অগ্রপথিক কানু বন্দ্যোপাধ্যায়: শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

অগ্রপথিক কানু বন্দ্যোপাধ্যায় শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠতার বিবেচনায় অনেক সময় তাঁদের নামের সঙ্গে কিছু উপাধি বা বিশেষণ যুক্ত হয়ে যায়— যেমন নটসূর্য বা রসরাজ ইত্যাদি। অর্ধশতাব্দীর বেশি অভিনয় করলেও কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে সেরকম কোনও ভূষণ যুক্ত হয়নি। অনেক সময় আবার অভিনেতার সৃষ্ট কোনও চরিত্র এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, দর্শকসাধারণের কাছে সেই চরিত্রের নামেই অভিনেতাকে অভিহিত করা হয়, যেমন ঘটেছিল দেবদাস চরিত্রের অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু যুগান্তকারী ও লোকপ্রিয় ছবি ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’তে হরিহর চরিত্রে আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় করার পরেও কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এমন কিন্তু ঘটেনি। এমন যে ঘটবে না এই ভেবেই হয়ত শম্ভু মিত্র খেদমিশ্রিত সংশয় প্রকাশ করে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন ‘কিন্তু কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে অপূর্ব অভিনয় হয়েছে এ ছবিতে (‘পথের পাঁচালী’) তা কি আদর পাবে?’ অভিনয়-কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে জনপ্রিয়তা বা সমাদর বিপুলভাবে না পাওয়ার ফলেই হয়ত এই প্রবীণ নট ১৯৭১ সালে একটি স্মৃতিচারণা শেষ করেছিলেন এইভাবে—

আমার মনে হয়, নাটক ভালোবাসেন যাঁরা, তাঁরা যদি প্রতিদান না চান, তবেই যেন স্টেজে অভিনয় করতে আসেন। ইদানীং আমি ভাগ্যবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। ভাদুড়িমশাই কী পেয়েছেন? অথচ ওরকম প্রতিভা খুব কমই হয়। অভিনয় যাঁরা করতে চান, সাধক হিসেবে যেতে হবে, প্রাোফেশন হিসেবে নিলে কী হবে জানি না। এখন আমি কোথাও অভিনয় করছি না, কেউ ডাকেন না আর। ভাঙা কুলো হয়ে পড়েছি আর কী! জ্ঞান হওয়া অবধি অভিনয় করে আসছি তো, তাই অভিনয় না থাকলে সন্ধেবেলা বড়ো ফাঁকা লাগে, কষ্ট হয়।

সত্যিই তো, আশৈশব অভিনয় করেছেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং সাধনা হিসেবেই নিয়েছিলেন অভিনয়কে। তাঁর জন্ম ২০ জুন, ১৯০৫ সালে। যখন তাঁর দশ-এগারো বছর বয়স তখন নন্দদুলাল বসুর বাড়িতে তাঁর মুখে সংস্কৃত কবিতার আবৃত্তি শুনে অমৃতলাল বসু খুব খুশি হয়েছিলেন। কানুবাবুর স্মৃতিচারণেও অমৃতলাল যে তাঁর স্কুল-জীবনে তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে অভিনয়ে এসেছিলেন তার উল্লেখ আছে। এইভাবে পাড়ায় শখের অভিনয় করতে করতেই অভিনয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ তাঁকে নিয়ে এসেছিল ‘সান্ধ্য সমিতি’ নামে ১১ নম্বর কৈলাস বসু স্ট্রিটের একটি অপেশাদার নাট্যদলের সংস্পর্শে। সেখানে নাট্য পরিচালক ছিলেন অর্ধেন্দুশেখরের পুত্র ভুবনেশ মুস্তাফি। অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন শিশিরকুমারের থিয়েটারের অমলেন্দু লাহিড়ি (নির্মলেন্দু লাহিড়ির অগ্রজ), ভূমেন রায়, রথীন বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদিরা। কানুবাবু সেখানে স্ত্রীভূমিকায় অভিনয় করতেন। ভুবনেশ মুস্তাফির পরিচালনায় ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকেও স্ত্রীভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৩৫-এ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর এই নাটকের একটি অভিনয়ের থেকে সংগৃহীত ১০০০ টাকা তাঁরা তুলে দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর হাতে।

রঙমহলে নরেশ মিত্রর পরিচালনায় বন্ধু রথীন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করছিলেন ‘মহানিশা’ নাটকে, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু উপযুক্ত চরিত্র তাঁর জন্য পাওয়া গেল না। সে সময় রঙমহলে ছিলেন নট-নাট্যকার যোগেশ চৌধুরি। তিনি কানুবাবুকে বললেন— ‘এখানে তো কিছু শিখতে পারবেন না, শিখতে হলে ভাদুড়ি মশাইয়ের কাছে যান।’ তিনি চিঠিও লিখে দেন নাট্যাচার্যকে।

শিশিরকুমার প্রথমে কানুবাবুকে থিয়েটারে যোগ দেওয়ার থেকে নিরুৎসাহিত করতে চাইলেন— ‘এ লাইন ভালো না, বাড়ির লোকেরাই অপাঙক্তেয় করে রাখবে’— এই সব বলে। কিন্তু কানুবাবুর আগ্রহাতিশয্যে শেষ পর্যন্ত শ্রীরামপুর টকিজ-এ ‘আলমগীর’ নাটকের অভিনয়ে শিশিরকুমারের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন বিক্রম সোলাঙ্কির ভূমিকায়।

১৯৩২ সালে ‘আলমগীর’-এ যে শিশির-সান্নিধ্যের শুরু তা নিরবচ্ছিন্ন ছিল ১৯৪৮ সালের ‘দুঃখীর ইমান’ অবধি। যুগপ্রবর্তক শিশিরকুমারকে কী চোখে দেখতেন কানুবাবু তার একটা আভাস মাত্র দেওয়ার জন্য তাঁরই একটা লেখা থেকে খানিকটা তুলে দিচ্ছি—

সেই সময় সাধারণ রঙ্গমঞ্চে ভাদুড়ি মশাইয়ের মত শিক্ষিত লোক কেউ ছিলেন না। ‘সীতা’ নাটক থেকেই তিনি অভিনয়ের ভাবধারা পাল্টে দিয়েছিলেন। অভিনয়ের সময় প্রতিটি action-এ যে reaction হবে সেটা ওঁর আগে কেউ তেমন প্রয়োগ করেননি। অমিত্রাক্ষর ছন্দ গদ্যায়িত করেছিলেন তিনি। সুরেলা ছন্দ বাদ দিয়ে সংলাপ অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হত। ছন্দ মাত্রা বজায় রেখেও blank verse-এর ব্যবহার ছিল অসামান্য। আর ছিল কণ্ঠস্বর। সে কণ্ঠস্বরের কোন তুলনা আজও পাইনি। ভাদুড়ি মশাইয়ের শিক্ষা দেবার পদ্ধতি ছিল খুব সুন্দর। যার একটু ধারণা আছে সেই তরে যেত। উনি প্রথমে চরিত্র বুঝিয়ে দিতেন সম্পূর্ণটা analysis করে। তারপর বলতেন ‘don’t do what I do – do what I say’� যেটা বুঝিয়ে দিলাম সেটা যা বুঝেছ তাই করবে।

আলোকসম্পাত, মঞ্চ নির্মাণ, ধ্বনি প্রয়োগ, কস্টিউম পরিকল্পনা সবের মধ্যে দিয়েই যে নাট্যাচার্য থিয়েটারে নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিলেন এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করে গেছেন কানুবাবু। জীবন, মানুষ ও সমাজকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করা এবং সেই বীক্ষণ অভিনয়ের মধ্যে প্রয়োগ করার শিক্ষা শিশিরকুমারের কাছেই পেয়েছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছিলেন—

চরিত্র সৃষ্টিতে ‘অবজারভেশন’ অনেকখানি কাজ করে। ‘বিরাজ বৌ’-তে নিতাই গাঙ্গুলির রোল করতাম। আমাদের পাড়াতে গিরিনবাবু নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি মাথার ওপর হাত তুলে তুড়ি দিয়ে ‘নারায়ণ নারায়ণ’ বলতেন। নিতাই গাঙ্গুলির চরিত্রে এটা নিয়েছিলাম। ‘উড়ো চিঠি’তে আমার রোল ছিল গোঁড়া নীতিবাগীশ হেডমাস্টারের। আব্বাসউদ্দীন আমার অভিনয় দেখে বলেছিলেন যে এ চরিত্র তাঁর দেখা। সুতরাং চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হলে চোখকান খোলা রাখতে হবেই।

শিশিরকুমার ভালবাসতেন যেমন, তেমনই মাঝে মাঝে পছন্দ না হলে চটে গিয়ে চেঁচাতেন— ‘কোথায় গেল কানাই, you acted like a buffoon.’ শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি বহু জায়গায় ঘুরেছেন। সেই সব ভ্রমণের সময় এবং কলকাতায় অবস্থানকালে শিশির ভাদুড়ি-কৃত প্রায় সব নাটকেই কানুবাবু অভিনয় করেছেন। কোনও কোনও নাটকে একাধিক চরিত্রে। ‘বিজয়া’ নাটকে প্রথমে একটি ছোট ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও পরবর্তীকালে নাটকটির প্রায় প্রতিটি পুরুষ চরিত্রে, এমনকী স্বয়ং শিশিরকুমার অভিনীত রাসবিহারী চরিত্রেও পরিবর্ত হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। শিশিরকুমার রহস্যছলে বলেছিলেন, ‘এবার বিজয়াটা বাকি থাকে কেন, এটাও একদিন করে ফেল!’ ‘আলমগীর’ নাটকে বিক্রম করেছেন, এমনকী এক দিনে দুটি বিপরীতধর্মী চরিত্র এরাদত খাঁ এবং ভীমসিংহ— একটি কমিক, একটি সিরিয়াস— এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শিশিরকুমার খুশি হয়ে বলেছিলেন— ‘কানাই, I owe you an appreciation.’ কানাই বলে ডাকতেন, কারণ কানুবাবুর আদি নাম ছিল কানাইলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

শিক্ষাগুরুর এই appreciation আর একবার অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়েছিলেন মহর্ষির লেখা ‘দেশবন্ধু’ নাটকে অভিনয়ের সময়। আমি অভিনয় করার সময় দেখি উনি চুপ করে তাকিয়ে আছেন। আমি আস্তে বললাম, ‘বড়দা এবার আপনি।’ ভাদুড়িমশাই যেন চটকা ভেঙে অভিনয় করলেন। পরে বললেন, ‘তোমার অভিনয় দেখতে দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ এত অপূর্ব appreciation খুব বেশি পাইনি।’ তবে তাঁর অভিনয়ের গুণগ্রাহীতার সব থেকে উজ্জ্বল মুহূর্তটি এসেছিল যখন রবীন্দ্র-উপন্যাস ‘যোগাযোগ’ মঞ্চস্থ হয়েছিল স্টারে। এই নাট্যরূপ শিশিরকুমারের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখে দিয়েছিলেন। এই নাটকে নবীনকৃষ্ণর ভূমিকা নিয়েছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয় দেখার পর সাজঘরে কবি তাঁর খোঁজ করেন, কানুবাবু কিন্তু ভয় বা সঙ্কোচে গ্রিনরুম ছেড়ে পালিয়েই গিয়েছিলেন। কবি প্রবোধ সান্যাল মশাইকে বলে গিয়েছিলেন কানুবাবু যেন পরদিন অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। শিশিরকুমার কানুবাবুকে নিয়ে গেলেন জোড়াসাঁকোতে। কানুবাবু প্রণাম করতে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘তোমার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার স্ত্রীর অভিনয় দেখে উপভোগ করেছিলাম।’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, নবীনকৃষ্ণের স্ত্রী শ্যামার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রানীবালা।

রঙ্গমঞ্চের পাশাপাশি সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে এসেছে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্রাভিনয়ের স্রোত। বাংলা ছায়াছবির নির্বাক অবস্থা যখন, যখন স্টুডিও বলেই কিছু তৈরি হয়নি, সেই সময়, সম্ভবত ১৯২৪ সালে, পি এন গাঙ্গুলি পরিচালিত নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে তিনি প্রথম চিত্রাবতরণের সুযোগ পান। অকিঞ্চিৎকর সেই চিত্রাবতরণ। এ ব্যাপারে নিজেই লিখেছেন— ‘আমি সেই সময় সবে অভিনয় করছি। সুবোধ বসু মেকআপ করেন, তিনিই আমাকে ছোট রোলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন— কাটা সৈনিকের বা ঐ ধরনেরই কিছু একটা হবে।… থিয়েটারই বলুন বা সিনেমাই বলুন একসট্রার রোলেই প্রথম চান্স পেয়েছিলাম।’

এক্সট্রার রোলে শুরু করলেও তাঁর অভিনয় কিন্তু মঞ্চের মতো সিনেমাতেও অকিঞ্চিৎকর ভূমিকাতেই থেমে থাকেনি। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম সবাক চিত্র ‘শুভ ত্রহস্পর্শ’-র কাহিনীকার স্বপনবুড়ো (অখিল নিয়োগী) এবং পরিচালক ছিলেন নাট্যকার মন্মথ রায়। ১৯৩৪ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি কমপক্ষে একশো বারোটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন এবং সেই সময় বাংলার অধিকাংশ প্রতিভাবান ও নামী অভিনেতাদের পাশে এবং বিশিষ্ট ও বিখ্যাত চিত্রনির্মাতাদের ছবিতে উল্লেখযোগ্য বহু চরিত্রেই কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু যে-ছবিটি তাঁকে অমরত্বের সীমান্তে পৌঁছে দেয় তার জন্য কুড়িটি বছর এবং ছিয়াশিটি ছবি তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে— ‘পথের পাঁচালী’ এবং এক বছর পরে ‘অপরাজিত’।

আমির আলি অ্যাভিনিউতে ‘মেস নাম্বার ফরটিনাইন’-এর একটি আমন্ত্রিত অভিনয়ের সময় সত্যজিৎ রায় কানুবাবুর সঙ্গে দেখা করে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে হরিহর চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। সত্যজিৎ বলেছিলেন ‘অনেক দেখেই আপনাকে ভালো লেগেছে, আপনাকে দিয়েই রোলটা হবে।’

পরবর্তীকালে স্মৃতিকথা বলার সময় কানুবাবু সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে বলেছেন—

ছবি ঠিক কীরকম হওয়া উচিত, ছবির আসল ভাষা কী, তার একটা বাস্তব আর প্রত্যক্ষ চেহারা সত্যজিৎই প্রথম আমাদের দেখান। ক্যামেরাকে কতভাবে ব্যবহার করা যায় তা উনিই প্রথম চিন্তা করেন। ছবি দেখা হয় ক্যামেরার চোখ দিয়ে— এইখানেই তো থিয়েটার আর ফিল্মের তফাৎ। একথা কিন্তু সত্যজিতের আগে কেউ তেমন করে ভাবেনি। আর কী ভীষণ ডিটেলের কাজ ওঁর ছবিতে— সেইজন্যই বোধ হয় ওঁর ছবির চরিত্রগুলো এত চেনা আর বাস্তব বলে মনে হয়। আগের যুগের ছবিতে মোটামুটি গল্পটা বলে যাওয়া হত শুধু, সবকিছুকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলবার জন্য প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে এত বেশি নজর থাকত না। শুধু চরিত্র নয়, সব কিছুরই যতটা সম্ভব বাস্তব চেহারা। বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম ‘পথের পাঁচালী’ আর ‘অপরাজিত’ এই দুটি ছবিতে কাজ করে।

‘পথের পাঁচালী’র পরিচালকের বাস্তবতা ও তার অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণের আগ্রহ সম্পর্কে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে শুটিংয়ের জন্য নির্ধারিত প্রথম দিনটিতেই বুঝতে পেরেছিলেন একথা আমরা জানতে পারি মারি সীটন-কৃত সত্যজিৎ রায়ের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ থেকে। প্রথম যেদিন কানুবাবুর শুটিং করার কথা তার আগের দিন তিনি নাপিতের কাছে চুল কেটে গিয়েছিলেন। শুটিং করতে এসে গ্রামের কবিপ্রাণ কথক ব্রাহ্মণের চুলে সেই পরিপাটি ছাঁট দেখে সত্যজিৎ এতই বিচলিত বোধ করেন যে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেদিন শুটিং বন্ধ করে দেন এবং কানুবাবুকে বলেন, চুল আবার আগের মতো বাড়লে তবেই শুটিং করা হবে। কানুবাবু এতে ক্ষুব্ধ তো হনই না, পরন্তু জনে জনে বলে বেড়িয়েছিলেন যে, এই প্রথম তিনি একজন সত্যিকারের পরিচালককে পেয়েছেন, যাঁর বাস্তব চরিত্রসৃষ্টির তাগিদ এতটাই যে, চুল কতটা লম্বা থাকবে সে বিষয়েও তিনি এত তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক অভিনয় দেখে কেন সত্যজিতের ভাল লেগেছিল এবং কেন তিনি তাঁর নবযুগ সৃষ্টিকারী ছবির অভিনয়ের জন্য কানুবাবুকে উপযুক্ত মনে করে নির্বাচন করেছিলেন তার কারণ খানিকটা অনুমান করা যেতে পারে।

বাংলা সিনেমার সাইলেন্ট যুগ থেকে পরে সবাক যুগেও অনেকদিন পর্যন্ত থিয়েটার থেকেই অধিকাংশ অভিনেতাকে আনা হত সিনেমায় অভিনয় করার জন্য। সেইজন্যই তাঁদের অনেকের অভিনয়ে মঞ্চাভিনয়ের আতিশয্যের অভ্যাসটুকু অনেক সময়ই থেকে যেত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত বাংলা থিয়েটারের প্রায় জন্মমুহূর্ত থেকেই বাংলার লোকনাট্য যাত্রা থেকে আসা সুরেলা অভিনয়ের পাশাপাশি আরও অন্তত দুটি অভিনয়শৈলী প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। সে দুটির জনক মহাপ্রতিভাধর দুই নট— অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ। লোকনাট্যের সুরাশ্রয়ী কণ্ঠমাধুর্যনির্ভর অভিনয়ধারা যে দিকপাল অভিনেতার হাত ধরে বাংলা থিয়েটারে আশ্রয় পেয়েছিল তিনি অমৃতলাল মিত্র। কলকাতার ইংরেজি, ফরাসি তথা ইউরোপীয় থিয়েটার দেখে এবং শেকসপিয়র, মলিয়ের তথা ইউরোপীয় নাট্যকলার পঠনপাঠন, চর্চা ও পরিপাক থেকে যে নবজাত বাংলা থিয়েটার গড়ে উঠেছিল তার নাগরিকতাও গরিষ্ঠ দেশবাসীর সুদীর্ঘ লোকায়ত ঐতিহ্যের প্রভাব এড়াতে পারেনি। এই সুরেলা অভিনয় অমৃতলাল মিত্র থেকে তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত গিরিশপুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, যিনি দানীবাবু নামেই বেশি পরিচিত, তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি শিশিরকুমারের কাছে শুনেছি দানীবাবুর অতুলনীয় কণ্ঠস্বর এবং মঞ্চ-উপস্থিতি ছিল, কিন্তু তাঁর অভিনয়ে সুরের ঝঙ্কার থাকলেও তাতে যুক্তি এবং স্বাভাবিক আচরণ ও কথনরীতির তেমন প্রকাশ থাকত না। শোকে তাপে ক্লিষ্ট ও কর্মব্যস্ত গিরিশচন্দ্রের অমনোযোগে দানীবাবু লেখাপড়া শিখতে পারেননি, কোনক্রমে সাক্ষর হতে পেরেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের উদাসীনতায় তাঁর অভিনয় শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল অমৃতলাল মিত্রকে। তাই দানীবাবুর অভিনয়ে পিতার অপেক্ষা অমৃতলালের প্রভাবই সমধিক। দানীবাবুর ভক্ত নির্মলেন্দু লাহিড়ির অভিনয়েও এই সুরপ্রধান ধারা প্রবাহিত হয়ে এসেছিল।

কিন্তুআশ্চর্যের কথা, এই সুরেলা ধারার পাশাপাশি অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির অভিনয় ছিল প্রকৃতবাদী, যাকে সচরাচর স্বাভাবিক অভিনয় বলা হয়ে থাকে। শিশিরকুমার বলতেন অর্ধেন্দুর মতো শক্তিমান অভিনেতা তিনি দেশে বিদেশে কোথাও দেখেননি। যে কোনও চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন, একই নাটকে দুটি ভূমিকায় অভিনয় করার সময় দুটো আলাদা কণ্ঠস্বর তৈরি করতেন। এ কথা বলা সোজা, কিন্তু করা যে নিতান্তই কঠিন তা অভিনেতামাত্রই জানেন। সর্বক্ষেত্রেই অভিনয়শৈলী জীবনানুগ প্রকৃতবাদী থাকত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির থিয়েটারে এই বহুমুখী ও প্রকৃতবাদী অভিনয়ের ধারক ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।

বাংলা থিয়েটারের প্রভাতসময় থেকে এই প্রকৃতবাদী বা স্বাভাবিক অভিনয় অর্ধেন্দুর অজস্র শিষ্যের সাধনার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে পৌঁছেছিল যোগেশচন্দ্র চৌধুরি ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং সমসাময়িক বেশ কিছু অভিনেতার মধ্যে। যোগেশচন্দ্র চৌধুরি ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর অভিনয় থিয়েটার ও সিনেমায় দেখতে একইরকম লাগত, অর্থাৎ স্বাভাবিক ও জীবনসদৃশ। দুটি মাধ্যমে নিশ্চয়ই তাঁরা একই রকম টেকনিক ব্যবহার করতেন না, বস্তুত সেটা সম্ভবই নয়, কিন্তুপ্রকৃতবাদী অভিনয়ের প্রাণবস্তু তাঁদের আয়ত্ত ছিল বলেই এই আশ্চর্য ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছিল।

অভিনয়ের এই বিশেষ ঐতিহ্যটি বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে কতখানি কাজে এসেছিল সে বিষয়ে মন্তব্য করার আগে থিয়েটারের আর একটি যে ধারার কথা উল্লেখ করেছি সে সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা বলে নেওয়া ভাল। বাংলা থিয়েটারের এই তৃতীয় ধারাটি গড়ে উঠেছিল প্রকৃতবাদী শৈলীর সঙ্গে থিয়েটারের প্রয়োজনীয় স্টাইলাইজেশনের স্বার্থে খানিকটা জীবনের থেকে বড় মাপের রূপায়ণের সমন্বয় করে। এর মধ্যে ইউরোপীয় থিয়েটারের ছায়া এবং লোকায়ত যাত্রা ও কথকতার সুরও কখনও কখনও মিশে থেকেছে। থিয়েটারের এই ধারার জনক গিরিশচন্দ্র এবং এর চূড়ান্ত বিকাশ শিশিকুমারের অভিনয়ে।

নাট্যাচার্য শিশিকুমারের মতে অর্ধেন্দুশেখর তাঁর দেখা সব থেকে শক্তিমান অভিনেতা হলেও গিরিশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ে জীবনের থেকে বড় মাপের এই রূপায়ণ দেখা যেত, এবং তাঁর ভাষায় ‘এঁরা যখন অভিনয় করতেন তখন মঞ্চের সঙ্গে অন্য একটা জগতের যোগ তৈরি হয়ে যেত।’

থিয়েটারের এই তিন ধারাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চাইছি বলে কেউ যেন মনে না করেন এই ত্রিধারা কখনওই পরস্পরের সঙ্গে ওভারল্যাপ করেনি বা কখনওই শৈলীমিশ্রণ ঘটেনি। এমন অনেকটাই ঘটেছে। বিশেষত তৃতীয় ধারাটির অনেকটাই যখন ছিল প্রকৃতবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত থেকেও লোকায়ত ও স্টাইলাইজেশনকে আত্মস্থ করে।

আমাদের আলোচিত দ্বিতীয় অর্থাৎ প্রকৃতবাদী বা স্বাভাবিক অভিনয়ের ধারাটি বাংলা থিয়েটারের প্রথম থেকেই এক বিশাল ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে ওঠার ফলে বাংলা সিনেমাও প্রথম থেকেই থিয়েটার থেকে আসা এমন বহু অভিনেতাকে পেয়েছে যাঁরা প্রথম থেকেই প্রায় সিনেমার মতোই অভিনয় করতেন। যোগেশ চৌধুরি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ি, তুলসী চক্রবর্তী, প্রভাদেবী, রাজলক্ষ্মীদেবী, মলিনাদেবী এবং কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতৃবর্গের অসাধারণ স্বাভাবিক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা সিনেমার অভিনয় যখন সাবালকত্বের পথে এগিয়ে এসেছে তখনই দেখা গিয়েছে ‘পথের পাঁচালী’— যেখানে সিনেমার অভিনয় থিয়েটারের পরবশ্যতা ভুলে নিজের ছন্দ, মাপ, স্টাইলকে খুঁজে পেয়েছে। নতুন ভারতীয় সিনেমার জন্ম হল ‘পথের পাঁচালী’তে, কিন্তু নতুন চিত্রাভিনয়ের সূতিকাগার তার অনেক আগেই রচিত হয়েছিল আধুনিক বাংলা থিয়েটারের আদিপর্বে প্রকৃতবাদী অভিনয়শৈলীর বিকাশের মধ্যে দিয়ে।

আধুনিক নাট্যকলা যেমন পুরাণোক্ত বা ইতিহাস-প্রসিদ্ধ মহান বীরদের পতনের মধ্যে ট্র্যাজেডির সন্ধান ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের মধ্যে রক্তাক্ত বেদনার্ত নাট্যবস্তুর সন্ধানে পথে নেমেছিল, আধুনিক অভিনয়ও তারই সঙ্গে সাধারণ মানুষ, রক্তমাংসের মানুষের সুখ দুঃখ শান্তি বাসনা বঞ্চনাকে মূর্ত করে তোলার ব্রত গ্রহণ করেছিল। সৌভাগ্যের কথা, বাংলার অভিনয়েও এই সাধারণ মানুষের জীবনসন্ধান আধুনিক বাংলা থিয়েটারের জন্মলগ্ন থেকেই চলে এসেছে।

কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ও কী মঞ্চে কী চলচ্চিত্রে এই সাধারণ মানুষের জীবনসন্ধানের কাজেই ব্রতী ছিল। সে কাজের একদিকে ছিল তাঁর সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যেই জীবনযাপন, সেই ‘জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায়, চারি দিকে বাঙালির ভিড়, বহুদিন কীর্তন ভাসান গান রূপকথা যাত্রা পাঁচালীর নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজও শ্রাবণের জীবন গোঙায়’; আর অন্যদিকে ‘শিল্পসৃষ্টির প্রেরণা— (যা) বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে সংসারের ছক কাটা উন্নতির পথে পরিপূর্ণ অন্তর্দান করবার মত স্বাভাবিকতা কোনদিনই সে অর্জন করতে পারে না— এমনই অস্বাভাবিক অবৈধ মানুষ এই আর্টিস্ট।’ কানুবাবুরই ভাষায় ‘এই তো শিল্পীর জীবন— ব্যক্তিগত বেদনাকে কখনও শিল্পের ওপর স্থান দিইনি।’

কানুবাবুর জন্ম হয়েছিল রাজস্থানের যোধপুরের পজপতরা নামে একটা গ্রামে। বাবা নর্দার্ন ইন্ডিয়ার সল্ট রেভেনিউতে কাজ করতেন। বাবার নাম শ্রীকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা-র নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় চলে আসাতে উত্তর কলকাতার প্রায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান তাঁরা। বাগবাজারের মহারাজা কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সিটি কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের চাকরিতে ঢুকে পড়েন। এক বছর পরে পোস্ট অফিসে চাকরি নিয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে দেন। সেই সময় প্রখ্যাত নাট্যকার-পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্তর সঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সূত্রে কানুবাবুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। দেবনারায়ণ গুপ্ত জানতে পারেন কানুবাবু পোস্ট অফিসের চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে চলেছেন। দেবনারায়ণবাবু লিখছেন— ‘কথাটা শুনে পরেরদিনই (কর্নোয়ালিস স্ট্রিট) পোস্ট অফিসে গিয়ে দেখা করে বললাম, এ কী করতে যাচ্ছেন? সম্পূর্ণ থিয়েটারের ওপর নির্ভর করে পাকা সরকারি চাকরি কি ছাড়া উচিত?’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কানুবাবু বললেন, ‘আমাদের আত্মীয় বন্ধুরা অনেকেই ঐ একই কথা বলছেন। আপনাদের কথা খুবই যুক্তিপূর্ণ, কিন্তু কেন জানি না মন আমার বলছে, কেরানিগিরির সঙ্গে অভিনয়-শিল্পকলার সাধনা একসঙ্গে চলতে পারে না। জানেন, পোস্ট অফিসের কাজে অনেক দায়দায়িত্ব আছে। এখানে কলম ধরে কাজ করি, আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ছায়াছবি আর নাটকের পার্ট। অসাবধানতায় যদি ভুলচুক করে ফেঁসে যাই? তাছাড়া কেরানিগিরির চেয়ে অভিনয় করাকেই আমি বেশি পছন্দ করি। তাই কেরানিগিরি ছেড়ে অভিনয়কেই পেশা করব ঠিক করেছি।’ এই অভিনেতার পক্ষেই লেখা সম্ভব

‘ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ’ ছবির সময় আমার মেকআপ উনি (সত্যজিৎ রায়) দেখতে গিয়েছিলেন— খুব ভালো লেগেছিল ওঁর। ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ আমার জীবনের এক আশ্চর্য ছবি, অদ্ভুত উপলব্ধি…। আমার মেকআপ হল। ওঁরা জানতে চাইলেন আমি কত টাকা চাই। বেশ ভালো রকম টাকাই চাইতে যাচ্ছিলুম— হঠাৎ কীরকম মনে হল, ঠাকুর বলতেন ‘মাটি টাকা টাকা মাটি’— আর আমি কী না তাঁর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য টাকার কথা ভাবছি! বললাম ‘আমি কিছু চাই না, আপনাদের যা ইচ্ছা দেবেন’। বোধহয় চার কি পাঁচ হাজার টাকা ওঁরা আমাকে দিয়েছিলেন, আর তার জন্য আমার কখনও কোন অনুশোচনা হয়নি। সে এক অদ্ভুত দিন গেছে। ঐ সময় আমি চেষ্টা করেছিলাম অন্য কোন ছবিতে কাজ না করবার। রোজ সকালে যেতুম গঙ্গাস্নানে, পুজো করে রোজ কাটিয়ে দিতুন অনেকটা সময়। বেশি কথাও বলতাম না ঐ দিনগুলোতে কারো সঙ্গে।’

এই একাগ্রতাই তাঁকে সমর্থ করেছিল এত বিচিত্র চরিত্রের রূপকার হতে। কোনওদিন কোনও টাইপের ছাঁচে তিনি বন্দী হননি। সাধক হিসেবে অভিনয়-কর্মকে নিয়েছিলেন বলেই সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করেছেন এবং অসাধারণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষের জীবন।

বিপুল সমাদর ও স্বীকৃতি তাঁর ওপর বর্ষিত হয়নি বলে খেদ করে লাভ নেই। পিছিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বে শিল্পসংস্কৃতির বহু কর্মীরই মূল্যায়ন বাকি থেকে যায়। বরং যখন ভাবি যে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনন্য শিল্পীদের তিনি ছিলেন অন্যতম শিক্ষাগুরু, তখন তাঁর শিল্পাদর্শ কোথাও না কোথাও ফলিত রূপ নিয়ে বেঁচে আছে এই কথা ভেবে হ্লাদিত হই, ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’য় তাঁর অভিনয় মৃত্যুহীন— এই বিশ্বাসে আশ্বস্ত থাকি।

কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্চে বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ আমার কোনওদিনই হয়নি। কিন্তু আমার প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’-এ অভিনয় শুরু করার আগেই ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘পরশপাথর’ ও ‘জলসাঘর’ দেখে সত্যজিতের সিনেমার অভিনয়, তথা প্রকৃত সিনেমার অভিনয় সম্পর্কে আমার বোধের বেশিটাই তৈরি হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সেই অনুচ্চারিত সুষমামণ্ডিত অভিনয়ের অন্যতম বাহক ছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তাঁর শততম জন্মদিনে সেই ভূষণবিহীন তবু চিরস্মরণীয় অগ্রপথিকের ঋণ স্বীকার করে আমি কৃতার্থ বোধ করছি। শতবর্ষের প্রতিমুখে তাঁকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *