রক্তের রঙ ১.৬

ছয়

দমাদম পেটাল কিছুক্ষণ ওরা ইয়টের গায়ে। কোন সাড়া নেই রানার। দুই মিনিট পর ধৈর্য হারিয়ে উঠে এল উপরে। কেবিনের দরজায় টোকা দিল জোরে জোরে।

এক মিনিট পর দরজা খুলল রানা। সারা গায়ে সাবান মাখা, স্নান করছিল। তোয়ালে জড়ানো কোমরে। ইয়েন ফ্যাঙের উপর দৃষ্টি পড়তেই বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার? কেউ গেল না যে? শুধু শুধুই অপেক্ষা করলাম শ্য ড্যাগন প্যাগোডায়। বিপদে পড়েছিলাম…’ হঠাৎ অন্যান্যদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল রানা, থেমে গেল কথার মাঝখানেই। সপ্রতিভ গলায় বলল, ‘বসুন আপনারা। কেবিনে তো জায়গা হবে না, ব্রিজ থেকে কয়েকটা চেয়ার নিয়ে ডেকেই বসুন।’

একটু যেন থমকে গেল ইয়েন ফ্যাঙ রানার পরম নিশ্চিন্ত ভাব দেখে। কিন্তু সে শুধু তিন সেকেন্ডের জন্যে। রানাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল সে কেবিনে। পিছন পিছন ঢুকল আরও চারজন। সবশেষে ঢুকল মোটা লোকটা। প্রত্যেকেই সশস্ত্র, শুধু একজন ছাড়া।

মোটাকে দেখেই হাঁ হয়ে গেল রানার মুখ। যেন ভয়ানক অবাক হয়েছে। ‘আরে! এই লোক তোমাদের সঙ্গে কেন? এই লোকই তো অনুসরণ…’

আর অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া গেল না। এক ধমকে ঠাণ্ডা করে দিল ওকে ইয়েন ফ্যাঙ।

‘চোপরাও! হারামীর বাচ্চা কোথাকার!’ কটমট করে চাইল সে রানার চোখে। ‘ন্যাকামি হচ্ছে?’ প্রচণ্ড এক চড় তুলে দু’পা এগিয়ে এল সে, কিন্তু আঘাত করার ঠিক পূর্বমুহূর্তে তীক্ষ্ণকণ্ঠে আদেশ এল নিরস্ত্র লোকটার কাছ থেকে।

‘কাট ইট। মেরো না, ইয়েন। ওর বক্তব্য শুনতে হবে আগে।’ পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করল।

লোকটা ছোটখাট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম পোশাক পরিচ্ছদ, চোখে পুরু লেন্সের রোল-গোল্ডের ফ্রেমের চশমা। ইউনিভার্সিটির প্রফেসারের মত সম্ভ্রান্ত, বিদ্বান একটা ভাব রয়েছে চেহারায়। এই গুণ্ডাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু এর আদেশের কতটা দাম টের পেল রানা মুহূর্তের মধ্যে ইয়েন ফ্যাঙের সংযত হয়ে যাওয়া দেখে। এই লোকটাই কি উ-সেন? ভাবল রানা।

‘ঠিক আছে, আপাতত গায়ে হাত দেব না। কিন্তু ওর কথা শুনে কি হবে? ও তো একটা সত্যি কথাও বলবে না, ডক্টর হুয়াং!’

মৃদু হাসল ডক্টর হুয়াং। সিগারেটের চেয়েও সরু পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটা চুরুট বের করল সে সোনালি সিগারেট কেস থেকে। ঠোঁটে লাগিয়ে বলল, ‘তোমাদের একজন দেখে এসো বাথরূমে কোন অস্ত্র আছে কিনা। প্রত্যেকটা জিনিস পরীক্ষা করবে, কমোডের সিস্টার্নও দেখবে।’ একজন চলে গেল বাথরূমে। রানার দিকে ফিরল ডক্টর হুয়াং। ‘আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আছে এদের। সার্চ করা হয়ে গেলেই স্নান সেরে আসুন। আমরা বসছি।’

কিছু পাওয়া গেল না বাথরূমে। বিনা বাক্যব্যয়ে বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে যতক্ষণ খুশি গোসল করল রানা। তারপর গা মুছে কাপড় পরে বেরিয়ে এল।

কেবিনের একমাত্র চেয়ারটা দখল করেছে ডক্টর হুয়াং, ইয়েন ফ্যাঙ বসেছে খাটের কিনারে, বাকি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ডেস্কের উপর বসল রানা সবার চেয়ে উঁচুতে।

‘বলুন, আপনাদের কি অভিযোগ?’ ভদ্রভাবে বলল রানা। ভুরু কুঁচকে চাইল একবার ইয়েন ফ্যাঙের দিকে, তারপর মুচকি হাসল মোটাকে দেখে।

‘আজ সন্ধে থেকে আপনার চাল-চলন অত্যন্ত রহস্যময় ঠেকছে ইয়েন ফ্যাঙের কাছে। ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিশেষ জরুরী মীটিং থেকে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছি আমি। আমি আশা করব আপনার এই দুর্বোধ্য গতিবিধির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে আপনি আমাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারবেন।’ ইয়েন ফ্যাঙের দিকে ফিরল ডক্টর হুয়াং। ‘মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রশ্ন করো, ইয়েন।

রানার দিকে ফিরল ইয়েন ফ্যাঙ। দুই চোখে গোক্ষুরের বিষ।

‘কোথায় গিয়েছিলে?’

‘শ্য ড্যাগন প্যাগোডায়।’ গম্ভীরভাবে উত্তর দিল রানা।

‘কেন?’

‘তোমার নির্দেশ অনুযায়ীই গিয়েছিলাম। ঠিক আটটা থেকে আটটা দশ পর্যন্ত অপেক্ষা…’

‘আমার নির্দেশ কি ছিল? আজকে যাবার কথা ছিল, না আগামীকাল?’

‘গতকাল তুমি বলেছিলে ‘টুমরো’, জাস্ট অ্যাট এইট পি-এম…’

‘আমি বলেছিলাম ‘ডে আফটার টুমরো’। বার বার করে বলেছিলাম…’

‘মিথ্যে কথা। হয় মিথ্যে বলছ, নয় ভুলে গেছ। অবশ্য বেহেড মাতাল ছিলে…’

‘খবরদার, আব্বাস মির্জা!’ একলাফে উঠে দাঁড়াল ইয়েন ফ্যাঙ। ‘মুখ সামলে কথা বলো, নইলে…’

এক হাত তুলে ওকে শান্ত হবার ইঙ্গিত দিল ডক্টর হুয়াং। বলল, ‘বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তোমাদের মধ্যে। মিস্টার আব্বাস মির্জা,’ রানার দিকে ফিরল সে, ‘আপনি বলছেন ইয়েন গতকাল মাতাল ছিল। কথাটা কতখানি সত্য?’

‘হানড্রেড পার্সেন্ট।’ আঙুল তুলে একজনের দিকে দেখাল রানা। ‘ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না, ও তো ছিল কাল।’

নির্দিষ্ট ব্যক্তির দিকে ফিরল ডক্টর হুয়াং, প্রশ্নের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ভুরু নাচিয়ে। লোকটা ভয়ে ভয়ে চাইল একবার ইয়েন ফ্যাঙের দিকে, কাচুমাচু ভঙ্গিতে অস্বস্তি ভোগ করল কয়েক সেকেন্ড, তারপর সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল। এতক্ষণে ডক্টরের চোখে একটু রাগের আভাস দেখতে পেল রানা। সরাসরি চাইল ইয়েন ফ্যাঙের চোখের দিকে।

‘আবার তুমি আইন ভঙ্গ করেছ, ইয়েন। এবার উ-সেনের কানে তুলতে হবে কথাটা।’

আর একটা চান্স দিন, ডক্টর, আর কোনদিন কাজের সময় ও জিনিস ছোঁব না। ওই হারামজাদা খাচ্ছিল মনের সুখে, আমি লোভ সামলাতে পারিনি, কয়েক ঢোক খেয়েছি ওর বোতল থেকে।’

রানার দিকে ফিরল ডক্টর হুয়াং। ‘কয়েক ঢোক মদ খেলে কেউ বেহেড মাতাল হয়ে যায়. না। তাছাড়া আপনি নিজেও মাতাল ছিলেন গতকাল। কাজেই ভুলটা ইয়েন করেছে না আপনি করেছেন বুঝবার উপায় নেই। আপনার পক্ষে ইচ্ছে করেই ভুল করবার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। অন্তত ওর তাই ধারণা। বহুদিনের অভিজ্ঞ, যোগ্য এবং বিশ্বস্ত লোক ও আমাদের। এসব ব্যাপারে সাধারণত ভুল হয় না ওর। তবু এ ব্যাপারটায় আপনি বেনিফিট অভ ডাউট পেতে পারেন। ধরে নিলাম, ইয়েন আপনাকে আগামীকালকের কথা বলেছিল, মাতাল অবস্থায় আপনি সেটা আজকের কথা মনে করে চলে গিয়েছিলেন ণ্ড ড্যাগন প্যাগোডায়। কিন্তু আরও কয়েকটা বিষয়ে আমাদের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দরকার। নিন, আমি প্রশ্ন করছি, উত্তর দিন।

এতক্ষণ পর সরু চুরুটটা ধরাল ডক্টর হুয়াং। নড়েচড়ে বসল রানা। সিগারেট ধরাল একটা। বুঝতে পেরেছে সে, এই লোক সহজ পাত্র নয়। প্রথম এবং প্রধান ফাঁড়াটা কেটে গেছে, কিন্তু ছোটখাট অনেকগুলো ব্যাপার আছে, এখন থেকে সাবধান না হলে ফেঁসে যাবে ও। মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হলো সে প্রশ্নবাণের জন্যে।

‘মেয়েমানুষের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন কেন?’

‘সেটা আপনারা জানলেন কি করে?’ অবাক হয়ে যাওয়ার ভান করল রানা।

‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিন!’ হুয়াং গম্ভীর।

‘শত্রপক্ষকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে।’

‘কারা শত্রুপক্ষ?’

‘জানি না। সম্ভাব্য শত্রুর কথা বলছি।’

‘সাবধানতা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন?’

‘ঠিক তাই।’

‘তারপর কি হলো?’

‘ট্যাক্সিতে উঠেই টের পেলাম, অনুসরণ করা হচ্ছে আমাকে। বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। পিছু পিছু ণ্ড্য ড্যাগন প্যাগোডা পর্যন্ত এল ট্যাক্সিটা, একটা মোটাসোটা লোককে নামতে দেখলাম। আমার একটু সন্দেহ ছিল, লোকটা আপনাদের দলেরও হতে পারে: হয়তো ওখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যেই পাঠানো হয়েছে ওকে।’ সিগারেটে লম্বা করে টান দিল রানা। ‘পনেরো মিনিট আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি ওখানে। ঘোরাঘুরি করে সময় কাটালাম। ঠিক আটটার সময় দাঁড়িয়ে পড়লাম একটা অন্ধকারমত জায়গার কাছাকাছি পরিষ্কার আলোয়। অপেক্ষা করছি, কেউ আসে না। ওদিকে আড়চোখে লক্ষ করলাম, অন্ধকার ছায়ায় ছায়ায় পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে অনুসরণকারী। শত্রু না মিত্র বুঝতে পারিনি আমি তখনও। একটা অ্যাংলো মেয়ে আসছিল এদিকে, ভাবলাম আপনাদের দলের হতে পারে, কিন্তু পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এমন সময় পিছনের লোকটা ডাকল আমাকে-এই যে, মিস্টার…। ঝট করে ঘুরেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি ওর ওপর।’ মোটা লোকটার দিকে ফিরল রানা, ‘সেজন্যে আমি দুঃখিত…’

‘থাক,’ বাধা দিল ডক্টর হুয়াং, ‘দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে। এখন বলুন, লোকটা আমাদের দলের লোকও হতে পারে এই সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও মারলেন কেন ওকে?’

‘সন্দেহ ছিল না আর। শত্রু জেনেই মেরেছি ওকে।’

‘কিভাবে জানলেন?’

‘পাস ওয়ার্ড ছিল ‘ট্যুরি’, কিন্তু লোকটা শুরু করেছিল ‘এই যে মিস্টার’ বলে।

মাথা ঝাঁকাল ডক্টর হুয়াং, চুরুটে টান দিল, ধোঁয়া ছাড়ল একগাল, তারপর ধোঁয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘একজন সাধারণ সৈনিকের তুলনায় আপনার রিঅ্যাকশন অত্যন্ত দ্রুত। এতই দ্রুত যে রীতিমত অস্বাভাবিক ঠেকছে আমার কাছে। যাই হোক, আপনার পরবর্তী কাহিনী শোনা যাবে, তার আগে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ খানিকটা শুনে নেয়া যাক।’ মোটার দিকে ফিরল হুয়াং। বার্মিজ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ‘এই লোকটা কি পনেরো মিনিট আগে পৌঁছেছিল? ঠিক আটটার সময় দাঁড়িয়ে পড়েছিল? অপেক্ষা করার ভাব দেখা গিয়েছিল ওর মধ্যে? ‘এই যে মিস্টার’ বলেছিলে? অ্যাংলো মেয়ে আসছিল? চেনো মেয়েটাকে?’

প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল লোকটা, শেষেরটা ছাড়া। চিন্তিতভাবে মাথা ঝাঁকাল ডক্টর হুয়াং। ঝট করে চাইল রানার দিকে।

‘এরপর নানকিং হোটেলে গিয়েছিলেন আপনি?’

‘হ্যাঁ।’ নির্দ্বিধায় জবাব দিল রানা। একটু অবাক হওয়ার ভান করল এরা সব জানে দেখে।

‘কেন?’

‘প্রথমত, প্যাগোডা থেকে পালিয়ে লোকজনের ভিড়ে মিশে যেতে, দ্বিতীয়ত, ডিনারটা সেরে নিতে, তৃতীয়ত, ইয়টে ফিরবার আগে আর কেউ অনুসরণ করছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে।

‘কেউ অনুসরণ করেছিল?’

‘না। ডিনার সেরেই ফিরে এসেছি আমি ইয়টে।‘

‘পথে কাউকে ছুরি মারেননি কিংবা মারতে দেখেননি?’

‘না তো! ইয়টে ফিরে দেখলাম যার বোট নিয়ে…’

‘সেই মেয়েটাকে গুলি করে মারা হয়েছে। ওর দুর্ভাগ্য, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে ও। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, তার আগে ভাল করে স্মরণ করবার চেষ্টা করুন, বটগাছ তলায় কোনরকম ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেয়েছিলেন কিনা?’

সত্যিই কোন আওয়াজ পায়নি রানা। বলল, ‘না। কোন আওয়াজ পাইনি। কেন, ওখানে আবার কোন দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটেছে নাকি?’

‘ঘটেছে। কিন্তু সে ব্যাপারে আপনাকে দায়ী করছি না, যদিও পরোক্ষভাবে এতে আপনার হাত থাকা অসম্ভব নয়। নানকিং হোটেল থেকে আপনাকে অনুসরণ করে এসেছিল লোকটা বটগাছের নিচ পর্যন্ত। আমাদেরই লোক। খানিক আগে পাওয়া গেছে ওর লাশ। পিঠে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে ওকে।’

বিম্মিত মুখভঙ্গি করল রানা, তারপর সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে প্রত্যক্ষ সন্দেহের আওতা থেকে মুক্ত রাখছেন কি কারণে?’

‘কারণ, লোকটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার একহাত পিছনে একজোড়া হাইহিল জুতোর দাগ পাওয়া গেছে। সেই দাগ অনুসরণ করে কিছুদূরে জুতোজোড়া, একটা ব্লাউজ স্কার্ট আর একটা হ্যান্ডব্যাগ পাওয়া গেছে। সেখানে গোপন পাহারা বসিয়ে দিয়েছি, কিন্তু আমার ধারণা, ফিরে আসবে না মেয়েটা। খুব সম্ভব পায়ের চিহ্ন গোপন করবার জন্যে জলে নেমে সাঁতরে চলে গেছে সে তার গন্তব্যস্থানে। ‘

রানার ধারণা অন্যরকম। ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সে সোফিয়ার জন্যে, কিন্তু মুখের ভাবে প্রকাশ পেল না কিছুই। হঠাৎ বিচলিত হয়ে ওঠার ভাব দেখাল রানা। বলল, ‘হ্যান্ডব্যাগটা কি গুঁই সাপের চামড়ার?’

চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ডক্টর হুয়াং-এর। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে। বলল, ‘আপনি জানলেন কি করে?’

‘তাহলে নিশ্চয়ই সেই অ্যাংলো মেয়েটার কাজ। ওর হাতে গুঁই সাপের চামড়ার ব্যাগ ছিল।’

‘হ্যাঁ, আমিও দেখেছি,’ বলল মোটা লোকটা।

ভুরু কুঁচকে ভাবল হুয়াং কিছুক্ষণ, তারপর বলল, ‘মেয়েটাকে চেনেন?’

‘আবার দেখলে চিনতে পারব।’

‘পরিচয় জানেন না?’

‘না।।’

‘তাহলে এটুকু জেনে বিশেষ লাভ হলো না। চেহারার বর্ণনা পাওয়া যাবে, এই যা লাভ। যাই হোক, আমরা আমাদের আগের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে পারি। ইয়টে ফিরে এসে দেখলেন খুন হয়ে গেছে মেয়েটা। তারপর কি ভাবলেন এবং কি করলেন?

‘এই নিরীহ মেয়েটার মৃত্যুর কোন কারণই ভেবে বের করতে পারিনি। কারা কাজটা করল, কেন করল, কিছুই বুঝতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে আপনারা করেছেন, নিশ্চয়ই ওই গর্দভ ইয়েন ফ্যাঙের কাজ। আমাকে অনুসরণ করবার কোন দরকার ছিল না, এত কাণ্ডের কিছুই প্রয়োজন ছিল না-শুধু পিছু ডেকে বলে দিলেই হত, আজকে নয়, দেখা করবার কথা আগামীকাল। এটুকু জানতে পারলেই ফিরে আসতাম আমি। তা না করে বেশি চালাকি করতে গিয়েছিল, ফলে মিছিমিছিই প্রাণ গেল দুজন মানুষের। এখন বুঝতে পারছি, এই মেয়েটাকে টরচার করা হয়েছিল আমার সম্পর্কে তথ্য আদায় করার জন্যে। কিছুই বলতে পারেনি মেয়েটা, জানলে তো বলতে পারবে, কিন্তু বিশ্বাস করেনি ওই চামার, যাবার সময় গুলি করে মেরে রেখে গেছে।’ ক্রুদ্ধ চোখে চাইল রানা ইয়েন ফ্যাঙের দিকে।

খলখল করে হাসল কিছুক্ষণ ডক্টর হুয়াং। ‘বুঝতে পারছি, আপনারা দুজন কেউ কাউকে পছন্দ করতে পারছেন না। আপনার কপাল খারাপ বলতে হবে। ওর সাথে সদ্ভাব না থাকলে যে কোন মানুষকে নানানভাবে অসুবিধায় পড়তে হয়। যাই হোক, আমার মতে সামান্য একটা দেহপসারিণীর জন্যে এতখানি বিচলিত হয়ে পড়াটা আপনার পক্ষে ঠিক শোভা পাচ্ছে না। শুনেছি, একটা পাখির জন্যেও নাকি কেঁদে উঠেছিল আপনার প্রাণ! এই যদি অবস্থা হয়, দেশ উদ্ধার করবেন কি করে?’

‘যে সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় মানুষ হত্যা করে, ঘরে ফিরে এসে সে-ই বুকে জড়িয়ে ধরে তার ছোট্ট তিন বছরের শিশুকে! দুর্বলের প্রতি মমতা দিয়ে বিচার করবেন না, শক্তিশালীর বিরুদ্ধে কতটা কঠোর হতে পারি, তাই দিয়ে বিচার হবে আমার। ‘

শ্রাগ করল ডক্টর হুয়াং। ‘সবাই ফিলসফার। যাই হোক, আমাদের আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। এখন আপনি কি ভাবছেন সেটা আমার প্রশ্ন ছিল না, আমি জানতে চেয়েছিলাম ইয়টে ফিরে যা দেখলেন তাতে কি চিন্তা এল আপনার মনে, কি ভাবলেন, কি করলেন?’

রানা বুঝল, রামঘুঘু! বলল, ‘স্বভাবতই ভয় পেলাম আমি। কারা করল কাজটা বুঝতে না পেরে প্রথমে ডিঙিটা ভাসিয়ে দিলাম স্রোতে, মৃতদেহটা আস্তে করে ছেড়ে দিলাম পানিতে। বিছানার চাদর থেকে ধুয়ে ফেললাম রক্তের দাগ। তারপর স্নান করে প্রস্তুত হচ্ছিলাম সারা রাত্রি জাগরণের জন্যে। সতর্ক থাকা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কেন কি ঘটছে কিছুই পরিষ্কার হয়নি আমার কাছে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। কারা অনুসরণ করছে আমাকে, উ-সেনের দলই বা কেন চুপচাপ, কারা খুন করল মেয়েটাকে আমারই ইয়টে এসে আমারই কেবিনের ভেতর-সবকিছু ঘোলাটে ছিল আমার কাছে, ভেবে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না।’

থামল রানা। দম ধরে বসে রইল হুয়াং মিনিট দুয়েক। রানা বুঝল অত্যন্ত দ্রুত চিন্তা চলেছে বুদ্ধিমান লোকটার মাথায়। সমস্ত তথ্য সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে নিখুঁত অঙ্কের হিসেব বের করছে হুয়াং। রানা পাস করল না ফেল করল জানা যাবে একটু পরেই। যেন কিছুতেই কিছু এসে যায় না, এমনি ভাব করে সিগারেট ধরাল সে আর একটা।

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে দাঁড়াল ডক্টর হুয়াং। ফিরল ইয়েন ফ্যাঙের দিকে। বলল, ‘এই লোকটা সন্দেহজনক। যদিও আজকের একটি ঘটনাও ওর বিরুদ্ধে নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, তবু কয়েকটা ব্যাপার অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে-এক: কেন স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশ? দুই: পিছনে লোক লেগেছে টের পাওয়ার পরও পালিয়ে গেল না কেন? তিন: নানকিং হোটেলে গেল কেন, লুকোবার এত জায়গা থাকতে? চার: এত হুঁশিয়ার লোক টের পেল না কেন যে নানকিং হোটেল থেকে লোক লেগেছে পিছনে? পাঁচ: ইয়টে ফিরে লাশ দেখেই পালিয়ে গেল না কেন? – কাজেই সাবধান থাকতে হবে আমাদের। এই লোক হয় প্রত্যেকটা কথা সত্যি বলছে, নয়তো প্রত্যেকটা কথাই এর মিথ্যা। হি মে বি ভেরি ডেঞ্জারাস ফর আস্। এর ব্যাপারে কোন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। আগামীকাল সন্ধে পর্যন্ত দুজন লোককে থাকতে হবে এখানে গার্ড হিসেবে। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করা চলবে না।’

একটানা এতগুলো কথা বলার পর রানার দিকে ফিরল হুয়াং। ‘আগামীকাল সন্ধে পর্যন্ত নজরবন্দী থাকতে হবে আপনাকে। শ্য ড্যাগনে আর যাবার দরকার নেই। ঠিক আটটার সময় উপস্থিত থাকবেন নানকিং হোটেলের লাউঞ্জে। ওখান থেকে আপনাকে চিনে নেবে আমাদের লোক। নতুন পাস ওয়ার্ড—ওয়েটিং। হোটেলের দরজা পর্যন্ত আপনার পিছু পিছু যাবে ইয়টের দুজন প্রহরী, আগে থেকেই জানিয়ে রাখছি, দুর্ঘটনা বা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ যেন না থাকে।’

রানার চোখের দিকে চেয়ে সামান্য একটা নড করে বেরিয়ে গেল ডক্টর হুয়াং।

রানার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল ইয়েন ফ্যাঙ।

রানা বুঝল ঘুমাতে পারবে আজ রাতে।

কিন্তু সোফিয়া? ধরা পড়ে গেল মেয়েটা? খবরটা জানা যায় কিভাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *