কাছের মানুষ
সিনেমা করতে এসেই পরিচয়। সেটা সম্ভবত ১৯৫৯, তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে আমরা দু’জনে প্রথম একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। যৌবনের প্রাণবন্ত সময় আর বয়সের দিক থেকেও আমরা কাছাকাছি, সে জন্য খুব দ্রুত সম্পর্কটা কাজের পরিচয় থেকে বন্ধুত্বে পৌঁছে গিয়েছিল। দিলীপ যে একজন দক্ষ অভিনেতা তা প্রথম থেকেই বুঝতে পারা গিয়েছিল। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬০-এ, দিলীপের ‘বাদশা মামুদ শা’ চরিত্রের অভিনয় বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। একসঙ্গে পেশাগত কাজ করতে করতেই খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম তপনদারই পরের ছবি ‘ঝিন্দের বন্দী’ করার সময়। সেই ছবিতে আমাদের দুজনেরই মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ রোল থাকায় অনেকদিন একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। রাজস্থানের পাহাড় আর দুর্গে আউটডোর শুটিং, কাজের পর অবসরের সময়টাও দারুণ কাটত। বিচিত্র রঙ্গরসিকতায় আমাদের আড্ডা-বৈঠক জমে উঠত। বয়সোচিত দুষ্টুবুদ্ধিরও অভাব ছিল না এবং সেক্ষেত্রে আমার ও দিলীপের বোঝাপড়া ছিল নিখুঁত। নিউ থিয়েটার্স-এর আমলের প্রবীণ অভিনেতা ধীরেনদা ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে একটা ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন (ঝিন্দের একজন জহুরি, যিনি রাজপরিবারের পরিচিত এবং অনেক গোপন সংবাদ জানেন)। আমি আর দিলীপ রীতিমতো পরিকল্পনা করে ধীরেনদাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতাম। আমাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে প্রমাণ করতে চাইতাম ধীরেনদা ঘোর মদ্যপ, খাওয়া-ঘুম ইত্যাদিতেই বেশি আগ্রহী এবং কিছুতেই মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করতে চাইছেন না। যদিও ধীরেনদা সম্পর্কে এই কথাগুলোর একটাও সত্যি নয়, তবুও আমরা যৌথ উদ্যোগে তেমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছিলাম যাতে ধীরেনদার নিজের কাছেও একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। পুরনো আমলের মানুষ, আমাদের কথা ও ভাবভঙ্গির কৌশল প্রথমদিকে ধরতে পারতেন না। পরে অবশ্য সব বুঝতে পেরে রেগে যেতেন।
তারপরে অসংখ্য ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। দিলীপ অনেক ছবিতেই উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেছে। কিন্তু ভেবেচিন্তে যদি একটা- দুটো ভূমিকা আলাদা করে সরিয়ে রাখতে হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় হাঁসুলিবাঁকের উপকথায় করালীকে বেছে নেব। যে-কোনও মানের বিচারে সেটা স্মরণীয় অভিনয়। নাটকেও ওর অনেক ভাল কাজ আছে। ওর ছবি ‘দর্পচূর্ণ’ আর ‘রাজদ্রোহী’ নাটক খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এখনও মনে আছে অভিনেতৃ সঙ্ঘের প্রযোজনায় ‘রাজকুমার’ নাটকে দিলীপ রাজকুমার-এর বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিল এবং অত্যন্ত সুন্দর কাজ করেছিল।
পরিচালক হিসেবেও ওকে সাফল্য পেতে দেখেছি। অন্যরকম ছবি করার ইচ্ছেও ওর মধ্যে কাজ করেছে, ‘গরম ভাত’-এর স্মৃতি তো এখনও উজ্জ্বল। ‘দেবদাস’ করেছিল অত্যন্ত নিষ্ঠা ও যত্নের সঙ্গে। চিত্রনাট্যটি একটি নাটক-নির্ভর ছিল বলে হয়ত একটু বেশি নাটকীয় হয়েছিল, কিন্তু পরিচ্ছন্নভাবে ছবিটি তৈরির ক্ষেত্রে ওর উদ্যোগ প্রশংসনীয় ছিল।
সাংগঠনিক কাজে দিলীপ চিরকাল অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং পরিশ্রমী। অভিনেতৃ সঙ্ঘে পাশাপাশি কাজ করার সেইসব দিনে ওর এই ধরনের গুণের পরিচয় পেয়েছিলাম। দিলীপের সঙ্গে যে পারিবারিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল সেটা শুধুমাত্র পেশার অভিন্নতার জন্য নয়। ও চিরকালই একজন সমাজসচেতন মানুষ, সাধ্যমতো সমাজ-কল্যাণমূলক কাজে জড়িয়ে থাকতে চেয়েছে। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ওর যে বামপন্থী মনোভাব রয়েছে সেটাও আমাদের পরস্পরের পক্ষে কাছের মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ এই ধরনের চিন্তা আমিও পছন্দ করি, এতকাল ধরে বহুক্ষেত্রেই আমরা সহমত পোষণ করে এসেছি।
যদিও বন্ধুর কাছে এটাই প্রত্যাশিত, তবুও দিলীপ যে পরিমাণ উৎসাহ নিয়ে আমার চলচ্চিত্র ও নাটকের কাজকর্ম দেখেছে এবং উৎসাহ দিয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করি। এই ধরনের সাগ্রহ গুণগ্রাহিতা খুব সুলভ নয়। এখনকার দিনে সমপেশায় রত পরিচিতদের মধ্যে এটা আর তেমনভাবে নেই, আমাদের সময় ছিল।
ব্যস্ততা ও সময়-সুযোগের অভাবে আগের মতো আর ঘন ঘন আসা-যাওয়া বা দেখা হয় না, কিন্তু মনের দূরত্ব তৈরি হয়নি কখনও, ও এখনও আমাদের কাছের মানুষ।
চিরকালই থাকবে।