রক্তের রঙ ১.২

দুই

দড়ির মই বেয়ে নেমে এল চারজন।

মাথার উপর পনেরো ফুট উঁচুতে নেমে এসেছিল, এখন একশো ফুট উপরে উঠে স্থির হয়ে আছে হেলিকপ্টার। নজর রাখছে চারদিকে

মনে মনে এদের দক্ষতার প্রশংসা না করে পারল না রানা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে মেশিন-পিস্তল। বটল গ্রীন ইউনিফরম। এদের মধ্যে একজনের কোমরে হোলস্টারে ঝোলানো রিভলভার, ঠোঁটে নিচু দিকে ঝোলানো বার্মিজ গোঁফ। রানা আন্দাজ করল, এইটাই সর্দার। সব কজনই বার্মিজ। ফোলাফোলা, থ্যাবড়া, চ্যাপ্টা, ভোঁতা নাক-মুখ, আধবোজা ঈষৎ বাঁকা চোখ, সুঠাম স্বাস্থ্য।

প্রথমেই সার্চ করা হলো রানাকে। অস্ত্র পাওয়া গেল না।

মিলিটারি ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে রাগত দৃষ্টিতে চাইল গোঁফধারী রানার দিকে। যেন ধরেই নিয়েছে, মস্ত কোন অপরাধ করেছে রানা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘কয়জন আছে এই ইয়টে?’

‘আমি একা।’ উত্তর দিল রানা।

‘একা?’ চোখের ইঙ্গিতে সার্চ করবার নির্দেশ দিল সঙ্গীদের। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মেশিন পিস্তলটা সোজা তাক করল রানার বুকের দিকে। সঙ্গীরা ছড়িয়ে পড়ল ইয়টের চারপাশে। এদের চলা ফেরা, ভাব ভঙ্গিতে অত্যন্ত পারদর্শী প্রফেশনাল একটা আভাস টের পেল রানা। অ্যামেচার নয়।

আবার প্রশ্ন করল গোঁফধারী। ‘একা? কোথায় চলেছ? কি আছে ইয়টে?’

তার আগে জানতে পারি, তোমরা কারা?’

কোস্টাল সিকিউরিটি গার্ড।’

‘কি চাও তোমরা?’

‘জানতে চাই, কি আছে ইয়টে?’

‘কিচ্ছু নেই। আমি ট্যুরিস্ট…ওয়ার্লড ট্যুরে বেরিয়েছি। এখন চলেছি রেঙ্গুন। কি থাকবে আমার কাছে? খুলনা থেকে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে বার্মা সরকারের জন্যে কয়েক পেটি চা নিয়ে যাচ্ছি স্যাম্পল হিসেবে। আর কিছু নেই আমার কাছে। সমস্ত কাগজপত্র, ডকুমেন্টস্ রয়েছে, দেখতে পারো। কোনরকম বে-আইনী জিনিস…’

‘শাট আপ।’ ধমকে উঠল গোঁফওয়ালা। কটমট করে চেয়ে বলল, ‘বড় বেশি কথা বলো হে তুমি, ছোকরা। বাজে কথা শুনতে চাই না। যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার উত্তর দেবে। দেখি পাসপোর্ট?’

‘তার আগে তোমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাও।’ বলল রানা।

‘আমার নাম ক্যাপ্টেন ইয়েন ফ্যাঙ। আর আইডেন্টিটি কার্ড তো দেখতেই পাচ্ছ হাতে।’ ঠোঁটের কোণে সামান্য বাঁকা হাসি টেনে এনে হাতের অস্ত্রটা নেড়ে দেখল। ‘কাজেই বেশি স্মার্টনেস দেখিয়ো না ছোকরা, এক- আধটা গুলি ছুটে বেরিয়ে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।’

তোমার নামে রিপোর্ট করব আমি রেঙ্গুন পৌঁছে।’

‘তার আগেই স্বর্গে পৌঁছে যাবে। আমরা খবর পেয়েছি, এই ইয়টে করে বে-আইনী অস্ত্রশস্ত্র যাচ্ছে বার্মার বিদ্রোহী সেনা বাহিনীর জন্যে। দেখি পাসপোর্ট?’

‘কেবিনে আছে।’

তিন সঙ্গী ফিরে এসে বার্মিজ ভাষায় জানাল আর কেউ নেই ইয়টে রানা ছাড়া। মাথা নাড়ল ইয়েন ফ্যাঙ। রানাকে বলল, ‘যাও, নিয়ে এসো কেবিন থেকে। কিন্তু সাবধান, কোনরকম চালাকি নয়, একটু এদিক ওদিক দেখলেই গুলি করবে আমার লোক।’

কেবিন থেকে পাসপোর্ট নিয়ে এল রানা। সাথে গেল দুইজন মেশিন- পিস্তলধারী।

ডেকের উপর রোটর ব্লেডের প্রবল বাতাস। নোঙর ফেলা ‘সত্ত্বেও অল্প অল্প দুলছে ইয়টটা ঢেউয়ের দোলায়। প্রয়োজন হলে এই দোলার সাহায্য নিতে হবে, ভাবল রানা।

পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র সংক্ষিপ্তভাবে পরীক্ষা করে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করল ক্যাপ্টেন ইয়েন ফ্যাঙ, ‘বোগাস। নকল।’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল রানার দিকে। নেভিগেশন লাইট নিবিয়ে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিলে কেন?’ রানাকে নিরুত্তর দেখে বলল, ‘সার্চ করব। চলো, হ্যাচ খুলে দাও।’ ডেকটেবিলের উপর থেকে ব্ল্যাক ডগ-এর বোতলটা তুলে নিল সে।

লোহার মই বেয়ে হোল্ডে নেমে এল ওরা।

দুজন মিলে খুলল একটা বাক্স।

চায়ের নমুনা দেখেই আঁতকে উঠল ইয়েন ফ্যাঙ। থরে থরে সাজানো রয়েছে গোটা পঞ্চাশেক চায়নিজ স্টেনগান। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বাক্সে ভর্তি অ্যামিউনিশন। লম্বা আকারের চতুর্থ বাক্সটায় হাসি হাসি মুখ করে শুয়ে আছে দশটা এল.এম.জি। চোখ কপালে উঠল ক্যাপ্টেনের। ঢক ঢক করে কয়েক ঢোক খেয়ে ফেলল সে বোতল থেকে। মুখ থেকে বোতলটা নামিয়ে বারণ করল একজনকে, ‘হয়েছে, হয়েছে। আর খোলার দরকার নেই-চায়ের ফ্লেভার নষ্ট হয়ে যাবে। লাগিয়ে দাও সব বাক্স যেমন ছিল তেমনি।

মেশিন-পিস্তলটার মুখ সরে গেছে রানার বুকের ওপর থেকে। আলতো করে ধরা আছে সেটা এখন মেঝের দিকে। ইচ্ছে করলেই ছিনিয়ে নিতে পারে রানা সেটা, কিন্তু তা করল না। এদের সত্যিকার পরিচয়টা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে আসছে রানার কাছে।

আরও দু’ঢোক কমিয়ে দিল ইয়েন ফ্যাঙ রানার ব্ল্যাক ডগ, তারপর সঙ্গীদের আদেশ দিল, ‘ঠিক আছে, এ আমাদেরই লোক, এবার তোমরা ফিরে যাও হেলিকপ্টারে, আমি কয়েকটা কথা সেরে আসছি।

তিন সঙ্গী হোল্ড ছেড়ে উপরে উঠে যেতেই অমায়িক ভাবটা মুছে গেল ইয়েন ফ্যাঙের মুখ থেকে। গম্ভীরভাবে বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি জেনুইন লোক। কিন্তু একটু ত্যাড়া কিসিমের। তোমার ব্যবহারটা একটু আয়ত্তে না রাখলে বিপদে পড়বে আমাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে। ত্যাড়া লোক পছন্দ করি না আমরা।’ রানাকে নিরুত্তর দেখে ধরে নিল বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে সে। এবার কাজের কথায় এল। জেনুইন লোক তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার ওই নকল কাগজপত্র দেখিয়ে রেঙ্গুন কাস্টমসকে ধোঁকা দিতে পারবে না।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘কাস্টমস যাতে তোমার কাছেই না ভিড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে এখন আমাদের। সেসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন পরবর্তী ডিরেকশন শুনে নাও মন দিয়ে। আগামীকাল দেখা পাবে না উ- সেনের। পরশু রাত আটটায় ণ্ড ড্যাগন প্যাগোডার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে তোমাকে আমাদের আস্তানায়। এর মধ্যে ইয়ট ছেড়ে কোথাও যাবে না, কিংবা কারও সাথে কোনরকম কন্ট্যাক্ট করবে না। বুঝলে?’

মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, ‘মাঝ-সাগরে ইয়ট থামিয়ে কি দেখতে এসেছিলে তোমরা?’

তোমাকে। পরীক্ষা করা হলো।’

‘পরীক্ষা করতে এসেছ, প্রথমেই পরিচয় না দিয়ে ভান করছিলে কেন? বলা যায় না, এক-আধজনের প্রাণও তো যেতে পারত এই বোকামির ফলে?’

মৃদু হাসল ইয়েন ফ্যাঙ। ‘গেলে তোমারটা যেত। তোমার প্রাণের জন্যে আমার খুব একটা মায়া নেই। তোমার রিঅ্যাকশন দেখার জন্যে এই মিথ্যার প্রয়োজন ছিল। কাউকে বিশ্বাস করি না আমরা। আমার কাছ থেকে ও.কে. সিগন্যাল না পেলে পৃথিবীর কারও পক্ষেই উ-সেনের সাথে দেখা করা সম্ভব নয়।’

‘আমাদের মেসেজ পাওয়ার পরেও এত সন্দেহ কিসের?’

তোমাদের মেসেজের মধ্যে কিছু ফাঁক আছে। তাই এই সাবধানতা।’

‘স্বচক্ষে দেখার পর সন্দেহ নিরসন হয়েছে আশা করি?’

‘না। এখনও তুমি আমাদের সন্দেহের বাইরে নও, আব্বাস মির্জা আগামী দুদিন তোমার সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। চলি এখন মনে রেখো, পরশু, রাত আটটা। পাস ওয়ার্ড-ট্যুরিস্ট।’

লোহার মই বেয়ে উঠে এল ইয়েন ফ্যাঙ ডেকের উপর। পিছু পিছু এল রানা। কেন যেন ভয়ানক অপছন্দ করল রানা এই লোকটাকে। এক লাথি মেরে লোকটাকে পানিতে ফেলে দেবার অদম্য ইচ্ছেটা বহু কষ্টে আয়ত্তে আনল সে। ঢক ঢক করে বোতলের অবশিষ্টটুকু গলায় ঢেলে পানিতে ফেলে দিল ইয়েন ফ্যাঙ খালি বোতলটা।

হঠাৎ ভয়ানকভাবে চমকে উঠল সে।

প্রকাণ্ড একটা ছায়া। ডেকের উপর। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ছায়াটা কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই।

‘কি ব‍্যাপার…’ প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল ইয়েন ফ্যাঙ। আবার দেখা গেল ছায়াটা। ইয়টের চারপাশে পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে অ্যালব্যাট্রেস। সার্চ লাইটের কর্কশ আলোয় বিদঘুটে দেখাচ্ছে ওর প্রকাণ্ড ছায়াটা। প্রাগৈতিহাসিক টেরাড্যাকটিলের মত।

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল ইয়েন ফ্যাঙ। চমকে ওঠার লজ্জাটা কাটাবার জন্যে তাক করল মেশিন-পিস্তল।

‘মেরো না, মেরো না ওটাকে…’

এগিয়ে এল রানা দুই পা। আবার ফিরে এসেছে বিশাল পাখিটা। বিচ্ছিরি কর্কশ শব্দ বেরোল পিস্তলের মুখ থেকে কট্ ফট্ কট্ কট্ কট্‌ কট্।

লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্যে জোরে ধাক্কা মারল রানা ইয়েন ফ্যাঙের কাঁধে কিন্তু তার আগেই প্রাণ বেরিয়ে গেছে পাখিটার। হুড়মুড় করে পড়ল ওটা সাগরজলে, ভাঙা-চোরা ভঙ্গিতে। বার দুই পাখা ঝাপটাল, তারপর স্থির হয়ে গেল। ঢেউয়ের মাথায় দুলছে। ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

রানার ধাক্কায় ডেক-চেয়ারে পা বেধে পড়ে গিয়েছিল ইয়েন ফ্যাঙ, তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে সে। লাল হয়ে গেছে চোখজোড়া। মেশিন-পিস্তলটা ধরল রানার বুকের দিকে তাক করে। ঠক ঠক করে কাঁপছে হাতটা।

স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে আছে রানা। হেলিকপ্টারটি বেশ খানিকটা নিচে নেমে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ইয়েন ফ্যাঙ, এগোতে সাহস পেল না। দড়ির মই নেমে এল, দুজন সঙ্গীর মাথা দেখা যাচ্ছে সাহস ফিরে পেল সে। ঝাঁপিয়ে পড়ল রানার উপর। একতরফা যেখানে খুশি কিল-ঘুসি-লাথি মারল সে রানাকে একটানা দুই মিনিট। মেশিন-পিস্তলের কুঁদো দিয়ে মারল ঘাড়ে, পিঠে। মার খেয়ে পড়ে গেল রানা। উঠে দাঁড়াল আবার। ফোঁস ফোঁস হাঁপাচ্ছে ইয়েন ফ্যাঙ, রাগে কাঁপছে এখনও, মেশিন-পিস্তলটা প্রস্তুত, ট্রিগার টিপবার ছুতো খুঁজছে ডানহাতের তর্জনী, কটমট করে চেয়ে রয়েছে রানার দিকে, লক্ষ করছে রানার প্রতিক্রিয়া।

পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা। ঈষৎ বাঁকা কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ইয়েন ফ্যাঙের মঙ্গোলিয়ান চোখের দিকে।

নীরবে কাটল এক মিনিট। কেউ কাউকে ভস্ম করতে পারল না চাউনি দিয়ে।

কোন কথা না বলে দড়ির মই বেয়ে উঠে গেল ইয়েন ফ্যাঙ। গুটিয়ে নেয়া হলো মই। যেদিক থেকে এসেছিল সেইদিকেই চলে গেল হেলিকপ্টার । পাঁচ মিনিটের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টিপথ থেকে।

বাতি জ্বেলে পাখিটাকে খুঁজল রানা। অদৃশ্য হয়ে গেছে সেটাও।

বিষণ্ণ মনে নোঙর তুলল রানা। কোর্স ঠিক করে নিয়ে ছেড়ে দিল ইয়ট। বোতলটাও নেই, পাখিটাও নেই।

দুটোই শেষ করে দিয়ে গেছে ইয়েন ফ্যাঙ।

কাজটা ভাল করেনি।

বড় নিঃসঙ্গ বোধ করছে রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *