নয়
ক্লোরিন গ্যাসে মৃত্যু সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না রানার। দম বন্ধ করে পড়ে রইল সে ঝাড়া পনেরো সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ প্রবল ভাবে কেঁপে উঠল ওর সর্বশরীর। বার দুয়েক কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল রানা। চোখ দুটো স্থির হয়ে চেয়ে রয়েছে ছাতের দিকে।
এতক্ষণ বুকটা ওঠা নামা করছিল, থেমে গেছে সেটাও। বাপ-বেটির অবস্থাও তথৈবচ।
আরও পনেরো সেকেন্ড পর নড়ে উঠল দর্শকরা। দুই একটা কথা বলল নিজেদের মধ্যে, তারপর রওনা হলো দরজার দিকে। একে একে বেরিয়ে গেল সব কজন। বন্ধ হয়ে গেল দরজা, ভারী বল্টু লেগে গেল বাইরে থেকে ঘটাং করে।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল রানা। উঠে বসল প্যাপন মং লাই এবং সোফিয়াও—সবাই দম বন্ধ করে রেখেছে। দরজাটার এপাশে কোন হ্যান্ডেল নেই। ধাক্কা দিয়ে দেখল রানা, বাইরে থেকে বন্ধ। এক ইঞ্চি পুরু কাচ কি লাথি দিয়ে ভাঙা যাবে? তাই চেষ্টা করে দেখতে হবে। এছাড়া আর কোন পথ নেই এখান থেকে বেরোবার।
দড়াম করে লাথি মারল রানা। খানিকটা বাতাস বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। অভ্যাস বশে শ্বাস টানতে গিয়েও সামলে নিল সে। এখন এই ঘরে একবার শ্বাস নেয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। আবার লাথি মারল রানা দরজার গায়ে। একবিন্দুও চিড় ধরল না কাচের গীয়ে। অনেক চাপ সহ্য করবার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে এই কাচ, সহজে ভাঙবে না।
উঠে এল প্যাপন মং লাই। সোফিয়াও এল। তিনজন মিলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিল একসাথে। এবার কেঁপে উঠল দরজাটা। দ্বিগুণ উৎসাহে আবার ধাক্কা দিল তিনজন একসাথে। আবার একটু কেঁপে উঠল দরজাটা। তার বেশি কিছুই নয়।
এক মিনিট পার হয়ে গেছে। চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে সোফিয়ার। আর বেশিক্ষণ দম আটকে রাখা সম্ভব হবে না ওর পক্ষে। কপালে এক আধটা শিরা দেখা দিতে শুরু করেছে।
দ্রুত চিন্তা চলছে রানার মাথায়। যে করে হোক বেরোতে হবে এখান থেকে আধ মিনিটের মধ্যে।
ঝটপট জুতো খুলে ফেলল রানা। স্টীলের পাত বসানো জুতোর একটা ধরিয়ে দিল প্যাপন মং লাইয়ের হাতে, অপরটা দিয়ে হাতুড়ির মত খটাখট মারতে শুরু করল কাচের গায়ে—ঠিক যেখানটায় হ্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে তার ছয় ইঞ্চি উপরে।
ছোট ছোট কাচের চিলতে উঠতে শুরু করল এবার। কামারের দোকানে যেভাবে দু’জন মিলে হাতুড়ি চালায় ঠিক তেমনি একবার রানা, একবার প্যাপন মং লাই জুতো মেরে চলল কাচের গায়ে দ্রুত বেগে। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই হাত গলাবার মত ফাঁক হয়ে গেল এক ইঞ্চি পুরু কাচ। হাত গলিয়ে দিয়েই হ্যান্ডেলে চাপ দিল রানা। খুলে গেল দরজা।
ছুটল রানা সুইচ বোর্ডের দিকে। ইশারা করে নিষেধ করল যেন কেউ শ্বাস না নেয়। কাচ-ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে ওরা বেরিয়েই, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে গ্যাস নিশ্চয়ই বেরিয়ে এসেছে এই ঘরে।
একটার পর একটা সুইচ টিপতে শুরু করল রানা। প্রথমটাতে ঝর ঝর করে পানি পড়তে শুরু করল, দুই নম্বরে নামতে শুরু করল পাইপটা নিচের দিকে হাতীর শুঁড়ের মত। তৃতীয়টাতে যথাস্থানে ফিরে গেল পাইপটা চতুর্থটাতে আবার পানি, পঞ্চমটাতে নেমে আসছে শুঁড়, ষষ্ঠতে আবার উঠে গেল সেটা। অনেকটা বুঝে ফেলেছে রানা। সপ্তম বোতাম টিপতেই ধোঁয়ার মত গ্যাস বেরোতে শুরু করল ঝাঁঝরি দিয়ে, তিন সেকেন্ড পর ওটা বন্ধ করে পাশেরটা টিপল রানা। অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াটা।
এতক্ষণে ফিরল রানা বাপ-বেটির দিকে। দেখল, সোফিয়ার নাক-মুখ টিপে ধরে আছে প্যাপন মং লাই। ছটফট করছে সোফিয়া, চোখ দুটো বিস্ফারিত। গলায়, কপালে নীল শিরা দপ দপ করে লাফাচ্ছে। শ্বাস নেয়ার জন্যে রীতিমত কুস্তি করছে সে, প্রাণপণ শক্তিতে একহাতে চেপে ধরে আছে ওকে প্যাপন মং লাই, অন্য হাতে টিপে ধরে আছে নাক-মুখ, কিছুতেই শ্বাস নিতে দেবে না। প্যাপনের নিজের অবস্থাও কাহিল হয়ে এসেছে, টকটকে লাল হয়ে গেছে চোখ দুটো।
একছুটে গিয়ে কাচ-ঘরের দরজাটা খুলে দিল রানা। আর দম আটকে রাখা যাচ্ছে না। কতক্ষণ লাগবে এই হারামী গ্যাসের বের হতে? আর তো থাকতে পারছে না।
আরও পনেরো সেকেন্ড কাটল।
ছটফটানি কমে আসছে সোফিয়ার। আর কিছুক্ষণ নাক-মুখ টিপে ধরে রাখলে শ্বাস নেয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে বেচারীর চিরতরে। ভুশ করে শ্বাস ছাড়ল রানা, সেই সাথে ইঙ্গিত করল প্যাপন মং লাইকে। তিনজনই ফুঁপিয়ে উঠল একসাথে। দুনিয়ার সব বাতাস একবারে টেনে নিতে চাইছে ওদের ফুসফুস। বার কয়েক শ্বাস নিয়েই ফুঁপিয়ে উঠল সোফিয়া। এত কষ্ট বোধহয় জীবনে পায়নি কখনও ও।
বেঁচে থাকার আনন্দে পাগলের মত হাসতে শুরু করল প্যাপন মং লাই, দুই হাতে রানাকে জড়িয়ে ধরে পচাং পচাং চুমো খেয়ে ফেলল দশ বারোটা। ধেই ধেই করে নাচল কিছুক্ষণ, তারপর জড়িয়ে ধরে আদর শুরু করল সোফিয়াকে।
প্রাণ ভরে শ্বাস নিল রানা। এক মিনিট পার হয়ে গেছে, তবু যখন মারা গেল না, তখন বুঝতে পারল বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে গেছে, আর ভয়ের কিছু নেই। অন্তত গ্যাসের ভয় নেই আর। মিসেস গুপ্তের মৃতদেহের কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। পিছু পিছু এল বাপ-বেটি। সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলো রানা, মারা গেছে মিসেস গুপ্ত। অসহায় ভঙ্গিতে একরাশ রক্তের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নিজেকে নিজের হাত থেকে উদ্ধার করা হলো না আর ওর। মনে মনে ক্ষমা করে দিল রানা ওকে।
ঘটাং করে বল্টু খোলার শব্দে চমকে উঠল তিনজন একসাথে। খুলে যাচ্ছে দরজাটা। বোতাম টিপে গ্যাস বের করে দিয়ে লাশগুলোর সৎকারের ব্যবস্থা করতে এসেছে কেউ।
দুই সেকেন্ডের মধ্যেই কয়েক লাফে পৌছে গেল রানা দরজার কাছে। আক্রমণের জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না লোকটা। মেশিন পিস্তল বের করবার সুযোগ পেল না, কি ঘটছে টের পাওয়ার আগেই জ্ঞান হারাল নাকের উপর একটা প্রচণ্ড ঘুষি এবং ঘাড়ের উপর একটা তীব্র জুডো চপ খেয়ে। ওকে ছেড়ে দিয়ে দ্বিতীয় জনের দিকে ফিরল রানা। পালোয়ানী চেহারা লোকটার।
বিস্ফারিত দুই চোখে অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে ছিল দ্বিতীয় প্রহরী রানার দিকে। রানাকে ওর দিকে ফিরতে দেখে সংবিৎ ফিরে পেল। চট করে হাত চলে গেল কোমরে ঝুলানো মেশিন পিস্তলের বাঁটে।
কলার ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ঘরের ভিতর নিয়ে এল রানা ওকে। ততক্ষণে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সামলে নিয়েছে দ্বিতীয় প্রহরী। একহাতে রানার কব্জি চেপে ধরল লোকটা, টান দিয়ে কলার থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে রানার হাত। অপর হাতে চলে এসেছে মেশিন পিস্তল। দড়াম করে থুতনি বরাবর ঘুষি মারল রানা। টলে উঠল ঠিকই, কিন্তু কাবু হলো না লোকটা, পিছন দিকে একটা ঝটকা দিয়েই লাফ দিল সামনের দিকে। কলার ছেড়ে, বাম হাতে জুডো চপ মারল রানা মেশিন পিস্তল ধরা হাতে, কব্জি থেকে আট ইঞ্চি উপরে নরম পেশীর ভিতরের নার্ভ সেন্টার লক্ষ করে। ছিটকে হাত থেকে পড়ে গেল মেশিন পিস্তলটা, কিন্তু হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানাও। রানার বুকের উপর পড়ল লোকটা। পড়েই দমাদম ঘুষি মারল কয়েকটা।
পা দুটো বাঁকিয়ে এনে লোকটার গলায় বাধিয়ে জোরে একটা চাপ দিল রানা। ডিগবাজি খেয়ে সরে গেল লোকটা রানার বুকের উপর থেকে। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল দু’জনই। ঝাঁপিয়ে পড়ল পরস্পরের উপর। এক সেকেন্ডের মধ্যে দড়াম করে মেঝের উপর আছাড় মারল লোকটা রানাকে। রানা টের পেল, কেবল অত্যন্ত শক্তিশালীই নয়, জ্যুজুৎসুর এস্পার্ট লোকটা। রানার তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞান রাখে সে আন্-আর্ল্ড কমব্যাট সম্পর্কে। মেশিন পিস্তলের দিকে এক পা বাড়াতেই লাথি চালাল রানা ওর পায়ে। পড়ে গেল সেও। উড়ে গিয়ে পড়ল রানা ওর উপর। আধ মিনিটের মধ্যে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেল দু’জনই, কিন্তু কেউ কাউকে কাবু করতে পারল না। খটাশ করে লাথি পড়ল লোকটার নাকের উপর। এতক্ষণে লক্ষ করল সে প্যাপন মং লাই এবং সোফিয়ার উপস্থিতি। নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটল সে। দুই হাতে চুলের মুঠি ধরে ঝুলে পড়ল সোফিয়া। রানা উঠে দাঁড়াবার আগেই সোফিয়াকে ঝুলন্ত অবস্থাতেই ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলে গেল সে সুইচ বোর্ডের কাছে। মেশিন পিস্তলের বাট দিয়ে মারল রানা লোকটার মাথার পিছনে। কিন্তু ততক্ষণে টিপে দিয়েছে সে অ্যালার্ম বেল। পরিষ্কার শুনতে পেল ওরা শব্দটা। ক্রিং ক্রিং বেজে চলেছে অ্যালার্ম। ঢলে পড়ে গেল দ্বিতীয় প্রহরীর জ্ঞানহীন দেহ।
অ্যালার্ম সুইচটা অফ করে দিল রানা।
‘এইটা ধরো।’ মেশিন পিস্তলটা সোফিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রথম প্রহরীর মেশিন পিস্তল বের করে নিল রানা ওর কোমর থেকে। এগিয়ে ধরল প্যাপন মং লাইয়ের দিকে। ‘আপনি ধরুন এইটা।’
মাথা নাড়ল বৃদ্ধ হাসি মুখে। বাম হাতে ধরা গোটা পাঁচেক ছুরি দেখাল। মিসেস গুপ্তের শরীর থেকে খুলে নিয়েছে। ‘ওটা তুমি রাখো, ওসবের বিচ্ছিরি শব্দ আমার পছন্দ হয় না।’ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এবার? কিভাবে বেরোবে এখান থেকে? বিপদ টের পেয়ে গেছে সবাই।’
‘আসুন আমার সাথে।’ বলেই এগোল রানা। ‘ওরা এখনও জানে না কি ধরনের বিপদ উপস্থিত হয়েছে। সেটা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের সারতে হবে সব কাজ।’ কয়েকটা করিডর পেরিয়ে একটা হলরুমে ঢুকল ওরা। ‘এত বিরাট দালানে লিফট ছাড়াও অন্তত তিন চারটে সিঁড়ি থাকার কথা। লিফট ব্যবহার করব না আমরা। এদের কতজন লোক আছে এখানে?’
চলতে চলতেই উত্তর দিল প্যাপন মং লাই, ‘পনেরো বিশজনের বেশি না।’
‘আমরা যাকে সামনে পাব গুলি করব। কিন্তু কেউ নিচের তলার দিকে পালাবার চেষ্টা করলে পিছু ধাওয়া করব না। আমাদের চেষ্টা হবে যত দ্রুত সম্ভব ছাতে পৌছানো, উপর দিকে উঠবার চেষ্টা করব আমরা। বিচ্ছিন্ন ভাবে তিনজন একসাথে যেন ধরা না পড়ি সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সোফিয়া, তুমি এইখানে দাঁড়াও। এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করবে তিন মিনিট পর।’
‘ওপরে কেন?’
‘আহ্-হা! প্রশ্ন কোরো না সোফিয়া,’ বকা দিল প্যাপন মং লাই। ‘আদেশ পালন করো। সময় নেই হাতে।’ রানার দিকে ফিরল, ‘আমি যাব কোন্ দিকে?’
‘চলুন এগোই।’
একটা অপেক্ষাকৃত সরু সিঁড়ির কাছাকাছি অন্ধকার ছায়ায় প্যাপন মং লাইকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে প্রকাণ্ড ড্রইংরুমে এসে ঢুকল রানা। ও জানে, মূল সিঁড়িটা এবং লিফটের দিকে নজর রাখতে পারবে সে এখান থেকে।
একমিনিটের মধ্যেই পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা।
‘কি হলো, ডাক্তার, অ্যালার্ম বেল বাজাল কে?’ উ-সেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল উপর থেকে।
‘বেল টেপা হয়েছে টর্চার চেম্বার থেকে, হুয়াং-এর উত্তর শোনা গেল। ‘আমি দেখছি, তুমি থাকো।’
‘ঠিক আছে, আমি বরং নিচ তলার সবাইকে সাবধান করে দিই। কিন্তু…কি ঘটতে পারে টর্চার চেম্বারে…’ কণ্ঠস্বরটা মিলিয়ে গেল।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে হুয়াং, হাতে পিস্তল। প্রহরীদের নাম ধরে ডাকল হুয়াং, কেউ কোন জবাব দিল না। হঠাৎ একটা আর্তনাদ শোনা গেল প্যাপন মং লাইয়ের এলাকা থেকে। মাঝ সিঁড়িতে থমকে দাঁড়াল হুয়াং।
পিছন দিকে জেনারেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল রানা। ‘কিয়া বাত, শেখ? চিল্লাতা কওন?’ লিফটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল দু’জন। এইদিকেই আসছে। ঘরে ঢুকে পিস্তলধারী হুয়াংকে দেখে থমকে গেল।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রানা।
মৃত রানাকে চোখের সামনে দেখেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল ওদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল মেশিন পিস্তল দেখে। আতঙ্কে বিকৃত হয়ে গেছে চোখ মুখ।
বুম করে পিস্তলের আওয়াজ হলো। থ্রী পয়েন্ট ফাইভ লেসের চশমার ভিতর দিয়ে রানাকে দেখতে পেয়েছে হুয়াং। বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি ওর। মাঝ সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই গুলি করেছে সে। লোকটার চিন্তার দ্রুততা সত্যিই বিস্ময়কর, কিন্তু হাতের টিপ তেমনি খারাপ। রানার দিকে তাক করে ছোঁড়া ছয়টা গুলি ইতোমধ্যেই মিস করেছে সে রেঙ্গুনে, সপ্তমটাও মিস হয়ে গেল। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলিটা সোজা গিয়ে ঢুকল জেনারেল এহতেশামের হৃৎপিণ্ডে।
ঝট্ করে ঘুরেই গুলি করল রানা। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরোল ডক্টর হুয়াং-এর কণ্ঠ থেকে। কিন্তু আহত হলো না নিহত বুঝতে পারল না রানা। দপ করে নিভে গেল সমস্ত বাতি। খট খট করে কয়েক সিঁড়ি নামল হুয়াং-এর পিস্তলটা। ওটা থেমে যেতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারদিক। কর্নেল শেখের অবস্থান লক্ষ্য করে আবার একঝাঁক গুলি বর্ষণ করল রানা। কাচের দরজাটা চুর করে দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলিগুলো। কর্নেল শেখ সরে গেছে। রানাও সরে গেল কয়েক পা।
নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পাচ্ছে না রানা। আশপাশেই কোথাও রয়েছে কর্নেল শেখ, কিন্তু কোথায় আছে বোঝার উপায় নেই। আরও কয়েক পা সরে গিয়ে অন্ধকার হাতড়ে একটা চেয়ার পেল রানা। চেয়ারের পাশেই টেবিল, টেবিলের উপর অ্যাশট্রে। বাম হাতে তুলে নিল রানা অ্যাশট্রেটা।
এমনি সময়ে কড়কড় শব্দে গর্জে উঠল মেশিন পিস্তল সোফিয়ার এলাকা থেকে। আর্ত চিৎকার শুনতে পেল রানা পুরুষ কণ্ঠে। আবার চুপ।
অ্যাশট্রেটা ছুঁড়ে দিল রানা হাত দশেক দূরে। ‘বুম’ গুলি হলো রানার বাম পাশ থেকে। আগুনের হল্কা দেখেই গুলি করল রানা। ‘উফ্’ শুনতে পেল রানা, তারপরই দুড়দাড় পায়ের শব্দ। ভাগছে কর্নেল শেখ। পায়ের শব্দ লক্ষ্য করে ট্রিগারে চাপ দিল রানা। একটি গুলিও বেরোল না। গুলি শেষ। দেয়ালের গায়ে খড় খড় শব্দ হলো, তারপর উ-সেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল লাউড স্পীকারে।
‘মিস্টার মাসুদ রানা! গ্যাস চেম্বার থেকে কিভাবে বাঁচলেন বুঝতে পারছি না। কিন্তু এইবার প্রস্তুত হয়ে যান মৃত্যুর জন্যে। কিছুতেই নিস্তার নাই আপনার। নেমে আসছি আমি এখুনি। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাবেন না আপনি, কিন্তু আমি ঠিকই দেখতে পাব। আমার কাছে দিন আর রাতে, আলো আর অন্ধকারে কোন প্রভেদ নেই। নিন রক্ষা করুন নিজেকে।
দপ করে একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল আবার সমস্ত বাতি। অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এল উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায়। আবার শোনা গেল উ-সেনের গলা। এবার আর লাউড স্পীকারে নয়, নিজস্ব গমগমে কণ্ঠস্বরে বলল, ‘আপনার বিশ হাত পিছনে আছি আমি, মিস্টার মাসুদ রানা। আমার হাতে রয়েছে দশটা থ্রোয়িং নাইফ। পালাবার উপায় নেই, বাঁচবার চেষ্টা বৃথা, তবু চেষ্টা করে দেখুন।
কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করল না রানা। কারণ হুয়াং যে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল সেখানে আবছা একটা পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। আন্দাজের উপর নির্ভর করে মেশিন পিস্তলটা ছুঁড়ে মারল সে মাঝ সিঁড়ি বরাবর। ঠাশ করে লাগল ওটা গিয়ে কোন নরম বস্তুর গায়ে। লাথি খাওয়া কুকুরের মত কেঁউ করে উঠল স্যুই থি।
‘স্যুই, তুমি এ সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েছিলে কেন?’ ধমকের সুরে বলল উ-সেন। ‘লোইকা মারা গেছে। কাজেই ছাতে গিয়ে লাভ নেই। পিছন দিকের লিফটে করে সোজা কার পার্কে নেমে যাও।’
এক লাফে একটা সোফার আড়ালে গিয়ে বসে পড়ল রানা। বোঁ করে কানের এক ইঞ্চি দূর দিয়ে গিয়ে ঘ্যাঁচ করে সোফার গায়ে বিধল একটা ছুরি। চমকে উঠল রানা। হা হা করে হেসে উঠল উ-সেন রানার পিছন থেকে। ছুরিটা টান দিয়ে বের করে নিয়ে একলাফে সোফার ওপাশে চলে এল রানা।
‘আমি ভেন্ট্রিলোকুইজ্ম্ জানি, মিস্টার মাসুদ রানা। ব্যাপারটা আপনার জানা ছিল না বলে প্রথম সুযোগে মারলাম না। সেটা ছাগল জবাই করার মত সহজ কাজ হত।
কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে সাঁই করে ছুঁড়ল রানা ছুরিটা। আবার হেসে উঠল উ-সেন।
‘সরে গেছি আমি ওখান থেকে। ঠিক যেখান থেকে আমার গলার আওয়াজ পাচ্ছেন, সেখানে আমি নেই। নিন, বাম হাতটা সামলান।
অত্যন্ত দ্রুত সরিয়ে নিল রানা বাম হাতটা, তবু ঘ্যাঁচ করে খানিকটা চামড়া চিরে দিয়ে বেরিয়ে গেল ছুরিটা। ‘উফ্’ বলেই এক লাফে সরে গেল রানা পাঁচ হাত দূরে। একটা চেয়ারে পা বেধে পড়ে গেল মাটিতে। চেয়ার সহ উঠে দাঁড়াল সে চৈয়ারের সীট দিয়ে বুকটা আড়াল করে।
‘বাহ্!’ প্রশংসা করল উ-সেন। ‘আপনার রিফ্লেক্স তো দারুণ! এত দ্রুত রিঅ্যাক্ট করতে দেখিনি আমি আর কাউকে। নইলে ছুরিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হত না কিছুতেই। কিন্তু চেয়ার দিয়ে আড়াল করলে কি বাঁচতে পারবেন? ধরতে গেলে আমি আপনার চতুর্দিকেই আছি। এখন…’
রানা বুঝল, কথা বলতে বলতে হয় ডান দিক নয় বাম দিক দিয়ে ওর পিছনে চলে যাচ্ছে উ-সেন পরিষ্কার টার্গেট পাওয়ার জন্যে। রীতিমত ভয় পেয়েছে রানা। অশরীরী আত্মার মত মনে হচ্ছে উ-সেনকে। কোন্ দিক থেকে ছুটে আসবে মৃত্যুবাণ বুঝবার উপায় নেই। পাগলের মত ছুটল সে বাম দিক লক্ষ্য করে। ঘরের আসবাব কোথায় কি ছিল সব গুলিয়ে গেছে মাথার মধ্যে। শেয়ালের তাড়া খাওয়া মুরগীর অবস্থা হয়েছে ওর। একটা চেয়ারে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল সে ডাইনিং টেবিলের উপর, টেবিল উল্টে হুড়মুড় করে মাটিতে। ঝনঝন করে কয়েকটা কাপ তস্তরী গ্লাস ছুরি কাঁটা চামচ পড়ল মাটিতে ।
মেঝে হাতড়িয়ে একটা কাঁটা চামচ তুলে নিয়েই ছুঁড়ল রানা ডান দিকে, উ-সেনের সম্ভাব্য অবস্থান লক্ষ্য করে।
‘চেষ্টা করলে আপনিও ভাল নাইফ থ্রোয়ার হতে পারতেন, মিস্টার মাসুদ রানা,’ বলল উ-সেন। ‘কাঁটা চামচটা এসে ঠিক আমার বাম হাতে লেগেছে।
কণ্ঠস্বর ভেসে এল রানা যেদিকে চামচ ছুঁড়েছিল ঠিক সেদিক থেকেই। রানা বুঝল ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে উ-সেন মিথ্যে বলে। কিন্তু কোনটাকে যে সত্য বলে ধরবে তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। বুদ্ধির উপর নির্ভর না করে নিজের অবচেতন মনের নির্দেশ মেনে চলাই স্থির করল সে। এঁকে বেঁকে ছুটল সিঁড়ির দিকে।
বাম বগলের নিচে দিয়ে কোট ফুটো করে ঢুকল একটা ছুরি। মরণ চিৎকার দিল রানা গলা ফাটিয়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল সিঁড়ির উপর। পাগলের মত খুঁজছে ডক্টর হুয়াং-এর পিস্তলটা।
পঞ্চম ধাপে পাওয়া গেল পিস্তলটা। কোন লক্ষ্যই নেই, কাজেই লক্ষ্যস্থির করার প্রশ্ন ওঠে না। চেয়ারটা সামনে বাগিয়ে ধরে যেদিক খুশি গুলি করল রানা পরপর পাঁচবার। শেষ গুলিটা বেরোবার সাথে সাথেই ডান দিক থেকে আওয়াজ এল, ‘আ-উফ্!’ সত্যিকার আর্তনাদ চিনতে ভুল হলো না রানার। একলাফে উঠে দাঁড়াল। প্রচণ্ড বেগে ছুঁড়ে মারল খালি পিস্তলটা শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। ঠুস করে কাচ ভাঙার শব্দ পেয়েই আনন্দে লাফিয়ে উঠল রানার হৃদয়। একটানে বগল তলা থেকে ছুরিটা বের করে নিয়ে মারল একই দিকে। খটাশ করে দেয়ালে গিয়ে লাগল ছুরিটা। সরে গেছে উ-সেন।
পাগলের মত অন্ধকারে খুঁজল রানা উ-সেনকে। কোথাও নেই। লিফটের কাছে কিসের শব্দ শুনে সেদিকে রওনা হতে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময় দপ করে জ্বলে উঠল সব ক’টা বাতি একসাথে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিচ্ছু দেখতে পেল না রানা ॥ আলোটা সহ্য হয়ে আসতেই দেখতে পেল লিফটের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে উ-সেন। চশমা নেই চোখে। বুকের ডান দিকে লেগেছিল রানার পঞ্চম গুলিটা। লাল হয়ে গেছে সাদা শার্ট রক্তে ভিজে।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রানা উ-সেনের রক্তে ভেজা শার্টের দিকে। নিজের বাম হাতের দিকে চাইল একবার। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। অদ্ভুত একটা উপলব্ধি এল ওর মধ্যে। কোনও প্রভেদ নেই! বিউটি কুইনের রক্তের সাথে ওর নিজের রক্তের রঙে কোন প্রভেদ নেই। লাল। গায়ের রঙ, জাতি, ধর্ম, পেশা, ইত্যাদির প্রভেদ থাকতে পারে; কিন্তু বিউটি কুইনের হত্যাকারী ইয়েন ফ্যাঙ, ইয়েন ফ্যাঙের হত্যাকারী মিসেস গুপ্ত, মিসেস গুপ্তের হত্যাকারী উ-সেন, সবার রক্তের রঙ লাল। ওর নিজেরও। তবু এই ‘হানাহানি, ইচ্ছের লড়াই, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, আর রক্তপাত! এ থেকে কি মুক্তি নেই মানুষের?
ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লিফটের দরজা। একটা গমগমে কণ্ঠ শুনতে পেল রানা।
‘মাসুদ রানা। তুমি মস্ত ক্ষতি করলে আমার। পৃথিবীর যেখানেই থাকো, যত সাবধানেই থাকো, বাঁচতে পারবে না তুমি আমার হাত থেকে। প্ৰস্তুত থেকো, আজ হোক, কাল হোক, দশবছর পরে হোক—প্রতিশোধ নেব আমি।
বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা।
জেনারেল এহতেশাম এবং হুয়াং কির লাশ ডিঙিয়ে ছুটল রানা ছাতের দিকে।