আমার বন্ধু রবি
রবির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একদিন সকালে সত্যজিৎ রায়ের বসার ঘরে। সেটা ১৯৬১ সাল, ‘অভিযান’ ছবির কাজ আরম্ভ হওয়ার আগে। প্রথম দর্শনেই ওকে আমার ভাল লেগে গিয়েছিল। চেহারাটা সত্যিই ওর চোখে পড়ার মতো ছিল। সেটা ওর মাথায় খাটো মাপের হওয়ার জন্যেই কিন্তু নয়। ওর ব্যায়ামে মজবুত চমৎকার শরীরে একটা লাবণ্য ছিল। মুখটা ছিল অত্যন্ত অভিব্যক্তিময়। আর চোখদুটো এত উজ্জ্বল যে তা লোককে আকর্ষণ করবেই। ওর গলার আওয়াজটাও আমার প্রথম দিন থেকেই খুবই ভাল লেগেছিল। সব মিলিয়ে একটা জ্যান্ত মানুষ।
মানিকদার বাড়ি থেকে দুজনেই একসঙ্গে বের হলাম গল্প করতে করতে। রাস্তায় নামতেই মনে হল আরও খানিকটা আড্ডা দিলে ভাল লাগবে। বললাম, ‘আপনার কি তাড়া আছে, নাহলে চলুন না কোথাও একটু বসা যাক।’ রবি বলল, ‘হ্যাঁ চলুন না। আপনি বিয়ার খান?’ বললাম, ‘হ্যাঁ খাই।’ ও বলল, ‘তাহলে চলুন চাংওয়াতে গিয়ে বিয়ার খেতে খেতে আড্ডা মারা যাবে।’ সেই প্রথম দিনের আড্ডা থেকেই বন্ধুত্ব শুরু হয়ে গেল। অভিনয়-পাগল দুই তরুণের সেই বন্ধুত্ব তিরিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ‘অভিযান’ ছবিতে দুজনে প্রথম একসঙ্গে কাজ করি। ছোটবড় প্রত্যেকটি চরিত্রের এমন সুঅভিনয় ‘অভিযান’ ছবিতে হয়েছিল তেমন খুব কম ছবিতেই হয়। তার মধ্যেও রবির অভিনয় আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। কৌতুকসৃষ্টির ক্ষমতা তো বটেই, সেই সঙ্গে রবির চরিত্র সৃষ্টির ক্ষমতাও ওর দ্বিতীয় ছবি ‘অভিযানে’ই অসামান্যভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। ছবির শেষ দিকে রামা যখন নরসিংহকে বলে— ‘গাড়িটা বেচে দেবেন সিংজি?’ সেই সংলাপটা যখন শুটিং-এর সময় রবি বলেছিল তখন থেকে আজ পর্যন্ত তা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর কৌতুক সৃষ্টির কথা মনে করলে ‘অভিযানে’র শুটিং-এর সময় মানিকদার একটা ছোট্ট মন্তব্য আমার মনে পড়ে। একটা দৃশ্যে দূরে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবিকে দেখা যায় কোলাপসিবল সাপের মতো একটা খেলনা নিয়ে স্থানীয় বাচ্চাদের খেলাচ্ছলে ভয় দেখাচ্ছে। আমরা যখন ক্যামেরার সামনে রিহার্সাল করছি, রবি তখন দূরে ওই কাণ্ডটা করে চলেছে। মানিকদা তাই দেখে বলে উঠলেন— ‘আরে বাবা, এ তো দেখছি একটা veritable scene stealer!’
সত্যিই রবির সেই ক্ষমতা আছে। তবে সুখের কথা, ও এত ডিসিপ্লিনড অভিনেতা যে অন্যের দৃশ্য চুরি করার কাজে নিজের অভিনয়-ক্ষমতার অপব্যয় করে না। চরিত্রের মধ্যে থেকে, চরিত্রটাকে স্পষ্ট করতে করতেই ওর কৌতুকসৃষ্টি চলতে থাকে। বড় কমেডিয়ানদের শেষ সাক্ষাৎ বোধহয় বাঙালি দর্শক রবি ঘোষের মধ্যেই পেয়েছে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘গুপী গায়েন’, ‘জনঅরণ্য’, ‘গল্প হলেও সত্যি’ এসব ছবির অবিস্মরণীয় অভিনয় তো আছেই, অসংখ্য সাধারণ মানের ছবিও রবির অভিনয়ের গুণে স্মরণযোগ্যতা পেয়েছে। ‘আগুন’ ছবিতে জোর করে কোট খুলে দেওয়ার পর কোটের নিচে ছেঁড়া শার্ট বেরিয়ে পড়ার দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না। কারণ, বড় কমেডিয়ানের যেটা আসল কাজ ওই দৃশ্যে রবি সেটা করেছিল। অর্থাৎ সত্যি মানুষের সত্যি দুঃখ-সুখের ছবি সে ফোটাতে পেরেছিল। বিজয় বসুর ‘বাঘিনী’ ছবিতেও রবি এমনই একটা সত্যিকারের বিশ্বাসযোগ্য মানুষের চরিত্র সৃষ্টি করেছিল।
রবি যে দুর্দান্ত কমেডি অভিনয় করবে এটা তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ‘ঘটক বিদায়’ নাটকে অভিনেতা রবি ঘোষকে পরিচালনা করতে গিয়ে ওর গুণপনার যে দিকগুলো নতুন করে আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা বোধহয় বলে রাখা ভাল। এই বয়সেও রবি যে কতখানি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান রেখেছে নিজেকে তা ‘ঘটক বিদায়ে’ ওর প্রবল পরিশ্রমসাধ্য কাজ দেখলে বোঝা যায়। যে সব অ্যাথলিটসুলভ কাজ এই অভিনয়ের মধ্যে ওকে করতে হয়, তা আজকের অনেক তরুণ অভিনেতার কাছেও দুষ্প্রাপ্য এবং শিক্ষণীয়। সেই সঙ্গে ওর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ নবীন অভিনেতাদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়া উচিত। হাসির নাটকে তো বাড়াবাড়ি করার প্রবণতা অনেকেরই আসে, এমনকি ক্ষমতাহীন অভিনেতা- অভিনেত্রীদেরও আসে। কিন্তু রবি যে মাপে প্রথম দিন শুরু করেছিল, একশো রাত্রি অভিনয়ের পরেও ঠিক সেই মাপটিই অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আর ওর চমৎকার কণ্ঠে সংলাপ উচ্চারণে অতুলনীয় ছন্দ ও লয়ের জ্ঞান, হাঁটাচলা, অঙ্গ সঞ্চালনের সেই পুরাতন লাবণ্য— সে-সব তো আছেই।
উইংসের পাশ থেকে আমি রবির অভিনয় প্রায় রোজই বেশ খানিকটা দেখি। সেটা পরিচালকের কর্তব্যকর্ম বলেই শুধু নয়। রবির অভিনয় আমার ভাল লাগে বলে। ডলি বসুর হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ায় ও যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর লুকনোর ইচ্ছেয় খুব ধীরে ধীরে বসতে আরম্ভ করে— (অত ধীরে ধীরে দাঁড়ানো থেকে মেঝেতে বসার জন্যে পায়ের পেশির কতখানি জোর দরকার ও ভারসাম্য রাখার জন্যে শরীরের ওপর কতখানি নিয়ন্ত্রণ রাখার দরকার তা অভিনয়ের ছাত্র হিসেবে আমি বুঝতে পারি) বসে পড়ার পর কোনদিকে লুকনো যেতে পারে তা এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে নিয়ে, তারপর আলমারির মধ্যে পূর্বতন আশ্রয়স্থল নিরাপদ মনে করে ধীরে ধীরে ও যখন হামাগুড়ি দিতে থাকে, তখন দর্শকদের উচ্ছ্বসিত হাসির সঙ্গে সঙ্গে নিরুচ্চার মুগ্ধতায় আমি রবির অভিনয় উপভোগ করতে থাকি এবং কামনা করতে থাকি এইভাবেই সে আরও বহু বহু বছর দর্শকসাধারণের জন্যে আনন্দের ফোয়ারা অনর্গল করে দিক।