অভিনয়ের ইতিহাস হারিয়ে যাবে কেন?

অভিনয়ের ইতিহাস হারিয়ে যাবে কেন?

মানুষের শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বয়সও অবশেষে শতবর্ষে পৌঁছে গেল। এই উপলক্ষে গোটা পৃথিবীতেই নানা ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠান হয়েছে, হচ্ছে। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই নানাভাবে চলচ্চিত্রের আলোড়িত ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে।

অঙ্কের হিসেবে বাংলা ছায়াছবির বয়স শতবর্ষ না হলেও খুব নবীন সে নয়, তারও এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। এই দীর্ঘ ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও চর্চার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব বোধহয় বাংলার চলচ্চিত্র-রসিক, সমালোচক ও চলচ্চিত্রসেবীদের রয়েছে।

অভিনেতা হিসেবে স্বভাবতই আমি সেই সামগ্রিক ইতিহাসের মধ্যে অভিনয়-শৈলীর ইতিহাস খোঁজার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। যে কোনও প্রাণবন্ত শিল্পকর্মের মতো, বাংলা ছায়াছবিতেও প্রতিভাবান ও দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যক্তিগত সৃষ্টিশীলতায় যে মূল্যবান ও স্মরণযোগ্য অভিনয় দেখা গেছে, তা কোন চলচ্চিত্র-রসিক অস্বীকার করবেন? ব্যক্তিগতভাবে আমার একাধিকবার মনে হয়েছে, শুরু থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত— এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের ধারার মধ্যে কোনও বিবর্তন আছে কিনা, বা থাকলে কীভাবে তা এসেছে সেই সত্য খুঁজে বার করার পক্ষে চলচ্চিত্রশিল্পের শতবর্ষ পূর্তিই সম্ভবত শ্রেষ্ঠ সময়। বাংলা চলচ্চিত্রের আগামীদিনের দর্শক, কর্মী ও গবেষকদের কাছে এই মূল্যবান অভিনয়-ইতিহাস তুলে ধরার প্রশ্নে আমাদের দেখতে হবে এই অভিনয় ধারায় কোনও বিশেষ শৈলী আছে কিনা, থাকলে তার বিভিন্নতা সম্পর্কেও সযত্ন অনুসন্ধান করতে হবে। এই ইতিহাস যেমন লিখিত আকারে গ্রন্থিত হতে পারে, তেমনি একাধিক তথ্যচিত্র নির্মাণের ভেতর দিয়েও তা সার্থকতরভাবে সংরক্ষিত হতে পারে।

অভিনয়ের ধারা ও স্মরণীয় শিল্পীদের নিজস্ব স্টাইল ছড়িয়ে আছে অতীত দিনের ছবিগুলিতে; অবশ্য পালনীয় শর্ত হিসেবে গবেষক-পরিচালককে সেই সব ছবি নতুন করে দেখে, বিশ্লেষণ করে বাংলা ছায়াছবিতে অভিনয়ের ইতিহাস-সম্পর্কিত তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে হবে। অভিনেতা হিসেবে আমি নিজে পুরনো দিনের সব উল্লেখযোগ্য অভিনয়-শিল্পের প্রশ্নে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি তা নয়। প্রাসঙ্গিক হিসেবে যা স্মৃতির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তাই-ই উল্লেখ করছি।

‘বাঙালী’ নামে একটা ছবি দেখেছিলাম, যতদূর মনে পড়ছে পরিচালক ছিলেন— প্রফুল্ল রায়। তদানীন্তন কালের নামী অভিনেতাদের অনেকেই সেই ছবিতে কাজ করেছিলেন। তুলসী লাহিড়ী ছিলেন, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে, সম্ভবত নির্মলেন্দু লাহিড়ীও সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। একই ছবিতে সেই সময়ের দু’জন বিখ্যাত অভিনেতা কাজ করেছেন, অথচ দু’জনের অভিনয়-শৈলী ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। অভিনয়ের ইতিহাস নিয়ে ছবি তৈরির সময় এ ধরনের ছবি ও এই সব ছবির অভিনেতাদের কাজের ধারা, উৎস বিশ্লেষণ-সহ ছবিতে ব্যবহার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত একেবারে এই আধুনিককালে বা কয়েক দশক আগে অর্থাৎ বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সময়ে অভিনয়ের কোন ধারা অক্ষুণ্ণ থেকেছে, কোন ধরনের অভিনয় বিদগ্ধজনের প্রশংসা পেয়েছে বা কী ধরনের অভিনয় জনপ্রিয় হয়েছে— এ সব প্রশ্নও এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে।

একটা সত্য আমরা সকলেই জানি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম পর্বে যে-সব অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করতে আসতেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আসতেন সরাসরি থিয়েটার থেকে। তাঁদের কাজে থিয়েটারের প্রত্যক্ষ প্রভাব অবশ্যই থাকত। সময়ের হিসেব নিয়ে দেখলে দেখা যাবে থিয়েটার থেকে সরাসরি সিনেমায় অভিনয় করতে আসার এই প্রবণতা অনেকদিন পর্যন্ত চালু ছিল। অনেক নামী অভিনেতা এভাবেই বাংলা ছায়াছবিতে এসেছেন, এক্ষুনি যাঁর নাম মনে পড়ছে তিনি— দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে বরং এই প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেছে; থিয়েটার থেকে অনেকে এসেছেন কিন্তু তার চেয়ে বেশি এসেছেন বোধহয় বাইরের থেকে, অর্থাৎ সিনেমায় অভিনয় করার জন্যেই অভিনেত্রী তৈরি হয়েছেন। তবে থিয়েটার থেকে সিনেমায় কাজ করতে বিখ্যাত অভিনেত্রীদের কেউ আসেননি তা নয়, যেমন প্রভা দেবী।

কোনও একটা সময় চিহ্নিত করে আলোচনা করলে কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। বাংলা ছায়াছবির সেই পর্বের অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গে যদি প্রমথেশ বড়ুয়ার আমল ধরি, তাহলে তখনকার অভিনেত্রীদের অধিকাংশই সিনেমায় অভিনয় করবেন বলে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সেই সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী চন্দ্রাবতী দেবীর দিদি কঙ্কাবতী দেবী থিয়েটারের অভিনেত্রী ছিলেন, সুতরাং অভিনয়-শিল্প সম্পর্কে চন্দ্রাবতী একেবারে অনভিজ্ঞ ছিলেন, তা বলা যায় না। চন্দ্রাবতী সরাসরি সিনেমাতেই অভিনয় শুরু করেন বলেই মনে হয়, কারণ চন্দ্রাবতীর থিয়েটারের অভিনয় সম্পর্কে তেমন কিছু শোনা যায় না। বড়ুয়া সাহেবের অন্যান্য যে সব অভিনেত্রী ছিলেন, যেমন মেনকা দেবী, তিনিও সরাসরি সিনেমাতেই তাঁর অভিনয়জীবন শুরু করেছিলেন বলে শুনেছি।

প্রমথেশ বড়ুয়া নিজেও থিয়েটারের অভিনেতা ছিলেন না; সিনেমায় কাজ শিখতেই তিনি বিদেশে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে ছবি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে নিজেও অভিনয় করতে শুরু করেন।

দুই

সিনেমায় থিয়েটার-প্রভাবিত অভিনয় এবং পুরোপুরি সিনেমার পক্ষে উপযুক্ত সংযমী অভিনয়— এই পার্থক্যের প্রসঙ্গ বোধহয় বাংলা ছায়াছবিতে অভিনয়ের ইতিহাস প্রসঙ্গ তুললে প্রথমেই এসে পড়বে। প্রমথেশ বড়ুয়ার কথাই ধরা যাক। বাংলা চলচ্চিত্রের এক সময়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব; তাঁর অভিনয় নিয়ে সেই আমলে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। যদি আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় তাহলে বলতে হবে, সিনেমায় তাঁর অভিনয় থিয়েটারের মতো নয় ঠিকই, কিন্তু সিনেমার আধুনিক ধারার সঙ্গেও তা মেলে না। আরও নির্দিষ্ট করে বললে— ওঁর অভিনয় বাংলা সিনেমায় একটা বিশিষ্ট ধারা হিসেবে বেঁচে আছে, বড়ুয়া সাহেবের অভিনয়ভঙ্গি শুধু ওঁকেই মানাত, অন্য কোনও অভিনেতা ওঁর স্টাইল-এ অভিনয় করলে সেটা বীভৎস কাণ্ড হয়ে দাঁড়াবে।

এখানে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইতিহাস একটা বিশাল বড় ব্যাপার, সে- সংক্রান্ত তথ্যচিত্র তৈরি হলে কী পদ্ধতিতে এই বিষয় নিয়ে অন্বেষণকেন্দ্রিক ছবি তৈরি হবে? একাধিক পথ দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়। প্রাথমিক চিন্তায় বলা যায়, যাঁরা থিয়েটার থেকে সিনেমায় এসেছেন, সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে একটা অংশ আর যাঁরা সরাসরি ছায়াছবিতে কাজ শুরু করেছেন তাঁদের অপর অংশে রেখে তথ্যচিত্র নির্মিত হতে পারে। এ ছাড়া আরও একটা উপায় আছে, নিজেদের অভিনয়-প্রতিভায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন এমন কয়েকজন স্মরণীয় চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলাদা করে ডকুমেন্টারি তৈরি করা যায়।

সিনেমার শতবর্ষে পৌঁছেও আমাদের চলচ্চিত্র মহলে বা সরকারি স্তরে বাংলা সিনেমার ইতিহাস ধরে রাখার কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সচেতন মানসিকতা নিয়ে, দিকপাল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণে অনেক আগেই উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের জীবনচর্চায় এসব অভ্যাস নেই, কখনও সেভাবে ছিল না। দেশের, বিদেশের সিনেমা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে; বিদেশি ছবি দেখা, বই বা পত্র-পত্রিকা পড়াও হয়েছে— বলতে পারি পণ্ডিত, বিদগ্ধ সমালোচক এবং উৎসাহী চলচ্চিত্র-রসিক সকলেই নিজেদের কর্মে ও চিন্তায় ব্যস্ত থেকেছেন, কিন্তু উপেক্ষিত থেকেছে বাংলা সিনেমা, বাংলা চলচ্চিত্রের কোনও বিস্তারিত নির্ভরযোগ্য ইতিহাস আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি।

ভাবতে দুঃখ হয় বাংলা সিনেমার বিরাট মাপের কোনও অভিনেতারই অভিনয়-শৈলীর কোনও হিসেব বা সুসম্পাদিত রেকর্ড রাখা হয়নি। চলচ্চিত্রের ইতিহাস, অভিনয়-শৈলীর ইতিহাস যথাযথভাবে ধরে রাখার দায়িত্ব ঠিক কার, তা আমি জানি না; সাধারণ অর্থে যদি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়, তাহলে বলতে হবে বাংলা চলচ্চিত্র-সম্পর্কে যাঁরা উৎসাহী তাঁরাই এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এ ব্যাপারে আমাদের দেশের সিনে ক্লাব, সিনে সোসাইটিগুলোরও একটা ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। গত ৩০ বা ৪০ বছরে এইসব সংস্থা থেকে পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, লেখক-সমালোচকরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়মিত চিন্তা ও চর্চায় চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণ করেছেন, নিজেদের লেখার উন্নতি করেছেন। সর্বত্র যা যা ঘটার সবই ঘটেছে, কিন্তু কোথাও কখনও অভিনয়-শিল্প নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে আলাদা চেহারায় কিছু লেখা হয়নি। কী করে অভিনয়ের যথার্থ মূল্যায়ন এই সব সিরিয়াস চলচ্চিত্র-রসিকদের নিজস্ব চর্চা থেকে বাদ পড়ল তা আমি বুঝিনি। একজন অভিনেতা হিসেবে ফিল্ম সোসাইটিগুলোর চলচ্চিত্রচর্চার এই দুঃখজনক দিকটা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। যাঁরা সিনেমা সম্পর্কে সত্যিই একটু বেশিমাত্রায় আগ্রহী, তাঁরা সকলেই স্বীকার করবেন আমাদের দেশের ফিল্ম সোসাইটিগুলোর যে আন্দোলন, তা বাংলা সিনেমার অভিনয়-শৈলীর মূল্যায়নেও একটা বড় ভূমিকা নিতে পারত। এদেশে ফিল্ম ক্লাব বা সোসাইটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা সিনেমায় স্টার সিস্টেম-এর প্রবল দাপট ছিল অর্থাৎ সাধারণ দর্শকদের কাছে স্টারদের উপস্থিতিই ছিল সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ফিল্ম সোসাইটির প্রগতিশীল চলচ্চিত্র-রসিকরা এই স্টার-সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যে, চলচ্চিত্র আসলে পরিচালকেরই মাধ্যম। কিন্তু একটা সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য সত্যটি তাঁরা বিস্মৃত হয়েছিলেন। বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরজা-জানালা সম্পর্কে অভিজ্ঞ সমালোচক-লেখকরা চলচ্চিত্রে পরিচালকের নির্মাণ-কৌশল, ক্যামেরার যথাযথ ব্যবহার, কারিগরি দক্ষতা, চিত্রভাষা, সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ক ইত্যাদি নানা মূল্যবান বিষয়ে উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করেছেন, কিন্তু দুঃখের কথা স্টার-এর প্রাধান্য খর্ব করে পরিচালকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উপেক্ষা করেছেন।

তিন

একটা ছায়াছবি যে পরিচালকের চিন্তা বা পরিচালন দক্ষতারই সৃষ্টি, এ কথা সাধারণভাবে স্বীকার না করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সত্য নির্ভুল বিচারে উপস্থিত করতে গেলে বলতে হয়, সিনেমা মাধ্যমটি শুধুমাত্র পরিচালকেরই মাধ্যম নয়। কোনও স্টার বা অভিনেতা পরিচালকের হাতের পুতুল বা কাদার তাল— যেভাবেই ভাবা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত অভিনেতা- অভিনেত্রীদের নিজেদেরও কিছু দেওয়ার থাকে। কারণ, মূর্তি গড়ার উপকরণ হিসেবে এখানে সত্যিই তো কাদা বা ময়দার তাল পরিচালকের হাতে থাকে না, যা থাকে তা জড়পদার্থের বদলে অতুলনীয় মানব-উপকরণ। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা না থাকলে কোনও বিশেষ চরিত্রের জন্য পরিচালক বিশেষ একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নির্বাচন করেন কেন? শুধু চেহারার মিল থাকাই নিশ্চয় একমাত্র কারণ নয়। মানুষের মনেরও একটা নিজস্ব প্রতিক্রিয়া থাকে, খুব বড় পরিচালকরা উঁচুমানের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সেই নিজস্ব প্রতিক্রিয়াকেই কাজে লাগিয়ে অসামান্য অভিনয়-দৃশ্য সৃষ্টি করেন। নিজে একজন অভিনেতা হিসেবে এখানে আমি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বক্তব্য পেশ করতে চাইছি— এ ব্যাপারে আমার মনে কোনও দ্বিধা নেই। প্রারম্ভিক ভূমিকা ছাড়াই যদি কোনও চলচ্চিত্র-রসিককে প্রশ্ন করা যায়— এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিনেমা-ব্যক্তিত্ব কে? অনুমান করতে পারি তিনি দ্বিধাহীনভাবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলবেন— চার্লস চ্যাপলিন। সেই চ্যাপলিনের চিত্রনির্মাণের কাজে শ্রেষ্ঠ উপকরণ ছিল তাঁর প্রধান অভিনেতাটি, অর্থাৎ চ্যাপলিন নিজে। তাঁর সব ছবিতে অভিনয়ের মধ্যেই তিনি নিজের বক্তব্যকে সবচেয়ে জোরালোভাবে উপস্থিত করেছেন। পরিচালক হিসেবে কাস্টিং, এডিটিং, ক্যামেরা চালানো, শট নেওয়ার বৈচিত্র্য ইত্যাদি পেরিয়ে দর্শকদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে তাঁর ছবির প্রধান অভিনেতাটির অভিনয়। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের প্রভাব নিয়ে আরও উদাহরণ দেওয়া অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছি। চলচ্চিত্রের অভিনেতারা যে একটা বড় ভূমিকা দখল করে রাখেন সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। মজার কথা হচ্ছে এই সত্য আমরা সকলেই জানি, কিন্তু সবসময় মনে রাখি না। এ ব্যাপারে বিদেশের ছবি কিন্তু অন্যরকম, সেখানে অভিনয়, অভিনয়ের মান নিয়ে বিস্তর কাজ হয়েছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাজ নিয়ে প্রবন্ধ লেখা, আলোচনা, বিতর্ক ছাড়া কঠোর সমালোচকদের বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন— সবই মূল্যবান বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

যা হয়নি তা নিয়ে অকারণ শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলা বা ক্রমাগত সমালোচনায় বিদ্ধ করার বিকৃত আনন্দে মগ্ন থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। প্রত্যক্ষভাবে ইতিহাসের প্রতিফলন ধরে রাখা, যথার্থ মূল্যবান গ্রন্থ এখনও লেখা হতে পারে, আর সেই বই থেকেই হতে পারে ঐতিহাসিক তথ্যচিত্র। এতদিন পরে, এই আধুনিক সময়ে বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও অভিনয় নিয়ে বিদেশের মতো প্রয়োজনীয় কাজ হওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।

ইদানীং বোম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমাতেও এক ধরনের বিশ্লেষণ-মূল্যায়নের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, অবশ্যই মোটা দাগের কাজ, কিন্তু মূল্যায়নের এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করতেই হয়। হিন্দি সিনেমার প্রধানত মনোরঞ্জক ছবিতে যাঁরা স্টার, যাঁরা সেই সব ছবি তৈরি করেছেন, তাঁদের কাজেরও সামাজিক মূল্যায়ন হচ্ছে। রাজকাপুরকে নিয়ে করা হয়েছে, আরও কয়েকজন এই তালিকায় আছেন। আমাদের এখানেও এ ধরনের কাজ হতে পারে। বাংলা ছবিতে আগে যাঁরা স্টার ছিলেন, যাঁরা বড় অভিনেতা ছিলেন— উভয় পর্যায়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়েই কাজ হোক। বাংলা সিনেমার ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য তা একান্তভাবে প্রয়োজন।

চার

হয়ত কেউ কেউ সামান্য অবাক হবেন, কিন্তু অভিনয়ের ধারা সম্পর্কে আলোচনায় এমন সত্যের আত্মপ্রকাশ অত্যন্ত জরুরি। সিনেমার আধুনিক স্টাইলের সঙ্গে মেলে এমন অভিনয়ের একটা ধারা বাংলা চলচ্চিত্রে একেবারে শুরু থেকেই ছিল। এই স্বাভাবিক ধারার অভিনয় যাঁরা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন তাঁরা তো নিজস্ব যোগ্যতাতেই তথ্যচিত্রের বিষয় হতে পারেন। অনেকদিনের পুরনো ছবির সব প্রিন্ট হয়ত পাওয়া যাবে না, যা পাওয়া যাবে তা থেকেই এইসব দক্ষ অভিনেতার কাজের সুনির্বাচিত অংশ বিশেষ তথ্যচিত্রে বিশ্লেষণ-সহ ধরে রাখতে হবে।

বাংলা সিনেমার একেবারে শুরুর সময় থেকেই স্বাভাবিক ও সংযমী অভিনয়ের স্টাইল নিয়ে এসেছিলেন তুলসী লাহিড়ী। আর একজনের নামও একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হবে, তিনি— যোগেশ চৌধুরি। যোগেশ চৌধুরি তাঁর সময়ে এতটাই স্বাভাবিক ধারার অভিনয় করেছেন যে দেখলে বিস্মিত হতে হয় এবং আজকের বিচারেও বোধহয় তা আধুনিক। অসামান্য দক্ষতায় সিনেমায় অভিনয়ের ভিত্তি ও মাত্রা নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন বলেই তুলসী লাহিড়ী ও যোগেশ চৌধুরিকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা দরকার।

তুলসী লাহিড়ীর সমসাময়িক কালের আর একজন স্মরণীয় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী। (১৮৯৯-১৯৬১) তিনি তুলসী লাহিড়ীর চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই একজন যুগন্ধর অভিনেতা, এঁর মতো অভিনেতা খুব কমই জন্মগ্রহণ করেন। তুলসী চক্রবর্তী অবশ্য একই সঙ্গে থিয়েটার ও সিনেমার মানুষ, উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত স্বচ্ছন্দবিহারী ছিলেন। বাংলা সিনেমার সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্কও যাঁর আছে, তিনিই জানেন তাঁর অভিনয়-শৈলী কত দূর স্বাভাবিক ছিল। আপাদমস্তক জীবনরসিক তুলসী চক্রবর্তীর জীবন বড় বিচিত্র। শৌখিন সংস্থায় নাট্যাভিনয়, পরে ‘বোসেজ সার্কাস’-এ শরীরচর্চার খেলা এবং স্টার থিয়েটারে নাটক দিয়ে তাঁর অভিনয়-জীবন শুরু হয়েছিল। একসময় তিনি ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারেও কাজ করেছিলেন বলে শুনেছি। সিনেমা ও থিয়েটার উভয় মাধ্যমে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিস্ময়কর দক্ষতা তাঁর ছিল এবং সিনেমায় তাঁর অভিনয়ের স্টাইল একেবারে স্বাভাবিক ধারার। যে-আমলে তিনি সিনেমায় অভিনয় শুরু করেছিলেন, তখন অধিকাংশ ছবিতেই তাঁর চারপাশে থিয়েটারধর্মী অভিনয় দেখা যেত, তিনি ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম। পরিচালক সত্যজিৎ রায় নিজে তুলসী চক্রবর্তীর অসাধারণ অভিনয়-ক্ষমতার প্রতি বিশেষভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জানি সত্যজিৎও আমার মতোই ভাবতেন— তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতা হয় না, তিনি কোনও ছবিতেই কখনও খারাপ অভিনয় করতে পারেন না। প্রায় চল্লিশ বছরের অভিনয়-জীবনে তুলসী চক্রবর্তী অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন। একেবারে শুরুর দিকের কিছু ছবি অর্থাৎ ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘অঞ্জনগড়’, ‘প্রভাস মিলন’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘রাধারানী’, ‘ভুলি নাই’— এই ছবিগুলো বা সেই সময়ের অন্য ছবিগুলোর প্রিন্ট হয়ত এখন পাওয়া যাবে না; কিন্তু পরের দিকের ছবিগুলো, যেমন— ‘সবার উপরে’, ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘অসমাপ্ত’, ‘কুহক’, ‘গলি থেকে রাজপথ’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ইত্যাদি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ‘পরশপাথর’, ‘পথের পাঁচালী’ তো আছেই। প্রায় একই সময়ের অভিনেতা ছবি বিশ্বাস; তখনকার দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি আগে থিয়েটারে কাজ শুরু করেছিলেন, সেখানে সুনাম অর্জনের পর সিনেমায় এসেছিলেন। ছবি বিশ্বাসের নিজের অভিনয়ের মধ্যে বোধহয় এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল, মাঝে মাঝে তাঁর অভিনয়-শৈলীর মধ্যে থিয়েটারের প্রভাব এসেছে। কিন্তু মূলত তিনিও স্বাভাবিক ধারার অভিনয় দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং সেই ধারার অভিনেতা হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে পরিণত বয়সে, তিনি চরিত্রাভিনেতা হিসেবে ব্যক্তিত্ব আরোপের দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, বলা যায় বাংলা সিনেমায় একাই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে অসামান্য অভিনয়ের ফলে ছবি বিশ্বাস সম্ভবত ভারতীয় চলচ্চিত্রেই এক আর্কিটাইপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।

যে-অর্থে ছবি বিশ্বাস অভিনয়-শিল্পের একটা প্রতিষ্ঠান, প্রায় একই অর্থে উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন জুটি, জহর রায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও অভিনয়-শৈলীর এক একটা প্রতিষ্ঠান। যে স্তরের অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে অসাধারণ ও সুন্দর তথ্যচিত্র হতে পারে এমন বেশ কয়েকজন উঁচুজাতের অভিনেতা বাংলা সিনেমায় এসেছেন, বলতে পারি বাংলা সিনেমা তাঁদের পেয়ে ধন্য হয়েছে। প্রতিষ্ঠানস্বরূপ অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী ও ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তো অবশ্যই দুটি আলাদা তথ্যচিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। এখনও পর্যন্ত যিনি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় চিত্রপরিচালক, তাঁর একাধিক ছবিতে এই দুই দিকপাল অভিনেতা বিশিষ্ট ভূমিকাগুলিতে অভিনয় করেছেন, বলা যায় সেই সব ছবির অভিনয় এঁদের জীবনের কালমিনেটিং পয়েন্ট।

যে বিষয় গুরুত্বে ও শিল্পের প্রশ্নে মূল্যবান তা নিয়ে আলোচনা সহজে শেষ হয় না। তুলসী চক্রবর্তীকে তো সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবিতে নিয়েছিলেন।

এখানে প্রাসঙ্গিক হিসেবে একটা বহু আলোচিত কথা বলতে হবে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকার জন্য আমাকে নানা অনুষ্ঠানে, আলোচনাসভায় ফিল্ম নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য শুনতে হয়, কোথাও আবার আমাকেই কিছু বলতে হয়।

একটা ভ্রান্ত ধারণার কথা শুনে থাকি যে ব্যতিক্রমী বা তথাকথিত শিল্পগুণান্বিত চলচ্চিত্রে নাকি পেশাদার অভিনেতাদের ভূমিকা খুবই কম, সেখানে নবাগত-নবাগতা শিল্পীদেরই বেশি দেখা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়ত ‘বাইসাইকেল থিফ’ সেইভাবেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে যিনি নতুন পথের দিশারী, সেই সত্যজিৎ রায় কিন্তু তাঁর প্রথম ছবি থেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে এ ধরনের কোনও পার্থক্যের দিকে নজর দেননি। তাঁর প্রথম ছবিতেই ছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, রেবা দেবী ও চুনীবালার মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং এঁরা সকলেই ছিলেন পেশাদার। ‘পথের পাঁচালী’তে আবার নবাগত-নবাগতারাও ছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনে সত্যজিতের চিন্তাধারা ছিল খুবই পরিষ্কার। ছবির মধ্যে বিশেষ চরিত্রটির জন্য যাঁকে প্রয়োজন, উনি তাঁকেই নিতেন। সে ব্যাপারে অপেশাদার নবাগত বা পেশাদার ইত্যাদি প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। এখন প্রশ্ন, সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবিতেই তুলসী চক্রবর্তীকে কেন নিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই তিনি নিজের ছবিতে নেওয়ার আগে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনীত ছবি দেখেছিলেন, ‘উদয়ের পথে’ তো বটেই, এ ছাড়া সেই সময়ের বিস্তর ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীকে ছোটবড় চরিত্রে দেখা যেত।

এমন অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন যাঁরা একজন অসাধারণ পরিচালকের কাছে কাজ করার পর তাঁদের নিজেদের কাজের একটা উত্তরণ ঘটেছে। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী এক্ষেত্রেও একেবারে আলাদা জাতের শিল্পী। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করার আগেই তিনি একজন সম্পূর্ণ ও দক্ষ অভিনেতা ছিলেন এবং সত্যজিৎ রায়ও এ সত্য জেনেই তাঁকে নিয়েছিলেন। ছবি বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, তিনিও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার আগেই বড় অভিনেতা ছিলেন। প্রয়োজনে ছবির চরিত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব আরোপ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। ‘জলসাঘর’ ছবিতে সত্যজিৎ রায় তাঁকে সেইভাবেই ব্যবহার করেছেন।

কিন্তু ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে ছবি বিশ্বাসের কাজ দেখে মনে হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করার পরই যেন তাঁর এমন অসাধারণ কাজ দেখা গেল। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস অনেক ছবিতে প্রায় এ ধরনের কাজ অবশ্যই করেছেন, কিন্তু ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবি বিশ্বাস আশ্চর্য ও বিস্ময়কর, যা স্থিতধী, অন্তর্চারী ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়ের একটা স্মরণীয় উদাহরণ হয়ে আছে। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ছবি বিশ্বাসকে দেখে মনে হয়েছে, সত্যজিতের মতো অসাধারণ পরিচালককে পেয়েই যেন তিনি তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করার আগে অভিনেতা হিসেবে ছবি বিশ্বাসের পূর্ণতা পাওয়া বা বিবর্তিত হওয়ার কিছু ছিল না, কিন্তু তাঁর যে আরও কত কী দেওয়ার ছিল তা আমরা আগে বুঝতে পারিনি। এক্ষেত্রে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকা নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখছি না, কারণ তা সকলেই জানেন। তেমন বিখ্যাত পরিচালকের ছবি নয় এমন ছবিতেও ছবি বিশ্বাস তাঁর অভিনয়-শৈলীর পরিচয় রেখেছেন, যে কোনও চলচ্চিত্র-রসিক অনায়াসে সেইসব ছবির হদিশ দিতে পারবেন। তথ্যানুসন্ধানী ও বিশ্লেষণে দক্ষ তথ্যচিত্র পরিচালক ছবি করার সময় সেইসব ছবি থেকেও একাধিক দৃশ্য ব্যবহার করতে পারবেন।

পাঁচ

উন্নতমানের পরিচালকের কাছে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাজের উন্নতি হয়। কথাটা পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন, না হলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। এমন অনেক বিখ্যাত, দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, যাঁদের অভিনয়-জীবন বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে এবং কোনও শিল্পীর কাছেই তা কম বড় প্রশংসার কথা নয়। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে উত্তমকুমারের নাম মনে পড়ছে। বাংলা ছবির দর্শকমাত্রই জানেন উত্তমকুমার একজন কত বড় দক্ষ অভিনেতা ছিলেন। আমার ব্যক্তিগত বিচারে তাঁর অভিনয়-জীবনে কয়েকটা মাইলস্টোন ছিল। যেমন নির্মল দে-র পরিচালিত ছবি ‘বসু পরিবার’। তার আগে তিনি কোনও ছবিতে ভাল অভিনয় করেননি তা নয়, কিন্তু ‘বসু পরিবার’ ছবিতে তাঁর কাজ আরও উঁচুস্তরে পৌঁছেছিল। আবার বেশ কিছুকাল পরে উত্তমকুমার যখন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে কাজ করলেন, তখন তাঁর অভিনয় যেন আরও কয়েক ধাপ উঁচুতে উঠে গেল। সিনেমা-অভিনেতা হিসেবে উত্তমকুমার আত্মনিয়ন্ত্রণে আরও দক্ষ হলেন, সামগ্রিকভাবে সুদক্ষ অভিনেতা উত্তমকুমারের অভিনয় একটা বাড়তি মাত্রা পেয়ে গেল বলে মনে হয়েছিল।

সারাজীবন ধরে অভিনেতা উত্তমকুমার ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছিলেন বলে আমি মনে করি। এখনও পর্যন্ত উত্তমকুমার বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তম নায়ক, কিন্তু তাঁকে নিয়ে এতদিনেও কোনও তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়নি; এতে শুধু বিস্মিত নয়, হতবাক হতে হয়। বেশিরভাগ দর্শকের কাছে তিনি কিংবদন্তি নায়ক, রোমান্টিক নায়কের ভূমিকায় অভিনেতা— এই চিন্তাতেই তিনি কিংবদন্তির জায়গায় পৌঁছেছেন। কিন্তু কখনও বোধহয় এই বিচারে যাওয়া হয়নি যে, তাঁর অভিনয়ের প্রাথমিক জোরগুলো ঠিক কোথায় ছিল!

প্রেমিকের ভূমিকায় বা একজন রসিক মানুষের ভূমিকায় উত্তমকুমার কেন বেশি সফল, ভাবা হয়নি তাও। আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে যেখানে বাংলা সিনেমায় ওঁর কোনও তুলনা আছে বলে আমার মনে হয় না সেটা হচ্ছে— রোমান্টিক কমেডি। উদাহরণ? বিভিন্ন সময়ের অসংখ্য ছবি ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। ‘চিরকুমার সভা’-র পূর্ণ-কে মনে পড়ছে? তার কিছুকাল পরে প্রভাত মুখার্জি পরিচালিত তারাশঙ্করের লেখা ‘বিচারক’ ছবিতে ওঁর অভিনয় উদাহরণ হিসেবে মনে পড়ছে। সেই ছবিতে উনি একজন বয়স্ক বিচারক; ফ্ল্যাশব্যাক-এ যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তরুণ বয়সে কী করে তাঁর বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে পূর্বরাগ পর্ব চলেছিল। সেখানে প্রেমিক হিসেবে তিনি হাজির। একই সঙ্গে নার্ভাস হয়ে পড়া, আচার-আচরণে বেশ খানিকটা বোকা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি তিনি যে কী অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে তাঁর অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন! মজার দৃশ্য, কিন্তু তার মধ্যেও তাঁর প্রেমিক-হৃদয়ের পরিচয় অক্ষুণ্ণ ছিল, সব মিলিয়ে সেই দৃশ্যগুলোতে তাঁর অভিনয় অত্যন্ত মধুর ও সৌন্দর্যময় মনে হয়েছিল। নিজের কোনও প্রিয় ভঙ্গি বা জোর করে দেখানো বোকামি নয়, সেখানে তিনি যেন পৃথিবীর সব প্রেমিকের হয়ে সেই দৃশ্যের বোকামিটুকু প্রকাশ করেছিলেন, আমার বিচারে বাংলা ছবিতে রোমান্টিক কমেডির এটা একটা স্মরণীয় উদাহরণ। তাঁর জীবনের একাধিক ছবিতে এই ধরনের অভিনয়-দক্ষতার পরিচয় আছে।

উত্তমকুমারের অভিনয়ের আর একটা উজ্জ্বল দিক হল নিজের বিশেষ অনুভব, অভিজ্ঞতা অভিনীত চরিত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারা। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের একজন বড়ভাই, বাড়ির সমস্ত দায়দায়িত্ব কাঁধের ওপর, পারিবারিক কাঠামোর চালিকাশক্তি, রক্ষাকর্তা— এই যে বড়ভাই, এমন ভূমিকায় অভিনেতা উত্তমকুমারের তুলনা আমি আজও পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় দেখতে পাইনি। সারাজীবনে যে সব ছবিতে উনি এ ধরনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, সেখানে অবাক হয়ে তাঁর কাজ দেখতে হয়েছে। এ ধরনের ভূমিকার উদাহরণ হিসেবে ‘বসু পরিবার’-এর উল্লেখ আগেই করেছি, পরের দিকে আছে ‘দুই পৃথিবী’। এ দুটো ছবির মাঝখানে উত্তমকুমারের অসামান্য অভিনয়-ধন্য একটা ছবি আছে— ‘নগরদর্পণে’। দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘নগরদর্পণে’ ছবি হিসেবেও ভাল ছবি, বড়ভাই উত্তমকুমার সেখানে এক কথায় অনবদ্য। ব্যক্তিগত জীবনে ভবানীপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবারে তিনি দায়িত্বশীল বড়ভাই ছিলেন, বাঙালির সামাজিক কাঠামোয় এ-ধরনের চরিত্রের যে-স্থান— এ দুটোই তাঁর অভিনয়ে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। আমার কাছে ব্যাপারটা অ্যানথ্রোপলজিক্যাল কিউরিওসিটির মতো মনে হয়— কী করে উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রটি বাঙালির পারিবারিক জীবনের বৈশিষ্ট্য এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল।

ছয়

বাংলা সিনেমায় কৌতুক অভিনয়েরও একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ধারা আছে, সেই অর্থে কমেডি অভিনেতাদের অভিনয়ের বিবর্তন নিয়েও একটা উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র হতে পারে। শুধু অভিনয়ের ইতিহাস সংরক্ষণের প্রশ্নে মূল্যবান নয়, বাংলা সিনেমায় এতাবৎ কাল পর্যন্ত যতজন উঁচুমানের কমেডি অভিনেতা এসেছেন, তাঁদের কাজ একালের বিদগ্ধ দর্শকদেরও অবাক করে দেবে, এ কথা যে কোনও অভিজ্ঞ ব্যক্তিই স্বীকার করবেন। সেই আশুবাবু-কুমারবাবুদের সময় থেকে তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার, রবি ঘোষ পর্যন্ত গোটা সময়টাই উজ্জ্বলতার ইতিহাস, কারণ এঁরা সকলেই উঁচুমানের অভিনেতা। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের মধ্যে স্থান পাবেন। এঁদের অভিনয়ের ধারা সহজেই একটা মূল্যবান তথ্যচিত্রের বিষয় হতে পারে। নায়ক হিসেবে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা তো আছেনই, এ ছাড়া ট্র্যাজিক অভিনেতা হিসেবে যাঁরা বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁদের নিয়েও কাজ হতে পারে। বস্তুতপক্ষে অভিনয়ের ধারার মধ্যে এই ধরনের বিভিন্নতা, তার বিবর্তন— এসব নিয়ে কখনও সেভাবে ভাবাই হয়নি। ট্র্যাজিক রসসঞ্চারে যাঁরা দক্ষ ছিলেন, তাঁদের অভিনয়ে ঠিক কী ধরনের বিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে— এসবও বিশ্লেষণের বিষয় হতে পারে।

ট্র্যাজিক অভিনয়ের প্রশ্নে একটা চরিত্র বাংলা ছবিতে প্রায় ল্যান্ডমার্কের মতো দাঁড়িয়ে আছে, জনপ্রিয়তার প্রশ্নেও এমন ট্র্যাজিক চরিত্র আর একটাও অভিনীত হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। আমি প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’-এর কথা বলতে চাইছি। ‘দেবদাস’ নিয়ে বা তাকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধান-বিশ্লেষণ হতে পারে। বড়ুয়া সাহেবের ‘দেবদাস’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে সেই ছবিটাতে তিনি কতটা আধুনিক সিনেমা-অভিনয় করেছিলেন? নিজের কিছু বিশেষ ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি-কেন্দ্রিক অভিনয়ে তিনি চরিত্রটিকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন— এ ধরনের সহজ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার সমস্যা এটা নয়, একই সঙ্গে এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে নিজস্ব ভঙ্গির সাহায্য সত্ত্বেও তিনি কী করে দেবদাস চরিত্রের নিদারুণ ট্র্যাজিক-রস ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। সেই ছবিতে তাঁকে দেখে দর্শকদের সারাক্ষণ মনে হত তিনি এমন একজন অসহায়, দুঃখী মানুষ, যিনি অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণায় সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছেন। তিনি এটাও প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যে, দেবদাস প্রকৃতপক্ষে একাটা সামাজিক অবিচারের শিকার; এটা নিঃসন্দেহে অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার এক মহৎ কৃতিত্ব।

সাত

এতক্ষণ শুধু অভিনেতাদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে আমি বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীদের সম্পর্কে কিছুই বলতে চাইছি না। বাংলা সিনেমার অভিনয়ের ইতিহাস সংরক্ষণ করতে গেলে একাধিক মহিলা প্রতিভার অভিনয়ও সেই তথ্যচিত্রে অবশ্যই রাখতে হবে; উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই প্রভা দেবীর নাম মনে পড়ছে। অসংখ্য বাংলা ছবিতে তাঁর অভিনয়ের মধ্যে একটি ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’। এখানে বলে রাখা দরকার, প্রভা দেবীর মতো অভিনেত্রী কোনও দেশেই সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনিও থিয়েটার থেকে সিনেমায় এসেছিলেন, তাঁর অভিনয় বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখতে হবে তিনি কতটা থিয়েটার-ঘেঁষা ছিলেন বা অন্য দৃষ্টিতে, সিনেমায় অভিনয় করার সময় থিয়েটারের আঙ্গিক কতটা কাজে লাগিয়েছিলেন, সেই আমলের অভিনেত্রী হিসেবে, মঞ্চ থেকে সিনেমায় এসে ক্যামেরার সামনে কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। প্রভা দেবীর অভিনয়ে যে টেকনিক্যাল দিক আছে, সেসব বিষয়ও তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় খেয়াল রাখতে হবে।

আর একজন অভিনেত্রীর নাম প্রায় একই সঙ্গে মনে পড়ল। তাঁকেও কখনও কোনও ছবিতে খারাপ অভিনয় করতে দেখিনি, তিনি রাজলক্ষ্মী দেবী। এঁরা যে সর্বদা খুব বড় ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন তা নয়, কিন্তু ছোট ভূমিকাতেই এঁদের অসামান্য দক্ষতা আলাদা করে বুঝতে পারা যেত। অভিনয়ের তথ্যচিত্রে যদি এঁদের মতো অভিনেত্রীরা না থাকেন, তাহলে অন্যায় ও ক্ষতি দুই-ই হবে। তেমন কিছু হলে আগামী দিনের মানুষ ভুলে যাবেন যে এঁরাও বাংলা ছবির অপরিহার্য অভিনেত্রী ছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের দর্শক বা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজলক্ষ্মী দেবীর নাম প্রায় জানেই না। এই না-জানাটা তাদের কোনও অপরাধ নয়, কিন্তু তাদের না- জানানো আমাদের মধ্যে কারও না কারও অমার্জনীয় অপরাধ। কানন দেবী, ছায়া দেবীর মতো বিরাট অভিনেত্রীদের নিয়ে কোনও অনুসন্ধিৎসা যদি বাংলা ছবির ইতিহাস-প্রণেতাদের বা তথ্যচিত্র-নির্মাতাদের না থাকে, তবে তা আমার কাছে অপরাধ বলেই বিবেচিত হবে।

অভিনয় নিয়ে আলোচনার শুরুতে তুলসী লাহিড়ী, যোগেশ চৌধুরি, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখের প্রসঙ্গে বলেছি যে, এঁরা বাংলা সিনেমার শুরু থেকেই সিনেমার উপযোগী স্বাভাবিক ধারার অভিনয় করতেন। একই ধরনের দুর্লভ যোগ্যতা নিয়ে মহিলা অভিনেত্রীদের কারা কাজ করতেন, তা-ও অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে।

.

সত্যজিৎ রায় বাংলা সিনেমা-জগতে আসার আগেই মঞ্জু দে ও অনুভা গুপ্তর কিছু অভিনয় বাংলা ছবির দর্শকরা দেখেছেন। সে অভিনয় স্বাভাবিক তো বটেই, মূল্যায়নের প্রশ্নে তাঁদের সেই সব কাজ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মনে রাখতে হবে তাঁরা নিজেদের অনুভব, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিতে নিজেরাই সিনেমায় স্বাভাবিক ধারার অভিনয় করতে পেরেছিলেন। মঞ্জু দে-কে নিয়ে তথ্যচিত্র হতেই পারে, কারণ অভিনয়-বিশ্লেষণে তিনি সত্যিই বড় অভিনেত্রী ছিলেন, একই কারণে সম্মানিত হবেন অনুভা গুপ্তও।

প্রতিভার প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দিলে প্রায় আমাদের সমসাময়িককালেই একজন বিরাট অভিনেত্রী আছেন, তিনি— সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সাবিত্রীকে নিয়ে অবশ্যই তথ্যচিত্র হতে পারে। তাঁকে নিয়ে কাজ করার একটা বাড়তি সুবিধা পরিচালক পাবেন, কারণ তিনি এখনও সৃষ্টিশীল। উত্তম-যুগের অভিনেত্রী সাবিত্রীও সিনেমা ও থিয়েটার— দুটি ক্ষেত্রেই সাবলীল। বাংলা সিনেমায় সাবিত্রী-অভিনীত বহু চরিত্র আমরা মনে করতে পারি, যা সেই ছবিগুলোকেই সমৃদ্ধ করেছে। ‘নতুন ইহুদী’ থেকে শুরু করে এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত সাবিত্রী অসাধারণ দক্ষতায় কাজ করেছেন। এমন অনেক ছবি হয়েছে, যেখানে সাবিত্রীর অসামান্য অভিনয়ে বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ এমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর অভিনয়ের জোরেই ছবিটা উতরে গেছে, দর্শকরাও সাবিত্রীর অভিনয়ের আকর্ষণেই ছবিটা দেখতে বাধ্য হয়েছেন।

সাবিত্রীর দক্ষতা নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। একটা ছবির কথা মনে পড়ছে। আমি যে-সময়ের কথা বলছি সেটা পঞ্চাশের দশক, তখন আজকের দিনের আর্ট ফিল্ম বলে আলাদা কিছু ছিল না বললেই চলে। তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের বোধবুদ্ধি নিয়ে স্বাভাবিক অভিনয় করতে হত। সেই সময়ে ‘অনুপমা’ নামের একটা ছবি দেখেছিলাম, তাতে সাবিত্রীর সঙ্গে অনুভা গুপ্তও ছিলেন। সেই ‘অনুপমা’ ছবিতে সাবিত্রীর অভিনয় আমি কোনওদিনই ভুলব না। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ে, যাকে পরিবারের সব কাজই করতে হয়, স্বামীকে নিয়ে আলাদা সংসার পেতেও যার জীবন-সংগ্রাম শেষ হয় না, কিন্তু এসবের পরেও প্রেমিকা হিসেবে উজ্জ্বল— এ ধরনের একটা চরিত্র, নিজেকে উজাড় করে দিয়ে সেই ছবিতে সাবিত্রী অসামান্য অভিনয় করেছিলেন। সরাসরিই বলছি, আজকের দিনে বাংলা সিনেমার কোনও অভিনেত্রী এমন একটা চরিত্রে অত উঁচুদরের কাজ করবেন, এ-কথা আমি ভাবতেই পারি না।

কাকে নিয়ে তথ্যচিত্র হওয়া উচিত— এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা এক অর্থে বিশেষ ধরনের গ্ল্যামারের পেছনে ছুটে থাকি, একটা মোহ বা মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি বোধহয়। আমরা শুধু সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে তথ্যচিত্র করার কথা ভেবেছি যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে তথাকথিত আর্ট ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত বা সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ছবিতে যাঁদের প্রতিভা বিকশিত হতে দেখা গেছে।

কিন্তু অভিনয়ের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন দলিল তুলে ধরতে গেলে অভিনয়ের বিবর্তন কীভাবে ঘটেছে, কাদের কাজের মাধ্যমে ঘটেছে, সেদিকে যদি নজর না দিই তাহলে সামগ্রিক প্রয়াসই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সত্যিই যদি এ ধরনের কোনও তথ্যচিত্র শেষ পর্যন্ত নির্মিত হয়, তাহলে সেই ছবির নিরপেক্ষ দর্শকরা অনায়াসে বুঝতে পারবেন কেন জনপ্রিয়তা, গ্ল্যামারের দৌড় ইত্যাদি পেরিয়ে শুধুমাত্র অভিনয়ের দক্ষতার প্রশ্নে তথাকথিত অখ্যাতদের নিয়েও ছবি করা হয়েছে।

আট

এবার মোক্ষম প্রশ্ন, বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠানস্বরূপ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে প্রামাণ্য পুস্তক রচনা ও তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ কে বা কারা করবেন? সহজ উত্তর হিসেবে বলা যায়, যাঁরা বা যিনি বাংলা সিনেমা ও অভিনয় সম্পর্কে আগ্রহী তাঁরা বা তিনিই করবেন। কাজটি সহজ নয় বলেই একজন যোগ্য ও কৃতবিদ্য কাউকেই এগিয়ে আসতে হবে। একাধিক তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থ একটা খুবই বড় প্রশ্ন, কে টাকা দেবেন? এ-কাজে বিরাট অঙ্কের টাকা ছাড়া সাংগঠনিক সাহায্যের দিকটাও চিন্তা করে দেখতে হবে। কোনও ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এ ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া অসম্ভব না হলেও তা খুবই কষ্টকল্পনার ব্যাপার। বরং কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উৎসাহী হতেও পারে।

বাড়তি সুবিধা আছে ইউরোপ ও আমেরিকার গবেষক-পরিচালকদেরও। ওই সব দেশে পুরনো ছবির প্রিন্ট এবং ছবি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সযত্নে সংরক্ষিত হয়। সুতরাং কেউ যদি কোনও পৃথিবী বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীর ওপর গুরুত্বপূর্ণ ছবি করতে চান, তাঁর নিজের জ্ঞান ও যোগ্যতা ছাড়া অন্য কোনও ধরনের অসুবিধা হবে না। সেখানকার কোনও তরুণ পরিচালকও যদি রোনাল্ড কোলম্যান, মন্টগোমারি ক্লি- বা সোফিয়া লোরেন-এর অভিনয়-দক্ষতা ও নিজস্ব স্টাইল নিয়ে কাজ করতে চান, তিনি প্রায় সব রকমের সাহায্যই পাবেন। আমাদের দেশ এই শ্রদ্ধাময় গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোনওকালেই সচেতন ছিল না, এখনও নেই।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় টাকা ও সাংগঠনিক সাহায্য— এই দুটি ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য যোগ্য কোনও পরিচালক আগ্রহী হলেও তাঁকে যদি আর্থিক ও সাংগঠনিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তাহলে তাঁর পক্ষে এ-কাজ করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে এখন যে ধরনের সমাজব্যবস্থা, সেখানে রাজ্য সরকারকেই এ-কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজ রাজ্য সরকার করছে, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রেও সরকারি সাহায্যের একটা বড় ভূমিকা আছে। বাংলা সিনেমার ইতিহাস সংরক্ষণের এই কাজটাও নিশ্চয়ই সরকারের কাছে মূল্যবান মনে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সামগ্রিকভাবে ইতিহাসের চিন্তা মাথায় রেখে বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের ধারা, বিবর্তন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দান যথাযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারলে সেটাও হবে একটা উল্লেখযোগ্য কাজ।

সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র ইতিমধ্যেই হয়েছে। মিঁয়া বিসমিল্লা খান, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র হয়েছে। সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীদের নিয়েও কিছু স্মরণীয় কাজ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়— এঁরা সকলেই তথ্যচিত্রের বিষয় হয়েছেন। চিত্রশিল্পীদের বেশ কিছু সৃষ্টি হাতের কাছেই পাওয়া যায় বলে সেক্ষেত্রে তথ্যচিত্র-নির্মাতা কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে যান।

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব অসুবিধা দেখা দেবে। পুরনো আমলের শিল্পীদের অভিনয়সমৃদ্ধ অধিকাংশ ছবির প্রিন্ট হয়ত এখন আর পাওয়া যাবে না, কিন্তু চেষ্টা করলে কিছু ছবি এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হবে। তুলসী লাহিড়ীর অনেক ছবিই হয়ত এখন আর পাওয়া যাবে না, কিন্তু কিছু ছবি এখনও হয়ত হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে যায়নি।

দুষ্প্রাপ্য হওয়ার জন্য একেবারে শুরুর সময়ের সাইলেন্ট ছবিতে যে-সব শিল্পী কাজ করেছেন, তাঁদের আলাদা করে না ধরে একটা সময় ধরে কাজ করা যেতে পারে। বড়ুয়া সাহেবের অধিকাংশ ছবিই এখনও পাওয়া যাবে বলে অনুমান করা যায়। উৎসাহিত উদ্যোগে অনেক কঠিন কাজকেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবিক অর্থে সফল করা যায়।

বাংলা সিনেমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের দর্শক, চলচ্চিত্র-শিল্প এবং অভিনয়-শিক্ষায় আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে এই ধরনের কাজ কি কেউই শুরু করবেন না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *