ভুলব কেমন করে?

ভুলব কেমন করে?

ব্যক্তিগত শোক এমন গভীর বিষণ্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না। যে প্রিয়জন চলে যায় সে যেন এক অলৌকিক শক্তিতে প্রবাহিত জীবনের সকল সুখ-দুঃখের স্মৃতি চোখের সামনে জীবন্ত চেহারায় বসিয়ে দিয়ে যায়। অনিলের হঠাৎ চলে যাওয়া আমাকে স্মৃতির গণ্ডিতে বেঁধে রেখেছে, একমাত্র সময়ই পারে আমাকে মুক্তি দিতে।

প্রথম পরিচয় ১৯৫৭-তে। দুজনেই চাকরির সন্ধানে অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের অফিসে হাজির। ঘোষকের চাকরি। পোস্ট মাত্র একটা, অথচ সেদিন ইন্টারভিউ দিতে হাজির প্রার্থীর সংখ্যা ছিল একশোর ওপর। সারাদিন ধরে চাকরির পরীক্ষা, একই সঙ্গে প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উভয়ের আলাপ, একদিনেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। চাকরির জন্য এসেছিল বটে, কিন্তু তখন ও বাংলা সিনেমার একজন সহকারী পরিচালক, কিছু চরিত্রে অভিনয়ও করেছে। কথা বলতে বলতে জানিয়েছিল, ‘উল্কা’ ছবি হতে পারে, তাতে একটা বড় ভূমিকায় অভিনয় করার সম্ভাবনা আছে, এ ছাড়াও আরও কয়েকটা ছোট ভূমিকার কাজও হাতে এসে গেছে, শেষ পর্যন্ত যদি রেডিওর চাকরিটা জুটে যায় তাহলেও হয়ত ওর পক্ষে করা সম্ভব হবে না। সত্যিই হয়নি। সিনেমার কাজের চাপে অনিল শেষ পর্যন্ত চাকরিটা করেনি। আর আমার জীবনের সেই প্রথম চাকরি জুটেছিল ওরই দয়ায়। কারণ শতাধিক প্রার্থীর মধ্যে যোগ্যতার বিচারে অনিল প্রথম হয়েছিল, আর আমি দ্বিতীয়। একাধিক যোগ্যতার জন্য ওর প্রথম হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তখনই ওর কণ্ঠস্বর ছিল চমৎকার ভরাট, কথাও বলত সুন্দর। তুলনায় তখন আমার গলা ছিল পাতলা। ও চাকরিটা না নেওয়ায় স্বাভাবিকভাবে আমি পেলাম।

প্রথম চাকরি পাওয়ার কয়েক মাস পরে যখন আমিও সিনেমায় অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন অনিল ছিল আমার প্রথম সমর্থক। সেই বয়সে যা হয়, বন্ধুত্ব একই জায়গায় থেমে থাকেনি। পরস্পরের বাড়ি যাওয়া, একসঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা দেওয়া এসব তো ছিলই। পুরনো বন্ধু বলে আজ এসব কথা লিখছি তা নয়, বন্ধুবৎসল অনিলের চরিত্রে গুণগ্রাহীতা একেবারে স্বভাবের সঙ্গে মিশে থাকত। অনেক দিনের অনেক স্মৃতি আলাদা করে বলতে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে। ১৯৬৪ সালে আমরা সপরিবারে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। সপরিবারে অর্থে আমার মা-বাবা সকলেই। একই সঙ্গে গিয়েছিল সস্ত্রীক অনিলও। অনিলের মা তখন পুরীতেই থাকতেন। দুটি পরিবারের সবাই মিলে মহানন্দে কেটেছিল সেই কয়েকটা দিন। সেই সময় দুজনেরই শুটিংয়ের ফাঁদ থেকে টানা সপ্তাহখানেক ছুটি পাওয়া খুবই কঠিন ছিল, কিন্তু কোনওরকমে সে বন্দোবস্ত হওয়ায় আমাদের উৎসাহের সীমা ছিল না। একসঙ্গে সমুদ্রে স্নান করতাম হইহই করে। দুই পরিবারের বয়স্করা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত, তখন আমরা দুজনে বিকেলে সমুদ্রতীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যেতাম। সেখানে, সেই নির্জন সমুদ্রসৈকতে কে আমাদের চিনতে পারবে? কোনও সমস্যাই ছিল না বলে বিস্তর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। বয়সে অনিল আমার চেয়ে কয়েক বছর বড় ছিল, কিন্তু বয়স কখনও এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধুত্বে বাধা হয়নি। তখনকার দিনের বন্ধুত্বে পেশাদারি মেজাজ থাকত না, ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের জোর সব মালিন্য মুছে দিত।

অনেক পরে যখন অভিনেতৃ সঙ্ঘ ও শিল্পী সংসদ আলাদা হয়ে গেল, তখনও অনিল শিল্পী সংসদের নেতা বলে আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি। অত্যন্ত আড্ডাপ্রিয় ও প্রাণবন্ত স্বভাবের মানুষ ছিল, বরাবর। খেলাধুলোর প্রতিও একটা স্বাভাবিক টান ছিল। শরীরচর্চা ও বিনোদন— দুটো প্রশ্ন মাথায় রেখে আমরা একসময় স্টুডিওর মধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলার আসর গড়েছিলাম। এ ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগী ছিল দিলীপ মুখার্জি ও অনিল। প্রথম কোর্ট তৈরি হয়েছিল রাধা ফিল্মস স্টুডিওতে, পরে এন টি আর ওয়ান-এ। প্রবল উৎসাহে ওপরে ত্রিপল লাগিয়ে কভার্ড কোর্ট তৈরি হয়েছিল। নিয়মিত খেলা হত। আমার স্ত্রী দীপাও ওখানে খেলতে যেত। অনিল প্রায় রোজই খেলতে যেত। পরে অর্ডন্যান্স ক্লাবের ব্যাডমিন্টন খেলাতেও অনিল-দিলীপ দুজনেই খেলতে গেছে। এখনকার পরিবেশে এসব কথা কতদূর বিশ্বাসযোগ্য শোনাবে জানি না, তবে তখন আমরা দিনের পর দিন শুটিং যেমন করেছি, তেমন সুযোগ পেলেই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে উচ্ছ্বাসে আড্ডা দিয়েছি, জনপ্রিয় সিনেমা অভিনেতা হিসেবে নিজেদের ঘরবন্দী করে রাখিনি।

শুধু ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু তাই-ই নয়, অনেক ছবিতেও অনিল আর আমি পরস্পরের বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছি। ‘দেবী’ আমাদের প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করা ছবি। অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে যে স্বাভাবিক প্রাণচঞ্চলতা ও কৌতুকবোধ ছিল, তা তখনকার পরিচালকরা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ব্যবহার করতেন, দর্শকরাও তা উপভোগ করতেন। ‘স্বরলিপি’ ছবিতে অনিল ছিল আমার নায়িকা সুপ্রিয়ার দাদা। দাদা আর বোন নায়কের বাড়ির পাশেই একটা ছোট বাড়িতে থাকে, বোন ঘরের বাইরে এসে কাপড় মেলতে গিয়ে প্রেমের গান গায়। দাদা একদিন এসে তার বোনের সঙ্গে আমার প্রেমপর্ব কতদূর এগিয়েছে তা নিয়ে নাটকীয়ভাবে কথাবার্তা চলছে। এতদিন পরে আর সেই সংলাপ মনে নেই, তবে স্বরলিপির সেই দৃশ্যে অনিলের অভিনয় যে দারুণ উপভোগ্য হয়েছিল, তা মনে আছে।

নানা ধরনের চরিত্রে স্মরণীয় কাজ করে গেছে অনিল। ‘দেবী’, ‘মহানগর’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’— এসব ছবিতে অনিল যে-মানের কাজ করেছে, তার তুলনা খুব বেশি নেই। তবে আমার নিজস্ব পছন্দ একেবারে আলাদা করে যদি কেউ জানতে চান তাহলে আমি বলব, অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি— পোস্টমাস্টার। সব ভুলে যেতে পারি, কিন্তু পোস্টমাস্টারকে কী করে ভুলব? এত স্বাভাবিক, সুন্দর কাজ করেছিল যে অবাক হয়ে দেখতে হয়। ‘মহানগর’ ছবিতেও তার অভিনয় খুবই উঁচুমানের। এ ছবির কাজের জন্যই অনিল মানিকদার সঙ্গে বার্লিন গিয়েছিল। অসংখ্য আজেবাজে চরিত্রে অভিনয় করতে করতে আমাদের পেশায় এক ধরনের ক্লান্তি আসে, তাই কোথাও কোনও ভাল কাজ হলে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অনিলের অভিনয় করা চরিত্রের কথা মনে পড়ছে। বড়লোকের স্ফূর্তিবাজ ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল, কিন্তু ওর বয়স তখন অতটা কম ছিল না। মানিকদার কাছে শুনেছি, ও নিজেই বয়সের জন্যে চরিত্রটা করতে তেমন উৎসাহ পাচ্ছিল না। কিন্তু মানিকদা ওকে ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত ছবিতে দেখা গেল অনিল চমৎকার কাজ করেছে। প্রাণচঞ্চলতায় উজ্জ্বল, মজার এবং একই সঙ্গে হৃদয়স্পর্শী, কাঞ্চনজঙ্ঘার অনিলকেও কখনও ভোলা যাবে না।

একটা জীবন থেমে গেলে সেখান থেকে পিছিয়ে গিয়ে সময়কে চিহ্নিত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। বহু ছবিতে একসঙ্গে কাজ করতে করতে, দীর্ঘকালের বন্ধুত্বের জন্য একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তপনদার ছবি ‘আতঙ্ক’ করার সময় হাসি-ঠাট্টার স্মৃতি মনে পড়ছে। মাঝখানে একটা সময় একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়নি। অনেকদিন পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অগ্রদানী’ করার সময় দীর্ঘদিন ধরে খুব আনন্দের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। অনেকেই হয়ত জানেন না, নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক মুগ্ধ করার মতো যোগ্যতা ছিল। ভাল ছাত্র ছিল সে। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে অবিভক্ত ভারতবর্ষে উত্তরবঙ্গ বিহারের অনেকটা অঞ্চল নিয়ে ভাগ-করা নর্থ জোন সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষায় অনিল ফার্স্ট হয়েছিল। ইংরেজি ভাষার ওপর চমৎকার দখল ছিল, ভাল ছবি আঁকতে পারত। রোজ ডায়েরি লিখত। আউটডোর শুটিংয়ে সারাদিন পরিশ্রমের পরেও অনিল তার রোজনামচার পাতায় সব বিস্তারিতভাবে লিখে রাখত। ভবিষ্যতে অনিলের ডায়েরি যদি সুসম্পাদিতভাবে প্রকাশিত হয়, তাহলে শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনীই নয়, আমাদের অভিনয় করার সময়টার ইতিহাসও ধরা পড়বে বলে আমার বিশ্বাস।

অনিলের চলে যাওয়া মনের মধ্যে একটা বড় ধাক্কা। সমসাময়িক বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই গত কয়েক বছরে চলে গেছে, অনিলও চলে গেল। মনে হচ্ছে আমাদের জেনারেশনের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে, পোস্টমাস্টারই ডাক-এর সময় জানিয়ে দিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *