শিশিরকুমারের স্মৃতি-৩

শিশিরকুমারের স্মৃতি-৩

আমার প্রথম ছবি অপুর সংসারের কাজ শুরু হওয়ার আগে ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে একবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। রোগশয্যায় জার্নাল লেখা অভ্যাস হয়েছিল। সেখানে শিশিরকুমার ভাদুড়ি সম্পর্কে দীর্ঘ স্মৃতিচারণা রয়েছে। যদিও এর অনেকটা ব্যক্তিগত, তবু এর কিছু কিছু অংশ পাঠক সাধারণের কৌতূহলের বিষয় হতে পারে, এই মনে করে তার থেকে কিছুটা এখানে তুলে দিলাম।

সেই গত সপ্তাহে জ্বর হওয়ার আগে শিশিরকুমারের কাছে গিয়েছিলাম। এতদিনে বোধহয় আমায় expect করছেন। ওই মুখটির কথা এত মনে পডে— old and beautiful। সব কটা রেখা বাণীময়। চুরুটটা ধরাতে ধরাতে ঘরে ঢুকলেন, মুখে হাসি— ‘Very glad to see you’।

আজ ২৩ জানুয়ারি। ছাপ্পান্ন সালের ২৩ জানুয়ারি শ্রীরঙ্গমে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ অভিনয় দেখেছিলাম। ২৪ তারিখ ‘প্রফুল্ল’। শ্রীরঙ্গমেই সেই শেষ। তারপর থেকে এখানে-সেখানে ওঁরই ভাষায় ‘ভাড়াটে কেষ্ট’ হয়ে মাঝে মাঝে অভিনয় করে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে শিশির ভাদুড়ির থিয়েটার নেই। বাংলা থিয়েটারের তাহলে কী আছে? ভাবলে চোখ ফেটে জল আসে। শিশিরবাবুও নিশ্চয়ই এসব কথা ভাবেন। তখন ওঁর মনের অবস্থাটা কী হয় জানতে ইচ্ছে করে। এসব দুঃখ ভাগ করে নেওয়ারও তো কেউ নেই। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি উনি সেই চওড়া চেয়ারটায় একা একা বসে ভাবছেন। কত কিছু ঘটে গেছে— এখনও কত কী ঘটতে পারে। সারাজীবন কত আঘাত দ্বন্দ্ব কত ঘটনার সমারোহ— richest possible experience।

যৌবনে যখন স্বপ্ন দেখতেন, যখন নিজের ক্ষমতাকে আবিষ্কার করেছিলেন— যে ক্ষমতা হয়ত অচরিতার্থ থেকে গেল— এখন হয়ত প্রদোষে কোনও জীবনের একাকিত্বের মধ্যে সবকিছুই তিনি বসে বসে ভাবেন। কতদিন হঠাৎ গিয়ে পড়ে তাঁকে একলা বসে থাকতে দেখে একথা আমার মনে হয়েছে। আর কতদিন বাঁচবেন জানি না। বিশাল বুকের খাঁচাটা আজকাল যেন একটু কুঁকড়ে আসছে— হাতটা আগের থেকে রোগা লাগে। সেই সুন্দর করতল, শিল্পীর আঙুল— চামড়া কুঁচকে আসছে তার ওপর। মাথায় অল্প কয়েকটা চুল বাকি পড়ে আছে। শিশিরকুমার শুনেছি একসময় শৌখিন ছিলেন। বাবুমার্কা নিশ্চয়ই নয়। তাহলেও যে-লোকটা মাইকেলের পার্ট অতবার করেছে সে মাইকেলের মতো একমোহর দিয়ে চুল না কাটুক অন্তত এসব ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন বলেই ভাবা স্বাভাবিক। আজকাল কাঠের পুরনো বাক্স হাতে রাস্তার ধারের নাপিত এসে চুল কেটে দিয়ে যায়। শিশিরবাবুর ভাই পয়সা দিয়ে দেন— কয়েকদিনের জমা হলে। দিনের বরাদ্দ চুরুট গোনাগুনতি থাকে সকালে। একটির দাম ছ’পয়সা। কিন্তু এসব ব্যাপারে ওঁর যে কোনও নজর আছে বলে মনেই হয় না। নালিশ তো একেবারেই নেই।

He hated self-pity.

বর্তমানের ভার বেশি ঠেকলে বড়জোর খুব খানিকটা ভবিষ্যতের গল্প করতে করতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। বলেন, কত কি করার আশা: ‘a film—a library— and a number of new experiments in theatre’।

তারপর আচমকা চুপ করে যান। বলেন— ‘আশা তো কত কিছুরই ছিল। কি জানো সৌমিত্র, শেষ জীবনটা ঠিক সুবিধের হল না।’ হেসে ফেলেন। তারপর বলেন, ‘না হোক— কী আর করা যাবে— কত লোকেরই হয় না।’

এখনও অবধি নতুন বই পড়েন। সমালোচনা করেন। মাঝে মাঝে খুব পুরনো বই পড়েন। বলেন, ‘পুরনো বিদ্যে একবার serially revise করা দরকার। তারপর বলেন, ‘নতুন আর কী পড়ব? I have read much— I have tired of reading।’ ওঠার সময় কিন্তু ঠিক বলেন, ‘নতুন কোনও বই পেলে এনো। পরের দিন গিয়ে দেখি সাদা বিছানার ওপর কালোতে সবুজে বাঁধাই চকচকে একখানা নতুন বই। নতুন লেখকের নতুন নভেল। সামনে চশমাটা খোলা। উনি ঘরে নেই। ওঘরে ফোনে হয়ত কথা বলছেন।

বসে বসে বই ওলটাই। শোবার ঘরে বই বেশি নেই। Encyclopaedia-র সিরিজ, Oxford-এর literary companion, কিছু অভিধান, সাহিত্যের ইতিহাস— এমনি ধরনের প্রায় দেড়শো-দুশো বই। নাটক ও থিয়েটারের ওপর বই-ই বেশি। ওঁর কত বই আছে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন— ‘হাজার দেড়েক বই আমার এখনও আছে— of which a thousand is worth preserving। আর যা আছে তার তিনগুণ বই, আমার গেছে।’ কতবার বাড়ি বদলেছেন, কত অজস্র ধরনের লোক আসে, কত ছাত্র— তাদেরও অনেকে পড়তে নিয়ে ফেরত দেয় না। কত চুরি গেছে। কত রকমারি edition-এর Shakespeare ছিল, সেটা কে এক বন্ধু আত্মসাৎ করেছেন। বললেন, ‘Those were my ribs, যাকগে— কী আর হবে।’ একদিন বলেছিলেন, কতকগুলি দুষ্প্রাপ্য বই আর মূল্যবান কাগজপত্র হারানোর বিষয়— ‘ওরকম আমার বহু হারিয়েছে— because those who live around me do not know the worth of it.’ ঘরে খানিকক্ষণ বসে থাকলেই বই উল্টোই। বই-এর তাকে খেরো দিয়ে বাঁধানো প্রফুল্ল আর আলমগীরের দুটো prompt copy— আশপাশে ওঁর মন্তব্য। রবীন্দ্রনাথের কিছু বই— নিজের হাতে লিখে, শিশিরবাবুকে দিয়েছিলেন। এইসব হাতড়াচ্ছি এমন সময় ঘরে ঢোকেন— ‘এসো এসো সৌমিত্র, very glad to see you— কেমন আছ?’ পাল্টা প্রশ্ন করি— আপনি কেমন আছেন? প্রত্যহই বলেন, ‘খুব ভাল।’ কোনওদিন বা যোগ করেন— ‘তবে ওই এক অসুখ— suffering from inaction.’

অম্বর থেকে ফিরে যেদিন দেখা করতে গেলাম সেইদিনই প্রথম মনে হল শিশিরকুমার বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। রোগা লাগল। গায়ে কোট আর মেরুজাই-এর মাঝামাঝি একটা সাদা রঙের জামা। ক’দিন আগে পুতুবাবু (ওঁর সব থেকে ছোটভাই ভবানী ভাদুড়ি) মারা গিয়েছেন। মনে মনে ভারী একটা সঙ্কোচ ছিল। কেমন করে দেখা করব। বারবার মনে পড়েছিল অম্বর যাওয়ার আগের দিন দেখা করতে এসে শুনলাম পুতুবাবুর stroke হয়েছে। দুজনে চুপচাপ বসেছিলাম। উনি যতই চেষ্টা করছেন অন্য কিছু নিয়ে আলোচনা করার ততই সব কেমন স্তব্ধ হয়ে আসছে। ওঠার সময় বললেন, ‘সৌমিত্র let us hope to meet in a better prospect next time.’ এই কথা ভেবে খুব মন খারাপ লাগছিল। প্রত্যহের মতোই উনি ওপরে ডেকে পাঠালেন। প্রশ্ন করলাম, কেমন আছেন? usual উত্তর এল— ‘খুব ভাল।’ তারপর একটুও না থেমেই বলে গেলেন— ‘তবে সাইকোলজিক্যালি একটু set back— যাক সে কথা— তোমার শরীর কেন বলো— how did you enjoy your trip? সেই যে অন্য কথা আরম্ভ করলেন আর একবারও পুতুবাবুর কথা বললেন না। যে জানে না সে ভাবতেও পারবে না কথা শুনলে যে এই মানুষটার অত প্রিয়জন মাত্র ক’দিন আগে মারা গিয়েছে। শেষের দিকে আমিই আবার কথাটা তুললাম। খুব সংক্ষেপে অসুখের বিবরণটা দিতে দিতে চশমাটা খুলে ফেললেন। কিছুই হয়নি এমনিভাবে একবার চোখটা মুছে নিলেন। Precious drops। তারপর সব প্রসঙ্গ যেন মুছে ফেলে নতুন করে আরম্ভ করলেন— ‘তারপর বলো, তোমার আর কী খবর— তোমার রেডিওর কাজ কেমন চলছে?’

পুতুবাবুর সঙ্গে আমারও ছোট্ট একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষত মনে আছে ‘প্রফুল্ল’ অভিনয়ের সময়। অভিনয়ের আগের দিন শিশিরকুমার আমাকে সকালে আসতে বলেছিলেন স্টেজটা দেখতে যাবেন বলে। নিচের ঘরে বসে আছি। এমন সময় শিশিরবাবু ঘরে ঢুকলেন সঙ্গে পুতুবাবু। শিশিরবাবুর পরনে গরদের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, কালো জুতো, গলায় চাদর। অমন সাজগোজের বাহার দেখে আমি বোধহয় একটু তাকিয়েছিলাম। দেখাচ্ছিল তো রাজকীয়। উনি একটু সলজ্জিত হেসে বললেন, ‘সাজ হয়ে গেল, না? সাজালে গোছালে ঘর/কামালে জোমালে বর।’ পরিহাসে তরল করে নিলেন মুহূর্তটিকে। বাড়ি থেকে পুতুবাবু আর আমি নিয়ে এলাম ট্যাক্সি করে। সেদিন বলে নয়— প্রত্যেকদিনই পুতুবাবু সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। ‘প্রফুল্ল’ অভিনয়ের দিনও দেখেছি সবসময় পুতুবাবু কাছে কাছেই আছেন। অভিনয়ের সময় চশমা থাকত না— তাই উইংসের ধারে ওঁকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আবার মঞ্চ থেকে প্রস্থান করে উইংস দিয়ে ঢুকলে ধরে নিতে হত। চোখেও তখন ছানি পড়েছে। এইসব কাজগুলো পুতুবাবুই করতেন। বঙ্গ সংস্কৃতির মঞ্চে অভিনয়ের দিন আমিও খানিকটা এই দায়িত্ব নিয়েছিলাম— পুতুবাবুই খানিকটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

সেইদিনের অভিনয়ের স্মৃতি আমার জীবনে একটা পরম ঘটনা। সেই আমার শিশিরকুমারের সঙ্গে প্রথম অভিনয়। তার আগে ওঁর বাড়িতে যাই আসি। আর যেদিন প্রথম ওঁর কাছে যাই সেদিন থেকে কেবলই বলি আমাকে অভিনয় শেখাতে হবে। উনি বলেছেন, ‘স্টেজ নেই, কোথায় শেখাব। তবে if I form a company I must take you.’ সহস্র আলোচনা করেন অভিনয় ব্যাপারে। কিন্তু হাতে-কলমে অভিনয় করার সাধ তো তাতে মেটে না। ইতিমধ্যে কার কাছে জানলাম ‘প্রফুল্ল’ হচ্ছে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে। ছুটতে ছুটতে গেলাম সিঁথি। বাসস্টপ থেকে বাড়ি অবধি যেতে যেতে ভাবছি, কী করে বলব— হয়ত বলতেই পারব না মুখ ফুটে। বাড়ি গেলাম। বিকেল হয়ে আসছে। বি টি রোড তখনও নির্জন। খবর দিতে উনি নেমে এলেন। কাঁধের ধারে বোতাম সাদা পাঞ্জাবি আর সিল্কের লুঙ্গি পরনে। কী বলব না বলব তাই ছটফট মনের ভেতরে। মরিয়া হয়ে বোকার মতো বলে ফেললাম— ‘আচ্ছা প্রফুল্ল হচ্ছে— তাই না?’ তারপর যে কথাগুলো কানে ঢুকল তা অতি আকাঙ্ক্ষিত হলেও অনতিপ্রত্যাশিত— বিশ্বাস হতে চাইছিল না। —’কেন, তুমি পার্ট করবে?’ একেবারে ছেলেমানুষের মতো বলে ফেললাম, ‘হ্যাঁ, আমি পার্ট করব।’ যেন আবদার। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও তোমার কথা ভেবেছি। তোমাকে দিয়ে সুরেশটা বেশ হয়। করবে?’ কী বলব? কাটা সৈনিক নয়, crowd নয়— শিশিরকুমারের যোগেশের পাশে আমি সুরেশ! বুকের ভেতরটা খুশিতে উত্তেজনায় আশঙ্কায় ঢিপঢিপ করতে লাগল। কিন্তু প্রাণপণে মুখের ভাব গোপন করার চেষ্টা করছি যেন কিছুই হয়নি। বললেন, ‘এক কপি প্রফুল্ল কিনে নেবে। খুব ভাল করে পড়বে। and then think।’ রিহার্সালের জায়গা বলে দিলেন দেশবন্ধু পার্কের কাছে ‘সমাজ ক্লাবের একটি ছোট ঘর। বললেন, ‘রিহার্সালে এসো তাহলেই হবে।’

প্রথম যেদিন রিহার্সালে যাব সেদিন যে কী উত্তেজনা মনে মনে তা বোঝাতে পারব না। শিশিরকুমার রিহার্সালে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জনপ্রবাদে কত কী যে শুনেছি। তাছাড়া, সেদিন শিশিরকুমার যেন আমার সম্বন্ধে খুব বেশি হতাশ না হন সে ভাবনাও ছিল। টেনশনেই বোধ করি গলাটাও সেদিন ধরে গেল। নানান রকম কুলকুচি করেও কিছু যেন হল না। যাই হোক, নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ আগেই গেলাম। ছোট্ট একটা ঘর ফরাসপাতা। বাইরে কিছু লোক ঘুরছে যাদের শ্রীরঙ্গমে অভিনয় করতে দেখেছি। আমি নিতান্ত একলা বোধ করছিলাম। আমি শ্রীরঙ্গমের কেউ নই। বড়বাবু বাইরে থেকে আমাকে রিক্রুট করেছেন। আর ওদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে আমার এমন একটা তফাত ছিল যা পেশাদারি অভিনেতার সঙ্গে তরুণ অপেশাদারদের থাকবেই। আমি সারাক্ষণ অসহজ বোধ করেছিলাম। খালি শিশিরবাবুর সঙ্গে একটু সহজ হতে পারছিলাম, তাও সেদিন যেন পুরোটা নয়। রিহার্সালের সময় সুরেশের সেই care free উড়নচণ্ডী চ্যাংড়া ভাবটা আমি সহজে কিছুতেই আনতে পারিনি। সমস্ত দলটার সঙ্গেই আমি তখন খোশখেয়ালে মিলতে পারিনি। নিজের self-consciousness চাপা পড়েনি। যাই হোক, সেদিন তো শিশিরকুমার এলেন— ভেতরে নিয়ে গেলেন রিহার্সাল রুমের। সে ঘরে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না, তাই বসে বসে delivery-র রিহার্সাল হত খালি। আর action-গুলো বলে বলে দিতেন। শিশিরকুমারের পার্ট শেখানোর কথা অনেক শুনেছি। হেমেন্দ্রকুমার রায় তো লিখেছেন যে, শিশিরকুমার অভিনয় শিক্ষক হিসেবে বড়— না অভিনেতা হিসেবে এ কথাটা বলা শক্ত। ওঁরা যে শিশির ভাদুড়ির কথা বলেছেন তিনি একটা মঞ্চের অধ্যক্ষ এবং আচার্য। আমি সেদিন যে শিশির ভাদুড়িকে দেখলাম তিনি একটা ছোট্ট এঁদো ঘরে কতকগুলি সাধারণ অভিনেতাকে বাচনভঙ্গি শেখাচ্ছেন। আর চরিত্রের ধারণা বলে দিচ্ছেন।

শিশিরকুমারের সব থেকে বড় শেখানো হল ভাবতে শেখানো। পার্টটা সম্বন্ধে ভাবতে তিনি অভিনেতাকে inspire করেন— নিজে পার্টটা সম্বন্ধে তার থেকেও বেশি ভাবেন। চরিত্রটা কী এ নিয়ে গোড়াতেই একটা intellectual discourse কিছু দেন না। মোটামুটি রিহার্সাল আরম্ভ হলে তারই ফাঁকে ফাঁকে চরিত্রটা বুঝিয়ে দেন দরকারমতো। অবশ্য আগে বাঁধা রঙ্গালয়ে কেমন রিহার্সাল দিতেন তা আমি দেখিনি। সমস্ত নাটকটা অমন তন্নতন্ন করে পড়তে কাউকে দেখিনি। যেন গোয়েন্দাগিরি করে কোথায় কী লুকনো সুপ্ত প্রচ্ছন্ন আছে সমস্ত হদিশ টেনে বের করেন। পড়ার সময় এমন সমস্ত সংলাপ— কী suggestion আবিষ্কার করে বসেন যা দিয়ে চরিত্র সম্বন্ধে ধারণার সূত্রটাই বদলে দেন— নাটকটার একটা নতুন রূপ ফুটিয়ে দেন— যখন নাটক পড়েন তখন যে সেখানে উপস্থিত থাকবে তার কাছে নাটকটির একটি সম্পূর্ণ বোধ তৈরি হবে। ঠিক অর্থটাকে উনি টেনে আনেন— emphasis করেন। এইটে ছাড়া যে আর কিছু হতে পারে তা আর মনেই হয় না। তাই বলে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে কখনও ভোলান না। ঠিক ব্যাপারটিকে যাচাই করে নিতে সবসময় সাহায্য করেন।

শিশিরকুমারের রিহার্সালে দেখেছি, অন্যের ভেতরে যে সম্ভাবনা আছে, তা উনি টেনে বের করেন। আর ডায়ালগ শেখানোর সময় কোনও মেকানিক্যাল পারসুয়েশন নেই— নেই কোনও প্রিকনসিভড আইডিয়া। অমুক অমুক জায়গায় অমুক অমুক রকমের প্যাঁচ করব— এমন কোনও আগের থেকে ভেবে নেওয়া জিনিসে উনি বিশ্বাস করেন না। বলেন, ‘স্বাভাবিক যা তাকেই বের করে নিয়ে এসো— with necessary intensification of emotion where proper— where significant.’

এই যে কণ্ঠস্বরকে শেষ অবধি শ্রুতিগ্রাহ্য করার সমস্যা— এ ব্যাপারটায় দেখেছি শিশিরকুমার কখনও চিৎকার করেন না। উনি বলেন, ‘গলাটা উঁচু স্কেলে বেঁধে নাও— বড় করে বলো— আর শোনানোর বড় দায়িত্ব হল উচ্চারণের। উচ্চারণ পরিষ্কার ও গোটা গোটা করো।’ উনি বেসটা কালটিভেট করতে বলেন। মডুলেশন বা গলার মোচড় যা শেখান তাও মানে বুঝে বুঝে সংলাপ বলার মধ্যে দিয়ে— আলাদা করে গলা উঠিয়ে নামিয়ে নয়। গলার কাজ ও অভিব্যক্তি রিহার্সালের সময় দেখার সুযোগ খুব বেশি। কেননা, পরপর হয়ত কাঙালিচরণ, ভজহরি, প্রফুল্ল, সুরেশ, রমেশ এইরকম বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে করে দেখিয়ে দিতে হচ্ছে। তখন দেখেছি বিভিন্ন চরিত্রে শিশিরকুমারের বিভিন্ন কণ্ঠ বিভিন্ন অভিব্যক্তি। তেমন কণ্ঠ, তেমন অভিব্যক্তি আর কখনও কোনও অভিনেতার কাছে পাব বলে বিশ্বাস হয় না। আর অমন উচ্চারণ কখনও শুনিনি। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তির রেকর্ডগুলো শুনে ওই উচ্চারণের তুলনা পেয়েছি।

রিহার্সালে শিশিরকুমারের উচ্চারণের প্রমাণ পেয়েছি। তবু সেখানে ওঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, তিনি তাঁর বিদ্যায় দক্ষ এবং সে বিদ্যা শিক্ষা দিতেও দক্ষ। কিন্তু অবাক হতে হয় এই ভেবে যে সমস্ত জীবনে কী পরিমাণ প্যাশন থাকলে একটা লোক একলা ইনসিয়েটিভে একটি থিয়েটার চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। আর বাধা তো অন্তহীন। ম্যারাথন টাসক। শিশিরকুমার যতখানি ইনস্পিরেশন ততখানিই পারস্পিরেশন। এমন সময় গেছে ওঁর, স্টেজে যখন নতুন বই খোলার আগে দিন-রাত মহলা চলত। প্রায় বেশিরভাগ লোক বাড়ি ফিরত না, হালুইকর বসত সকলের রান্না করতে। সকালে রিহার্সাল, দুপুরে রিহার্সাল, সন্ধ্যায় প্লে। এর মধ্যে প্রয়োগকর্তার সমস্ত পরিশ্রম চিন্তা। ম্যানেজারের দায়দায়িত্ব সবই তো ছিল। তার ওপর কখন যে ব্যক্তিগত জীবনচর্চা, পড়াশুনা এসবের সময় পেতেন ভেবে পাই না। একস্ট্রা-হিউম্যান এনার্জি না থাকলে চলে না। কিছু না হোক যা পড়াশুনা করেছেন তাই পড়লেই তো আমাদের জীবনটা ধরে দিতে হবে। অনেক নামকরা অধ্যাপক, ডাকসাইটে পণ্ডিতের কাছে গিয়েছি। কিন্তু এমন লিটারেরি কনসায়েন্স আর কারও মধ্যে দেখিনি।

ওঁর বৈদগ্ধ্যের একটা প্রকাশ দেখেছি। ওঁর কথা বলায় এত উজ্জ্বল উইট, এত মননদীপ্ত সরসতা এবং আপন অনন্য ব্যক্তিত্বের দ্বিধাহীন প্রকাশ, তাঁর কথা বলার মধ্যে দেখেছি যে মাঝে মাঝে বার্নার্ড শ’র কিংবদন্তিগুলো মনে পড়ে গেছে। শিশিরবাবুর এই অসামান্য কথা বলাকে লক্ষ করে প্রমথ চৌধুরি একবার বলেছিলেন, ‘শিশির, তুমি এত ভাল কথা বলো— তুমি লেখ না কেন?’ শিশিরকুমার উত্তর দিয়েছিলেন— ‘Some people are born to write literature and some people are born to talk literature. I am are one of those who talk literature. I shall be talking splendid literature throughout my life.’

প্রমথবাবু আর একবার ওঁকে একটু খোঁচা দিয়ে বলেছিলেন, ‘শিশির, এই যে তোমরা সব ছেড়েছুড়ে স্টেজে গেলে— তা হলটা কী?’ শিশিরবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আজ্ঞে হয়নি কিছুই, কিন্তু আর কোন দিকটায় কী করলেন আপনারা? সাহিত্যের কী হল? শিবরাত্রির সলতে বলতে তো ওই এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ এসব গল্প শিশিরবাবুর কাছেই শুনেছি। শুনে মনে হয়েছে প্রমথবাবুর মতো ইনটেলেকচুয়ালও বোধহয় বুঝে উঠতে পারেননি, শিশিরকুমার কেন স্টেজে গিয়েছিলেন— কী তাঁর সার্থকতা অধ্যাপনার মতো সমাজশ্রদ্ধিত বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে, সুসমঞ্জস সেটেল্ড জীবনকে উপেক্ষা করে, অত টাকার দেনা মাথায় নিয়ে শিশির ভাদুড়ি কেন যে থিয়েটার করেছিলেন, তা সেদিন অনেকেরই কাছে দুর্বোধ্য ঠেকত হয়ত। সেদিন একজন অধ্যাপকের পক্ষে নটবৃত্তি গ্রহণ করাটা কীরকম বিপ্লবসূচক ছিল তা হয়ত আজকে অনেকেই ভাবতে পারেন না। তাই বা বলি কেন? কোনও ব্রাইট ছেলে আজকে যদি বলে যে সে অন্য কিছু না করে শুধু থিয়েটার করবে, তাহলে তার শুভার্থী হিতাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে ক’জন তাকে সেই নিরাপত্তাহীন বিপজ্জনক পেশা নিতে উৎসাহ দেবে? আর সেদিন যখন বাংলা রঙ্গালয় শিশিরকুমারের আবির্ভাবের মর্যাদা পায়নি— যখনও ‘লোকে কয় অভিনয় কভু নিন্দনীয় নয়, নিন্দার ভাজন শুধু অভিনেতাগণ’— তখন জীবনের কোনও গভীরে ডাক থাকলে সমস্ত জীবনের রিস্ক নিয়ে সুন্দর স্বাস্থ্যবান, উজ্জ্বল যুবকটি স্টেজে এসে পৌঁছয়? সেই যুবকটি আজ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আর আজও তিনি বলেন, ‘Stage is the hell and we shall be merry devils there.’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *