বিদায় বন্ধু

বিদায় বন্ধু

প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা, দুঃখ বোধহয় শেষ পর্যন্ত কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। নিজেই বইতে হয়। সারাজীবনে এমন তো অনেকবারই মৃত্যুর শোক এসে বিহ্বল করে গেছে। তবু এখনকার বয়সে মৃত্যু যেন আরেকটা নতুন দুঃখ নিয়ে আসছে বারবার, তা হল সমসাময়িক সহকর্মী-বন্ধুবান্ধব হারানোর বেদনা। কিছুদিন আগে অনিল চলে গিয়েছে। দু-এক মাসের মধ্যে নির্মলদা, নীলিমাদিও চলে গেলেন। নির্মলদার মতো বন্ধুকে আকস্মিকভাবে হারানোর কষ্টটার সঙ্গে বোঝাপড়া করে ওঠার আগেই বিনা মেঘে বাজের মতো রবির মৃত্যুটা স্তম্ভিত করে দিল। একই সঙ্গে একই সেটে কাজ করছিলাম তপনদার টিভি সিরিয়ালের। মৃত্যু চোখের সামনে থেকে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। দুটো শটের মাঝখানে বিশ্রাম করছিলাম আমরা তিনজন— রবি, মনোজ আর আমি। অভিনয়, অভিনেতা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ইতিমধ্যে লাঞ্চব্রেক-এ খাওয়া সারা হল। আমাকে সেট-এ ডাকল। শট দিয়ে পরের শটে রবির জন্য অপেক্ষা করছি, কে যেন এসে বলল রবি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ফ্লোর থেকে ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে দেখি ওকে ধরাধরি করে গাড়িতে ওঠাচ্ছে। আমি মেকআপ রুম থেকে ওর চশমাটা নিয়ে তপনদার সঙ্গে গাড়িতে উঠলাম। ভাবছিলাম সুস্থ বোধ করলে চশমাটা চাইতে পারে। হাসপাতালে ডাক্তার যখন বললেন ‘ও নেই’ তখনও ওর চশমা আমার হাতে ধরা। রবির আর তখন চশমার দরকার নেই। মৃত্যু এসে এমনই আকস্মিকভাবে সাঁইত্রিশ বছরের বন্ধুত্বের ওপর এমন একটা পর্দা টেনে দিল যার ওপারে দৃষ্টি চলে না।

১৯৬১ সালে মানিকদার ‘অভিযান’ ছবির যখন প্রস্তুতি চলছে তখনই আমার রবির সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়। এবং আলাপের প্রথম দিন থেকেই বন্ধুত্ব শুরু হয়ে যায়। পরস্পরের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ দ্রুত হলেও এই ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। মানিকদার বসবার ঘরেই একদিন সকালে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ওর ব্যায়ামে মজবুত শরীর, অভিব্যক্তিময় মুখ এবং উজ্জ্বল চোখ আমার প্রথম থেকেই ভাল লেগেছিল। ওর কণ্ঠস্বরটাও ছিল চমৎকার।

বেলা বাড়ল যখন দুজনেই মানিকদার ঘর থেকে উঠে পড়লাম। নিচে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ গল্প করার পর মনে হল এখুনি এই আড্ডাটা থামানো ঠিক হবে না। অতএব একটা ট্যাক্সি নিয়ে চাংওয়া রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হলাম দুজনে। বিয়ার ও চিনা খাবার সহযোগে আড্ডা চলল বিকেল অবধি। দুজনেই যেন বুঝলাম সুর মিলে গেছে। অভিনয়ে নিবেদিতপ্রাণ, খোলা মন, প্রাণবন্ত মেজাজ। নিজেকে নিয়ে সদা বিব্রত থাকার বদলে জগৎসংসারের বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী এমন তরুণের সঙ্গে একদিনেই যে বন্ধুত্ব শুরু হয়ে যাবে এ আর অস্বাভাবিক কী? সেই বন্ধুত্ব চলে এসেছে এতগুলো বছর। নানা অর্থেই কাছাকাছি বেঁচেছিলাম এতগুলো বছর। কত ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি তার তো হিসেব করাই শক্ত। একসঙ্গে থিয়েটার করেছি, অভিনেতৃ সঙ্ঘের কাজ করেছি, পথেঘাটে আন্দোলন করেছি। আবার আড্ডায়, অনুষ্ঠানে বছরের পর বছর কেটে গেছে এতটাই কাছাকাছি যে নৈকট্যকে পেশার জগতের বন্ধুত্ব বললে নেহাতই খাটো করা হয়। শেষ দশটা বছর তো কাছাকাছি বাড়িতেই থেকেছি। সে বাড়িতে আসার উৎসাহও তো রবিই জুগিয়েছিল। বলেছিল ‘পুলু গলফ গ্রিনে চলে আয়, ভোরবেলা পাখির ডাক শুনতে পাবি।’ দুজনের বাড়ির হাঁটাপথ বড় জোর দু’মিনিটের দূরত্ব। বৃষ্টিতে কলকাতা ভাসছে— কিংবা বন্ধের দিনে ত্বরাহীন আড্ডায় কেটেছে রবি-বৈশাখীর সঙ্গে আমার ও দীপার। এই দীর্ঘ সময়ের নানা স্মৃতি এখন উদ্বেল করছে।

‘অভিযান’ ছবির শুটিং করতে বেশ কয়েকবার বীরভূমে যেতে হয়েছিল। প্রথমবার ছিলাম হেতমপুর রাজবাড়িতে। সবাই মিলে হইহই করে আনন্দে দিন কাটত। একটা বড় ঘরে লম্বা ঢালাও বিছানা করে আমাদের শোওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হত শুটিং-এর জন্য। কিন্তু কোনও ক্লান্তিই যেন হত না আমাদের। অনেক রাত্তির অবধি অক্লান্ত আড্ডা চলত— শেখরদা, জ্ঞানেশদা, সৌমেন্দু, পূর্ণেন্দু, ভানু ঘোষ, বংশীদা, দুর্গাদা, বিজয়দা, রবি সবাই মিলে মানিকদার সঙ্গে কাজ করার সব স্মৃতিই আমার কাছে উজ্জ্বল। কিন্তু ‘অভিযান’ তার মধ্যে আলাদা জায়গা নিয়ে আছে। তার একটা বড় কারণ এই ছবিটার ছোটবড় সবগুলি চরিত্রের অসাধারণ অভিনয়-ক্ষমতার প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। রবির সৃষ্টি সেই রামা (যে নরসিংহের গাড়ির ক্লিনার) বাংলা সিনেমার দর্শকরা কখনও ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। স্বয়ং মানিকদার একটা মন্তব্য মনে পড়ছে। একটা দৃশ্যের টেকিং-এর আগে আমরা ক্যামেরার ফ্লোরগ্রাউন্ডে রিহার্সাল দিচ্ছি— দূরে ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যাচ্ছে রবিকে। একটা কোলাপসিবল খেলনার সাপ নিয়ে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলার ছলে ভয় দেখাচ্ছে। রিহার্সাল চলছে আর রবিও মহা আনন্দে খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলোও প্রচুর মজা পাচ্ছে। মানিকদা ব্যাপারটা লক্ষ করে বলে উঠলেন, ‘আরে বাব্বা। এ তো

varitable scene slealer।’ সত্যিই তাই। কারণ গাড়ি দেখতে ভিড় করা বাচ্চাদের সঙ্গে ভয় দেখানোর খেলাটা ও এত স্বাভাবিক সুন্দর ভঙ্গিতে করছিল যে চোখ ওর দিকে চলে যাচ্ছিল।

বস্তুত অভিযান ছবিতে রবির অভিনয়ের একাধিক দৃশ্য আমার এখনও মনে আছে। থাকবে। যে দৃশ্যটির কথা সকলেই বলবেন আমিও সেই দৃশ্যটির কথাই বলছি। ছবিতে দেখার অনুভব একরকম আর নিজে সেই দৃশ্যে অভিনয় করার সময় সহ অভিনেতার অভিনয়ের যাথার্থ্য ও অনুভবের দ্বারা মুগ্ধ হওয়া আর একরকম অনুভূতি। ছবির শেষদিকে ব্যাকুল রামা যখন এসে বলছে, ‘গাড়িটা বেচে দেবেন সিংজি’ ইত্যাদি কথাগুলি। তখন রবির অসামান্য অভিব্যক্তি ও উচ্চারণভঙ্গি আজও আমি ভুলতে পারি না। একজন অভিনেতার জীবনবোধ কতটা গভীর হলে ওইভাবে সংলাপ বলা যায় তা নিশ্চয়ই রসজ্ঞ মানুষেরা বুঝেছেন।

অভিনয়-ক্ষমতার ফ্লেকসিবিলিটি ছিল বলেই ছোটবড় নানা ধরনের চরিত্রে রবি মনে রাখার মতো অভিনয় করেছে। ‘মণিহার’ ছবিতে রবি গানের অনুষ্ঠান করার ইম্প্রেসারিয়ো। এক তারকা-শিল্পীকে ধরার জন্য সেই অনুষ্ঠানের দালাল-মশাই দরজার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়েছিল সারারাত— দরজা খোলামাত্র গড়িয়ে পড়ল এবং তারপর অতুলনীয় অভিব্যক্তিতে জানাল সে তেমন একটা কিছু অস্বাভাবিক কাজ করেনি।

রবির অভিনয় অনেক ছবিতেই সম্পদ হয়ে আছে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে অসিত সেনের একটা ছবি ‘আগুন’-এর ছোট্ট একটা ভূমিকায় রবি অভিনয় করেছিল, যে অভিনয় আমার অসামান্য বলতে দ্বিধা নেই। সেই ছবিতে আমার ও আমার স্ত্রীর (কণিকা মজুমদার) পরিচিত প্রবাসী বাঙালির চরিত্র ছিল সেটি। লোকটি পেশায় উকিল। কালো কোট পরে এসেছেন। চা খেতে গিয়ে গায়ে পড়ে যাওয়াতেই বোধ করি তাঁকে শার্টটা কেচে দেওয়ার জন্য খুলে দিতে জোরাজুরি করা হচ্ছিল। উকিল কিছুতেই কোট খুলবে না। তবু জোর করে কোট খোলার পর দেখা গেল তার নিচে শার্টটা শতচ্ছিন্ন। এই দৃশ্যকে মুহূর্তের মধ্যেই রবি পরিহাস- উচ্ছলতা থেকে একটা ভেঙে-পড়া মানুষের বেদনার মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। খুব বড় অভিনেতা না হলে বড় কমেডিয়ান হওয়া যায় না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বাংলা ছবিতে কমেডি অভিনয়ে যত বড় বড় অভিনেতা দেখেছি অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় অভিনেতা দেখা গেছে কিনা সন্দেহ। ফণী রায় আশুবাবুদের সময় থেকে শুরু করে ক্ষণজন্মা তুলসী চক্রবর্তী এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর রায়ের মতো অসামান্য অভিনেতাদের মধ্যে দিয়ে বাংলা ছবিতে কমেডি অভিনয়ের একটা উঁচু মান প্রবাহিত হয়ে এসেছে। রবি এই মহান ঐতিহ্যের শেষ প্রতিনিধি বলে আমি মনে করি। পূর্বসূরিদের মতোই তার অভিনয়েও গভীর ও তীব্র জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। বাঘিনী ছবিতে একটি দুষ্টপ্রকৃতির নিষ্ঠুর লোভী নারীলোলুপের যে চরিত্রচিত্রণ রবি করেছিল তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে জীবনের ও মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা রবি যেভাবে কাজে লাগিয়েছে তার জন্যে।

প্রার্থপ্রতিম চৌধুরীর ছায়াসূর্য ছবির দুটো দৃশ্য মনে পড়ছে। একটা সিগারেটের টিন থেকে সিগারেট নেবে রবি, সেখানে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দ্রুত তিন-চারটে সিগারেট নিয়ে নিল। দক্ষ কৌতুক অভিনেতার প্রাথমিক দায়িত্ব ওই সিগারেট নেওয়ার সময় রবি যেমন পালন করেছিল— অর্থাৎ দর্শককে প্রভূত হাসিয়েছিল, সেই সঙ্গে আঙুলের ক্ষিপ্রতায় চোখমুখের ভঙ্গিতে নিম্নমধ্যবিত্তের লোভের সত্য চেহারাটাও রবি বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল। ওই ছবিরই শেষে স্টেশন মাস্টার জ্ঞানেশদা যখন লেখক নির্মলকুমারকে জানিয়ে দিচ্ছে রবি বদ্ধকালা তখন সেটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে নিভে যাওয়া ভাবমূর্তি— ভেঙে যাওয়া মানুষের মুখ নিয়ে রবি কলম ফেরত দিয়েছিল সেই অভিব্যক্তি ও সংলাপ বলাও ভোলা যায় না।

‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে রবি আমার বন্ধু, পাড়ার রকে বসে ক্রমাগত আড্ডা দেওয়া ছেলে। সেখানেও তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার থেকেই যেন সে চরিত্রটাতে প্রাণসঞ্চার করেছিল।

অনেক ছবিতেই এমন সব চরিত্রে এমন সব দুর্বলভাবে লিখিত চিত্রনাট্যের আশ্রয়ে— আমাদের কাজ করতে হয় যেখানে সৃষ্টিমূলক কোনও কাজ করা অসম্ভব। তখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় একটা যান্ত্রিক পরিশ্রম। অভিনেতা হিসেবে রবিকেও এমন কাজ তো করতেই হয়েছে। বহু পরিচালকই তার দক্ষতা সঠিক ব্যবহার করতে পারেননি। কিন্তু ভাল চিত্রনাট্য ও দক্ষ পরিচালক থাকলে রবি ঘোষ একা কতদূর কী করতে পারে তার প্রমাণ দেখা গিয়েছে তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে।

তবে রবির অভিনয়-ক্ষমতার সর্বোত্তম প্রকাশ নিশ্চয় ঘটেছে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেই একথা প্রায় নির্দ্বিধায় বলা যায়। মানিকদার ছবিতে যখন যেখানে যতটুকু সুযোগ সে পেয়েছে তা সে কাজে লাগিয়েছে। এবং তাই সে সব ছবি থেকে সাফল্যও পেয়েছে প্রভূত পরিমাণে। ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে রবির কাজের ভূয়সী প্রশংসা হয়েছিল। ‘জনঅরণ্য’ ছবিটা সত্যজিৎ রায়ের এমন একটা ছবি যা দেখলে মুখটা যেন বিস্বাদ হয়ে যায়। ‘শাখাপ্রশাখা’ ছাড়া আর কোথাওই বোধহয় সত্যজিৎ সমসাময়িক মানুষের সম্পর্কে এমন তিক্ত মন্তব্য রাখেননি। দালালের লোভের সামনে ইট, কাঠ, পোশাক-আশাকের মতো নারীও যে ভোগ্যপণ্য এই রূঢ় বাস্তব উন্মোচিত হয়েছিল জনঅরণ্যে। এবং সেখানে রবির অভিনয় এত উচ্চাঙ্গের না হলে হয়ত ছবিটা মনকে অত ধাক্কাই দিতে পারত না। মানিকদার শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ ছবিতে রবির অভিনয় চরিত্রটাকে প্রায় এক শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিস্থানীয় করে তুলেছে। একজন অভিনেতার ভূমিকায় তার কথা বলার ভঙ্গি দিয়ে শুধুমাত্র হাস্যরসই পরিবেশন করা হয়নি— মধ্যবিত্ত বাঙালির সন্দেহপ্রবণ অবিশ্বাসীর অভিব্যক্তিতেও রবি চমৎকার।

মনে পড়ে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র ‘ক’ কে ‘খ’-এর মতো উচ্চারণে ‘সো খাইন্ড অফ ইউ’ বলা। ওটা পরিচালকের নির্দেশই ছিল, কিন্তু ওরকম নির্ভুল সুন্দরভাবে কাজটা করার কৃতিত্ব তো অভিনেতাকেই দিতে হবে। আর সেই দাড়ি কামানো হবে কি হবে না এই প্রশ্নে কালাতিপাত করার দৃশ্যটিও মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। চারজন নব্য যুবকের মন কী শূন্যতায় ভেসে আছে যে দাড়ি কামানো হবে কি হবে না এই প্রশ্নে অতখানি সময় ব্যয় হচ্ছে।

এই অসামান্য দৃশ্যের নির্মাণ মানিকদার পক্ষেই সম্ভব ছিল এবং গম্ভীরমুখে সেই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করার মধ্যে দিয়ে রবি সেই নির্মাণে সহযোগী হয়েছিল।

১৯৬২-তে ‘অভিযান’ করার পর আবার মানিকদার ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে। পালামৌ-এর বেতলা জঙ্গলে অনেকদিন শুটিং হয়েছিল। বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছিল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে চিপাদার বলে একটা গ্রামে কয়েকটা ছোটখাটো বাড়িতে ছড়িয়েছিটিয়ে আমরা থাকতাম। রবি, শুভেন্দু ও সমিত একটা সুন্দর বাংলোয় ছিল। সারাদিনে শুটিং-এর পরিশ্রম যেন গায়েই লাগত না। এত সবাই মিলে আনন্দ করে হইহই করে দিন কাটত। রাত্তিরে ভুঁইহার আদিবাসীদের মাদল শুনে আমরা চলে যেতাম তাদের গ্রামে, শর্মিলাও সঙ্গী হত। আদিবাসীদের নাচের মধ্যে আমরা মিলে যেতাম। বলাই বাহুল্য, রবির প্রাণবন্ত রসিক উপস্থিতি সেখানেও আমাদের আনন্দের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিত।

শুধু এইরকম পরিবেশেই নয়, রবি জীবনের বেশিরভাগ অবস্থাতেই জীবনকে উপভোগ করতে পারত। অভিনেতা যদি জীবন থেকে রস না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তার কৃতকার্য রসহীন হয়ে যেতে পারে। রবির তেমন ঘটেনি। সেইজন্যেই জীবন-রসিক রবি তার নিজের অভিজ্ঞতার থেকে বাঙালি জীবনের একটা ছবি তার অভিনয়ের মধ্যে গড়ে দিতে পেরেছিল। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের মৌলিক ও প্রাথমিক অভিজ্ঞতাগুলো রবি নিজের পায়ে মাড়িয়ে এসেছিল। দারিদ্র্য ও জীবনসংগ্রামের সত্যিকারের বাস্তব চেহারাটা সে জানত। সেই অভিজ্ঞতাই সে অভিনেতা হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল।

রবির অভিনয়ে কাজে লেগেছিল ওর শারীরিক সক্ষমতাজনিত ক্ষিপ্রতা ও লাবণ্য। অনেকে হয়ত মনে করেন শারীরিক সৌন্দর্য বা লাবণ্য বুঝি নায়ক- নায়িকার চরিত্রের অভিনেতৃবর্গেরই দরকার হয়— কৌতুক অভিনেতার ক্ষেত্রে এর আবার প্রয়োজন কী? কিন্তু আমার চিরকালই মনে হয় কমেডিয়ানরাই অনেক বেশি গ্রেসফুল। তাদের শারীরিক ক্রিয়াকাণ্ডে যে লাবণ্য প্রকাশ পায় তা অনেক সময়ই অন্য ধরনের অভিনেতাদের থাকে না। চার্লস চ্যাপলিন তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আমাদের বাংলা ছবিতেও তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় প্রমুখ কমেডিয়ানের শরীর এতখানি ফ্লেকসিবল ছিল বলেই না তাঁরা সমস্ত শরীরটাকে দিয়ে অভিনয় করাতে জানতেন। অমন ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং কজন অভিনেতা পারে? তাঁদের প্রকাশশৈলীটা পরিহাসতারল্যে সঞ্চারমান বলে লোকে অনেক সময়ই সচেতন হয়ে খেয়াল করে না তাঁদের শারীরিক পটুতা ও সৌন্দর্যের দিকটা। রবি তার পূর্বসূরিদের মতোই এ ব্যাপারে শারীরিকভাবে দক্ষ ছিল। বরং সত্যি বলতে কী, সে তাঁদের থেকে আরও সচেতনভাবে শরীরকে অভিনয়ের কাজে নিয়োগ করেছে। অভিনয়ের সময় তার হাঁটাচলা, হাতের ব্যবহার ভারী সুন্দর ছিল। তরুণ বয়সে রবি নিজের উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী গ্রুপে ভাল ওয়েট লিফটার ছিল। কিন্তু সেই স্পোর্ট পরে ওকে ছেড়ে দিতে হয়, কেননা চালিয়ে যেতে হলে যে ধরনের ব্যয়সাপেক্ষ খাওয়াদাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচ তা মধ্যবিত্ত পরিবারে সম্ভব হয়নি, ওয়েট লিফটিং ছেড়ে দিলেও তার সুফল অনেকটাই রয়ে গিয়েছিল ওর সুগঠিত স্বাস্থ্যের মধ্যে এবং সেই সম্পদ রক্ষার জন্যে ও আজীবন শরীরচর্চা করে গেছে এবং সেই সম্পদই ওর অভিনয়ের মধ্যে কাজে লাগিয়েছে।

একটা উদাহরণ মনে পড়ছে, সাধারণ রঙ্গালয়ের একটা নাটকে (ঘটক বিদায়) রবি আমার পরিচালনায় অভিনয় করেছিল। তাতে একটি দৃশ্যে নাটকের প্রধান মহিলা চরিত্র হঠাৎই ঘরে ঢুকে পড়ে ও রবিকে দেখতে পেয়ে যায়। রবি এই আকস্মিক প্রবেশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রথমে পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে অতি ধীরে ধীরে বসে পড়ে এবং তারপর অতি ধীরে হামাগুড়ি দিতে দিতে সমস্ত মঞ্চটা অতিক্রম করে ঘরের পেছনে রাখা আলমারিতে লুকিয়ে পড়ে। ভাবখানা এই যে অত ধীরে হামাগুড়ি দিলে আর যেন তাকে দেখা যাবে না। পাঁচশো রাত্রি ওই দৃশ্যে রবির ওই অভিনয় দেখে দর্শক হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ত। পাঁচশো রাত্রি রবি ঠিক একইভাবে ব্যাপারটা করত। আমি প্রায়ই উইংসের ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে ব্যাপারটা দেখতাম। কারণ অভিনয়ের ছাত্র হিসেবে আমি বুঝি ওটা করার জন্যে অভিনেতার নিজস্ব যে ছন্দবোধ তা কতখানি নির্ভর করে তার শারীরিক সক্ষমতার ওপর, পায়ের পেশির কতটা জোর থাকলে ওরকম আস্তে আস্তে বসা যায়— শরীরের কতখানি নিয়ন্ত্রণ থাকলে ওভাবে হামাগুড়ি দেওয়া যায়।

ওই শারীরিক দক্ষতার সঙ্গেই মিলেছিল রবির নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগাবার ক্ষমতা। বাবার বকুনি ও সংসারের প্রয়োজন এই দুয়ের চাপে অভিনয়-পাগল রবি চাকরি করতে ঢুকেছিল। চাকরি করত কোর্টে। যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই জানেন কোর্ট আর হাসপাতাল হচ্ছে মানবচরিত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সবচেয়ে ভাল জায়গা। মানুষের সুখ-দুঃখ, লোভ-লালসা, শোক-বঞ্চনার নানা গল্প এই দুই জায়গায় ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ। রবি চাকরি করতে গিয়ে মানুষকে দেখার সেই সুযোগ মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল। মানুষকে দেখা অভিনয়ের ক্ষেত্রে এতটাই জরুরি যে তা বিস্তৃত ব্যাখ্যার দরকার করে না। মানুষকে দেখার ক্ষুধা তার মধ্যে ছোটবেলা থাকেই ছিল। থিয়েটারের প্রথম দিনগুলো থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ছবিতে কাজ করার দিন অবধি রবি ঘোষ কখনও নিজের অভিজ্ঞতা অর্জনের ইচ্ছে ত্যাগ করেনি। ওর কাছে ওর নিজের জীবনের অনেক গল্প শুনেছি, তার থেকেই এই ধারণা আমার হয়েছে।

নিজের ছেলেবেলা বা যৌবনের চাকরি করার সময় নিয়ে যে সব গল্প সে করত তার মধ্যে অনেকগুলোই শুনতে শুনতে হেসে লুটিয়ে পড়তে হত। একটা এক্ষুনি মনে পড়ছে। স্কুলের বন্ধু ছিল সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। শহর ইংরেজ আমেরিকান গোরা মিলিটারিতে থইথই করছে। একদিন বিকেলে রবি ও সত্য হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছে চৌরঙ্গিতে। জাদুঘরের সামনের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে এমন সময় উল্টোদিক থেকে দুজন গোরা পল্টনের আগমন। ওদের সামনে থেমে গিয়ে তারা দুর্বোধ্য ককনিতে কী যেন জিজ্ঞাসা করল। দুজন স্কুল- ছাত্রেরই ইংরেজির দৌড় খুব বেশি ছিল না। ফলে প্রথমটায় বুঝতেই পারছিল না সাহেবরা কী জানতে চাইছে। সত্যর পড়াশোনায় ভাল বলে একটা সুনাম ছিল। দু-একবার ‘beg your parden’ বলে সাহেবদের প্রশ্নটা দু-একবার শুনল। শুনে বোঝা গেল ওরা জানতে চাইছে zoogarden-টা কোনদিকে, কীভাবে যেতে হয়। সত্য বলতে শুরু করল ‘zoogarden…?’… তারপর যখন বুঝল পুরো পথনির্দেশ দেওয়ার মতো ইংরেজি তার আয়ত্তে নেই, তখন হাতটা তুলে ধর্মতলার দিকে দেখিয়ে সেই উঁচানো হাত ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে অর্থাৎ আলিপুরের দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে লম্বা করে টেনে একটা ইংরেজি শব্দ শুধু বলল ‘G-o-o-o-o-‘।

এই গল্পটা বলার সময় রবির অনবদ্য ভঙ্গির চেয়েও যেটা বেশি অবাক করেছিল সেটা ওর অবজারভেশনের ক্ষমতা। গল্পটা বর্ণনা করার সময় যুদ্ধকালীন কলকাতা ও গোরা সৈনিক যেন চোখের ওপর ভেসে উঠছিল। গল্পটার মধ্যে যথাযথ ঘটনার বর্ণনা ও ব্যাপারটার হাস্যকরতা দুটোই অভিনেতা রবি ঘোষ মনে রেখেছিল। এইখানেই ওর উৎকর্ষ এবং প্রকাশভঙ্গি যে কোনও বড় অভিনেতারই উৎকর্ষ। তাঁরা জীবনের সর্বত্র যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তা-ই নিজেদের কাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এ না পারলে কিছুই পারা হল না। শুধু হাসির জায়গায় হাসা কি কাঁদার দৃশ্যে কাঁদতে পারাটা অভিনেতার অত্যন্ত প্রাথমিক প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে। তাই দিয়ে অভিনেতার উৎকর্ষ বিচার করা চলে না। বিচিত্র আচার-আচরণ নিয়ে বিচিত্র মানবমন, মানুষের বিবিধ চরিত্র মানুষের বিভিন্ন অবস্থানের ছবি দর্শকের কাছে তৈরি করতে পারাটাই সত্যিকারের ভাল অভিনেতা- অভিনেত্রীর কাজ। রবি ঘোষ সেইখানেই বড় অভিনেতা।

অভিনেতার কাজের একটা বড় বাধা, অভিনেতার কলাকৌশল আয়ত্ত করার কোনও প্রথাগত রাস্তা নেই। চিত্রকরের ড্রইংয়ের গ্রামার বা গায়কের স্বরলিপির নিশ্চিত সুরবিন্যাস তার নেই। জীবন থেকেই বেশিটা শিখতে হয় এই অনুকারী শিল্পীকে। আর খানিকটা হয়ত শেখার হদিশ পাওয়া যায় অগ্রজ গুণীদের কাজ দেখে বা শিক্ষাগুরুর নির্দেশ থেকে। তবু একথা বলা যায় অভিনয় শেষ পর্যন্ত কাউকে শেখানো যায় না। যে পারে সে আপনি পারে— সে ক্রমাগতই শিখতে থাকে। অনেকে উৎপল দত্তর শিক্ষাই যে রবির পক্ষে অভিনেতা হতে সাহায্য করেছিল এমন কথা বলেন। আমার এটা সর্বাংশে সত্য বলে মনে হয় না। লিটল থিয়েটার গ্রুপের সংসর্গে রবি ঐশ্বর্যবান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর সেখান থেকে অভিনয়কে উন্নততর করার শিক্ষার কৃতিত্বটা একেবারেই নিজস্ব। রবির সিনেমার অভিনয় দেখার আগেই আমি ওর অঙ্গারের অভিনয় দেখেছিলাম। সে অভিনয় কিন্তু লিটল থিয়েটার গ্রুপের কারোরই মতো ছিল না— এবং সত্যি কথা বলতে উৎপল দত্ত পরিচালিত নাটকে অংশগ্রহণকরী বাকি সব অভিনেতার থেকেই সে বিশিষ্ট ও উৎকৃষ্ট ছিল। বরং বলতে পারি সে অভিনয়ের মধ্যে আমি শিশিরকুমার, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী এঁদের একটা ছায়া দেখেছিলাম। রবির সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর জেনেছিলাম ও অল্পবয়েস থেকেই ওই সব মহান অভিনেতার অনুরাগী ছিল।

শুনেছি কৌতুকাভিনেতা হতে উৎপল দত্তই ওকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। রবি যদি উৎপল দত্তের মতো সিরিয়াস নাট্য-পরিচালক হওয়ার কথা ভাবত তাহলে হয়ত ওর কাছ থেকে থিয়েটার আরও অনেক কিছু পেত। নাটক পরিচালনা ও করেনি তা নয়। ওর পরিচালিত ‘শ্রীমতী ভয়ংকরী’ নাটকের থিমসঙ হিসেবে একটা গানের দরকার ছিল। একদিন নিউ থিয়েটার্স-এ দুজনে দুটো ছবিতে শুটিং করছি, ও এসে বলল ওই থিমসঙটা লিখে দিতে হবে। যে মেকআপ রুম থেকে ও শেষবারের মতো মৃত্যুপথযাত্রায় চলে গেল সেই ঘরে বসেই শুটিং-এর ফাঁকে-ফাঁকে রবির জন্য থিমসঙ লিখে দিয়েছিলাম।

রবি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছে। তার প্রথমটা ছিল ‘নিধিরাম সর্দার’। তাতে উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটির জন্যে তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে কষ্টকর একটি মেকআপ নিতে হত। রবি সেই মেকআপের বিষয় আলোচনা করত, আর স্টিল এনে দেখাত। রবির দ্বিতীয় ছবিটা খুব উপভোগ্য হয়েছিল— ‘সাধু-যুধিষ্ঠিরের কড়চা’। রবি ছাড়াও চিন্ময় ও জয়া ওই ছবিতে দারুণ ভাল অভিনয় করেছিল। আর ছোট্ট একটা ভূমিকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছিল তপেন চট্টোপাধ্যায়। মানিকদার ছবি ছাড়া তপেনের এত ভাল অভিনয়, অন্য কোনও ছবিতে দেখিনি। তপেনের কাছ থেকে সে কাজটা আদায় করে নেওয়ার সচেতন যত্ন যে রবি করেছিল তা আমি জানি।

স্মৃতিচারণ করতে গেলে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কথা তো ভিড় করে আসতে চায়। মনে পড়ছে অভিন্ন ও বিচক্ষণ বন্ধুর একদিনের পরামর্শ। ঘটনাটা ঘটেছিল আশির দশকের গোড়ায়। এক পরিচালক বন্ধুর ছবিতে রবি আমি দুজনেই কাজ করছি। কিন্তু সে ছবি যা হচ্ছিল তা সেলুলয়েডে নিম্নস্তরের যাত্রা ছাড়া কিছু নয়। কাজের ব্যাপারে পরিচালকের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝেই মতান্তর হচ্ছিল। ফলে আমি বিরক্ত হয়ে মেজাজ খারাপ করে ফেলেছিলাম। একটা শটের আগে দুজনে ক্যামেরার জোনের বাইরে অপেক্ষা করছি, প্রবেশ সঙ্কেতের জন্যে, অন্য কেউ না শোনে এমন গলায় রবি আমাকে বলল, ‘শোন, তুই অকারণে রাগ করছিস। যে পুজোর যে বাদ্যি। তুই তো জানিস কী ছবি হচ্ছে। কাজ করতে হচ্ছে করে যা। কাজ শেষ হলে বাড়ি গিয়ে নিজের নাটকের কাজ নিয়ে ভাবিস।’ কথাগুলো আমারও জানা। কিন্তু ওর আন্তরিকভাবে বলাটা সেদিন মনটাকে ঠান্ডা করতে কাজে লেগেছিল।

কমলকুমার মজুমদার রবিকে খুব পছন্দ করতেন, রবির সম্পর্কে প্রশংসা লিখে গেছেন। একসময়ে কমলকুমার রবি আর আমাকে নিয়ে একটা আলাদা নাটকের দল গড়তে চেয়েছিলেন। সে সময় অনেক আলোচনা হত, বিস্তর পরামর্শ দিতেন, ফুটওয়ার্ক তৈরির জন্যে একটা থালার মাপের বৃত্তে কুচিপুড়ি নৃত্যের মতো করে কী করে ঘুরতে হয় আমাদের দুজনকে তার রিহার্সালও দিইয়েছিলেন। কিন্তু পরে শেষ পর্যন্ত সেই নাটকের দল আর হয়নি। রবির ও আমার দুজনেরই ব্যস্ততা এত বেশি ছিল। কমলকুমার বলেছিলেন, ‘তোমরা যে প্রকার মুজরো খাটছ তাতে আর এসব করবে কী করে?’ আমার মনে হচ্ছে কমলকুমারের পরামর্শেই রবি ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়তে শুরু করেছিল। তার ব্যক্তিগত জীবনের শোকে-দুঃখে কথামৃত শান্তির উৎস হয়ে থাকতে পারে। কথামৃত থেকে অনেক সময়েই রবিকে উদ্ধৃতি দিতে, ব্যাখ্যা করতে শুনেছি।

রবির সঙ্গে এই দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্বের সবটাই যে একই মেজাজে একই সুরে বাঁধা ছিল এমন তো জীবনে হয় না, ওঠা-পড়াও ছিল বইকি। কিন্তু বন্ধুত্বের মূল বাঁধনটা কোনওদিনই আলগা হয়ে যায়নি। ফিল্ম, থিয়েটার, ওয়ানওয়াল যেখানেই দুজনে একসঙ্গে কাজ করেছি সেখানেই একটা হার্দিক সহযোগিতা ছিল। পরস্পরের কাজের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল। কত ছবির প্রযোজক-পরিচালককে কোনও ভূমিকা শুনে বলেছে— ‘এ-পার্ট সৌমিত্রর— ওকে নিন।’

আমাদের এই আঞ্চলিক সিনেমা ও থিয়েটার পরিধিটা খুব বিশাল নয়। সেখানে এত দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজের মধ্যে দিয়ে যে বন্ধুত্বটা গড়ে ওঠে তা প্রায় পারিবারিক সম্পর্কের পর্যায়ে চলে যায়। পরস্পরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে যাই আমরা, ভাইবোন নিকট আত্মীয়ের মতোই একটা অচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়। বৈশাখীর সঙ্গে রবির বিয়ের সাক্ষী ছিলাম আমি। আমার মেয়ে পৌলমীর আরেঙ্গেত্রমে (প্রথম জনসমক্ষে নৃত্য পরিবেশন) রবি এসেছিল ফুল নিয়ে। এমন অজস্র স্মৃতি মুখর হয়ে উঠছে এখন।

রবির মৃত্যুর দু সপ্তাহ আগে ফ্রান্স থেকে ক্যাথরিন বার্জ নাম্নী এক মহিলা এসেছিলেন আমার ওপর একটা ছবি করতে। ইসমাইল মার্চেন্ট ও জেমস আইভরি তার প্রযোজক। পরিচালিকা সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত— তাঁর সব ছবিই দেখেছেন। স্বভাবতই রবির কাজেরও তিনি অনুরাগী। তাঁর ছবিতে সৌমিত্রর জীবনকথা বলার জন্যে তিনি একটা দিশি প্রকরণ ব্যবহার করেছেন। মেদিনীপুর, বীরভূম ইত্যাদি অঞ্চলে যেমন গ্রাম্য পটুয়ারা যমপট উন্মোচন করতে করতে পুরাণ কাহিনীর গান গেয়ে বর্ণনা করে রবি সেইরকম একটা পটুয়ার ভূমিকা নেবে। রবি সানন্দে কাজটা করেছিল। কিং লিয়ারের অভিনয় করছি এমন একটা দৃশ্যখণ্ডও সেখানে আছে— সেখানেও লিয়রের ‘ফুল’-এর অভিনয়টা করল রবি। শুটিং হয়ে গেল। সবই রইল, রবি নেই। আমার জীবনকথা বলে যমপটের পটুয়া চলে গেল।

রবির এই মৃত্যু এতই আকস্মিক ও অভাবিত যে এখনও তা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এই শোকাহত, স্তম্ভিত অবস্থাতে মনে পড়ে মার্ক টোয়েনের একটা কথা— ‘সেই মানুষই সত্যিকারের ভাগ্যবান যে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোটের চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত।’ মানুষের জীবনে টাকার তো প্রয়োজন আছেই, কিন্তু যে-মানুষের উপস্থিতি কাম্য টাকার কথা ভুলিয়ে দিতে পারে— যার দিকে চেয়ে প্রসন্ন চোখে বলতে হচ্ছে করে ‘আরে দ্যাখো দ্যাখো কে এসেছে’— রবি ছিল সেই বিরল জাতের মানুষ। সে সৌভাগ্যবান, কেননা তার জন্যে অভ্যর্থনা সব সময়ে সব জায়গায়।

কিন্তু এ ভাবনা তো ব্যক্তিগত বন্ধুর বিয়োগে আক্রান্ত। বিষাদ, যা কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। কিন্তু একটা জায়গা আছে যেখানে আমার অনুভবের অংশীদার আছে। শিল্পী রবি ঘোষের কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় তাকে হারানোর ক্ষতির চেয়ে ঢের বড় প্রাপ্তি। এ প্রাপ্তি আমার একার নয়। সমস্ত বাঙালির। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবি তৈরি হওয়ার সময় থেকে এমন একটা ভাবমূর্তি তার তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, বাঙালির সিনেমা যতদিন থাকবে তার সিনেমা তথা শিল্পকলা, সংস্কৃতি নিয়ে চৈতন্য যতদিন থাকবে ততদিন রবি ঘোষের দান তাদের মনে রাখতে হবে। আমরা যারা সেই সময় থেকে ছবিটা দেখে আসছি তারাই যে শুধু মনে রাখব এমন নয়। এমন প্রজন্ম এখনই আছে যাদের সিনেমা দেখা শুরুই হয়েছে শিশু হিসেবে গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখে। সমস্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঙালি শিশুরও তাই হবে। বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে ওই ছবি যেমন হয়ে আছে ‘আবোল তাবোল’ কি ‘ঠাকুমার ঝুলি’। বহমান বাঙালি জীবনের সেই আনন্দ আস্বাদনের শরিক হয়ে যখন রবির কথা ভাবি তখন ব্যক্তিগত শোকের ছায়া মিলিয়ে যায়। সেখানে রবি ঘোষ মৃত্যুত্তীর্ণ।

‘বিদায় বন্ধু’ লেখাটি রবি ঘোষের প্রয়াণ (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭) ঘটার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘আজকাল’-এর রবিবাসর-এর প্রধান লেখা হিসেবে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল। রবি ঘোষ স্মারক সঙ্কলন (রবি ঘোষ স্মৃতি সংসদ কর্তৃক ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮-তে প্রকাশিত) থেকে নেওয়া এই লেখাটি সৌমিত্র আদি রচনার পর পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *