রক্তের রঙ ১.৭

সাত

রাত আটটা।

রিসেপশন কাউন্টারের কাছাকাছিই একটা সোফায় বসল রানা।

নানকিং হোটেলের স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা-বোর্ডারদের চলাফেরা, ট্যুরিস্টদের ব্যস্ত চোখমুখ, পোর্টার-বেয়ারার ত্রস্ত পদচারণ, রিসেপশনিস্টের মেকি হাসির অভ্যর্থনা, মুহুর্মুহু টেলিফোনের ঝনঝনি-আলস্যভরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে দেখছে রানা সব। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

‘ওয়েটিং ফর সামবডি?’ কানের কাছে মোলায়েম মধুর কণ্ঠস্বর।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা, পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক বার্মিজ সুন্দরী। রুচিসম্মত কেতাদূরস্ত পোশাক, মাথায় চুড়ো খোঁপা। হাতে লাল একটা মুখ-বাঁধা থলের মত প্লাস্টিকের ব্যার্গ। সেই রঙের সাথে ম্যাচ করা লিপস্টিক।

উঠে দাঁড়াল রানা। বলল, ‘ইয়েস। ওয়েটিং ফর ইউ। দিস ইজ আব্বাস মির্জা।’

‘অ্যান্ড দিস ইজ স্যুই থি। গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’ মিষ্টি করে হাসল স্যুই থি।

‘ডিলাইটেড। নাউ, হোয়াট্স্ দা প্রোগ্রাম?’ প্রথমেই কাজের কথা পাড়ল রানা। ‘লেস গো অ্যাহেড উইথ ইট।

‘ওঞ্চিউ হ্যাভ আ ড্রিংক? আই অ্যাম থারস্টি।’

নিজের জন্যে এক পেগ হুইস্কি এবং মেয়েটির জন্যে শ্যাম্পেনের অর্ডার দিল রানা। বসল ওরা মুখোমুখি। গতকালকের সেই বেয়ারাটা গ্লাস দুটো রেখে গেল টেবিলের উপর, রানাকে জিজ্ঞেস করল ডিনার খাবে কিনা। গতকাল মোটা বকশিশ পেয়ে লোভ হয়ে গেছে ব্যাটার! হাসল রানা, চাইল মেয়েটির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।

মাথা নাড়ল মেয়েটা। বলল, ‘আমাদের ওখানে আপনার স্পেশাল ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এখানে খেয়ে নিলে নিরাশ হবেন আপনার হোস্ট।‘

বেয়ারাকে বারণ করে দিয়ে ফিরল রানা মেয়েটির দিকে। ‘ওখানে ড্রিংকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?’

হাসল স্যুই থি। ‘আছে। সব ব্যবস্থাই আছে। আপনার মালপত্র এতক্ষণে পৌঁছে গেছে, চমৎকার একটা এয়ারকনডিশনড কামরার ব্যবস্থা হয়েছে। অতিথিদের যত্ন আত্তির ত্রুটি রাখেন না উ-সেন। আপনার আরামের দিকে লক্ষ রাখার ভার দেয়া হয়েছে আমার ওপর। আপনার সব রকমের আরামের ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে প্রয়োজন হলে ঘুমাতেও হবে আপনার সাথে। কাজেই কিছুটা আলাপ করে আপনাকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে বুঝে নেয়ার সুযোগটা গ্রহণ করলাম। পাঁচ দশ মিনিটের এদিক ওদিকে কিছুই মনে করবেন না উ-সেন।’

হঠাৎ রানার চোখে পড়ল, সান্ধ্যভ্রমণ সেরে ইনভ্যালিড চেয়ারটা ঠেলে ওপাশের কাচের দরজা দিয়ে ঢুকছে মিসেস গুপ্ত। আধ-শোয়া হয়ে বসে আছে সরোজ গুপ্ত। রানার উপর চোখ পড়ল মিসেস গুপ্তের। ভয় পেল রানা, এখন যদি কোনরকমে প্রকাশ পায় যে ওরা পরস্পরকে চেনে, তাহলে সহজেই বেরিয়ে যাবে গতকাল নানকিং হোটেলে কেন এসেছিল রানা। আর এটুকু জানতে পারলেই আগাগোড়া সব ব্যাপার ফাঁস হয়ে যাবে। উ-সেনের পক্ষে গুপ্ত দম্পতির সত্যিকার পরিচয় বের করা বড়জোর দশ মিনিটের কাজ। ওরা ভারতীয় এজেন্ট-এটুকু জানতে পারলেই বাকিটুকু বুঝে নিতে কষ্ট হবে না কারও।

অস্বস্তিকর কয়েকটি সেকেন্ড কাটল। না, ভুল করল না মিসেস গুপ্ত। চিনতে পারার কোনরকম লক্ষণ প্রকাশ পেল না ওর চাহনিতে। দৃষ্টিটা সরে গেল রানার ওপর থেকে, স্থির হলো অন্য একটা যুবকের মুখের ওপর। মনে মনে হাসল রানা মিসেস গুপ্তের অতৃপ্ত স্ত্রীর ভূমিকায় তুলনাহীন অভিনয় দেখে। কপাল থেকে একগুচ্ছ অবাধ্য চুল সরিয়ে ইনভ্যালিড চেয়ার ঠেলে নিয়ে লিফটে উঠে গেল সে।

শ্যাম্পেনের অবশিষ্টাংশটুকু এক ঢোকে গিলে নিয়ে ঘড়ি দেখল স্যুই থি বলল, ‘চলুন, ওঠা যাক।

রানা বলল, ‘আরেক গ্লাস আনতে বলি?’

‘নো থ্যাংক ইউ, বেশি দেরি করলে আবার রেগে যাবেন আপনার হোস্ট।’

‘ব্যস, এক গ্লাস শ্যাম্পেনেই সব বোঝা হয়ে গেল আপনার?’

‘কিছুটা হলো,’ হাসল মেয়েটা। ‘বাকিটুকু বুঝে নেব গভীর রাতে।’

‘আপনি যেভাবে বলছেন, তাতে এখুনি জিভে পানি এসে যাচ্ছে আমার!’

বিল চুকিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল রানা। একটা দুধ-সাদা মার্সিডিস টু- টোয়েন্টি এসে দাঁড়াল ফুটপাথ ঘেঁষে। পিছনের দরজা খুলে দিল শোফার। উঠে বসল ওরা। রাজহংসের মত ভেসে চলল মার্সিডিস বেঞ্জ রেঙ্গুনের উজ্জ্বল-আলোকিত রাজপথ ধরে।

ঘনিষ্ঠ হয়ে এল স্যুই থি। রানার ডানহাতটা তুলে ঘাড়ের পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে আনল সামনে, মাথাটা এলিয়ে দিল রানার কাঁধে। চিকচিক করছে চোখদুটো, ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে, চকচকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে। আলতো করে কামড়ে দিল সে রানার ঘাড়ের পাশে। শিরশির করে উঠল রানার সর্বশরীর অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে। ঘাড় ছেড়ে দিয়ে এখন রানার ঠোঁট খুঁজছে স্যুই থির লজেন্সের মত ঠোঁট। উরুর ওপর থেকে সরে গেছে সারং। রানার বামহাতটা টেনে নিল সে ফর্সা উরুর ওপর। পেয়ে গেছে সে রানার ঠোঁট। গরম নিঃশ্বাস পড়ছে রানার গালে।

কিন্তু বোধশক্তি লোপ পেল না রানার। কোন রাস্তা দিয়ে কোনদিকে চলেছে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে ওর। প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এর পাশ দিয়ে গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিল গাড়িটা, জুবিলি হল পেরিয়ে এগিয়ে গেল আরও। একটা পরিচিত রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালের পাশের বাইলেন দিয়ে এসে দাঁড়াল পনেরোতলা ইয়ান লাও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কের সামনে। একটা গাড়ি বেরোচ্ছিল, সেটা বেরিয়ে যেতেই নেমে গেল ওরা ভিতরে। দু’পাশে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা আছে, কিন্তু খালি স্পেসও আছে। কোথাও না থেমে সোজা এগিয়ে গেল মার্সিডিস। কার পার্কের শেষ প্রান্তে পৌঁছতেই ধীরে ধীরে খুলে গেল একটা স্টীলের দরজা। খুব সম্ভব উ-সেনের ব্যক্তিগত কার-পার্ক। কালো একটা সিট্রন ডি.এস. দাঁড়িয়ে রয়েছে গম্ভীর মুখে। থেমে দাঁড়াল দুধ-সাদা মার্সিডিস।

আগেই সামলে নিয়েছে স্যুই থি। নেমে পড়ল রানা ওর পিছু পিছু। ‘এই পুরো বিল্ডিংটা উ-সেনের?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ। তবে সবচেয়ে ওপরের দুটো তলা ছাড়া সবটাই ভাড়া দেয়া হয়েছে। এরকম আরও কয়েকটা দালান আছে ওর রেঙ্গুনে আর মান্দালয়ে। আসুন, এইদিকে।’ লিফটের দিকে এগোল স্যুই থি। এগোল রানাও।

স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বেগে উপরে উঠতে শুরু করল লিফট। এত স্পীডের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি ছিল না রানার। ওর মনে হলো, ইঞ্চি তিনেক কমে গেছে ওর দৈর্ঘ্য।

চোদ্দতলায় থামল লিফট। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। নীল কার্পেট বিছানো একটি লবি, ঝকঝকে সাদা দেয়াল। একটা কাঁচের দরজা পেরিয়ে পৌঁছল ওরা আধুনিকতম ফার্নিচারে সুসজ্জিত মস্ত একটা ড্রইংরুমে। কার্পেটের রঙ পাল্টে লাল হয়ে গেল। ছয় ইঞ্চি পুরু ফোম রাবারের উপর কালো চামড়া মোড়া সোফা। একই ডিজাইনের তিন সেট সোফা তিনভাবে সাজানো আছে। অপূর্ব কারুকাজ করা গোটা কয়েক বার্মা টিকের চেয়ার এবং টেবিল। ঘরের কোণে চমৎকার কারুকার্য করা বার্মা টিকের অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাউন্টার, তার ওপাশে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা মিনিয়েচার বার। দেয়ালের গায়ে ফ্রেমে বাঁধানো পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকটা পেইন্টিং, ঘরের তিন কোণে তিনটে ফ্লাওয়ার ভাসে প্রকাণ্ড তিনটে তাজা ফুলের তোড়া। দক্ষিণ দেয়ালে একটা আটফুট বাই ষোলো ফুট কাচের জানালা-গোটা রেঙ্গুন শহরটা দেখা যায় ওখানে দাঁড়িয়ে।

উ-সেনের মধ্যে যে আশ্চর্য এক সৌন্দর্যপ্রেমিক রয়েছে সেটা টের পেয়ে বেশ খানিকটা দমে গেল রানা। কারণ ও জানে, যত রকমের দস্যু বা আইন অমান্যকারী অপরাধী আছে, তার মধ্যে ভয়ঙ্করতম হচ্ছে রুচিশীল সৌন্দর্যপ্রেমিকেরা। দু’একটা ব্যাপারে এরা আশ্চর্য রকমের কোমল, কিন্তু অন্যান্য ব্যাপারে এদের চেয়ে নিষ্ঠুর আর হৃদয়হীন, এক কথায় পিশাচ দ্বিতীয়টি পাওয়া ভার। এরা করতে পারে না এমন কাজ নেই, নামতে পারে না এমন নীচ নেই। এদের উপরের প্রলেপ দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না কতবড় ভয়ঙ্কর শয়তান বাস করে এদের বিকৃত মস্তিষ্কের ভিতর পিসারো, মডিগলিয়ানী, গগাঁ আর পিকাসো দেখে বিন্দুমাত্র মুগ্ধ হতে পারল না রানা, বরং আশঙ্কায় ছেয়ে গেল ওর মনটা। ভয়ঙ্কর ধূর্ত হয় অপরাধ জগত্রে এইসব আঁতেলেকচুয়ালরা, রানা কি পারবে ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ উদ্ধার করতে?

‘কি ভাবছেন?’ হাসল স্যুই থি মিষ্টি করে। ‘ওরকম আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন। কি খাবেন? হুইস্কি, না কোন ককটেল? কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবেন মিস্টার উ-সেন। অতিথিকে শুকনো মুখে রেখেছি জানলে ভয়ানক চটে যাবেন উনি আমার ওপর।

হাসল রানা। বসে পড়ল একটা সোফায়। বলল, ‘একটা ককটেল হলে মন্দ হত না। সস্তা কোন শ্যাম্পেন আছে আপনাদের কাছে?’

‘আমি সস্তার কোন কারবার করি না, মিস্টার আব্বাস মির্জা।’ একটা গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল রানার পিছন দিক থেকে। ‘নির্বোধ আর অক্ষমেরা সবকিছুর মূল্য নিয়ে মাথা ঘামায়।’

পিছন ফিরল রানা। দেয়ালের গায়ে একটা দরজা নিঃশব্দে খুলে গেছে কখন। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছে ডাবল-ব্রেস্টেড নীল মোহায়ের স্যুট পরা দীর্ঘদেহী এক পুরুষ। রানার চেয়ে অন্তত ছয় ইঞ্চি বেশি লম্বা। সরু কোমর, প্রশস্ত কিন্তু আড়ষ্ট কাঁধ, পিঠটা একেবারে খাড়া। মুখ দেখে বয়স বুঝবার উপায় নেই। চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে যে কোন বয়স হতে পারে। প্রকাণ্ড মাথা ভর্তি ঘন পাকা চুল, দার্শনিকের মত এলোমেলো। চোখে অত্যন্ত গাঢ় সবুজ রঙের সানগ্লাস, ওটার হ্যান্ডেল থেকে একটা সরু তার গিয়ে ঢুকেছে কোটের ব্রেস্ট পকেটে।

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এগিয়ে এল লোকটা রানার দিকে। রানার মাথার দুই হাত উপরে ওর দৃষ্টি। উঠে দাঁড়াল রানা। কিন্তু লোকটার দৃষ্টি যেদিকে ছিল সেদিকেই রইল, পরিবর্তন হলো না। ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরে শিরশির করে উঠল রানার শিরদাঁড়ার ভিতরটা। বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল রানা স্যুই থি-র দিকে, সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল সে। কোনকিছু না ছুঁয়ে বা ধরে একটা সোফা ঘুরে নিশ্চিত পদক্ষেপে রানার সামনে এসে দাঁড়াল অন্ধ লোকটা। হাত বাড়িয়ে দিল রানার দিকে।

আমি উ-সেন। ভেরি গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিস্টার আব্বাস মির্জা।

‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ,’ উত্তর দিল রানা।

দেয়ালের গায়ের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে আপনাআপনি। শুকনো, শক্ত একটা হাত জোরের সাথে শেক করল রানার হাত। দরাজ কণ্ঠে আগের কথার খেই ধরল উ-সেন, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সব আনন্দই অমূল্য, মিস্টার আব্বাস মির্জা। আনন্দের প্রশ্নে, উপভোগের প্রশ্নে, মূল্য বিচার করতে নেই। সস্তা শ্যাম্পেনের সাথে কি মিশিয়ে ককটেলের কথা ভাবছিলেন?’

‘ব্র্যান্ডি!’

‘গুড! শিকাগোর কথা বলছেন। বেশ, ঊনপঞ্চাশের ক্রুগ শ্যাম্পেন আছে আমাদের, আর আছে আটাশের হাইন ব্র্যান্ডি। বানাও স্যুই, আমাকেও দিয়ো এক গ্লাস। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ককটেল দিয়েই শুরু হোক আমাদের আলাপ। আপনাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?’

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে স্যুই থি-র দিকে চাইল রানা। মাথা ঝাঁকাল স্যুই থি।

‘নিশ্চয়ই, দেখুন,’ বলল রানা বিনয়ী কণ্ঠে।

প্রথমে রানার চিবুক, তারপর গাল, কান, কপাল ছুঁয়ে দেখল উ-সেন; দুই হাতে মাথার মাপ নিল, ঘাড়ের পরিধি দেখল, প্রশস্ত দুই কাঁধ এবং পেশীবহুল বাহু দেখল। দেখা হয়ে যেতেই সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গুড। স্যুই থি-র রাত আজ স্বপ্নের ঘোরে কাটবে বুঝতে পারছি। আজকের রাত হবে ওর জীবনের স্মরণীয় রাত। বহুদিন পর একজন সত্যিকার বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী পুরুষের সাথে আলাপ হলো। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে এতক্ষণে সত্যি আনন্দ বোধ করছি, মিস্টার আব্বাস মির্জা। আসুন, বসা যাক।’

বসল ওরা মুখোমুখি দুটো সোফায়। রানা লক্ষ করল পাপেটের মত আড়ষ্ট হাঁটার ভঙ্গিটা হাঁটার বৈশিষ্ট্য নয়, শারীরিক কোন অসুবিধা আছে উ- সেনের। বসেছে পিঠটা একেবারে সোজা রেখে। সার্জিক্যাল করসেট পরেছে কিনা ভাবল রানা। কিন্তু না, সার্জিক্যাল করসেট হলে শোলডার ব্লেডের নিচে এসেই শেষ হয়ে যেত। এর সারা পিঠই আড়ষ্ট। ট্রেতে করে তিন গ্লাস ককটেল নিয়ে এল স্যুই থি, নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। স্বচ্ছন্দে একটা গ্লাস তুলে নিল উ-সেন, অন্য গ্লাসের সাথে ধাক্কা খেলো না। রানা একটা গ্লাস তুলে নিতেই টুং করে টোকা দিল ওর গ্লাস দিয়ে।

‘আপনার সাফল্য কামনা করছি। ‘

স্যুই থি বসেছে উ-সেনের পাশে পায়ের উপর পা তুলে। ছোট্ট চুমুক দিল গ্লাসে।

‘আপনার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে টপ ফ্লোরে। ঠিক নটার সময় ডিনার খাব আমরা। আরও একজন অতিথি থাকবেন। আপনার সাথে পরিচয়ের পালাটা আগেই সেরে রাখলাম, ভালই হলো। গমগমে কণ্ঠ উ-সেনের, প্রকাণ্ড ড্রইংরুমটা মনে হয় কাঁপছে। এই গ্লাসটা শেষ হলেই আপনাকে আপনার ঘর দেখিয়ে দেবে স্যুই থি। আপনার মালপত্র পৌঁছে গেছে আপনার ঘরে। ন’টা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে পারবেন, ইচ্ছে হলে স্নান সেরে নিতে পারেন। ঠিক নয়টার সময় স্যুই থি গিয়ে নিয়ে আসবে আপনাকে।’ স্যুই থির কোমরে হাত রাখল উ-সেন। ‘আজকের ডিনারটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন বিশিষ্ট অতিথি আসবেন আপনার সাথে আলাপ করতে, পরিচিত হতে। তার আগে প্রাথমিক দু’একটা প্রশ্নোত্তর সেরে নেয়া যাক।

নড়েচড়ে বসল উ-সেন।

‘প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি জানতে পারলাম, আমার লোক আপনার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেনি। অবশ্য ইয়েন ফ্যাঙের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। আমি অন্ধ মানুষ, নিজে সবকিছু করতে পারি না, কাজেই ওর মত কিছু আনকালচারড, আনসফিস্টিকেটেড, মোটাবুদ্ধির লোককে দিয়ে অনেক কাজ করাতে হয়। আশা করি ওর অপরাধ আপনি নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।’

‘না, না। কিছু মনে করিনি আমি।’ বলল রানা।

‘থ্যাংক ইউ। কিন্তু সেই অ্যাংলো মেয়েটি সম্পর্কে কোন খোঁজ পাইনি আমরা এখন পর্যন্ত। কে মেয়েটা? কেন সে খুন করল আমাদের একজন লোককে, আপনার পিছু নিয়েছিল কেন সে, কোন দলের মেয়ে সে,

‘কি তার উদ্দেশ্য-কিছুই জানা যায়নি। আপনি এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারবেন?’

‘চেহারার বর্ণনা দিতে পারি। এর বেশি কিছুই জানা নেই আমার।’

‘অথচ মেয়েটা আপনাকে ণ্ড ড্যাগন পর্যন্ত কেবল নয়, নানকিং হোটেল পর্যন্ত, এবং সবশেষে বটগাছের নিচু পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল…’ কথাটা বলতে বলতে থেমে গেল উ-সেন, হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘আপনাকে সন্দেহের আওতার বাইরে রেখেছি আমি সব সময়েই। কিন্তু আপনি রেঙ্গুন এসে পৌছুবার সাথে সাথেই অন্য একটা দলের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে-সেটাই চিন্তিত করে তুলেছে আমাকে। আজ সন্ধ্যায় নানকিং হোটেলে আপনাকে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে ফ্যান সু। কাজেই আপনার ব্যাপারে আমার আর কোন সন্দেহ নেই। তবু কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছি।’

‘নানকিং হোটেলে?’

‘হ্যাঁ। আমার বিশ্বস্ত লোক আছে ওখানে। ওর কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছি আমি। ফ্যান সু যখন বলেছে আপনাকে চেনে না, আমি বুঝে নিয়েছি আপনাকে কাউন্টার এসপিয়োনাজের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি, আপনি জেনুইন লোক। যাই হোক, আজ ডিনারে আসছে জেনারেল এহতেশাম। তিনি আপনার লোকদের গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা করবেন। মোটামুটি প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়েও আলাপ হবে। তিন হাজার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সৈনিকের কথা শুনে দারুণ উৎসাহিত বোধ করছেন তিনি।’

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল উ-সেন। রানাও দাঁড়াল। রানার কাঁধে একটা হাত রাখল উ -সেন।

‘আপনি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন আমার চলাফেরা দেখে? লাঠি ব্যবহার করছি না, দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ঠাহর করবার চেষ্টা করছি না, তাহলে অন্ধ মানুষ, এত স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করছি কি করে?’ হাসল উ-সেন। ‘জন্মান্ধ হলে এটা সম্ভব হত না। চোখ দুটো হারিয়েছি আমি বছর তিনেক আগে এক প্লেন অ্যাকসিডেন্টে। সেই থেকে এই চশমা ব্যবহার করছি আমি।’

‘এই চশমা দিয়ে দেখতে পান?’

‘নো, মাই ডিয়ার ইয়াং ম্যাম। দেখতে পাই না। বাদুড়ের মত চলি আমি। এই চশমাটা আসলে একটা সাউন্ডট্র্যান্সমিটার। ডক্টর হুয়াং কি-র আশ্চর্য এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। অত্যন্ত ডেলিকেট এর মেকানিজম্। আশেপাশের দশ গজ পর্যন্ত এর রেঞ্জ। দশ গজের মধ্যেকার প্রত্যেকটা জিনিস থেকে রিফ্লেক্টেড হয়ে বীমগুলো ফিরে আসছে আমার বাম কানের পাশে বসানো একটা রিসিভারে। এই রিসিভারটা আবার সরু তার দিয়ে জয়েন করা আছে আমার পকেটে রাখা একটা মিনিয়েচার অ্যামপ্লিফায়ারের সাথে।’

‘এর ফলে গোলমাল পাকিয়ে যায় না?’

‘প্রথম প্রথম যেত। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সব বস্তুর ঘনত্ব সমান নয়। দেয়াল, চেয়ার-টেবিল, কাচ, তরল পদার্থ, মানুষ-প্রত্যেকটা জিনিস আলাদা আলাদাভাবে চিনতে কোন কষ্ট হয় না আর। শুধু ঘরের ভেতরেই নয়, রাস্তা-ঘাটে চলতেও কোন অসুবিধে হয় না। অনায়াসে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে আসতে পারি আমি সারাটা রেঙ্গুন শহর। শুধু তাই নয়, আমার কয়েকটা বিশেষ সুবিধা আছে, সাধারণ চক্ষুবিশিষ্ট মানুষের যা নেই। প্রথমত, চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শ্রবণশক্তি বেড়ে গেছে আমার চতুর্গুণ। এটা প্রকৃতির তরফ থেকে ক্ষতিপূরণের প্রচেষ্টা খুব সম্ভব, দ্বিতীয়ত, শুনলে আশ্চর্য হবেন, আমার সূর্য অস্ত যায় না কোনদিন। দিন রাত্রির প্রভেদ নেই আমার কাছে। ঘন অন্ধকারে আপনি অচল হয়ে পড়বেন আলো ছাড়া, কিন্তু আমি ঠিকই দেখতে পাব, যেমন আলোতে, তেমনি অন্ধকারে। আর তৃতীয়ত,… হঠাৎ থেমে গেল উ-সেন। লজ্জিতকণ্ঠে বলল, ‘এই দেখো, নিজের গল্প নিয়ে এতই মেতে গেছি যে ভদ্রতাজ্ঞান পর্যন্ত লোপ পেয়ে গেছে। যাও স্যুই, অতিথিকে পৌঁছে দিয়ে এসো তাঁর ঘরে।’

আর একটি কথাও না বলে পাপেটের মত পা ফেলে ফেলে চলে গেল উ-সেন ঘর ছেড়ে।

স্যুই থির পিছু পিছু সিঁড়িঘরের দিকে এগোল রানা।

স্নান সেরে নিতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *