চরিত্রাভিনেতা উত্তমদাও অসাধারণ

চরিত্রাভিনেতা উত্তমদাও অসাধারণ

ঠিক কীভাবে এই লেখা শুরু করলে ভাল হত বুঝতে পারছি না, উত্তমদার জন্মদিনে তাঁর মৃত্যুর স্মৃতি এসে হৃদয় ভারাক্রান্ত করছে। ব্যক্তিগত শোক তো আছেই, অনেক বড় ক্ষতি হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের পক্ষে। কিন্তু একজন অভিনেতা হিসেবে আমি উত্তমকুমারের মৃত্যুকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখি, ১৯৮০-তে যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তখন তিনি তাঁর অভিনয়-দক্ষতার শিখরে পৌঁছেছিলেন বলে আমি মনে করি। একজন অসাধারণ দক্ষ, অভিজ্ঞ অভিনেতা জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়ে চলে গিয়েছিলেন বলেই উত্তমকুমারের মৃত্যু আমার কাছে গভীর বেদনার কারণ হয়েছিল।

রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তিনি অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন এটা কারও কাছে জানাবার মতো তথ্য নয়। মৃত্যুর আগে, তিনি বয়স বেড়ে যাওয়ার জন্য খুব স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত হিসেবে রোমান্টিক ইমেজ ত্যাগ করে চরিত্রাভিনয় শুরু করেছিলেন। সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের আরম্ভ এই সময়টা একাধিক কারণে বাংলা চলচ্চিত্রের পক্ষে খুব কঠিন সময় ছিল। বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল প্রমুখরা চলে গেছেন, ঠিক সেই সময়ে উত্তমকুমারের মতো উঁচুমানের অভিনেতার চরিত্রাভিনেতা হিসেবে কাজ করা শুধু তাঁর নিজের জন্যই নয়, বাংলা ছায়াছবির জন্য প্রয়োজন ছিল। অন্যরা কী মতামত দেবেন আমি জানি না, তবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস রোমান্টিক নায়ক উত্তমকুমার চরিত্রাভিনেতা হিসেবে একইরকম সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারতেন, কারণ তাঁর সেই অভিনয়-ক্ষমতা ছিল। আশির শুরু থেকেই বাংলা ছবির চেহারা বদল শুরু হয়েছিল। চেহারা বদল না বলে বলতে পারি বাংলা ছবি হিন্দি ছবির চেহারা-পোশাক নকল করার দিকে ঝুঁকে পড়ল। সামগ্রিকভাবে হিন্দির অনুকরণ সর্বাংশে মেনে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এখন চিন্তা হয় উত্তমদা, যিনি বাঙালির রুচি, সংস্কৃতির বিশ্বাসযোগ্য অভিনেতা হিসেবে এত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তিনি কি এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে খুশি থাকতে পারতেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই জানি না। তবে আমি আমার কথা বলতে পারি, আমি মোটেই খুশি নই। অভিনেতা উত্তমকুমার ও ব্যক্তি উত্তমকুমারকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানি বলেই আশঙ্কা হয় হয়ত তাঁর খুব কষ্টই হত।

সিনেমায় অভিনয় শুরু করার আগে থেকেই উত্তমদার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কীভাবে তা বহুবার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখেছি। পরের দিকে তো সম্পর্কটা মধুর পারিবারিক সম্পর্কের পর্যায়ে চলে এসেছিল, তখনকার দিনে যেমন হত আর কি।

অভিনেতা উত্তমকুমার সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধার কথা বহুবার বলেছি, লিখেছি। একটা কথা আমার চিরকালই মনে হয়েছে, উত্তমকুমার তারকা হিসেবে যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তা পরোক্ষভাবে তাঁর অভিনয়-দক্ষতাকে ঢেকে দিয়েছিল। তিনি যে কত উঁচুমানের দক্ষ অভিনেতা ছিলেন, তার যথার্থ বিশ্লেষণ হয়নি। বহু ছবিতে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে; চিরকুমার সভা, দুই পৃথিবী, চাঁপাডাঙার বউ, বিচারক, চিড়িয়াখানা, নায়ক— এই ছবিগুলোর স্মৃতি এখনও অমলিন আছে। অম্লান আছে অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতিও। যে-সব ছবিতে একই সঙ্গে কাজ করেছি, সে- সময় ওঁর সান্নিধ্য আমাকে সবসময়েই অনুপ্রাণিত করত। কোনও ছবিতে আমার নিজের কাজ সম্পর্কে ওঁর মতামত জানতে চাওয়ার আগেই উনি ছবিটা দেখে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অভিনেতা উত্তমকুমার সম্পর্কে একালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিক্রিয়া কী, তা আমি জানি না। তবে আমাদের সেই প্রথম জীবনে বাংলা ছবির অধিকাংশ নবীণ-প্রবীণ অভিনেতা-অভিনেত্রী অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন, আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস তো আজ ইতিহাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *