পরিচালকের ছবি, ছবির অভিনেতা

পরিচালকের ছবি, ছবির অভিনেতা

পরিচালকের ছবি বা ‘ডিরেক্টরস ফিল্ম’ শব্দটি সম্ভবত আমাদের দেশে নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয় না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে বোঝাও হয় না। কারণ ‘ডিরেক্টরস ফিল্ম’ বলতে সাধারণভাবে আমাদের মাথার মধ্যে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, তা হচ্ছে ডিকটেটরস ফিল্ম। প্রথমেই মনে হয়, এমন একজন স্বৈরতান্ত্রিক নেতা এই চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মটার পিছনে দাঁড়িয়ে হুকুমের ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, যিনি অন্য কাউকে বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা দিচ্ছেন না, নিজেই সমস্ত কর্মকাণ্ড কল্পনা করছেন এবং নিজেই যাবতীয় কাজ করছেন। এমনভাবে ভাবতেই আমরা অভ্যস্ত। বোধহয় মানুষের মনের মধ্যেই একনায়কের প্রতি একটা অনুচ্চারিত আকর্ষণ আছে, সেইজন্যই আমরা এরকম করে ভাবতে ভালবাসি যে, এমন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক নিশ্চয়ই আছেন, যিনি নিজেই সব ভাবনা ভাবেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন।

কিন্তু আসলে বোধহয় পরিচালকের কাজ তা নয়। যিনি খুব উঁচুদরের পরিচালক, বিশেষ করে যাঁরা তথাকথিত শৈল্পিক ছবিগুলির পরিচালক, তাঁদের সকলেরই চলচ্চিত্র নির্মাণ-কর্মের ওপর একটা ব্যাপক দখল দরকার হয়। তিনি যে শুধু তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় পরিচালনা করেন তাই-ই নয়, তাঁকে ছবির অন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপরেও যত্ন ও সতর্কতার দৃষ্টি রাখতে হয়। তিনি তাঁর শিল্পনির্দেশককে পরিচালনা করেন। ক্যামেরাম্যান ও চিত্রনাট্য-লেখককেও তিনিই পরিচালনা করেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালকরা নিজেরাই চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিল্পময় ছবির পরিচালকরা সকলেই নিজেদের ছবির চিত্রনাট্য নিজেরাই লেখেন তা নয়, তবে অনেকেই এই কাজের ভার নিজেই গ্রহণ করেন। অনেক পরিচালক নিজেই ক্যামেরায় চিত্রগ্রহণ করেন, এরকমও দেখা যায়, বকলমে পরিচালক নিজেই ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। কখনও কখনও ছবির পরিচালক নিজে একটা চরিত্রে অভিনয়ও করছেন। কিন্তু যেহেতু একা সব চরিত্রে অভিনয় করা যায় না, সেজন্য কয়েকজন অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে নিতেই হয়। পরিচালকের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে সামগ্রিক অর্থে গোটা ছবিটাকে কল্পনা করা, চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাণ্ডকে নির্ভুল পদ্ধতিতে কল্পনা করা। একটা সার্থক ছবির ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় কাজ আর কিছু নেই। একজন বড় ও প্রতিভাবান পরিচালকই এই কাজটি বিস্ময়কর দক্ষতায় করতে পারেন, অন্যরা পারেন না। একটি ছবি তৈরির ক্ষেত্রে বড় বড় কাজ যেমন থাকে, তেমন ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজও থাকে, দক্ষ পরিচালকরা সবই গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য রাখেন।

ছবি তৈরি যখন কল্পনা থেকে বাস্তবে নেমে আসে তখন পরিচালককে কাজ শুরু করে অনেক সময় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কখনও কখনও অনেক সাধ অপূর্ণ থেকে যায়, বাস্তবিক পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। ‘মেনে নেওয়া’ শব্দটি এজন্য ব্যবহার করছি যে পরিচালকের স্বপ্নে, কল্পনায় সমগ্র ছবিটি থাকলেও শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র একটা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম ও বাস্তবিক আজ। কোনও পরিচালক হয়ত কোনও দৃশ্যের শুটিংয়ে অনেকটা বড়, উজ্জ্বল নীল আকাশ পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে সেটে গিয়ে দেখলেন জানলা দিয়ে একচিলতে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে, তার বেশি কিছুতেই দেখানো যাচ্ছে না। বলাই বাহুল্য, সময়, কাজের রুটিন এবং অর্থ ইত্যাদি বহু কথা ভেবে হয়ত এ ধরনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিচালককে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে আপস করতেই হয়। পরিচালক তাঁর মনের মধ্যে যে ধরনের সেট তৈরি করতে চেয়েছিলেন, হয়ত দেখা গেল সেই শহরে সেই ধরনের জিনিসপত্রই পাওয়া যায় না, তখন পরিচালককে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। সিনেমা বস্তুটি সম্পর্কে দর্শকদের যতই স্বপ্ন-রঙিন ধারণা থাক না কেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ একটা অত্যন্ত আয়াসসাধ্য বাস্তবিক কাজ। শুটিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এমন একাধিক অসুবিধার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

এবার অভিনেতাদের প্রসঙ্গ। অভিনেতাদের পরিচালনা করাটাও একটা অত্যন্ত বাস্তবিক বা প্র্যাকটিক্যাল কাজ। পরিচালক যখন চিত্রনাট্য লিখেছেন বা লিখিয়েছেন, তখন একটা চরিত্রকে কল্পনা করেছেন,— তার কথা বলা, হাঁটা, কথা বলার বিশেষ ভঙ্গি, চরিত্রের বসে পড়া, উত্তেজিত হওয়ার ভঙ্গিটাও ভেবে রেখেছেন। যেহেতু একটা চরিত্র কখনও একমাত্রিক নয়, আক্ষরিক অর্থেই বহুমাত্রিক, সেজন্য একজন অভিনেতাকে পরিচালক বেছে নিতে বাধ্য হন যে-অভিনেতা এই বহুমাত্রিক চরিত্রের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশ করতে পারবেন। হয়ত দেখা গেল সেই নির্বাচিত অভিনেতা নয়টি প্রয়োজন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আটটি অভিব্যক্তি বা কাজ তাঁর অভিনয়ে আনতে পারছেন, কিন্তু স্থূলকায় হওয়ার জন্য চরিত্রের প্রয়োজন গুণাবলির মধ্যে একটি গুণ, অর্থাৎ দ্রুতবেগে হাঁটা তা পারছেন না। এক্ষেত্রে পরিচালককে পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। উদাহরণটি আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়। ধরে নিচ্ছি পরিচালক রাম নামক একজন অভিনেতাকে নির্বাচন করলেন; সেই রাম ভদ্রলোক হয়ত ক্রোধের দৃশ্য, প্রেম এবং কান্নার অভিনয় খুবই ভাল করতে পারেন, কিন্তু বিরক্তি বা ঘিনঘিনে রাগ এই ব্যাপারটা সেই অভিনেতা কিছুতেই অভিনয়ে ফোটাতে পারেন না। তাঁর সমস্ত রাগ করা জোরে বেরিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে পরিচালকের কল্পনায় স্থির করা চরিত্রের মধ্যে ঘিনঘিন রাগ থাকলেও পরিচালককে বাধ্য হয়ে রামবাবুকেই নির্বাচন করতে হয়, কারণ রাম ঘিনঘিনে ব্যাপারটা না পারলেও অন্য প্রয়োজনীয় অভিব্যক্তিগুলো ফোটাতে পারেন। আবার উল্টো উদাহরণও আছে, হয়ত দেখলেন জনৈক অভিনেতার অভিনয়ে শুধু চাপা বিরক্তি বা ঘিনঘিনে রাগই আছে, অন্য রাগ খুব ভাল নেই, সেই পরিস্থিতিতেও পরিচালক সেই অভিনেতাকেই পছন্দ করলেন, কারণ সেই চরিত্রের মূল সুরই হয়ত ওইরকম, সারাক্ষণের অসুখী মুখ ও চাপা বিরক্তি তার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে রয়েছে। সচেতন পরিচালক তখন ভাববেন নির্বাচিত অভিনেতার বিরক্তি-প্রকাশের দক্ষতা দিয়েই তিনি চরিত্রটিকে অভিনয়ের কাঙ্ক্ষিত মান অতিক্রম করাবেন, অন্য যে সব অভিব্যক্তি, তা রিহার্সাল ও নির্দেশনার কৌশলে বার করে নেবেন, অথবা এমনভাবে শট নেবেন যাতে সেই অভিনেতার তুলনামূলক দুর্বলতা ধরা পড়বে না।

এ ধরনের নানা ভাবনা এবং সমস্যা অতিক্রম করে একজন পরিচালককে ছবি তৈরি করতে হয়। একজন যোগ্য পরিচালকের চিন্তা ও সমস্যার কথা লিখতে গেলে অন্তত হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যায়। সুতরাং ছবি তো পরিচালকেরই ছবি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে একটা ছবি হয়ে ওঠে সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত থাকা প্রত্যেকেরই ছবি। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলব, পরিচালক হলেন নেতা, অনেকটা অস্থির সমুদ্রে একটা জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতোই তাঁর ভূমিকা। জাহাজের অসংখ্য ছোটবড় কলকবজা, অনেক নাবিক অর্থাৎ কলাকুশলী চলচ্চিত্র নামক জাহাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একটি ছবির ক্ষেত্রে পরিচালকের ভূমিকা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একেবারে অপরিহার্য, জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতোই।

কিন্তু পৃথিবীর আরও অনেক বিস্ময়কর ঘটনার মতো চলচ্চিত্রেও কখনও কখনও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ এমন ছবিও হয়, যে ছবিতে পরিচালক নেই। ‘নেই’ অর্থে আমি একেবারে শারীরিকভাবে অনুপস্থিতির কথা বলছি না, নামকোয়াস্তে হয়ত তিনি আছেন, কিন্তু কাজের প্রশ্নে গোটা ছবির সামগ্রিক সমস্যা এবং মুশকিল আসান পদ্ধতি তাঁর কল্পনায় বা অভিজ্ঞতায় নেই। এমনও হয় কল্পনাকে ঠিক কীভাবে বাস্তবায়িত করতে হয় তা তাঁর আংশিক জানা আছে। এমন দুঃখজনক পরিস্থিতিতে ছবিটা তৈরি হওয়াই খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আগেই বলেছি ছবি তৈরি একটা অনেক হাত দিয়ে ভারী বস্তুকে দাঁড় করানোর মতো কঠিন পরিশ্রম, কৌশল ও যত্নের কাজ। সেজন্য অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে গেলে ছবির বিভিন্ন বিভাগের কর্মীদের যথেষ্ট অসুবিধা হয়। অন্যদের কথা বাদ দিই, আমাদের অর্থাৎ অভিনেতাদের কষ্ট খুব বেড়ে যায়। তখন অনিবার্যভাবে যে চিন্তা মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তা হল যে— এই ভদ্রলোক তো কিছুই জানেন না, সাহায্য করা তো দূরের কথা, ইনি আমাকে সমগ্র ছবির একটা স্পষ্ট ধারণাই দিতে পারছেন না। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, একটা ছবির সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে থাকেন তাঁদের প্রত্যেকেরই কিন্তু একটা চূড়ান্ত লক্ষ্যবস্তু থাকে, সেটা হল— কী করে ছবিটাকে ভাল করে তোলা যায়। এই লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছনোর কাজে প্রধান উৎসাহদাতা এবং পথপ্রদর্শক হচ্ছেন ছবির পরিচালক।

এখানে একটু ভুল বোঝার অবকাশ হয়ত আছে। পরিচালক উন্নততর ছবির কাজে চূড়ান্ত লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নেতা হিসেবে সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান ঠিকই, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে একজন বড় অভিনেতা বা প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা একই ব্যাপার মাথায় না রেখে যন্ত্রের মতো অভিনয় করেন। একজন বড় অভিনেতা সব সময়েই পুরো ছবিটার কথা ভাবেন। জীবনে যেমন সবসময় সর্বোত্তম যোগাযোগ ঘটে না, তেমন ছবি তৈরির ক্ষেত্রেও সর্বদা একজন প্রতিভাবান পরিচালক ও যোগ্য অভিনেতা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান না।

একজন পরিচালক যদি একাই একটি ছবির একাধিক কাজ দক্ষ হাতে করতে পারেন তাহলে হয়ত খুবই ভাল হয়, কিন্তু পৃথিবীর একাধিক বিখ্যাত পরিচালক আছেন যাঁরা কিছু কিছু কাজ অন্যদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন এবং বিস্ময়কর ও স্মরণীয় ছবি করেছেন। পরিচালক নিজেই চিত্রনাট্য লিখলে হয়ত সোনায় সোহাগা হয়, কিন্তু অনেক বিখ্যাত পরিচালকই অন্যের লেখা চিত্রনাট্য নিয়ে ছবি করেছেন। অন্য কেউ চিত্রনাট্য লিখছেন মানে এই নয় যে পরিচালকের কল্পনার বাইরে তাঁর চিত্রনাট্যটি লিখিত হয়ে যাচ্ছে। পরিচালক যেমন তাঁর ছবির একজন অভিনেতার কাছ থেকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত অভিনয় করিয়ে নিয়ে থাকেন, তেমন চিত্রনাট্যকারের কাছ থেকে তাঁর পছন্দমতো কাজই তিনি করিয়ে নিয়ে তবে ছবির কাজ শুরু করেন। এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই চিত্রনাট্য-লেখকের সঙ্গে পরিচালক বার বার বৈঠকে বসেন এবং গোটা ছবি সম্পর্কে বার বার বিস্তারিতভাবে আলোচনাও করেন। তবে একটা কথা ঠিকই, একটা ছবির কল্পনা মাথার মধ্যে আসার পর পরিচালকের একটা প্রধান চিন্তা থাকে, যোগ্য ব্যক্তির হাতে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া। নিজে চিত্রনাট্য লিখলে, তাঁর অসংখ্য সমস্যার দ্রুত এবং সেরা সমাধান ঘটে যায়। আমি নিজে থিয়েটার করার সময় এই ব্যাপারটা খুব ভালভাবে উপলব্ধি করেছি। যে-নাটক আমি পরিচালনা করি, সেই নাটকের একটি চরিত্রে নিজেকে রাখতে পারলে একটা দায়িত্ব ঘাড় থেকে নেমে যায়। অর্থাৎ একটা বড় চরিত্রের অভিনয় নিয়ে আর কোনও চিন্তা রইল না, কারণ আমি জানি সেই চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয়টা করে দেবে। তেমনি চলচ্চিত্র তৈরির ক্ষেত্রে নিজেই চিত্রনাট্য লিখলে পরিচালকের মন থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা দায়িত্বমুক্তির উপলব্ধি ঘটে বলে আমি বিশ্বাস করি।

অযোগ্য উদাহরণে অনেকের চিত্তদাহের সম্ভাবনা আছে, সুতরাং পরিচালকের ছবি— এ প্রসঙ্গে যোগ্য উদাহরণ খোঁজা যাক। অবশ্য খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হবে না, একজন যোগ্যতম পরিচালক আমাদের ঘরের মধ্যেই আছেন, তিনি— সত্যজিৎ রায়। একটি ছবি তৈরির অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি নিজেই কল্পনা করতে পারেন এবং কল্পনা অনুযায়ী সেই কাজগুলি নিজেই বাস্তবে করতে পারেন, একেবারে হাতে-কলমে করে দেখিয়েও দিতে পারেন। গোটা ছবি, যাবতীয় সমস্যা-সহ তাঁর কল্পনায় উপস্থিত হয়। শুধু উপস্থিত হয় বললে কমই বলা হবে, খুবই শিল্পসম্মতভাবে আসে। তার চেয়েও বড় কথা, মানিকদা ছবি তৈরির সময় যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করে আগাগোড়া তাঁর চিন্তা অনুযায়ী কাজ করেন। একেবারে প্রথম থেকে শুরু করা যায়। মানিকদা চিত্রনাট্য নিজেই লিখতে পারেন এবং লেখেনও, তাঁর জীবনের প্রথম থেকেই তিনি তাই-ই করছেন। চিত্রনাট্য লেখার পর কার কার ওপর দায়িত্ব দিলে ভাল এবং উঁচুমানের ছবি হবে তা ঠিক করে নেন। ধরা যাক ক্যামেরাম্যান, একজন যোগ্য এবং গুণী ক্যামেরাম্যানকে শুধু নির্বাচন করেন তাই-ই নয়, তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করতে পারেন। করেনও। কারণ তাঁর নিজের ক্যামেরা-সম্পর্কিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি তোলেন, চলচ্চিত্রে আসার ঢের আগে রয়েল সোসাইটি অফ ফটোগ্রাফিতে ছবি পাঠাতেন, প্রদর্শনী করেছেন। একটি ছবিকে শিল্পসম্মত করে তোলার জন্য শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রস্তুতি আছে। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে নন্দলাল বসুর মতো শিল্পীর কাছে কাজ শেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। সুতরাং সামগ্রিকভাবে তাঁর শিল্পবোধ সম্পর্কে সন্দেহ করার কোনও সুযোগ নেই। বরং তাঁর ছবিতে আমরা অবাক হয়ে দেখেছি যে একজন পরিচালকের শিল্পবোধ কত উঁচুদরের হতে পারে বা তাঁর ছবির শিল্প-নির্দেশনার কাজ কত ভাল হতে পারে। যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি একেবারে প্রথম থেকেই গভীর প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন, তাঁর চারপাশে তিনি যে সব ব্যক্তিত্বকে সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরাই শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র-বোধের নির্ভুল পরিচয়। বংশী চন্দ্রগুপ্ত সুব্রত মিত্র— এঁরা শুধু একজন শিল্প-নির্দেশক বা একজন ক্যামেরাম্যান নন, এঁরা নিজেদের যোগ্যতাতেই একেক জন বিরাট প্রতিভাবান শিল্পী। যেহেতু সত্যজিৎ রায় নিজে একজন বড় শিল্পী, প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত চলচ্চিত্র-নির্মাতা, সেজন্য তাঁর পক্ষে ছবির বিভিন্ন দিকে এমন যোগ্যতম লোককেই বেছে নেওয়া স্বাভাবিক ছিল। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘পরিচালকের ছবি’। ডিকটেটর অর্থে নয়, আন্তরিক অর্থে একাধিক যোগ্য ব্যক্তির প্রচেষ্টায় যোগ্য নেতার নির্দেশে নির্মিত ছবি।

অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে পরিচালকের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আমার নিজের মতামত খুব পরিষ্কার। আমি ছবিটাকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালকের ছবি হিসেবেই কল্পনা করি। পরিচালক যেমন চাইবেন, তেমনই হবে। ভাল পরিচালক এবং মন্দ পরিচালক উভয়ের ক্ষেত্রেই আমার মনোভাব প্রায় একই রকম থাকে। পরিচালকের কাজে হস্তক্ষেপ করা আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না, আমি হস্তক্ষেপও করি না। এ কথা অবশ্য ঠিক যে, বয়স যত বেড়েছে তত ধৈর্য কমেছে এবং খারাপ কাজের প্রতি বিরক্তিও হয়ত বেড়েছে। একেবারে নেহাত খারাপ কিছু হচ্ছে দেখলে হয়ত কখনও কখনও হস্তক্ষেপ করেছি এবং সেটাও অনিচ্ছার সঙ্গে করেছি। পরিচালকের সঙ্গে অভিনেতার সম্পর্ক এমনই যে সর্বদা ব্যাপারটা সরকারি ভদ্রতার মতো দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। পরিচালকের যোগ্যতার তফাত ঘটলে অভিনেতার কাজের ধরনটা যায় বদলে। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করার সময় আমার স্বাধীনতা অনেক বেড়ে যায়। এই ‘স্বাধীনতা’-র অর্থ শিল্পীর স্বাধীনতা, আমার মনের স্বাধীনতা। কেন বেড়ে যায়? এর প্রথম এবং প্রধান কারণ হল অভিনেতাদের সঙ্গে মানিকদার কাজ করার পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ, যেখানে কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম তিনি খাটান না। অর্থাৎ যে অভিনেতা যেমন, যে রকম, তার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করেন, তাঁকে তেমনই গুরুত্ব দেন। আমার প্রথম ছবি তাঁর সঙ্গে করার জন্যই হোক বা ঘন ঘন তাঁর সঙ্গে ছবি করতে পারার সুযোগের জন্যই হোক অথবা অন্য কোনও কারণের জন্যই হোক না কেন— মানিকদার সঙ্গে আমার একটা অদ্ভুত গভীর-আন্তরিক বোঝাপড়া আছে। আমি স্বাভাবিক কল্পনাতেই বুঝতে পারি কোন ছবির চরিত্রটা উনি ঠিক কীভাবে ভেবেছেন, চরিত্রটি শেষ পর্যন্ত কেমন দাঁড়াবে। কোন দৃশ্যে চরিত্রটি কীভাবে হাঁটবে, কোন ভঙ্গিতে কথা বলবে ইত্যাদি ব্যাপারে আমি দেখেছি আমার ভাবনা ওঁর ভাবনার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে গেছে। ওঁর ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে আমার সৌভাগ্যের অন্ত নেই, সেজন্য বিস্তর উদাহরণ হাজির করা যায়।

প্রসঙ্গত ‘অশনি সংকেত’ ছবির কথা বলতে পারি। ‘অশনি সংকেত’-এর গঙ্গাচরণ চরিত্রে অভিনয়ে সূক্ষ্ম অংশ বা ডিটেল কি উনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন? না, বলতে হয়নি। উনিও চিত্রনাট্যকার হিসেবে যখন চরিত্রটির কথা লেখেন, তখন ওঁরও চরিত্রটি সম্পর্কে চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর নির্বাচিত অভিনেতা সম্পর্কেও একটা মূল্যায়ন করা হয়ে গিয়েছিল— এই অভিনেতার নাক-চোখ-মুখ এইরকম, এর দেহসৌষ্ঠব, অঙ্গ-সংস্থান এইরকম, এর কণ্ঠস্বর— এই এই ভাবাবেগ প্রকাশে সক্ষম ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর চিন্তায় নিশ্চয়ই এ কথা ঘোরাফেরা করেছিল যে এই অভিনেতার কাছ থেকে আমি গঙ্গাচরণের এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আদায় করতে পারব। একই সঙ্গে আমিও জানতাম উনি আমার কাছ থেকে ঠিক কী ধরনের অভিব্যক্তি চাইছেন— এটাই বোধহয় পরিচালকের সঙ্গে অভিনেতার সম্পর্কের একটা জীবন্ত এবং আন্তরিক উদাহরণ।

গঙ্গাচরণের হাত ধরেই এ প্রসঙ্গে আরও একটু এগিয়ে যাওয়া যায়। দুর্ভিক্ষের পরিবেশে গঙ্গাচরণের বাহ্যিক আচরণ, চলাফেরা ইত্যাদি কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত, তা স্থির করার ক্ষেত্রে আমাদের যৌথ উদ্যোগ ছিল। ‘অশনি সংকেত’-এর লোকেশন দেখতে সত্যজিৎ রায় বীরভূমে যেতেন, একাধিকবার গিয়েছেন। বীরভূম তো সত্যজিৎ রায়ের খুবই পরিচিত জায়গা, অনেক ছবি ওই জেলার বিভিন্ন পরিবেশে করেছেন, তবুও ‘অশনি সংকেত’ ছবি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনি বারবার বীরভূম গিয়েছিলেন। সাধারণত আমাদের দেশের ছবিতে যা ঘটে না, শোনা যায় না, রীতিনীতি নেই, সেই ব্যাপারটিই তখন ঘটেছিল। অর্থাৎ তিনি লোকেশন দেখার সময় আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের কেউ কেউ হয়ত আড্ডা মারতে বা ছুটি কাটাতে পরিচালকের সঙ্গে লোকেশনে যেতে পারেন, কিন্তু ছবির মূল চরিত্রের ঠিকানায় তাকে দেখতে যাওয়া আমাদের দেশে খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু মানিকদা আমাকে প্রতিবারই বীরভূমে নিয়ে গেছেন। উনি আমাকে যে সেই সুযোগ দিয়েছিলেন তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আমি যাতে সেই পরিবেশে পৌঁছে গঙ্গাচরণের পাড়ার, গ্রামের পরিচিত লোকজনের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করতে পারি, তাদের চলাফেরার স্টাইল লক্ষ্য করতে পারি। আমারও ইচ্ছে ছিল, আমিও মানিকদাকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু ইচ্ছা প্রকাশ করলেই কি সাধারণ পরিচালকরা প্রধান চরিত্রাভিনেতাকে লোকেশনে নিয়ে যান? এটা হচ্ছে পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সচেতন-নিষ্ঠার প্রকাশ এবং এই জন্যই তিনি অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা, এবং এই জন্যই সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘পরিচালকের ছবি’। লোকেশনে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আর কিছু বলেননি। যা দেখার আমি নিজেই দেখেছি। আসলে পরিচালক সত্যজিৎ রায় জানতেন, সবাইকে নয় এই অভিনেতাকে যদি আমি এই সুযোগটা দিই, তাহলে সে এই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। অন্য অর্থে এটা তাঁর কাজেও লেগেছে, কারণ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সৌমিত্র তো তাঁর ছবিতেই অভিনয় করবে, যদি লোকেশনের অভিজ্ঞতা তার নিজস্ব প্রস্তুতিকে সাহায্য করে, তাতে তাঁর ছবিই সামান্য হলেও উন্নততর হবে। আসলে মানিকদা তাঁর নিজের কাজটাকে এত বেশি শ্রদ্ধা করেন, যত্ন করেন যে, প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় থেকে বড় বড় ব্যাপার পর্যন্ত সর্বত্রই তাঁর সমান সতর্ক দৃষ্টি থাকে। এক্ষেত্রে তিনি ডিকটেটর তো ননই, একেবারে অন্য সম্পর্কের মানুষ, বলতে পারি অভিজ্ঞ ও বন্ধু পরিচালক। তিনি বিখ্যাত পরিচালক, গুণী মানুষ। সেজন্য তিনি সহজেই নিজের অহং বোধ থেকে এমন চিন্তাও তো করতে পারতেন যে, অভিনেতার আবার লোকেশনে যাওয়ার কী দরকার, আমি যেমন করে হাঁটতে বলব তেমন করেই হাঁটবে, যেমন করে তাকাতে বা মুখভঙ্গি করতে বলব তেমনই তো করবে। কিন্তু তিনি তা ভাবেননি, বরং সৌমিত্র-র গঙ্গাচরণ হয়ে ওঠার কাজে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছেন। ছবির শুটিং শুরু হওয়ার ঢের আগে থেকেই উৎসাহ দিতে শুরু করেছেন। আমি বীরভূমে গিয়ে বিরাট কিছু করিনি, ওখানকার মানুষদের চলাফেরা দেখেছি, স্কেচ করে এনেছি, পরে বাড়িতে এসে সেইভাবে হাঁটার অভ্যাস করেছি এবং শুটিং-এর সময় সেইভাবেই হেঁটেছি। সেটা মানিকদা দেখেছেন এবং অনুমোদনও করেছেন। অনুমোদন অর্থে উনি মুখে কখনও এসব কথা বলেন না, এটা এক ধরনের শব্দহীন অনুমোদন। এটা একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে কতটা অনুপ্রাণিত করে তা ওঁর ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁরাই জানেন।

আবার ওই ছবিতেই উনি দু-একটা জায়গায় ছোট্ট এমন একটা নির্দেশ দিয়েছেন যার মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। সাধারণত উনি আমাকে প্রায় নির্দেশই দেন না, কিন্তু যখন যতটুকু দেন সেটা আমার ভুল সংশোধনের পক্ষে এত জরুরি, এত মোক্ষম যে সেটা বুঝতে আমার এক মূহূর্তও দেরি হয় না। ওঁর ছবিতে নিশ্চিন্তে প্রাণ খুলে অভিনয় করতে পারার এটাও একটা কারণ যে, আমি জানি আমার যদি কোনও ভুল হয়, তাহলে পরিচালক হিসেবে এমন একজন আছেন, যিনি আমার ছোট্ট ভুলও শুধরে দেবেন। স্বাভাবিকভাবে আমার আত্মবিশ্বাস অসম্ভব বেড়ে যায় এবং আমি প্রায় যা খুশি করার মতো মানসিক-আনন্দে পৌঁছে যাই। কিন্তু অন্য অধিকাংশ পরিচালকের ছবিতে অভিনয়ের সময় অনেক সতর্ক হয়ে, সঙ্কুচিত হয়ে কাজ করতে হয়, কারণ তখন সর্বদাই একটা চিন্তা মাথার মধ্যে খোঁচা দেয়, যদি আমি কোনও ভুল করি, তাহলে আমার সেই বিচ্যুতি সংশোধনের কেউই ফ্লোরে নেই। আজ হয়ত দীর্ঘদিন অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য এক ধরনের দক্ষতা এসে গেছে, কিন্তু যখন অভিনেতা হিসেবে অভিজ্ঞতা ছিল না, বয়স কম ছিল, তখন এই ব্যাপারটা— আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ দুটোই একেবারে তুঙ্গে পৌঁছে যেত। সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশ দেওয়া প্রসঙ্গে এই ঘটনার কথা হয়ত আগেও লিখেছি, তবুও আবার বলছি। ‘অশনি সংকেত’-এ একটা দৃশ্য ছিল যেখানে জোতদারকে রাত্রিতে কিছু লোক ঠেঙিয়েছিল। এরপর গঙ্গাচরণ সেই জোতদারকে দেখতে এসেছিল, আসল উদ্দেশ্য কিছু চাল সংগ্রহ করা, কিন্তু ভাবটা এমন যেন রোগী দেখতেই এসেছে। গঙ্গাচরণ নির্ভুলভাবেই জানত যে জোতদারের বাড়িতে চাল আছে। জোতদার বিছানায় শুয়ে শুয়ে খুব ভয় পেয়ে প্রায় কান্নাকাটি করে বলছে যে তাকে মেরেছে। তারপর সে নিজেই তার মেয়েকে বলছে— ‘ওরে আড়ায় একটুখানি চাল আছে সেটা পণ্ডিতমশাই-কে দিয়ে দে’। অর্থাৎ গঙ্গাচরণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল।

প্রসঙ্গত বলি: গঙ্গাচরণের চরিত্রে একটা সামান্য হলেও ধূর্তামি রাখব বলে আমি গোড়া থেকেই ভেবেছিলাম। এই ধূর্তামিকে একদিক থেকে আমি বলব নিষ্পাপ ধূর্তামি। সে পাপী বদমাইশ লোক নয়, প্রচণ্ড অভাবের সংসারে শুধু বেঁচে থাকার জন্যই সে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে, এটুকু ধূর্তামি না করলে সে নিজের অস্তিত্বই রক্ষা করতে পারে না। গঙ্গাচরণের এই ধূর্তামি হচ্ছে, তার চেয়েও অশিক্ষিত এবং সরলতর কয়েকটা মানুষকে তার কৌশলে বশীভূত করে নিজের সংসার চালানো, কাউকে মাদুলি দিচ্ছে, কাউকে ওষুধ দিচ্ছে, আবার মন্ত্র দিয়ে গ্রাম বেঁধে দিচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির পরিহাস হিসেবে দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম পেরিয়ে আরও বিশালতর সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে গ্রামের অন্যান্যদের মতো গঙ্গাচরণও অসহায়। দুর্ভিক্ষ তাদের সবাইকে একই মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

সেই বিশেষ দৃশ্যটির প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। সেই দৃশ্যে, গঙ্গাচরণ যখন সাফল্যের সঙ্গে চালটুকু পেতে চলেছে তখন তার ধূর্তামির প্রকাশ হিসেবে রিহার্সালের সময় একটা ক্ষীণ হাসি চোখের সামান্য ভাঁজে, ঠোঁটের কোণে লাগিয়ে রাখছিলাম। চিকিৎসার ছলে এসে গঙ্গাচরণ তার পরম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটুকু যখন হাতিয়ে নিচ্ছে তখন তাঁর ধূর্তামির প্রকাশে ওই হাসিটুকু দরকার বলে আমার মনে হয়েছিল। দু-তিনবার রিহার্সালের পর যখন শটটা টেক করা হবে তখন মানিকদা আমাকে বললেন— ‘সৌমিত্র, ওই হাসিটা রেখো না, ওটা অফ করে দাও, যেন কিছুই হয়নি।’ ব্যস, আর কিছুই বললেন না। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের সামনে বিদ্যুৎ চমকের আলোর মতো গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মুহূর্তে বুঝতে পারলাম যে গঙ্গাচরণ যদি না হেসে ওটা করে তাহলে তার ধূর্তামিটা আরও বেশি করে প্রকাশ পায়। যেন চাল পাওয়ার ব্যাপারে গঙ্গাচরণের বিন্দুমাত্র আগ্রহই নেই, সে তো এসেছিল চিকিৎসা করতে।

এইভাবে চরিত্রের সূক্ষ্মতর প্রকাশ অর্থাৎ গঙ্গাচরণের ছলনার এই ব্যাখ্যা যিনি করতে পারেন সেই পরিচালকের ছবিই নানাবিধ গুণে ধনী হয়ে উঠতে পারে। মানিকদা, গোটা শুটিং-এ আমাকে গঙ্গাচরণ প্রসঙ্গে একটা কথাও বলেননি, কিন্তু হঠাৎ এমন একটা পরামর্শ দিলেন যাতে গোটা দৃশ্যই অনেক উন্নতমানে পৌঁছে গেল। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার মনের যোগাযোগ কতটা তারও এটা একটা উদাহরণ বলতে পারি। একটা ছবি যোগ্য পরিচালকের হাতে পড়লে গোটা ব্যাপারটাই তাঁর কল্পনা অনুযায়ী রূপায়িত হয়। চিত্রনাট্য, শট নেওয়ার পরিকল্পনা সবই পরিচালকের প্রত্যক্ষ সৃষ্টি, এক অর্থে অভিনেতা-অভিনেত্রীও তখন অনেকটা জীবন্ত সেট-এর ভূমিকা পালন করে, যেন একটা ঘড়ির অনেকগুলো চাকার মধ্যে একটা চাকা, নিজের কাজটুকু করতে মগ্ন।

কিন্তু একজন ভাল অভিনেতা বা যিনি ভাল অভিনেতা হয়ে উঠতে চাইছেন, তাঁর নিজের কিছু মৌলিক অবদানও ছবিতে থাকে। সচেতন ও দক্ষ অভিনেতার সেই অবদান ছবিটাকে জীবন্ত করে তোলে। পৃথিবীর বহু ভাল ভাল ছবিতে এই অবদানের উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেক ভাল অভিনেতাই তাঁর অভিনীত চরিত্রের অভিনয়ে নিজস্ব কিছু করার চেষ্টা করেন। ছবিটাকে জীবন্ত করে তোলার ব্যাপারে ভাল অভিনেতাদের ভূমিকা প্রায় প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ অভিনেতা হয়ত একটা বাড়ি তৈরি করে দিতে পারেন, কিন্তু সেই বাড়িটাতে আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য একজন গুণী অভিনেতার প্রয়োজন হয়।

মানিকদার ছবিতে সেই আলো জ্বালানোর চেষ্টা করার সুযোগ আমি বরাবর পেয়েছি। মানিকদা আমাকে সেই স্বাধীনতা প্রথম থেকেই দিয়ে এসেছেন। কখনও কখনও অন্য দু-একজন পরিচালকের ছবিতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তাঁরা আমাকে চরিত্রটিতে প্রাণ ঢেলে অভিনয় করতে উৎসাহিত করতে পেরেছেন। সাম্প্রতিককালের ছবির মধ্যে ‘সংসার সীমান্তে’, ‘কোনি’ এবং ‘আতঙ্ক’র চরিত্র আমাকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিল, আমিও অভিনয় করে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। একজন নিবেদিতপ্রাণ অভিনেতা তাঁর পছন্দসই চরিত্র পেলেই আন্তরিক চেষ্টায় একটু নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্য অভিনেতাদের উদাহরণ দিলেই হয়ত ভাল হত, কিন্তু তার একটা বিপদও আছে। তার চেয়ে বরং নিজের কথাই বলি।

সত্যজিৎ রায়ের ছবি। ওই ‘অশনি সংকেত’ ছবিতেই একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। একটা বাড়িতে চাল চাইতে এসেছি, বিকেল বেলার দিকে শটটা নেওয়া হচ্ছে। বাড়ির মহিলাটি বললেন, ‘আপনি দাঁড়ান, আমি দিচ্ছি।’ বলে মহিলাটি ঘরের মধ্যে চলে গেছেন চালের সন্ধানে, গঙ্গাচরণ অপেক্ষা করছে। তখন তার খিদে, তেষ্টা সবই রয়েছে, চাল সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন, সব মিলে শরীরের একটা তীব্র প্রয়োজনবোধ কাজ করছে। সেই শটটা নেওয়ার সময় যখন ক্যামেরাটা আমার কাছে চলে আসছে, আমি নিজেই ঢোক গেলার মতো একটা জিনিস করেছিলাম। আমি বুঝতে পারলাম মানিকদা তাতে খুশি হলেন। সাধারণত উনি শট নেওয়ার পর ‘ওকে’ বা ‘গুড’ এ ধরনের মন্তব্য করেন। কিন্তু সেই দৃশ্যটা টেক করার পর আমাকে শুধু ছোট্ট করে বললেন— ‘এক্সেলেন্ট’। ওই ছোট্ট মন্তব্যটি একেবারে মনের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে অভিনেতাটি এমনই অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ে যে সে মনে মনে আরও পাঁচটা পরিস্থিতি খুঁজতে শুরু করে দেয়। সে অন্বেষণ অভিনেতাকে যথার্থই উদ্যোগী করে, অন্যতর উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

একজন অভিনেতার সঙ্গে পরিচালকের সম্পর্ক এবং অভিনয় ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কেন বারবার সত্যজিৎ রায়ের কথা এসে যাচ্ছে এ নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও অভিজ্ঞ পাঠক প্রশ্ন তুলবেন না। কারণ তিনিও জানেন মানিকদার ছবি দিয়েই আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি এবং তাঁর সস্নেহ সাহায্যে আমার সিনেমা জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেজন্য সর্বোত্তম উদাহরণ উপস্থিত করতে গেলে আমাকে সত্যজিৎ রায়ের কথাই বলতে হবে। যখন প্রথম ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করি তখন আমার অনেক ব্যাপারে সংশয় ছিল, কিন্তু শঙ্কা ছিল না। অতবড় পরিচালকের সঙ্গে প্রথম কাজ করছি এজন্য আমার কোনও ভয় ছিল না। এই ভয় না থাকার কারণ অবশ্য মানিকদা নিজে, উনি অত্যন্ত সহজভাবে আমাদের সঙ্গে মিশতেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই যাবতীয় ব্যবধান দূর হয়ে যেত। তবে অভিনয়ের নতুন মাধ্যম সম্পর্কে একটা ভয় ছিল, অনভিজ্ঞতাজনিত ভয়। কিন্তু সেটাও মানিকদা নিজেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। ‘অপুর সংসার’ শুরু করার আগে একাধিকবার শুটিং দেখিয়েছেন। ওঁর জলসাঘর, পরশপাথরের শুটিং দেখতে আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন। ফলে আস্তে আস্তে ক্যামেরা-সম্পর্কিত ভয় বা অস্বস্তি আমার কেটে গিয়েছিল। আমার একটা ক্যামেরা টেস্টও নিয়েছিলেন। আমার ধারণা সেই ক্যামেরা টেস্ট নেওয়া শুধু আমার জন্যই নিয়েছিলেন, ওঁর নিজের কাজের ক্ষেত্রে তার কোনও প্রয়োজন ছিল না। উনি নিজে এটা কখনও বলেন না, তবে শুধু আমাকে সাহায্য করার জন্য, ক্যামেরা বস্তুটার সঙ্গে আমার পরিচয় হবে এই ছিল ওঁর উদ্দেশ্য। ওঁর মতো পরিচালক আমাকে দেখে বুঝতে পারেননি যে আমাকে ক্যামেরায় কেমন লাগবে— একথা আমি বিশ্বাস করি না। ওঁর মতো শিল্পীর পক্ষে ওঁর ড্রয়িং টেবিলে বসে আমার মুখটা এঁকেও দেখা সম্ভব ছিল যে আমাকে কেমন দেখাবে। যত দিন গেছে ততই আমার মনে হয়েছে ওই ক্যামেরা টেস্টটা উনি শুধু আমাকে সাহায্য করার জন্যই করেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, উনি আমার একটা ভয়েস টেস্টও নিয়েছিলেন। আমি তখন রেডিও-তে কাজ করতাম, উনি হয়ত রেডিও-তেও আমার গলা শুনেছিলেন এবং বুঝতেও পেরেছিলেন। তবুও আমাকে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে আমার অস্বস্তিটুকু কেটে যাবে তা উনি নির্ভুলভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।

আমার মনের মধ্যে একটা সমস্যা ছিল, আমাকে নিয়েই। একথা এখন লিখলে হয়ত অনেকে হাসবেন, কিন্তু আমি আন্তরিক সত্যি কথা বলছি বলেই আমাকে বিশ্বাস করার আবেদন জানাচ্ছি। আমার মনের মধ্যে প্রবল সন্দেহ ছিল যে আমাকে ক্যামেরায় ঠিক কেমন দেখাবে। ছোটবেলা থেকেই আমার ধারণা ছিল যে আমাকে দেখতে খুব খারাপ এবং ক্যামেরায় আমাকে ততোধিক খারাপ লাগে। কী কারণে আমার এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল তাও আমি জানি। তখন, আমাদের ছোটবেলা, ভাল ক্যামেরা ইত্যাদি তো সর্বত্র পাওয়া যেত না, এবং স্কুল-কলেজে যে-সব ছবি আমার তোলা হত তাতে আমার খুনি অথবা বেশ বদমাইশ ধরনের একটা চেহারা ফুটে উঠেছে বলে মনে হত। এসব চিন্তা খালি মনের মধ্যে রেকর্ডের মতো ঘুরত। তারপর একদিন মনে মনে ভাবলাম ক্যামেরায় আমাকে যেমন খুশি দেখাক, দায় সত্যজিৎ রায়ের, উনি তো দেখেশুনেই আমাকে নিয়েছেন। ক্যামেরায় কখন কীরকম লাগবে সেটাও সুব্রত মিত্রের চিন্তা, উনিই ওসব ভাববেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, এই চিন্তা আমাকে অনেকটা সাহায্য করেছিল বলেই প্রাণ ঢেলে অভিনয় করতে পেরেছিলাম।

‘অপুর সংসার’ ছবির জন্য মানিকদা যখন আমাকে নির্বাচন করলেন, তখন আমার ছায়াছবিতে অভিনয় সম্পর্কে প্রায় কিছুই ধ্যানধারণা ছিল না। কীভাবে আমাকে পছন্দ করেছিলেন সে ইতিহাস আজ সকলেই জানেন, তাই নতুন করে লেখার প্রয়োজন বোধ করছি না। আলাপ হওয়ার পরে মাঝে মাঝে ডাকেন, আমিও নিজে থেকে ওঁর কাছে যাই, গল্প-আড্ডা ইত্যাদি হয় এবং দ্রুতগতিতে সম্পর্কের দূরত্ব কমতে থাকে। একদিন আমাকে বললেন, বইটা পড়ে ফেলতে। তারপর চিত্রনাট্য লেখা শেষ হওয়ার পর উনি সেই চিত্রনাট্যের একটা কপি আমাকে পড়তে দিলেন। সেই প্রথম, এর আগে উনি কাউকে ওঁর চিত্রনাট্য পড়তে দিতেন না, কিন্তু আমাকে দিয়েছিলেন এবং সেটা এখনও আমার কাছে আছে। ইংরেজিতে লিখতেন তখন, যাবতীয় প্রয়োজনীয় নির্দেশ, টীকা সবই ইংরেজিতে লেখা, শুধু সংলাপ অংশ বাংলায় লেখা। সেই চিত্রনাট্যের প্রথম খসড়া (first draft) আমাকে দেওয়ার পর ভাল করে পড়তে বললেন। আমিও প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে পড়া শেষ করলাম। চিত্রনাট্যটি পড়ে আমার মনে যত বিচিত্র প্রশ্ন উপস্থিত হত আমি সবই মানিকদাকে জিজ্ঞাসা করতাম, আলোচনা করতাম। সাধারণত উনি অভিনেতাদের সঙ্গে খুব বেশি আলোচনা করেন না, কিন্তু কেউ করলে আপত্তি করেন না। এটা ওঁর একেবারে নিজস্ব, মৌলিক পদ্ধতি। উনি কখনও নিজে থেকে এসে বলবেন না— ‘শোনো, আমি কীরকমভাবে এই চরিত্রটির কথা ভেবেছি জানো’,— ইত্যাদি ধরনের কথা বলে কোনও আলোচনা করার কোনও অভ্যাস ওঁর নেই। কিন্তু যদি কেউ, অর্থাৎ কোনও অভিনেতা যদি নিজে থেকে কোনও চরিত্রের অভিনয় সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন, তাহলে সেই অভিনেতাকে যত কম শব্দে পারেন উত্তর দেবেন এবং নির্ভুল উত্তর দেবেন। আমি ওঁর কাছ থেকে একটু বিশেষ ব্যবহার পেয়ে এসেছি, কিন্তু অন্য অভিনেতাদের সম্পর্কে উনি কখনও খুব বেশি আলোচনা করেন না। খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কেউ অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত হলে তাঁকে চিত্রনাট্য পড়ার সময় কয়েকটি কথায় পরিষ্কারভাবে চরিত্রটির কথা বলে দেন, আবার কখনও রিহার্সালের সময়ও বলে দেন। সত্যজিৎ রায়, অর্থাৎ সর্বদাই বিরাট পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাপার— যদি এমন কেউ ভাবেন তাহলে সেই ধারণা সত্যের অনেক দূরে থেকে যাবে। একেবারে সহজসরল ভাষায় চরিত্রটি ব্যাখ্যা করে দেন। হয়ত চরিত্রটির আর্থিক অবস্থা বা বিশেষ কোনও মানসিক দুর্বলতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন— ‘বড়লোকের ছেলে, চলাফেরা তেমনই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে যাবতীয় কথা বা আলোচনা সবই আগে, ছবির শুটিং-এর সময় চরিত্রটি নিয়ে কোনও ধরনের আলোচনা করেন না।

‘অপুর সংসার’-এর সময় অবশ্য উনি নিজে থেকেও আমাকে ‘অপু’ চরিত্রটি সম্পর্কে একটা দু-পৃষ্ঠার ‘অপু-পরিচিতি’ লিখে দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে নয়, বাংলায়। এটা বা এ ধরনের সাহায্য উনি অন্য কাউকে কখনও করেছেন কিনা আমি জানি না, তবে আমার ক্ষেত্রে সেটাই প্রথম প্রাপ্তি। সেই দুটি পৃষ্ঠা এখনও আমার কাছে আছে। লেখাটি আমি বারবার পড়েছিলাম। আমার নিজের, তখনকার কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী (যা আজকে বুঝতে পারি স্ট্যানিসল্যাসভস্কি ইত্যাদি পড়ার অনিবার্য ফল) পুরো অপু চরিত্রের একটা সাইকোবায়োগ্রাফি তৈরি করেছিলাম। সেটা চিত্রনাট্যে যেখানে যেখানে অপু নেই অথবা দুটো দৃশ্যের মাঝখানের সময়, অর্থাৎ অপু যদি রবিবার কোনও রেস্তোরাঁতে খায় এবং বুধবার নৌকো করে কোথাও বেড়াতে যায় তাহলে মাঝখানের দুটো দিন সে কোথায় কী করছিল? সেই মাঝখানের দু’দিন অপু কী করতে পারে তা আমি লিখতাম। আজ ভাবলে হাসি পায়, সেই সময়ে আমি সেগুলো আবার মানিকদাকে দেখাতামও। উনি কিন্তু হাসি বা ঠাট্টা করা তো দূরের ব্যাপার, আমাকে প্রবল উৎসাহ দিয়ে বলতেন— ‘বাঃ বাঃ, ঠিক হয়েছে।’ কখনও ছেলেমানুষী বলে উড়িয়ে দেননি, বরং যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো দেখতেন। আসলে উনি বুঝেছিলেন যে অভিনেতাটি এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ‘অপু’ চরিত্রটির মধ্যে ঢুকছে, উনি সেই পদ্ধতিটাকেই উৎসাহ দিয়েছিলেন। আমি কী ছাইপাঁশ লিখেছিলাম তা নিশ্চয়ই ওঁর মতো মানুষের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, কিন্তু আমার পদ্ধতি ও চিন্তাটা হয়ত ওঁর ভাল লেগেছিল।

এখন আমার ‘অপুর সংসার’ ছবিটা দেখে মনে হয় আমি কিছু বুঝিনি, যা বোঝার তা উনিই বুঝেছিলেন। আমাকে যা করতে বলেছিলেন আমি তাই-ই করেছিলাম। বস্তুতপক্ষে ‘অপু’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আমার নিজেকে চেনার, চিহ্নিত করার প্রশ্ন জড়িত ছিল। শুধু আমার নয়, আমার মনে হয় সেই সময়ে আমাদের বয়সী প্রত্যেকটি ছেলের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য, আমরা সকলেই একটু একটু করে ‘অপু’ ছিলাম। অপু চরিত্র অভিনয়ের জন্য ঠিক কী করতে হবে তার সবটাই তো মানিকদার বোঝার ব্যাপার ছিল। আমি নিজে তখন ফিল্মে অভিনয়ের কিছুই জানতাম না।

কিন্তু এর পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও আমার, কোনওরকম অসুবিধা হয়নি কেন? আমি তো সহজ আবেগে বহে যাওয়া ঝর্নার মতো এগিয়ে গিয়েছিলাম, কোথাও হোঁচট খাইনি। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা হচ্ছে, এটা আমার প্রথম ছবি তৈরি করার কাজ শুরু করার আগে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ থাকারই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফল। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালকের সঙ্গে একেবারে জীবনের প্রথম ছবিতে কাজ করে এমন আনন্দদায়ক, উত্তেজনাময় অভিজ্ঞতা কজন অভিনেতার জীবনে জুটেছে আমি জানি না, তবে আমার কাছে ব্যাপারটা এখনও উত্তেজনাময়। তবে সত্যজিৎ রায় যে সর্বদা এমন সহজভাবে সব অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন তা নয়। সেই অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের নাম আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই করব না, আমি এমনও দেখেছি যে মানিকদা কোনও কোনও ক্ষেত্রে একেবারে অভিনয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশেও নির্দেশ দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন। আক্ষরিক অর্থে শুটিং-এর সময় অভিনেতাকে— ‘এদিকে তাকান, হাত তুলুন, মাথা নিচু করুন’ ইত্যাদি ধরনের নির্দেশ দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন। আমার ক্ষেত্রে, যে কারণেই হোক ব্যাপারটা তেমনভাবে কোনো দিনই ঘটেনি। আমার ধারণা মানিকদার সঙ্গে একটা আন্তরিক, যা ঠিক দেখানো বা বোঝানো যায় না এমন ধরনের যোগাযোগ থাকার জন্যই বারবার ঘটেছে। অন্য কিছু কারণও থাকতে পারে, তবে আমি সেগুলোর খবর জানি না। আগেই বলেছি ওঁর কাজের পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যাপক ও উদার, একটা কিছু মনোমতো না হলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য কিছু যা একই রকম চমৎকার, তা চট করে ভেবে নিতে পারেন। বড় বড় সংলাপ থাকলে যদি কখনও সামান্য দু-একটা শব্দ এদিক-ওদিক হয় অনেক সময় উনি তা মেনে নিয়েছেন, আবার কখনও কখনও বলেন যে এই অংশটুকু ভাল করে মুখস্থ করবে, প্রতিটি শব্দ নির্ভুলভাবে সংলাপে থাকা দরকার।

প্রত্যেক বড় পরিচালকের আরও একটা প্রায় সহজাত দক্ষতা থাকে, সেটা হল, ছবির চরিত্রের জন্য উপযুক্ত অভিনেতা নির্বাচন করা। দর্শকদের ছবিটা দেখার সময় বা দেখার পর মনে হবে অমুক চরিত্রটিতে অমুক অভিনেতা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে কাজ করা সম্ভব হত না। অন্য কাউকে মানাত না এবং অভিনয়ের দিক থেকেও বোধহয় খামতি থেকে যেত। সত্যজিৎ রায়ের প্রায় সব চরিত্র সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য। শুধু সত্যজিৎ রায় নয়, পৃথিবীর আরও বড় বড় পরিচালক যাঁরা আছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এ কথা একই রকম সত্য। কুরাসোয়া-র ছবি দেখলেও তো একই কথা মনে হয়। ‘রসোমন’ ছবিতে তোশিরো মিফুনে-কে বাদ দিয়ে অন্য কারও কথা ভাবা যায়? কুরাসোয়া-র আত্মজীবনী পড়ে একটা মজার ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম যে, তোশিরো মিফুনে-র সঙ্গে কুরাসোয়ার যেমন সম্পর্ক, আমার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের অনেকটা তেমনই সম্পর্ক। তোশিরো মিফুনে-র জীবনের তৃতীয় ছবি হচ্ছে কুরাসোয়া-র সঙ্গে এবং সেই ছবিটাই পৃথিবী-বিখ্যাত ‘রসোমন’। কুরাসোয়া-র ‘রসোমন’ থেকেই যে পৃথিবীর মানুষ তোশিরো মিফুনে-কে জানে এ কথা আবার বলার কোনও প্রয়োজন নেই, কিন্তু এই জানার সঙ্গে একটা ধারণাও হয়ত কারও কারও আছে যে ‘রসোমন’-ই হচ্ছে তোশিরো মিফুনে-র জীবনের প্রথম ছবি, তা নয়। এমনকি কুরাসোয়া-র পরিচালনাতেই মিফুনে ‘রসোমন’-এর আগে একটা ছবি করেছিলেন। তোশিরো মিফুনে-কে পছন্দ করার ঘটনাটিও বেশ নাটকীয় এবং মজার। একটা স্টুডিওতে অভিনেতা পছন্দ করার পালা চলছিল, কুরাসোয়া-র গুরুস্থানীয় দুজন পরিচালক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কুরাসোয়া নিজে একটা ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য সেই নতুন অভিনেতা নির্বাচনের ব্যাপারে উপস্থিত থাকতে পারছিলেন না, যদিও নিয়ম অনুযায়ী একজন পরিচালক হিসেবে ওঁরও ওই অভিনেতা-পরীক্ষা পর্বে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। মধ্যাহ্নভোজের সময়ে কুরাসোয়া স্টুডিওতে ফিরে এসে দেখলেন একজন অভিনেতার পরীক্ষা নেওয়া চলছে এবং সেই অভিনেতা দারুণ হইচই করে দুর্দান্ত অভিনয় করল। দেখে কুরাসোয়া মনে মনে ভাবলেন, বাঃ তরুণ অভিনেতাটির মধ্যে তো অসাধারণ অভিনয়-ক্ষমতা রয়েছে! মধ্যাহ্নভোজের পর কুরাসোয়া আবার নিজের শুটিংয়ে চলে গেলেন। বিকেলে, সারাদিনের কাজ শেষ করে স্টুডিওতে ফিরে এসে দেখেন যে, তখনও সেই দারুণ অভিনয়-করা যুবকটিকে নেওয়া হবে কী হবে না তা নিয়ে জোর তর্ক-বিতর্ক চলছে। কেন? সে নাকি জাপানি কায়দায় ভদ্রতাসূচক ব্যবহার করেনি, বসতে বলার আগেই বসে পড়েছিল বা ওই জাতীয় একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিল। অন্য যে সব কর্তাব্যক্তি, তাঁরা তখনও তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করছেন— ‘না, এমন অসভ্য ধরনের লোককে নেওয়া যায় না।’ কিন্তু একজন, যিনি কুরাসোয়া-র গুরুস্থানীয় তিনি বাধা দিয়ে বলছেন— ‘না, না, ছেলেটির মধ্যে দারুণ অভিনয় আছে, ওকেই নেওয়া হোক।’ তখন কুরাসোয়া নিজে ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করে বললেন— ‘কী আশ্চর্য! আপনারা অভিনয়ের কী বোঝেন? ইনি বলছেন ছেলেটিকে নিতে, আপনারা রাজি হচ্ছেন না কেন? আমি নিজে ছেলেটির অভিনয় দেখে গিয়েছি, ওকেই নেওয়া হোক।’ কুরাসোয়া-র ভেটো প্রয়োগে কাজ হল এবং শেষ পর্যন্ত সেই সামান্য অভদ্র যুবক অর্থাৎ তোশিরো মিফুনে-কে নেওয়া হল। সুযোগ পাওয়ার পর মিফুনে কুরাসোয়া-র গুরুস্থানীয় দুই পরিচালকের দুটো ছবিতে অভিনয় করলেন, দুটো ছবিই হিট করল। তারপর কুরাসোয়া-র সংগে দুটি ছবি করার পর ‘রসোমন’-এ অভিনয় করলেন তোশিরো মিফুনে, এবং গোটা পৃথিবীর চলচ্চিত্র-রসিকরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন মিফুনে কত বড় অভিনেতা। কুরাসোয়া লিখছেন— ‘অনেকে বলেন, মিফুনে নাকি আমারই সৃষ্টি, কিন্তু তা সত্যি নয়। মিফুনের মধ্যে অসাধারণ অভিনয়-ক্ষমতা ছিল, সেই অভিনয়-ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রকাশের জন্য যতটুকু কাট-ছাঁট এবং পালিশ করা প্রয়োজন ছিল তাও আমার দুই গুরু তাঁদের ছবিতে অভিনয় করার সময় করে দিয়েছিলেন, আমি কিছুই করিনি।’ কুরাসোয়া-র এই মানসিকতাই তোশিরো মিফুনে-কে তাঁর সেরা দক্ষতাকে উজাড় করে দেওয়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে আমি বিশ্বাস করি। গোটা পৃথিবী তো এ-সত্য জানে যে, মিফুনে কুরাসোয়া-র মতো অসাধারণ গুণী পরিচালককে পেয়েছিলেন বলেই তাঁর দক্ষতাকে দেখাতে পেরেছিলেন। কিন্তু কুরাসোয়া-র মানসিকতা এবং বক্তব্য মুগ্ধ করার মতো। আসল সত্য আরও সরাসরি বলা যায়, যার ভেতরে অভিনয়-ক্ষমতা নেই তাকে কোনও বড় পরিচালকও ভাল অভিনেতা হিসেবে তৈরি করতে পারেন না। প্রতিভাবান পরিচালকের প্রাথমিক কাজগুলির মধ্যে এই সম্ভাবনা বা লুকানো দক্ষতা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে আবিষ্কারের ক্ষমতা থাকা দরকার, থাকেও। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে একজন বড় পরিচালক একজন সাধারণ মানের অভিনেতাকে দিয়ে একখানা বা দেড়খানা ছবির জন্য ভাল অভিনয় করিয়ে নিতে পারেন, তার বেশি পারেন না এবং বোধহয় চেষ্টাও করেন না।

পরিচালকের ছবি প্রসঙ্গে এত কথা বলার পরে প্রাসঙ্গিক অন্য কথাও এসে পড়ে। ছবির গল্প, চরিত্র এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ের জন্যেও ছবি স্মরণীয় হয়ে থাকে, ছবি উতরে যায়। নিজেকে একজন দর্শক হিসেবে ভেবে আমি নিজের কিছু মতামত এ প্রসঙ্গে জানাতে পারি। দু-একটা ছবির কথা বলব, সেগুলো ফ্লপ ছবি, সেজন্যই হয়ত অনেকে মনে রাখেননি। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটি মনে রাখার হয়ত একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে ছবিটির পরিচালক সত্যজিৎ রায়। যদিও অনেকে বলেন চিড়িয়াখানা হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের করা সবচেয়ে খারাপ ছবি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি ছবিটাকে একটা কারণেই মনে রাখব তা হচ্ছে উত্তমকুমারের অভিনয়। ভাল বললে যেন সবটা বলা হয় না, ইংরেজি ‘ব্রিলিয়ান্ট’ শব্দটিই আমি ওই অভিনয়ের আগে বসাতে চাই। ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমার খুব ভাল অভিনয় করেছিলেন এ কথা সবাই জানেন, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দের প্রশ্নে আমি ‘চিড়িয়াখানা’-র উত্তমকুমারকে একটু ওপরে রাখব। এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে কোনও ধরনের তর্কে বসার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। একজন অভিনেতার জন্যও একটা ছবিকে মনে রাখা যায়। সেই ছবিটাকে যে খুব উঁচুদরের কিছু হতে হবে, বা আর্থিক সাফল্য পাবে তার কোনও মানে নেই। একগাদা বুনো লতাপাতার মধ্যে হঠাৎ যেমন একটা জুঁই গাছ দেখা যায়, ঠিক সেইরকম ব্যাপার। এ ব্যাপারে একাধিক উদাহরণ দেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গল্প, দেবকীকুমার বসু পরিচালক, বেশ কিছু নামী অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে ‘চিরকুমার সভা’ হয়েছিল। এখন ছবিটাকে দেখলে খুবই হাস্যকর লাগে। কিন্তু আমার কাছে ছবিটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে উত্তমকুমারের ‘পূর্ণ’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। আমি বিশ্বাস করি সচেতন অনেক দর্শকেরও নিজের পছন্দে মনে রাখা এমন কিছু কিছু ছবি আছে। আরও একটি ছবির কথা বলতে পারি, যতদূর মনে পড়ছে ‘সূর্যগ্রাস’ নামের একটা উপন্যাস থেকে ‘অনুপমা’ বলে একটা ছবি হয়েছিল। বিকাশ রায়, অনুভা গুপ্ত, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তমকুমার— এঁরা অভিনয় করেছিলেন। বিকাশ রায় এবং অনুভা গুপ্ত দুজনেই খুব ভাল অভিনয় করেছিলেন, ছবিটা একটা অসাধারণ উল্লেখযোগ্য ছবি হয়েছিল, তা নয়। মোটামুটি সাহিত্যগুণ সংবলিত একটা পরিষ্কার ছবি হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু আজও আমি ছবিটা ভুলতে পারি না সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের জন্য, এত অসামান্য অভিনয় করেছিলেন সাবিত্রী, ক্ষণে ক্ষণে সেই চরিত্রটি যেন আমাকে হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে মুগ্ধ হতে বাধ্য করে।

একজন অভিনেতা হিসেবে বা একজন চলচ্চিত্র-রসিক হিসেবে এ কথা লিখতে আমার দুঃখই হচ্ছে যে, এই স্মরণীয় অভিনয়ের জন্য মনে রাখার তালিকায় সাম্প্রতিককালের কোনও বাংলা ছবিকে রাখতে পারছি না। যদি ছবি ছাড়াও শুধু অভিনয়ের জন্য সাম্প্রতিক পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে কোনও ছবিকে মনে রাখার প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আমি গৌতম ঘোষের ‘পার’ মনে রাখব, ওই ছবিতে নাসির-এর অভিনয়টাই মনে রাখা যায়। একইভাবে শাবানা-র ‘অঙ্কুর’, স্মিতার ‘ভূমিকা’-র অভিনয় মনে রাখব। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা এই একই আবেগে সাম্প্রতিক কোনও বাংলা ছবির কোনও অভিনয়কে স্থান দিতে পারছি না।

বিখ্যাত সাহিত্যের চলচ্চিত্ররূপ দেওয়া এবং তাতে সাহিত্যের রসহানি হচ্ছে কিনা বা চলচ্চিত্র সাহিত্যের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারছে কিনা ইত্যাদি ধরনের কঠিন তত্ত্বে আমি যেতে চাইছি না। কিন্তু কিছু কিছু ছবিতে সাহিত্যের প্রত্যক্ষ অবদান থাকে। উদাহরণ হিসেবে তারাশঙ্করের ‘কবি’ এবং সেই চিরকাল হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে থাকা চরিত্র ‘ঠাকুরঝি’-র কথা মনে করা যায়। ‘ঠাকুরঝি’ চরিত্রে অনুভা গুপ্ত বিস্ময়কর ভাল অভিনয় করেছিলেন, এ ব্যাপারে কারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কবি’ না লিখতেন তাহলে কি অনুভা গুপ্ত ওই স্মরণীয় অভিনয় করার সুযোগ পেতেন? তাহলে সেই বিচারে ছবি তো সাহিত্যিকেরও ছবি।

আমি কোনও নির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত যুক্তি পেশ করতে পারব না, কিন্তু এ কথা আমার একাধিকবার মনে হয়েছে যেন বেশ কিছু স্মরণীয় ছবি তৈরি হয়েছে শুধু অভিনেতাদের জন্যই। এ ব্যাপারে অসংখ্য বিদেশি উদাহরণ আছে: গ্রেটা গার্বো, ক্লার্ক গেবল, গ্যারি কুপার ইত্যাদিদের ভেবে যত ছবি হয়েছে তার তালিকাটা খুব ছোট নয়। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা আমাদের দেশেও এ ব্যাপারে কয়েকটি উজ্জ্বল উদাহরণ আছে। এই উদাহরণগুলো আমি একটা চ্যালেঞ্জ মেশানো প্রশ্নের আকারে রাখতে চাই— যদি ছবি বিশ্বাসের মতো অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে না থাকতেন তাহলে কি ‘জলসাঘর’ কাহিনীটি নিয়ে ছবি করার কথা ভাবা হত? এখানে তো অভিনেতাই ছবির প্রাণ। সত্যজিৎ রায়ের মতো বিশাল বড় পরিচালককেও অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আমার ধারণা, ছবি বিশ্বাস না থাকলে জলসাঘর করার কথা মানিকদা আদৌ ভাবতেন না।

কথাটা ‘পরশপাথর’ এবং তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কেও কমবেশি সত্য। অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর পরিচয় বাংলা সিনেমার দর্শকরা অবশ্যই জানতেন, কিন্তু ‘পরশপাথর’ না নির্মিত হলে তাঁর প্রতিভার পরিমাপ করা এত সহজ হত না। আমি জানি, আমি লিখছি বলেই এটা শুধু আমার কথা নয়, আমার মতো বহু মানুষ আছেন যাঁরা তুলসী চক্রবর্তীকে ভালবাসেন, তাঁরা ‘পরশপাথর’ হওয়ার পর খুশি হয়েছিলেন। আমরা, সমস্ত বাঙালি দর্শকরা আমাদের সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় একজন অভিনেতার শেষ বয়সে তাঁর সর্বোত্তম বিকাশ ঘটেছে দেখে অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছিলাম। একটা ব্যাপারে আমি বাজি রাখতে পারি। একজন অভিনেতা হিসেবে, অভিনয়ের ছাত্র হিসেবে আমি চ্যালেঞ্জ করছি, কেউ, কোনও দর্শক বা সমালোচক যদি আমাকে দেখিয়ে দিতে পারেন তুলসী চক্রবর্তী তাঁর জীবনের কোনও ছবিতে খারাপ অভিনয় করেছেন তাহলে আমি লক্ষ টাকার বাজি হেরে যাব। আমার বাল্যজীবন থেকে আমি তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় দেখছি, কোনওদিন কখনও তাঁকে আমি খারাপ অভিনয় করতে দেখিনি। আরও সহজ এবং আন্তরিক স্বীকারোক্তিতে বলতে পারি এঁদের মতো গুণী অভিনেতাদের অভিনয় দেখে দেখেই তো যা শেখার তা শিখেছি।

অভিনেত্রী-অভিনেতাদের জন্যই যে ছবির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার অন্য ধরনের উদাহরণও আছে। বাংলা ছবির মধ্যপর্ব অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত সময়ে উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেনকে কেন্দ্র করে যে সব ছবি তৈরি হত, সেই বাণিজ্যিক ছবিগুলোর একটা বিরাট ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। আজকের বাণিজ্যিক ছবিগুলোর মতো সেগুলো ছিল না। সেই ছবিগুলোর কাহিনী বা চিত্রনাট্য লিখতেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদিদের মতো সাহিত্যিকরা, যাঁদের কলমের অনেক বেশি জোর ছিল, তাঁদের কলমে জীবনের সামগ্রিক ছবি সব সময়ে না থাকলেও জীবনের আনন্দ-বেদনার স্বাদ থাকত, সহজ করে বলতে বললে কাহিনী বা চিত্রনাট্যে খানিকটা সত্যিকারের জীবন খুঁজে পাওয়া যেত। সেই ছবিতে যাঁরা সঙ্গীত পরিচালনা করতেন, তাঁরা যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন, কাউকে কাউকে প্রতিভাবানও বলা যায়। সেই ছবিতে যাঁরা গান গাইতেন তাঁরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো অসামান্য গায়ক। সেই ছবিগুলোতে যাঁরা নায়ক-নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতেন অর্থাৎ উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন তাঁদের যত ম্যানারিজম থাক না কেন, তাঁরা অত্যন্ত আকর্ষণীয় দুটি তরুণ ও তরুণীর ছবি পর্দায় উপস্থিত করতেন। এবং সব শেষে সেই ছবিগুলোতে হাস্যরস পরিবেশনের দায়িত্ব যাঁদের ওপর দেওয়া হত সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর রায়ের মতো অভিনেতা শুধু বাংলা বা ভারতীয় ছবিতে নয়, গোটা পৃথিবীতেই দুর্লভ ছিল। সুতরাং সব মিলিয়ে সেই ধরনের বাংলা ছবির প্রমোদ বিতরণের সামগ্রিক ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এবার একটা প্রশ্ন, সেই ছবিগুলোর পরিচালকদের নাম কি কেউ মনে রেখেছেন? ব্যক্তিগতভাবে, সেই সব ছবির পরিচালকদের ছোট করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই, কিন্তু এটাই তো বাস্তব, সত্য। তাহলে সেই ছবিগুলো কার? পরিচালকের? নিশ্চয়ই না। সেই ছবিগুলো অবশ্যই উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেনের ছবি, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়-জহর রায়ের ছবি, এমনকি কখনও কখনও নেপথ্য গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরও ছবি।

শিল্পসম্মত এবং রসোত্তীর্ণ ছবির তালিকায় দক্ষ পরিচালকের ছবি নয় বলেই হয়ত এই ছবিগুলো এক হিসেবে কেউ মনে রাখবেন না। কিন্তু কেনই বা রাখবেন না? সমকালীন রচনা বা সাহিত্যের নির্দশন হিসেবে অনেক অকিঞ্চিৎকর গোয়েন্দা উপন্যাসও তো জাতীয় গ্রন্থাগারে রেখে দেওয়া হয়। কারণ? ভবিষ্যতে যাঁরা অতীতের সংস্কৃতি চর্চা করবেন তাঁদের সেগুলো কাজে লাগবে। তাহলে চলচ্চিত্রের ইতিহাস চর্চার বেলাতেও তো বাংলা সিনেমার মধ্যপর্বের ছবিগুলোর মূল্য আছে। তদানীন্তন বাঙালি সমাজের মনোজগতের বিনোদন হিসেবে এই ছবিগুলো যে স্থান অধিকার করেছিল তা জানার জন্যও এই ছবিগুলোকে মনে রাখতে হবে। এবং সেই ছবিগুলোর স্মৃতিতে যাঁরা ভাস্বর হয়ে থাকবেন তাঁরা সকলেই তো অভিনেতা-অভিনেত্রী। এই একই ধরনের ফর্মুলায় আমার হয়ত দু-একটা ছবি আছে, এবং সেই ছবিগুলোও প্রকৃত অর্থে পরিচালকের ছবি নয়, সামগ্রিক বিনোদনের মূল্যে সাফল্য পাওয়া ছবি বললে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়।

সব কথা শেষ হলে, একটা প্রশ্ন বোধহয় মনের মধ্যে জেগে থাকে। যদি কেউ চলচ্চিত্রের মান নির্ণয় করতে বসে ছবিগুলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে রাখতে চান, তখন তিনি কোন ছবিগুলোকে সর্বোত্তম পর্যায়ে রাখবেন? তাহলে বোধহয় ‘পরিচালকের ছবি’ হিসেবে চিহ্নিত ছবিগুলোই উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছে হাঁটুমুড়ে বসে পড়বে। কারণ সাধারণত দেখা যায় সর্বপ্রকার গুণ অর্থাৎ ছায়াছবির সমস্ত বিভাগের সেরা কাজ বার করে এনে তার সমন্বয় করে একটা উঁচুদরের শিল্পসম্মত অসাধারণ ছবি তৈরি হয় না যদি তার পেছনে একজন সচেতন, সতর্ক এবং প্রতিভাবান পরিচালক না থাকেন। এই ব্যাপারগুলোর জন্যই ‘পরিচালকের ছবি’-কে সবার ওপরে স্থান দিতে হয়।

প্রথম সিনেমা মিডিয়া তৈরির জন্যও প্রথমে একজন বড় পরিচালকের প্রয়োজন হয়েছিল। ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’-এর আমলে একজন বড় পরিচালকেরই প্রয়োজন ছিল। ‘মাদার’ ছবির জন্যেও একজন বড় পরিচালকের দরকার ছিল, যিনি চলচ্চিত্র বস্তুটির ভাষা তৈরি করে দেবেন। সিনেমার সেই আদি যুগে, শব্দহারা ছবির যুগেও সিনেমাকে গতি দিয়ে, প্রাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কয়েকজন গুণী পরিচালকের প্রয়োজন হয়েছিল। চ্যাপলিন এ ব্যাপারে সর্বোত্তম উদাহরণ। চার্লস চ্যাপলিন অবশ্য একটা ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার, একদিক থেকে চ্যাপলিন বিচার করা বোধহয় সবচেয়ে শক্ত। চার্লস চ্যাপলিন নিশ্চয়ই খুব বড় পরিচালক ছিলেন। ক্যামেরা পরিচালনা, সম্পাদনা ইত্যাদি সব ধরনের কাজই তিনি জানতেন। চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রেও তাঁর দক্ষতা ছিল, সঙ্গীতেও তাঁর সহজাত দক্ষতা ছিল। এত সব ভালভাবে না জানলে অতগুলো অসাধারণ ছবি করা যায় না, কিন্তু এত কিছু জানা সত্ত্বেও তিনি অভিনয়ের ওপর খুব বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন। বিশেষ করে একজন অভিনেতার ওপরেই বেশি নির্ভর করতেন, তাঁর নাম— চার্লস চ্যাপলিন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতাটি পরিচালক চ্যাপলিনের হাতের কাছেই ছিল। অন্য পরিচালকরা, বিশেষ করে বড় পরিচালকরা, সব সময়ে অভিনয়ের ওপর সর্বদা অতটা নির্ভরশীল ছিলেন না।

সুতরাং, যে ছবি চলচ্চিত্রের— পৃথিবী মনে রাখছে, তার সৃষ্টির কৃতিত্ব প্রধানত একজন বড় পরিচালককেই দিতে হচ্ছে, তাঁদের স্বপ্ন-কল্পনায় ছবিগুলো তৈরি হওয়ার পর বাস্তবের চেহারা নিচ্ছে। ‘গন উইথ দি উইন্ড’ যতই তারকা-খ্যাতিতে বিখ্যাত হোক, একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরিচালক ছাড়া কি ছবিটা হতে পারত? সব কিছু মিলেও কখনও কখনও একটা ছবি অসাধারণ হয়ে ওঠে, সেখানে পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়, চিত্রনাট্য— সব মিলেমিশে যায়, যেমন— ‘হাই নুন’। একটা দিনের ঘটনা নিয়ে ছবি— কোথায় পৌঁছে গেছে! তবে এমন ছবি দল বেঁধে আসে না, কোথাও কোথাও তবু একটা দুটো আসে, সর্বত্র তো বাংলা সিনেমার মতো আবহাওয়া নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *