জ্যেষ্ঠরা

জ্যেষ্ঠরা

ঠিক স্মৃতিকথা লেখা বা বলার মতো করে গুছিয়ে হয়ত নয়, কিন্তু মনে তো পড়েই। পুরনো দিনের যাঁরা অভিনেতা, যাঁদের সঙ্গে আমি সিনেমায় এসে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে অনেকের স্মৃতি আমার মনে বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। মাথার ওপর ছবি বিশ্বাস তো ছিলেনই, তাঁর রাজকীয় উপস্থিতি কী করে ভোলা যায়! তুলসীদার মতো অমন স্নেহপ্রবণ মানুষকেও কখনও ভুলতে পারি না। আমার সৌভাগ্য যে, এঁদের সকলেরই স্নেহ আমার ওপর প্রায় অকারণে বর্ষিত হয়েছিল। অন্তত তখন তো তা-ই মনে হত। তাঁরা সকলেই বোধহয় স্বভাবত স্নেহপ্রবণ ছিলেন।

এক

লিখতে বসে এই মুহূর্তে যাঁর কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অবিস্মরণীয় নায়ক-গায়ক রবীন মজুমদার। রবীনদার সঙ্গে আমি প্রথম যে-ছবিটায় অভিনয় করেছিলাম, সেটা— ‘কিনু গোয়ালার গলি’। সেটা সম্ভবত ১৯৬৩ বা ১৯৬৪ সাল হবে। ছবিটার স্মৃতি খানিকটা আবছা হয়ে এসেছে, কিন্তু রবীনদার স্মৃতি এখনও ভুলিনি। একটা দৃশ্য ছিল তাস খেলার। শট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা কথা বলছিলাম। কথা বলছিলাম বলতে প্রায় সব কথা আমিই বলছিলাম, ওঁকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম। কারণ উনিই তো আমাদের কিশোর বয়সে দেখা নানা ছবির নায়ক। ‘কবি’-র কথা কী করে ভুলব! অত বড় ‘স্টার’ ছিলেন, সে-সব কথা আমার মাথায় ছিল। যাঁরা একদা স্টার থাকেন, পরে তাঁরা প্রচারের, আকর্ষণের আলোকবৃত্তের বাইরে চলে গেলে, সাধারণত তাঁদের মনে এক ধরনের কমপ্লেক্স তৈরি হয়। মজার কথা হচ্ছে, রবীন মজুমদার এমন মধুর চরিত্রের মানুষ ছিলেন যে, তাঁর মধ্যে সেই নক্ষত্রসুলভ মানসিক জটিলতার চিহ্নমাত্র ছিল না। হাসিমুখে খুব সহজভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। কালীদাও (কালী ব্যানার্জি) আমাদের কথা শুনছিলেন।

তারপর একসঙ্গে একটা ছবি করেছিলাম, নাম— ‘নিশিমৃগয়া’। সেখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল। বস্তুতপক্ষে ঘটনা হিসেবে সেটা খুবই সামান্য, কিন্তু রবীনদার চমৎকার মানসিকতার পরিচয়ের জন্য সেটা মনে আছে। মেকআপ রুমে বসে আছি। সেই সত্তরের শুরুতেও ‘ইন্দ্রপুরী’ স্টুডিওতে একটা বড় স্পেশাল মেকআপ রুম ছিল, যেখানে উত্তমকুমার ও আমার ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। অদ্ভুত সেই নিয়মটা স্টুডিও কর্তৃপক্ষেরই তৈরি। মেকআপ নিয়ে বসে আছি, একা। ছবিটাতে আমার পরিচিত প্রিয়জন অনেকেই ছিলেন— বসন্তদা, উৎপল দত্ত, অনুপ, অপর্ণা, ভানুদা, শেখরদা— কিন্তু কেউই তখনও আসেননি। কেউ নেই বলে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমার তো আড্ডা দেওয়া স্বভাব। স্টুডিওতে হাজির প্রযোজকপক্ষের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজ আর কে আছেন?’ উত্তর পেলাম— ‘রবীন মজুমদার’। —’কখন আসবেন তিনি?’ —’তিনি তো সেই সকাল দশটায় এসে গেছেন!’ —’কোথায় আছেন?’ আমি তাড়াতাড়ি উঠে তাঁকে খুঁজতে গেলাম। গিয়ে দেখি, তিনি জুনিয়র আর্টিস্টদের জন্য নির্দিষ্ট একটা ছোট মেকআপ রুমের এক কোণে বসে আছেন। গিয়ে বললাম, ‘এ কী, আপনি এখানে বসে আছেন! চলুন আমার ঘরে।’ রবীনদা বললেন, ‘না না ভাই, আমি এখানেই ঠিক আছি।’ আমি জোর করে তাঁকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিলাম। মজার কথা হচ্ছে, যে-ঘরটাতে আমার এবং উত্তমদা ছাড়া আর কারও ঢোকার অধিকার ছিল না, সেখানকার দেওয়ালে পুরনো আমলের শিল্পীদের মধ্যে দুজনের ছবি ছিল, একটি দেবী মুখার্জির, অন্যটি রবীন মজুমদারের। সেই ঘরে রবীন মজুমদারের ছবি থাকার অধিকার আছে, কিন্তু স্বয়ং রবীন মজুমদারের ঢোকার অধিকার নেই। এই হচ্ছে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি! ঘটনাটা অদ্ভুত লেগেছিল।

আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দেওয়ালের ছবিটা কবেকার, কীভাবে তৈরি হয়েছিল ইত্যাদি। উনি অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে জানিয়েছিলেন, ওঁর কোনও একটা ছবিতে একটা পেইন্টিংয়ের দরকার হয়েছিল, সেই সময় করানো হয়েছিল। একজন যথার্থ ভালমানুষ হলে যা হয়, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতেন। সেই থেকে ওঁর সঙ্গে একটা সহজ স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে ওঁর জীবনে একটা আবার ‘ফিরে আসা’ ঘটেছিল। সেই ‘কাম ব্যাক’ আমাদের সকলেরই জানা ছিল। একটা প্রাসঙ্গিক কথা এসে যাচ্ছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, ওঁর যৌবনে উনি অভিনেতা হিসেবে তেমন একটা গভীর রেখাপাত করার মতো অভিনয় করেননি, তখন ওঁর গাওয়া গানই আমাদের অনেক বেশি মুগ্ধ করেছিল। আমরা ওঁকে সিঙ্গিং-স্টার হিসেবেই ভাবতাম। পরে বার্ধক্যে আবার ফিরে এসে উনি যে-সব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেগুলো কিন্তু খুবই সুন্দর কাজ হয়েছিল।

‘চৌরঙ্গী’ যখন থিয়েটারে হয়, তখন একদিন সেটা দেখতে গিয়েছি। উনি সেই নাটকে কাজ করছিলেন। খুবই সুন্দর ছিল ওঁর কাজ। গিয়ে শুনলাম ওঁর জ্বর হয়েছে। আমি দেখা করতে এসেছি শুনে সেই জ্বর থাকা অবস্থাতেই এলেন, এসেই বললেন, ‘আমি তোমার নাটক ‘বিদেহী’ দেখে এসেছি, আমার খুব ভাল লেগেছে।’ আমি অবাক। আমরা তখন ‘অভিনেতৃ সংঘ’ থেকে ‘বিদেহী’ করেছিলাম। বললাম, ‘সে কী, আপনি নিজে দেখতে গিয়েছিলেন, সে-কথা তো বলেননি আমাকে!’ উনি ওঁর স্বভাব অনুযায়ী বললেন, ‘না, তখন তোমাকে আবার বিরক্ত করব। কিন্তু আমার খুবই ভাল লেগেছে।’ আমার নাটক দেখার পর উনি আমার সঙ্গে দেখা করলে আমি বিরক্ত হব, আর উনি জ্বর গায়ে নিয়ে এসে আমার সঙ্গে দেখা করছেন, সেটাই যেন নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ভাল মানুষদের চিন্তার ধারা এমনই হয়।

তারও পরের ছবি ছিল সুখেন দাসের ‘প্রতিশোধ’। বর্ধমানের কাছে পাল্লা রোডের বাংলোতে আমাদের কয়েকদিনের আউটডোর শুটিং। যখন আমাদের দুজনের কাজ নেই, অন্যদের কাজ হচ্ছে, তখন আমরা বসে বসে গল্প করতাম। দিনের বিভিন্ন সময়ে, কখনও সন্ধেবেলায়। সেই সময়েও উনি চমৎকার গাইতে পারতেন। আমার অনুরোধে ‘কবি’র সেই সব বিখ্যাত গান, তারপর ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে’— সবই শুনিয়েছিলেন। সকলেই জানেন উনি একসময় ‘মরফিন’ অ্যাডিক্ট হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার থেকেই ওঁর কেরিয়ারটা নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘটনার সূত্র ধরে আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঠিক কীভাবে ঘটনাটা ঘটেছিল।

আমার প্রশ্নে এতটুকু বিব্রত না হয়ে উনি একেবারে বিশদভাবে ঘটনাটা আমাকে বলেছিলেন। পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবির একটা বড় সেট পড়েছিল। সেই সেটটি নাকি অনেক পয়সা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রধান অভিনেতা রবীন মজুমদার। শুটিংয়ের ঠিক আগে ওঁর জ্বর হয়েছিল। খুবই জ্বর, কী করে অভিনয় করবেন? শুটিং ক্যানসেল হলে অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন শৈলজানন্দের একজন সহকারী ছিলেন (তাঁর নামও রবীনদা আমাকে বলেছিলেন, কিন্তু সেই নামটা আজ আর মনে নেই), তিনি একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স নিয়ে হাজির হলেন। সেই বাক্স থেকে কয়েকটা ছোট গুলি জাতীয় ওষুধ দেওয়ার পর তিনি বললেন, ‘এবার তোমাকে একটা ইঞ্জেকশন দেব, তাতেই তোমার জ্বর চলে যাবে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইঞ্জেকশনটা দিলেনও। সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যে রবীনদা বেশ সুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং তাঁর জ্বরও ছেড়ে গেল। সেই ইঞ্জেকশনে মরফিন ছিল। সেই সময় শৈলজানন্দের ইউনিটের অনেকেই নাকি কমবেশি মরফিন নিতেন। মরফিন এমনই একটা বস্তু যা তিন-চারদিন নিলেই লোকে অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ে। সেই দামি সেটটা নষ্ট হয়ে যাবে শুধু সেই যুক্তিতে রবীন মজুমদারকে মরফিন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এই গল্পটা যখন উনি শেষ করলেন, তখন আমি ওঁকে বলেছিলাম, ‘তাহলে মরফিন অ্যাডিক্ট হওয়ার পেছনে আপনার তো কোনও দোষ ছিল না, আপনি এক ছলনার শিকার হয়েছিলেন।’ এমনই মানুষ, জবাবে উনি আশ্চর্য শান্ত গলায় বলেছিলেন,’না, তা কেন, সেটা আমি কী করে বলব ভাই, আমি তো তখন ছেলেমানুষ ছিলাম না। ওদের কেন দোষ দেব, আমার বোঝা উচিত ছিল।’ সেই থেকে আস্তে আস্তে উনি যখন অ্যাডিক্ট হয়ে গেলেন, ওঁর সিনেমা-জীবন নষ্ট হয়ে গেল। ওঁর গানের অত কদর ছিল, সেটাও চলে গিয়েছিল।

সেই সময়কার একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা উনি বলেছিলেন। নেশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে, একেবারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বৌদি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। রবীনদা একা বাড়িতে। সেই সময়ে একটা গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। উনি গাইবেন এই কথা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা হইহই করে উঠেছে। কিন্তু যেই উনি মঞ্চে উঠেছেন গাইবার জন্য, তখনই দর্শকরা প্রায় সমবেত কণ্ঠে ‘ইস’ ‘ইস’ করে উঠল। ওঁর চেহারা তখন ততটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নিজের কানে শুনলেন, লোকে বলছে— ‘ভদ্রলোকের চেহারার এই হাল হয়েছে!’ পরদিন সকালে বাড়িতে একা বসে আছেন। ওঁর এক কাকা, যিনি সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি হঠাৎ সেই সকালে এসে হাজির। সম্ভবত বৌদি তাঁকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু রবীনদা তা জানতেন না। সেই সন্ন্যাসী কাকা বেনারস থেকে কলকাতায় পৌঁছে সোজা এসেছেন। এসেই তাঁর প্রথম প্রশ্ন— ‘বৌমা কোথায়?’ রবীনদা বললেন, ‘বাপের বাড়ি চলে গেছে।’ সেই কাকা তারপরে বললেন, ‘তুই তো আগেও মদ্যপান ইত্যাদিতে অভ্যস্ত ছিলি, কিন্তু এখন এমন কী সব্বোনেশে নেশা করছিস যে বৌমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়?’ উনি চুপ করে আছেন। কাকাবাবু হঠাৎ রবীনদার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘তুই আমার গা ছুঁয়ে বল তুই আর কখনও এমন নেশা করবি না।’ রবীনদা বলেছিলেন, আমারও সেই মুহূর্তে কেমন যেন একটা সাহস এসে গেল, মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম যে, মরফিন নেওয়া ছেড়ে দেব। এই কথা শোনার পরেই সেই সন্ন্যাসী কাকা ট্যাক্সি ডেকে বেনারসে ফিরে গেলেন। রবীনদা ঈশ্বর, অলৌকিক ঘটনা ইত্যাদিতে কতদূর বিশ্বাস করতেন জানি না, কিন্তু বলেছিলেন— কী অলৌকিক নাটকীয় যোগাযোগ, কাকা চলে যাওয়ার ঠিক পরমুহূর্তেই নচি এসে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল।

বলার প্রয়োজন ছিল বলেই বোধহয় রবীনদা সেই প্রসঙ্গে আরও কিছু বলেছিলেন। যদিও বাংলার সিনেমা-জগতের সকলেই কমবেশি জানতেন যে কী অসম্ভব চেষ্টা ও যত্নে সঙ্গীত-পরিচালক নচিকেতা ঘোষ (যিনি নিজেও পাস করা ডাক্তার) ও তাঁর বিখ্যাত চিকিৎসক বাবা রবীন মজুমদারকে মরফিন-এর নেশা ছাড়িয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন। কিন্তু স্বয়ং রবীন মজুমদারের বক্তব্য কী করে জানা সম্ভব যদি তিনি না বলেন!

রবীনদা বলে চলেছেন, আমি অবাক হয়ে শুনছি।

তখনকার দিনে এই ধরনের ‘মরফিন অ্যাডিক্ট’-দের সুস্থ করে তোলার বিশেষ চিকিৎসা ছিল না। কিন্তু নচিকেতা ঘোষ ও তাঁর বাবা দুজনে মিলে গভীর আন্তরিকতায় চিকিৎসা শুরু করলেন। সেই ডিটক্সিফাই করার চেষ্টায় রোগীর মরফিন নেওয়ার পরিমাণ কমতে শুরু করল। কিন্তু কমতে কমতে এমন অবস্থায় এল না যে, তাঁকে সুস্থ বলা যায়। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়েননি নচিবাবুরা। পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে যদি মানসিকতা বদলায়— এই ভাবনায় নচিদা রবীনদাকে পুরী নিয়ে গেলেন। কাজ হল, সেখানে গিয়ে মরফিন নেওয়ার পরিমাণ আরও খানিকটা কমল। কলকাতায় ফিরে এসেও চিকিৎসা অব্যাহত রইল। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে যতটুকু না নিলে রোগীর শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটতে পারে ততটুকুই দেওয়া হচ্ছিল। নচিকেতা ঘোষ ও তাঁর পরিবারের মানুষদের চেষ্টা, উদ্বেগ রবীনদা লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। তিনি হঠাৎ একদিন ঘোষণা করলেন— ‘দেখো আজ থেকে আমাকে যতটুকু পরিমাণ মরফিন দিতে হচ্ছে তাও দেবে না। আমি চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি যা-ই করি না কেন, কিছুতেই দেবে না। তাতে যদি আমি উইথড্রয়াল সিমটম-এ মরেও যাই, যাব। কিন্তু আর আমি কিছুতেই মরফিন নেব না।’

এই ধরনের পরিস্থিতিতে রোগীর শরীর ও মনে ঠিক কী অবস্থা হয় তা নিশ্চয় চিকিৎসক হিসেবে নচিদা ও তাঁর বাবা জানতেন। কিন্তু রবীনদার কথা শুনে এটা বুঝতে পারছিলাম চমৎকার মনের মানুষটির কী অসাধারণ মানসিক জোর ছিল।

রবীনদা বলে চলেছেন—

‘যা হওয়ার তাই হল। আমি প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তিনদিন অর্থাৎ প্রায় ৭২ ঘণ্টা আমার কোনও বাহ্যজ্ঞান ছিল না। নচিও বোধহয় এক মুহূর্ত আমার বিছানার পাশ থেকে নড়েনি। শেষ পর্যন্ত যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম, আমার বিছানার পাশের জানালার কাছে একটা বড় গাছ, তার পেছন থেকে লাল সূর্য উঠছে। সেই সূর্যটার দিকে তাকিয়ে, বুঝলে সৌমিত্র, আমার নতুন একটা জন্ম হল।’ ঠিক পরিষ্কার মনে নেই, রবীনদা আমাকে বলেছিলেন তখন নাকি নচিকেতা ঘোষরা সপরিবারে এন্টালির জোড়া গির্জার কাছাকাছি কোথাও একটা থাকতেন।

বলেছিলেন, তার পর থেকেই উনি রাতারাতি সুস্থ হয়ে ওঠেননি, উইথড্রয়াল সিমটম-এর জন্য শরীরের ওপরেও যথেষ্ট চাপ পড়েছিল। কিন্তু মরফিন আর কখনও নেননি। পরে, মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠার পরে ডাক্তাররাই নাকি ওঁকে কখনও কখনও একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করার পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু রবীনদা রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, নেশাকে যেদিন সম্পূর্ণ জয় করতে পারব, সেদিন আবার ভেবে দেখব।

পাল্লা রোডের বাংলোয় সেই সন্ধেবেলায় আমি অবাক হয়ে এককালের সুপারস্টারের মধ্যে একজন অসামান্য সাহসী ও হৃদয়বান মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছিলাম। পরবর্তীকালেও এমন মানুষ খুব বেশি দেখিনি। সুস্থ হওয়ার পরেও রবীনদার পারিবারিক সমস্যা সেই অর্থে কাটেনি। কারণ কেরিয়ার বিধ্বস্ত, তখন তো কাজ নেই। সেই প্রবল অর্থসঙ্কটের দিনে রবীনদার বোন গৌরী, অর্থাৎ গৌরী ঘোষ (এই তথ্যটা কতজন জানেন আমি জানি না), দারুণভাবে রবীনদার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। রবীনদাও শেষ পর্যন্ত অভিনয়ের জগতে ফিরে এসেছিলেন।

দুই

এটাকেও জীবনের প্রাপ্তি বলতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তাঁর মতো এমন একজন খাঁটি, সৎ মানুষ প্রায় দেখিইনি। আমরা যখন প্রথম অভিনয়ে আসি, তার অনেক আগে থেকেই কমলদা মানে কমল মিত্র একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। ওঁর সঙ্গে আগে আমার পরিচয় ছিল না। যখন স্টার থিয়েটারে ‘তাপসী’ নাটকে অভিনয় করতে গেলাম, তখন উনি সেখানে প্রধান অভিনেতা। সেটা সম্ভবত ১৯৬৩। সবাই স্টেজে রিহার্সাল দিচ্ছেন। আমি গিয়ে পৌঁছতেই সলিল মিত্র মশাই নিয়ে গিয়ে বসালেন দেবুদার (নাট্যপরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত) পাশে। একটু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কারণ সেখানে রিহার্সাল চলছে তো ঠিকই, কিন্তু মাঝের যে সামান্য সময়ের বিরতি, তখনও কেউ কোনও কথাবার্তা বলছেন না। এমনকি সেখানে যারা আমার চেনা, তারাও আমার সঙ্গে কোনও কথাবার্তা বলছিল না। কেমন যেন একটা দূর-দূর ভাব। যে কোনও মানুষ সেই মুহূর্তের এমনও ব্যাখ্যা করতে পারেন— কী দরকার বাবা, সত্যজিৎ রায়ের হিরো, কত খ্যাতি, এখন আগ বাড়িয়ে কথাবার্তা বলতে গেলে যদি পাত্তা না দেয়! কিন্তু আমার মানসিক অবস্থাটা ঠিক উল্টো। ভাবছিলাম, আমি এলাম তোমাদের এখানে, তোমরা আমাকে কাছে ডাকবে না? রিহার্সাল চলছে আর আমার পক্ষে দম বন্ধ করা পরিস্থিতিও চলছে। তারপর এক সময়ে যখন সেই বিশেষ দৃশ্যটার রিহার্সাল সম্পূর্ণ হল, কমলদা জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তোমাদের এই সিনটার রিহার্সাল কি শেষ হয়েছে?’ উত্তর পেলেন— ‘হ্যাঁ, হয়েছে।’ উনি তখন চটি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘এসো ভাই, তুমি যে আজ থেকে আমাদের থিয়েটারে জয়েন করলে, এর জন্য আমরা খুবই খুশি হয়েছি।’ এই যে উদারতা, এটা ওঁর মধ্যে ছিল। বলাই বাহুল্য, গোটা পরিবেশটা বদলে গিয়ে সহজ হয়ে গেল, অন্য পরিচিতরাও তখন এগিয়ে এসে কথাবার্তা শুরু করল। কমলদা সেই মুহূর্তে সহজ সৌজন্যে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কী করে মানুষকে আপন করে নিতে হয়। তাঁর সেই উদারতা, আন্তরিকতার পরিচয় আমি চিরকালই পেয়ে এসেছি, যতদিন তিনি আমাদের মধ্যে ছিলেন।

পরিচয় হওয়ার পর থেকেই আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল ওঁর মতো একজন সিনিয়র অভিনেতার অভিজ্ঞতামিশ্রিত স্মৃতিকথা অন্যদেরও জানা প্রয়োজন। সেজন্য প্রায় নাছোড়বান্দা হয়ে, ক্রমাগত অনুরোধ করে ওঁকে দিয়ে একটা আত্মজীবনী লেখাতে পেরেছিলাম।

কমল মিত্রের বাইরের ইমেজ, (সেই ইমেজ অবশ্যই তাঁর অভিনীত চরিত্র থেকেই তৈরি হয়েছিল।) গুরুগম্ভীর, বাজখাঁই গলা এবং নায়ক-নায়িকার প্রেমের প্রশ্নে রীতিমতো খারাপ বাবা বা জ্যাঠামশাই। কিন্তু বাস্তবিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ওঁর মতো স্নেহপ্রবণ মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আর মিথ্যে বলে কোনও কথা উনি জানতেন না। ওঁর মুখ খারাপ ছিল বলে প্রচার আছে। কিন্তু সেটা ছিল নারকেলের খোলার মতো, ভেতরে ছিল সুমিষ্ট শাঁস ও বিশুদ্ধ জল। যাঁরা তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছেন, তাঁরাই জানতেন কী ওঁর মনের আসল পরিচয়। মিথ্যে উনি তো বলতেনই না, এবং কেউ বলুক সেটাও তীব্র অপছন্দ করতেন।

কমলদার সততার বিস্তর উদাহরণ আছে। এখানে একটাই লিখছি। উনি একবার নিজের পেশায় প্রতিদিনের অভিনয়ের ফি হিসেবে একশো টাকা বাড়িয়েছিলেন। যারা ওঁকে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজের জন্য নিত, তারা আপত্তি করলে উনি সরাসরি বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে লোকে তো ফি বাড়ায়, তাই বাড়িয়েছি। তোমাদের বেশি মনে হলে আমাকে নিয়ো না।’ কিন্তু ওঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না বলে তারা শেষ পর্যন্ত বাড়তি টাকাটা দিয়েই ওঁকে নিয়েছিল। কিন্তু তার পরের প্রযোজক ভদ্রলোক তাঁর অনেকদিনের পরিচিত এবং আর্থিক ক্ষমতার প্রশ্নে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তারা কমলদাকে হাতে-পায়ে ধরে তাঁর সেই পুরনো ফি-তেই কাজ করতে রাজি করিয়ে ফেলে। ঘটনাটি ঘটার পর আবার যখন বাড়তি টাকা দিতে রাজি হওয়া প্রযোজকের কাছে ডেট অনুযায়ী কাজ করে ফিরেছেন, তখন প্রথমেই প্রাোডিউসারকে গালাগাল দিয়ে কাছে ডেকে, গুনে গুনে তিনশো টাকা ফেরত দিয়েছিলেন। তারা তো অবাক। কমলদার বক্তব্য ছিল তিনদিনের কাজের বাড়তি টাকা তিনি কী করে নেবেন, তাতে যে মিথ্যাচার হবে! আজকের দিনে এমন আচরণের কথা ভাবা যায়?

এখনও ল্যান্সডাউন রোডে (এলগিন রোড ক্রসিং-এর কাছে) ওঁর বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাই। উনিও শিশিরকুমারের ছাত্র ছিলেন বলেই বোধহয় আমার প্রতি ওঁর মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ ছিল। জীবনের শেষের দিকে, যখন ওঁর যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, তখন পরিচালক তরুণ মজুমদারের একটা ছবিতে আমরা একসঙ্গে আউটডোর-এ গিয়েছিলাম। ওঁর জন্য বিশেষভাবে কাঠের কমোড ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল মনে আছে। উনি যাওয়ার আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘সৌমিত্র আমার সঙ্গেই থাকবে, নইলে আমি ঠিক কনফিডেন্স পাব না।’ বাড়িতে গেলে ভারী আদর-যত্ন করতেন আর সেই সঙ্গে পুরনো দিনের মজার মজার গল্প যেন ফুরোতেই চাইত না। মাঝে মাঝে অভিনয়- সংক্রান্ত আলোচনাও হত, সেখানেও ওঁর নিজস্ব ভাবনাচিন্তা ছিল।

তিন

কালোদা অর্থাৎ অসিতবরণের, বলা যায়, আমি একজন ফ্যানই ছিলাম। তার প্রধান কারণ ওঁর শারীরিক সৌন্দর্য, ইংরেজি ‘হ্যান্ডসাম’ শব্দটারই প্রতিমূর্তি যেন। আচার-ব্যবহারে যেমন মিষ্টি মানুষ, তেমনই ছিল তাঁর চেহারা ও চলাফেরা। স্কুল বা কলেজ থেকে যখন ইডেন গার্ডেনস-এ ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতাম, তখনই ওঁকে দেখতাম। প্রতিটি খেলায় কালোদা হাজির। ওঁর চেহারার সঙ্গে মানানসই স্যুট পরা থাকত। তখন পরিচয় ছিল না, তাই দূর থেকেই দেখতাম। সি এ বি-র ক্লাব হাউস তখন অন্যত্র ছিল, মাঠের দক্ষিণ দিকে দীর্ঘদেহী ঝাউগাছরা ছিল। উনি সেই ক্লাব হাউসের এনক্লোজার-এ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বসে খেলা দেখতেন। তখন থেকেই একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, এবং সেই জন্যে মনের মধ্যে একটা প্রশ্নও ঘুরে বেড়াত— একজন মানুষের হাঁটা কী করে এতটা সুন্দর হয়, একেবারে যাকে বলে— হাইলি গ্রেসফুল! সেই সময়কার অন্য অভিনেতাদের থেকে একেবারে আলাদা। পরে অবশ্য রহস্যটা জেনেছিলাম। উনি তো যৌবনে মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট ও হকি দুটোই খেলতেন। সব খেলোয়াড়ের মধ্যেই একটা আত্মবিশ্বাসী, রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটা থাকে। খেলতে গেলে খুব স্বাভাবিকভাবে পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম ছাড়া একজন মানুষের হাঁটা সুন্দর হতে পারে না। কালোদা ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে যাঁর হাঁটা ছিল সবচেয়ে সুন্দর, তিনি জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। জ্ঞানেশদা নিয়মিত ব্যায়ামের সঙ্গে জিমনাস্টিক-এর অনুশীলনও করতেন। জ্ঞানেশদা যৌবনে যে-ভাবে হাঁটতেন তার কোনও তুলনা ছিল না।

কালোদার শরীর থেকে মনে যাই। পরে যখন পেশার টানে আমিও অভিনয় করতে এলাম, তখন তাঁর সঙ্গে খুব কাছের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আমাকে তো বটেই, আমার স্ত্রী, আমাদের পরিবারের সকলের সঙ্গে তাঁর একটা আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সদাহাস্যময় কথাটা বোধহয় একমাত্র কালোদার ক্ষেত্রেই শতকরা একশোভাগ সত্যি। গুণের একেবারে আধার ছিলেন। তবলাবাদক ও গান গাইবার জন্য রীতিমতো খ্যাতি ছিল। বাংলা সিনেমায় ওঁর সেইসব যোগ্যতা একাধিক ছবিতে কাজেও লাগানো হয়েছিল। অথচ জীবন এমন, মানুষের সুখ-দুঃখের কোনও ভারসাম্য সেখানে নেই। মেয়ে ও জামাই জি টি রোডে এক মোটর দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ওঁকে একেবারে ভেঙে পড়তে দেখেছি। শেষ বয়সে ধর্মে মতি হয়েছিল। একদা নায়ক-গায়ক হিসেবে রবীন মজুমদার-অসিতবরণের মধ্যে একধরনের পেশাদারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। লেজেন্ডারি আর্টিস্ট হিসেবে ওঁদের নিজেদের সেরা সময়ে তেমন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে দেখেছি রবীনদা ও কালোদা দু’জনে দু’জনের পরম বন্ধু। শেষ বয়সে অধিকাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাজকর্ম কমে যায়, ফলে নিয়মিত দেখাশোনার সুযোগ কমে যায়। সেই সময়ে একদিন রবীনদা আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘জানো সৌমিত্র, কালো একটা কীর্তনের দল করেছে। আমাকে ডেকেছিল, আমি গিয়ে ওদের গান শুনে এলাম।’ শুনে আমারও যে কী ভাল লাগছিল তা যেন আজও অনুভব করতে পারি। পেশাদার জগতে প্রচারে-অপপ্রচারে যত লড়াই-ই থাক না কেন, ব্যক্তিগত স্তরে তখন আমরা সকলেই একেবারে পারিবারিক সম্পর্কেরই স্বাদ পেতাম, পেয়েছিলাম।

চার

সিনেমায় এসে আমি যা পেয়েছি তাতে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে হয়। আমি তো তখন সত্যিই অনভিজ্ঞ ছিলাম, সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে বয়সের বেশ তফাত, অভিজ্ঞতার তো বটেই। ‘অভিযান’ ছবিটা যখন হয়েছিল তখন আমি মাত্র কয়েকটি ছবির অভিনেতা। জ্ঞানেশদা-শেখরদা আমার তুলনায় অনেক সিনিয়র। কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ওঁরা আমাকে অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিতেন, যার জন্য সুযোগ পেলে আমি এখনও ধন্যবাদ দিতে চাই। উৎসাহ-পরামর্শ যেমন দিতেন আবার প্রশংসাও করতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওঁদের আন্তরিক ব্যবহার ও সাহচর্য।

শেখর চট্টোপাধ্যায় অভিনয়-জীবনে ভিলেনের পার্ট করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে খুবই চমৎকার মানুষ। প্রকৃত অর্থে অনেক স্ট্রাগল করে বড় হয়েছিলেন। রীতিমতো পড়াশুনো করতেন, অনেক কিছুর খবরও রাখতেন। জ্ঞানেশদা-শেখরদা এঁদের সকলেরই দেখেছি আমার প্রতি একটা অপরিসীম স্নেহমিশ্রিত দুর্বলতা ছিল। পরে ভেবে দেখেছি, তাঁদের আমার প্রতি এমন মনোভাব না-ও থাকতে পারত। পেশাদার অভিনেতাদের জগৎ, সেখানে যে যার কাজের জন্যই তো সাফল্য পাবে। কিন্তু ওঁরা হৃদয়বান ছিলেন বলেই অমন সহজ পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

বুলবুলদা অর্থাৎ সতীন্দ্র ভট্টাচার্য আমার চেয়ে বয়সে তেমন একটা কিছু বড় ছিল না, হয়ত বছর চারেকের তফাত হবে। বুলবুলদার চেহারাও ছিল চমৎকার। হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ। সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা, অর্থাৎ সংলাপ বলার ডিক্সন খুব ভাল ছিল। এই আর একজন মানুষ যাঁর মধ্যে কোনওরকম ভান বা তঞ্চকতা ছিল না। বলতে গেলে এমন সৎ মানুষ দুর্লভ। অথচ আমাদের চলচ্চিত্র-জগতে উল্টো স্বভাবের চলনই বেশি। যে যা নয়, সে সেটাই বেশি দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।

বুলবুলদা হইহল্লা করতে পছন্দ করত, আমাদের সঙ্গে সবসময়ে মজার কথাবার্তা বলত, কিন্তু অভিনয়ের প্রশ্নে অত্যন্ত সিরিয়াস স্বভাবের মানুষ। আমি দাদা বলতাম ঠিকই, কিন্তু তুই-তোকারির সম্বন্ধ ছিল, যেমন বাড়িতে থাকে। অনেক ছবিতেই একসঙ্গে কাজ করেছি, তবে ‘বাক্সবদল’ ছবিতে ওর কাজ ছিল এককথায় আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। অভিনেতৃ সঙ্ঘ থেকে যখন ‘রাজকুমার’ করেছিলাম, তখন ওকে দিয়ে একটা দুষ্ট লোকের চরিত্রে (রবি গুপ্ত) অভিনয় করিয়েছিলাম এবং বুলবুলদা চমৎকার কাজ করেছিল। একজন সুদর্শন হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ ওইরকম একটা চরিত্রে কাজ করবে তা কেউ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু তাতেই অন্য এক ধরনের মজা হয়, অর্থাৎ স্মাইলিং স্টাইলিং অ্যান্ড বি আ ভিলেন। সেই নাটকটার একটা শো চলার সময়েই ওর হার্টের অসুখ প্রথম ধরা পড়ে।

শেষ পর্যন্ত বুলবুলদা হার্ট অ্যাটাকেই মারা গিয়েছিল, সেটাও ওর বাবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরেই। সদাশয় মানুষের যাবতীয় পরিচয় বুলবুলদার মধ্যে ছিল। সে-ও একদা হিরো ছিল, কিন্তু পরে সরে গিয়ে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য তার কোনওরকম মানসিক সমস্যা তৈরি হয়নি।

হাসিখুশি মানুষ প্রসঙ্গে আর একজনের কথা মনে পড়ছে। তাঁর কথা মনে পড়লেই হাসি পাবে। ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ থাকার সময় আমাদের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন শ্যাম লাহা। তিনিও সদাহাস্যময় এবং অত্যন্ত সহজ স্বভাবের মানুষ ছিলেন। বয়সে বিস্তর সিনিয়র ছিলেন বলে আমরা যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথাবার্তা বলতাম। তবে রঙ্গ-রসিকতায় কোনও বাধা ছিল না। টাকাপয়সা খরচের ক্ষেত্রে এমন করতেন, যেন কেউ তাঁর নিজের টাকা খরচ করে ফেলেছে। চোখ দুটো তাঁর এমনিই বড় ছিল, সেটাকে আরও বড় করে বলতেন, ‘অত টাকা খরচ করো না বাপু।’ কখনও কখনও তাঁর অত্যন্ত সতর্ক ও হিসেবি মনোভাব দু-এক টাকার স্তরেও নেমে আসত। এবং ওঁর এই বাড়তি সতর্ক চিন্তাভাবনার জন্য আমার বা অনুপের সঙ্গে ওঁর তর্কাতর্কি বেধে যেত। আমরা যদি ওঁকে বলে ফেলতাম, ‘আপনি কেন অমন করছেন, এটা কি আপনার টাকা?’ উনি এতটুকু অপ্রতিভ না হয়ে, ওঁর সেই অননুকরণীয় কৌতুকময় কণ্ঠস্বর ও ভঙ্গিতে বলতেন, ‘হ্যাঁ, আমারই তো টাকা।’ অত্যন্ত সরস মানসিকতার মানুষ এবং আমাদের প্রতি ওঁর স্নেহ-ভালবাসার অন্ত ছিল না।

‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ভেঙে ‘শিল্পী সংসদ’ নামে আলাদা সংস্থা হয়ে যাওয়ার সময় উনি আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে যাঁরা ওঁর বিশেষ বন্ধু, তাঁরা সকলেই দক্ষিণপন্থী ছিলেন, কংগ্রেসের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সমর্থন করতেন। সেই তাঁরা অর্থাৎ অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, পিনাকী মুখোপাধ্যায়, মিহির ভট্টাচার্য— এঁরা শ্যামদার দীর্ঘদিনের অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁরাও ওঁকে জোর করেননি। কিন্তু নিজস্ব বোধবুদ্ধি বিচারে স্থির থেকে উনি পরিষ্কার বলেছিলেন— ‘না, আমি ”অভিনেতৃ সঙ্ঘ” ছেড়ে যাব না। কারণ আমি মনে করি সৌমিত্র, ভানু, এরা যেটা করছে সেটাই ঠিক।’ অথচ রাজনৈতিক বিশ্বাসে শ্যামদাও কংগ্রেসি ছিলেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিন্দুমাত্র অবনতি হয়নি, ওঁরা নিয়মিতই শ্যামদার খোঁজখবর নিতেন। আসল কথা বোধহয় এই যে, ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকলে, বিশেষ কোনও কাজের আদর্শে স্থির থাকলে এই মানসিকতা থাকে, শ্যাম লাহাদেরও ছিল।

পাঁচ

একই ধরনের শোভন-সুন্দর স্নেহ-ভালবাসার ব্যবহার পেয়েছি অজিতদার কাছ থেকেও। অজিতদা, মানে অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো হৃদয়বান, সুরসিক ও স্নেহপ্রবণ মানুষও খুব বেশি দেখিনি। প্রবীণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনিও ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ছেড়ে চলে যাননি। প্রয়োজনে আমাদের উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন এবং সঙ্ঘের নাটকে নিয়মিত অভিনয়ও করেছেন। উনি যে খুব বড় দরের অভিনেতা ছিলেন সে তো সকলেই জানেন। ওঁর ছবিগুলো দেখলেই সেই সত্য বারবার প্রতিষ্ঠিত হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি অজিতদারও স্নেহে অভিষিক্ত ছিলাম। অজিতদা মানুষ হিসেবে এত ভাল ছিলেন তা বোধহয় এই স্নেহরসে সিক্ত না হলে বুঝতেই পারতাম না। বিশেষ করে চারপাশে এত হিসেবি, স্বার্থগন্ধী মানুষদের মধ্যে অজিতদাদের একেবারে অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হয়। মনে পড়ছে একবার শীতে হাওড়ার কোথাও একটা (বোধহয় রামরাজাতলায়) ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ থেকে নাটক করতে গিয়েছি। অজিতদাও আছেন। অজিতদার গায়ে একটা দামি চৌখুপি শাল। আমি সরলপ্রাণে এবং কোনও কিছু না ভেবেই অ্যাপ্রিশিয়েট করে বলেছি— ‘বাঃ, চমৎকার শালটা তো!’ অজিতদা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘তোমার ভাল লেগেছে?’ তার পরের মুহূর্তেই নিজের গা থেকে সেই শালটা খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার।’ তার মধ্যে অন্য কোনও কারণ ছিল না, উনি জানতেন সেই সুন্দর শালটার বদলে কিছুই পাবেন না। এই যে স্বার্থবোধশূন্য অকারণ স্নেহ, সেটাই বোধহয় স্নেহের প্রকৃত স্বরূপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *