রক্তের রঙ ১.৯

নয়

বিস্ময়ে বিস্ফারিত কর্নেল শেখের দুই চোখ। অবিশ্বাস ফুটে উঠল চোখের দৃষ্টিতে। তারপর দেখা দিল ভয়।

‘রানা! তুমি এখানে! তুমি এখানে কেন?’

‘আপনি চেনেন একে?’ প্রশ্ন করল উ-সেন। ‘রানা বলছেন কেন? এর নাম আব্বাস মির্জা নয়?’

‘তুমি চেনো নাকি?’ একই সাথে প্রশ্ন করল জেনারেল এহতেশাম। ‘কিভাবে চেনো?’

রানার দুই হাত চলে গেল টেবিলের নিচে।

‘চিনি মানে?’ উত্তর দিল কর্নেল শেখ, ‘ভাল করেই চিনি। একসাথে কাজ করেছি আমরা ঢাকায়। আমার চেয়ে ভাল করে আর কেউ চেনে না ওকে। ও হচ্ছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেকেন্ড ম্যান। মেজর জেনারেল রাহাত খানের ডানহাত। ওর নাম মাসুদ রানা। ভয়ঙ্কর লোক। ও এখানে কেন?’

হুড়মুড় করে উল্টে গেল টেবিলটা। চেয়ার উল্টে মাটিতে পড়ল স্যুই থি এবং জেনারেল এহতেশাম। ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল দুটো ককটেল গ্লাস। বাম কনুই চালাল রানা বামপাশে বসা ডক্টর হুয়াং-এর সোলার-প্লেকসাসে। কাত হয়ে ঢলে পড়ল ডক্টর হুয়াং।

‘সাবধান!’ চিৎকার করে উঠল কর্নেল শেখ। ‘ওকে থামান! নইলে সবাইকে মেরে ফেলবে ও একা, খালিহাতে!’

চেয়ার তুলে মারল রানা কর্নেল শেখের হাতে। পিস্তল বেরিয়ে এসেছিল ওর হাতে, ছিটকে চলে গেল সেটা ঘরের কোণে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একবার রানার দিকে চেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে জেনারেলের উপর। তুলে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছে সে জেনারেলকে।

ফাইলটা তুলে নিয়েছিল উ-সেন টেবিল ওল্টাবার আগেই, এবার চট করে উঠে দাঁড়িয়ে রওনা হলো সে দেওয়ালের গায়ের দরজার দিকে। হাত বাড়িয়ে টাইটা ধরল রানা, কিন্তু কখন উঠে দাঁড়িয়েছে ডক্টর হুয়াং টের পায়নি সে। প্রকাণ্ড একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন শোভা পাচ্ছে ওর হাতে। পেছন থেকে রানার ঘাড়ের পাশে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল সে, সেইসাথে ধাক্কা মারল ওল্টানো টেবিলের দিকে। উঠে বসার চেষ্টা করছিল স্যুই থি, টেবিল টপকে ওর ঘাড়ের উপর পড়ল রানা।

‘গুলি করুন, গুলি করুন!’ চিৎকার করছে কর্নেল শেখ আতঙ্কিত কণ্ঠে ‘ওকে চেনেন না আপনারা! এক্ষুণি গুলি করুন, নইলে মারা পড়ব সবাই!’

গুলি করল হুয়াং। স্যুই থির মাথার দুই ইঞ্চি দূরে মেঝেতে লাগল গুলিটা। ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠল স্যুই থি। উঠতে যাচ্ছিল রানা, দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরল স্যুই থি। কনুই দিয়ে ওর কাঁধের নরম মাংসে জোরে একটা চাপ দিল রানা। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ছেড়ে দিল সে রানার গলা। উঠে পড়ল রানা।

মুশকিল হয়ে গেছে ডক্টর হুয়াং-এর। রানাকে ধাক্কা দিতে গিয়ে পুরু লেসের চশমাটা পড়ে গেছে মাটিতে। খুঁজবার সময় নেই, গুলি করা দরকার, কিন্তু গুলি ঠিক লক্ষ্যে পৌছুবে কিনা বুঝতে পারছে না। স্যুই থির চিৎকার শুনে ওর ধারণা হয়েছে ওকেই বুঝি লেগেছে প্রথম গুলিটা, দ্বিতীয় চিৎকার শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু আর গুলি করতে ভরসা পাচ্ছে না।

চলে যাচ্ছে উ-সেন। একলাফে পৌঁছে গেল রানা। প্রথমেই থাবা দিয়ে ফেলে দিল ওর চশমা। পরমুহূর্তে মারল ওর চরম মার। খুলিটা ঠিক যেখানে ঘাড়ের সাথে মিশেছে, আঙুলগুলো সোজা রেখে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে মারল সেখানে কারাতের কোপ, হাতটা সামান্য একটু উপর দিকে কাত করে। নিখুঁতভাবে মারল রানা। যে কোন লোকের অডন্টয়েড প্রসেস সেঁধিয়ে যাবে মেডুলার মধ্যে, ভেঙে ডিজলোকেটেড হয়ে যাবে ভেতরের হাড় একটিমাত্র আঘাতে-মৃত্যু হবে তৎক্ষণাৎ। মুখের দিকে না চেয়েই বুঝতে পারল রানা, মারা গেছে উ-সেন। ফাইলটা পড়ে গেছে হাত থেকে, পড়ে যাচ্ছে লম্বা আড়ষ্ট দেহটা।

আবার গুলি করল হুয়াং। লক্ষ টাকা দামের একটা অয়েল পেইন্টিং বরবাদ হয়ে গেল। ঝট করে উ-সেনের আড়ালে চলে গেল রানা, তারপর জোরে ধাক্কা দিল মৃতদেহটা সামনের দিকে। এই ফাঁকে চট করে চোখ পড়ল রানার, উঠে দাঁড়িয়েছে কর্নেল শেখ জেনারেলকে টেবিলের নিচে থেকে বের করে নিয়ে।

এদিকে হুয়াং-এর উপর গিয়ে পড়েছে উ-সেনের লাশ। পড়ে গেছে সে, নিচ থেকে উঠতে পারছে না। পিস্তল ধরা হাতটা শূন্যে দুলছে আছড়ে-পাছড়ে বেরোবার চেষ্টা করছে বলে। দুই পা এগিয়েই লাথি মারল রানা হুয়াং-এর কবজিতে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল হুয়াং। পিস্তলটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দশ হাত তফাতে।

জেনারেলের দিকে ফিরল এবার রানা। জেনারেলকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাচ্ছে কর্নেল শেখ। ওল্টানো টেবিলটা টপকে ছুটল রানা সেদিকে, কিন্তু একটা পা ধরে ফেলল স্যুই থি। পড়ে গেল রানা। ব্যথা পেল হাঁটুতে। ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল পিঠের উপর স্যুই থি। দুই হাতে কিল মারল কয়েকটা, তারপর লম্বা লম্বা নখ দিয়ে খামচাতে শুরু করল। ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস পড়ছে ওর, নখগুলো এখন খুঁজছে রানার চোখ। ঝট করে ঘুরল রানা। দেখল তীব্র ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেছে স্যুই থি-র মুখটা। দড়াম করে ঘুসি মারল রানা ওর তলপেটে। মুহূর্তে দূর হয়ে গেল সমস্ত ঘৃণা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহাৱা। ঢলে পড়ল একপাশে, দম নিতে পারছে না, পেটে হাত চেপে গড়াগড়ি শুরু করল সে।

পনেরোতলায় যাবার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে শেখ জেনারেলকে নিয়ে।

মেঝে থেকে ফাইলটা কুড়িয়ে নিয়েই ছুটল রানা। সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেকের বেশি উঠে গেছে ওরা। একেক লাফে চার সিঁড়ি করে টপকে উঠতে শুরু করল রানা। পেছন ফিরে রানাকে দেখেই দ্রুততর হলো ওদের গতি, কিন্তু প্রায় পৌছে গেছে রানা। লাফ দিল সে কর্নেল শেখের হাঁটু লক্ষ্য করে। দুর্ভাগ্য রানার, পিছলে গেল পা। প্রথমে পড়ল কনুই, তারপর সিঁড়ির কিনারে আছড়ে পড়ল হাঁটুর নিচের শক্ত হাড়। মাথাটা বাঁচাতে চেষ্টা করল রানা নিজের অজান্তেই, পারল না-জোরে ঠুকে গেল কপালটা সিঁড়ির উপর। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বোধশক্তি হারাল সে অবর্ণনীয় তীক্ষ্ণ ব্যথায়।

ধীরে ধীরে মাথা তুলে উপরদিকে চাইল রানা। অদৃশ্য হয়ে গেছে কর্নেল শেখ জেনারেলকে নিয়ে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে আবার ছুটল রানা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত। ডানদিকের করিডরের চতুর্থ ঘরটায় ঢুকছে ওরা। রানা পৌঁছবার আগেই ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। দেহের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল রানা দরজার গায়ে। যেমন ছিল তেমনি রইল দরজাটা, যেন ইস্পাত দিয়ে তৈরি।

বুম করে গুলির আওয়াজ হলো। রানার তিন হাত দূরে দেয়ালের গায়ে লেগে এক খাবলা প্লাস্টার তুলে নিয়ে বিঙ্‌ করে চলে গেল বুলেটটা। পিস্তল দুটো নিচে ওভাবে ফেলে রেখে ঝোঁকের মাথায় খালিহাতে চলে আসায় রাগ হলো নিজের উপরই। পেছন ফিরে দেখল, ডক্টর হুয়াং শুয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়। দুই কনুই মেঝেতে রেখে দুই হাতে ধরেছে সে পিস্তলটা। একমাত্র ভরসা, চশমাটা আনতে ভুলে গেছে সে তাড়াহুড়োয়। সামনের দিকে চেয়ে দমে গেল রানা। লম্বা, ফাঁকা করিডর, দুপাশে সারি সারি বন্ধ দরজা। একলাফে চলে এল সে কর্নেল আর জেনারেল যে ঘরে ঢুকেছে, তার ঠিক উল্টোদিকের দরজার সামনে। বুম্ম্! এবারের গুলিটা সোজা করিডর পেরিয়ে গিয়ে ঠুস্ করে শেষ মাথার কাচের জানালা ভেদ করে বেরিয়ে গেল।

হ্যান্ডেলে চাপ দিতেই খুলে গেল দরজা। অন্ধকার ঘর। ঢুকেই চাবি লাগিয়ে দিল রানা। সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল দেয়ালের গায়ে। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের ছয়টা গুলির চারটে ব্যয় হয়ে গেছে আগেই, পঞ্চমটা দুই ইঞ্চি পুরু সেগুন কাঠের দরজা ভেদ করে চুরমার করে দিল ড্রেসিং টেবিলের দামী বেলজিয়াম গ্লাসটা। আর আছে একটা গুলি। ঝুঁকিটা নেয়াই স্থির করল রানা। হাত বাড়িয়ে চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে দিল দরজার।

ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে দরজাটা। পিস্তলটা দেখা দিল সর্বপ্রথম। প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রানা দেয়ালের সাথে মিশে। শেষ গুলিটা খরচ করার আগে নিশ্চয়ই লাইট জ্বালবার চেষ্টা করবে হুয়াং। কিন্তু দরজার গায়ে হাত বোলাতে দেখেই টের পেল রানা, ওর মতলব অন্যরকম। এগোল রানা। কোনরকম লক্ষ্য স্থির না করেই গুলি করল হুয়াং। হাতে গিয়ে লাগল গুলি। ততক্ষণে চাবিটা খুলে নিয়েছে হুয়াং। ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। বাম হাতের আঙুলের ওপর খটাস করে মারল হুয়াং পিস্তলের বাঁট দিয়ে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা, ক্লিক করে তালা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো।

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে রানা। আঙুলগুলো ব্যথা করছে, ঘাড়টাও টনটন করছে, গালে কপালে যেসব জায়গায় স্যুই থির নখের আঁচড় লেগেছে, সেসব জায়গা জ্বলছে নোনতা ঘাম লেগে। আধ মিনিট চিন্তা করল রানা। এই খাঁচার মধ্যে মিনিট পনেরো আটকে রাখতে পারলেই লোকজন সংগ্রহ করে কিংবা পিস্তল রিলোড করে রানাকে গ্রেপ্তার করা হুয়াং- এর জন্যে অতি সহজ কাজ। বেরোতে হবে। কিন্তু কিভাবে? একমাত্র পথ জানালা। এগিয়ে গেল রানা জানালার দিকে। কাচের জানালাটা খুলে বাইরে মাথা বের করল সে।

ঘুরে উঠল মাথাটা। পনেরো তলা নিচে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। প্রচুর লোকজন চলাচল করছে রাস্তায়। গাড়ি, অটোরিকশা, ট্রাক, বাস চলে যাচ্ছে সাঁই সাঁই। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে রাস্তায়, দোকানে। বিচিত্র-বর্ণ জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্ত, স্বাধীন অসংখ্য বর্মী মেয়ে-পুরুষ। এত উঁচু থেকে ছোট ছোট পুতুলের মত লাগছে ওদেরকে। রানা ধরা পড়ে গেছে ইঁদুরের কলে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলো রাস্তা আলোকিত করেছে ঠিকই, কিন্তু উপরে আসছে না। রানার মনে হচ্ছে একটা আলোকিত অ্যাকুয়ারিয়াম দেখছে সে। চাঁদের ম্লান আলো পড়েছে দালানের গায়ে। যা খুঁজছিল তা পেল না রানা। পনেরোতলা থেকে একেবারে নিচ পর্যন্ত খাড়া নেমে গেছে দেয়ালটা-কার্নিস নেই একটাও।

এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেল রানা। ওয়ারড্রোবটা ঠেলে রেখে এল দরজার গায়ে। আবার এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। ব্যাটন বগলে চেপে চুরুট ফুঁকছে একজন ট্রাফিক পুলিস। এখন এদের সাহায্য চেয়ে লাভ নেই, তার আগেই খতম হয়ে যাবে সে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বেরোতে হবে এখান থেকে। কিন্তু কি করে?

একটাই মাত্র পথ আছে। কিন্তু সে পথে চেষ্টা করতে গেলে পাঁচ মিনিটের আগেই খতম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পাঁচ সেকেন্ড লাগবে ও পথে পরপারে চলে যেতে, তবু ওইটাই এখন একমাত্র পথ। জানালা দিয়েই বেরোতে হবে ওকে।

জুতোর গোড়ালি থেকে ছুরিটা বের করে আনল রানা। ডাবল-বেড বিছানার চাদরটা কেটে ছয় টুকরো করল, শক্ত করে গিঁঠ দিল একটার সাথে আরেকটা, তারপর আবার গিয়ে দাঁড়াল জানালার পাশে। দড়ির এক মাথা বাঁধল জানালার একটা লোহার শক্ত হিঞ্জের সাথে। টেনে দেখল ভার সইতে পারবে কিনা। মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে দড়িটা ফেলে দিল বাইরের দিকে এবার শার্টের গোটাকয়েক বোতাম খুলে ফাইলটা ঢুকিয়ে দিল গেঞ্জির নিচে বুকের কাছে বর্মের মত আটকে রইল ফাইলটা। শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিয়ে জানালাটা যেই টপকাতে যাচ্ছে, অমনি শোনা গেল ডক্টর হুয়াং-এর কণ্ঠস্বর।

‘মিস্টার মাসুদ রানা, রিলোড করা হয়ে গেছে, তালা খুলে দিচ্ছি আমি, মাথার উপর হাত তুলে বেরিয়ে আসুন। এই ঘরে কোন অস্ত্র নেই, আমি জানি। ভাল চান তো বেরিয়ে আসুন, নইলে আমি ঢুকব। আমাকে ঢুকতে হলে দেখামাত্র গুলি করা ছাড়া উপায় থাকবে না আমার।’

দড়ি বেয়ে সড় সড় করে নেমে এল রানা হাতদশেক। যখন থামল, গিঁঠগুলো চেপে বসল আরও, ইঞ্চি দুয়েক নেমে গেল সে আপনাআপনি। ধক করে উঠল ওর বুকের ভেতরটা দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে মনে করে। চট করে চোখ গেল বহু নিচে ব্যস্ত রাজপথের দিকে। সবাই নিশ্চিন্তে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। কেউ কল্পনাও করতে পারছে না দেড়শো ফুট উঁচুতে সার্কাসের মহড়া দিচ্ছে এক বিদেশী অ্যাক্রোব্যাট, প্রাণের দায়ে।

ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দুলতে শুরু করল রানা। ক্রমেই বাড়তে থাকল ঝুল। পাশের ঘরের জানালার কাছে পৌছুতে হবে।

মাঝে মাঝেই দেয়ালের গায়ে ঘষা খাচ্ছে শরীরটা। যতটা সম্ভব পা দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করছে রানা, কিন্তু ইতোমধ্যেই গোটাকয়েক রাম-ঘষা খেয়েছে সে বাম কনুই আর হাঁটুতে। আর দু’তিনটে খেলেই সিকি ইঞ্চি চামড়া গায়েব হয়ে যাবে ওর ওসব জায়গা থেকে।

পাশের ঘরের জানালার কাছাকাছি পৌছুতেই টের পেল রানা, আরও হাতদুয়েক নামতে হবে। দোলায়িত অবস্থাতেই আরও দুই হাত নামল রানা, দোলার গতি বাড়িয়ে দিল শরীর বাঁকিয়ে। হাত দুটো অবশ হয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু এখন আর মত পাল্টাবার উপায় নেই, যেটা করছে সেটাই শেষ পর্যন্ত করে দেখতে হবে-আসলে বারো হাত দড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার শক্তি নেই আর ওর হাতে। প্রথম সুযোগেই এক লাথি দিয়ে বেশ খানিকটা কাচ ভেঙে ফেলল রানা। ছিটকিনির কাছাকাছি লক্ষ্য স্থির করেছিল যাতে প্ৰয়োজন হলে ওটা খোলা যায়। আবার ঝুল খেয়ে ফিরে এল রানা পাশের ঘরের জানালার কাছে। এবার আরেকটা লাথি দিয়ে আরও খানিকটা কাচ খসিয়ে দিল সে। আর বড়জোর দু’বার ঝুল খাওয়ার শক্তি আছে হাতে, এর মধ্যে কাজ সারতে না পারলে খসে যাবে দড়িটা হাত থেকে, এবং…। দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছে রানা, আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে ব্যথায়। দুই বাহু ঠকঠক করে কাঁপছে ম্যালেরিয়া রোগীর মত। পরেরবার জানালা পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারল না রানা। মাঝপথে জোরে এক ঘষা খেল কনুইয়ের ছড়ে যাওয়া জায়গাটায়। হায় হায়! ছুটে গিয়েছিল দড়িটা হাত থেকে, পাগলের মত হাতড়ে আবার ধরে ফেলল রানা। পট্ পট্ শব্দ হলো কাপড়ের দড়িতে বুঝতে পারল, এত ওজন পছন্দ হচ্ছে না ওটার, এখন যে কোন মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে। প্রাণপণে শেষবারের মত দোল খেল রানা, জানালার কাছে পৌঁছে ভাঙা জায়গা দিয়ে পা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দেহ-মনের বোঝাপড়া আর আগের মত নেই, সিনক্রোনাইযেশন হারিয়ে ফেলেছে সে। পর পর দুই পায়েই চেষ্টা করল, কিন্তু একটা পাও ঢোকাতে পারল না ফাঁক দিয়ে। দপ করে নিবে গেল সব আশা, চেতনা লোপ পেতে চাইল রানার। কোনমতে টিকে রইল সে।

ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে সর্বাঙ্গ থেকে। টপ করে ভুরু থেকে এক ফোঁটা খসে পড়ল চোখের মধ্যে। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে নিজেকে নিজে গাল দিচ্ছে রানা এখন অনর্গল-আরেকবার, আরেকবার চেষ্টা কর শুয়োর, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না, টিকে থাক্ কুত্তা, ঠিক হয়ে যাবে এক্ষুণি, আর একটা বার উল্লুক, আর একটা বার…

চোখের পাতা বারকয়েক মিটমিট করল রানা। হ্যাঁ, আবার দেখতে পাচ্ছে সে। আরেক ঘষা খেল সে কাঁধে, কিন্তু পা দিয়ে গতিটা বজায় রাখল। আবার ফিরে এল জানালার কাছে। সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে বাম পা-টা চালাল রানা। হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে গেল বাম পা, কিন্তু জোর ঝাঁকি খেয়ে হাত ছুটে গেল ওর দড়ি থেকে।

আর ভয় নেই। এক পায়ে ঝুলে রইল সে পনেরোতলার জানালায় মাথা নিচু পা উঁচু অবস্থায়। বিশ সেকেন্ড বিশ্রাম নিল, তারপর শরীরটা বাঁকা করে ওপরে উঠিয়ে খুলে ফেলল জানালার বল্টু। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে পাশের ঘরে প্রবেশ করল রানা। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে টিপে টিপে দুই হাতের আঙুল, বাইসেপ আর কাঁধের আড়ষ্টতা দূর করল সে, তারপর এগিয়ে এসে কান রাখল দরজায়। খুব কাছেই খস খস আওয়াজ পেয়ে সামান্য ফাঁক করল দরজাটা। দেখল ঠিক ওরই মত পাশের ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিচ্ছে ডক্টর হুয়াং করিডোরে দাঁড়িয়ে।

‘মিস্টার মাসুদ রানা,’ তেমনি শাসাচ্ছে হুয়াং, ‘আমার সাথে পাঁচ ছয়জন পিস্তলধারী রয়েছে। যদি প্রাণে বাঁচতে চান, মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে আসুন। বিশ্বাস করুন, কোন উপায় নেই আর আপনার। পাঁচ পর্যন্ত গুনছি, এর মধ্যে বেরিয়ে না এলে আমরা সবাই ঢুকব একসাথে ঘরের ভেতর, দেখামাত্র গুলি করা হবে আপনাকে। এক…দুই…’

পাঁচ গোণার আগেই বেরিয়ে এল রানা নিঃশব্দে। পেছন থেকে মৃদু চাপড় দিল হুয়াং-এর পিঠে। ভয়ানক চমকে পিছু ফিরল হুয়াং। রানাকে দেখে সেকেন্ড দুয়েক বুঝেই উঠতে পারল না সে ব্যাপারটা, যখন বুঝল তখন স্পষ্ট আতঙ্ক ফুটে উঠল ওর চোখে মুখে। অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়ার দশা হলো। সামলে নেয়ার আগেই প্রচণ্ড এক ঘুসি এসে লাগল নাকের উপর, পরমুহূর্তে জুডো চপ পড়ল ঘাড়ের পাশে। বিনা দ্বিধায় জ্ঞান হারাল সে। এবার আর ভুল করল না রানা। পিস্তলটা তুলে নিল মেঝে থেকে, জ্ঞানহীন দেহটা টেনে ঘরের মধ্যে ফেলে তালা লাগিয়ে দিল বাইরে থেকে।

দ্রুতপায়ে নেমে এল রানা। যেমন রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি পড়ে রয়েছে উ-সেন। স্যুই থি জ্ঞান ফিরে পেয়ে এপাশ ওপাশ মাথা ঝাঁকাচ্ছে, রানাকে দেখে ভীতি দেখা দিল ওর চোখে। একটা ফ্লাইং কিস্ উপহার দিল রানা ওকে। গেঞ্জির নিচে থেকে ফাইলটা বের করে হাতে নিল। নিচু হয়ে উ-সেনের খোলা চোখের দিকে চাইল সে এক সেকেন্ডের জন্যে। অন্ধ চোখদুটো স্থির। যন্ত্রণার কোন ছাপ নেই সে চোখে। নিমেষের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে-কষ্ট পেয়ে মরেনি লোকটা।

এখানে আর সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। আজ সারারাত ঘর থেকে বেরোবে না কর্নেল শেখ আর জেনারেল এহতেশাম। কিছুই করবার উপায় নেই রানার। কাগজপত্র হাতে এসে গেছে, এরা তৎপর হয়ে ওঠার আগেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। লিফটে উঠল সে দ্রুতপায়ে। নাগরদোলার মত পাকস্থলী শিরশিরানো গতিতে নেমে এল কারপার্কে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *