রক্তের রঙ ২.২

দুই

দুইজন পোর্টার পাঁজাকোলা করে তুলে শুইয়ে দিল রানাকে হুইল চেয়ারে। চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে লিফটে উঠল মিসেস গুপ্ত। লাউঞ্জে ওদের বিদায় দেয়ার জন্যে এসে হাজির হলো হোটেল ম্যানেজার, প্রচুর দুঃখ প্রকাশ করল, কোন রকম সাহায্যে আসতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করল। যথেষ্ট বিনয়ের সাথে সমস্ত সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে, বিল চুকিয়ে দিয়ে চোখের সামনে যত বেয়ারা আর পোর্টার দেখতে পেল সবার হাতে দশ টাকার একটা করে নোট গুঁজে দিতে শুরু করল মিসেস গুপ্ত।

হঠাৎ চোখ পড়ল রানার সোফিয়ার উপর। কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে রানার দিকে! অনেক চেষ্টা করে তিন বার চোখের পাপড়ি ফেলল রানা, পাঁচ সেকেন্ড পর আবার তিন বার। আশা—যদি কোন মতে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। চিনতে পারার কোন লক্ষণই প্রকাশ পেল না সোফিয়ার মধ্যে। মিসেস গুপ্ত একবার কড়া চোখে চাইল সোফিয়ার দিকে। রানা ঠিক বুঝতে পারল না, গত পরশু দেখা অ্যাংলো মেয়েটাকে বার্মিজ পোশাকে ভিন্ন পরিবেশে চিনতে পারল কিনা মিসেস গুপ্ত। ট্যাক্সিতে তোলা হলো রানাকে। আরেকবার চোখ পড়ল ওর সোফিয়ার ওপর। ঠিক একই ভঙ্গিতে, যেন কারও জন্যে অপেক্ষা করছে এমনি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ওর মধ্যে কোন রকম চাঞ্চল্যের আভাস দেখতে না পেয়ে একেবারে হতাশ হয়ে গেল রানা। বুঝল, সোফিয়ার কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না। মনে মনে একটু যেন স্বস্তিও বোধ করল সে। এই বিষাক্ত সাপের বিরুদ্ধে লাগতে যাওয়াটা সোফিয়ার মত সহজ সরল মেয়ের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হত; ভালই হয়েছে টের পায়নি মেয়েটা কিছুই, টের পেলে নিজের বিপদ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না সে।

গাড়িতে উঠেই রানাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে ওর হাতের তালুতে দুই আঙুল দিয়ে মৃদু টোকা দিল মিসেস গুপ্ত। কোন সাড়া পেল না রানা হাতের তালুতে। রানীর যাতে আরাম হয় সেজন্যে ভাল করে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল, একহাতে জড়িয়ে ধরল রানার কাঁধ। হুইল চেয়ারটা ভাঁজ করে গাড়ির বুটে তুলে দিল পোর্টার। ব্যাগ, সুটকেস উঠে যেতেই গাড়ি ছেড়ে দিল ড্রাইভার।

‘সোজা রেল স্টেশনে যাব, ম্যাডাম?’

‘হ্যাঁ, স্টেশনের দিকেই যাও, কিন্তু পথে জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে একটু রেখো গাড়িটা কয়েক মিনিটের জন্যে। একটা ট্রাংকল করব। পাঁচ সাত মিনিট লাগবে।

জি. পি.ও-র সামনে থেমে দাঁড়াল ট্যাক্সি। আরেকবার রানার হাতের তালুটা পরীক্ষা করে নেমে গেল মিসেস গুপ্ত। সামান্য একটু শিরশিরে অনুভূতি হলো রানার হাতে। মিসেস গুপ্ত টের পেল না, কিন্তু ভিতর ভিতর আশান্বিত হয়ে উঠল রানা। আর আধঘন্টা সময় পেলেই ফিরে আসবে ওর হৃতশক্তি। খোদার কাছে প্রার্থনা করল সে যেন ট্রাংক লাইন পেতে দেরি হয় শয়তান মেয়েলোকটার।

ট্যাক্সিওয়ালাকে সাবধান করল মিসেস গুপ্ত। ‘আমার স্বামী ভয়ানক অসুস্থ নার্ভাস ব্রেক ডাউন। যদি কোন কথা বলতে চায়, সাথে সাথে ডাকবে আমাকে। বুঝেছ?’

গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং সেইসাথে মোটা বকশিশের ভরসা পেয়ে বিনীত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বিগলিত ড্রাইভার। ড্রাইভিং সীটে পাশ ফিরে বসে হাঁ করে চেয়ে রইল রানার মুখের দিকে কোন কথা বলে কিনা দেখার জন্যে।

রানার প্রার্থনা বিফল করে দিয়ে ঠিক সাত মিনিটের মধ্যে ফিরে এল মিসেস গুপ্ত। ছুটল ট্যাক্সি রেল স্টেশনের দিকে। খুশি খুশি লাগছে মিসেস গুপ্তকে। গুন গুন করে গান ধরেছে।

স্টেশনে ওপেন টিকেটটা কনফার্ম করাতে মিনিট দশেক ব্যয় হয়ে গেল। দু’জন কুলির জিম্মায় রেখে গিয়েছিল রানাকে, ফিরে এসে ট্রেনে ওঠাবার ইঙ্গিত করল মিসেস গুপ্ত কুলিদের। ধরাধরি করে তোলা হলো রানাকে হুইল চেয়ারসহ ট্রেনের করিডরে। তারপর ঠেলে নিয়ে ঢোকানো হলো ছোট্ট একটা কম্পার্টমেন্টে। ব্রিটিশ আমলের পুরানো বগি বদলে আধুনিক হয়ে গেছে বাৰ্মা রেলওয়ে।

মাঝের সীটে, মাঝের সীটে।’ বলল মিসেস গুপ্ত। ‘জানালার ধারে বসতে অপছন্দ করেন উনি।’

তিনজন মিলে ধরে শুইয়ে দিল ওরা রানাকে মাঝের সীটে। একটা রাবারের বালিশ ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে রানার মাথার নিচে দিয়ে দিল মিসেস গুপ্ত। তৃতীয়বার পরীক্ষা করল রানার হাতের তালু। লাফ দিয়ে উঠল দুটো আঙুল রানার তালুতে মৃদু ঘষা দিতেই। ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল মিসেস গুপ্তের। তাড়া দিল কুলিদের, ‘যাও, তাড়াতাড়ি লাগেজগুলো নিয়ে এসো।

বেরিয়ে গেল কুলি দু’জন। সতর্ক দৃষ্টিতে রানার উপর নজর রাখল মিসেস গুপ্ত। একটু বিচলিত দেখাচ্ছে ওকে। ইতোমধ্যে হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত সাড়া ফিরে পেয়েছে রানা। দ্রুত দূর হয়ে যাচ্ছে অসাড়ত্ব।

ফিরে এল কুলি দু’জন মাল-সামান নিয়ে, কিছু বাঙ্কের উপর তুলে দিল, কিছু নামিয়ে রাখল পাশের খালি সীটের উপর। দশ টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দিল মিসেস গুপ্ত ওদের হাতে। খুশি হয়ে বেরিয়ে গেল ওরা হাঁটু পর্যন্ত মাথা নুইয়ে সালাম করে। দরজাটা বন্ধ করে করিডরের পাশে জানালার ফ্রস্টেড কাচগুলো নামিয়ে দিল মিসেস গুপ্ত। করিডর দিয়ে লোকজনের চলাফেরার সময় সামান্য একটু ছায়া দেখা যাচ্ছে কেবল। যাত্রীদের সবার চোখ থেকে সম্পূর্ণ আড়াল হয়ে গেল ছোট্ট কম্পার্টমেন্টটা। অপর পাশের জানালায় কনুইয়ের ভর দিয়ে প্ল্যাটফরমের দিকে চেয়ে রইল মিসেস গুপ্ত। প্ল্যাটফরমের ব্যস্ততা দেখছে। একজন লোককে জিজ্ঞেস করল, ট্রেন ছাড়বে কখন; এক্ষুণি ছাড়বে শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। প্রতি তিন সেকেন্ড অন্তর অন্তর ঘাড় ফিরিয়ে রানাকে দেখছে সে।

ডান হাতটা মুঠি করে পরীক্ষা করল রানা শক্তি ফিরে এসেছে কিনা। পুরো সাড়া ফিরে আসেনি এখনও, কিন্তু বেশ জোর পাচ্ছে সে হাতে। কাঁধ পর্যন্ত বোধ ফিরে এসেছে, কিন্তু কাঁধটা নড়ানো যাছে না। মনে হচ্ছে ওই অংশটা মরে গেছে।

জানালার কাচের দিকে চোখ রেখেছিল মিসেস গুপ্ত। রানার এই নড়াচড়া লক্ষ্য করল সে কাচের গায়ে। সরে এল জানালা থেকে। বাঙ্কের উপর থেকে কসমেটিক কেসটা নামাল। বলল, ‘ট্রেনটা ছাড়লে পরে ইঞ্জেকশন দেব ভেবেছিলাম, পাছে লোকজন এসে ডিসটার্ব না করে; কিন্তু দেখতে পাচ্ছি দেরি করলে বিপদে পড়ে যাব।

কসমেটিক কেসটা পাশের সীটের উপর রেখে তার মধ্যে থেকে একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স বের করল মিসেস গুপ্ত। ঘাড়ে এখনও শক্তি পাচ্ছে না রানা। এগিয়ে এল মিসেস গুপ্ত সিরিঞ্জ হাতে। ‘তোমাকে উপুড় করে নিতে হবে। অসুবিধে নেই, কাপড়ের ওপর দিয়েই ইঞ্জেক্ট করা যাবে। নড়াচড়া কোরো না, শুধু শুধু ব্যথা পাবে তাহলে। আরও একটু এগিয়ে এল সে।

লম্বা করে দম নিল রানা। তারপর বিদ্যুৎ বেগে ডান হাতে ধরে ফেলল মিসেস গুপ্তের বাম হাত। তাজ্জব হয়ে গেল মিসেস গুপ্ত। এতটা সে আশা করেনি। চোখে চোখে চেয়ে রইল দু’জন কয়েক সেকেন্ড। ‘বোকামি কোরো না, আব্বাস মির্জা।’ ঠাণ্ডা গলায় বলল মিসেস গুপ্ত। ‘এটা রিজার্ভ করা কম্পার্টমেন্ট। কেউ আসবে না। কারও সাহায্য পাবে না তুমি। হাত ছাড়ো।’

ততক্ষণে বাম হাতটা উঁচু করে ফেলেছে রানা। বিপদ টের পেয়ে প্রাণপণ শক্তিতে ঠেলা দিয়ে উপুড় করার চেষ্টা করল মিসেস গুপ্ত রানাকে, সেই সাথে এগিয়ে আসছে সিরিঞ্জটা। সর্ব শরীর এখনও অসাড় হয়ে আছে রানার। কিন্তু বাম হাতে ভর দিয়ে ঝট করে সরে গেল সে খানিকটা। একেবারে কাছে এসে গিয়েছিল সূচটা—রানা সরে যেতেই ঘ্যাঁচ করে ঢুকে গেল গদির ভিতর। এইবার কোমর পেঁচিয়ে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল রানা বাম হাতে। সীটে বেধে গেছে মিসেস গুপ্তের ঊরু, শরীরটা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে পিছন দিকে।

‘উহ্, ছাড়ো! ব্যথা লাগছে।’ ককিয়ে উঠল মিসেস গুপ্ত। ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে ওর মুখ

মনে মনে হাসল রানা। মনে মনেই বলল, ‘আরাম দেয়ার জন্যে এটা করছি না, সুন্দরী।’ আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে আরও জোরে টানল ওকে সামনের দিকে। ডান হাত সহ কোমর জড়িয়ে ধরেছে বলে কব্জিটুকু ছাড়া হাতটা নড়াতে পারছে না মিসেস গুপ্ত, তবু বার কয়েক চেষ্টা করল সে সূচটা রানার শরীরে ঢুকিয়ে দেবার

যখন বুঝল এ চেষ্টা বৃথা, তখন হাত থেকে সিরিঞ্জটা ফেলে দিয়ে শারীরিক বল দিয়েই রানার মোকাবিলা করবার জন্যে প্রস্তুত হলো সে।

রানা জানে কি অবিশ্বাস্য শক্তি আছে মিসেস গুপ্তের গায়ে। বাইরে থেকে দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না মেয়েমানুষের গায়ে এত জোর থাকতে পারে। অন্যের ক্ষেত্রে এই বিস্ময় এবং আকস্মিকতা প্রতিপক্ষকে হতচকিত করে দিয়ে পরাজিত করতে পারে হয়তো, কিন্তু রানা জানে এখন একটু ঢিল দিলেই সব আশা ভরসা শেষ হয়ে যাবে ওর। কাজেই মিসেস গুপ্তের ব্যথায় নীল হয়ে যাবার ছল বিন্দুমাত্র বিভ্রান্ত করতে পারল না ওকে। ‘ছাড়ো, উহ্! ব্যথা লাগছে। ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না তুমি। ছাড়ো, বোকামি কোরো না। মিছেমিছি…’ বলতে বলতে হঠাৎ প্রবল ভাবে টানা-হেঁচড়া শুরু করল মিসেস গুপ্ত। প্রস্তুত ছিল রানা। দাঁতে দাঁত চেপে আঁকড়ে ধরে রইল সে। বাম হাতে টানছে সামনে, ডান হাতে ঠেলছে পিছনে। ডান হাতটা কব্জি ছেড়ে উঠে এসেছে কাঁধের দুর্বল একটা নার্ভ সেন্টারে। ফিরে আসছে ওর শক্তি।

নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করতে পেরে ককিয়ে উঠল মিসেস গুপ্ত। চোখ দুটো উদ্‌ভ্রান্ত দেখাচ্ছে, ধস্তাধস্তি কমে গেছে। ফোঁপাচ্ছে এখন, চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে, ব্যথার চোটে দাঁত বেরিয়ে গেছে, গাল দুটো কাঁপছে থর থর করে। সামনে ঝুঁকে কামড় দেয়ার চেষ্টা করল রানার নাকে। মাথাটা সরিয়ে নিল রানা। সারী পিঠ এখনও অবশ হয়ে আছে, কিন্তু ঘাড়ে ফিরে এসেছে বোধশক্তি।

ঠিক এমনি সময়ে খুলে গেল করিডরের দরজা। একজন স্যুট পরা বর্মী ভদ্রলোক মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আসতে পারি? সীট আছে?’ কথাটা বলেই থমকে গেল সে দুই যাত্রীর অবস্থা দেখে।

‘এটা রিজার্ভড্ কম্পার্টমেন্ট,’ কোন মতে বলল মিসেস গুপ্ত। ‘আমার স্বামী অত্যন্ত অসুস্থ। দয়া করে গার্ডকে ডেকে দেবেন?’

লোকটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি করবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত করছে। চিৎকার করে উঠল মিসেস গুপ্ত, ‘গার্ড! গার্ডকে ডাকুন! জলদি!’

দরজা ভিড়িয়ে দিয়েই ছুটল লোকটা গার্ডের উদ্দেশে। রানা বুঝল সময় ফুরিয়ে আসছে। জিভ নড়াতে পারছে না, কাজেই কোন কথাই বোঝাতে পারবে না সে কাউকে। আবার একটা ইঞ্জেকশন পড়লেই একেবারে অসহায় হয়ে যাবে সে আবার। কিন্তু ইতোমধ্যে কি করা যায় বুঝতে পারছে না সে। আর পাঁচটা মিনিট এইভাবে ধরে রাখতে পারলে সারা শরীরে সাড়া ফিরে আসত ওর, তখন ধীরে সুস্থে একটা ব্যবস্থা করলেই চলত—এখন শুধু ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই ওর। সাহায্যের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে হুড়োহুড়ি শুরু করল মিসেস গুপ্ত। এঁকে বেঁকে রানার হাত থেকে ছুটবার চেষ্টা করছে সে। ডান পা-টা সীটের উপর তোলার চেষ্টা করছে। সেদিকে সুবিধে করতে না পেরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে মেঝেতে।

দরজা খুলে গার্ড ঢুকল। ‘কি হয়েছে?’ বলেই ব্যাপার বুঝতে পেরে একলাফে এগিয়ে এসে রানার দুই কাঁধ চেপে ধরল লোকটা।

‘ওকে ব্যথা দেবেন না।’ চিৎকার করে উঠল মিসেস গুপ্ত।

‘কিন্তু, ম্যাডাম… লোকটা…’

‘ও আমার স্বামী। অসুস্থ। নার্ভাস ব্রেকডাউন। দয়া করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে একটু সাহায্য করুন আমাকে।’

‘যান, যান, সবাই যান এখান থেকে। এটা প্রাইভেট কম্পার্টমেন্ট—যান সবাই, তামাশার কিছু নেই।’ দু’তিন জন অতি উৎসাহী দর্শককে ঠেলে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল গার্ড। এগিয়ে এল রানার দিকে।

সারাটা পিঠ অবশ হয়ে রয়েছে। রানা বুঝল, হেরে গেছে সে। কথা বলবার চেষ্টা করল, কিন্তু আড়ষ্ট জিভ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না। আপনা আপনি ঢিল হয়ে গেল ওর দুই হাত। এক ঝটকায় সরে গেল মিসেস গুপ্ত। আবার কথা বলবার চেষ্টা করল রানা, কোলা ব্যাঙের মত কর্কশ আওয়াজ বেরোল শুধু।

‘ডাক্তার ডাকা দরকার,’ বলল গার্ড।

‘না, না। ডাক্তারের কোন দরকার নেই,’ বলল মিসেস গুপ্ত। কাঁধটা ডলছে সে ডান হাত দিয়ে। মুছে ফেলেছে চোখের পানি। ‘একটা ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেক্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে এক্ষুণি। একটু ধরুন ওকে।’ সিরিঞ্জটা তুলে নিল সে মেঝে থেকে।

অনেক চেষ্টা করেও একটি কথাও বলতে পারল না রানা। দু’জনে মিলে ধরে উপুড় করে ফেলল ওকে, দুই হাত চেপে ধরল গার্ড, ঘ্যাঁচ করে ঢুকে গেল সূচটা মেরুদণ্ডের ভিতর। সিরিঞ্জটা বাক্সের ভিতর ভরে সেটা রেখে দিল মিসেস গুপ্ত কসমেটিক কেসে। তারপর মধুর করে হাসল গার্ডের দিকে ফিরে। ‘কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে যাবে ওষুধের।‘

‘এই পাগলের সাথে একা এক কামরায় থাকা তো আপনার জন্যে নিরাপদ নয়, ম্যাডাম।’

‘আপনি আমার স্বামীর সম্পর্কে কথা বলছেন।’ একটু উষ্মা প্রকাশ পেল মিসেস গুপ্তের কথায়। পরমুহূর্তে নরম হয়ে গেল আবার। উনি আসলে পাগল নন, সাময়িক স্নায়বিক উত্তেজনা ছাড়া কিছুই নয়।

‘কিন্তু ম্যাডাম, যা দেখলাম তাতে আমার মনে হয়, বেকায়দায় পড়ে গেলে মারাও যেতে পারেন…’

‘না, না। গত দুই বছর ওর সাথে আছি আমি, সেবা শুশ্রূষা করছি, ওর সবকিছু আমার মুখস্থ। কোন অসুবিধে হবে না আর। আপনার সাহায্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, দরকার হলে আবার ডাকব আপনাকে।’ পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে গার্ডের হাতে দিল মিসেস গুপ্ত। বলল, ‘এটা আপনার। ঠিক সময় মত এসে উপস্থিত হয়েছিলেন আপনি।

দুই তিন সেকেন্ড বুঝতে পারল না গার্ড যে টাকাটা ওকে নিতে বলা হচ্ছে, যখন বুঝল তখন ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিল সে নোটটা। ভাঁজ করে নোটটা পকেটে রেখে আকর্ণ হাসল। ‘থ্যাংকিউ, ম্যাডাম। টাকা দেয়ার কি দরকার ছিল। যখন দরকার হবে ডাকবেন, ছুটে চলে আসব।’ রানার দিকে ফিরল। ‘কেমন বোধ করছেন এখন?’

‘দেখুন না, এখুনি কেমন ঘুম ঘুম ভাব এসে গেছে চোখে।’ জবাব দিল মিসেস গুপ্ত। ‘আশাকরি আর কোন অসুবিধা হবে না। ঘুমিয়ে পড়লেই সব ঠিক হবে যাবে। আপনি দেখবেন কেউ যেন আমাদের ডিস্টার্ব না করে। কেমন?’

সম্মতি জানিয়ে এবং টাকা দেয়ার জন্যে আরও একবার ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল গার্ড। প্রায় সাথে সাথেই চলতে শুরু করল ট্রেনটা। এবার দরজায় বল্টু লাগিয়ে দিল মিসেস গুপ্ত। বাম কাঁধটা ডলতে ডলতে এসে বসল সামনের সীটে। সিগারেট ধরাল একটা। রানাকে আগুনের দিকে চাইতে দেখে বলল, ‘না। আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে তোমাকে বশ্যতা স্বীকার করানো যাবে না, বুঝে নিয়েছি আমি। আশ্চর্য!

অদ্ভুত মানসিক শক্তি আছে তোমার মধ্যে, আব্বাস মির্জা। এত দ্রুত এই ওষুধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে দেখিনি আমি আর কাউকে। তাছাড়া অসম্ভব শক্তি তোমার গায়ে। এত ভয়ঙ্কর লোকও দেখিনি আমি এর আগে ‘ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘স্বাধীনতার আগে নিশ্চয়ই তুমি পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে ছিলে? ওদের সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনেছি আমি সরোজের মুখে। ওদের মধ্যে একজনকে সরোজ দারুণ শ্রদ্ধা করত, মনে মনে তার মত হবার স্বপ্ন দেখত। উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ছাড়তে শুরু করল মিসেস গুপ্ত। চক চক করছে চোখ দুটো। রানা দেখল, ঘাড়ের ওপর যেখানটা ও চেপে ধরেছিল, ফর্সা চামড়ার ওপর কালচে দাগ পড়ে গেছে সেখানে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠছিল সে, কিন্তু মিসেস গুপ্তকে ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার সব খুলতে দেখে ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বিষিয়ে গেল মনটা। কথা বলতে বলতে কাপড় ছাড়ছে মিসেস গুপ্ত। ‘তোমাকে দেখে আমার কেবল সেই লোকটার কথা মনে পড়ছে। যদিও জানি, সে হলে কিছুতেই এরকম বোকার মত পা দিত না আমার ফাঁদে, এস্পায়োনেজের জগতে সে একটা জিনিয়াস বলে পরিচিত, তোমার মত নয়—তবু কেন যেন ওর কথাই মনে আসছে আমার বার বার। কাপড় ছেড়ে হাঁটু গেড়ে বসল সে রানার পাশে। দ্রুত হাতে জামা কাপড় খুলছে রানার। মুখের কাছে মুখ এনে লিপস্টিকে লাল ঠোঁট দুটো ঘষল রানার ঠোটে, ছোট্ট করে কামড় দিল রানার গালে। মধুর হাসি হেসে বলল, ‘বারো ঘণ্টার জার্নি, স্টেশন মাত্র আটটা—কেউ ডিস্টার্ব করবে না। যাই হোক, সরোজের সেই দুর্ধর্ষ স্পাইয়ের নামটা কি জানো? মাসুদ রানা।’ বুকের ওপর উঠে এল মিসেস গুপ্ত। ‘সত্যি করে বলো তো, তুমিই কি সেই লোক?’

দুই চোখে গোক্ষুরের বিষ নিয়ে চেয়ে রইল রানা মিসেস গুপ্তের চোখের দিকে।

উত্তর দিতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *