মনোজ মিত্র

মনোজ মিত্র

মনোজের ওপর আমার একটা রাগ আছে। মনোজ মিত্র। হ্যাঁ, নাট্যকার মনোজ মিত্রর কথাই বলছি। কেন জানেন? ও আমাকে নাটক লিখে দেয় না বলে। কত বছর ধরে যে ওর পেছনে পড়ে রয়েছি। ও যদি বাজে লেখক হত তাহলেও না হয় রাগটা বাদ দেওয়া যেত। কিন্তু এতদিন ধরে এতগুলো ভাল নাটক লেখার নজির আমাদের সমসাময়িক কালে ক’জনেরই বা আছে? প্রায় দু’দশক আগে ওর ‘চাকভাঙা মধু’ নাটকটা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে নাটকটাও আমি অভিনয় করার জন্যে পাইনি। থিয়েটার ওয়ার্কশপকে সেটা আগেই দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। অভিনয় না করতে পেরে যে ক্ষোভটা হয়েছিল সেটা খানিকটা শান্ত করেছিলাম ওই নাটক আমাদের ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় ছাপিয়ে।

এই তো সেদিন সে আর একখানা দারুণ নাটক লিখেছে— ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’। আমি দু’বার এটির অভিনয় দেখেছি। এই নাটকটা দেখতে দেখতে এই হতভাগা সময়ের হতাশা কেটে যায়। মানুষ যে আজও ভাল কাজ করতে পারে, সমস্ত দুর্যোগ সঙ্কটের মধ্যেও মানুষ যে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে— লড়াই করতে পেছপা হয় না— এমন বিশ্বাস আজকে অনেক সময়েই ধরে রাখা যায় না। অলকানন্দার পুত্রকন্যা সেই বিশ্বাসটাকে নতুন করে শক্তি জোগাল।

তবে এই নাটকটা দেখতে দেখতে মনোজের ওপর নতুন একপ্রস্থ রাগ হল। এটা তো আমাকে ও দিতে পারত। পাবলিক থিয়েটারে করলেও এ নাটক চলত বলে আমার বিশ্বাস। পাবলিক থিয়েটারের উপযুক্ত নাটক যখনই খুঁজতে হয় তখনই আমার নাট্যকার বন্ধুদের ওপর রাগ হয়। তাঁরা সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয় করা যায় এমন নাটক আমাদের লিখে দেন না বলে। শুধু নাটক লিখিয়ে বন্ধুদের ওপরই নয়, রাগ আমার গল্প উপন্যাস লিখিয়ে বন্ধুদের ওপরও হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কতবার বলেছি— ‘সুনীল আমাকে একটা নাটক লিখে দাও।’ বললেই বলেছে, ‘ও বাবা, নাটক লেখা বড় শক্ত কাজ।’ ও মা, ইতিমধ্যে দেখি দু-তিনখানা নাটক ও লিখে ফেলেছে। সেগুলো বধুসন্ধ্যার মজলিশ ইত্যাদির সভ্যরা অভিনয়ও করে ফেলেছেন। নাটকগুলো খুব ভাল লেখা— কবিতার মতো সুন্দর। কিন্তু ওই সব বুদ্ধিগ্রাহ্য সাঙ্কেতিক নাটক পাবলিক থিয়েটারে করলে সেখানকার বেশিরভাগ দর্শকের মাথার কয়েক হাত ওপর দিয়েই তা বেরিয়ে যাবে।

কবিরা নাকি অনেক সময় নাট্যকারে পরিণত হন। শক্তি, তারাপদ বা আমার অন্যান্য কবি বন্ধুদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটল না, যে তারাই আমার নাটকের জোগানদার হবে। তবে আমাদের সময়ের কথা কি বলছি, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল এইরকম জনাকয়েককে বাদ দিলে কবির নাটক রচনার ঘটনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই বড় কম। গিরিশচন্দ্র, ক্ষীরোদপ্রসাদের সাহিত্যিক প্রতিভা নাটক আশ্রয় করেই প্রকাশ পেয়েছিল। অথচ প্রতিভাবান সাহিত্যিকরা পরবর্তীকালে কেন নাট্যশালাকে এড়িয়ে চললেন, এই প্রশ্নটা আমাকে প্রায়ই বিব্রত করে। নাটক লিখতে হলে নাট্যশালার জন্যেই লিখতে হয়, তার সুবিধে-অসুবিধেকে জেনেবুঝে নিজের লেখনীকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়— এমন শৃঙ্খলার শৃঙ্খল পরতে কি আমাদের লেখকদের মনে বাধা থেকে গেছে? নাকি রবীন্দ্ররুচি প্রভাবিত পরবর্তীকালের লেখকরা সাধারণ রঙ্গালয়কে একটু নাক সিঁটকিয়ে দেখে এসেছেন? প্রসঙ্গহীনতা, প্রগলভতা দোষে অভিযুক্ত নট-নটী ও পতিতা অধ্যুষিত পাবলিক থিয়েটার শুদ্ধতাবাগিশ লেখকের চোখে ব্রাত্য ঠেকে থাকবে হয়ত!

অথচ নাট্যশালার সঙ্গে ওতপ্রাোতভাবে জড়িয়ে না থেকে উঁচুদরের নাটক সৃষ্টি তো করা যায় না। পৃথিবীর কোনও দেশের সাহিত্যেই এর ব্যতিক্রম ঘটেছে বলে মনে হয় না। শিশিরকুমার ভাদুড়ি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটু অভিমানেই যেন একবার আমায় বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশেও তো শেক্সপিয়র জন্মেছিলেন— কিন্তু তিনি তো জোড়াসাঁকোর জন্যেই লিখলেন— সাধারণ রঙ্গালয়ে এলেন না।’

আলাপচারী আলগা এই মন্তব্যের মধ্যে বোধহয় একটা সত্যি আছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে থাকলে সেই প্রতিভার স্পর্শে রঙ্গালয়ে ও তার দর্শক যেমন চূড়ান্ত উৎকর্ষের দিকে যেতে পারত, তেমনি রবীন্দ্রনাট্যও হয়ত আরও মাটির কাছাকাছি আসত, তার সর্বজনীনতা বাড়ত— এমন একটা স্পেকুলেশন বোধহয় করা চলতেই পারে।

সাহিত্যিক প্রতিভা আছে এমন লেখকরা আজ আর নাটক লেখেনই না, পাবলিক থিয়েটারের জন্যে তো নয়ই। নতুন সুলিখিত নাটকের অভাব থেকেই দায়ে পড়ে বাধ্য হয়ে বিদেশি নাটকের দ্বারস্থ হতে হয় আমাকে। কোনটা অবলম্বন করলে এ দেশের পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে খাপ খাবে, কোথায় কী অদলবদল করতে হবে যাতে বিদেশি বলে আঁশটে সন্দেহটা দর্শকের নাকে না পৌঁছয়, অ্যাডাপটেশনের সময় এই সব যখন ভাবতে হয়, তখনই আমার নাট্যকার, সাহিত্যিক, কবি বন্ধুদের সম্বন্ধে রাগ হতে থাকে। দেশের মাটি দেশের মানুষের গল্প তাঁরা এত লিখছেন, আর আমাদের পাবলিক থিয়েটারে করা যায় এমন একখানা নাটক লিখে দিতে পারছেন না? একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়ে যাওয়ার পরেই যখন আর একটা নাটকের পরিকল্পনা শুরু করতে হয় তখনই এই রাগের শুরু হয়ে যায়।

এখন সেই অবস্থাটা আসছে। এখন ভাবতে হচ্ছে এর পরের নাটকটা কী করব। নাট্যকার সাহিত্যিক বন্ধুদের আর একবার উপরোধ জানানোর কথা যেমন ভাবছি— তেমন ভাবছি প্রতিবারের মতো এবারেও তারা লিখে দেবে না। এই হতশ্বাস ভাবনার থেকেই রাগ হতে শুরু হচ্ছে। ফ্রাসটেশন থেকে ভাবতে আরম্ভ করছি— দুর, আর নাটক করা যাবে না। সত্যি সত্যিই যদি না যায় তাহলে কিন্তু আমি তার জন্যে সাহিত্যিক ও নাট্যকারদেরই মনে মনে দায়ী ঠাউরে রাখব— মনোজ, সুনীল, শীর্ষেন্দু প্রভৃতিরা— এই কথাটা তোমাদের আগেভাগেই জানিয়ে রাখলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *