রক্তের রঙ ২.৩

তিন

ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে বেরিয়ে গেল লোকটা।

পুতুলের মত দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে মনটা হঠাৎ ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল সোফিয়ার।

আশ্চর্য এক যাদু আছে লোকটার মধ্যে। ওর দুর্দান্ত, দুর্দমনীয় সাহসই কি এভাবে টানছে মনটাকে? সোফিয়া দেখেছে চিতাবাঘের মত কি আশ্চর্য গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লোকটা শ্যূ ড্যাগন প্যাগোডায় মোটা লোকটার উপর, কেমন বিদ্যুৎ বেগে পরাজিত করেছিল ওকে সাঁতরে গিয়ে ইয়টে ওঠার পর, কি চমৎকার দৃপ্ত ভঙ্গিতে টেবিলের ওপর বসে মোকাবিলা করেছিল উ-সেনের লোকদের প্রশ্নগুলোর। আজ রাতে রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালের পাশে ফিয়াটের ড্রাইভিং সীটে বসে বসে দেখেছে সে ঘড়ির দোলকের মত ঝুলতে ঝুলতে কিভাবে পনেরো তলার উপর এক জানালা থেকে আরেক জানালায় চলে গেল লোকটা। বড্ড ভয় লাগছিল ওর, মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে যাবে; পড়লে কি অবস্থা হবে ভাবতে গিয়ে গা গুলিয়ে আসছিল। এমন সাহসী লোক জীবনে দেখেনি সে।

কিন্তু সাহসই একমাত্র কারণ নয়, বুঝতে পারে সোফিয়া। অন্যকিছু আছে। কি সেটা? মন? হ্যাঁ, লোকটা মহৎ সন্দেহ নেই; পরোপকারী তাতেও কোন সন্দেহ নেই—কিন্তু কারণটা ঠিক এসবও নয়। ইচ্ছে করলেই বিপদ এড়িয়ে যেতে পারত লোকটা, কোথাকার কোন্ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সরোজ গুপ্ত বিপদে পড়েছে, টেলিফোনে টের পাওয়া গিয়েছে যে ওদের ঘরে অন্য লোক ঢুকেছে, ব্যস ছুটল লোকটা। নিজের বিপদের কথাটা ভাবল না একটি বারও। কিন্তু এটাও আসল কারণ নয়।

আসলে এইসব এই লোকটার সত্যিকার পরিচয় নয়, বাইরের ভূষণ মাত্র। আশ্চর্য এক পৌরুষ আছে এর মধ্যে—এবং সেইটাই এর আসল পরিচয়। কঠিন আর কোমলে মেশানো। দয়া-মায়া আর নির্মমতা একই সাথে বাস করে ওর বুকের ভিতর। ওর চোখ জোড়া যেমন কামনায় দগ্ধ করে দিতে পারে নারীর হৃদয়, তেমনি নিস্পৃহ হয়ে যেতে পারে মৌন ধ্যানী ঋষির মত। অদ্ভুত এক মানুষ।

বুকের ভিতর কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সোফিয়া ওকে যেতে দিয়ে। নির্বিকার হেঁটে চলে গেল লোকটা বিপদের মুখে নারীর আলিঙ্গন মুক্ত হয়েই—সোফিয়া জানে এটা নারীর প্রতি অনাসক্তি নয়, বলিষ্ঠ চরিত্রের স্বাভাবিক প্রকৃতি।

বাঙালীরা এরকম জানত না সোফিয়া। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়েছে সে একাত্তরের নয়টি মাস, শান্তিপ্রিয় ভাবুক বাঙালী জাতির অসমসাহসিক বীরত্বের কথা পড়েছে সে খবরের কাগজে; কিন্তু আজ সত্যিকার একজন বাঙালীকে দেখে বুঝতে পারল কেন একটা ঝঞ্ঝাটপ্রিয় শক্তিশালী সশস্ত্র যোদ্ধা জাতি এমন চরম পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হলো, এমন শোচনীয় ভাবে পর্যুদস্ত হয়ে গেল ভাবুক বাঙালী জাতির কাছে। এদের মধ্যে আগুন আছে। গভীর মনোযোগের সাথে চেয়ে না দেখলে বোঝা যায় না কি আশ্চর্য শক্তি, কি অমিত তেজ রয়েছে এদের বুকের ভিতর, চরিত্রে। বাঙালী জাতি অনেক উপরে উঠবে, উপলব্ধি করতে পারল সোফিয়া অন্তরের অন্তস্তলে।

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল সোফিয়া চিলেকোঠায়। রানার ফেলে দেয়া একটা সিগারেটের টুকরো থেকে ধোঁয়া উঠছে। সেই ধোঁয়ার দিকে চেয়ে চেয়ে মিনিট দুয়েক চিন্তা করল সে ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মনে মনে। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন পিস্তলটা পরীক্ষা করল নেড়েচেড়ে। তারপর সেটা ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে নিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে।

.

ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারল না সোফিয়া।

নানকিং হোটেলের ছয়তলায় লম্বা করিডরের শেষ মাথায় টয়লেটের দরজাটা সামান্য ফাঁক করে রেখে কয়েকটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করল সে। মিসেস গুপ্তকে ঘরে ফিরতে দেখল। তারপর কেটে গেল অনেকক্ষণ। ঘরের ভিতর কি হচ্ছে বোঝার উপায় নেই—শুধু একঘেয়ে অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে গিয়ে দরজায় কান পাতার সিদ্ধান্ত নিয়ে যেই টয়লেট থেকে বেরোতে যাবে, এমনি সময় দেখতে পেল ধীরে ধীরে খুলে গেল পাঁচশো আশির দরজা। একটু পরেই কাঁধের উপর একটা ভারী বোঝা নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে মিসেস গুপ্ত। বোঝাটা যে একজন মানুষের লাশ সেটা বুঝতে অসুবিধে হলো না সোফিয়ার। করিডরের ম্লান আলোয় চেহারাটা দেখতে পেল সে এক সেকেন্ডের জন্যে। ওটা যে একটা লাশ বুঝতে পেরেই ধক করে উঠেছিল সোফিয়ার বুকের ভিতরটা, কিন্তু মুখের চেহারা দেখে আশ্বস্ত হলো কিছুটা। না, আব্বাস মির্জা নয়।

আলুথালু বেশ মিসেস গুপ্তের। মনে হচ্ছে কামরার ভিতর ধস্তাধস্তি হয়েছে। পাঁচ ছয়টা কামরা পেরিয়ে এসে একটা কামরার তালা খুলে ঢুকে পড়ল মিসেস গুপ্ত। আব্বাস মির্জা কোথায়? ওই কামরার ভিতর মারামারি হয়েছে, মানুষ মারা গেছে, লাশ গোপন করবার চেষ্টা করছে মিসেস গুপ্ত—বোঝা গৈল, কিন্তু ক’জন মানুষ মারা গেছে, আব্বাস মির্জার খবর কি, বোঝা যাচ্ছে না। সে যদি সুস্থ থাকে, তাহলে মেয়েলোক লাশ বইছে কেন? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে লোকটার। কি হয়েছে? জখম না মৃত্যু?

ছুটে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো ওর, কিন্তু সামলে নিল। একবার মনে হলো সরাসরি মিসেস গুপ্তকে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করবে। কথাটা মনে আসতেই টয়লেট থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, এমনি সময় বেরিয়ে এল মিসেস গুপ্ত করিডরে, এপাশ ওপাশ চাইল, তারপর দ্রুতপায়ে চলে গেল নিজেদের স্যুইটে। মেয়েলোকটার চলাফেরার মধ্যে কেমন যেন অস্বাভাবিক একটা কিছু টের পেল সোফিয়া, কি সেটা বুঝতে পারল না, কিন্তু মনে হলো এর কাছে খোলাখুলি কিছু বলতে যাওয়া এখন ঠিক হবে না। দেখা যাক, এরপর কি করে।

লোকটা আব্বাস মির্জা বা সরোজ গুপ্ত নয়, এটা বুঝতে পেরেছে সোফিয়া। তার মানে ওরা দু’জন ওই কামরার ভিতরেই আছে এখন। কি করছে আব্বাস মির্জা? গিয়ে হাজির হবে সে? হঠাৎ ইতস্তত ভাবটা কেটে গেল সোফিয়ার। পরিষ্কার মনে পড়ল, ইয়টে সে প্রশ্ন করেছিল আব্বাস মির্জাকে মিসেস গুপ্ত তার মিত্র কিনা, উত্তর পেয়েছিল—জানি না। এই কারণেই মনের ভিতর থেকে বাধা পাচ্ছিল সে মিসেস গুপ্তের কাছে সরাসরি নিজের পরিচয় দিতে। নিঃসন্দেহ না হয়ে কিছু করা এখন বোকামি হবে। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। তোশক, বালিশ আনা নেয়া দেখল, ইয়েন ফ্যাঙকে দেখল—মাথার মধ্যে চিন্তা চলেছে, কিন্তু পরিষ্কার হচ্ছে না কিছুই।

পুরো একটি ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পরেও যখন মিসেস গুপ্ত আর ঘর থেকে বেরোল না, তখন পা টিপে চলে এল সে লাশ-লুকানো কামরার সামনে। হ্যান্ডেলে চাপ দিতেই খুলে গেল দরজাটা। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাতি জ্বেলে ভাল করে পরীক্ষা করল সে লাশ দুটো। ইয়েন ফ্যাঙকে চিনতে পারল সে। অপর লোকটা কে? বার্মিজ নয়। খুব সম্ভব ভারতীয়। অর্থাৎ গুপ্ত দম্পতির শত্রুপক্ষ নয়। আচ্ছা! এই লোকটাই সরোজ গুপ্ত নয় তো? কিন্তু তাহলে দাড়ি গেল কোথায়?

সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় শুয়ে আছে লোকটা। যত্নের সাথে সাজিয়েছে মিসেস গুপ্ত ঘটনাটা। হোমোসেক্‌ेয়াল স্যাডিস্ট-ম্যাসোশিস্টের কারবার। পিস্তলটা পড়ে আছে কার্পেটের উপর। নিশ্চয়ই ইয়েন ফ্যাঙের আঙুলের ছাপ রয়েছে এখন ওটার গায়ে। এখানে দেখবার আর কিছুই নেই। সাবধানে, ঘরের কোন কিছু স্পর্শ না করে বেরিয়ে এল সোফিয়া করিডরে, গুপ্ত দম্পতির স্যুইটের দরজায় কান পাতল, কিছুই শোনা গেল না, ফিরে এল আবার টয়লেটে।

ভোর বেলায় বেরিয়ে এল মিসেস গুপ্ত। হাতে আব্বাস মির্জার উদ্ধার করা ফাইল। লিফটে করে নেমে গেল সে নিচে। মুখে মৃদু হাসি। আব্বাস মির্জা কোথায়? খোঁজ করে দেখবে সে ঘরের ভিতর? এখন ও ঘরে না ঢোকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে স্থির করল সোফিয়া। একাধিক লোক থাকার সম্ভাবনা আছে ও ঘরে।

দু’জনের জন্যে চা নাস্তা নিয়ে বেয়ারা ঢুকল পাঁচশো আশি নম্বর কামরায়। কোন্ দু’জন? সরোজ গুপ্ত আর আব্বাস মির্জা, না, মিসেস গুপ্ত আর আব্বাস মির্জা? বেয়ারার প্রবেশ দেখেই বোঝা গেল ওই ঘরে অস্বাভাবিক কিংবা গোপনীয় কিছুই নেই। এত ভোরে বোর্ডার নয় এমন কোন লোককে ওই ঘরে দেখলে অস্বাভাবিক ঠেকবে বেয়ারার কাছে—কাজেই যুক্তি সঙ্গত ভাবেই ধরে নেয়া যায়, ওই কামরায় রয়েছে অসুস্থ সরোজ গুপ্তের ছদ্মবেশে আব্বাস মির্জা একা। সরোজ গুপ্ত মারা গেছে।

বোঝা যাচ্ছে, পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্ল্যান পরিবর্তন করেছে আব্বাস মির্জা। এখন প্রশ্ন, স্বেচ্ছায়, না, অনিচ্ছায়? ওকে কিছুই না জানিয়ে চলে যাবে লোকটা দেশ ছেড়ে, একটা খবর পর্যন্ত দেবে না, এমন হতেই পারে না। গত রাতে ফিরে আসার কথা ছিল আব্বাস মির্জার, কথা ছিল ফাইলটা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গুপ্তের হাতে তুলে দিয়ে ওরা যাবে মান্দালয়ে ওর বাবাকে উদ্ধার করতে। সবকিছু ভুলে গিয়ে হঠাৎ প্ল্যান বদলে ওকে একটা খবর পর্যন্ত না দিয়ে চলে যাবে লোকটা দেশ ছেড়ে একথা ভাবতেই পারে না সে। এমন অবশ্য হতে পারে যে হোটেলের কামরা থেকে ওর নাম্বারে ফোন করে ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে লোকটা। কেউ ফোন ধরেনি। কিন্তু তাহলে তো সোফিয়ার কোন বিপদ হয়েছে মনে করে খোঁজ খবর করাই স্বাভাবিক। অন্তত এই লোকটার পক্ষে কিছু না বলে পালিয়ে যাওয়া মোটেই স্বাভাবিক নয়। দেখা যাক কি হয়।

খানিক বাদে ফিরে এল মিসেস গুপ্ত। বেরিয়ে গেল বেয়ারা। আর বেশিক্ষণ এই টয়লেটে থাকা নিরাপদ নয়। যে কোন সময় এখন জমাদার এসে ঢুকতে পারে ঝাড়ু দেবার জন্যে। একবার করিডরের এপাশ ওপাশ দেখে নিয়ে বৈরিয়ে এল সোফিয়া। লিফট ব্যবহার করল না, সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। লাউঞ্জে বসে নাস্তা সারল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই নেমে এল মিসেস গুপ্ত। হুইল চেয়ার ঠেলে। মালপত্র নিয়ে আসছে পোর্টার।

অর্থাৎ চলে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে কাউন্টারের পাশে দাঁড়াল সোফিয়া। ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে মিসেস গুপ্ত। সরাসরি চাইল সে মিস্টার গুপ্তের দিকে। দাড়ি গোঁফ থাকা সত্ত্বেও আব্বাস মির্জাকে চিনতে একটুও কষ্ট হলো না সোফিয়ার। আশ্চর্য চোখ দুটো লুকাবে কোথায়? কেমন যেন একটা অভিমান উথলে উঠতে চাইল ওর বুকের ভিতর। ওকে কিছু না জানিয়েই চলে যাচ্ছে লোকটা।

হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারল সোফিয়া। মুখটা এমন ফ্যাকাসে কেন? চোখ দুটোই বা এমন ভাবে এপাশ ওপাশ নড়ছে কেন? মনে হচ্ছে, স্থির রাখতে পারছে না চোখের মণি। ড্রাগড়? কোন ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে ওকে?

মিসেস গুপ্তের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে মান্দালয়ে যাচ্ছে ওরা। কেন? এখান থেকে সোজা ব্যাংকক যাওয়ার কথা। তা না গিয়ে মান্দালয়ে চলেছে কেন? চোখের পাপড়ি ছাড়া আব্বাস মির্জার সারা শরীরে বিন্দুমাত্র প্রাণের চিহ্ন নেই কেন?

পর পর তিনবার চোখের পাপড়ি ফেলল লোকটা। কিছু একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে? আবার তিনবার পড়ল চোখের পাপড়ি। কি বোঝাতে চাইছে আব্বাস মির্জা? এখন হৈ-চৈ করে প্রকাশ করে দেবে সে সবকিছু? ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার জন্যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, নাকি অনুসরণ করতে বলছে ওকে। কি করা উচিত এখন?

এখন গোলমাল করলে দুটো খুনের সাথে জড়িয়ে গিয়ে মহা ঝামেলায় আটকে যেতে পারে ওরা। কাজেই গোপনে অনুসরণ করাই স্থির করল সে। আবছা ধারণা নিয়ে কোন কাজ করা উচিত হবে না। যখন পরিষ্কার বুঝতে পারবে কি করা উচিত, কেবল মাত্র তখনি কিছু একটা করার চেষ্টা করবে সে। যেন কিছুই দেখেনি, কিছুই বোঝেনি এমনি ভাব করে দাঁড়িয়ে রইল সে। মিসেস গুপ্তের ট্যাক্সি ছেড়ে দিতেই বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল সে হোটেল থেকে।

স্টেশনের পথে একটা গাঢ় রঙের সানগ্লাস আর ছোট্ট একটা অটোমেটিক ড্রিল কিনল সে ট্যাক্সি থামিয়ে। স্টেশনে পৌছে লোকজনের ভিড়ে মিশে অপেক্ষা করল মিসেস গুপ্তের জন্যে। বুঝতে পেরেছে সোফিয়া, মস্ত বিপদে পড়েছে এখন আব্বাস মির্জা, খুব সম্ভব আবার উ-সেনের লোকের হাতে তুলে দিতে নিয়ে চলেছে ওকে মিসেস গুপ্ত কোন ওষুধের সাহায্যে কাবু করে। কাজেই এখন প্রতিটা পদক্ষেপ সাবধানে ফেলতে হবে ওকে, নইলে মহা বিপদ হবে আব্বাস মির্জার।

এল ওরা। টিকেট কনফার্মেশন হয়ে যেতেই ট্রেনে তোলা হলো আব্বাস মির্জার ইনভ্যালিড চেয়ার। কুলি দু’জন এবার ল্যাগেজ নিয়ে যাচ্ছে। মিসেস গুপ্ত রয়ে গেছে ট্রেনের ভিতরেই।

কুলিদের পিছু পিছু ট্রেনে উঠল সোফিয়া। কোন্ কম্পার্টমেন্টে ঢুকল ওরা লক্ষ্য করল। একজন রেল কর্মচারী রিজার্ভড্ লেখা একটা প্লাস্টিক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিচ্ছে মিসেস গুপ্তের কম্পার্টমেন্টে। ঠিক পাশের কম্পার্টমেন্টে বসে পড়ল সোফিয়া। মাঝারী কম্পার্টমেন্ট। ছয় সাতজন যাত্রী, সবাই পুরুষ।

খানিকক্ষণ পরই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হন্তদন্ত হয়ে গার্ডকে ডাকতে ডাকতে ছুটে গেল পিছন দিকে একজন ভদ্রলোক পাশের কামরা থেকে বেরিয়ে। ভিড়ের সাথে মিশে গেল সোফিয়া, দাঁড়িয়ে রইল রিজার্ভড্ কামরার দরজার সামনে উৎসুক দর্শকদের জটলায়।

গার্ড এসে দরজা খুলতেই প্রথম চোখ পড়ল সোফিয়ার মিসেস গুপ্তের উপর, তারপর আব্বাস মির্জার উপর। মেঝেতে পড়ে থাকা সিরিঞ্জটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওর, ওপাশের সীটের উপর রাখা কেসটাও চোখ এড়াল না। বজ্রমুষ্ঠিতে ধরে আছে আব্বাস মির্জা, মিসেস গুপ্তের চোখে পানি, গার্ডকে দেখে আব্বাস মির্জার হতাশ ভঙ্গি, মিসেস গুপ্তের স্বস্তি—সবই দেখে ফেলল সে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই।

আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না ওর। সব লোককে আব্বাস মির্জার ইয়টে তুলে দেশে পাঠিয়ে দেয়ায় নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো ওর। মস্ত বোকামি হয়ে গেছে। আজকে জনা দশেক লোক থাকলে এখন আব্বাস মির্জাকে উদ্ধার করা দশ মিনিটের কাজ ছিল। এক্ষুণি হুড়মুড় করে ঢুকে তুলে নিয়ে গেলে কারও কিছু করবার সাধ্য ছিল না।

যাই হোক, এখন সেকথা ভেবে কোন লাভ নেই।

হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে আব্বাস মির্জার নির্দেশে সবাইকে দেশে পাঠিয়ে দেয়াই উচিত হয়েছে। না বুঝে তো আর নির্দেশ দেয়নি লোকটা। এখন ওর কর্তব্য হচ্ছে যে করে হোক কৌশলে আব্বাস মির্জাকে উদ্ধার করা। কিন্তু কিভাবে?

বাথরূমে ঢুকল সোফিয়া ট্রেনটা চালু হতেই।

এক ইঞ্চির আট ভাগের তিন ভাগ ব্যাসের একটা আগর বিট লাগাল সে অটোমেটিক ড্রিলের মাথায়। ঠিক কোন্ অ্যাঙ্গেলে ড্রিল করলে পাশের কামরার বেশির ভাগ অংশ চোখে পড়বে আন্দাজ করে নিয়ে শুরু করল সে কাঠ খোঁড়া। খুব ধীরে ধীরে চাপ দিচ্ছে সে ড্রিলের হ্যান্ডেলে। এক সুতো, দুই সুতো করে ঢুকতে শুরু

করল আগর বিট বাথরুমের কাঠের ভিতর। ছোট্ট একটা ফুটো হয়ে গেল দুই মিনিটের মধ্যেই। ঠিক তিন ইঞ্চি দূরে আরেকটা ফুটো করল সে একই মাপের। ভিতরের দৃশ্য দেখার জন্যে অতটা তাড়া বোধ করল না সে। প্রথমেই কাঠের গুঁড়োগুলো ফেলে দিল সে কমোডের ফোকড় দিয়ে, সামান্যতম এক আধ কণাও যেন না থাকে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য দিল। কারও সন্দেহ যাতে না হয়, সেদিকে যত্ন নিতে হবে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে যখন নিশ্চিন্ত হলো, তখন ছোট্ট ফুটো দুটোতে চোখ রাখল সোফিয়া।

ভিতরের দৃশ্য দেখে চক্ষুস্থির হয়ে গেল ওর।

মিনিট খানেক চেয়ে থেকে কান গরম হয়ে উঠল ওর। দ্রুত হাতে আব্বাস মির্জার কাপড় খুলছে নগ্ন মিসেস গুপ্ত। মহিলা নিঃসন্দেহে পারভার্টেড। চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো সোফিয়া দু’মিনিট পর। কপাল ঘেমে গেছে ওর। হার্ট বিট বেড়ে গেছে। ঢিব ঢিব শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে নিজেই। বার দুই শিউরে উঠল শরীরটা আপনা আপনি। আবার চোখ রাখল সে ফোকড়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখল দুই মিনিট। শিরশির করছে শরীরটা। দুই কান, গাল গরম হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে ভাপ বেরোচ্ছে নাক দিয়ে। ছিটকে সরে এল সোফিয়া। এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে দূর করে দেয়ার চেষ্টা করল কুৎসিত দৃশ্যটা মন থেকে।

খেয়াল হলো, এতক্ষণ বাথরূমে থাকাটা ঠিক শোভন হচ্ছে না। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে বসল সে সীটে। চোখের সামনে ভাসছে পাশের কম্পার্টমেন্টের দৃশ্যটা। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কাগজ কিনল একটা, কিন্তু মন বসাতে পারছে না কাগজে। ছটফট করছে সোফিয়া। বারো ঘণ্টা সময় কাটাবে কি করে সে?

আধঘণ্টা পর আবার গিয়ে ঢুকল সে বাথরূমে। মড়ার মত পড়ে আছে আব্বাস মির্জা। বুক পর্যন্ত একটা শাড়ি দিয়ে ঢাকা। মিসেস গুপ্তের শরীরে কোন পরিচ্ছদ নেই। পায়ের উপর পা তুলে কাত হয়ে বসে আছে পাশের সীটে, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মেয়েলোকটার আশ্চর্য সুন্দর ফিগার দেখে হিংসে হলো সোফিয়ার। শরীরের কোথাও বাড়তি বা কমতি কিছু নেই, ঠিক যেখানে যেমনটি দরকার তাই দিয়েছে ওকে বিধাতা। আশ্চর্য রূপ মহিলার লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আব্বাস মির্জার দিকে। বিশ্রাম নিচ্ছে।

বেরিয়ে এল সোফিয়া। কেমন একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে ছয়জন পুরুষ সহযাত্রীর সামনে ইতোমধ্যেই দুইবার বাথরূমে ঢোকার জন্যে। সামান্য একটু মাথা ঝাঁকিয়ে দূর করে দিল সে লজ্জাটা—একশো বার বাথরূমে গেলেই বা কার কি?

পেগু জংশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেল সোফিয়া।

স্টেশনের গায়ে লাগানো পোস্ট অফিস থেকে ফোন করল মান্দালয়ে ওর এক বান্ধবীর কাছে, স্টেশনে গাড়ি পাঠাবার জন্যে। ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে এসে উঠল আবার গাড়িতে গোটা দুয়েক ইংরেজী থ্রিলার হাতে নিয়ে। ঘণ্টা খানেক পর আবার ঢুকল সে বাথরূমে।

আবার সেই দৃশ্য। কিন্তু এবার দুই একটা টুকরো কথা ভেসে আসছে। ফুটোয় কান পাতল সৈাফিয়া।

‘….ভালই করেছ। বেঁচেছি আমি। উ-সেনের কাছে নিজেকে আমার নিতান্ত নগণ্য একটা পণ্য সামগ্রী মনে হত। ওর তুলনায় আমি কিছুই না। ওর মৃত্যুতে খুশি হয়েছি আমি, এখন আমি মুক্ত। কিন্তু উন্নতির চরম শিখরে উঠে যখন সে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করছে, তখন তোমার মত একজন অতি সাধারণ লোক, উ-সেনের তুলনায় কানা কড়ির যোগ্যতাও যার নেই, হঠাৎ এসে হাজির হয়ে এক সন্ধ্যার মধ্যে তাকে হত্যা করে বেরিয়ে আসতে পারল, এটা আমার ভয়ানক খারাপ লাগছে। নিজেকে আরও ছোট মনে হচ্ছে অযোগ্য লোকের অধীনে এতদিন কাজ করেছি বলে। মনে মনে কৃতজ্ঞ ছিলাম, ওর অতুলনীয় প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করতাম আমি, কিন্তু এত ঘৃণাও বোধ হয় পৃথিবীতে আর কাউকে করতাম না আমি। মৃত মানুষের বিরুদ্ধে কিছু বলতে নেই, কিন্তু প্লাস্টিক সার্জারীর পর একটি বছর আমার শরীরটা নিয়ে যা খুশি তাই করেছে সে, ওর বিকৃত কামনার লোলুপতা দেখে নিয়েছি আমি সেই একটি বছর। কি পাশবিক অত্যাচার সহ্য করেছি আমি বারোটা মাস তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আকর্ষণ কমে যেতেই ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি সে, আমাকে ব্যবহার করেছে আজ এর পিছনে কাল ওর পিছনে কুৎসিত এক গণিকার ভূমিকায়। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে সরোজের ঘাটে এসে ভিড়ল আমার তরী। বেঁচে থাকার অন্য অর্থ শিখলাম আমি ওরই কাছে।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। আবার ফুটোতে চোখ রাখতে যাচ্ছিল সোফিয়া, এমনি সময়ে ভেসে এল মিসেস গুপ্তের কণ্ঠস্বর। ‘আমি জানি, তোমাকে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে না দিয়েও আমার প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। ইচ্ছে করলে তোমার মাধ্যমেই তোমাদের সরকারের সাহায্য নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু এই পথটাই বেছে নিলাম দুটো কারণে। প্রথমত : আমি ল্যান্ড অভ প্যারাডাইসে যেতে চাই। সোনার দেশ আমেরিকা, আমার স্বপ্নের দেশ। তোমার সাহায্যে সেখানে যেতে পারতাম না আমি। আর দ্বিতীয়ত: কথাটা শুনতে অদ্ভুত লাগবে, কিন্তু এটাই আসল সত্য, উ-সেনের প্রেমে পড়েছিলাম আমি। উ-সেনই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। ওর সমস্ত অত্যাচার হাসি মুখে সহ্য করতে পারতাম আমি যদি না আমাকে দূর করে দিয়ে স্যুই থিকে নিয়ে ও ঢলাঢলি করত।

যদি না আমাকে সামান্য এক পণ্য হিসেবে গণ্য করত। একথা জানত উ-সেন, আমার অকৃত্রিম ভালবাসা মনে মনে উপভোগও করত, সেজন্যেই বিশ্বাস ভঙ্গ করবার পরও ডক্টর হুয়াং আর স্যুই থির অনুরোধ ঠেলে কাজে বহাল রেখেছিল আমাকে। তুমি উ-সেনের হত্যাকারী—তোমার সর্বনাশ না করা পর্যন্ত শান্তি হবে না আমার।

বেরিয়ে এল সোফিয়া। চোখাচোখি করল দুজন অল্প বয়সী যাত্রী। থ্রিলারে মন দিল সোফিয়া ওদের উপেক্ষা করে। ধীরে ধীরে কথা বার্তা শুরু করেছে যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে। কে কোথায় কি করে ইত্যাদি দিয়ে শুরু হলো প্রাথমিক আলাপ। বই পড়ায় ব্যস্ততার ভান করে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল সোফিয়া সবাইকে। যুবকদের একজন বাথরূম হয়ে এল। ফুটো দুটো লক্ষ্য করল কিনা কে জানে। বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল সোফিয়া। একটা কিছু প্ল্যান তৈরি করবার চেষ্টা করছে সে মনে মনে।

সাড়ে বারোটা নাগাদ চতুর্থ বারের মত সোফিয়া ঢুকল বাথরূমে। উপেক্ষা করল যুবক দুজনের মুচকি হাসি। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এছাড়া আর উপায় কি? এখনও জানতে পারেনি সে যা জানতে চায়।

এতক্ষণে কপাল ফিরল সোফিয়ার! কসমেটিক কেসটা নামাচ্ছে মিসেস গুপ্ত। ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সটা বের করছে ওর ভিতর থেকে, সেই সাথে কথা বলছে। কান পাতল সোফিয়া।

‘…আছে। লাইটিক ককটেলের প্রভাব দূর হয়ে যাবে দুই মিনিটের মধ্যেই। যদি দেখি ওদের সাথে নেগোসিয়েশন ঠিক পথে যাচ্ছে না, তখন প্রয়োজন মনে করলে কোন এক সুযোগে এই ওষুধটা ইঞ্জেক্ট করব আমি তোমার শরীরে। ওদের সাথে কোন কারণে পড়তা না পড়লে তোমার সাহায্য দরকার হতে পারে আমার নিরাপদে বেরিয়ে আসার জন্যে। বুঝতে পেরেছ?’ কথা বলতে বলতে একটা শিশি থেকে ওষুধ নিল মিসেস গুপ্ত সিরিঞ্জে, এগিয়ে গেল আব্বাস মির্জার দিকে। আরও খানিক পরে দিলেও চলত, কিন্তু একবার যা দেখিয়েছ, তারপর আর কোন রকম রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। উপুড় করল সে আব্বাস মির্জার নগ্ন শরীরটা। সে নিজেও নগ্ন। পিঠে, শিরদাঁড়ার কাছাকাছি ঢুকিয়ে দিল সূচটা। সিরিঞ্জটা যথাস্থানে তুলে রাখল। বলল, ‘এবার এসো, আরেক বাউট হয়ে যাক, তারপর দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে আসব রেস্টুরেন্ট- কার থেকে।’ এগিয়ে গেল সে আব্বাস মির্জার দিকে।

চোখ সরিয়ে নিল সোফিয়া। বাথরুম থেকে বেরিয়েই বয়স্ক টাক পড়া এক ভদ্রলোকের কথা কানে গেল ওর। ভদ্রলোক বেশ জমিয়ে ফেলেছেন সহযাত্রীদের সাথে, ছোকরা দুটোও অবাক হয়ে গেছে তাঁর পাণ্ডিত্যের বহর দেখে, হাঁ করে গিলছে কথাগুলো।

..গ্লুকোজ। শরীরটা আর গ্লুকোজ অ্যাবযব করতে পারে না বলে রক্তের মধ্যে জমা হতে থাকে শুগার, এজন্যে ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ড ঠিক মত কাজ করতে পারে না, ফলে মৃত্যু হয় রোগীর সঠিক চিকিৎসা না হলে। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম প্রমাণ হলো, প্যানক্রিয়াসের সাথে এই রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। প্যানক্রিয়াস হচ্ছে পাকস্থলীর পিছনে, অ্যাবডোমেনের ঠিক এই জায়গাটায় অবস্থিত একটা বড় সড় গ্ল্যান্ড। ইতর প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেল এই গ্ল্যান্ডটা কেটে বাদ দিয়ে দিলেই এই রোগের আক্রমণ হয় প্রায় তৎক্ষণাৎ। আরও পরে জানা গেল প্যানক্রিয়াসের কয়েক গুচ্ছ সেল থেকে এক জাতীয় হরমোন তৈরি ও সিক্রিশন হয়ে রক্তের সাথে মেশে, এবং এই হরমোনই গ্লুকোজ অ্যাব্যবশনে সাহায্য করে। এর নাম দেয়া হলো ইনসুলিন হরমোন।

এতক্ষণে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করতে পেরে দুই কান লাল হয়ে উঠল সোফিয়ার। মাথাটা নিচু হতে হতে বইয়ের সাথে নাক ঠেকবার উপক্রম হলো ওর। কিন্তু বিদ্বান লোকটির সেদিকে খেয়াল নেই। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন তিনি:

‘১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে ডক্টর ব্যান্টিং ও প্রফেসর ম্যাকলিওড ইতর প্রাণীর প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন বের করে নেয়ার কৌশল আবিষ্কার করলেন। নোবেল প্রাইজ পেলেন ওঁরা এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্যে। আজকের দিনে ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র আর ততটা ভয়ঙ্কর অসুখ নয়। প্রোটামাইম-যিংক ইনসুলিনের একটা ইঞ্জেকশনেই যে কেউ নিশ্চিন্ত থাকতে পারে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে। কিন্তু তাই বলে ডোজ বাড়িয়ে দেবার উপায় নেই। ইনসুলিনের মাত্রা বেশি পড়ে গেলে আবার শুগার স্টার্ভেশন দেখা দেবে। ঘর-বাড়ি দুলবে চোখের সামনে, সর্বশরীর কাঁপতে শুরু করবে, চোখের তারা এক জায়গায় স্থির থাকবে না,—মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে এর ফলে। আসল কথা, রক্তের মধে শর্করার পরিমিতি রক্ষা করতে হবে। তাহলেই স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মত চলাফেরা করতে পারবে যে কোন ডায়াবেটিস রুগী।’ কেউ যাতে মনে না করে যে ওর বক্তব্য শেষ হয়ে গেছে, সেজন্যে শাসনের ভঙ্গিতে এক আঙুল তুললেন বৃদ্ধ। আরও কথা আছে। কথা বলেই চললেন তিনি। ‘পাগল চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ইনসুলিন দারুণ কার্যকরী ওষুধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। হরদম ব্যবহার হচ্ছে পাগলা গারদে। যার ডায়াবেটিস নেই, এমন পাগলের ভেইনে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিলে তীব্র একটা শক পাবে ওর শরীর, জ্ঞান হারাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই, শুরু হয়ে গেল শুগার স্টার্ভেশন।—কিছুক্ষণ এভাবে রেখে তারপর গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন দিলে দেখা যায় অনেক ধরনের পাগলামি সেরে যায়। এসব অবশ্য এক্সপার্ট ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া করতে গেলে মারা যেতে পারে রুগী। তবে…’

বক বক করে চললেন পণ্ডিত বৃদ্ধ। যেন কিছুই শুনতে বা বুঝতে পারছে না এমনি ভাবে বই পড়ে চলল সোফিয়া।

আধঘণ্টা পর আড় চোখে দেখতে পেল সে পাশের কামরা থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্ট-কারের দিকে চলে গেল মিসেস গুপ্ত। এক মিনিট আন্দাজ সময় দিয়ে উঠে দাঁড়াল সোফিয়া। বেরিয়ে এল করিডরে। মিসেস গুপ্তের লাল শাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল রেস্টুরেন্ট-কারের দরজা দিয়ে। চট করে ঢুকে পড়ল সোফিয়া রিজার্ভড় কম্পার্টমেন্টের ভিতর।

চোখ মেলে শুয়ে আছে আব্বাস মির্জা। বুক পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা। খোলা দুই চোখে স্পষ্ট বিস্ময় দেখতে পেল সে। দ্রুত কাজ সারতে হবে এখন।

প্রথমেই হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কোটটা সরিয়ে দিল সোফিয়া। ঢাকা পড়ল দেয়ালের গায়ের ছোট্ট গর্ত দুটো। কসমেটিক কেসটা নামিয়ে ছোট বাক্সটা বের করে রাখল সে সীটের উপর। বাক্সের মধ্যে দুটো একই মাপের শিশি, আর একটা গোল বলের মত কাচের কি একটা জিনিস। একটা শিশির গায়ে লেবেল আছে, অপরটা লেবেলহীন। লেবেলের গায়ে শুধু একটা শব্দ লেখা—লাইটিক। অর্থাৎ, লেবেলহীন শিশির ভিতর রয়েছে লাইটিকের প্রভাব মুক্ত করার ওষুধ। এই ওষুধটা ইঞ্জেক্ট করলেই দুই মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে আব্বাস মির্জা। দুই মিনিটের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে না মিসেস গুপ্ত? তবু দরজাটা সামান্য ফাঁক করে একবার দেখে নিল সে করিডরটা।

বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আব্বাস মির্জা। দ্রুত হাতে সিরিঞ্জের মধ্যে খানিকটা ওষুধ টেনে নিল সোফিয়া লেবেলহীন শিশি থেকে। ইঞ্জেকশন দিতে তেমন কোন অসুবিধে হলো না, সূচ ফোটানোর দাগ রয়েছে পিঠে, ঠিক সেই বরাবর ঢুকিয়ে দিয়ে টিপে দিল সোফিয়া। সিরিঞ্জটা বাক্সের ভিতর রেখেই মনে পড়ল ওর হ্যান্ডব্যাগে রাখা পিস্তলটার কথা। হুইল চেয়ারের গদির নিচে রেখে দিল সে আব্বাস মির্জার দেয়া স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন। চট করে দরজাটা খুলে চোখ রাখল বাইরে।

ভয়ানক ভাবে চমকে উঠল সোফিয়া। ফিরে আসছে মিসেস গুপ্ত। উদ্‌ভ্রান্তের মত এদিক ওদিক চাইল সে। বলল, ‘ধরা পড়ে গেলাম বোধহয়। ফিরে আসছে মেয়েলোকটা। দরজা খুলেই দৌড় দেব আমি। পিস্তলটা রইল ওই চেয়ারের গদির নিচে। যেমন ভাল বুঝবেন করবেন।

হঠাৎ আশ্চর্য ভাবে সহায় হলো সোফিয়ার ভাগ্য। একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে কে যেন ডাকল মিসেস গুপ্তকে। থেমে দাঁড়িয়ে সেই কামরায় গিয়ে ঢুকল সে। সীটের উপর রয়েছে কসমেটিক কেসটা, কোটটা আগের জায়গায় রাখা হলো না, সময় নেই। এক্ষুণি এসে পড়বে মহিলা। করিডরে বেরিয়ে এল সোফিয়া। ধীর পায়ে চলে গেল রেস্টুরেন্ট-কারের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *