চিরশ্রেষ্ঠ অভিনেতা চ্যাপলিন
আমায় যদি প্রশ্ন করা হয় সিনেমার ইতিহাসে চিরশ্রেষ্ঠ অভিনেতা কে, আমি এক মুহূর্ত না ভেবে এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলব চার্লস চ্যাপলিন। চ্যাপলিনের সম্বন্ধে এই মুগ্ধতা আমার একার নয়। যে যেখানে সিনেমা দেখে এবং চ্যাপলিনের ছবি দেখেছে সে আমারই মতো সেই খুদে মানুষ চার্লির চির অনুরক্ত হয়ে আছে। পণ্ডিত জ্ঞানীগুণী থেকে আপামর সাধারণ দর্শক চ্যাপলিনের অভিনয়ের ভক্ত। সমব্যবসায়ী অভিনেতাকুল পর্যন্ত নিত্যবিদ্বেষিণী ঈর্ষার ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর মহত্ত্বকে নমস্কার করে।
আমি খুব শৈশবের থেকেই চ্যাপলিনের ছবি দেখেছি। বিশেষ করে তাঁর স্বল্পদৈর্ঘে্যর বেশ কিছু ছবি এইট মিলিমিটার ফিল্মে। এইসব ছবি তখন আমাদের দেশেও পাওয়া যেত, আর আত্মীয় বন্ধু অনেকের বাড়িতে সংগ্রহে তা ছিল। এবং সেই ছবির প্রক্ষেপণ ঘরে বসেই দেখা যেত। তাছাড়া খুব ছোটবেলা থেকেই আমি স্কুল পালিয়ে অভিভাবকদের নিষেধ শাসনকে ফাঁকি দিয়ে সিনেমা হলে গিয়েও ছবি দেখতাম। তেমনভাবেও কিছু ছবি আমি শৈশবেই দেখে ফেলেছিলাম। পরবর্তীকালে কলেজে ওঠার পর অভিনয় থিয়েটার সিনেমা ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহটা যখন আরও ব্যাপক আকার নিল তখন তো চ্যাপলিনের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাটাও দানা বাঁধল। এবং তাঁর সম্বন্ধে লেখা বই বা প্রবন্ধাদি পেলেই পড়তে শুরু করলাম।
নিজে অভিনয়কেই জীবনধারণের উপায় বলে গ্রহণ করার পর থেকে দীর্ঘ তিন দশকের ওপর প্রায়শই চ্যাপলিনের ছবি চ্যাপলিনের অভিনয় আমার ভাবনাকে উদ্বেলিত করেছে। প্রত্যক্ষে না বোঝা গেলেও আমি নিশ্চিত যে তার প্রভাব কোনও না কোনওভাবে আমার অভিনয় চিন্তার মধ্যে আত্মস্থ হয়ে আছে।
অভিনয় যদি মানবচরিত্রের দর্পণ ও মানবজীবনের ব্যাখ্যা হয়, তাহলে তার এমন সদর্থক প্রকাশ চ্যাপলিনের অভিনয়ে দেখি যা প্রায় তুলনারহিত। চার্লস চ্যাপলিন বলেছিলেন যে, মনন ও সংবেদন অভিনেতার মধ্যে সমানভাবে কাজ করলে তবেই একজন অসামান্য অভিনেতাকে পাওয়া যায়। চ্যাপলিনের নিজের অভিনয়ে এই দুই গুণের চূড়ান্ত সমাবেশ ছিল বলেই সম্ভবত তাঁর অভিনয় এমন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এবং আজও মানুষকে আনন্দ দিতে সক্ষম হয়ে আছে।
নির্বাক চলচ্চিত্রেই তাঁর অভিনয় আমরা বেশি দেখেছি। সেখানে শরীরের ভঙ্গি তথা মুখাবয়বের ভাব ও অভিব্যক্তিই ছিল প্রধান আশ্রয়। এইদিক থেকে দেখলেও বিচিত্র ভাব প্রকাশে সক্ষম দেহ ও মুখ চ্যাপলিনের মতো আর কারও দেখেছি বলে মনে হয় না। এই শারীরিক অভিনয় ও মুখের অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবনবোধের আশ্চর্য প্রকাশ ঘটেছিল বলেই সম্ভবত সেই অভিব্যক্তিই এত ব্যঞ্জনাময় ও ঐশ্বর্যময়। জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেছেন বুঝেছেন তা তীব্রভাবে তাঁর অভিনয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। এবং জীবনের এই পরিস্ফুটনের কেন্দ্রে তাঁর মানুষকে ভালবাসা। বিশেষ করে গরিব মানুষ, সর্বহারা ব্যথিত উৎপীড়িত মানুষ বাঁচার জন্যে নিয়ত সংগ্রামে রত মানুষের জন্যে তাঁর তীব্র ভালবাসার নিবিড় মমতার অজস্র নিদর্শন তাঁর সমস্ত ছবির মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। ‘গোল্ড রাশ’, ‘দ্য কিড’, ‘সিটি লাইটস’, ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ সবই সেই লিটল ম্যান-এর জীবন সংগ্রামের অসাধারণ আখ্যান। এইসব আখ্যানের মধ্যে চ্যাপলিনের জীবনের অভিজ্ঞতাই শুধু ব্যাপ্ত হয়ে নেই, তাঁর মানুষ সম্পর্কে জীবন সম্পর্কে গভীর তীব্র আশাবাদও দীপ্ত হয়ে আছে। সামান্য মানুষের অসামান্য মহত্ত্বের দলিল হয়ে আছে চ্যাপলিনের ছবি ও তাঁর অভিনয়।
শুনেছি সবাক ছবি তৈরি হওয়া আরম্ভ হলে এই নতুন আঙ্গিকের সঙ্গে চ্যাপলিন বোঝাপড়া করে নিতে পারবেন কি না এ নিয়ে অনেকের সংশয় ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন যে বাক্যহীনতার থেকে সংলাপে যেতেই শুধু নয়, নির্বাক ছবির অভিনয়ের যে বিমূর্তকরণে চ্যাপলিনের অনায়াস দক্ষতা ছিল তার থেকে সবাক চলচ্চিত্রে বাস্তবিকতায় যেতে চ্যাপলিনের অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু বস্তুত যে সবাক ছবিগুলি তারপর তিনি করেছিলেন তার মধ্যে এই অস্বস্তির বিন্দুমাত্র সাক্ষ্য নেই। মঁশিয়ে ভের্দু বা লাইমলাইটের অভিনয় আমার কাছে আজও আধুনিক সিনেমার অভিনয়ের দৃষ্টান্তস্থল বলেই মনে হয়। অথচ যে প্রবল প্রাণশক্তির ছন্দময় উচ্ছ্বাস তাঁর নির্বাক ছবির অভিনয়কে প্রায় নৃত্যের মতো বিমূর্ত করে তুলেছিল পরবর্তীকালের সবাক অভিনয়ের অন্তস্থলেও তার লাবণ্যকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না।
অসীম শারীরিক দক্ষতা, ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা, রসসৃষ্টির প্রতিভা না থাকলে খুব বড় অভিনেতা হওয়া যায় না। চার্লস চ্যাপলিনের এ সবই ছিল। জীবনের দ্রষ্টা হিসেবেও অভিনেতা চ্যাপলিনের সমকক্ষতা কম অভিনেতাই দাবি করতে পারেন। সর্বোপরি অভিনয়ের মধ্যে যে গভীর মানবিকতার সঞ্চার তিনি করতে পেরেছিলেন তা কালোত্তীর্ণ এক প্রেরণার মতো আজও আমাদের শিল্প চেতনাকে পথ দেখিয়ে চলেছে। এই জন্যেই চার্লস চ্যাপলিনকে চিরশ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত করতে আমার এক মুহূর্তও ভাবতে হয় না।