বরেণ্য অভিনেত্রী

বরেণ্য অভিনেত্রী

স্মৃতিরও বয়স হয়। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় যখন আমি, আমাদের বন্ধুবান্ধবরা প্রথম দেখি তখন আমরা কলেজের ছাত্র। সেই সময়ের সিনেমা ও থিয়েটারে ওর যে সব অভিনয় দেখেছি, এতদিন পরে তার বিস্তারিত বর্ণনা বা খুঁটিনাটি দিক আলোচনা করে লেখা সম্ভব নয়। স্মৃতি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। সময়ের ব্যবধানও কম নয়, প্রায় পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর। তবে সেই তখন থেকেই সাবিত্রীর অভিনয় আমাদের দারুণভাবে মুগ্ধ করত। সিনেমা-থিয়েটারের নাম বা দৃশ্য আজ আর তেমনভাবে মনে না থাকলেও তার অসাধারণ অভিনয়ের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া আজও অম্লান, জীবন্ত। ওর অভিনয়-জীবনের প্রথম দিকের ছবিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা আমাদের সেই ছাত্রজীবনেই দেখা; ‘পাশের বাড়ি’, ‘বসু পরিবার’ ইত্যাদি। বিশেষ করে পরিচালক নির্মল দে-র ‘বসু পরিবার’ আমরা খুবই উপভোগ করেছিলাম। এই ছবিগুলোর কয়েক বছর পরে দেখা আরও কয়েকটা ছবিতে ওর অভিনয়ের স্মৃতি মনে পড়ছে— ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ আর ‘অনুপমা’। দুটো ছবিতেই সাবিত্রীর সঙ্গে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার।

সেই ‘অনুপমা’ ছবির একটি দৃশ্য সাবিত্রীর অভিনয়ের স্মৃতির মধ্যে অনন্য হয়ে আছে। যতদিন বেঁচে থাকব, যদি স্মৃতি একেবারে ঝাপসা না হয়, তাহলে সেই দৃশ্যটি আমার মনে থাকবে। ছবিটিতে দেখানো হয়েছিল— উত্তমদা আর সাবিত্রীর প্রেমজ বিবাহে পারিবারিক আপত্তি; সেই প্রতিবন্ধকতায় ওরা বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে, প্রবল আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ে অত্যন্ত দরিদ্র মানুষরা যে ধরনের পরিবেশে বাস করেন, সেইরকম অঞ্চলে ঘর ভাড়া নিতে বাধ্য হয়েছে। উত্তমদা একটা সাইকেলে সারাদিন কাজকর্মের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। সাবিত্রীকে যথারীতি একা হাতে গোটা সংসারের সব কাজ সারতে হয়। দৃশ্যটিতে দেখানো হচ্ছে, সারাদিনের কাজের শেষে সাবিত্রী বাইরের দরজায় উত্তমদার জন্য অপেক্ষা করছে। স্বামীর ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে প্রতীক্ষা। উত্তমদা ফিরে এসে সাইকেল থেকে নেমে বলছে,

—তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ যে?

—তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছিল তাই।

উত্তর শুনে উত্তমদা সহাস্যে খুব রোমান্টিক বাচনভঙ্গিতে বলে,

—যদি না ফিরতাম?

সাবিত্রী জবাব দিয়েছিল,

—তাহলে দাঁড়িয়েই থাকতাম।

সহজ, সাধারণ একটা কথা। কিন্তু এর মধ্যে যুগ-যুগান্তের সব নববিবাহিত দম্পতি বা নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসার সংলাপ উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছে। আদ্যন্ত সহজ কয়েকটা শব্দে যে সত্য প্রকাশিত হয়েছিল, তা আমি আজও ভুলতে পারিনি। সাবিত্রী যেভাবে কথাগুলো বলেছিল, মানে তার সহজ ভালবাসাকে অত সত্য করে বলার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, এতটাই সুন্দর ছিল সেই অভিনয়।

পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময় থেকেই সাবিত্রী বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। সেই সময়ে তার একাধিক ছবি দেখেছি। পরে নিজেও যখন বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে এলাম, তখন খুব স্বাভাবিক কারণে ওর খুব বেশি ছবি দেখার সময়, সুযোগ ঘটেনি। যতদূর মনে পড়ছে, ষাট দশকের প্রথম তিন-চার বছরের মধ্যে ওর সঙ্গে আমি প্রথম অভিনয় করেছিলাম। তখন আরও কাছ থেকে দেখেছি সাবিত্রী কত বড়মাপের অভিনেত্রী। একই সঙ্গে সিনেমা ও থিয়েটারে তার অভিনয় অসাধারণ স্তরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, ওর অভিনয়ের বহুমুখীনতাও তখন আরও ভালভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। থিয়েটার প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ওর ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয়ের স্মৃতি। থিয়েটারে অবশ্য সাবিত্রীর অভিনয় তার আগেও দেখেছি, ‘নতুন ইহুদী’র কথা মনে পড়ছে। উত্তমদা ও সাবিত্রীকে নিয়ে ‘শ্যামলী’ নাটক স্টারে চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে। নিরুপমা দেবীর উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ‘শ্যামলী’ নাটক জনপ্রিয় হওয়ার হয়ত আরও কিছু কারণ ছিল। কিন্তু ‘শ্যামলী’ যে প্রায় মিথ হয়ে উঠেছিল, সেটা সাবিত্রীর অভিনয়ের জন্যই ঘটেছিল বলে আমি মনে করি। থিয়েটারে ওই ধরনের চরিত্রে একেবারে অসাধারণ কাজের দৃষ্টান্ত। বাকশক্তিহীনা একটি মেয়ের চরিত্র, সুতরাং সংলাপের সাহায্য নেই। শুধুমাত্র চলাফেরা, নাচ আর হাত নেড়ে, মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে তাকে চরিত্রটিকে প্রাণবন্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। কাজটি কোনও অর্থেই সহজ নয়। অবশ্য একটা বিশেষ সুবিধে সাবিত্রীর ছিল, ওর চোখ দুটো খুব বড়, খুব সুন্দর। সেই চোখ দিয়ে শ্যামলীর যাবতীয় আনন্দ-দুঃখ প্রকাশ করেছিল। একথা অবশ্যই ওর বিস্ময়কর কৃতিত্ব ছোট করার জন্য লিখছি না, কারণ আয়ত চোখ থাকলেই তো সকলে চোখকে অভিব্যক্তির কাজে লাগাতে পারে না! সাবিত্রী দিনের পর দিন সেই কাজটা অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে করে ইতিহাস তৈরি করেছিল।

মৃণাল সেনের ‘প্রতিনিধি’ ছবিতে প্রথম সাবিত্রীর সঙ্গে অভিনয়। সেই অভিনয় করার স্মৃতি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। কারণ সাবিত্রী এমন মানের দক্ষ শিল্পী যে, যে-কোনও চরিত্রের অভিনয়ে গভীরতা, যাথার্থ্য আনতে পারে, জীবন যেরকম হয় তারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পারে। ওর অভিনয় প্রায় ম্যানারিজম বর্জিত, কাজের মধ্যে সততা এবং পরিশ্রমেরও প্রমাণ থাকে। সব মিলিয়ে আমি বলব সাবিত্রী অভিনয়-শিল্পের একজন বরেণ্য অভিনেত্রী। এখনও পর্যন্ত অভিনেত্রী হিসেবে সাবিত্রী কোথায়, কী পুরস্কার পেয়েছে, তা আমি জানি না। জানার বিশেষ প্রয়োজনও বোধ করছি না। কারণ এই সব পুরস্কার ইত্যাদি কখনও একজন যথার্থ শিল্পীকে ধন্য করে না, সেই অর্থে চিনিয়েও দেয় না।

‘প্রতিনিধি’-র পর আরও কয়েকটি ছবিতে সাবিত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেছি। দীর্ঘদিন পরে সেই সব ছবিতে কাজ করার বিস্তারিত স্মৃতি আর তেমন উজ্জ্বল নেই। কিন্তু সাবিত্রীর অভিনয়ের একটা ইম্প্রেশন থেকেই গেছে। ‘নতুন দিনের আলো’ নামে একটা ছবি করেছিলাম; তার গল্প, লোকেশন ইত্যাদির সামান্যই মনে আছে। কিন্তু সেই ছবিতে সাবিত্রীর চরিত্রে একটা স্থায়ী বিষাদ ছিল, নিজের অসামান্য শিল্পবোধ থেকে সাবিত্রী চরিত্রায়নে সেই বিষাদ চরিত্রটিতে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল তা কিন্তু আজও মনে আছে।

নানা সিনেমা-থিয়েটারে অভিনয় করতে করতে সময় কেটেছে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি বা তার কাছাকাছি সময়ে ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ থেকে ‘রাজকুমার’ নাটক মঞ্চস্থ করা হল। নাটকটা লেখা ও প্রধান পুরুষ-চরিত্রে অভিনয় করা ছাড়া পরিচালনার দায়িত্বও আমার ওপরে ছিল। তখন আমি আমার আকৈশোরের গুণমুগ্ধতা থেকে, ওর অভিনয় ক্ষমতার প্রতি অনুরাগ থেকে সাবিত্রীকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। সাবিত্রীও আমার অনুরোধে সাগ্রহে রাজি হল। ততদিনে সাবিত্রী যে একজন সত্যিকারের বড় অভিনেত্রী, তা শুধু আমি কেন সর্বত্র, সকলেই জেনে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে আমি ওর একটা অন্য পরিচয় প্রথম জানতে পেরেছিলাম।

প্রথম কয়েকদিন ও রিহার্সালে আসতে পারেনি। দায়িত্বশীল পরিচালক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। আমি চিরকাল অত্যন্ত সিরিয়াস মানসিকতা নিয়ে থিয়েটার করি, ওই দু-তিন দিন মহলায় না আসায় আমার দুশ্চিন্তা আমি গোপন করিনি। মনে মনে ভেবেছিলাম— সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এতদিনকার প্রতিষ্ঠিত বড় অভিনেত্রী, সে হয়ত অভিনেতৃ সঙ্ঘের প্রযোজনাটিকে তেমন সিরিয়াসলি নেয়নি। আমার শঙ্কার কথা আমি নীলিমাদিকে (নীলিমা দাস) বলেছিলাম। নীলিমাদি ওকে আমার উদ্বেগের কথা বলায় সাবিত্রী বলেছিল— ‘তুমি সৌমিত্রদাকে চিন্তা করতে বারণ ক’র, আমার ফার্স্ট অ্যাক্ট মুখস্থ হয়ে গেছে।’ আমি তখন কথাটা ঠিক বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম— কী করে হবে, মাত্র কয়েকদিন রিহার্সাল হয়েছে, তার মধ্যে আবার ও দু-তিন দিন আসতে পারেনি। কিন্তু তারপরে সাবিত্রী যেদিন রিহার্সালে এল, সেদিন সবিস্ময়ে দেখলাম সত্যিই ওর ফার্স্ট অ্যাক্ট মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ অভিনয়ের আগে নিজেকে প্রস্তুত করার কাজে ও এতটাই সিরিয়াস যে বাড়িতে হোমওয়ার্ক করে। যখন পুরোদমে ‘রাজকুমার’-এর মহলা শুরু হল আমি দেখলাম, ও অভিনয়ের কাজে অত্যন্ত সিরিয়াস, শতকরা একশো ভাগ মনোনিবেশ করার সহজাত ক্ষমতাও ওর আছে। পরিচালক হিসেবে, একজন সহ-অভিনেতা হিসেবে তখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম, কেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এত বড় অভিনেত্রী। যখন সে অভিনয় করছে, তখন তার মধ্যে একজন বিখ্যাত, বড় প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীর অহমিকা, মিথ্যা দম্ভ— এসব কিচ্ছু নেই। মনে হচ্ছিল যেন মাত্র আগের দিনই সে অভিনয় করার কাজে এসেছে। তার পরিশ্রম করার ইচ্ছে আর সিরিয়াস মানসিকতাই তাকে গড়ে তুলেছে। পরিচালক হিসেবে বলি, ওর মতো অভিনেত্রীকে অভিনয় প্রসঙ্গে নির্দেশ দিতে তো বেশি কিছু করতে বা বলতে হয় না, ও নিজেই সহজে, অক্লেশে সব পারে। আমার দিক থেকে শুধু পরিকল্পনাটা কী, সেটা বলতে হয়েছিল। অর্থাৎ আমি নাটকের প্রয়োজনে ওর অভিনয় করা চরিত্রটির কাছে কী চেয়েছিলাম। যদি কখনও কোথাও সামান্য দু-একটা জায়গা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, ও আমায় বলত— ‘তুমি দেখিয়ে দাও ঠিক কী তুমি চাইছ’, আমি সেটা করলে, ও তৎক্ষণাৎ সেটা নির্ভুলভাবে করে দেখিয়ে দিত। সহ-অভিনেত্রী হিসেবে ওর সহযোগিতা একেবারে তুলনাহীন।

অভিনেতৃ সঙ্ঘের অভিনয় হওয়ার পরে ‘রাজকুমার’ আমি পেশাদার মঞ্চে (কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ) নিয়মিত অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন সাবিত্রীকে ছাড়া নাটকটি করার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এবং বলাই বাহুল্য, সাবিত্রী সেখানেও অসাধারণ অভিনয় করেছিল। এই নাটকের বহু দৃশ্যে তার স্মরণীয় অভিনয়ের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে সাবিত্রীর অভিনয় আমার কাছে চিরস্মরণীয়। সেই শেষ দৃশ্যে নায়ক আত্মহত্যা করে, নায়িকা জয়া সেটা প্রত্যক্ষ করেছে (সাবিত্রীর অভিনয় করা চরিত্রটির নাম ছিল ‘জয়া’)। তারপর সে স্বপ্নচালিতের মতো দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে, তখন তার মুখে কোনও সংলাপ নেই। অন্যরা কথা বলছে, কিন্তু জয়া নির্বাক। সেই অবস্থায় সে ঘরকন্নার কাজ করে যেতে থাকে; কয়েকটা গ্লাস পড়ে আছে, সেগুলো তুলে রাখে। অনেকক্ষণ পরে নায়কের ছেড়ে যাওয়া স্পোর্টস জ্যাকেটটা দেখতে পেয়ে সেটা তুলে সরাতে গিয়ে হঠাৎ যেন তার সংবিৎ ফিরে আসে, সে বুঝতে পারে, নায়ক আর নেই। সে তখন কেঁদে চিৎকার করে ওঠে— ‘বাঁচাও, বাঁচাও’। অর্থাৎ এই যে নিষ্ঠুরতা, যার শিকার হচ্ছে সে, সেই নিষ্ঠুর পরিবেশ থেকে বাঁচানোর আহ্বান জানিয়ে সে চিৎকার করে উঠেছে। সেই মর্মান্তিক দৃশ্যে সাবিত্রীর অভিনয় যে কী অসাধারণ পর্যায়ে উঠে যেত, সে যাঁরা দেখেননি, তাঁরা বোধহয় নির্ভুল অনুমান করতে পারবেন না।

‘শেষরক্ষা’ নাটকে সাবিত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেছি, সেখানে তার কমেডি অ্যাক্টিং যথারীতি খুবই উঁচুমানের। আমাদের সময়ে কোনও মহিলা অভিনেত্রীকে ওর মতো কমেডি অ্যাক্টিং করতে দেখিনি। সবদিক থেকে বিচার করলে ওকে আমি একজন সম্পূর্ণ অভিনেত্রী হিসেবে উল্লেখ করে আমার শ্রদ্ধা জানাতে চাই। বহুমুখীনতার কথা তো আগেই বলেছি। ওর অভিনয়কলার বহুমুখীনতা ওকে কমেডি, ট্র্যাজেডি— দুটো ধারাতেই সমান দক্ষতা এনে দিয়েছে। আগের দিনের বা একেবারে হাল আমলের অভিনেত্রীদের দেখি চোখের জলের দৃশ্যে তাঁরা গ্লিসারিন ব্যবহার করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার এতে কোনও আপত্তি নেই, নিজেদের প্রয়োজনে তাঁরা গ্লিসারিন ব্যবহার করতেই পারেন। কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্যে অভিনয়ের জন্যে সাবিত্রী কখনও গ্লিসারিন ব্যবহার করেনি, বোধহয় দরকার হয়নি।

অভিনয়ের আরও একটা দিকে আমার মনে হয় সাবিত্রী তার সমকালের অনেক অভিনেত্রীর তুলনায় স্কোর করেছে। সকলেই জানেন সে পূর্ববাংলার মেয়ে। অনেক পূর্ববাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দেখেছি, তাঁদের বাচনভঙ্গিতে পূর্ববাংলার উচ্চারণের রেশটুকু অনেকসময় থেকে গেছে। কিন্তু সাবিত্রী ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁদের দুজনের কথা বলায় আমি সেই উচ্চারণের রেশটুকু থাকতে দেখিনি। সেই দিক থেকে বলব, সাবিত্রী ও ভানুদার এলোকিউশন উঁচুমানের, কথা বলায় ভানুদার নিজের জিভের ওপর দখল ছিল অসামান্য, সাবিত্রীরও আছে। ভানুদাই সাবিত্রীকে অভিনয়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং ওকে খুবই স্নেহ করতেন। শুনেছি সাবিত্রীর মুখে পূর্ববঙ্গের বিশেষ অঞ্চলের ভাষার প্রাণবন্ত উচ্চারণ শুনেই নাকি ভানুদা ওকে তাঁদের দলের নাটকে প্রথম অভিনয় করিয়েছিলেন।

পরোক্ষভাবে ভানুদাই আর একটা কৌতুকময় ছবির কথা মনে করিয়ে দিলেন। ঢুলুদার (পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়) ছবি মন্ত্রমুগ্ধ-তে উৎপলদা, সাবিত্রী আর আমি একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। সেটাও অনেকদিন আগের ছবি, বোধহয় সত্তর দশকের শেষদিকে ছবিটা হয়েছিল। মজার ছবি, আমরা সকলেই কাজটা উপভোগ করতাম। বিশেষ করে সাবিত্রীর অসামান্য প্রাণবন্ত কমেডি অ্যাক্টিংয়ের সঙ্গে কাজ করাটা একটা আনন্দের উৎস ছিল।

একদিন উৎপল দত্তর সঙ্গে সাবিত্রীর কাজ হচ্ছে, কাজ শেষ হওয়ার পর উৎপল দত্ত এত খুশি হয়েছিলেন যে শুটিংয়ের শেষে বলেছিলেন— ‘শুটিং করে এত আনন্দ জীবনে খুব কম পেয়েছি।’ উৎপল দত্তর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেডি ছবিতে অভিনয় করা, খুব সহজ কথা নয়। সাবিত্রী এত স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছিল যে, আমার মনে হয়, সাবিত্রী নয় বরং উৎপল দত্তকেই বোধহয় সাবিত্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেডি অ্যাক্টিং করতে হয়েছিল। কমেডি ছবির কথা লেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্র্যাজেডির স্মৃতিও মনে পড়ল। পরিচালক স্বদেশ সরকারের ছবি ‘শাস্তি’। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে তৈরি। ছবিটাতে প্রথম দিকটায়, সত্যি কথা বললে, চরিত্রটাতে সাবিত্রীকে ঠিক যেন যথাযোগ্য মনে হচ্ছিল না। একটা অল্পবয়সী গ্রামের মেয়ে, তার নানারকম ছেলেমানুষী রয়েছে। অন্য কিছু নয়, চরিত্রটাতে ওকে ঠিক ভাল মানাচ্ছিল না। তারপর যখন বড়বউ খুন হয়ে যায়, তখন একটা ডায়ালগ ওর মুখের ওপর ওভারল্যাপ করে— ‘বউ গেলে আবার বউ পাওয়া যাবে, ভাই গেলে তো আর ভাই পাওয়া যাবে না।’ এই একটা সংলাপ সাবিত্রীকে এতটাই গভীরভাবে আঘাত করে যে, সে সমস্ত দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে জেল খাটতে চলে যায়। ছবির এই শেষ অংশটায়, একজন নারীর তীব্র অভিমান যে তাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম করে দিতে পারে, একটা কথা তার সত্তাকে এত গভীরভাবে আঘাত করেছে যে, সংসারের সব কিছু ছেড়ে সে চলে গেল— সেটা সাবিত্রী শুধু অভিব্যক্তির দিক থেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। অভিনয়ের দিক থেকে সে যে কী অসামান্য অভিব্যক্তি, তা ভোলা যায় না।

‘গৃহদাহ’ ছবিতে মৃণাল চরিত্রে সাবিত্রীর অভিনয় যাঁরা মনে রেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝেছেন উঁচুমানের শিল্পী না হলে একটা চরিত্রকে অতটা প্রাণবন্ত করা যায় না। মৃণালের সঙ্গে মহিমের কথাবার্তা, আচার-আচরণ সম্পর্কে অচলা যা ভেবেছিল, সেই নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মৃণাল চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের প্রযোজন ছিল। একটা সহজ নির্মল নারী চরিত্র, সাবিত্রী অভিনয় করেছিল বলেই সেটা অতটা উচ্চস্তরের হয়েছিল। থিয়েটারেও নানা ধরনের চরিত্রে তার দক্ষতা দেখার সুযোগ ঘটেছে। অভিনেতৃ সঙ্ঘের প্রযোজনা হিসেবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। হাজারি ঠাকুর— সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় আর সাবিত্রী ‘পদ্ম ঝি’। যথারীতি সুন্দর কাজ করেছিল।

বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইতিহাস হারিয়ে যাবে কেন?— এই প্রশ্ন নিয়ে কয়েক বছর আগে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম। অভিনয়ের ধারা ও স্মরণীয় শিল্পীদের নিজস্ব স্টাইলের সংরক্ষণ নিয়েও কিছু কথা ছিল সেই লেখাটিতে। বরেণ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়, অভিনয়ের স্মৃতি প্রসঙ্গে নিজস্ব যোগ্যতাতেই সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের উল্লেখ সেখানে ছিল। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিরাট অভিনেত্রীকে নিয়ে যে অবিলম্বে তথ্যচিত্র হওয়া উচিত এবং সেই কাজে স্বয়ং সাবিত্রীই বিরাটভাবে সাহায্য করতে পারেন। কারণ তিনি এখনও সৃষ্টিশীল— এসব প্রস্তাবও সেই লেখায় ছিল।

আজও কিন্তু কয়েক বছর আগের সেই লেখা থেকে একচুল সরে আসার কোনও কারণ ঘটেনি। আমি আজও বিশ্বাস করি, এমন অনেক সিনেমা ও থিয়েটার হয়েছে যেখানে সাবিত্রীর অসামান্য অভিনয়ে বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ এমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে শেষ পর্যন্ত তার অভিনয়ের জোরেই নাটক বা ছবিটা উতরে গেছে, দর্শকরা সাবিত্রীর অভিনয়ের আকর্ষণেই তা দেখতে বাধ্য হয়েছেন।

সাবিত্রীর অভিনয় নিয়ে আরও দীর্ঘ, বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ লেখা উচিত এবং সেটা করতে গেলে তার কাজগুলো আবার নতুন করে সময় নিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল। বাস্তবিক অসুবিধের জন্য সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে তেমন কিছু করতে পারলে আমি অবশ্যই খুশি হতাম, তৃপ্ত হতাম। কিছু কথা বলা হল, এর পরেও যদি কারও মনে হয়, ঠিক কী সাবিত্রীকে অন্য অভিনেত্রীদের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে, তা হলে বলব সেটা ওর পারসেপশন। ও যেভাবে একটা চরিত্র উপলব্ধি করতে পারে, তার গভীরে প্রবেশ করতে পারে, সেটা সব অভিনেত্রী পারেন না। আরও একটা অত্যন্ত মূল্যবান বিশেষ গুণের উল্লেখ প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে— ফ্রেশনেস অফ অ্যাপ্রাোচ। এত বছর অভিনয় করেছে, এখনও যদি ওকে কোনও একটা চরিত্রে অভিনয় করতে অনুরোধ করা হয়, আমি জানি সেটা সাবিত্রী কোনও ধরে নেওয়া ধারণা থেকে করবে না। সে নিজে কত বড় বা কী জাতের অভিনেত্রী, সেটা সেই চরিত্রের ওপর চাপিয়ে দেবে না কিছুতেই। এক্ষেত্রে অভিনয়ের জন্য পাওয়া চরিত্রটির নিজস্ব পরিচয়ই প্রধান, অন্য কিছু নয়।

অবশ্য এই বিশেষ গুণগুলো না থাকলে কি আর একজন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় হতে পারে! হওয়া সম্ভব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *