রক্তের রঙ ১.৪

চার

সোফিয়া মেয়েটার সাথে দুর্ব্যবহার করে মনটা খচ খচ করছে রানার। কথাটা শুনেই যেরকম কুঁকড়ে গেল, ফ্যাকাসে হয়ে গেল, সেটা অভিনয় হতেই পারে না। মেয়েটা কল-গার্ল নয়, এটুকু লিখে দিতে পারে রানা। কিন্তু তাহলে কি? বার্মার মেয়েরা বহুকাল থেকেই পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করে আসছে, জানে রানা। এ মেয়েটার গায়ে পড়া ভাবটা কি অতিমাত্রায় স্ত্রী-স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ?

দুত্তোর বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রানা মেয়েটার চিন্তা, কিন্তু বার বার ঘুরে ফিরে আসছে চিন্তাটা। কি যেন বলতে চেয়েছিল মেয়েটা। কি সেটা? রানার বর্তমান কাজের সাথে জড়িত কিছু? বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে প্রণামরত মোটা লোকটার দিকে যেভাবে চেয়েছিল, তাতে রানার মনে হয়েছিল জানে মেয়েটা—পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে মারামারির দৃশ্যটা। কিন্তু তাহলে চিৎকার বা হৈ-চৈ না করে রানাকে নিরালা কোথাও নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে কেন? উ-সেনের দলের মেয়ে? আর একটু খোঁজ-খবর নেয়া উচিত ছিল মেয়েটা সম্পর্কে!

নানকিং হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থামতেই গাড়ির দরজা খুলে ধরল উর্দি পরা দারোয়ান। ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে ঢুকে পড়ল রানা হোটেল লাউঞ্জে। একটা কাচের দরজার ওপাশে দেখা যাচ্ছে হোটেলের পিছনের উজ্জ্বল আলোকিত মনোরম বাগান। বিভিন্ন ধরনের দেশী-বিদেশী ফুলের বেড়, লাল- নীল-সবুজ বাতি দিয়ে সাজানো। মাঝে মাঝে কাঁধ সমান ঝাউ গাছ। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে সুন্দর, সুরুচিপূর্ণভাবে সাজানো রয়েছে টেবিল চেয়ার। বেশ ভিড়। অত্যুজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সুইমিং পুলের কাছাকাছি কমবয়েসী বোম্বেটে ছেলেপিলেদের ভিড়।

ফটো ইলেকট্রিক সেলে পরিচালিত প্রকাণ্ড কাচের দরজা খুলে গেল রানা এগোতেই। চমৎকার দখিনা হাওয়া। স্যুইমিং পূলে জনাকয়েক উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরী, জনাদুয়েক বয়স্ক পুরুষ ডাইভ দিচ্ছে, সাঁতার কাটছে। যতটা সম্ভব নির্জন জায়গায় বসে পড়ল রানা একটা খালি টেবিলে। বেয়ারা এসে দাঁড়াতেই অর্ডার দিল একটা ডাবল হুইস্কির। সালাম জানিয়ে চলে গেল বেয়ারা। চারদিকে চাইল রানা। একটা পরিচিত মুখও চোখে পড়ল না।

দ্বিতীয় দফা হুইস্কি এল, কিন্তু মিস্টার বা মিসেস সরোজ গুপ্ত এল না। অপেক্ষা করছে রানা। কিছুক্ষণ আগে একটা ইনভ্যালিড চেয়ার ঠেলে এক মহিলাকে এদিকে আসতে দেখে একটু আশান্বিত হয়েছিল, কিন্তু কাছে আসতে দেখা গেল ইনভ্যালিড চেয়ারে শুয়ে আছে এক দাড়িঅলা বুড়ো, চেয়ারটা ঠেলছে অপূর্ব সুন্দরী এক থাই রমণী। চলে গেল পাশ কাটিয়ে। প্রায় পৌনে ন’টা বাজে, আর অপেক্ষা করা যায় না, ডিনার সেরে উঠে পড়বে ঠিক করল রানা। নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল হয়েছে। স্যুট, লাল টাই পরেছে রানা, রুমালটা অর্ধেক বের করে রেখেছে বুকপকেটে, কোটের বাটনহোলে একটা হলুদ বাটন ফ্লাওয়ার-চিনতে না পারার কোন কারণ নেই।

বেয়ারা ডাকতে যাবে, এমন সময় চমকে উঠল রানা। পেছন থেকে এসে টেবিলের গায়ে ধাক্কা দিয়েছে ইনভ্যালিড চেয়ারটা, উল্টে পড়ে গেছে আধগ্লাস হুইস্কি।

‘ওহ্, আই অ্যাম ভেরি সরি। প্লীজ এক্সকিউজ মি। আই মাস্ট বাই ইউ অ্যানাদার ড্রিঙ্ক।

রানা বলল, ‘ওহ্, নো, দ্যাটস্ অলরাইট।’ গলা চড়িয়ে ডাক দিল, ‘বয়।’ বয় ছুটে এল। রানা কিছু বলবার আগেই থাই মহিলা রানার জন্যে হুইস্কির অর্ডার দিল। ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে টেবিল পরিষ্কার করে চলে গেল বেয়ারা। লজ্জিত হাসি হাসল মহিলা।

‘কিছু মনে করবেন না, দেখতে পাইনি। আপনি কি বাঙালী?’

‘হ্যাঁ। আপনি?’

আমি মিসেস গুপ্ত। ইনি আমার হাসব্যান্ড, মিস্টার সরোজ গুপ্ত। আমি থাই, উনি বাঙালী।’

‘আমার নাম আব্বাস মির্জা। গ্লাড টু মিট ইউ।’ স্বস্তি ফুটে উঠল রানার মুখে। ‘বসুন না, আপনাদের জন্যে কিছু অর্ডার দিই?’ ঘুম ঘুম ভঙ্গিতে চেয়ে রয়েছে সরোজ গুপ্ত, কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ল। প্রশ্নের জবাব দিল মিসেস গুপ্ত।

‘ধন্যবাদ। ডিনারের সময় হয়েছে, তার আগে আমরা ড্রিঙ্ক করব না।’

‘বেশ তো, আসুন না, একসাথেই ডিনার খাওয়া যাক?’

‘সরোজ অসুস্থ। হোটেল কামরাতেই ডিনার সারে ও। অর্ডার দেয়া আছে, এতক্ষণে হয়তো পৌঁছে গেছে ওর খাবার। তাছাড়া ঘরে ফিরবার সময় হয়েছে ওর। ওকে রেখে এসে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি।

‘তাহলে চমৎকার হয়। কি অসুখ ওঁর?’

‘আরথ্রাইটিস। এই চেয়ার ছাড়া চলতে পারে না এক পা-ও।’

‘খুবই দুঃখের কথা। কতদিন ধরে এরকম?’

‘বছরখানেক ধরে। বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই।’

‘কপাল খারাপ। এর কোন চিকিৎসা নেই?’

‘একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম। কিন্তু এই জিনিসটা ওর ধাতের বাইরে। ব্যবসার কাজে আজ এ শহর, কাল ও শহর, ছোটাছুটির বিরাম নেই। আপনি একটু বসুন, আমি ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসছি।’

‘আপনার কোন অসুবিধে নেই তো?’ সরোজ গুপ্তের দিকে ফিরল রানা। ‘মানে, আপনার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে খাওয়া-দাওয়ার…’

‘না না। কোন অসুবিধে নেই।’ অমায়িক হাসি হাসল মিস্টার গুপ্ত। ‘বহুদিন পর বাংলা ভাষায় কথা বলবার সুযোগ পেয়েও সেটা হারাতে হচ্ছে বলে আমি খুবই দুঃখিত। আছেন কদিন? সম্ভব হলে আসবেন এর মধ্যে। গল্প করা যাবে।

চলে গেল মিসেস গুপ্ত ইনভ্যালিড চেয়ার ঠেলে নিয়ে। দুজনের জন্য ডিনারের অর্ডার দিল রানা। সাত কোর্সের ইংলিশ ডিনার। একটা সিগারেট ধরিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল। মিনিট পাঁচেক পরেই ফিরে এল মিসেস গুপ্ত। ঠোঁটে লিপস্টিক।

খেতে খেতে গল্প চলল। ভদ্র দূরত্বের ভাবটা খসে গেল অল্পক্ষণেই। মহিলা খুবই আলাপী।

‘জরুরী খবর দিয়ে আনানো হয়েছে আমাদের মান্দালয় থেকে। জানানো হয়েছে, বিশেষ কাজে এসেছেন আপনি ব্যাংকক থেকে, কাজ সারার পর গোপনে এদেশ থেকে বেরিয়ে যাবার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে আমাদের। সবরকমের সহযোগিতা দিতে হবে আপনাকে।’ হাসল মিসেস গুপ্ত। ‘কি ধরনের সহযোগিতার জন্যে প্রস্তুত থাকব আমরা কিছু ধারণা দিতে পারবেন?

‘আমি নিজেই জানি না এখনও।’

মাথা নাড়ল মিসেস গুপ্ত। ‘কবে নাগাদ সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে জানাতে আপত্তি আছে?’

‘সেটাও আমার জানা নেই। যে কোন দিন যে কোন সময়ে প্রয়োজন পড়তে পারে। আদৌ প্রয়োজন না-ও পড়তে পারে। তবে প্রয়োজনের সময় আমাকে ঠিক কি করতে হবে জানিয়ে রাখলে সুবিধে হবে আমার।’

‘দিনের বেলা আমরা কোন সাহায্য করতে পারব না। যে কোনদিন-রাত আটটার পরে এলে আমাদের স্যুইটের দরজা খোলা পাবেন। স্যুইট নম্বর ৫৮০। সোজা ঢুকে পড়বেন আমাদের ঘরে। করিডরে লোক থাকলে অবশ্য না ঢোকাই ভাল, খানিক ঘুরে ফিরে আবার ট্রাই নেবেন। একবার আমাদের ঘরে পৌঁছুতে পারলে আর কোন চিন্তা নেই, নিরাপদে পৌঁছে যাবেন ব্যাংকক।

ব্যাপারটা মনে মনে নাড়াচাড়া করে দেখল রানা এক মিনিট। তারপর বলল, ‘কিভাবে পাচার করছেন আমাকে?’

আপনি পৌঁছানোর সাথে সাথেই মেক-আপ করে চেহারা পাল্টে দেব আমি আপনার, সরোজের চেয়ারটা দখল করবেন আপনি, ব্যস, বাকি কাজটুকু সহজ। শরীর খারাপের অজুহাতে আপনাকে নিয়ে চলে যাব আমি ব্যাংককে সরোজ গুপ্ত হিসেবে। আমরা এত বেশি ট্রাভেল করি যে সবাই চেনে আমাদের।’ হাসল আবার। ‘সরোজের স্বভাবচরিত্র আর বদমেজাজ সম্পর্কে সবাই ওয়াকেফহাল।’

‘খুবই রিস্কি মনে হচ্ছে আমার কাছে ব্যাপারটা।’

‘মোটেও না। অন্তত এক ডজন ভারতীয় স্পাইকে পার করেছি আমি এভাবে। আপনাকে নিয়ে হবে তেরো জন।

‘আনলাকি থারটিন। যাই হোক, আমি ভারতীয় স্পাই, একথা জানলেন কি করে?’

আমরা ভারতীয় এজেন্ট। নিশ্চয়ই চাইনিজ স্পাইকে পার করতে বলবে না আমাদের ভারত সরকার। সহজ ইনফারেন্স। যাই হোক, কি এমন গোপন কাজে এসেছেন বলুন তো, যেজন্যে ছদ্মবেশে পালাতে হবে আপনাকে রেঙ্গুন থেকে।

‘তার আগে বলুন দেখি সরোজ বাবুর চেয়ারটা আমি দখল করে নিলে বেচারার কি দশা হবে?’

‘ও চলে যাবে হোটেল ছেড়ে।’

‘কিভাবে?’

‘সোজা পায়ে হেঁটে। আসলে কোন অসুখ নেই ওর, তাছাড়া বুড়োও না ও। আপনারই সমবয়সী। দাড়ি চেঁছে ফেললেই সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যাবে ও। গটমট করে হেঁটে বেরিয়ে যাবে হোটেল থেকে। কেউ সন্দেহ করতে পারবে না।’

এই ব্যবস্থায় মোটেই খুশি হতে পারল না রানা। চুপচাপ খাওয়া সারল ও। টুকিটাকি দু’চারটে কথা হলো। সবশেষে বলল রানা মনের কথাটা।

আমার যতদূর ধারণা, এই ধরনের কৌশল একবার বা দু’বার করা চলে নিরাপদে। বেশিবার রিপিটিশন হলে কারও না কারও চোখে ধরা পড়ে যায়, এবং তারা এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে, সময়-বিশেষে ব্ল্যাকমেইল করতেও ছাড়ে না।’ সরাসরি চাইল রানা মিসেস গুপ্তের চোখের দিকে । ‘আপনাকে ভাগ্যবতী বলতে হবে, কারও চোখে পড়েননি আজ পর্যন্ত। মাফ করবেন, আমি আপনাদের এই ছেলেমানুষী খেলা দেখে নিরাশ হচ্ছি। আরও ভাল কোন প্ল্যান আশা করেছিলাম আমি। যাই হোক, আপনাদের উপর নির্ভর না করে উপায় নেই আমার, খুব সম্ভব আসছি আমি দু’একদিনের মধ্যেই। অনুমতি করুন, এবার তাহলে উঠি আমি?’

‘কোথায় উঠেছেন রেঙ্গুনে?’

‘সব কথা আজ বলে ফেললে ব্যাংকক যাওয়ার পথে আর গল্প পাব না। কোথায় ছিলাম, কি কাজে এসেছিলাম, কিভাবে কাজটা করলাম তার রোমহর্ষক বর্ণনা দেব আপনাকে ফিরতি পথে। কথা দিলাম। বাই দা ওয়ে, ওই যে স্কার্ট পরা মেয়েটা বসে আছে, খুব সম্ভব অ্যাংলো-বার্মিজ, চেনেন ওকে?’

রানার চোখের ইঙ্গিত অনুসরণ করে দেখল মিসেস গুপ্ত সোফিয়াকে। একটা ঝাউ গাছের আড়ালে বসে আছে মেয়েটা, একা।

‘না তো! এনি ট্রাবল্?’

‘না না, কোন ট্রাবল নেই। কিন্তু এখন উঠে পড়াই উচিত। বেয়ারা…।’

.

উঠে পড়ল সোফিয়াও। বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলল রানার পিছু পিছু। গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রানা। এগোতে গিয়েও থেমে গেল সোফিয়া হোটেলে ঢুকছিল দু’জন লোক, রানাকে ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এসে থমকে দাঁড়াল একজন। পেছন ফিরে দেখল রানাকে। সঙ্গীকে থামিয়ে বলল, ‘আরে! দ্যাখ তো, এই লোকটার ইয়টই না কাল রাতে সার্চ করলাম আমরা?’

রানাকে দেখা যাচ্ছে দরজার কাচের মধ্যে দিয়ে, ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে লম্বা পা ফেলে।

‘তাই তো!’ উত্তর দিল সঙ্গী। ‘এই ব্যাটা, এখানে কি করছিস? আগামীকাল আটটার আগে ইয়ট ছেড়ে কোথাও যাওয়া ওর নিষেধ। আশ্চর্য!’

‘শোন। ঘাপলা আছে মনে হচ্ছে। আমি পিছু নিচ্ছি শালার, তুই খোঁজ নিয়ে দ্যাখ কার সাথে দেখা করতে এসেছিল ব্যাটা। আমি আধঘণ্টার মধ্যে না ফিরলে খবর দিবি ইয়েন ফ্যাঙকে।‘

বেরিয়ে গেল লোকটা।

পিছু পিছু বেরিয়ে এল সোফিয়া হোটেল থেকে

বটগাছতলায় পৌঁছে রশি খুলে নৌকোয় উঠে বসল রানা। দ্রুত হাতে কাপড় বদলাল, তারপর বৈঠা তুলে নিল। দু’ঘণ্টা পার হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে উঠেছে এতক্ষণে বিউটি কুইন।

অতি সন্তর্পণে বটগাছতলায় এসে দাঁড়াল রানার দ্বিতীয় অনুসরণকারী। দেখল রানার বেশ পরিবর্তন। মুচকে হাসল। কি করা উচিত ভাবল কিছুক্ষণ। স্থির করল, লোকটা যে গোপনে ইয়ট ছেড়ে শহরে এসেছিল, এই কথার সাক্ষ্য- প্রমাণ না থাকলে পরে বেমালুম অস্বীকার করবে ব্যাটা। কাজেই ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে ধরা পড়ে গেছে ও। অন্তত কয়েকটা কথা বলতে হবে ওকে এক্ষুণি।

পকেট থেকে রিভলভার বের করল লোকটা। নিজের অজান্তেই মস্তবড় ভুল করল সে। অভ্যাসবশে রিভলভারটা তাক করল রানার দিকে।

পিছনে মৃদু খসখস আওয়াজ। শিরশির করে উঠল ওর শিরদাঁড়ার ভেতরটা। কেন যেন মনে হলো পিছনে ফিরে লাভ নেই, চরম ক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। ভয়ানক ভয় পেয়ে ককিয়ে উঠতে চাইল সে, আওয়াজ বেরোল না গলা দিয়ে। বরফের মত জমে গিয়েছে সে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ঠিক পেছনেই, দুই ফুট দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছে ওর মৃত্যু। সচকিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করল পানিতে, ইয়টের ওই লোকটাকে ডাক দিয়ে সাহায্য চাইতে ইচ্ছে করল, কিন্তু কিছুই করতে পারল না সে। কিছু করবার আগেই তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করল সে পিঠের কাছে। মুহূর্তে লোপ পেল ওর সমস্ত চেতনা, যেন হাজার ভোটের বিদ্যুৎ বয়ে গেল শরীরে। পরমুহূর্তে দেখতে পাচ্ছে সে আবার। বৈঠা বেয়ে চলে যাচ্ছে আব্বাস মির্জা। চিৎকার করে ডাকতে চেষ্টা করল সে রানাকে, ঘড় ঘড় আওয়াজ বেরোল শুধু। রক্ত বেরিয়ে এল নাক মুখ দিয়ে। স্পষ্ট বুঝতে পারল সে, মারা যাচ্ছে, কেউ বাঁচাতে পারবে না আর ওকে। ডুবে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে সে ক্রমেই। হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে একটা ভেলার উপর। দপ করে নিবে গেল পৃথিবীর সব আলো। এখন শুধু নিকষ কালো অন্ধকার।

নিঃশব্দে ভিড়ল বোটটা ইয়টের গায়ে। চট করে অ্যাংকর-চেনের সাথে বেঁধেই উঠে পড়ল রানা ভাঁজ করা কাপড়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে।

কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখতে পেল রানা এক চিলতে 1 ধড়াস করে উঠল ওর বুকটা। খুলল কি করে! ভাগল নাকি মেয়েটা? কেন? কিভাবে?

কেবিনটা নিজহাতে চাবি মেরে রেখে গেছে রানা।

দরজার পাশে এসে দাঁড়াল রানা নিঃশব্দ পায়ে। চোখ রাখল দরজার ফাঁকে। না, পালায়নি। শুয়ে আছে বিউটি কুইন।

সরে গেল রানা দরজার সামনে থেকে। তন্নতন্ন করে খুঁজল পুরো ইয়টটা। কেউ নেই আর। রাইডিং লাইটটা নিবিয়ে দিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল গোটা ইয়ট। কেবিনের দরজার ফাঁকে শুধু এক চিলতে আলো। আবার এসে দাঁড়াল রানা। কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল আধমিনিট, তারপর একটানে দরজা খুলে লাফিয়ে ঢুকল ঘরের ভেতর। না। কেউ নেই আর।

দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানার ধারে এসে দাঁড়াল রানা।

জ্বলন্ত চুরুট ঠেসে ধরা হয়েছিল মেয়েটার বুকে, গালে, তলপেটে, কপালে। কথা আদায় করার চেষ্টা করেছিল কেউ-এমন কোন কথা, যা ঘুণাক্ষরে জানা ছিল না বেচারীর। রানার কানে স্পষ্ট ভেসে উঠল মেয়েটার কণ্ঠস্বর: ইউ কাম ব্যাক, দেন লাভ মি। নো ডিজিজ। ইউ এঞ্জয় সাহিব, প্রমিজ। আই নো বেগার, ইউ লাভ মি আফটার কাম ব্যাক।

মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। বাচ্চা মেয়ের মত বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে।

রানা জানে, কোনদিন ভাঙবে না এ ঘুম। কপাল ফুটো করে ঢুকে গেছে একটা বুলেট।

মারা গেছে বিউটি কুইন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *