শিশিরকুমারের স্মৃতি-১

শিশিরকুমারের স্মৃতি-১

১৯৫৮ সালের শুরুতে একবার অসুস্থ হয়ে রোগশয্যায় জার্নাল লেখা অভ্যাস হয়েছিল। এরমধ্যে শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রসঙ্গ প্রায়ই থাকত। এই প্রসঙ্গগুলি ব্যক্তিগত এবং এই লেখা বিশ বছর আগের মনের লেখা। তবু এই শিশিরকুমারের মতো মহৎ প্রতিভার কিছু মাত্র পরিচয় থাকলেও থাকতে পারে এই মনে করে অতীতে দুবার,— শারদীয় আনন্দবাজারে (১৩৭৮) ও শারদীয় অমৃত (১৩৭৯)— এই জার্নাল থেকে কিছু কিছু স্মৃতিচারণ প্রকাশ করেছিলাম। বর্তমানেও করছি।

এই দুটো বছর ধরে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই শিশিরকুমারের বাড়িতে যাই। আগে আগে নিচে নেমে আসতেন। এখন ওপরেই ডেকে পাঠান। আস্তে আস্তে কোথা দিয়ে যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে জানতেই পারিনি। অথচ শিশিরকুমারের কাছে আসার সৌভাগ্য হবে কোনওদিন ভাবিনি। প্রথম যেদিন ওঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ হয়েছিল সেদিনটা মনে আছে। ১৯৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারি। শ্রীরঙ্গমে সেদিনই শেষ অভিনয়। সেদিনের নাটক ছিল প্রফুল্ল। আমরা প্রায় বিশ-পঁচিশজন বন্ধু মিলে দেখতে গিয়েছি। সকলেরই মন ভার। সকলেই চুপচাপ। অভিনয় হল। ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ বলে শিশিরবাবু হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে দাঁড়ালেন। শ্রীরঙ্গমে শেষবারের মতো যবনিকা নামল।

সেদিন প্রফুল্ল-র অভিনয় করেছিলেন শেফালিকা (পুতুল) দেবী। ওঁর ছেলে বাবু (অর্ধেন্দু) আমাদের বন্ধু। বলেছিল সেদিন শিশিরবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। এর আগে তো কতবার শ্রীরঙ্গমের বাইরে থেকে ফেরত এসেছি, দেখা হয়নি। অভিনয় শিখতে চাই বলাতে উত্তর পেয়েছি— ‘এখন নতুন লোক নেওয়া হবে না— পড়াশুনা করুন এখন— পরে আসবেন।’ সেদিন আমাকে দাঁড়াতে বলে পুতুল মাসিমা ভেতরে চলে গেলেন। কোর্টের বেলিফ পেয়াদা সব দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিশির ভাদুড়িকে স্টেজ থেকে সরিয়ে পজিশন নেবে তারা। ছবি বিশ্বাসকে দেখলাম মেকআপ তুলতে এলেন। মনে হল মদ্যপান করেছেন। পরে শিশিরবাবুর কাছে শুনেছি যে ওই একটি দিন ছাড়া ছবিবাবু কোনওদিন মদ খেয়ে শিশিরবাবুর সামনে যাননি। আমার অবশ্য তখন দেখার মতো মনের অবস্থা নয়। বুক টিপটিপ করছে। কত কি শুনেছি। রাগী, দাম্ভিক শিশিরকুমার। দেখা করবেন তো? দেখা হলেই বা কীরকম ব্যবহার করবেন? এই সব ভাবছি, এমন সময় ডাক এল। একটা ঘরে ঢুকতেই দেখি সামনে শিশিরকুমার। ঘরটায় ভিড়। সেদিনকার অভিনয়ে যাঁরা ছিলেন তাঁরা রয়েছেন। দু-একজন কাঁদছেন। থমথমে ভাব।

পুতুল মাসিমা বললেন— ‘বাবুর বন্ধু, আপনাকে প্রণাম করতে এসেছে।’ প্রণাম করতেই সাগ্রহে বললেন— ‘থাক থাক। কি নাম তোমার?’

নাম বললাম।

—বাঃ, বেশ নাম। কী করো?

—আমি ছাত্র।

—কোন কেলাশ?

—আমি ফিফথ ইয়ারে পড়ি।

—কী পড়? কী বিষয়?

—বাংলা।

—বাংলা? বাঃ। বেশ বেশ।

আত্মীয়স্বজন গুরুজনস্থানীয় বেশিরভাগ লোকের কাছে শুনে এসেছি বাংলা পড়ে কী হবে? এই প্রথম একজন বয়স্ক লোক বাংলা পড়ি শুনে খুশি হলেন।

পরের প্রশ্ন—

—তোমার বাড়ি কোথায়?

—আমার বাড়ি কৃষ্ণনগরে।

—আরে তোমার বাড়ি কেষ্টনগরে? সেখানে তো আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। এই-তো সেদিনও গিয়েছিলাম।

এসব খবর সবই জানতাম। কিন্তু এ প্রসঙ্গে কিছু না বলে দুম করে বলে ফেললাম—

—থিয়েটার কি আর হবে না? থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল?

—না। কে বলল থিয়েটার হবে না? থিয়েটার বন্ধ হবে না। এ বাড়ি শুধু আমাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে।

—তাহলে আমাদের কী হবে?

কথাটা শুনে খুব ভাল করে সেই হাই-পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে খানিক চেয়ে রইলেন, আমার দিকে। কীরকম যেন চুপ হয়ে গেলেন। চিন্তিত।

বললাম—

—আমি আপনার কাছে আবার আসতে চাই।

—কেন আসবে না? নিশ্চয়ই আসবে। তবে কোথায় আসতে বলব তোমায়? এ বাড়ি তো ছেড়ে দিলাম। যাক, টেলিফোন থাকবে। সেখানে আমার খোঁজ করে জেনে নিও কোথায় আছি।

আসার সময় প্রণাম করতে মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন বুঝতে পারলাম না।

এর কিছুদিন পরেই সিঁথির বাড়িতে গেলেন। মনে আছে সেদিন একদিকে বাংলা বিহার একীকরণের প্রস্তাবে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন এটা সংস্কৃতির ওপর আঘাত— বাংলা ভাষার ওপর আঘাত। আবার বলেছিলেন অনেক ভাষা শেখো— মনকে ছড়িয়ে দাও। মনে হয়েছিল লোকটা একই সঙ্গে কী ভীষণ বাঙালি, আবার বোধহয় পৃথিবীর নাগরিক হলেও এর চলে।

সেই যে যেতে আরম্ভ করেছিলাম, এখন আর না গিয়ে থাকতে পারি না। যখনই মন দমে আসতে চায়, মলিন হয়ে যায়, তখনই ছুটে যাই ওই বৃদ্ধের কাছে। তখন হয়ত অক্সফোর্ডের কম্প্যানিয়ন হাতে করে বসে আছেন। কবে কোন ইংরেজ ভারতে অভিনয় করেছিল তার ঠিকুজি খুঁজছেন। এনামেলের চটা-ওঠা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেন। ইসকাইলাস থেকে শ’— চর্যা থেকে রবীন্দ্রনাথ, কত বিষয় নিয়ে যে আলোচনা করেন, থিয়েটারের গল্প, অভিনয়ের বিচার। আধুনিক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করলে বলেন— ‘দ্যাখো ওসব আমার পড়া নেই। তিরিশের ওপারে আমাদের যুগ শেষ হয়ে গেছে— পড়াশুনার সীমাও সেই অবধি।’ অথচ সমর সেন, জীবনানন্দের কিছু পরিচয় রাখেন দেখেছি। ব্রেশট পড়িয়েছিলেন আমায় উনিই। তখন তো কলকাতায় ব্রেশটের নামও কোথাও শুনিনি।

সত্তরের সঙ্গে চব্বিশের যেন একটা বন্ধুত্বই হয়ে গেছে। কত ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করি। এবং কী অনায়াসে, অসঙ্কোচে তার জবাব দেন। জিজ্ঞেস করেছি— ‘আপনি কি খুব মদ খেতেন?’

—তা খেতাম। তবে সেটা ছিল seasonal। ধরো দশদিন পনেরো দিন মদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। একদিন আরম্ভ করলাম, তখন আবার পাঁচদিন শুধু মদই খেলাম। আর কিছুই ছুঁলাম না। এই রকম আর কি।’

ওঁর মদ খাওয়ার ব্যাপারে যে সব কিংবদন্তি চালু আছে সেগুলোর অনেকগুলোই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। এত উচ্ছৃঙ্খল হয়েও কি শিশিরবাবু তিরিশ বছর ধরে পাবলিক থিয়েটার করেছেন এই দাপটে? পঞ্চাশ- ষাটটা নাটকের ওই রকম উচ্চস্তরের প্রাোডাকশন করেছেন? এটা কী করে সম্ভব হল? মদ খাওয়ার ব্যাপারে একদিন বলেছিলেন— যারা বলে মদ খেয়ে শিশির ভাদুড়ির থিয়েটার উঠে গেছে তারা কিছুই জানে না। একটা লোক কত মদ খেতে পারে জীবনে? তাতে থিয়েটার ওঠে না। কত টাকার মদ খেয়েছি? পঞ্চাশ হাজার টাকা? সত্তর? আশি? রোজগার তো তার ঢের বেশি করেছি। আসলে টাকা রাখার যে ব্যবসাবুদ্ধি সেটাই বোধহয় আমার কম ছিল। তাছাড়া টাকার অপচয় যেভাবে হয়েছে আমার থিয়েটারে, যেভাবে টাকা নষ্ট হয়েছে আমি তা ঠেকাতে পারিনি। চুরি ধরতে পারিনি— পারলেও বন্ধ করতে পারিনি।

আমি রেগে বলে ফেলেছিলাম— ‘কেন পারেননি? থিয়েটারের স্বার্থে পারা উচিত ছিল। এতদিন প্রফুল্ল করেছেন, সংসার চেনেননি?’ উনি কিন্তু রাগ করেননি আমার কথায়। খানিকটা চুপ করে থেকেছেন বিষণ্ণ হয়ে। তারপর বলেছেন— ‘দ্যাখো সৌমিত্র, তোমার অল্প বয়েস। সংসারে ঢোকোনি। সংসারে ঢুকলে, বয়েস হলে বুঝতে পারবে দায়দায়িত্ব অত সহজে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় না।

ছাত্রাবস্থাতেই বাবা মারা যান শিশিরবাবুর। তখন থেকেই বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের বিরাট আর্থিক দায়দায়িত্ব নিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। সুনীতিবাবুর কাছে শুনেছিলাম শিশির ছিলেন তাঁর সময়ের সব থেকে উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় ছাত্র। জনপ্রিয়তার গুণেই ধনী বন্ধুবান্ধবদের ব্যবসায়ে দালালি করে তিনি সেই বয়সেই অনেক টাকা রোজগার করতেন। শিশিরবাবুর রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হতে তাঁর পরিবারের বৃহৎ অংশও বোধকরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। থিয়েটার করার পর শিশিরবাবু না ডাকতেই পরিবারের অনেকে এসে থিয়েটারে ঢুকেছিলেন। বড় গাছের গায়ে মানিপ্লান্টের মতো জড়িয়ে ছিলেন। শিশিরবাবুরও হয়ত বিশ্বস্ত একটা অর্গানাইজেশন দরকার ছিল কিন্তু সর্ষেতেই যদি ভূত থাকে তাহলে কে ছাড়াবে?

সেদিন চলে আসার আগে শিশিরবাবু বললেন— ‘সৌমিত্র, এক এক সময় দুঃখ হয় জীবনে কিছু হল না। যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম সেটা কেউ বোঝেনি।’ নিবে আসা চুরুটটাতে দেশলাই জ্বালাতে জ্বালাতে বলেন— ‘এসো আবার। তোমার খানিকটা সময় নষ্ট হয় বোধহয়— কিন্তু কথা বলার লোক পাই আমি। সপ্তাহে একবার অন্তত এসো। I feel very lonely.’

সেদিনকার মতো চলে আসি। পরের সপ্তাহেই আবার যাই। একখানা বই নিয়ে যাই ওঁর জন্য। উনি একখানা আমায় পড়তে দেন। প্রথম কথাবার্তা সেই সূত্রেই আরম্ভ হয়। তারপর সেই স্রোত নানা দিকে বইতে থাকে। নানা কথার প্রবাহে একদিন নবান্নের কথা ওঠে। ‘নবান্ন’র মধ্যে নতুন থিয়েটারের যে সম্ভাবনা ছিল সেইটে দেখে উনি ভয় পেয়ে ওঁর শ্রীরঙ্গমে আর নবান্ন করতে দেননি, এমত একটা গুজব বাজারে কে বা কাহারা চালু রেখেছে। পাবলিক থিয়েটারে তিরিশ বছর কত কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনাসামনি হয়েছেন শিশির ভাদুড়ি। তাঁর মতো প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী লোক নবান্নকে তাঁর থিয়েটারের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে আদপে মনে করবেন এটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। আর যে লোকটা থিয়েটারে শেষ পর্যন্ত নতুন নাটক, কালোপযোগী নাটক হন্যে হয়ে খুঁজছেন। পরিচয়, প্রশ্ন, দুঃখীর ইমান প্রযোজনা করেছেন। তিনি নতুন কিছু দেখে ঘাবড়ে যাবেন এটা কীরকম একটা ছেলেমানুষি কথা বলে মনে হয় আমার। আমি এই গুজবের সত্যাসত্য নিয়ে ওঁকে প্রশ্ন করি। ওঁর বক্তব্যটা জানতে চাই। উনি বলেন— ‘হ্যাঁ, আমার থিয়েটারেই তো ওরা নবান্নর অভিনয় করেছিল। সেটা চুয়াল্লিশ সাল। আমি একদিন বসে দেখলাম। দেখলাম ওরা কমিউনিস্ট। বেয়াল্লিশে ওরা ইংরেজের ফিফথ কলাম হয়েছিল। এদিকে কংগ্রেস স্বাধীনতা আনছে এরকম একটা ধারণা তখনও আমার ছিল। আমার থিয়েটারে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্টদের কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে আমি দেব না বলেও ওদের অভিনয় করতে দিইনি। কিন্তু দ্যাখো ওই কমুরাই (কমিউনিস্ট) তো ঠিক বুঝেছিল— আমরাই বুঝতে পারিনি কংগ্রেসের স্বরূপটা। এ স্বাধীনতা যে ভুয়ো— আমরা যে এখনও আইনত ব্রিটিশ কমনওয়েলথের প্রজা— কলকাঠি যে এখনও ইংরেজদের হাতে— এ তো ওরাই বুঝেছিল।’

এক একদিন গল্প করতে করতে অভিনেতাদের গল্প ওঠে। আমি কেবল প্রশ্ন করি যাঁদের দেখিনি তাঁদের নিয়ে। ওঁর কথা বোঝার চেষ্টা করি। গিরিশচন্দ্রের কথায় শিশিরকুমার সব থেকে শ্রদ্ধিত। বলেন, ‘গিরিশবাবুর সব কিছুই আমার চেয়ে ভাল ছিল। দেহ, মুখ, চোখ— আমার তো চোখ নেই বললেই হয়। আর গলা তো আমার তাঁর তুলনায় কিছুই নয়। আমার একটা জিনিসই ওঁর থেকে ভাল— সেটা উচ্চারণ। গিরিশবাবুর উচ্চারণে কোলকাত্তাইয়া drawl ছিল। মোমোতা (মমতা), চোমোৎকার (চমৎকার) বলতেন।’ খাস উত্তর কলকাতার বনেদি অনেক পরিবারে এরকম উচ্চারণ শুনেছি বটে।

দানীবাবুর কথা জানতে চাওয়াতে বললেন— ‘দানীবাবুর শুধু বিদ্যাই নয়, বুদ্ধিরও অভাব ছিল। লেখাপড়া তো শেখেনইনি, পরন্তু বাবা দেখতেন না, নেশাভাঙ করে বড় হয়েছেন— adult হয়ে যাবার পরেও কথার জড়তা আধোআধো উচ্চারণের রেশ থেকে গিয়েছিল। কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধির দ্বারা যদি চালিত হতেন তাহলে দানীবাবুর তুল্য অভিনেতা কেউ হতেন না। He had a wonderful voice, and a more than wonderful presence। বিরাট গলার আওয়াজ, বিরাট গলার range। পুরো গলাটা ওপরে উঠত। যত ওপরে উঠত তত ভাল লাগত। অসম্ভব দম ছিল— এক দমে কতটা যে বলতে পারতেন ধারণার অতীত। যৌবনে গলাটা একটু কর্কশ ছিল। গাঁজাটাজা খেতেন তো। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে সে কর্কশতা চলে গিয়েছিল। তবে ওঁর ওই অসাধারণ কণ্ঠ, অসাধারণ presence-এর কোনও ঠিকঠাক logical ব্যবহার ছিল না। গলা সিঁড়িভাঙার মতো ধাপে ধাপে উঠল। খানিকটা বললেন আবার নামল। আর খুব সুরেলা ছিল অভিনয়। হাঁটাচলাতেও নানা রকমের mannerism ছিল।’

আমি শুনে বলে ফেলেছিলাম— ‘তখনকার অভিনয় বোধহয় অমনিই হত।’ রাগ করে বললেন— ‘তখনকার অভিনয়’ কথাটার কোনও মানে হয় না। গিরিশবাবু তো ওরকম অভিনয় করতেন না— অর্ধেন্দুশেখর করতেন না, দানীবাবুর ওই স্থূল ও ভুল অভিনয়ের কারণ হল তিনি কোনওদিন গিরিশবাবুর কাছে শিক্ষা পাননি। Economy of expression কী সেটা গিরিশবাবুর অভিনয় দেখলে বোঝা যেত। ‘শিবাজী নাটকে আওরঙ্গজেব করছেন। শিবাজীকে ধরে আনা হয়েছে আওরঙ্গজেবের দরবারে। শিবাজী খুব তীব্রভাবে প্রতিবাদ করছেন— দরবার চঞ্চল হয়ে উঠছে। আওরঙ্গজেব শুধু কী একটা লিখেই চলেছেন। তার মধ্যে একবার চোখ তুলে শিবাজীর দিকে তাকালেন। একবার হিন্দু রাজপুরুষদের দেখলেন তাদের ওপর হিন্দুরাজার এই বক্তৃতায় কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে— একবার মুসলমানদের দেখলেন— যেন তারা প্রয়োজন বোধে প্রস্তুত থাকে। তিনটি দৃষ্টিতে যেন পুরো একটা নাটক হয়ে গেল। শিবাজীর আরও খানিকটা চিৎকারের পর মুখ তুলে পাশের একজনকে খুব আস্তে আস্তে বললেন ছত্রপতির শরীর বোধকরি অসুস্থ। ওঁকে হাকিমের কাছে নিয়ে যাও।’ এই দৃশ্যে অভিনয়ের যে সংযম তার তুলনা দেখিনি। বলিদান নাটকে করুণাময় যেখানে স্ত্রীকে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে— স্ত্রী বলছেন, ‘এই তো এখানেই সারারাত ছিল, তোমাকে হাওয়া করেছে।’ তার উত্তরে করুণাময় বলছে— ‘আর আমি সারারাত কি করেছি জানো? মনে মনে তার মৃত্যুকামনা করেছি।’ এই কথাটা এত সহজভাবে বলতেন যে বুকের ভেতরে গিয়ে বিঁধত। গিরিশবাবুর অ্যাকটিং অত সহজ ছিল বলেই অত nobel মনে হত।

আলোচনা করতে শিশিরবাবু বলেছেন দানীবাবুর শিক্ষা হয়েছিল অমৃতলাল মিত্রের কাছে। তাঁরও অপূর্ব কণ্ঠ ছিল— কিন্তু সুরেলা অভিনয় করতেন। নির্মলেন্দুর অভিনয়ে আবার দানীবাবুর নাকি প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। শিশিরবাবু বলেন— ‘অমন সুন্দর কণ্ঠ, অমন চেহারা তা দানীবাবুর copy করে করে ও গেল। ভয়ানক সুরেলা অ্যাকটিং। অবশ্য একদম শেষের দিকে একটা সামাজিক নাটক দেখেছিলাম— সুর কমে গেছে, অনেকটা স্বাভাবিক।’

একটা জিনিস লক্ষ করেছি অভিনয় বা থিয়েটারের ব্যাপারে সমালোচনার সময় শিশিরকুমার নির্মম। কোনও বিবেচনাতেই তিনি আপস করেন না। নির্মলেন্দু বা অহীন্দ্রবাবুর অভিনয়কে নাকচ করতে দ্বিধাহীন। আবার তিনকড়ি চক্রবর্তী সম্বন্ধে বলেন— ‘He was a very good actor’। মথরো দেখেছ? অসাধারণ। আরও অনেক পার্টই। তবে একবার তিনকড়িদা যোগেশ করতে চাইলেন— আমি আমার ওখানেই ব্যবস্থা করলাম— ওঁর রমেশও করে দিলাম— অভিনয়ের শেষে গ্রিনরুমে ঢুকে বললেন— ‘শিশির হল না।’ বয়ঃজ্যেষ্ঠ ছিলেন। আমি শ্রদ্ধা করতাম। কী বলব। বললাম শুধু— ‘অনেক বেশি বয়সে এ পার্ট নিলেন, আরও আগে আরম্ভ করলে হত।’

সেরকম ভারী পার্টের পক্ষে বয়েসটা একটা factor বইকি। এই সময় রমেশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। বললেন, ‘রমেশের পার্ট আজ অবধি ভাল করে হয়নি। ছবি-টবি মন্দ করে না, কিন্তু ও পার্টটা একজন করতে পারত— নরেশ। নরেশ is a great actor and a very mean man। সেইজন্যেই এত প্রতিভা নিয়েও বাংলা স্টেজের জন্য কিছুই করে গেল না। ও যদি আমার পাশে এসে দাঁড়াত তাহলে অনেক কিছু করতে পারতাম। কলেজ থেকে একসঙ্গে আমরা অভিনয় করছি। তখন ওর সঙ্গে অভিনয় করতে আমার ভয় লাগত।’

দুর্গাদাস সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছি— কেমন অভিনয় করতেন। জবাবে বলেছেন— ‘দুর্গার গলার আওয়াজ ছিল ভারী ভাল— চেহারা ছিল অতি সুন্দর। অভিনয় সব সময়ে যে খুব logical, চরিত্র অনুযায়ী হত তা নয়— কিন্তু একটা গুণ ছিল, he had a way of his own— পার্টটা নিজের করে নিতে পারত। সেটাও অনেক সময় ভালই লাগত।’ একটু মুচকি হেসে বললেন— ‘আর, ওর অভিনয় সব থেকে বেশি কারা পছন্দ করত জানো তো?— মেয়েরা।’

একদিন প্রশ্ন করি— ‘আপনার সব থেকে ভাল ছাত্র কারা?’ বললেন— ‘একজন ওই শৈলেন (চৌধুরী)। দেখেছ ওর অভিনয়? ওর ভেতরে অনেক বৈচিত্র্য ছিল— promise ছিল। সে সব fulfilled হবার আগেই তো মরে গেল। আর একজন আমার ভাই বিশু (বিশ্বনাথ ভাদুড়ি)। বিশুরও অভিনয়ের প্রচুর ক্ষমতা ছিল। শেষকালটায় আর একটা থিয়েটার করার চেষ্টা করে। বাড়িও কিনেছিল। ঝপ করে মরে গেল। থাকলে কলকাতা শহরে আর একটা থিয়েটার হত।… আর একজন ছিল আমার দলে খুব ভাল অভিনেতা— শেতল পাল।’ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরির কথা তুলেছি। বলেছেন— ‘হ্যাঁ, ওঁরা আমার ছাত্র ঠিকই। এক হিসেবে আমার সব থেকে ভাল ছাত্র ওঁরাই। কিন্তু ছাত্র বলে ওঁদের কথা মনে আসে না— ওঁরা ছিলেন আমার বন্ধু। থিয়েটারের মানুষ হিসেবে এঁরা অসামান্য ছিলেন। মহর্ষিকে যখন প্রথম অভিনয় করতে রাজি করালাম তখনও উনি কলকাতার ভাষা ভাল করে বলতে পারেন না— কথায় বাঙাল টান ছিল। সেইখান থেকে কতবড় অভিনেতা হয়েছিলেন। যোগেশবাবুর লেখার ক্ষমতা ছিল খুব। প্রায় রাতারাতি তো ‘সীতা’ লিখে দিয়েছিলেন। আর অভিনয় ছিল অতি স্বাভাবিক। ওঁকে বলতে পারো অর্ধেন্দুশেখরের school-এর অভিনেতা।

এই প্রসঙ্গে বাংলা অভিনয়ের বিভিন্ন school-এর কথা ওঠে। শিশিরকুমার হেসে বলেন— ‘ওসব ইস্কুল-টিস্কুলে আমি বিশ্বাস করি না। There is only one school of acting— that is good school of acting। তবে বাংলা থিয়েটারের অভিনয়ের কতকগুলো ধারা আছে।’

আগেও ছিল, আজও সেগুলো দেখতে পাওয়া যায়। একদিকে যাত্রার ট্র্যাডিশন থেকে জন্মানো সুরেলা অভিনয়ের ধারা— অমৃত মিত্তির থেকে দানীবাবু, দানীবাবু থেকে নির্মল (নির্মলেন্দু লাহিড়ী)— আর একদিকে চরম স্বাভাবিকতা— naturalism; অর্ধেন্দুশেখর, ঠাকুরবাড়িতে অবনীন্দ্রনাথ— অমৃতলাল বসু খানিকটা— যোগেশবাবু। এই দুয়ের মাঝখানে গিরিশবাবু— স্বাভাবিক— কিন্তু সময় সময় elevated– theatrical-ও।

আমার হঠাৎ মনে পড়ে যায় ষোড়শীর জীবানন্দ। স্বাভাবিকতার naturalism-এর চূড়ান্ত এই অভিনয়। যখন চণ্ডীমণ্ডপে বসে শিশিরকুমার কথা বলেন, তখন মনে হয় আমিও সেই আসরে বসে আছি। কিন্তু ষোড়শীর ঘরের চাবিটা দিতে যান— নিজের অতীত বর্ণনা করেন, মাইম করেন একটু— পায়ে করে মাদুর টেনে বসতে গিয়ে তার তলায় নির্মলের চিঠি আবিষ্কার করেন— এবং পকেটে রাখা কিন্তু দৃশ্যমান নয়, রিভলভারের ওপর চাবি দিয়ে ঠং করে মেরে বুঝিয়ে দেন পকেটের অস্ত্রের উপস্থিতি ও জীবানন্দের সাইকোলজি— সে অভিনয় স্বাভাবিক বটে কিন্তু theatrical means-এর চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার। আবার যখন ষোড়শীর আশ্রমে চলে যাওয়ার আগে জীবানন্দর মানবিক দুর্বলতাকে প্রকাশ করে ষোড়শীকে বলেন, ‘তুমি ফিরে আসবে না অলকা?’— প্রস্থানের পূর্বমুহূর্তে যখন ‘অলকা’ বলে ডাকেন, তখন তা যে কী আশ্চর্য লিরিকাল তা, যে না-দেখেছে সে বুঝবে না। সেই ‘অলকা’ ডাক আর তখন যেন স্বাভাবিকতার স্তরে থাকে না। যুগ-যুগান্তের যত বিরহী মানুষের আর্তনাদ সব যেন ওই ‘অলকা’ ডাকের মধ্যে এসে জড়ো হয়। শিশিরবাবুর অভিনয়ের শরীরটা যেন বাস্তবতার আর প্রাণটা-আত্মাটা যেন কাব্যের।

মহর্ষির কথায় নানা ব্যক্তিগত কথা বলতে আরম্ভ করেন শিশিরকুমার— ‘আমৃত্যু বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল মহর্ষির সঙ্গে। মৃত্যুর আগেও গিয়েছিলাম। কত কথা মনে পড়ে। এক বিছানায় শুয়ে রাত পর্যন্ত কাটিয়েছি। আচ্ছা, আগে যাদের যাবার কথা তারা পড়ে থাকে। যাদের সামনে অনেকখানি জীবন তারাই কেবল আগে চলে যায়, কেন বলো তো?’

প্রভাদেবী যখন মারা গিয়েছিলেন তখনও শ্রীরঙ্গম আছে। সেদিন শ্রীরঙ্গমে অভিনয় হয়নি। আর অভিনয় বন্ধ হবার বিজ্ঞপ্তি হিসেবে বাইরে একটা পোস্টার লেখা ছিল— ‘প্রভাদেবীর মৃত্যুতে রঙ্গমঞ্চ নিষ্প্রদীপ।’ শিশিরবাবুরই নির্দেশে লেখা। ওই সাহিত্যবোধ আর কার হবে?

আমি শুনেছিলাম শিশিরকুমারের উপস্থিতিতে প্রভাদেবী দু-এক সময় রিহার্সাল পরিচালনা করেছেন। শিশিরকুমার অডিটোরিয়ামে বসে দেখছেন। কথাটা ওঁকে বলতে বলেছিলেন— ‘সৌমিত্র, প্রভার সঙ্গে পরিচয় হলে বুঝতে সে সত্যিকারের বিদুষী ছিল। ও ডেমই বলো আর জেমই বলো, প্রভাসুন্দরীর মতো actress বিলেতে একটিও নেই। আমার সময়ের সব থেকে বড় অভিনেত্রী হলেন প্রভা, কঙ্কা, কৃষ্ণভামিনী and of course তারাসুন্দরী।’

এঁদের একজনও আর নেই। শিশিরকুমার রয়েছেন প্রাচীন কীর্তির মতো। গল্পে গল্পে রাত বেড়ে যায়। উঠে পড়ি। রাস্তায় বের হওয়ার আগে জিজ্ঞেস করি—

—এর মধ্যে কোনও থিয়েটার করার মতো প্রস্তাব আসেনি?

—না।

—আর কোনও দল থেকে…

—না, কেউ আসেনি। ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ভালমন্দ যাই হোক সত্যরে লও সহজে। এখন বুঝতে পারি আর বোধহয় আশা নেই। স্টেজ ছাড়ার পর দু’বছর হয়ে গেল। আর কদিনই বা বাঁচব। এখন কোনও মিরাকেল ঘটা ছাড়া আমার পক্ষে থিয়েটার করা শক্ত। কী আর হবে! They also serve who stand and wait.

বি টি রোড ধরে বাড়ি ফিরি যখন চোখ দুটো ঝাপসা লাগে। সেই ঝাপসা দৃষ্টির ভেতর দিয়ে দেখতে পাই শিশিরকুমার কোথায় আছেন, কেমন আছেন, থিয়েটার করছেন কিনা, এসব কথা ভেবে বিপুল বিরাট জীবনের স্রোত এতটুকু থমকে দাঁড়ায়নি— এই দেশের কোথাও এতটুকু আঁচড় পড়েনি— কলকাতা রয়ে গেছে কলকাতাতেই। মনে হতে থাকে ‘O God that madest this beautiful earth, when will it be ready to receive thy saints?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *