজ্ঞতা, অবহেলা ও অবিশ্বাসের ধূলিমলিনতায়। শিশিরপ্রতিভাকে বুঝতে না পারার জন্য যতখানি, ঠিক ততখানিই সমসাময়িকের ঈর্ষার জন্য তাঁর আবির্ভাবলগ্নেই শিশিরবাবুকে এই অজ্ঞতা, অবহেলা ও অবিশ্বাসের শিকার হতে হয়েছিল। চিন্তাহীন মূঢ় বিরূপতা তাঁর ‘সীতা’ হরণ করেছিল। ডি এল রায়ের সীতা অভিনয়ে অসমর্থ হয়ে যোগেশ চৌধুরিকে দিয়ে নতুন সীতা লেখাতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু পরবর্তীকালের যাঁরা নাট্যনায়ক তাঁরা শিশিরকুমার সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রচারে সহায় হয়েছেন, অনেক সময় প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় হয়েছেন, এইটাই বড় পরিতাপের বিষয়।

কোনও অজ্ঞান,শিক্ষাদীক্ষাহীন লেখক যখন ‘বিদ্রোহের থিয়েটারে’ প্রতিবিপ্লবী শিশির ভাদুড়ি নামক লেখা লেখেন (দুঃসাহসী লেখক ছদ্মনামের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছেন— শূদ্রক) তখন তাঁর বালখিল্যতায় খুব হাসি পায়। তিনি ধরেই নিয়েছেন বাংলা থিয়েটারের প্রধান ধারাটি হচ্ছে নীলদর্পণ নাটকের— যার মধ্যে অত্যাচারিত কৃষক উপস্থিত। অন্যটি হল প্রতিক্রিয়াশীল ধারা— দেবদেবী, অবতার, পুরাণ, ইতিহাস, সমাজ সংস্কার, ইংরেজ সভ্যতার কুফল ইত্যাদির ধারা। এই প্রতিক্রিয়াশীল ধারার বাহক শিশির ভাদুড়ি নীলদর্পণকে ধাক্কা মেরে নাকি সরিয়ে দিলেন থিয়েটার থেকে। এঁদের লেখা পড়লে ভাবতে বসতে হয় নীলদর্পণ আর সধবার একাদশী একই লোকের লেখা তো? নইলে অমন পরস্পরবিরোধী ধারায় স্থান পাচ্ছে কী করে?

কিন্তু এইসব উদঘুটে সমালোচক ছাড়াও আমাদের থিয়েটারে বহু নেতৃস্থানীয় শ্রদ্ধেয়রাও শিশিরকুমার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এত পরস্পরবিরোধী স্ববিরোধী যুক্তিহীন প্রমাণবিযুক্ত কথা বলেছেন যে তা নিয়ে হাসি পায়,— শুধু কিনা তা দুঃখের হাসি।

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত একজায়গায় বলেছেন, ‘শিশির ভাদুড়ি অনেক দিক থেকেই থিয়েটারকে এগিয়ে দিয়েছিলেন; অ্যাকটিং, কম্পোজিশন, গান, লাইট, এসব তো বটেই, এছাড়াও নাটক script হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষমতাও ওঁর ছিল অসামান্য। এসব দিকে শিশির ভাদুড়ি যতটা বাড়তে পেরেছিলেন সেট-এর conception-এ ততটা এগোতে পারেননি বলেই মনে হয়। অথচ, সেই সময়েই ঠাকুরবাড়িতে কিন্তু সেট সেটিং নিয়ে চিন্তা বা প্রয়োগ অনেকখানি এগিয়েছে।’

ঠাকুরবাড়ির সেট সেটিং-এর দায়িত্বে অবনীন্দ্রনাথ অনেক সময়ে থেকেছেন। তিনি কিন্তু সীতার মঞ্চ বিষয়ে বলেছেন— ‘চারুচন্দ্র নিপুণ চিত্রকর, তিনি দৃশ্যপট সাজগোজ যত্নে রচনা করলেন, অভিনয়কে প্রাধান্য দিতে গেলে নিশ্চয়ই দৃশ্যপটগুলিকে অনেক পিছনে রাখা দরকার। সেখানেও দেখলেম শিশিরবাবু অনেকটা বড় জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন দয়া করে চারুবাবুকে। প্রথম দৃশ্যেই এটা চোখে পড়ল আমার, তারপর যখন দুর্মুখ প্রবেশ করলেন তখন এটা আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠল।’

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘শিশিরের প্রযোজনার ফলেই বাংলা রঙ্গমঞ্চে হিন্দু যুগের পোশাক পরিচ্ছদ, stage decor বা মঞ্চসজ্জা প্রভৃতি বিষয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টির আধারে একটা যুগান্তর এসে গেল। অবনীন্দ্রনাথ আর নন্দলাল, অসিতকুমার প্রমুখ তাঁর শিষ্যদের ছবি— আর পিছনে রবীন্দ্রনাথের নানা কবিতা আর অন্য লেখা। এ বিষয়ে এগুলিরও অনুপ্রাণনা ছিল নিভৃতে, কিন্তু অত্যন্ত গভীর আর সুদূরপ্রসারী।

শম্ভু মিত্র শিশিরকুমারের নাট্যমুহূর্ত সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি এ বাংলাদেশের, আমার অনুমানে সমগ্র ভারতবর্ষের প্রথম নির্দেশক, যিনি মঞ্চের ছবি কল্পনা করেছেন। ধরা যাক এই নাটকেরই (দ্বিগ্বিজয়ী) তৃতীয় অঙ্ক। নাটকে লেখা আছে, দৃশ্য হচ্ছে একটা মসজিদের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গণ। কিন্তু চোখে দেখেছিলাম একটা ছাত। ছাতটার পিছন দিকের অংশ বোধহয় এক ধাপের মতো উঁচু ছিল। তারই শেষে হল ছাতের উঁচু প্রাচীর। এবং তারও পেছনে স্পষ্ট আঁকা দূরের বাড়িগুলোর ওপর অংশ ও আকাশ। এই দৃশ্য দেখা মাত্র মন ভরে গিয়েছিল। ছবিতে যেমন বেশিরভাগ জায়গাটা ফাঁকা রেখেই ভরাট করে তুলতে পারেন এক একজন শিল্পী এ সেরকম।’

হেমেন্দ্রকুমার রায়ও বঙ্গ রঙ্গালয়ে শিশিরকুমার কি কি পরিবর্তন সূচিত করেছিলেন তা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘পিছন থেকে টেনে তোলা সমতল ক্ষেত্রের আঁকা দৃশ্যপটের ব্যবহার তুলে নেওয়া। সীতার ঘরবাড়ি ছিল সত্যিকারের ঘরবাড়ির মতো। তার প্রত্যেক দরজার ভিতর কিংবা নগর বা অরণ্যের পথ দিয়ে প্রমাণাকারের মতো মানুষ আনাগোনা করতে পারত। আগে এমন দৃশ্য সংস্থান দেখা যায়নি। আগাগোড়া প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের প্রামাণিক স্থাপত্য ও সাজপোশাক এই প্রথম।’

এইসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রুদ্রপ্রসাদের উদ্ভাসিত উক্তিটি কি গ্রহণযোগ্য? রুদ্রপ্রসাদ অবশ্য একা নয়, আর একজন প্রতিভাধর নাট্যনায়কও এরকমই বিভ্রান্তিকর কথা বলেছেন, তিনি উৎপল দত্ত। তিনি বলেছেন— ‘শিশির ভাদুড়ির প্রাোডাকশনের সেট সেটিং একটুও কমপিটেন্ট ব্যাপার ছিল না। উনি জীবনে কখনও ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সীন তো নয়, স্রেফ ন্যাকড়া ঝুলছে।’

এরকম ভিত্তিহীন উক্তির উৎস কী? যদি ধরে নিই শেষদিকে শ্রীরঙ্গমের দৃশ্যপট ইত্যাদি এমনই দৈন্যদশায় পৌঁছেছিল তা দেখেই ‘ন্যাকড়া ঝুলত’ বলেছেন উৎপলবাবু। তাহলে তো বলব তিন দশকের প্রযোজনার উজ্জ্বল ইতিহাসের সত্য বর্ণনা না করে আংশিক ন্যাকড়া লেখায় গুঁজে দেওয়াটা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মিথ্যে বলে যাওয়া।’ গিরিশ মানস-এর লেখকের কাছে এমন আশা করা যায় না।

বাদল সরকার এক জায়গায় বলেছেন— ‘এখনকার কালে ওই যুগের প্রভাব পড়ার মতো কিছু দেখিনি। আমি স্টারে বিশ্বাস করি না। অ্যাক্টরস থিয়েটারে বিশ্বাস করি না, সবাই মিলে অভিনয় করাই ভাল। তখন তো ছিল না, সুতরাং এখন যা হয় তাকে নিশ্চয়ই প্রভাব বলতে পারব না।’ এর আগে অবশ্য বাদল সরকার স্বীকার করেছেন, ‘আসলে বহুরূপীর নাটক দেখেই আমার নাটক দেখার সূত্রপাত। তাই সেই যুগ সম্পর্কে কতটুকুই বা বলতে পারব?’

তা-ই যদি হয়, তাহলে না জেনে বলার দরকারটাই বা কি? নেই নেই করেও শিশিরের সমসাময়িক বহু লেখা রয়েছে, বইপত্র আছে। সেখান থেকেও তো জেনে নেওয়া যেত।

‘সবাই মিলে অভিনয়’ শিশিরবাবুর কালে ছিল না এমন অদ্ভুত ধারণা করার ভিত্তিটা কোথায় পেলেন? অবনীন্দ্র লিখেছেন, ‘কি অভিনয় করার দক্ষতা, কি অভিনয় শিক্ষা দেবার ক্ষমতা— দুই দিক দিয়ে শিশিরবাবুর পরিচয় নেবার সৌভাগ্য হয়ে গেল আমার সেদিন।’

তাহলে কি শেখালেন শিশিরবাবু যা সবাই মিলে অভিনয় করা হয়ে উঠল না?

নরেশ মিত্র লিখেছিলেন, ‘সীতা নাটকের সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল ‘টিমওয়ার্ক’। একদল শিল্পী এক হয়ে একান্নবর্তী সংসারের বাসিন্দা হয়ে যদি কিছু সৃষ্টি করে তাহলে তা অসাধারণ হয়ে ওঠে।’

নরেশ মিত্রর সাক্ষ্যকে যদি গুরুত্ব না দিতে হয় তাহলে মনে করতে হয় তিনি অভিনয়-কলা বুঝতেন না।

আমি নিজে যে সময়ে শিশিরবাবুর থিয়েটার দেখেছি তখন অবশ্য দলে পুরনো দলের দিকপালরা বেশিরভাগই নেই। অনেক দুর্বল অভিনেতাও আছেন। কিন্তু একই রকমের একটা স্টাইলের মধ্যে তাঁদের সকলের অভিনয় তখন বেশ কিছুটা যেন বাঁধা থাকত। শিশিরবাবুর রিহার্সালে উপস্থিত থেকেও এই ধারণাটা আমার হয়েছে যে, যে উনি শিক্ষার ভেতর দিয়ে সেইটেই তৈরি করার চেষ্টা করছেন। সেই ভাঙা হাটেও ‘সধবার একাদশী’তে কী চমৎকার টিমওয়ার্ক দেখেছি। অবশ্য মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের মতো মহান অভিনেতাও সেই টিমে ছিলেন, কিন্তু সেই একটি সোয়ালোতেই তো গ্রীষ্ম সূচিত হয়নি। বাকিরাও অনেকেই ভাল অভিনয় করতেন। মণি শ্রীমানি, বাণীব্রত, সমীর লাহিড়ী, সত্যেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখর নাম মনে পড়ছে।

সেট সেটিং ছাড়াও অভিনয় নিয়ে মন্তব্য করেছেন উৎপল দত্ত: —’আর শিশির ভাদুড়ির যেখানে দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা— তা হচ্ছে অভিনয় যতই ভাল হোক, নাটক চুলোয় যেত একটি কারণে। আলমগীর বা কর্ণার্জুন যাই করুন না কেন সেই যুগের পরিবেশ এক মুহূর্তের জন্য খুলত না।’ এরকম স্ববিরোধী আলগা অভিনয়-বিচার উৎপলবাবুর মতো পণ্ডিতের নিকট প্রত্যাশা করা যায় না। যে অভিনয়ে ‘যুগের পরিবেশ এক মুহূর্তের জন্য খুলত না’ তাকেই উনি ‘অভিনয় যতই ভাল হোক’ কী করে বলেছেন? যে-অভিনয়ে ‘যুগের পরিবেশ এক মুহূর্তের জন্য খুলত না’ সে-অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথের মতো কী অবনীন্দ্রনাথের মতো লোক মুগ্ধ হতেন কী করে, ভাবলে বিস্ময় হয় না কি? আমরা তো সবাই জানি এঁরা অসাধারণ অভিনেতা ছিলেন। তবে কি বলব এঁরা অভিনয় বুঝতেন না?

আর এক জায়গায় উৎপলবাবু বলেছেন— ‘অভিনয় ভাল হত, কিন্তু world standered acting কিছুতেই বলা যায় না।’ কেন? World standered বলতে যা বোঝায় তা সাহেবরা করে বলে? শিশিরকুমারের অভিনয় সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র দিলীপ রায়ের মতো লেখাপড়া জানা বিদেশ-টিদেশ ঘোরা শিল্পীই লিখেছেন— ‘কাল এক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল। তিনি শিশিরকুমারের আলমগীর দেখেননি। তাঁর এক বিলাত-ফেরত আত্মীয়া তাঁকে বলেছেন যে, শিশিরকুমারের অভিনয় সুন্দর হয়েছে বটে কিন্তু বিলাতের মতো হয়নি।’

কথাটা শুনে একটু হাসিও পেল, দুঃখও হল; সেটা এই কথা ভেবে যে, বিলাত সম্বন্ধে এরূপ অভ্রভেদী ধারণা আমাদের শিক্ষিত সমাজের মন থেকে দূর হতে এখনও অনেক দেরি।… ইংরেজদের চেয়ে ফরাসিরা শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (এ শুধু আমার মত নয়, ভারতীয়দের মধ্যে অভিনয়-কলার প্রায় একমেবাদ্বিতীয়ম বিশেষজ্ঞ সমালোচক সাহিদ সুরাওয়ার্দি অপিচ অন্যান্য ইউরোপীয়দেরও এই মত) ফরাসিদের চেয়ে রুশ জাতি শ্রেষ্ঠ। ইতালীয় অভিনয় আমি দেখিনি। কিন্তু বার্লিনে বন্ধুবর সুরাওয়ার্দির কাছে শুনেছি যে ইতালিয়ানরাও নাকি অভিনয়-দক্ষতায় ইংরেজদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কাজেই অভিনয়-কলার বর্তমান সময়ে শ্রেষ্ঠ ইংরেজ অভিনেতার স্থানও শিশিরকুমারের চেয়ে উচ্চে নয়, এ কথা বললেও যাঁরা নিখিল ইউরোপের শিল্পকলার খবর রাখেন impressed হবেন না।

আমি বলতে চাই যে, ইংরেজ ফরাসি জার্মান ও রুশ এই কয় জাতির শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও অভিনেত্রী দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এবং আমার মনে হয় বিখ্যাত রুশ অভিনেতা কাচালভ (Kachalov) ছাড়া আর কোনও অভিনেতাকেই আমি শিশিরকুমারের চেয়ে বড় অভিনেতা বলে মনে করি না।

উৎপলবাবুর আরেকটি মন্তব্য— ‘সেটে চলাফেরা করা, ঢোকা বেরনো— এইসব যে মোশান মাস্টারের কাজ সেখানে শিশির ভাদুড়ি ব্যর্থ।’ এরই পাশাপাশি দিগ্বিজয়ীর অভিনয়-সম্পর্কে শম্ভু মিত্রের বক্তব্য— সেই অভিনয়ে নাদিরের সাধারণ কণ্ঠস্বরের আদেশে অন্য সকলের যে সশ্রদ্ধ মনোযোগ, সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে যে সম্মানের তটস্থতা এবং চলায় ফেরায় যে সামরিক ক্ষিপ্রতা, এ সমস্তই তখন আমার কাছে একেবারে অকল্পনীয়। বাংলা থিয়েটারের পৌরাণিক বীরদের যে গদাই-লস্করি চালচলন তার সঙ্গে এর কোনও সাদৃশ্যই নেই। বরঞ্চ প্রধান চরিত্র নাদির শাহের বীরত্ব ও বুদ্ধি তার শার্দূল-ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে যেন প্রতিভাসিত হয়। এই প্রথম বুঝলাম যে এমন একজন লোক দরকার হয় যাঁর চিন্তাটা এই রকম প্রত্যেকটা চরিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি পর্যন্ত বিস্তৃত।

পরবর্তী প্রজন্মের অনুসন্ধানী এমত অবস্থায় কার কথা প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করবেন?

শিশির ভাদুড়ীর কিছু অভিনয়ের ও প্রযোজনার সম্পর্কে সহৃদয় হৃদয়সংবেদ্য বেশ কিছু বর্ণনা ও যথার্থ আলোচনা করা সত্ত্বেও শম্ভু মিত্রও কিন্তু শিশিরবাবু সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টির উৎস। ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের যে স্রোত চলেছে কাব্য-গল্প-চিত্র-নৃত্যের মধ্যে দিয়ে মঞ্চ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জাতির সাংস্কৃতিক জীবন থেকেই সে ছিন্ন। তা না হলে আজও পর্যন্ত কি ”শা-জাহান”, ”বঙ্গে বর্গী”র মতো নাটক অভিনীত হতে পারত এই আমাদের মঞ্চে, না নাট্যাচার্য ও বাণীবিনোদদের কেবলমাত্র অশ্লীল কণ্ঠবাদন করেই জীবিকা অর্জন করতে হত। অথচ তাঁরা ভাল অভিনেতা। অতীতে অনেক ভূমিকায় তাঁদের অনেককে দেখে আমরা পাগল হয়ে গেছি। তবু আজ আর নতুন করে কিছু অভিনয় তাঁরা করেন না বা করতে পারেন না, অর্থবিহীন কণ্ঠবাদনই তাঁদের পেশা।’ উপরিউক্ত পঙক্তি তো শম্ভু মিত্রেরই লেখা।

আমার সোজাসুজি প্রশ্ন হল, এই মন্তব্য সত্য না মিথ্যা? পোলেমিকস-এর বাকচাতুর্যে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া এটাকে আমার আর কিছুই মনে হয় না। ওই প্যারাগ্রাফের আগের প্যারাগ্রাফে শম্ভুবাবু লিখেছেন, ‘কাব্য গল্প চিত্র নৃত্য-এর কোনওটাই তত জনপ্রিয় নয় যত জনপ্রিয় থিয়েটার।’ পরের প্যারাগ্রাফেই যখন তিনি বলেন, ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের যে-স্রোত চলেছে কাব্য-গল্প-চিত্র-নৃত্যের (হায় বাঙালির নৃত্যের সাংস্কৃতিক মান!!) মধ্যে দিয়ে মঞ্চ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে’— তখন কোথায় যেন একটা স্ববিরোধ উঁকি মারতে আরম্ভ করে। থিয়েটার যদি জনপ্রিয় থেকেই থাকে, তাহলে তা কি সংস্কৃতির থেকে ততখানি বিচ্ছিন্ন? অন্য যে সব আর্টফর্মের কথা তিনি বলেছেন তারাও তো দেখা গেল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সংস্কৃতির ধারায় অনেকখানি দেউলিয়া, জনজীবন থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তাহলে তিনি থিয়েটারকে আলাদা করে নিচ্ছেন কী উদ্দেশ্যে? পরের প্যারাগ্রাফেই তিনি বলেছেন, ‘অভিনয় শিল্পের এই যে অবনতি এ বোধহয় সমস্ত দেশেই আসে। যখন ভাল নাটক দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। মঞ্চ তখন যেন এক অভিনেতার সম্পত্তি হয়ে ওঠে, এবং নাটকগুলো হয় exibitionism-এর উপলক্ষ মাত্র। অথচ মঞ্চ নাট্যকার, অভিনেতা ও দর্শক এই তিনের একটা এজমালি সম্পত্তি এই বোধটা তখন হারিয়ে যায়।’

এইখানে নাট্যাচার্যকে এমনকী বাণীবিনোদকেও আক্রমণ করাটা অর্থহীন তো বটেই, ভাষার দিক থেকে অশালীনও বটে। নাটক দুষ্প্রাপ্য হলে অভিনেতার দোষ হবে কেন? কোন যুক্তিতে? বিশেষত নাট্যাচার্য যখন নতুন পুরাতন ক্ল্যাসিক ইত্যাদি সর্বপ্রকার নাটক নিয়ে প্রায় ষাটটি প্রযোজনা করে বুঝিয়ে দেন তিনি ক্রমাগত ভাল নাটকের সন্ধান করেছেন? আর তাছাড়া সব সময়ই ভাল নাটক পেলে তবে অভিনেতার সু-অভিনয় হবে নইলে হবে না, এমন কথা সত্যি হতে পারে না। অনেক সময়ই অনেক দেশে ভাল নাট্যকার থাকেন না— তখনও তো ভাল অভিনেতার উদয় হতে বাধে না।

আমি নাট্যাচার্যকে শ্রীরঙ্গমে শেষ বছর পাঁচেকই অভিনয় করতে দেখেছি। তাঁর অভিনয় দেখে কখনই মনে হয়নি কেবলমাত্র অশ্লীল ও অর্থহীন কণ্ঠবাদন করেই তিনি জীবিকা অর্জন করেছেন। অসামান্য জীবনবোধে সমৃদ্ধ মনে হয়েছে তাঁর তখনকার অভিনয়। আমার মনে তো সত্যি একটা প্রশ্ন আছে যে বার্ধক্যের পরিণত প্রজ্ঞা তাঁর মতো সৃষ্টিশীল নটের অভিনয়ে যতখানি ঐশ্বর্য এনেছে, শম্ভুবাবুরা যে শিশিরকুমারের ভক্ত বলে নিজেদের বলেন অর্থাৎ তাঁর প্রথম দশ বছর— তখন তাঁর সে গভীরতা ছিল কিনা।

আর একটা কথা। থিয়েটার সাধারণভাবে নিশ্চয়ই নাট্যকার অভিনেতা দর্শকের মিলিত সম্পত্তি। কিন্তু কোনও সময়ে যদি নাট্যকার না-ই থাকে তাহলে মঞ্চ অভিনেতারই শিল্পকলায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলে আর্টের ক্ষতি হবে এমন শিল্প-আইন কোথায় লেখা আছে? থিয়েটার বা যে কোনও শিল্পেরই ঈপ্সিত সৌন্দর্য সৃষ্টির কোনও বাঁধা গৎ আছে কি? নেই। অভিনেতা যদি তাঁরই নিজস্ব শিল্পরচনার ক্ষমতা দিয়ে দর্শককে জীবনের একটা রসাত্মক আস্বাদ এনে দিতে সক্ষম হয় তাহলেও সেটাকে নিন্দা করতে হবে। আমাদের সমসাময়িক কালে ‘অপরাজিতা’র অভিনেত্রী তো অভিনয়-কলাকে সেই মহৎ শিখরেই তুলতে পেরেছিলেন। তাকে শিল্প বলতে আমার বাধা নেই; কণ্ঠবাদন বললে বা exibitionism বললে তো আমার মারাত্মক বোঝার ভুল বলেই জাহির হবে।

শিশিরকুমার সম্পর্কে আরও একটি অভিযোগও প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে শিশির-পরবর্তী নাট্যকর্মী ও নেতারা অনেক সময়েই করেছেন। উৎপলবাবু লিখেছেন— ‘নতুনকে মেনে নেওয়ার বা আহ্বান করার ক্ষমতার মধ্যে মহত্ত্ব রয়েছে। টিকে থাকতে গেলে তো তা করতেই হবে। শিশির ভাদুড়ি তা পারেননি। নবান্ন প্রসঙ্গে ওঁর বিরূপতা সর্বজনবিদিত।’ শম্ভু মিত্রের ‘নবান্ন নাট্যাভিনয়কে মঞ্চ ভাড়া না দিয়ে যেমন তার ফলপ্রসূ স্রোতকে রোধ করা যায়নি—’ এই মন্তব্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

শিশিরবাবুর যে ধরনের আত্মপ্রত্যয় ছিল তাতে নতুন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভয়ে তিনি নবান্নকে মেনে নেননি এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কত প্রতিদ্বন্দ্বিতারই সম্মুখবর্তী তো তিনি হয়েছেন থিয়েটারের জীবনে। চরিত্রের বিশিষ্টতা ব্যক্ত করতে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন— ‘তার path of rectitude সততার পথ ছিল তার পক্ষে একেবারে বাঁধাধরা।’ এহেন চরিত্রের লোকের পক্ষে একটু অবিশ্বাস্যই মনে হত। তবু একদিন আমি তাঁকে এ সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বলেছিলেন— ‘হ্যাঁ, আমার থিয়েটারেও তো ওরা নবান্নর অভিনয় করেছিল। আমি দেখেছিলাম। দেখলাম ওরা কম্যুনিস্ট। বেয়াল্লিশে ওরা ইংরেজের ফিফথ কলাম হয়েছিল। এদিকে কংগ্রেসই স্বাধীনতা আনছে এরকম একটা ধারণা আমার ছিল। আমার থিয়েটারে দাঁড়িয়ে কম্যুনিস্টদের কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে দেব না বলেই ওদের অভিনয় করতে দিইনি। কিন্তু দেখ, ওই কমুরাই (কম্যুনিস্ট) তো ঠিক বুঝেছিল। আমরাই বুঝতে পারিনি কংগ্রেসের স্বরূপটা। এ স্বাধীনতা যে ভুয়ো— আমরা যে আইনত ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর প্রজা, কলকাঠি ইংরেজের হাতে এ-তো ওরাই বুঝেছিল।’ এ-কথা বলেছিলেন ১৯৫৮ সালে। অতএব বোঝাই তো যাচ্ছে, নবান্ন যাঁরা করেছিলেন তাঁদের সেদিন মেনে নিতে পারেননি শিশিরকুমার।

তবে নবান্ন ও শিশিরবাবুর মনোভাব সম্পর্কে নবান্নর নাট্যকার, অভিনেতা ও নবনাট্য আন্দোলনের পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্যের মতটা জানা থাকলে এ- বিষয়ে সম্যক ধারণা করা যেতে পারে। বিজন ভট্টাচার্য লিখেছেন— ‘বাংলা নাটক ও শিশিরকুমার ভাদুড়ি এই বিষয় সম্পর্কে অন্য মনের বিশেষ সংখ্যায় আমার কাছে একটি লেখা চাওয়া হয়েছে। সম্পাদক মশাই আরও জানিয়েছেন যে, শিশির-পরবর্তী যুগের সূচনা যে নবান্ন দিয়ে সেই প্রসঙ্গে শিশিরকুমারের অনীহার একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে। প্রসঙ্গটির বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার।

আলোচনা নিশ্চয়ই হওয়া দরকার। অন্তত শিশিরকুমারের অনীহা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার ধারক-বাহক যাঁরা তাঁদের ব্যতিরেকেও বৃহত্তর শিল্পরসিক জনসাধারণের অবগতির জন্যেও বিষয়টি আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, উক্ত প্রচলিত ধারণা শুধু যে অমূলক তাই নয়, নিকৃষ্ট মানসিকতাসঞ্জাত অভিসন্ধিমূলক— কু বই কোনও সু নেই এই ধারণার মধ্যে। নাট্যের ক্ষেত্রে যাঁরাই শিশিরকুমারের সান্নিধ্যে এসেছেন ভাগ্যক্রমে তাঁদের কোনও বিচক্ষণের মুখেই এ কথা কোনওদিন শুনিনি। পক্ষান্তরে নাট্যক্ষেত্রে যুগচেতনা সম্পর্কে যাঁরা শিশিরকুমারের অনীহার কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে অর্বাচীনের মতো বুদ্ধিমত্তা ও সমাজসচেতনতা প্রকাশে প্রয়াসী হয়েছেন, তাঁরা পরে বিষয়বুদ্ধির নিরিখে সেই সব যুক্তি-তর্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাকি তবু যেটুকু সেটা ব্যাঘ্রের অনুসারী ফেউ-এর আর্তস্বর ব্যাঘ্রেরই গৌরব বাড়ায়।

নবান্নের যুগচেতনা সম্পর্কে অবহিত না থাকলে শিশিরকুমার কখনও তদানীন্তন কালে ‘দুঃখীর ইমান’ মঞ্চস্থ করতে ব্রতী হতেন না। এই নাট্য প্রযোজনার মূলে দীন দুঃখী ইমান সম্পর্কে শিশিরকুমারের সমাজসচেতনতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অদ্যকার খর দিনেও এই সচেতনতার স্বাক্ষর নামকরা প্রতিষ্ঠানের নাট্যকর্মে— অনুপস্থিত।’

অলমতি বিস্তারেণ। শিশিরকুমারের শতবর্ষের জন্মদিনটি এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *