অতল জলের আহ্বানে

অতল জলের আহ্বানে

তিন দশকের ওপর অভিনয়ের পেশায় নিযুক্ত আছি। শ-দেড়েকের মতো ছবিতে কাজ করেছি। তার অনেকগুলোই স্মৃতিতে লীন হয়ে এসেছে এবং এই সব ছবিতে যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের অনেকের কথাই এতদিন বাদে সচরাচর মনে পড়ে না। অনেক ছবিতে কাজ করেছি যেগুলো ছবি হিসেবেই মনে রাখার মতো, কোনওটায় বা অভিনীত চরিত্রটা মনে রাখার মতো, তাই মনে আছে। কিন্তু এখন, এই পঁয়ত্রিশ বছর অতিবাহিত করার পর, অভিনয় জীবনের স্মরণযোগ্য কি কি ঘটেছিল তেমন কথা মনে করার চেষ্টা করলে দেখি এমন কিছু ছবির কথাও মনে আসে যেগুলো ছবি হিসেবে স্মরণীয় নয়, অভিনীত চরিত্রটাও মনে নেই, তবু সেই ছবিতে কাজ করার সুখানুভূতিও আজও ভুলতে পারিনি। ১৯৬২ সালে এমনি একটা ছবিতে কাজ করেছিলাম। সেই ছবির নাম ‘অতল জলের আহ্বান’। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী আশ্রয় করে ছবিটার নাম ছিল বলেই তার নাম আমার স্মৃতির সঞ্চয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এমন নয়, ছবিটায় কাজ করার সঙ্গে আমার কতকগুলো ব্যক্তিগত প্রথম-অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে। তাই ছবিটা ভুলিনি।

ওই ছবিতেই অজয় করের পরিচালনায় আমার প্রথম অভিনয়। অজয় করের পরিচালনায় আমি আটটি ছবিতে অভিনয় করেছি। এক সত্যজিৎ রায় (১৪টি) আর সলিল দত্ত (৯টি) ছাড়া আর কোনও পরিচালকেরই এতগুলি ছবিতে আমি অভিনয় করিনি। ‘অতল জলের আহ্বান’ দিয়েই অজয়দার সঙ্গে আমার সংযোগের শুরু। ছোটবেলা থেকেই অজয়দার নাম জানি। প্রথমে ক্যামেরাম্যান হিসেবে পরে ডিরেক্টর হিসেবেও। শুধু ক্যামেরাম্যান হিসেবে তাঁর করা একটা ছবি খুব মনে আছে— ‘চন্দ্রশেখর’। ডিরেক্টর হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি সম্ভবত ‘জিঘাংসা’। ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলে’র গল্প নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রর রচনা ‘জলার পেত্নী’ ছিল এই ছবির কাহিনীর আশ্রয়। যখন দেখেছি তখন বোধহয় স্কুলও পার হইনি। কিন্তু খুব আনন্দ পেয়েছিলাম দেখে। এখনও কুয়াশার ভেতর আলো-আঁধারির রহস্যের কথা আমার মনে পড়ে।

তারপর ‘অনন্যা’, ‘মেজদিদি’ এসব দেখেছি। এবং ভাল লেগেছে। আমার মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায় অজয় করের ছবির গুণপনার প্রশংসাই করতেন। বলতেন, ভাল স্ক্রিপট পেলে অজয়বাবু ভাল ছবি করেন।

অজয়বাবুর সঙ্গে এই ‘অতল জলের আহ্বান’-এ কাজ করতে গিয়ে প্রথম থেকেই একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভারি মিষ্টি মানুষ ছিলেন। ‘বাবু’ থেকে ‘দাদা’ বলতে বেশিদিন সময় লাগেনি। তাঁর যে গুণটা অচিরেই দেখতে পেয়েছিলাম তা হল ফিল্ম নির্মাণের বেশিরভাগ দিকগুলো সম্পর্কে ওঁর নিশ্চিত দখল। কলকাতার সিনেমার ইতিহাসে অজয় কর তো ক্যামেরাম্যান হিসেবে একটা ল্যান্ডমার্ক ছিলেনই। লাইটিং বিভিন্ন লেন্সের ব্যবহার, ফ্লেমিং, গতিময় ক্যামেরার স্বচ্ছন্দ বিচরণ এসব তো বটেই ল্যাবরেটরির কাজের জ্ঞান, এমনকি সিনেমা নির্মাণের প্রাথমিক যে প্রয়োজন এডিটিং, তার সম্বন্ধেও তাঁর জ্ঞান অসামান্য মাত্রাতেই ছিল।

অভিনয়ের ব্যাপারে নতুনদের নিয়ে বেশি কাজটাজ যতদূর জানি করেননি, কিন্তু দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী চিনতে ভুল করতেন না। তাদের ওপর চরিত্রায়ণের অনেকটা দায়িত্ব দিয়ে নির্ভর করতেন। সিনেমা মাধ্যমটা বুঝতেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীর মেজাজ-মন বুঝতেন, স্বভাবে সহৃদয় ছিলেন। অভিনেতাদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যেত তাঁর। তাদের বিশ্বাসভাজন হয়ে তাদের কাছ থেকে ভাল কাজটা আদায় করে নিতে জানতেন। এই আদায় কিন্তু ডিরেক্টরের ছড়ি না ঘুরিয়েই করতেন। অজয়দাকে ফিল্মমেকার হিসেবে আমি আর একটা কারণে খুব শ্রদ্ধা করি। অজয়দা ছিলেন বাংলা ফিল্মের আগের কালের মানুষ এবং প্রচলিত অর্থে কমার্শিয়াল সিনেমার যূথলগ্ন। তবু প্রথম থেকেই ঝকঝকে, তকতকে ফোটাগ্রাফির নয়নসুখকর আলোছায়ার মায়ার স্রষ্টাই শুধু তিনি ছিলেন না, সুসাহিত্যের চিত্ররূপকার এবং রুচিবান পরিচালক হিসেবেও তিনি নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট ছিলেন। তাঁর থেকেও বড় কথা হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সিনেমার অগ্রগতির তালে তালে তিনি বেশ খানিকটা পদক্ষেপ করতে পেরেছিলেন। নির্মাণের ক্ষেত্রে তো বটেই। এমনকি ‘কাঁচকাটা হীরে’, ‘বর্ণালী’, ‘মাল্যদান’-এর মতো ছবির কথা ভাবলে তো মনে হয় সুযোগ পেলে আরও অনেকখানি আধুনিক অগ্রসর মর্মবস্তুও তিনি তাঁর ছবিতে নিশ্চয়ই আনতে পারতেন।

এ ব্যাপারে একমাত্র তপন সিংহ ছাড়া তাঁর সঙ্গে খুব বেশি পরিচালকের তুলনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তপন সিংহ তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের অসামান্য দক্ষতাকে যুগোপযোগী সমকালীন সিনেমার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন।

সিনেমা মাধ্যমটা যন্ত্রনির্ভর। সেই যন্ত্রপাতির সার্থক ব্যবহারই শুধু নয়, যান্ত্রিক কলাকৌশলের অগ্রগতিতেও তাঁর প্রবল আগ্রহ তাঁর সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। দুটো জিনিস এখনই মনে আসছে। প্রথমটা হল back projection-এর বদলে front projection-এর স্থানীয় পদ্ধতির প্রয়োগ তিনিই মাথা খাটিয়ে বের করেন। এর ফলে শুটিং-এর অনেক টেকনিক্যাল সমস্যার সমাধান হয়। চলমান যানবাহনের অভ্যন্তরে স্থিত পাত্রপাত্রীর দৃশ্যতে বাস্তবিক যাথার্থ দেওয়ার জন্য তাদের পেছনে যানগতির উল্টোদিকে অপস্রিয়মাণ পশ্চাৎপটের ব্যবহার, ফিল্মে বহুদিনই ছিল। সেখানে স্থাণু গাড়ি বা ট্রেনের কামরা বা নৌকাতে অভিনেতৃবর্গকে রেখে পেছনে back projection-এ দৃশ্যের উপযুক্ত চলমান পথ বা মাঠঘাট বা নদীস্রোতের ফিল্ম, পর্দায় প্রক্ষেপণ করে চলন্ত যানের বিভ্রম তৈরি করা হত। এই ব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সরাসরি প্রক্ষেপিত দৃশ্যের সামনে অভিনেতাদের রেখে শুটিং করার সুবিধেজনক কায়দাটা অজয় করেরই উদ্ভাবন।

দ্বিতীয় উদ্ভাবনটি ব্লিম্প ক্যামেরায় Zoom lense ব্যবহারের উপায়। ব্লিম্প জিনিসটা আসলে একটা ঢাকনা। এটা ক্যামেরার ওপর চাপানো হয় ক্যামেরা যন্ত্রটা সচল থাকলে তার মোটর থেকে যে আওয়াজ হয় তা চাপা দিতে। তখনকার অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরায় ব্লিম্প ছিল একটা শক্তপোক্ত বাক্সের মতো। কিন্তু যেসব অ্যারি ক্যামেরা তখন কলকাতায় ছিল তাতে ব্লিম্পের ঢাকনা লাগালে Zoom lense আর ব্যবহার করা যেত না। অর্থাৎ Zoom lense আসার আগে যখন ব্লক লেন্স নিয়েই শুটিং হত, এই সব অ্যারি মডেল সেই সময়কার। Zoom আসার পর যন্ত্রনির্ভর সিনেমা, শিল্পের অগ্রগতিতে আগ্রহী সমস্ত পরিচালকের মতোই অজয় করও এই লেন্স বহুল ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এবং ব্লিম্প ছাড়া ক্যামেরার আওয়াজে যে অসুবিধের সম্মুখীন হলেন তা অপনোদনের জন্যে ব্লিম্প লাগানো ক্যামেরাতেই Zoom lense লাগানোর একটা উপায় উদ্ভাবন করলেন।

সদা শোভন মার্জিত-বেশ এই মধুর মানুষটির অভাব চলচ্চিত্রের বহু লোকের মতো আমি এখনও বোধ করে থাকি।

‘অতল জলের আহ্বান’-এ অভিনয় করার দিনগুলোর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার একটা প্রধান কারণ সেই ছবিতে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে অভিনয় করতে পাওয়ার সুযোগ। কিন্তু এই সুযোগটা প্রথম বারের নয়। এটা ছিল শেষবারের মতো তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারার সুযোগ। তবু যে এই ছবিটার কথা ভাবলে ছবি বিশ্বাস নামের সেই জমকালো মানুষটির স্মৃতি ঝলমল করে ওঠে, তার কারণ দু’জনের একসঙ্গে অত কাজ আর কোনও ছবিতে ছিল না। তাই সেদিন যেদিন ওই ছবির শুটিং থাকত সেই সব দিন ঘুম ভাঙতেই মনে মনে যখন ভাবতাম আজ কোন শুটিং কি কি দৃশ্য আছে, তখন ছবিদার সঙ্গে অভিনয়ের দৃশ্য আছে মনে পড়লেই আমার মনটা আনন্দে উত্তেজনায় যেন লাফাতে থাকত। কারণ ওই ছবিতে তাঁর সঙ্গে কাজ করে আমি এত কিছু শিখেছিলাম যা কোনও তরুণ শিক্ষার্থীর সাধারণভাবে শিখতে পাঁচ-সাত বছর চলে যায় এই লাইনে। এবং কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি যে সেই শিক্ষার অনেকটাই যেমন পেয়েছিলাম কাছে থেকে তাঁর কাজের পদ্ধতি অনুধাবন করার সুযোগ পেয়ে, তেমনি আবার অনেকটাই তিনি, যাকে বলে হাতে ধরে, শিখিয়েছিলেন।

প্রথম যেদিন ছবিদার সঙ্গে শুটিং করেছিলাম সেই দিনটা আমার মনে আছে। সেই শুটিং ছিল তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে। তার আগে শুটিং-এর অভিজ্ঞতা বলতে আমার ঝুলিতে একটিমাত্র ছবি। সেটি হল সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’। আর যাঁর সঙ্গে সেদিন অভিনয় করতে হবে সেই ছবি বিশ্বাসের তখন দেশজোড়া নামডাক। তার ওপরে তাঁর সম্বন্ধে নানান রকম রটনা তো শুনতাম। তিনি সহ-অভিনেতাদের খুব বেগ দেন অভিনয়ের সময়, তিনি নাকি নবাগতদের এত ঘাবড়িয়ে দেন যে তাদের অভিনয় খোলে না ভাল করে, ইচ্ছে করেই অন্য অভিনেতাকে চেপে দেন। এমনি সব নানান শোনা কথার জন্যে সত্যি বলতে কি, প্রথম দিন তাঁর সঙ্গে শুটিং করার আগে একটু নার্ভাসই লাগছিল। তবে তাই বলে মাত্রাতিরিক্ত ভয় আমার ছিল না। বয়সটা তো অনেক কম ছিল, অনেকটা বেপরোয়াও ছিলাম। আর ছোটবেলা থেকেই এইসব বড় অভিনেতার প্রতি আমি খুব আকর্ষণ বোধ করতাম। তাঁদের সান্নিধ্যে আসার সুখটাই তাঁদের সম্পর্কে ভয় কাটিয়ে দিত। তাছাড়া সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের ছবিতে প্রথম কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং শিশির ভাদুড়ীর মতো মানুষের সান্নিধ্যও মনকে অযথা ভয়ের থেকে অনেক মুক্তি দিয়েছিল সেই অল্পবয়সেই।

তবু ছবি বিশ্বাসের মতো অত বড় অভিনেতার সঙ্গে শুটিং করতে গিয়ে একটু মানসিক উত্তেজনা ছিল না— এমন কথা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। কি জানি, উনি আমার মতো নভিসকে নাকাল করবেন না তো? সেই সম্ভাবনাটা কাটাতে এবং ওঁর কাছে কিছু শেখার সম্ভাবনাটি বাড়াতে ভাবলাম ওঁকে একটু তুষ্ট করে রাখি। ওঁর সঙ্গে পরিচয় আগেই হয়েছিল ‘জলসাঘর’-এর শুটিং দেখতে গিয়ে। ইতিমধ্যেও দু-একবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। উনি স্টুডিওতে এসে গেছেন শুনে ওঁর মেকআপ রুমে ওঁকে সম্ভাষণ জানাতে গেলাম। খুব আন্তরিক গলায় উনি প্রতিসম্ভাষণ জানালেন। বসতে বললেন। যেন অনেকদিনই চেনেন। গোড়াতেই বললাম, ‘ছবিদা, আজ আপনার সঙ্গে প্রথম শুটিং করব, ভুলটুল হলে একটু দেখিয়ে দেবেন কিন্তু।’ কথাটা শুধু ওঁকে তুষ্ট করার জন্যেই বলিনি, শিক্ষার্থীর আন্তরিকতা নিয়েই বলেছিলাম। আমার কথার উত্তরে যা বলেছিলেন তা আজও আমার স্মরণে আছে, স্মরণীয় হয়ে থাকবে সারা জীবন। বলেছিলেন, ‘দ্যাখ, যা করবি সেটা confidently করে যবি। What I would find wrong may be another way of thinking it.’

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে ছবিদার সঙ্গে বেশি কাজ ছিল না। এর পরেই ওঁর সঙ্গে শুটিং করলাম সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ ছবিতে। একদিন একটা দৃশ্যে ওঁর ফ্লোরের ওপর সজোরে পড়বার কথা। সেদিন সকালে উনি স্টুডিওতে এলেন পুরো বুকের খাঁচাটায় বেলেডোনা প্লাস্টার লাগিয়ে। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘কাল রাত্তিরে শুতে যাওয়ার সময় বৌমা মশারিটা গুঁজে দিয়ে গেলেন কিন্তু পায়ের দিকটা একটু যেন ফাঁক ছিল, সেখানটা যেই গুঁজতে ঝুঁকে পড়েছি ওমনি একটা হাঁচি এল— আর বাইরে না হয়ে সেটা কীরকম যেন পাঁজরের কাছে burst করে গেল। তাই থেকেই ভীষণ ব্যথা।’ আসলে বোধহয় কঠিন মেঝের ওপর সেদিন শুটিং-এ আছড়ে পড়াটা যাতে বাদ দেওয়া যায় তাই পাঁজরার কাছে হাঁচি burst করার গল্পটা ফেঁদেছিলেন।

মানিকদার কাছে খবর গেল। মানিকদা মেকআপ রুমে এসে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করাতে আবার ছবিদা পূর্ববর্ণিত গল্পটা বললেন। মানিকদা খুব গম্ভীরভাবে ‘তাই নাকি, হাঁচি burst করল?’ বললেন যদিও কিন্তু তাঁর চোখে একটা হাসির ঝিলিক ছিল। বললেন, ‘ছবিদা, আমি দেখছি আপনার পড়ার ব্যাপারটা avoid করা যায় কিনা, তবে ওটা avoid করা শক্ত। তবু আমি দেখছি।’ বলে ফ্লোরে চলে গেলেন। ছবিদা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বুঝলি?’ আমরা কেউ কিছু বলছি না। ছবিদা বললেন, ‘একটু অপেক্ষা কর, বুঝতে পারবি।’ একটু পরেই মানিকদা আবার এলেন। এসে বললেন, ‘না ছবিদা, ওটা avoid করা যাচ্ছে না। আপনি প্লাস্টারটা খুলেই ফেলুন।’ ছবিদা বললেন, ‘অগত্যা।’ স্বভাবসিদ্ধ ভারী গলায় হেসে হেসে মানিকদা আবার চলে গেলেন। ছবিদা বললেন, ”এবার বুঝলি? আমি ও লম্বুকে চিনি। ও যে ছাড়বে না আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। ওর কাছে ফাঁকি চলবে না।’

শারীরিকভাবে কষ্ট হতে পারে এমন কোনও শুটিং থাকলে ছবিদা নানা ছলছুতোয় তার থেকে রেহাই খুঁজতেন এবং অন্যান্য পরিচালকের ক্ষেত্রে তাঁদের ফাঁকিও দিতে পারতেন। একটা ঘটনা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। একদিন টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে আমার শুটিং, অন্য ছবির কাজে অন্য ফ্লোরে ছবিদারও শুটিং আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, ছবিদা গাড়ি থেকে নামলেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে উপস্থিত সবাইকে একটা কাহিনী বললেন, গতকাল নাকি বাগানে কাজ করতে গিয়ে কীভাবে একটা গর্তে পা পড়ে পা-টা মচকে গেছে। সেই ছবির পরিচালক তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘ও তাহলে আপনাকে আর ওই ছুটে আসাটা করতে হবে না। ওটা বাদ দিয়েই ম্যানেজ করে নেব।’

সেদিন কয়েকঘণ্টা পরে ফ্লোরের বাইরে এসেছেন, আমার সঙ্গে গল্প করছেন, এমন সময় ওঁর শট রেডি বলে সহকারী পরিচালক ডেকে গেল। উনি ফ্লোরের দিকে স্বাভাবিক চালে হাঁটতে শুরু করামাত্র আমি দেখলাম একটুও খোঁড়াচ্ছেন না, পায়ে ব্যথার কোনও চিহ্নই নেই। বললাম, ‘ছবিদা, আপনার খোঁড়ানোর continuity-টা কিন্তু থাকছে না।’ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু কোন পায়ে ব্যথা বল তো? বাঁ পা-টাই হবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঁ পা-টা’ বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেলেন।

এই রসিক মানুষটির স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। ‘দেবী’ ছবিতে একদিনের শুটিং-এর কথা মনে আছে। সেদিন অভিনয়ের সময় ওঁকে ‘রঘুবংশ’ থেকে বেশ খানিকটা আবৃত্তি করতে হবে। একটা কাগজে লাইনগুলো লিখে দেওয়া হয়েছিল। সেই লাইনগুলি বারকয়েক নিজে মনে মনে ও বারকয়েক উচ্চারণ করে পড়লেন। তারপর আমাকে ডেকে কাগজটা হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই, পড়া ধর।’

আমি প্রম্পটারের মতো ওঁকে সাহায্য করতে লেগে গেলাম। কিন্তু প্রম্পট প্রায় করতেই হল না। দু-একবার বলতেই ছবিদা গড়গড় করে মুখস্থ বলতে লাগলেন সেই সংস্কৃত শ্লোকমালা। এই ধরনের আবৃত্তি কিংবা লম্বা লম্বা সংলাপ দ্রুত আয়ত্ত করার ও মনে রাখার ব্যাপারে মানুষকে চমকে দেওয়ার মতো স্মৃতি ছিল ছবিদার।

এই মানুষটির সঙ্গে ‘অতল জলের আহ্বান’-এই শেষবারের মতো কাজ করেছিলাম আমি। এই ছবির প্রথম দিনের শুটিং-এ কিন্তু সেই ছবি বিশ্বাসকে দেখলাম অনবরত সংলাপ ভুলে যাচ্ছেন, ঠিক ঠিক মনে রাখতে পারছেন না, সংলাপের একটা বিশেষ জায়গায় এসে বারবার ভুল করছেন। কীরকম যেন ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। বার্ধক্যের অবসাদ যেন এতদিনে এসে ছুঁয়ে দিয়েছে এই রাজকীয় মানুষটাকে। যত ভুলে যাচ্ছেন সংলাপ, তত রেগে যাচ্ছেন। রাগছেন নিজেরই ওপর কিন্তু রাগটা ফলাচ্ছেন ইউনিটের আর সকলের ওপর। সমস্ত ফ্লোর যেন শাহেনশাহ বাদশাহের বে-মর্জিতে তটস্থ হয়ে উঠেছে।

আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল ছবিদাকে অমন বেকায়দা অবস্থায় দেখে। ভাবলাম মানুষটাকে একটু স্থির হতে সাহায্য করি। ভয়ও করছিল। কী জানি কিছু বললে যদি আরও রেগে যান। তবু কাছে গিয়ে ওঁর পেটের ওপর হাত রেখে খুব আবদারের গলায় বললাম, ‘একটা কথা বলব? রেগে যাবেন না তো?’ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী কথা?’ বললাম, ‘রিহার্সালের সময় ওই গরম কোটটা পরে আছেন কেন? এতসব জুতো মোজা কোট-টাই পরে গরম লাগছে বলেই তো লাইন ভুলে যাচ্ছেন। এখন ওগুলো খুলুন তো, শটের সময় পরে নেবেন।’

বলেই মনে হল, এবার বোধহয় প্রচণ্ড ধমক খাব, ভীষণ রেগে যাবেন। গরম কোট পরলে সংলাপ মনে থাকবে নাকি খুললে মনে থাকবে, কী করলে শুটিং-এর সময় সুবিধে হবে, সেটা ছবি বিশ্বাসের থেকে ভাল কে জানে, কে বোঝে? ওই ছবি বিশ্বাসকে আমি, কালকা যোগী উপদেশ দিচ্ছি এই ভেবে আহত হবেন না তো?

ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছি ওঁর দিকে। উনিও ওঁর স্বভাবসিদ্ধ ফুটেজ খাওয়া তরিকায় খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, ‘বলছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ পরক্ষণে যেন ম্যাজিকের মতো মুখ থেকে সব বিরক্তি রাগ অবসাদ অন্তর্হিত হয়ে গেল। বেশকারের নাম ধরে ডেকে বললেন, ‘দে, কোটটোটগুলো খুলেই দে। ছোটকত্তা যখন বলছেন, তখন এগুলো খুলেই দেখি একটু আরাম পাওয়া যায় কি না।’

কোট জুতো খোলা হলে খানিক বসলেন। আমিও পাশে বসলাম। একটু পরে আর একটা দুঃসাহসিক কাজ করলাম। ওঁকে বললাম, ‘বলব, কেন ওই জায়গাটায় ভুল হচ্ছে?’ অদ্ভুতভাবে তাকালেন। ভাবটা যেন, সাহস তো কম নয়! তবু বললাম যে ওইখানে সংলাপের মধ্যে একটা প্রসঙ্গান্তর আছে। নতুন প্রসঙ্গটা মনে রাখলেই পরের সংলাপটা সহজেই মনে আসবে। আমি জানতাম ছবি বিশ্বাসকে এসব অভিনয়-সম্পর্কিত প্রাথমিক কথা বলাটা সত্যিই ধৃষ্টতা। তবু ওঁকে ওটা বলে বসেছিলাম। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলছিস?’ আমি ঘাবড়ে গিয়ে হাসলাম। তখন একটু মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, একবার বল কথাগুলো। বলাবলি করে দেখি।’

শট তারপর ঠিকই হল। এবং সেই শটে ছবিদা তাঁর সেই স্বভাবসিদ্ধ রাজকীয় ব্যক্তিত্ব নিয়েই অভিনয় করলেন।

শটের শেষে অন্য শটের আয়োজন হচ্ছে। ছবিদা অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা কোণে এসে বসলেন। আমি বসব বলে কাছে যেতেই ওঁর মুখটা দেখে বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে গেল। কী এক বিষাদ কী করুণ ক্লান্তিতে সেই অনিন্দ্য মুখখানি যেন আঁধার হয়ে রয়েছে। পরিবেশটা হালকা করে দেওয়ার জন্যে বললাম, ‘কী হল? কী ভাবছেন এত?’ খুব আস্তে কয়েকটা কথা ওঁর মুখ থেকে যেন আপনা-আপনিই বের হয়ে এল, ‘আর তো বনবাসের সময় হল রে।’ কথাটা শুনে ছেলেমানুষের মতো প্রায় ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিলাম আর একটু হলেই। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাট্টা করে বললাম, ‘এখুনি বনবাসের কথা ভাবছেন কী? আপনার রাজ্যপাট, সিংহাসনের কী হবে— কার হাতে এসব দিয়ে যাবেন?’ তখন তাঁর মুখখানা ভারি মধুর দুষ্টুমি-ভরা হাসিতে আলো হয়ে গেল। খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘কেন? যুবরাজরা আছেন।’ বললাম, ‘দাঁড়ান, তাঁরা বড় হোন তৈরি হোন— তারপরে ওসব ভাববেন।’ বললেন, ‘যুবরাজরা তো দেখছি ভালই তৈরি হচ্ছেন।’

এই ছবিতে উনি বাপ আমি ছেলের পার্ট করেছিলাম। একসঙ্গে অনেক অভিনয় ছিল। ফলে অনেক শিক্ষা হয়েছিল। একদিন শুটিং-এ একটা জায়গা আমার হচ্ছে না ঠিকমতো। আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কী করলে যে ঠিক হবে তা বুঝতে পারছি না। ছবিদা আমার সঙ্গে রিহার্সাল দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলছেন না। আমি গিয়ে সেই আবদারের মতো করে বললাম, ‘দেখছেন তো হচ্ছে না। বলছেন না কেন? একটু বলে দিন না কী করব? দিন না বাবা একটু দেখিয়ে।’

বললেন, ‘আমার কথাগুলো মুখস্থ হয়েছে?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘আমার movementsগুলো?’

‘হ্যাঁ।’

খুব খুশি হলেন যেন।

‘ঠিক আছে আমার কথাগুলো বলে movementsগুলো করো, তোমারটা দেখিয়ে দিচ্ছি।’

ওঁর কথা ও movements আমার মুখস্থ হয়ে গেছে বলার সময় একটু গর্ব হয়েছিল আমার। কিন্তু উনি যখন রিহার্সাল দিয়ে আমারটা করে দেখাতে লাগলেন তখন আমি তাজ্জব বনে গিয়ে দেখলাম আমার সংলাপ ও movements-ও ওঁর মুখস্থ। আমি যদিও বলিনি ওঁকে কোনখানে আমার অসুবিধেটা হচ্ছে, তবু ঠিক যেখানটায় ভুলটা হচ্ছিল সেই জায়গাটার অভিনয় করে থেমে গেলেন। বললেন, ‘বুঝতে পেরেছ এবার?’ সবটা আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল আমার কাছে। বললেন, ‘এইভাবে তাহলে করবি জায়গাটা।’ বলে পুরো শটটা দেখিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ‘Thank you. আর ভুল হবে না।’ বললেন, ‘না না, এবার নিজে কয়েকবার করো। বসিয়ে নাও জিনিসটা।’ নিজের ক্লান্তি খাটুনি উপেক্ষা করে বারদুয়েক আমার সঙ্গে রিহার্সাল দিলেন। তারপর বললেন, ‘কী, হয়েছে তো এবার? বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা?’ আমি হ্যাঁ বলতেই সম্রাটসমুচিত ভঙ্গিতে আমার দিকে যেন হেলা-ভরে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেন, ‘শিখে নাও, শিখে নাও। আর কবে শিখবে?’

অসুস্থতা ও বার্ধক্যে বিব্রত মানুষটিকে যখনই অনুরোধ করেছি তখনই যত্ন করে অভিনয়ের খুঁটিনাটি দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রম ও ক্লান্তি উপেক্ষা করে। কত উপদেশ- নির্দেশই না দিয়েছেন অভিনয়ের উৎকর্ষসাধনের জন্যে! এই সব উপদেশের মধ্যে একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘থিয়েটার করো, তোমার এখন একটু থিয়েটার করা দরকার। তাহলে তাড়াতাড়ি শিখবে।’

‘অতল জলের আহ্বান’-এর পরে ছবিদার সঙ্গে আর কাজ করার সুযোগ হয়নি। কেননা তারপরেই মোটর অ্যাক্সিডেন্টে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরে আমি স্টার থিয়েটারে ‘তাপসী’ নাটকে অভিনয় করার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হই। নাটকটির প্রথম অভিনয়রজনীর আগে স্বত্বাধিকারী সলিল মিত্র মহাশয় নিজে আমাকে সঙ্গে করে আমার জন্যে নির্দিষ্ট মেকআপ-রুমটিতে পৌঁছে দেন। এটা প্রায় তাঁর প্রথাবিরুদ্ধই কাজ ছিল। সেই মেকআপ-রুমটি তালাবন্ধ ছিল। সেটি খুলে দিয়ে সলিলবাবু বলেছিলেন, ‘এই ঘরটিতে ছবিবাবু বসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমরা এই ঘরটি বন্ধই রেখেছিলাম। আজ আপনাকে খুলে দিলাম, তার কারণ শুধু এই নয় যে আপনি আমাদের থিয়েটারে আসাতে আমরা খুশি হয়েছি— আরও বড় কারণ হল ছবিবাবুই আমাদের বলেছিলেন আপনাকে আমাদের থিয়েটারে নিয়ে আসতে। আমরা যে আপনাকে এত আগ্রহ করে, এত অনুরোধ করে আমাদের থিয়েটারে এনেছি সেটা ছবিদারই জন্যে। উনি প্রায়ই আপনার কথা বলে বলতেন, ‘ওকে নিয়ে এসো। তোমরা একটি ভাল হিরো পাবে, আর ছেলেটিও কিছু শিখবে।’

আমার অভিনয়-শিক্ষা হবে বলে পিতার মতো আগ্রহে তার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছেন তাঁর মতো অসামান্য নট, একথা ভাবলে আজও আমার মন কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে যায়। জানি না এরকম জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আজ আর পাওয়া যায় কি না। আমার পরম সৌভাগ্য, আমার তরুণ শিক্ষার্থীসময়ে এমন সব মানুষ ছিলেন।

‘অতল জলের আহ্বান’ ছবির কাজ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে আরও দুজন দুর্লভপ্রতিভার অধিকারী শিল্পীর সঙ্গে প্রথম অভিনয় করতে পারার জন্যে। এঁরা হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর রায়। তার ঢের আগে থেকেই অবশ্য লক্ষ লক্ষ বাঙালির মতো আমিও এঁদের ভক্ত ছিলাম। প্রথম যে শটটিতে একসঙ্গে কাজ ছিল সেটা খানিকটা এইরকম: অন্যমনস্ক আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বাড়ির চাকরকে তারস্বরে ডাকছি, ‘নন্দগোপাল, নন্দগোপাল’ বলে। ডাক শুনে ভানু ও জহরের আগমন। দুজনেরই মুখ ভাবলেশহীন। তাঁদের দেখে আমি বলব, ‘একি দুজন কেন? আমি তো একজনকে ডাকছি— নন্দগোপাল।’ ভানুদা বলবেন, ‘আমরাই। আমি নন্দ ও গোপাল।’ শটের সময় জহরদা এরপরেই আর একটা কথা জুড়ে দিলেন, ‘দুয়ে মিলে নন্দগোপাল।’ আমি হেসে ফেলার জন্যে শুধু সেই টেকটিই নয়, বেশ কয়েকটি টেক বরবাদ হয়ে যায়।

সেই শুরু হল ওঁদের সঙ্গে শুধু অভিনয়ই নয়, প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তুলসী চক্রবর্তী ছাড়া এঁদের দুজনের মতো কৌতুকাভিনেতা বাংলাদেশে আর হয়নি। দুজনেই তিনশোর ওপর ছবিতে অভিনয় করেছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে; এবং সে সব ছবির ক’টা চরিত্রই বা সত্যি সত্যি সুলিখিত বা সুনির্দেশিত? অনেক সময়েই তো দেখেছি পরিচালক এঁদের নির্দেশ দেওয়ার সময় নিজেই হেসে উঠে বলছে, ‘এ দৃশ্যটায় আপনারাই কিছু করে নিন— হে হে হে হে।’ এমত অবস্থাতেও এত দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার ক্ষমতা যাঁদের ছিল, তাঁরা যে অনন্যসাধারণ অভিনেতা, একথা তো তর্কের অতীত। জীবনের দ্রষ্টা, মানবচরিত্রের বোদ্ধা এই দুই অভিনেতার অভিনয়ের মধ্যে বাঙালির জীবন বারবার প্রতিভাসিত হয়েছে, কখনও মমতায় স্নিগ্ধ হয়ে, কখনও-বা সমালোচনার কটু আস্বাদে। এই দুই নটের অপরিমিত প্রাণশক্তি ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির ঝলক, ব্যঙ্গ, পরিহাস ও কৌতুকের উচ্ছ্বাস হয়ে এঁদের অভিনীত চরিত্রকে প্রাণময় রেখেছে, শারীরিক অভিনয়ের অদ্ভুত লাবণ্য, মুখ্যবয়বের অপরূপ অভিব্যক্তি এঁদের সৃজনকর্মকে শিল্পের সুষমা দিয়েছে।

শুধু অভিনয়ের সময়ই নয়, এঁদের রসবোধ ও কৌতূহলস্পৃহার প্রকাশ চারপাশের মানুষকে সর্বদাই আনন্দে অভিষিক্ত করে রাখত। আমি এঁদের দুজনেরই স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি, তবে ব্যক্তিগতভাবে ভানুদার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল, যাকে প্রায় পারিবারিক স্তরের বলা যায়। অনেক আত্মীয়ের থেকেও তিনি আমার ও আমার পরিবারের নিকট ছিলেন।

তাঁর বশংবদ ও গুণমুগ্ধ সহকর্মী অনেকেই তাঁর আপাতকোপন বিস্ফোরক কথাবার্তার জন্যে তাঁকে স্নেহচ্ছলে ‘দুর্বাসা’ বলে সম্বোধন করত।

এই নামকরণটা সম্ভবত অনুপই করেছিল। এ হেন দুর্বাসার সহস্র রাগের কারণের মধ্যে একটা বলি। ভানুদার অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকালে তাঁর কাছের লোকেদের ফোন করা এবং তাদের কাছ থেকে ফোন পাওয়া। উনি প্রত্যাশাই করতেন তারা ফোন করবে। না করলে সত্যি সত্যিই রাগ করতেন। আমার সে প্রকারের অভ্যাস না থাকায় আমাকে প্রায়শই তাঁর তিরস্কার শুনতে হত। এবং সে সব ভর্ৎসনার ভাষার তীব্রতা আভিধানিক অনুমতির বাইরেও চলে যেত বহু সময়েই।

আমাদের তখন দু’বেলা দেখা হয়। একসঙ্গে অভিনয় করা ছাড়াও একসঙ্গে অভিনেতৃ সঙ্ঘও করি। ভারতবর্ষে অভিনেতাদের এই প্রাচীনতম সংগঠনটির যাঁরা জন্ম দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন ভানুদা ও বিকাশ রায়। একদিন রোজদিনের মতোই সকালে ভানুদা এসেছেন আমাদের বাড়িতে। আমার ও আমার স্ত্রীর সঙ্গে রোজদিনকার মতোই অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে যখন উঠছেন, তখন পকেট থেকে কিছু নোট ও খুচরো পয়সা বার করে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘দীপা, এই নাও, ২৭ টাকা ১২ আনা আছে। এটা রেখে দাও।’ দীপা বলল, ‘এটা কীসের টাকা ভানুদা?’ ভানুদা উত্তর দিলেন, ‘তোমার স্বামী তো ফোন করে না, সম্ভবত ওর টাকার অভাব। এই টাকাটা দিয়ে গেলাম, এটা Quitz হলে আবার দিয়ে যাব। ওকে বোলো এবার যেন রোজ ফোন করে।’

আর একবার, তখন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তুমুল আন্দোলন প্রতি-আন্দোলন চলছে প্রেক্ষাগৃহের শ্রমিকদের একশো দিনের স্ট্রাইক নিয়ে। ভানুদা, অনুপ আর আমি অভিনেতৃ সঙ্ঘের কাজে শ্যামবাজারে অজিতেশ ব্যানার্জির বাড়ি গিয়েছি। এইখানে বলে রাখি, অজিতেশ তার আগেই ফিল্মে অভিনয় শুরু করলেও অভিনেতৃ সঙ্ঘের সভ্য হন এই আন্দোলনে আমাদের মদত দেবেন বলে। এই প্যাশনেট মানুষটির কথা বারান্তরে লেখার ইচ্ছে রইল। আপাতত ভানুদার গল্পটা বলি। আমরা তিনমূর্তি অজিতেশের বাড়ি যাওয়াতে সে গলি তো লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। কথাবার্তা বলে অজিতেশের বাড়ি থেকে বেরনোর পরে গাড়িতে উঠে গাড়ি চালানোই দায় হল। অনুপ চালাচ্ছিল, পাশে আমি, ভানুদা পেছনের সিট থেকে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে পড়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এই ভিড় থেকে বার হওয়ার জন্য অজিতেশ, অনুপ ও আমি যখন ভিড়-করা মানুষদের অনুরোধ করছি রাস্তাটা একটু ছেড়ে দিতে, সেই সময় একজন পরিহাসপ্রিয়, কিংবা সাহসী, কিংবা বোকা, কিংবা বাহাদুরি করার আকাঙ্ক্ষাপ্রণোদিত যুবক গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে কান-এঁটো করা হাসি হেসে ভানুদাকে বলল, ‘কী ভানুদা, কেমন আছেন?’

ভানুদা আমার ও অনুপের সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যাপারে আলোচনায় নিরত ছিলেন। প্রশ্ন শোনামাত্র এক পল বিলম্ব না করে ‘আগের মতোই’-বলে আবার আলোচনায় রত হলেন। এহেন তীক্ষ্ণ উত্তরের পরে ছেলেটির নিরস্ত হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু পাঁচজনার সামনে বীরত্ব প্রচারের জন্যই হোক, কিংবা বোকা বলেই হোক, অথবা ভানু ব্যানার্জি নামক লোকটির wit সম্পর্কে তার কোনও ধারণা না থাকা জন্যেই হোক, সে আবার বত্রিশ পার্টি দন্তরুচি কুমুদিত করে বলে বসল, ‘আগে কেমন ছিলেন তা তো জানি না।’ এবং বাউন্সারে হুক করে ছয় মারার মতো তৎক্ষণাৎ ভানুদার ঝটিতি উত্তর এল, ‘তাহলে অমুক (অমুক অর্থে এমন গালি যা ছাপা উচিত নয়) অখন কীরকম আছি তর জাননের দরকারটি কী?’

ভানু ব্যানার্জি ও জহর রায়ের মতো দুজন এত জনপ্রিয় কমেডিয়ানের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা পারস্পরিক ঈর্ষার বিষ তাঁদের সম্পর্ককে কলুষিত করলে আশ্চর্য হওয়ার হয়ত কিছু থাকত না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে আদতে ভানু-জহরের মধ্যে গভীর সখ্য ছিল। আর এই সখ্য এতই শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে দুজনের মধ্যে মন-অভিমান বা ছোটখাটো ঝগড়াতেও তা বিন্দুমাত্র টলত না। ওঁদের এইরকম দু-একটা মান-অভিমানের সময় দুজনেই এসে আমার কাছে পরস্পরের সম্বন্ধে নালিশ করতেন। অনেকটা যেন শিশুদের মতো। যেমন জহরদা এসে বললেন, ‘পুলু তুই একটু ভানুকে বোঝা, তোর কথা তো শোনে। সেদিন মদ্যপান করে আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নিচ থেকে ‘কমলা-কমলা’ বলে চিৎকার (কমলা জহরদার স্ত্রীর নাম)। কমলা তো জানে, কিন্তু পাটনা থেকে বাবা এসেছিলেন তখন। তিনি ভেনো সম্পর্কে কী ভাবলেন বল তো?’

আবার কোনওদিন ভানুদা আমাকে বলতেন, ‘তুই তো জহরের দোষ দেখতে পাস না; জানিস সেদিন একটা ফাংশানে এত ড্রিঙ্ক করে গিয়েছে যে সারা রাস্তা আমাকে সামলাতে হয়েছে। তুই একটু বলিস ওকে।’ বলাই বাহুল্য, পরিণতবয়স্ক এই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুর শিশু-সমুচিত কথায় আমি মনে মনে হেসেই আমার দায়িত্ব শেষ করতাম।

পুরনো দিনের কথা ভাবতে বসলে মনে হয় যে এই সমস্ত বন্ধুত্ব কত অচ্ছেদ্য ছিল। সিনেমাকর্মীদের ১০০ দিনের স্ট্রাইককে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতে একসময় চলচ্চিত্র-শিল্প প্রায় দুটো যুযুধান শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। আমাদের অভিনেতৃ সঙ্ঘও সেই সময় দু’টুকরো হয়ে শিল্পী সংসদ জন্ম নেয়, সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নও ভেঙে নতুন ফেডারেশন তৈরি হয়। এই সব ব্যাপারে উভয় তরফের মধ্যে যত তীব্র ঝগড়াঝাঁটি, যত লড়াই-ই হয়ে থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত দেখেছি বন্ধুত্বগুলি তা সত্ত্বেও অটুট থেকে গেছে।

জহরদা অভিনেতৃ সঙ্ঘ ছেড়ে শিল্পী সংসদে যোগ দিয়েছিলেন। সংগঠন ভাঙার সময় জহরদার সঙ্গে আমারও কম ঝগড়া হয়নি। আর জহরদার মতো প্রখর বুদ্ধিমান, অসাধারণ বাকপটু লোকের সঙ্গে লড়াই করেও সুখ ছিল। তবে আন্দোলন ইত্যাদির ক্ষেত্রে অবশ্য জহরদাও আমার বা ভানুদার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারতেন না। এমনি এক বিতণ্ডার সময়ে আমি আক্রমণ করার অত্যুৎসাহে ও উত্তেজনায় জহরদাকে এমন একটা কথা বলে আক্রমণ করেছিলাম, যা বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুকে কখনই বলা উচিত নয়। জহরদা তাতে খুব আহত বোধ করেন। এবং বলে ফেলার পর থেকেই আমি নিজেও মনে মনে অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত বোধ করতে থাকি। কেবলই মনে হতে থাকে যে এটা আমার খুবই অন্যায় হয়েছে। অথচ জহরদার সামনাসামনি গিয়ে মার্জনা চাইতেও কীরকম লজ্জা হচ্ছিল।

মার্জনা চাওয়ার সুযোগটা করে দিল জহরদার ঔদার্যই। প্রত্যেক বছর পুজোর পর জহরদা পোস্টকার্ডে লাল কালিতে সকলকে বিজয়ার সম্ভাষণ লিখে পাঠাতেন। ওই অত ঝগড়াঝাঁটির পরও তার ব্যতিক্রম না করে জহরদা যখন সে বছরেও আমাকে পোস্টকার্ড পাঠালেন, তখন সেই সুযোগটা আমি গ্রহণ করলাম। আমি একটা চিঠি লিখে ক্ষমাপ্রার্থী হলাম এবং চিঠির শেষে লিখেছিলাম আমার সব থেকে প্রিয় অভিনেতা যে কয়জন আছেন, তুমি তাঁদের একজন। জহরদা খুব খুশি হয়েছিলেন।

জহরদা যেদিন মারা যান, সেদিন খুব ভোরে জহরদার বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয় পূর্বরাত্রে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জহরদার জীবনাবসান হয়েছে এবং খবরটা যেন আমি ভানুদাকে জানাই।

অতএব জহরদার মৃত্যুসংবাদ ভানুদাকে জানাবার মতো কঠিন দায়িত্বটা আমাকে পালন করতে হয়। আমি ফোন করতেই ভানুদা স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘বল।’

আমি বললাম, ‘তোমার চা-টা খাওয়া হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘শরীর-টরীর ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

‘তোমাকে একটা খারাপ খবর দেব।’

‘কী?’

‘জহরদা মারা গেছে।’

‘কে বলল তোকে?’

‘বাড়ির থেকে ফোন করেছিল। তোমার ফোন পাচ্ছিল না সম্ভবত, আমায় খবর দিতে বলল।’

একটু চুপ করে থেকে ভানুদা বলল, ‘বডি কোথায়?’ আমি যখন বললাম, ‘মেডিক্যাল কলেজে’, তখন শুধু ‘আমি আসছি, তুই রেডি হয়ে থাক’ বলে ফোন ছেড়ে দিলেন।

একটু পরে গাড়ি নিয়ে এলেন। রওনা হলাম। সারাটা রাস্তা ভানুদা একেবারেই চুপ। আমি খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছিলাম, কেননা, ভানুদার শরীরও ভাল ছিল না তখন। মেডিক্যাল কলেজের কাছে যখন পৌঁছেছি, তখন হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ব্র্যাকেটটা ভেঙে গেল রে।’ বলে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন।

আমি আর ভানুদা মেডিক্যাল কলেজে যখন পৌঁছলাম, তখন আত্মীয় ও বন্ধুরা সমস্ত রাত্তির থাকার পরে সৎকার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে বাড়ি গিয়েছে, ফিল্মের অন্য কেউ তখনও আসেনি। আমরা ওয়ার্ডের বারান্দায় একটা অবহেলায় সরিয়ে রেখে দেওয়া খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। জহরদার দেহটা ঢাকা দেওয়া আছে একটা পর্দার কাপড়ে, শোভন-সাদা চাদরও জোটেনি। ভানুদা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুতে এই কি জহরের পাওনা ছিল দেশের কাছে? একটা সাদা চাদরও কি ও পেতে পারত না? বিদেশ হলে এত বড় অভিনেতাকে তো নাইটহুড দিত রে।’

তারপর ভানুদাও একদিন চলে গেলেন। আমার কিন্তু বিশ্বাস ভানু-জহরের ব্র্যাকেটটা ভাঙেনি। বাঙালির সংস্কৃতির একটা উজ্জ্বল সম্পদ হয়ে তা ইতিহাসে আশ্রয় পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *