রক্তের রঙ ২.৪

চার

ঝড়ের মত ঢুকে ঝটপট কাজ সেরে ঝড়ের মতই বেরিয়ে গেল সোফিয়া।

রানা বুঝল, নানকিং হোটেলে ওকে ঠিকই চিনতে পেরেছিল মেয়েটা, ফলে পিছু নিয়েছে; কোন কৌশলে জানতে পেরেছে লাইটিক ককটেলের কথা, ফ্যান সু গুপ্ত কামরা ছেড়ে বেরোতেই ছুটে এসেছে রানাকে উদ্ধার করতে। এখন দুটো মিনিট সময় দরকার। দুই মিনিট সময় পেলেই অবস্থা আয়ত্তে এসে যাবে ওর। আসছে মিসেস গুপ্ত—কামরায় ঢুকেই কি সে টের পেয়ে যাবে যে লাইটিকের প্রভাব কেটে যাচ্ছে রানার শরীর থেকে?

খুলে গেল দরজা। কামরায় ঢুকেই থমকে দাঁড়াল মিসেস গুপ্ত। ভুরু জোড়া কুঁচকে গেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রানাকে পরীক্ষা করল সে, চোখ জোড়া সরে গেল ওপাশের সীটের উপর নামিয়ে রাখা ডালা খোলা কসমেটিক কেসটার উপর। পাশেই পড়ে আছে ছোট বাক্সটা। সারাটা কামরা ঘুরে এসে আবার স্থির হলো দৃষ্টিটা রানার চোখের উপর

দরজা লাগিয়ে দিয়ে ছুটে গেল সে কসমেটিক কেসটার কাছে। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে সে। ছোট বাক্সটা খুলে প্রথমেই সিরিঞ্জটা শুঁকে দেখল সে। লেবেল লাগানো শিশিটা হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল, মুখটা খুলে গন্ধ শুঁকল, তারপর বাক্সে ভরে রেখে দিল কসমেটিক কেসের ভিতর। এবার রানার একটা চোখের পাতা দুই আঙুলে যতদূর সম্ভব ফাঁক করে পরীক্ষা করল সে। তারপর হাসল।

মনে মনে হিসেব করে দেখল রানা দুই মিনিট পার হয়ে গেছে। ওষুধের প্রভাবটা কেটে যাওয়ার সাথে সাথেই প্রথমে কি করবে, তারপর কি করবে সব ঠিক করা আছে ওর; কিন্তু চেষ্টা করেও এক ইঞ্চিও নড়াতে পারল না সে হাত বা পা। মিথ্যে কথা বলেছিল নাকি মেয়েলোকটা?

‘বোঝা যাচ্ছে, এই ট্রেনে তোমার অন্তত একজন মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বন্ধু রয়েছে। বন্ধু না বলে বান্ধবী বলাই বোধহয় ভাষার দিক থেকে বেশি শুদ্ধ। দারুণ এক্সপার্ট মেয়ে বোঝা যাচ্ছে। তবে গার্ডের ডাকে ওপাশের একটা কামরায় না ঢুকলে খুব সম্ভব হাতে নাতেই ধরতে পারতাম ওকে।

কামরার চারপাশের দেয়ালে চোখ বুলাল মিসেস গুপ্ত। বলল, ‘কিন্তু কোনখান থেকে চোখ রাখছে ও আমাদের উপর? তোমার কোটটা দুই আঙটা সরানো হয়েছে কেবল, এছাড়া ঘরের আর কিছুই এদিক ওদিক করা হয়নি। কাজেই আমার বিশ্বাস, ওইখানেই কোন ফুটোয় কান পেতে শুনেছে ও আমার কথাবার্তা। দেখেছে সবকিছু।’

কোটটা সরিয়ে ফুটোয় চোখ রাখল মিসেস গুপ্ত, তারপর সরে এল।

‘যা ভেবেছিলাম তাই। কিন্তু আর কোন সুযোগ পেতে হচ্ছে না। আর এক মিনিটের জন্যেও চোখের আড়াল করছি না আমি তোমাকে। প্ৰয়োজন হলে পুলিসের সাহায্য নেব। চিনেছি আমি ওকে নানকিং হোটেলেই।

খাবার নিয়ে এল বেয়ারা।

খাবারের গন্ধে জিভে পানি এসে গেল রানার। ভয়ানক খিদে পেয়েছে। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। গোগ্রাসে গিলল মিসেস গুপ্ত। বিল চুকিয়ে মোটা বকশিশ দিল বেয়ারাকে। তারপর দরজা বন্ধ করে এসে আরাম করে পাশের সীটে বসে সিগারেট ধরাল।

রাত আটটা।

অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পৌছল ট্রেন মান্দালয়ে।

সোফিয়াকে কোথাও দেখতে পেল না রানা। প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকা স্যুই থিকে দেখতে পেল।

‘ইনি আমার স্বামী, মিস্টার সরোজ গুপ্ত,’ পরিচয় করিয়ে দিল ফ্যান সু গুপ্ত। আর এর কথা তো তোমাকে বহুবার বলেছি সরোজ, এ-ই সেই সুন্দরী স্যুই থি।

কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতা টেনে আনার চেষ্টা করল মিসেস গুপ্ত, কিন্তু রানা বুঝল, সাপে নেউলে সম্পর্ক ওদের দুজনের মধ্যে। বিষ নজরে দেখছে, দুজন দুজনকে। এক বিন্দু হাসি নেই স্যুই থির মুখে। গম্ভীর ভাবে নিরাসক্ত কণ্ঠস্বরে বলল, ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’ কুলিদের ইঙ্গিত করল এগোবার জন্যে, নিজে ও পা বাড়াল সামনের দিকে। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল একবার মিসেস গুপ্তের মুখ, বলল, ‘সবাই অপেক্ষা করছে তোমার বক্তব্য শোনার জন্যে। যতটা দাবি করছ ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য না থাকলে এখান থেকে কেটে পড়াই তোমার পক্ষে মঙ্গল বলে মনে করি।’

‘উপদেশের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যুই।’ তরল কণ্ঠে বলল মিসেস গুপ্ত ‘কিন্তু তোমার উপদেশ ছাড়াই বহুদূর চলে এসেছি আমরা। দোরগোড়া থেকে ফিরে যেতে আসিনি। কি হয়েছিল রেঙ্গুনে বলো তো?’

‘তোমাকে কিছু বলবার হুকুম নেই। আমার কাজ তোমাদের স্টেশনে রিসিভ করে আস্তানা পর্যন্ত পৌছে দেয়া।’

‘পাকিস্তানী জেনারেলকে অনুরোধ করেছিলাম থাকবার জন্যে, তিনি আছেন তো? এটুকু জানাতে বারণ করেনি নিশ্চয়ই কেউ?’

আছেন। জরুরী কাজ ফেলে অপেক্ষা করছেন তোমার বক্তব্য শোনার জন্যে।

কুলিদের সাহায্যে গাড়িতে তোলা হলো রানাকে। সিক্সটি নাইন মডেলের মার্সিডিস বেঞ্জ। গাড়ি ছেড়ে দিল স্যুই থি। প্রায় নির্জন রাস্তা। এক আধটা গাড়ি ছাড়া রাস্তায় লোকজন নেই। ঝম ঝম বৃষ্টি, আর সেই সাথে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক। ওয়াইপার চলছে, কিন্তু তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না পথঘাট।

‘উ-সেনের লাশ কি করেছ?’ আবার প্রশ্ন করল মিসেস গুপ্ত।

‘শোক মিছিলে শরিক হতে এসেছ বুঝি?

‘উ-সেন কেবল একা তোমার সর্দারই ছিল না, আমারও ছিল।

‘কেবল সর্দারই নয়, আরও কিছু। তাই না?’ মুচকি হাসল স্যুই থি তোমার আমার মধ্যে মিল আছে এই একটা ব্যাপারে।

‘কিন্তু তোমার মধ্যে তেমন শোকের ছায়া দেখতে পাচ্ছি না, স্যুই থি।’

‘তোমার মধ্যেও না।’ রানার দিকে চাইল সে। ‘তোমার স্বামী খুবই চুপচাপ মানুষ দেখছি?’

‘ওর শরীর খারাপ। ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে হয়েছে।’

আর কিছুই বলল না স্যুই থি। চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে রিয়ার ভিউ মিররের দিকে চাইছে। হঠাৎ স্পীড বাড়িয়ে দিল সে। বলল, ‘কাউকে পিছু লাগিয়েছ নাকি, ফ্যান সু?’

‘না তো! কি ব্যাপার?’ কথাটা বলেই হঠাৎ সচকিত হয়ে পিছন দিকে চাইল মিসেস গুপ্ত।

দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি। একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে পিছনের ড্রাইভার। পাশাপাশি এসে পড়ল গাড়িটা, এবার ওভারটেক করছে। লাল একটা ওপেল রেকর্ড। অস্পষ্ট আলোতেও পরিষ্কার চিনতে পারল মিসেস গুপ্ত। বিস্ফারিত চোখে দেখল ওই গাড়ির বেপরোয়া ড্রাইভার আর কেউ নয়—সেই অ্যাংলো মেয়েটা। সামান্য একটু সামনে এগিয়েই বাঁয়ে চাপতে শুরু করল লাল গাড়িটা।

‘বাঁয়ে কাটো! স্যুই থি! অ্যাকসিডেন্ট করবে ওই গাড়িটা! ও আমাদের থামাবার চেষ্টা করবে।

পাকা ড্রাইভার স্যুই থি। আধ মিনিট আর এগোতে দিল না পাশের গাড়িটাকে। বরং বেশি চেপে এসেছিল বলে ঝট করে ডাইনে স্টিয়ারিং কেটে ছোট্ট একটা গুঁতো মারল ওপেলের পেট বরাবর। সরে গেল লাল গাড়িটা, কিন্তু স্পীড কমল না একটুও। যতদূর যায় ততদূর টিপে ধরেছে সোফিয়া অ্যাক্সিলারেটর। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সে সামনে। পাগলের মত চালাচ্ছে গাড়ি।

হঠাৎ স্টিয়ারিং কাটল স্যুই থি। বিপজ্জনক একটা শার্প টার্ন নিয়ে ঢুকে গেল বাম পাশের অন্ধকার গলিতে। ‘কেঁউ’ করে আর্তনাদ করে উঠল একটা কুকুর, চাপা পড়ল চাকার তলায়। পিছন ফিরে দেখল মিসেস গুপ্ত, এ গাড়ির সাথে সাথে টার্ন নিয়েছিল লাল গাড়িটা। কিন্তু প্রস্তুত ছিল না বলে দেরি করে ফেলেছে এক সেকেন্ড। সামলাতে পারল না। প্রচণ্ড বেগে গিয়ে ধাক্কা খেল একটা দোকানের দেয়ালের সাথে।

‘গাড়ি থামাও, স্যুই। ধরে আনি হারামজাদিকে

গাড়ি থামাবার কোন লক্ষণই দেখা গেল না স্যুই থির মধ্যে। বলল, ‘তুমি চেনো ওকে?’

‘চিনি না, কিন্তু রেঙ্গুন থেকে অনুসরণ করে এসেছে ও আমাকে। ওকে এঁরা দরকার।‘

‘ধরা যাবে। মান্দালয়ে লাল ওপেল রেকর্ড খুব বেশি নেই। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট করবার চেষ্টা করছিল কেন ও?’

কেন ও কি করছে ওর কাছ থেকেই জানা যেত,’ বিরক্ত হয়ে জিভ দিয়ে পা।’ শব্দ করল মিসেস গুপ্ত। দলের লোক হয়েও আমাকে কেন এত সন্দেহ করছ বুঝতে পারছি না আমি, স্যুই।’

‘সবই বুঝতে পারবে তুমি, ফ্যান সু। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। এবং সম্ভবত আমাদের কাছেও।‘

বার কয়েক মোড় ঘুরে আবার বড় রাস্তায় উঠে এল মার্সিডিস টু টোয়েন্টি। রাস্তাঘাট কিছুই চিনতে পারছে না রানা। বাঁকগুলো টের পাচ্ছে কেবল। ওর মনে হচ্ছে গোলক ধাঁধার রাস্তায় অনন্তকাল ধরে ওরা শুধু চলছে তো চলছেই। পথ আর ফুরাচ্ছে না। ওদিকে সোফিয়ার কি অবস্থা কে জানে।

মিনিট দশেক পর ঠিক রেঙ্গুনের ইয়ান লাও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মত দেখতে একটা প্রকাণ্ড দালানের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা। ঠিক একই আর্কিটেকচারাল ডিজাইন, তবে এটা এগারোতলা। আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কে গাড়িটা থেমে দাঁড়াতেই দু’পাশ থেকে দু’জন লোক এগিয়ে এল। এক নজরেই বোঝা যায় দুজনই সশস্ত্র। কেবল সশস্ত্রই নয়, সতর্কও। ইনভ্যালিড চেয়ারে তুলে দেয়া হলো রানাকে। ওটা ঠেলার ব্যাপারে কেউ সাহায্য করল না মিসেস গুপ্তকে, পিছু পিছু এল লিফট পর্যন্ত, কিন্তু লিফটে উঠল না প্রহরী দুজন।

নাইনথ ফ্লোরে পৌঁছে লিফটের দরজা খুলে যেতেই আরও দুজন সশস্ত্র প্রহরীর দেখা পাওয়া গেল। পিছু পিছু এল ওরা ড্রইংরুম পর্যন্ত, দাঁড়িয়ে রইল জায়। ড্রইংরুমে বসে আছে ডক্টর হুয়াং, জেনারেল এহতেশাম এবং কর্নেল শেখ। উঠে দাঁড়াল সবাই।

পরিচয়ের পালা সারা হলো সংক্ষেপে।

কর্নেল শেখ বলল, ‘আপনার স্বামীর শরীরটা ভাল নেই মনে হচ্ছে?’

‘ও বলছে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে।’ বলল স্যুই থি।

‘রেঙ্গুনের গোলমালটার কথা জানেন নিশ্চয়ই?’ কাজের কথায় এল কর্নেল শেখ।

‘হ্যাঁ। সেজন্যেই আসতে হলো আমাদের।’ বলল মিসেস গুপ্ত। ‘আমি জানি, উ-সেনের মৃত্যুর ব্যাপারে আমার করবার আর কিছুই নেই। কিছুটা আমার দোষে ঘটেছে এই দুঃখজনক ঘটনাটা। দোষ না বলে ভুল বলাই ভাল। ঘাই হোক, এজন্যে ক্ষতিপূরণ দিতে পারি আমি, সেই কথাই জানাতে এসেছি আমরা।

সবাই বসল। হুইল চেয়ারটায় ব্রেক কষে দিয়ে মিসেস গুপ্তও গিয়ে বসল একটা সোফায়।

‘ক্ষতিপূরণ?’ অবাক হলো ডক্টর হুয়াং। ‘উ-সেনের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ?’

‘উ-সেনের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হয় না। আমার অফার আপনার জন্যে নয়, ডক্টর হুয়াং। জেনারেলের সাথে আমি একটা চুক্তিতে আসতে চাই। আপনার কাছে আমি আর কিছুই আশা করি না, আমি জানি আপনাদের কাছ থেকে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্য নেই আমার

‘একথা কেন বলছ, ফ্যান সু?’ যেন অন্তরে ব্যথা পেয়েছে, এমনি ভাবে বলল ডক্টর হুয়াং।

‘আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে গতকাল রাতে ইয়েন ফ্যাঙ গিয়েছিল আমাদের হোটেল কামরায় আমাদের খুন করবার জন্যে। রেঙ্গুনে। এরপর আপনাদের কাছ থেকে আর কি আশা করতে পারি আমি বলুন?’ রানার দিকে চাইল মিসেস গুপ্ত। সেই জন্যেই সরোজের আজ এই অবস্থা।

‘ফ্যাঙকে পাঠানো হয়েছিল আব্বাস মির্জা বলে সেই লোকটাকে ঠেকাবার জন্যে।’ বলল ডক্টর হুয়াং।

‘ব্যর্থ হয়েছে সে।’

‘বলেন কি?’ আঁতকে উঠল কর্নেল শেখ। ‘ব্যর্থ হয়েছে? তাহলে কোথায় সে?’

সোজা জেনারেলের দিকে চাইল মিসেস গুপ্ত। আমার হাতে। বন্দী।’

‘তোমার হাতে!’ এক সাথে কথা বলে উঠল হুয়াং এবং স্যুই থি। ‘অসম্ভব!’ বলল কর্নেল শেখ।

‘খুবই সম্ভব, কর্নেল।’ বিজয়িনীর ভঙ্গিতে সবার দিকে চাইল মিসেস গুপ্ত। *ও এখন আমার হাতে বন্দী। সম্পূর্ণ সুস্থ, সবল, জীবিত। একমাত্র আমি জানি কোথায় আছে ও। আপনারা ওর ব্যাপারে উৎসাহী হতে পারেন মনে করে এসেছি আমি আপনাদের কাছে। ইচ্ছে করলেই আমার সাথে একটা চুক্তিতে আসতে পারেন আপনারা।’

‘মিছে কথা বলছে,’ বলল স্যুই থি।

‘আশ্চর্য! আপনি যা দাবি করছেন…নাহ্, অসম্ভব…’ মাথা নাড়ল কর্নেল শেখ।

খল খল করে হেসে উঠল মিসেস গুপ্ত। কসমেটিক কেসটার গায়ে তবলা বাজাল, ওটা খুলে ওর ভিতর থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে ধরাল, লম্বা করে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ছাতের দিকে। বলল, ‘জল খাব এক গ্লাস। উঠে গিয়ে রানাকে একটু আরাম করে বসবার ব্যবস্থা করে দিল টানা হ্যাঁচড়া করে এখানে ওখানে বালিশ গুঁজে দিয়ে। রানার হাতের তালুতে দুই আঙুল দিয়ে ঘষা দিল। লাফ দিয়ে উঠল দুটো আঙুল।

রানা নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে, কিছুক্ষণ থেকেই বোধ ফিরে আসছে ওর হাতে। সবশেষের ইঞ্জেকশনটা তেমন কার্যকরী হয়নি। খুব সম্ভব ইচ্ছে করেই কম করে দিয়েছে মিসেস গুপ্ত ওষুধের ডোজ। এখন আর ঘর বাড়ি দুলছে না চোখের সামনে।

সামান্য একটু কুঁচকে গেল মিসেস গুপ্তের ভ্রূ জোড়া। ফিরে গিয়ে বসল সে সোফায়। কই, কেউ জল খাওয়াবে না?

‘স্যুই, ওকে একগ্লাস জল দাও।’ বলল হুয়াং। তারপর ফিরল মিসেস গুপ্তের দিকে। ‘তুমি বলতে চাও, জেনারেলের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলতে তুমি আব্বাস মির্জাকে গ্রেপ্তারের কথা বুঝিয়েছিলে? মানে, সত্যিই তুমি ওই ভয়ঙ্কর লোকটাকে বন্দী করেছ?’

‘ঠিক তাই। উ-সেনকে খুন করে সোজা নানকিং হোটেলে আমাদের স্যুইটে এসে হাজির হয়েছিল আব্বাস মির্জা। ওখানে ইয়েন ফ্যাঙ অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। স্যুই থির হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে কয়েক ঢোকে শেষ করল মিসেস গুপ্ত শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত। ‘ফ্যাঙকেও খুন করেছে লোকটা। সত্যিই বলেছেন, লোকটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।’ গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল স্যুই থির হাতে।

‘আপনি সিনেমা থেকে ফিরেই বন্দী করে ফেললেন ভয়ঙ্কর লোকটাকে?’ বলল কর্নেল শেখ। ‘কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার কাছে।

কৌশলে ওর বিশ্বাস উৎপাদন করেছিলাম আমি। বাকিটুকু খুবই সহজ কাজ।’

‘তোমার কথা যদি সত্য বলে ধরে নেয়া যায়, তাও ব্যাপারটা অপরিষ্কার থেকে যাচ্ছে,’ বলল ডক্টর হুয়াং। ‘তুমি নিশ্চয়ই ওর কাছেই শুনেছ যে মারা গেছে উ-সেন? ওকে তৎক্ষণাৎ হত্যা না করে মান্দালয় পর্যন্ত আমাদের পিছু পিছু এসেছ তুমি কি করতে?

‘নিজস্ব কোন পরিকল্পনা আছে ওর,’ বলল স্যুই থি।

‘নিশ্চয়ই।’ জোরের সাথে বলল মিসেস গুপ্ত। ‘খামোকা আসতে যাব কেন? আগেই বলেছি, জেনারেলের সাথে আমি একটা চুক্তিতে আসতে চাই।’

‘টাকা?’ প্রশ্ন করল স্যুই থি।

‘হ্যাঁ। টাকা, পাসপোর্ট এবং নিরাপত্তা।’ গম্ভীর মিসেস গুপ্ত।

‘ভগবান! মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর!’ বলল স্যুই থি বিস্মিত কণ্ঠে।

‘না, মাথা আমার ঠিকই আছে। আমাদের দুজনকে নির্বিচারে হত্যার আদেশ দেয়ার পরেও যদি তোমাদের দলে থাকতে চাইতাম তাহলে বলতে পারতে আমার মাথার গোলমাল আছে। উ-সেনকে ঘৃণা করতাম আমি। ওর জন্যে কাজ করতাম কেবল কৃতজ্ঞতা বোধটা সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিতে পারিনি বলে। কৃতজ্ঞ ছিলাম ওর কাছে, তাই ওর মত একজন জঘন্য চরিত্রের লোককে সহ্য করেছি গত কয়েকটা বছর। যাই হোক, ওকে সহ্য করেছি বলেই তোমাদের দুজনকেও সহ্য করবার কোন কারণ আমি দেখতে পাই না। তোমাদের অধীনে কাজ করবার মানসিকতা আমার নেই।’ জেনারেলের দিকে ফিরল মিসেস গুপ্ত। ‘ওদের সাথে কাজ করা সম্ভব নয় বলেই আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমি। আমাকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা ওদের কারও মধ্যে আছে বলে মনে করি না আমি। আমি আব্বাস মির্জাকে বন্দী করেছি, ওকে আপনার হাতে তুলে দিতে পারি যদি আপনি আমার জন্যে একটা আমেরিকান পাসপোর্ট, প্লেনের টিকেট, কিছু টাকা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেন।’

‘যদি না পারি?’ প্রশ্ন করল জেনারেল এহতেশাম।

তাহলে শুধু হাতেই ফিরে যেতে হবে আমাকে। অন্য অল্টার্নেটিভ ভেবে রেখেছি আমি।

মুচকি হাসল ডক্টর হুয়াং। বলল, ‘তা বেশ। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি। তুমি শুধু তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যে বলছ। তোমার স্বামীর কি হবে? তাকে আর দরকার নেই?

‘না। উ-সেনের নির্দেশে ওকে বিয়ে করেছিলাম আমি। ওর সাথে কোন সম্পর্ক রাখার ইচ্ছে নেই আমার। সোনার দেশ আমেরিকায় নতুন ভাবে আবার শুরু করতে চাই আমার জীবন।

এতক্ষণে আবার কথা বলল কর্নেল শেখ। বলল, ‘ওই লোকটার বিনিময়ে আপনি যা চাইছেন তা দিতে আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে যেতাম, কারণ তুলনামূলক ভাবে আপনার দাবি খুবই সামান্য, সম্ভবত ওর সত্যিকার পরিচয় আপনার জানা নেই বলেই; ওকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্যে আরও অনেক কিছুই দিতে রাজি থাকতাম আমরা, কিন্তু…

কর্নেলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে স্যুই থি বলল, ‘কিন্তু দুঃখের বিষয়, তোমার কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ দূর হচ্ছে না কর্নেলের। আমরা যেমন জানি, ওঁরাও তেমনি জানেন, মিথ্যে বলছ তুমি। আসল উদ্দেশ্য তোমার অন্য কিছু

‘মিথ্যে বলছি তা টের পেলে কি করে?’ বাঁকা চোখে চাইল মিসেস গুপ্ত স্যুই থির দিকে।

‘যাকে বন্দী করেছ বলছ, তার সত্যিকার পরিচয় জানলে এই মিথ্যার আশ্রয় নিতে না তুমি।’

‘ওর নাম আব্বাস মির্জা নয়,’ বলল কর্নেল শেখ। ‘আপনাকে ঠিক অবিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু কিছু মনে করবেন না, আমার কাছে অবিশ্বাস্যই লাগছে ব্যাপারটা। ওর সত্যিকার নাম হচ্ছে মাসুদ রানা। সেকেন্ড ম্যান অভ বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স।

‘মাসুদ রানা!’ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল মিসেস গুপ্তের দুই চোখ নিজের অজান্তেই দৃষ্টিটা একবার ঘুরে এল রানার উপর থেকে। বলেন কি! মাসুদ রানা? অসম্ভব! সে কি করে হবে? ওর সম্পর্কে গল্প শুনেছি আমি সরোজের কাছে।’ মাথা নাড়ল মিসেস গুপ্ত। ‘আশ্চর্য!’ ধরা পড়ার ভয়ে আর রানার দিকে চাইল না সে। ‘অসম্ভব…’

‘ঠিক বলেছেন। অসম্ভব।’ গোঁফে তা দিল কর্নেল শেখ। ‘মাসুদ রানার হাতে ইয়েন ফ্যাঙের মৃত্যুটা বিশ্বাসযোগ্য। আমি ডক্টর হুয়াংকে নিষেধ করেছিলাম ফ্যাঙকে একা পাঠাতে। রানার বিরুদ্ধে অন্তত চারজন ইয়েন ফ্যাঙকে পাঠানো দরকার ছিল। আমি ওর সাথে কাজ করেছি, ব্যক্তিগত ভাবে চিনি আমি ওকে। পাকিস্তানের সেরা স্পাই ছিল সে। আপনি যদি বলতেন, হঠাৎ অতর্কিতে গুলি করে বা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছেন ওকে, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হত। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ওকে বন্দী করেছেন এই কথাটা নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া আমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা এত কঠিন কেন?’

হঠাৎ হেসে উঠল মিসেস গুপ্ত হিস্টিরিয়া রুগীর মত। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে ওর মুখের দিকে, কিন্তু কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই ওর। হেসেই চলেছে খল খল করে। আধ মিনিট পর কোন মতে বলল, ‘অসম্ভব, হি হি হি। উ-সেনের হত্যাকারীকে বন্দী করেছি আমি তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে যত বড় স্পাই হোক না কেন, আমার হাতে এখন বন্দী।’

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কাঁধ ঝাঁকাল ডক্টর হুয়াং। বোকা হয়ে গেছে সবাই।

‘তাই যদি হয়…’ শুরু করেছিল কর্নেল, কিন্তু ওর কথায় বাধা দিল স্যুই থি।

‘বিশ্বাস করবেন না ওর কথা। মিথ্যে বলায় ওর জুড়ি নেই। উ-সেন বলেছেন আমাকে একথা।

‘বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা আপনাদের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।’ হাসি থামিয়ে বলল মিসেস গুপ্ত। স্যুই থির দিকে ফিরল সে। ‘আমার সম্পর্কে উ-সেনের মতামত জেনে সুখী হলাম। সত্যিই আমি কখন মিথ্যে বলছি, কখন সত্যি বলছি বুঝবার ক্ষমতা ছিল ওর। কিন্তু আজ যদি উ-সেন বেঁচে থাকত তাহলে পরিষ্কার বুঝতে পারত যে সত্যি কথাই বলছি আমি। যাই হোক, আমার বক্তব্য শুনেছেন আপনারা।’ কর্নেল শেখের দিকে ফিরল মিসেস গুপ্ত। ‘পৃথিবী বিখ্যাত স্পাই মাসুদ রানার বিনিময়ে আমার সামান্য দাবি পূরণ করতে রাজি আছেন আপনারা?’

‘আমার মনে হয় সত্যি কথাই বলছে ফ্যান সু।’ মিসেস গুপ্তের পিছন থেকে ভেসে এল উ-সেনের গুরু গম্ভীর ভরাট কণ্ঠস্বর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *