ভানু-জহরও উত্তম-সুচিত্রার মতোই অপরিহার্য ছিলেন
বাংলা সিনেমার কমেডিয়ানদের আমি ভীষণ ভক্ত। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার দৃষ্টি আনত হয়ে যায়। আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে এঁদের কনট্রিবিউশন যে কত— তার কোনও মূল্যায়ন হয়েছে কি? অন্য দেশে হলে তাঁরা অনেক বেশি করে সম্মানিত হতেন। মর্মান্তিক হলেও সত্য, দর্শকদের মন ছাড়া এঁরা আর কিছুই জীবনে পাননি। আমি মনে করি, আমাদের দেশের কমেডিয়ানরা ‘ওনলি গ্রেসফুল আর্টিস্টস’। এঁদের বেশিরভাগই লাবণ্যময়, শোভাময়— অভিনয়টা ছিল সমস্ত শরীর, মন জুড়ে।
প্রথমে যাঁর কথা মনে পড়ছে, তিনি আশু রায়। হাইলি ট্যালেন্টেড অভিনেতা। ভাল ক্যারেক্টারাইজেশন করতে পারতেন। পরের দিকে এলেন তুলসী লাহিড়ী, নবদ্বীপ হালদার। এঁরা একেকজন চরিত্রাভিনেতা, কৌতুক অভিনেতাও। নবদ্বীপ হালদার খুবই বিশিষ্ট একজন কমেডিয়ান। সঙ্গীতের ওপর ওঁর ছিল অসম্ভব দখল। বেশ কিছু গানও লিখেছেন। দু-একটা মনে পড়ে এখনও। যেমন— ‘আর খেতে পারিনা ফ্যাস্তা-ফ্যাচাং চচ্চড়ি, আলুভাতে বেগুনপোড়া পুঁই ডাঁটা চচ্চড়ি’ সেকালে খুব জনপ্রিয় ছিল। আমি বুঝতে পারি না এই সব গান তখন কীভাবে রেকর্ড করেছিলেন উনি। এই গানে একটা কোরাস ছিল। আজ ভাবি কী করে এই সব সম্ভব হল? উনি বিভিন্ন গলায় গাইতে পারতেন। সম্ভবত কোরাসটা নিজেই করেছিলেন। ছবিতে আমরা যে গলা শুনি তা আসলে ওঁর নিজের গলা নয়। ভয়েস নানাভাবে কন্ট্রোল করতে পারতেন তিনি।
আমি মনে করি, আমাদের গ্রেটেস্ট এভার কমেডিয়ান হলেন তুলসী চক্রবর্তী। তার পরের যুগে এলেন অজিত চট্টোপাধ্যায়। ফরমিডেবিল কমেডিয়ান।
বিশেষ করে জলসা বা বিচিত্রানুষ্ঠানে কমিক স্কেচ পরিবেশন করায় খুবই দক্ষ ছিলেন। একবার একটা জলসায় তাঁর কৌতূক নক্সার পরের শিল্পী ছিলেন দুই দিকপাল গায়ক— পঙ্কজ মল্লিক ও শচীন দেব বর্মণ। তখনকার বিচিত্রানুষ্ঠানের প্রথা অনুযায়ী সেই দুই মহাশিল্পী আগে থেকেই এসে দর্শকাসনে বসে আছেন। অজিতদা মঞ্চে উঠে তাঁদের সামনেই তাদের নিয়ে একটা নক্সা তৈরি করলেন। সে নক্সার বিষয় বস্তু হ’ল-রেডিওর প্রোগ্রাম-বাহক ‘বেতার জগত’-এ যেন ভুল ক্রমে ছাপা হয়ে গেছে পঙ্কজ গাইবেন পল্লীগিতি আর শচীনদেব গাইবেন রবীন্দ্র সংগীত। এর প্রতিবিধান করা যাবে না, অতএব এই দুই মহাশিল্পী দুজনে দুজনের কাছে পরস্পরের বিশিষ্ট গীতধারা শিখতে লাগলেন। দুজনের ম্যানারিজম ইত্যাদি অনুকরণ করে অজিতদা অনবদ্য এই হাস্য কৌতূকের সৃষ্টি করেছিলেন। এই অজিত চট্টোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভানু-জহর কৌতূক নক্সায় মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন। জহুরি জহর চিনতেন। অজিতবাবুও চিনেছিলেন এই দুই অসাধারণ গুণসম্পন্ন কমেডিয়ানকে। উনিই ওঁদের ফোরফ্রন্টে আনেন। তাই, পরে দেখেছি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়ও অসংখ্য ছোট ছোট কমেডিয়ানকে আবিষ্কার করেছেন। একটু অভিনয়-ক্ষমতা, দক্ষতা থাকলেই তাঁরা তাদের সুযোগ করে দিতেন।
ভানু-জহর ব্যক্তিজীবনেও ওঁরা এমনই কৌতুকপ্রিয় সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। ওঁদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও পরিচালক, শিল্পী বা দর্শক অভিনয়ে একঘেয়েমির অভিযোগ আনেননি। একটা বিশুদ্ধ হাসির বাতাস নিয়ে তাঁরা যেন মানুষের মনে ঢুকে পড়তেন। অভিনয় তখন আর অভিনয় থাকত না। মনে হত পর্দায় নয়, সামনেই দুই মূর্তিমান হাজির। ওঁদের সবথেকে বড় সম্পদ ছিল রসবোধ। নাহলে ওঁরা কী করে মানুষকে দশকের পর দশক অমনভাবে হাস্যরসে নিমজ্জ রাখতে পেরেছিলেন ওঁদের জীবনবোধের গভীরতা সরস কৌতূকের উজ্জ্বল তরঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। সেখানে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, তাপিত, তাড়িত, ব্যস্ত বাঙালি জীবনের ছবিটা ফুটে উঠত। বাংলা ছবির কমেডিয়ানদের উত্তরাধিকার তুলসী চক্রবর্তী, ভানু-জহর হয়ে রবি ঘোষেই বোধহয় শেষ হয়েছে।
অনেকেই জানেন না, ভানু ও জহর উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। হলিউডের ছবি এঁরা নিয়মিত দেখতেন, ক্লাউনদের অভিনয় ছিল নখদর্পণে। এঁরা অভিনয়-ক্ষেত্রে বিদেশি রীতি-শৈলীর অনেকটাই অনুসরণ করেছিলেন।
বাংলা ছবির শ্রষ্ঠ কমেডিয়ান তুলসী চক্রবর্তী ওঁর জীবনই ওঁকে শিল্পী করে তুলেছিল। তুলসীবাবুর বাবা কাজ করতেন রেলে। যখন ওঁর বয়স তিন, তখন ওঁর বাবা মারা যান। ক্লাস থ্রি-র পর আর লেখাপড়া করেননি। জ্যাঠামশাইয়ের কাছে মানুষ। ওঁর জ্যাঠামশাই নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন— ছিল একটা গানের দলও। গানের দলের সঙ্গে মফসসলেও চলে যেতেন। রাজবাড়িতে বারোয়ারি পুজোয়— যেখানেই গানবাজনা হত, জ্যাঠার গানের দল যেত সেখানেই কিশোর বয়স থেকেই তুলসী চক্রবর্তী চলে যেতেন। এক সময় তুলসীবাবু ভাবলেন জ্যাঠার ঘাড়ে বসে আর খাবেন কেন? স্বাবলম্বী হতে হবে। নানারকম চাকরি করার চেষ্টা করলেন। একবার তিনি একটি রাস্তার হোটেলে বাসনকোসন মাজার কাজ শুরু করেছিলেন। ওখানে মাতালবাবুরা চাঁট, ঘুগনি, পরোটা, মাংস ইত্যাদি খেতেন। তুলসীবাবুকে ওইসব বাসন মাজতে হত। মনে রাখতে হবে, বিদেশের মতো ডিশ-ওয়াশ নয়। জ্যাঠা টের পেয়ে চুলের মুঠি ধরে বাড়ি নিয়ে গেলেন। মাতালবাবুদের এঁটো গ্লাস ধোবে?� স্বাবলম্বী হবে? যুবা বয়সে তুলসীবাবু চলে গেলেন রেঙ্গুন। তখন কলকাতা থেকে রেঙ্গুনের জাহাজ ছাড়ত। হঠাৎ দেখলেন একটা সার্কাস পার্টি ওই জাহাজে উঠেছে। তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন। ডেস্টিনেশন বর্মা। কিছুদিন পরে আবার ফিরে এলেন। খালি হাতে নয়। অনেক অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে। তিন-চারটে ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন সেখানে।
পালিয়ে এলেন কেন? নিজেই বলেছেন— গা থেকে যখন জন্তু জানোয়ারের গন্ধ বেরতে লাগল তখন পালিয়ে এলাম।
সার্কাস পার্টিতে ক্লাউনের অভিনয় করার অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে অনেক কাজে দিয়েছিল।
তুলসীবাবু নানারকম চাকরি করেছেন। জ্যাঠা নিয়ে গিয়ে একটি প্রেসে কম্পোজিটারের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন। তখন লেটার প্রেসে কাজ হত। আরে উনি তো শিল্পী হতেই জন্মেছেন। কম্পোজ করতে করতে দেখলেন, ওই প্রেসে রঙ্গালয়ের পোস্টার ছাপা হচ্ছে। থিয়েটার এর অনেক অভিনেতার নাম ছাপা পোস্টার দেখে তাঁর মনে উচ্চাশা জন্মায়। জ্যাঠা স্টার থিয়েটারের মিউজিশিয়ান। ডাবল শো থাকলে তুলসী চক্রবর্তী জ্যাঠার টিফিন নিয়ে যেতেন। ওই সুবাদে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে বড় বড় অভিনেতাদের অভিনয় দেখার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। একদিন জ্যাঠাকে গিয়ে বললেন, আমি অভিনয় করব। জ্যাঠা বললেন, তাই করো। তোমার অভিনয়টা হবে। সে সময় অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিরাট মানুষ— স্টার থিয়েটারের কর্ণধার, ডিরেক্টর, প্রাোডিউসার। ওঁকে গিয়ে জ্যাঠা বললেন— আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি ওকে।
সেই শুরু। যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দারিদ্র তাকে দেয়নি তার পরিপূরক জীবন বোধও দারিদ্রই তাকে দিয়েছিল।
এটা মনে রাখা দরকার— বাংলা ছবিতে যেমন উত্তম-সুচিত্রা ছাড়া চলত না, তেমন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, তুলসী চক্রবর্তী ছাড়াও চলত না। দর্শকদের কাছে উত্তম-সুচিত্রার মতো তাঁরাও জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁদের চাহিদাও ছিল সমান। আর একজন অভিনেতা— উৎপল দত্ত। তিনি চরিত্রাভিনেতা হলেও কমেডির ক্ষেত্রে ছিলেন অতুলনীয়।
উত্তমকুমার এক অর্থে আর একজন গ্রেট কমেডিয়ান। বিশেষ করে রোমান্টিক কমেডিতে। চিরকুমার সভার পূর্ণর চরিত্র মনে করুন।
খুব ফরমিডেবল অভিনেত্রী গীতা দে। আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। কমেডিয়ান হিসেবেও এরা কম বড় নয়। মনে আছে, একবার একটা ছবি হল— তরুণ মজুমদারের ‘একটুকু বাসা’। সেখানে সবাই কমেডিয়ান, আমি ছাড়া। আমাকে বেশ কষ্ট করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছিল। তবে দারুণ আনন্দ পেয়েছিলাম কমেডি করতে।
সত্যজিৎ রায়ের স্ক্রিপ্ট নিয়ে ছবি করেছিলেন তাঁর ফার্স্ট অ্যাসিস্টেন্ট নিত্যানন্দ দত্ত। ছবি ‘বাক্সবদল’। আমি অভিনয় করি।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারতবর্ষ। তার মধ্যে আবার আমাদের রিজিওনাল সিনেমা। ভানু-জহরের মতো অভিনেতারা কী পেলেন, কী পেলেন না, সেই হিসেব করতে যাওয়াই বৃথা। তবে ওঁরা যে ভালবাসা মানুষের থেকে পেয়েছেন, তা ক’জনে পায়? তিরিশ বছর ধরে তিনশো ছবিতে ওঁরা কাজ করেছেন। মানুষকে এন্টারটেইন করেছেন। মানুষ ওঁদের ত্রিশ বছর ধরে ভাল বেসেছিল।
শিল্পীর কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা হল মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা।
যেদিন জহরদা মারা গেলেন আমার মনে আছে। ওঁর পাড়ার লোকজন আমাকে ফোন করে জানালেন মেডিক্যাল কলেজে জহরদা মারা গেছেন আপনাকে জানালাম। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটু খবর দিতে পারেন? ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী করে জহরদার মৃত্যুসংবাদ দেব? অনেক কষ্টে ভানুদাকে বললাম সে খবর। ভানুদা ট্যাক্সি করে এসে আমাকে তুলে নিলেন। মেডিক্যাল কলেজে তখন আমরা শুধু দুজন। আর কেউ নেই। পাড়ার লোকজন গেছে জিনিসপত্র কিনতে। আমরা ওপরে গিয়ে দেখলাম জহরদাকে সবুজ রঙের একটা পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ভানুদা বললেন, জহরের কি দেশের কাছে এইটুকুই পাওনা ছিল সৌমিত্র? অন্য দেশ হলে স্যার উপাধি পেত।