প্রসঙ্গ: উত্তমকুমার
উত্তমদা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমাকে কশাসলি কথা বলতে হয়। আর সেটা শুধু উত্তমদা বলে নয়, একটা প্রফেশনে এক জায়গায় থাকলে বাকি সকলের সম্বন্ধেও আমাকে কশাসলি কথা বলতে হয়। কেননা কতকগুলো প্রফেশনাল এথিকস আছে, একেবারে ব্যক্তিগত অনেক জিনিস থাকে, যেগুলো বলা যায় না। সেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করা যায়। কিন্তু ইন পাবলিক সেটা বলা যায় না। দ্বিতীয় কথা, আমার ওপর এটার দায়িত্ব আরও বেশি এসে পড়ে কেননা ফলসলি অর ট্রুলি অর ইন অ্যান ইম্যাজিনড ওয়ে আমাদের দুজনকে রাইভ্যাল ভাবা হয়েছে অনেক সময়, সেক্ষেত্রে একেবারে নির্বিকার বিচারের জায়গায় বসে উত্তমকুমার সম্পর্কে কোনও কথা বলা আমার পক্ষে একটু শক্ত হয়ে যায়। তখন মনে হতে পারে, যদি এর মধ্যে দিয়ে কোনও সমালোচনা প্রকাশ পায়, তাহলে সেটাকে রাইভ্যালরি আছে বলে ভাবতে পারে মানুষ। সেটা আমি ভাবতে দিতে মোটেই চাই না। কেননা, একটা প্রফেশনে কম্পিটিশন নিশ্চয়ই থাকে, এই সমাজে তো থাকবেই। আর এই কম্পিটিশন আমার মধ্যে কখনও কাজ করেনি, এমন কথাও আমি বলছি না। কিন্তু সেই সঙ্গে খুব অনেস্টলি আর জেনুইনলি বলছি যে সমাজের এই প্রতিযোগিতা আমার বিশ্বাসের জায়গা থেকে বিশ্বাস করি না। আর একটা জিনিসও বলা ভাল, যে কোনও গুণী মানুষ সম্পর্কে আমার এক ধরনের অনুভূতি হয়। সেটা হচ্ছে যে, আমি সত্যিসত্যিই আমার ঈর্ষার যোগ্য নন এমন মানুষকে ঈর্ষা করি না, ঈর্ষা করা আমার আসে না। সেরকম গুণ যাঁদের মধ্যে দেখি আমি তাঁদের এত গুণগ্রাহী হয়ে যাই যে, সেই ঈর্ষার জায়গাটা আমার তাতেই মেল্ট করে যায়। সেরকম হয়ত কিছুমাত্রায় উত্তমদার ক্ষেত্রেও আমার ঘটেছে।
আমি যখন অভিনয় করতে এই লাইনে ঢুকেছি, তখন উত্তমদা আরও অনেক তৈরি, অভিনেতা হিসেবে অনেক দক্ষ। আমি তাঁর অন্তত দশ বছর পরে এই লাইনে এসেছি। উত্তমদার তখন অনেক কিছুই শেখা হয়ে গেছে। উত্তমদার নিজের ভেতরে কী করে নিজেকে কালটিভেট করতে হয়, সেটা ছিল। আর আমার ভেতরে সেটা বরঞ্চ একটু কমমাত্রায় ছিল। ফলে এই লাইনে এসে উত্তমদা কীভাবে নিজেকে কনডাক্ট করেন, এগুলো যখন দেখতাম, আমি দেখতাম সেরকমভাবে আমি পারি না। সুতরাং উত্তমদাকে দেখে দেখে অনেক কিছু আমাকে শিখতে হয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় অ্যাডমায়ার করতে আরম্ভ করেছি, শুধু অভিনেতা হিসেবে নয়। আর অভিনেতা হিসেবে ও যে আমার পছন্দের অনেকটাই ছিল, আবার অনেকটা ছিলও না একটা সময়, মানে যখন আমি ফিল্মে আসিনি, যখন কলেজে-টলেজে পড়ি তখন অবশ্য বেশিরভাগ বন্ধুই সুচিত্রার ফ্যান ছিল। উত্তম-সুচিত্রার সেই রাইজিং সময়টা আমি কিন্তু উত্তমদার অভিনয় বেশি পছন্দ করতাম। এবং আমার বন্ধুদের সঙ্গে এই নিয়ে আমার তর্ক হত। তখন থেকেই উত্তমকুমারকে আমার পছন্দ হত। আবার উত্তমদার মধ্যে যেসব ম্যানারিজম ছিল সেগুলোর সম্পর্কেও ক্রিটিক্যাল ছিলাম। অনেক সময় অনেক অভিনয় ভাল লেগেছিল। ‘চিরকুমার সভা’র ‘পূর্ণ’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ‘ভূতনাথ’ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এত ভাল লাগত। একটা জিনিস ওঁর অসাধারণ ভাল ছিল। সেটা হচ্ছে রোম্যান্টিক কমেডি, মানে প্রেমিক কিন্তু স্লাইটলি কমিক— ওই প্রেমে পড়ে বোকা হয়ে গিয়ে যেসব হাস্যরসের উদ্ভবগুলো হয়— তার গ্রেটেস্ট এগজ্যাম্পল হচ্ছে ‘চিরকুমার সভা’র ‘পূর্ণ’। ক’টা কথা আছে? কিন্তু কী অসাধারণ, কী ফানি, অ্যাট দ্য সেম টাইম, কী মিষ্টি। সে প্রেমিকই— সেখান থেকে সে যে ভীষণ বিচ্ছিরি অন্যরকম কিছু হয়ে যাচ্ছে তা নয়— কিন্তু প্রেমে পড়ে তার অনেক রকম বিপদ এবং গোলমাল হচ্ছে— যার জন্য দেখতে মানুষের হাসি পাচ্ছে। ভীষণই সুন্দর। ‘বিচারক’ বলে একটা ছবি দেখেছিলাম ওঁর। তাতে ওঁর যেটা ফ্ল্যাশব্যাক— মানে যখন উনি ইয়াং মুন্সেফ— তাতে একটা গোঁফ নিয়েছিলেন। অল্পবয়সী মুন্সেফ সাইকেলে করে কোর্টে যায় এবং প্রেমে পড়ে সে বোকা হয়ে গিয়েছে। সেটা যে কী সুন্দর কমেডি। সেই রোম্যান্টিক কমেডি— এই জিনিসটা ভীষণ ভাল করতেন। কমেডির সেন্সটা বোধহয় সমস্ত দক্ষ অভিনেতার মধ্যেই থাকে। এমনকি প্রেমের টিপিক্যাল ছকে-বাঁধা ছবিগুলো উত্তম-সুচিত্রার। তার মধ্যেও এমন একটা সাবলীলতা থাকত, যে দেখে মনে হত উত্তমদার ভেতরে একটা প্রেমিক সত্তা আছে।
উত্তমদার অভিনয় প্রথম থেকেই ভাল লাগলেও কোনওদিনই মনে হয়নি উত্তমদার অভিনয় অনুসরণ করব। আমার অভিনয়শৈলীর মধ্যে উত্তমদার কোনও প্রভাব নেই। কিন্তু অভিনয় করার ক্রাফটের দিক থেকে ওঁর সঙ্গে কাজ করে ছোটখাট জিনিস অনেকসময় শিখেছি। যেমন কী করে পজ-এর সঙ্গে একটু হোল্ড করতে হয়, বা কী করে বোকার মতো না হেসে অল্প হেসে জিনিসটা করা যায়। এগুলো শিখেছি কখনও ছবি দেখে কখনও একসঙ্গে কাজ করতে করতে। কিন্তু ওঁর মতো অভিনয় করব, এরকম কোনওদিন ভাবিনি। মানে আমার আইডল ডিফারেন্ট ছিল। থিয়েটার থেকে এসেছি বলে আমার আইডল শিশির ভাদুড়ী চিরকালই ছিলেন। কিন্তু আমার মনের গঠনটা অন্যরকম হওয়ার ফলে আমি বেঁচে গেছি শিশির ভাদুড়ীর অনুকারক না হয়ে, যে কোনও ভাল অভিনয় আমাকে সব সময় অ্যাপিল করে। সে যেরকমই হোক, আমার থেকে যত ডিফারেন্টই হোক, আমার মতো হোক বা না হোক, সমস্ত ভাল অভিনয় আমার আত্মস্থ করতে ইচ্ছে করে। আমার মনে হয়, অভিনয় জিনিসটাতে মনটাকে ব্লটিং পেপারের মতো করে রাখতে হয়। কেবল দেখতে হয়, জানতে হয়, শিখতে হয়। এবং সেই দেখাটা জীবন থেকে দেখা। মানুষ কীভাবে বিহেভ করে, তার থেকে দেখা। তাই বলছি, উত্তমদা আমার আইডল না হওয়ার ফলে আমি কোনওদিন তাঁর পথ অনুসরণ করিনি। উত্তমদা সম্পর্কে আরও ভাল করে ওয়াকিবহাল হয়েছি যখন, আর একটু বয়স বেড়েছে, একসঙ্গে কাজ করেছি, আমার কাছে উত্তমদার গুণগুলো আরও বড় হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আমি আগেও বলেছি, সেটা হচ্ছে যে, উত্তমদার মধ্যে একটা দোটানা ছিল। স্টার হব, না পরিপূর্ণ অভিনেতা হব, সেখানে উনি বিরোধটা মিটিয়ে ফেলেছেন এই ভেবে হয়ত যে স্টারটাই অভিনয়, ওটাই অভিনেতার আলটিমেট ডেভেলপমেন্ট। কিন্তু আমার বারবার মনে হয়েছে উত্তমদার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। ওঁর মধ্যে এতরকম চরিত্রাভিনয়ের দিক ছিল, সেগুলো তিনি নিজে ভরসা পেতেন না বলে ফুল ডেভেলপমেন্ট অফ হিজ ফ্যানটাসটিক ট্যালেন্ট হয়নি। সেই সঙ্গে আমার মনে হয়, একদিক থেকে দেখলে সব অভিনেতাই তো তাই। তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের ইমেজে খানিকটা বন্দী। কেউ অল্পের মধ্যে বন্দী হয়ে যান, কেউ আর একটু বড় ভ্যারাইটির মধ্যে বন্দী হন। কিছু তো তার নিজের শিয়ার ফিজিওনমি, শরীর গঠনই কিছুটা পরিমাণে তাকে বন্দী করে। তেমনি উত্তমদাও হয়ত তাঁর সেই নায়কসুলভ চেহারাটা, যেটা তাঁর-ও কিছুটা ছিল, পরে সেটাকে উনি সম্পূর্ণভাবে ডেভেলপ করেছিলেন।
কলকাতার হিরো দেখতে গেলে ওঁর মতো হিরো নেই। আমি যতদূর জানি যে, তিনি অসম্ভব ভাল ছবি দেখতেন, ভাল হিরোদের অভিনয় আত্মস্থ করার চেষ্টা করতেন। সেখান থেকে উত্তমকুমারের ওই স্টার ইমেজ-এর ব্যাপারটা এসেছে। তাছাড়া, এদের সময়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হাওয়ায় এই ব্যাপারটা ছিল যে গ্ল্যামার জিনিসটা ভীষণ বড়। কিছুটা পরিমাণ সেটা সত্যিও তো বটে। আমি একজন উত্তমকুমারের গ্ল্যামারস্ট্রাক হিসেবে যে যে জিনিসগুলো আমার ভাল লাগে সেই পয়েন্টের ভেতর যেতে পারি। প্রথম কথা হচ্ছে, আগেকার দিনের বেশিরভাগই সেইরকম হত, খর্বকায় নায়ক আগে বেশি দেখা যেত না, উনি বাঙালির তুলনায় যথেষ্ট লম্বা মানুষ। অনেকেই জানে না, উনি আর আমি একই হাইটের। যদিও দেখাত না কারণ কাঁধগুলো অন্যরকম। দ্বিতীয় কথা প্রথম থেকেই ওঁর যেটা ছিল মিলিয়ন ডলার এনডাওমেন্ট, সেটা হচ্ছে ওঁর হাসিটা। আমি ওঁর হাসির একজন মুগ্ধ ভক্ত বলতে পারেন। আমি ওরকম হাসি খুব কম দেখেছি। আমি একবার বহুকাল পূর্বে উত্তমকুমার সম্পর্কে একটা লেখা লিখেছিলাম। তাতে লিখেছিলাম ওরকম হাসি আমি দেখিনি এবং ওঁর হাসিটা আমার কাছে এমনই যে, উনি যদি একটা খুন করেও আমার সামনে হেসে দাঁড়ান আমি বিশ্বাসই করব না যে উনি খুন করেছেন। একটা জাদু ছিল ওঁর হাসিতে। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। এবং সেটা সম্ভবত স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে। শুধু স্ত্রীলোকেরাই মুগ্ধ হতেন তা নয়। আমার মতো পুরুষমানুষেরা, যে কোনও পুরুষমানুষই সেই হাসি দেখে মুগ্ধ হবেন। এমন একটা মিষ্টি হাসি। যার দিকে চেয়ে হাসতেন, সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হবে সে তাঁর আপনার হয়ে গিয়েছে।
ওঁর মুখের আলাদা করে কিছু, অমুকটা ভীষণ সুন্দর, তমুকটা ভীষণ সুন্দর এমনটা নয়। কিন্তু তাদের সংস্থাপনটা সব কিছু। চোখগুলো, নাকটা, ঠোঁট দুটো। ঠোঁট দুটো হয়ত বেশি পুরু ছিল। কিন্তু এত ফোটোজিনিক সেগুলো হয়ে উঠত। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, তোমার তো আলজিভের তলা থেকে ক্যামেরা বসালেও ভাল দেখায়। আসলে যখন উনি সিনেমায় এসেছেন তখন প্রথমপ্রথম ছবি ফ্লপ হত। স্ট্রাগল করেছেন ছবি ফ্লপ হত বলে। ছবি ফ্লপ তো শুধু তাঁর দোষে হত না। কিন্তু লোকটা নিজেকে সেই মতো মেপে নিতেই না নিজেকে ধরতে পেরেছিলেন এবং ছবিতে নিজেকে অ্যানালাইজ করেছেন যে আমার কপালটা বেশি চওড়া লাগছে। নাকটা… ঠিক আছে, আমি মেকআপটা সেরকমভাবে করব, যাতে নাকটা একটু শার্প আসে। একটাই জিনিস উনি সযত্নে মেকআপের সময় করতেন যে, কোনও জিনিস যদি দেখতে খারাপ লাগে, নন-গ্ল্যামারাস লাগে, সেটা উনি করতেন না। যে কারণে অনেক রোলই উনি করেননি। উনি তো ‘সংসার সীমান্তে’র অঘোর করতে চাননি। ‘অভিযান’-এর নরসিংহ করতে চাননি। সেজন্য আমি রোলটা পেয়েছিলাম। মানিকদা তখন ডিরেক্টর ছিলেন না। বিজয়দা ছিলেন পরিচালনায়। উত্তমদাকে বলেছিলেন যে, ‘তোমাকে ডিগ্ল্যামারাইজ করতে হবে’। তাইতেই উনি বলেছিলেন, ‘না আমি ওসব করব না’। সুতরাং, এই অ্যাটিচুড-এর তফাত একটা বোধহয় ওঁর আর আমার মধ্যে ছিল। অ্যাপ্রাোচের তফাত। আর ‘অভিযান’-এর সময়ই তো উনি ফুল ফর্মে। অ্যাকচুয়ালি আমার মনে হয় ‘রাইচরণ’ ভালভাবে গ্রাহ্য হয়নি বলেই বোধহয় উনি ওই পথটা বেছে নিয়েছিলেন। ‘রাইচরণ’ উনিই ভাল করেছিলেন, কিন্তু তখন পাবলিক নেয়নি। তখন থেকেই উনি সন্ত্রস্ত হয়ে সেই পথে আর পা বাড়াননি।
কিন্তু আমি ওঁর অভিনয়শৈলীর যে অ্যাসেসমেন্ট করেছি, তাতে উনি যথেষ্ট বিচিত্র চরিত্র-চিত্রণের ক্ষমতা রাখতেন। একটা বিশেষ ধরনের চরিত্রে আমি ওঁর কোনও জুড়ি পাই না— সেরকম আরও আছে হয়ত, কিন্তু এই একটা আমি মেনশন করছি— সেটা হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারের বড় ভাই। যেটা ওঁর নিজের চরিত্রের মধ্যেও ছিল এবং সেরকম একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। যেখানে যখন করেছেন— নির্মল দে’র ‘বসু পরিবার’— যেটার থেকে ওঁর নাম হল প্রথম— সেই ছবিতে উনি বড় ভাই। তারপর ‘দুই পৃথিবী’ বলে একটা ছবি করেছিলেন এবং তারপরের দিকের অনেক ছবিতেও— ওই অনেকগুলো ভাই-টাই নিয়ে একটা একান্নবর্তী পরিবারের তিনি হচ্ছেন মাথা। অসাধারণ অভিনয়— ওই জিনিসগুলো বোধহয় ওঁর মতো ভাল আর কেউ করতে পারে না।
আমার কীরকম মনে হয় যে, উত্তমকুমারের সমসাময়িক যাঁরা— দিলীপকুমার, রাজকাপুর, দেবানন্দ ইত্যাদি— এমনকি পরেও কিছুটা— ওই অমিতাভ বচ্চন প্রভৃতি— এঁদের সকলের চাইতে আমার কাছে উত্তমকুমার বেশি প্রিয় নায়ক। আমি জানি না, আমি অভিযুক্ত হতে পারি যে আমি বাঙালি বলে বা তাঁর বন্ধু বলে এরকম বলছি। তা নয়, আমার এটা আরও মনে হয় এই কারণে যে, প্রেমিকের রোলটা উনি যে-সাচ্ছন্দের সঙ্গে, যে-পারফেকশনের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন, ততটা পারফেকশন কিন্তু আমি এঁদের মধ্যে পাই না। আমি রাজকাপুরকে অ্যাডমায়ার করি অন্য কারণে— তাঁর আর একটা অন্য ধরনের চরিত্রাভিনয়ের জন্য। দিলীপকুমারকে অ্যাডমায়ার করি— তিনি এমন একটা সুন্দর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেই প্রেমিকটাকে প্রতিষ্ঠিত করতেন। কিন্তু শুধু প্রেমের দৃশ্য— প্রেম করাটা— সেই বহু সময় সত্যিকারের প্রেমিকও নয় কিন্তু— অনেক প্রেমিক ছেলেই ওরকমভাবে প্রেম করে না— আমরা জানি, কিন্তু উত্তমদা তার মধ্যে এমন একটা সৌন্দর্য, এমন একটা শোভা সৃষ্টি করতে পারতেন— সেইটে ওঁর বিশেষ গুণ। ওঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের মধ্যে রোম্যান্টিক প্রেমের ভূমিকাভিনেতা হিসেবে উনিই সবচেয়ে ভাল। উত্তমদা যেমন ফোটোজিনিক, আমার কাছে অবশ্য খুব হ্যান্ডসাম লোকই— কিন্তু ওঁর ভাবভঙ্গির মধ্যে এক নেক্সট ডোর ইয়ংম্যান গোছের একটা ব্যাপার ছিল। ওই দূরধিগম্য, স্পর্শযোগ্য নয়— এরকম মনে হত না উত্তমদাকে দেখলে।
ওঁর একেবারে শেষের দিকে শেষ তিনি-চার বছর এমন একটা ফেজ গিয়েছিল, উনি হিরো হিসেবে যত কিছু করেছেন, সেগুলো চলছে না। সেটা বয়সের জন্য। প্রায় সাত-আটটা ছবি, পরের পর অসফল বক্স অফিসে। তখন থেকে উনি ক্যারেক্টার-অ্যাক্টিং আরম্ভ করলেন। এবং তাঁর ক্ষমতা দেখা গেল। সেই জন্যই ওঁর এই মৃত্যুটা আমার কাছে শোকাবহ লাগে। যখন থেকে তিনি এই বিচিত্র চরিত্রের দিকে যেতে আরম্ভ করলেন তার মাত্র দু-তিন বছরের মধ্যেই তাঁকে চলে যেতে হল। আমরা লুজ করলাম। আমি এরকম ছবিতে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, যে ছবিতে তাঁকে ডিরেক্টর বলেছে যে, ‘উত্তমদা, মেসে এই সিনটাতে তুমি লুঙ্গি পরে থাকবে। লুঙ্গি আর একটা গেঞ্জি।’ উনি বললেন, ‘লুঙ্গি’! মেসে তো সবাই লুঙ্গি পরেই থাকে। এটাই যদি দশ বছর আগে কেউ বলত, উনি হয়ত কিছুতেই করতেন না। দেখলাম সে সেট-এ লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে, একটা টিপিক্যাল মেসবাসীর মতো মেসে বসে সিনটা করলেন। মানে তখন তাঁর ওই দ্বিধাগুলো কেটে গিয়েছিল। সেটা হচ্ছে ওই শেষের তিন-চার বছরের কথা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, আজকে উনি যদি থাকতেন, ইন্ডাস্ট্রির উপযুক্ত হয়েই থাকতেন। আমি খানিকটা যে জায়গায় আজ বয়োজ্যেষ্ঠ রোলগুলো করি, উনিও নিশ্চয়ই তাই করতেন। এবং আমারই মতো নিশ্চয়ই কষ্ট হত তাঁর, এত বাজে ছবি। এখন ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, কাজটা হ্যাজ বিন রিডিউসড টু জাস্ট ব্রেড-আর্নিং। সেরকম জায়গায় নেমে গেছে এই জিনিসটা। তবে মানিয়ে নিতে নিশ্চয়ই উনি পারতেন। কেননা, উনি ভীষণ প্রফেশনাল ছিলেন। ওঁদের দেখেই শিখেছি প্রফেশনালিজম কাকে বলে। উনি শেষের দিকে অ্যাডাপ্ট করেছেন এবং সেই জন্যেই বলছি, টিকে থাকবার ব্যাপারে ওঁর কোনও অসুবিধে হত না। উনি টপেই থাকতেন।
একটা ঘটনা বলি। ওঁর শেষের দিকে। একজন ডিরেক্টরের ছবিতে কাজ করছি। তিনি ওঁকে একটা জিনিস করতে বলছেন। সেটা ওঁর পছন্দ হচ্ছে না। উনি বলছেন, ‘না, এটা হয় না। লজিক্যালি এটা হয় না।’ সত্যি, উনি যেটা বলছিলেন, সেটাই ঠিক, অভিনয়ের দিক থেকে। আর যে-ডিরেক্টরের ছবি, তিনি অত্যন্ত খাটো। তাঁর বোধ আর উত্তমকুমারের বোধের অনেক তফাত। তখন তিনি তাঁর ডিরেক্টরসুলভ অথরিটিটা প্রয়োগ করে বললেন, ‘না, উত্তমদা। আপনি যখন নিজের ছবি করবেন, তখন এসব করবেন। আমার যা ইচ্ছে, এখন তাই করতে হবে।’ কিন্তু এগুলো বলার একটা ভঙ্গি আছে, উত্তমকুমারের মতো কোনও বড় অভিনেতাকে, বড় স্টারকে ওভাবে তো বলা যায় না! তিনি এরকমভাবে বললেন এবং এতে উনি অত্যন্ত অসম্মানিত বোধ করলেন। কিন্তু জিনিসটা করে দিয়ে আমাকে বললেন, ‘কী রে শুনলি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। দেখলাম তো চোখের সামনে।’ বললেন, ‘ভাল লাগছে না, এরকমভাবে কাজ করতে।’ আমি বললাম, ‘কী করবে বলো।’ বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই তো মুশকিল।’ খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখ পেয়ে কাজটা বন্ধ করে দিতে পারেননি।
একটা জিনিস মানিকদা সাধারণভাবে বলেছিলেন, হি ওয়াজ নট এ সেরিব্রাল অ্যাক্টর। এই সেরিব্রাল অ্যাক্টর এবং ইনস্টিংকটিভ অ্যাক্টর— এই জাতগুলো কিন্তু আমার কাছে খুব অ্যাকসেপ্টেবল নয়। কেন বলছি, সেই লোকটার বুদ্ধিমার্গের ছাপ হয়ত অন্য জায়গায় নাও থাকতে পারে। অ্যাপ্লিকেশন অফ আর্ট-এর সময় সেই বুদ্ধির ছাপটা ফুটে ওঠে। আর উত্তমদার মতো অভিনেতা যদি বুদ্ধি দিয়ে অভিনয় না করতেন, তাহলে তিনি অন্তত এতটা বড় রেঞ্জের জায়গায় কখনওই যেতে পারতেন না। এইটা আমার মনে হয় বেশ একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা। উত্তমদা খুব বেশিদূর অবধি লেখাপড়া করেননি। সেটা অবশ্য আমরাই বা কী? এগুলো বা ডিগ্রি কোনও ম্যাটার করে না অভিনয়জীবনে। তবু আমি বলব, আগেকার যাঁরা স্টলওয়ার্ট, বড় বড় অভিনেতা, তাঁদের পড়াশোনার ব্যাপ্তি নিশ্চয়ই তাঁদের অনেক পরিশীলিত করেছে। তাঁদের মনটাকে আরও সূক্ষ্মতর, উৎকৃষ্টতর শিল্পবস্তুর মধ্যে নিয়ে যেতে পেরেছে। সেখানে হয়ত উত্তমদা পারেননি। উত্তমদাকে কোন দিক থেকে বাঁচিয়েছে, তাঁর মনের পরিশীলনটা যে নষ্ট হয়ে যায়নি, সেটার কারণ হচ্ছে উত্তমদা ফান্ডামেন্টালি, মানে উত্তমদার মনটা শিল্পী ছিল বলে। শিল্পী ছিলেন বলেই তিনি অত অভিনয় ভালবাসতেন ছোটবেলা থেকে। গানবাজনা ভালবাসতেন। ওঁকে বাঁচিয়েছে ওঁর গানবাজনা। গান ভালবাসতেন শুধু নয়, নিজে ভীষণ সুন্দর গান করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ভীষণ ভালবাসতেন। এই যে জিনিসটা, এই গান ভালবাসলে তার মধ্যে একটা পরিশীলন ঘটে। সব সময় যে আমাকে সাহিত্য করে বা বই পড়ে মনের পরিশীলন ঘটাতে হবে তার কোনও মানে নেই। উচ্চারণ ঠিক করার জন্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন, তার থেকেও একটা শক্ত জিনিস করতেন। চণ্ডীপাঠ করতেন। এই নিষ্ঠা, ডেডিকেশন কজনের থাকে?
উত্তমদা যে কত বড় অভিনেতা সেটা বোঝা যায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একটা ছবি করেই সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়টা হজম করে নিয়েছিলেন। ‘চিড়িয়াখানা’-তে সেই অভিনয়টা করেছিলেন এবং তারপর থেকে ওঁর অভিনয়ের রীতিটাই বদলে গেল। স্টাইলিসটিক্যালি, রাদার শৈলীর দিক থেকে, রীতির দিক থেকে ‘চিড়িয়াখানা’য় উত্তমকুমারের অভিনয় ‘নায়ক’-এর থেকেও ভাল। উনি যে কত বড় জাত অভিনেতা ওই ‘চিড়িয়াখানা’ দেখলে বোঝা যায়। ওই আন্ডারটোনে নিচের দিকে কথা বলা— সেগুলো সেই তখন থেকেই এসেছে এবং ‘চিড়িয়াখানা’তে সেগুলো তিনি ডেমনস্ট্রেট করতে পেরেছেন— একটামাত্র ছবি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে করে। অবশ্য তিনি তখন যথেষ্ট অভিজ্ঞ অভিনেতা, ক্রাফট-এর ওপর দখল অনেক বেশি বলে চট করে তিনি এগুলো ধরতেও পেরেছেন। ‘নায়ক’-এ সত্যজিৎ রায় ওঁকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এখানে কনশাসলি অভিনয়টা করেছেন। ওই ব্যোমকেশের যে থিঙ্কিং পার্ট— চিন্তাশীল মানুষের যে-অভিনয়— এটা— উত্তমকুমার সেই গভীরভাবে ভাবছেন— ঠান্ডা, চুপচাপ, আস্তে কথা বলছেন— এগুলো আগে উত্তমকুমারের অভিনয়ে দেখিইনি বলতে গেলে— উইদাউট এনি ফ্ল্যামবয়েন্স। আগে যে পারফরমেন্স-পারফরমেন্স একটা ভাব, সেটা চলে গিয়েছিল।
সাধারণ মানুষ হিসেবে উনি যে জীবনযাপন করতে পারেন না, এ জন্য ওঁর একটা জ্বালা, যন্ত্রণা অনেক সময়ই প্রকাশ পেত। এই লোকটা সাধারণ বাঙালি জীবন থেকে উঠে এসেছেন তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ডটা তো তাই। যথেষ্ট স্ট্রাগল দেখেছেন। যথেষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্তের সঙ্কট দেখেছেন। তাঁর বাবা সাধারণ কাজ করতেন। তাঁদের বাড়িতে জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। সেখানে নানা জিনিস দেখেছেন। আবার অভিনয় জিনিসটাকে ভয়ঙ্কর ভালবাসতেন। এটা তাঁর প্যাশন ছিল ছোটবেলা থেকেই। ফলে তিনি মানুষকে স্টাডি করাটা যে অভিনেতার একবারে প্রাথমিক কাজ, এটা জানতেন। পরে স্টার হয়ে গিয়ে তাঁর এক্সপোজার টু কমন পিপল কমে গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু প্রায়ই বলতেন, ‘এগুলো জানিস ইচ্ছে করলেও পারি না’। ওটা জেনুইন যন্ত্রণা। সেটা নিজেকেই এক জায়গায় মিস করা। আবার ওঁর স্টারডম সম্পর্কে আগ্রহ এত প্রবল যে, আমাকে কত উপদেশ দিয়েছেন, আমি কেন ওরকমভাবে কফি হাউসে ঘুরে বেড়াই, রাস্তাঘাটে ঘুরি, যাতে সে সব না করি। আমার যাতে গ্ল্যামারটা বৃদ্ধি পায়— বলতেন, ‘তুই ওরকম করিস না, ওতে গ্ল্যামারটা চলে যায়।’ ভয়ঙ্কর ভালবাসতেন বলেই ওই উপদেশগুলো দিতেন। মনে আছে ‘তিন কন্যা’য় ‘সমাপ্তি’তে আমি ওই চশমাটা পরেছিলাম বলে উত্তমদা বললেন যে ‘বুড়োটে একটা চশমা পরলি কেন, তোর গ্ল্যামারের ক্ষতি হবে ওতে’। এটাই মনে হয় ওঁর স্ববিরোধ।
ওঁর কাজে নিষ্ঠার ব্যাপারে একটা ঘটনা বলি। দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। একটা সংলাপে, সেই শটটায় আমি নেই, আমি ক্যামেরার পাশে মোড়ায় বসে আছি। আর উত্তমদা একটা লম্বা সেনটেন্স-এ বোধহয় টুইস্টার, এরকম পরপর দু-তিনটে র-ফলা ঋ-ফলা কী সব ছিল, বারবার আটকে যাচ্ছেন। বার চারেক হয়ে যাওয়ার পর, এন জি হচ্ছে ক্রমাগত। আমি মোড়া থেকে উঠে গিয়ে বললাম, আরে এটা বাজে একটা শট। এটা বদলে দিতে বল না? উত্তমকুমার যদি সেই সময় কোনও ডিরেক্টরকে বলতেন যে, ‘অ্যাই, এই লাইনটা বলব না। পাল্টে দাও’ তো তিনি পাল্টে দিয়ে ধন্য হতেন। তখন তাঁর এত প্রতাপ, এত প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তা না করে তিনি বললেন, ‘আরে বোস না, এক্ষুনি হয়ে যাবে। এটা ঠিক করে বলে নিয়ে তারপর চা খাব।’ দিলীপ বলল, ‘একটা টি-ব্রেক দিই!’ উনি বললেন, ‘না না, আগে এই শটটা আমি ঠিক করব।’ ছ-সাতটা টেক এন জি হওয়ার পর আমায় বললেন, ‘পুলু তুই একটু বাইরে যা তো।’ আমি তো অবাক হয়ে বেরিয়ে এলাম। আট না নয় নম্বর টেক-এ ওকে করে বাইরে এসে বললেন, ‘দে, তোর ভাল সিগারেট একটা দে।’ তখন পকেটে সিগারেট রাখেন না। হার্টের একটু প্রবলেম হয়েছে। আমি বললাম, ‘আমার অদ্ভুত লাগছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’ বললেন, ‘জানি কী জিজ্ঞেস করবি।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কেন? তোমার তো আমাকে দেখে নার্ভাস লাগার কথা নয়। শুনলে পাগলেও হাসবে।’ উনি বললেন, ‘না, নার্ভাস লাগছিল না। তোকে দেখে ভীষণ সেলফ-কনশাস লাগছিল।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ বললেন, ‘না মানে উচ্চারণের, জিভের ওই ব্যাপারটা হচ্ছিল তো। তোর জিভটা তো পরিষ্কার। ওই জন্য আমার একটু সেলফ-কনশাস লাগছিল।’ এইটা যে বলতে পারে, বুঝতে পারে, সেই তো পারে তার নিজের লিমিটেশনকে অতিক্রম করতে। সেই জন্যই তিনি বরাবর বলতেন, ‘আমার জিভটা মোটা ছিল।’ নিজেই বলতেন। কিন্তু কোনওদিন কোনও বাঙালি দর্শককে বলতে শোনা যায়নি, ‘উত্তমবাবুর জিভ মোটা। কথা বোঝা যায়নি।’ তিনি এত যত্ন নিয়ে, এত পরিশ্রম করে তাঁর কথা পরিষ্কার রেখেছিলেন। মনে আছে, আমরা দুজনে বসে একদিন ‘দেবদাস’ দেখছি। ‘দেবদাস’-এর ওপেনিং শো। আমার পেছনে উনি বসে আছেন। আর উজ্জ্বলা সিনেমা হলের সাউন্ড বক্স ভীষণ খারাপ। আমি খানিকক্ষণ পরে বিরক্ত হয়ে ওঁর হাঁটুতে চাপড় মেরে বললাম, ‘দাদা কী হচ্ছে বল তো। আমি তো কোনও ডায়ালগ বুঝতে পারছি না।’ উত্তমদা রসিকতা করে বললেন, ‘আমি তোরটা তবু বুঝতে পারছি। আমারটা একেবারেই বুঝতে পারছি না।’
ওঁর ভেতরে একটা বিশেষ সত্তা ছিল। প্রত্যেক মানুষের পার্সোনালিটির যেমন একটা মূল খুঁটি থাকে, যে এই লোকটা এই রকম। কমল মিত্তিরকে দেখলেই যেমন মনে হয় এই লোকটা খাঁটি, ঋজু মেরুদণ্ডের একটা লোক। কোনও কারণে মিথ্যে কথা বলতে পারে না। চেষ্টা করেও পারবে না। উত্তমদার পার্সোনালিটির গঠন হচ্ছে যে, উনি বাড়ির বড় ভাই। সেই জন্য আমাদের সম্পর্কে বা আমার সঙ্গে যতই বাজার চালু রাইভ্যালরি হোক, যতই প্রতিযোগিতার এলিমেন্ট আমাদের দুজনের মধ্যে কখনও-সখনও এসে থাকুক, আমার সঙ্গে ব্যবহারের মধ্যে অধিকাংশ সময় আমি এটাই দেখেছি যে তিনি বড় ভাইয়ের মতো আমার সঙ্গে ব্যবহার করছেন। একটা ঘটনা এখানে বলি। এক সময় প্রায় দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অভিনেতৃ সঙ্ঘ আর শিল্পী সংসদ। সেটা হয়ে যাওয়ার পর প্রথম যে পয়লা বৈশাখটা এল, যেটা প্রত্যেকবারই হত, মন্টুদা একটা ফাংশন করতেন বসুশ্রীতে, সেখানে আমরা সবাই প্রতিবারের মতোই জড়ো হলাম। সেখানে বাঙালি মধ্যবিত্তরা যা করে, সবাই তাই করতাম। পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে প্রণাম বা কোলাকুলি যা করে থাকে সকলে। সেই পয়লা বৈশাখের সকালে আমি যখন পৌঁছলাম তখন দেখলাম উত্তমদা তার আগেই পৌঁছে গেছেন। তখন তো পরস্পরের, দুই শিবিরের লোকেদের দেখা হলেই ঝগড়াঝাঁটি হয়, বাকযুদ্ধ হয়। আমি গিয়ে দেখলাম যে ভানুদা, উত্তমদা প্রায় পাশাপাশি বসে আছেন। আমি গিয়ে ভানুদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। আর যেহেতু দুই শিবিরে আমরা বিভক্ত তাই উত্তমদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম না করে, হাতটা ধরে ‘শুভ নববর্ষ’ বললাম। বলামাত্র উত্তমদার মুখটা লাল হয়ে গেল। রাগে দুঃখে। এবং এই হচ্ছে লোকটার মহত্ত্ব। লোকটার ভেতরের আসল মানুষটা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বড় ভাই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারিস না!’ আমার পরম সৌভাগ্য যে, এই মুহূর্তে আমি যে অন্যায় করেছি, সেই চেতনাটা হল, আমি ওঁর পা-টা জড়িয়ে ধরে বললাম যে ‘আমাকে মাপ করে দাও, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।’ তখন বুকে জড়িয়ে ধরে দুজনে কোলাকুলি করলাম। আমাদের সম্পর্কগুলো এইরকম ছিল। ফ্যামিলির মতো।
আমাদের দুজনের আরও একটা যোগ ছিল। প্রাইভেট যোগ আর কি। সেটা ঘটেছিল যখন লোডশেডিং শুরু হল। তখন ইন্ডাস্ট্রিতে একটা মিটিং ডাকা হল। সমস্ত লোককে ডাকা হল। কনভেনার ছিল তিনজন। তিনজন ব্যক্তি। কোনও প্রতিষ্ঠান নয়। সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাতে সমস্ত ইন্ডাস্ট্রি ভেঙে পড়ে টেকনিসিয়ান স্টুডিওতে। তাতে কী করে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে গভর্নমেন্টের কাছে একটা ডেপুটেশন দিতে হবে। যেদিন ডেপুটেশন দিতে আমরা যাব, মানিকদার বাড়িতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মানিকদার গাড়িতেই আমরা গেলাম। মানিকদা সামনে বসলেন। পেছনে আমি আর উত্তমদা। সেই গাড়িতে যেতে যেতে এমনই গল্প করছি। উত্তমদা বললেন, ‘কী মানিকদা, আমাকে আর ছবিতে নিচ্ছেন না।’ মানিকদা বললেন, ‘তুমি এমন একটা বয়সে পৌঁছেছ, না বুড়ো না জোয়ান! এই বয়সের রোল না পেলে তো আর তোমাকে নেওয়া যায় না। এই বয়সের রোল পাওয়া মুশকিল।’ এই সব কথা হচ্ছে। বলতে বলতে এই কথা উঠল যে ইন্ডাস্ট্রিতে ভাল বুড়ো নেই। ছবি বিশ্বাস চলে যাওয়ার পর থেকে সেরকম দারুণ একটা জমকালো বুড়ো, যিনি ভাল অভিনয় করবেন আবার যাঁর একটা স্টার ভ্যালুও আছে— এরকম বুড়ো নেই। তখন আমিই ঠাট্টা করে বললাম, ‘না না, উত্তমদা ছাড়ো তো! ও সব বুড়ো এখন পাওয়া যাবে না। তুমি আর আমি বুড়ো হলে, তখন আবার ইন্ডাস্ট্রিতে ভাল বুড়ো আসবে।’ এটা আমার একটা ঠাট্টা ছিল। তারপর অনেক সময়ে উনি যখন হতাশায় ক্লান্ত, কোনও কারণে হয়ত মনটন খারাপ, বললেন, ‘দুর আর ভাল লাগছে না।’ এত কষ্ট হল এটা শুনে যে, আর ভাল লাগছে না! আমি একটু ঠাট্টা করে বললাম, ‘কেন মনে নেই, বুড়োর রোলগুলো করতে হবে না? কোত্থেকে হবে, এখন থেকেই ভাল না লাগলে? তুমি আর আমি বুড়ো না হলে ইন্ডাস্ট্রিতে ভাল বুড়ো পাওয়া যাবে না!’ তখন হাসতে লাগলেন। সেদিক থেকে বিরাট লস ইন্ডাস্ট্রির। সত্যিসত্যিই এমন একটা প্রেজেন্স, এমন একটা চেহারা, এমন একটা দর্শক টানার ক্ষমতা, ওরকম বুড়ো পেলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির হয়ত অনেকটাই সুরাহা হত।
প্রসঙ্গত, উত্তমদার ব্যাপারে আমার আরও একটা আফসোস হয়। কিছুদিন আগে একটা গ্রুপ থিয়েটারের ব্যানারে আমি ‘টিকটিকি’ নাটকটা করি। এই নাটকটা আদতে পাবলিক থিয়েটারের নাটক— কমার্শিয়াল থিয়েটারের। আসলে কেন এটা পাবলিক থিয়েটারে করতে পারিনি তার কারণ হচ্ছে স্টারের অভাব। ওই যে দুজন মাত্র অভিনেতা বলে পাবলিক থিয়েটারে করতে গেলে, পাবলিক থিয়েটারে দর্শককে টেনে নিয়ে আসার জন্য শুধু আমি একা সাফিসিয়েন্ট ছিলাম না। আর একজন স্টার হতে হত। অর্থাৎ যদি ওই নাটকটা আমি আর উত্তমকুমার করতাম অথবা আমি আর উৎপল দত্ত করতাম— তাহলে ওটা পাবলিক থিয়েটারে চালানো যেত। ইন ফ্যাক্ট উৎপলদা এবং উত্তমদা দুজনকে নিয়েই নাটকটা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যে কারণেই হোক, উৎপলদা রাজি হলেন না। তারপর কথায় কথায় উত্তমদাকে বললাম। উত্তমদা ছবিটা দেখেছিলেন। বললেন, ‘খুবই ভাল হয়, তবে আমি স্টেজওয়ার্ক করতে পারব না, দেখছিস তো আমার শারীরিক অবস্থা— সরবিট্রেট খেয়ে খেয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তুই এক কাজ কর— ফিল্ম কর— তুই ডিরেক্ট কর— আমি অভিনয় করব। আমাকে ডিউরিং প্রাোডাকশন পয়সাও দিতে হবে না। আমার নামে ফিল্মটা চার্জ করে দিবি— বক্স অফিস থেকে যা কালেকশন হবে তা থেকে আমি নিয়ে নেব।’— এর থেকে ভাল জেনারাস অফার আর কী হতে পারে? তখন প্রাোডিউসার খুঁজতে লাগলাম। একজন খুব বড় ডিস্ট্রিবিউটর— যাদের ঘরে উত্তমদার অন্তত পঁচিশখানা সুপারহিট ছবি আছে— তারা সব শুনে প্রথমে খুব উৎসাহ দেখাল। তারপর বলল, ‘না, এ সব ছবি মফসসলে চলবে না।’ বললাম, ‘কেন?’ বলল, ‘মেয়ে নেই।’ তো সেটাও তাদের ভুল অ্যাসেসমেন্ট। আর যদি নাই-বা চলল তারা না হয় পস্টারিটির জন্য ওই টাকাটা খরচ করত। অনেক ফ্লপ ছবিও তো তারা করে। উত্তম-সৌমিত্রর এরকম একটা আর্কাইভাল জিনিস থাকত! তো সে-ও হল না।
উত্তমদার রাজনৈতিক চিন্তা কী ছিল— এই জিনিসগুলো তো আমাদের অভিনেতাদের নিয়ে কেউ ডিসকাস করে না। এটা ঠিক যে রাজনৈতিকভাবে যাঁরা প্রাগ্রসর তাঁরাও তো অনেকে এ বিষয়ে ভণ্ড ছিলেন। উত্তমদা কিন্তু তা ছিলেন না। উত্তমদা ভণ্ড ছিলেন না। রাইটিস্ট ব্যাকওয়ার্ড রাজনীতি ওঁর ব্যাকগ্রাউন্ড— উনি সেইটেতেই বিশ্বাস করতেন, সারাজীবন কিন্তু সেটাই প্র্যাকটিস করেছেন— হি হ্যাড অ্যান ইনটেগ্রিটি অ্যাবাউট ইট— এগুলো নিয়ে তো আর পাবলিকলি ডিসকাস করা যায় না, আর করলে লোকে বুঝতেও পারবে না। তবে এসব সত্ত্বেও বলতেই হয় অভিনেতা হিসেবে লোকটা এত পাওয়ারফুল, এত বড় এবং শুধু তাই নয়, এক যুগের ইনস্টিটিউশনের মতো। উত্তমকুমারকে বাদ দিয়ে কি বাংলা সিনেমা ভাবা যায়?