রক্তের রঙ ২.৫

পাঁচ

চমকে উঠল মাসুদ রানা।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আড়ষ্ট হয়ে গেল মিসেস গুপ্ত। কিন্তু সে শুধু তিন সেকেন্ডের জন্যে। তারপর ঝট করে ফিরল সে উ-সেনের দিকে।

রানার মনে হলো বারবার ইঞ্জেকশন দেয়ার ফলে মাথার মধ্যে কোন গোলমাল হয়ে গেছে ওর। স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে সে, ওষুধের গুণ অত্যন্ত দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—মাথা ঘোরাটা একেবারেই নেই, দুই হাত, কাঁধ, এমন কি পিঠে পর্যন্ত বোধশক্তি ফিরে এসেছে; ইচ্ছে করলেই পা নড়াতে পারে সে এখন। কিন্তু মাথাটায় কিছু হলো নাকি? মৃত উ-সেন আবার বেঁচে ওঠে কি করে? ব্যাপারটা কেবল অবিশ্বাস্যই নয়, ভীতিপ্রদও। শিরশির করে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত উঠে এল ঘাড়ের কাছে, শিউরে উঠল রানা।

উ-সেনের লাশ দেখেছে সে মেঝেতে শুয়ে আছে, অপলক প্রাণহীন দুই চোখ চেয়ে রয়েছে ছাতের দিকে, অভিব্যক্তিহীন। সেই লোকটাই এসে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে। একটা ডিভান ঘুরে এগিয়ে এল রানার দিকে। তেমনি আড়ষ্ট হাঁটার ভঙ্গি। পিঠ, কাঁধ আড়ষ্ট, সোজা। যখন ঘুরছে, ঘাড় না ফিরিয়ে সারাটা শরীর ঘোরাচ্ছে। আরেকবার শিউরে উঠল রানার শরীর।

‘মিস্টার সরোজ গুপ্ত, এতদিন আপনার নামই শুনেছি কেবল, আজ আপনার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে সত্যিই আনন্দ বোধ করছি।’ কাছাকাছি এসে দাঁড়াল উ-সেন। ওর হাত ধরে হুইল চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়াল স্যুই থি। রানার গাল, দাড়ি, গোঁফ, নাক, কপাল ছুঁয়ে দেখল উ-সেন। দম আটকে পড়ে রইল রানা। ওদিকে মিসেস গুপ্তের অবস্থাও তথৈবচ। ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে রয়েছে সে এদিকে। কথা বলেই চলেছে উ-সেন। ‘অবশ্য আপনি আমার অপরিচিত নন। আপনার কথা এতই শুনেছি ফ্যান সুর কাছে যে সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও আপনার নিত্যনৈমিত্তিক অনেক অভ্যাস, এমন কি মুদ্রাদোষ পর্যন্ত জানা হয়ে গেছে আমার। আপনার প্রতি ফ্যান সুর অকৃত্রিম ভালবাসার কথা জেনে এক সময় রীতিমত ঈর্ষা বোধ করেছিলাম আমি, কিন্তু আজ আপনার জন্যে দুঃখই বোধ করছি। কি ভয়ঙ্কর নাগিনীর পাল্লায় আপনি পড়েছেন ভাবতেও গা শিউরে উঠছে।’ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল উ-সেন। হুয়াং, তোমার একখানা চুরুট ছাড়ো তো ভায়া।’ সোফার দিকে এগোল উ-সেন। রানা লক্ষ করল, দরজায় দাঁড়ানো প্রহরী দুজন কখন যেন আলগোছে এসে দাঁড়িয়েছে হুইল চেয়ারের চার হাতের মধ্যে। তুমি কোনজন? ফ্যান সু?’ বলল উ-সেন।

সিগারেটের চেয়েও সরু একটা সিগার বের করে দিল ডক্টর হুয়াং উ-সেনের হাতে, ঠোঁটে লাগাতেই আগুন ধরিয়ে দিল সেটায়। বলল, তিন নম্বর সোফায়।

মিসেস গুপ্তের সামনে এসে দাঁড়াল উ-সেন। ছুঁয়ে দেখল মুখটা। বলল, ‘বাহ, কি সুন্দর! কে বিশ্বাস করবে এই সৌন্দর্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক উদ্যতফণা গোক্ষুর—পিছন ফিরলেই এক মুহূর্ত দ্বিধা করবে না যে ছোবল দিতে?’

‘ও আমাকে বলেছিল মারা গেছ তুমি,’ ফ্যাসফেঁসে কণ্ঠে বলল মিসেস গুপ্ত। ‘মাসুদ রানা বলেছিল খুন করেছে তোমাকে।’

মিসেস গুপ্তের পাশের সোফায় বসে পড়ল উ-সেন। ‘আর তুমি তা বিশ্বাস করেছিলে। বোকার মত।’ হাসল উ-সেন। হুয়াং-এর দিকে ফিরে বলল, ‘ডাক্তার, সরোজ গুপ্তকে সুস্থ মনে হচ্ছে না কেন?’

‘ফ্যান সু বলছে ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে।‘

‘ও। স্যুই থি, চুরুটটা নিভে গেছে—ধরিয়ে দাও তো, লক্ষ্মী।’ কর্নেল শেখের দিকে ফিরল উ-সেন। ‘দেখলেন? আমি বলেছিলাম না, রেঙ্গুন থেকে এতদূর আমাদের পিছু পিছু ধাওয়া করে আসার পিছনে ফ্যান সুর বিশেষ কোন মতলব আছে? প্রমাণ হলো?’ হাসল সে। ‘আসলে বেশ কিছুদিন যাবৎ আমার মৃত্যু কামনা করে আসছে ও মনে মনে, তাই মাসুদ রানার কথায় খুব সহজেই বিশ্বাস করে বসেছে। তাই না, ফ্যান সু? ওকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজনও রোধ করোনি, কিভাবে হত্যা করেছে আমাকে? মাথার খুলির ঠিক নিচে ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছিল সে আমাকে। যে কোন সাধারণ লোক ওই আঘাতে অক্কা পেতে এক সেকেন্ডের বেশি দেরি করবে না।’

‘হায় হায়!’ প্রায় ফিস ফিস করে বলল মিসেস গুপ্ত। নিজের অজান্তেই রানার দিকে চাইল সে। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখটা। রানা বুঝল, সাবধান না হলে ধরা পড়ে যাবে সবার কাছে মিসেস গুপ্ত।

‘এখন আর হায় হায় করে কি লাভ, ফ্যান সু? খুন করতে পাঠাবার সময় ওকে বলে দেয়া উচিত ছিল তোমার। ওই বেচারার দোষ নেই। দোষ তোমার। ও জানবে কি করে যে আমার ঘাড় আগে থেকেই মটকানো ছিল?’ রানার দিকে ফিরল উ-সেন। ‘এই আধ-পাগলা সার্জন মেরামত করেছিল আমাকে প্লেন ক্র্যাশের পর, মিস্টার সরোজ গুপ্ত। কিছু কিছু জিনিস সে ফিরিয়ে দিতে পারেনি আমাকে। যেমন দৃষ্টি শক্তি। কিন্তু বাদ বাকি সবই করেছে সে সাধ্য মত।’ মাথার পিছন দিকটায় টোকা দিল সে দুটো। ‘অডন্টয়েড প্রসেসকে প্রোটেকশন দেয়ার জন্যে এই চামড়ার নিচে আছে একটা স্টীল প্লেট। যদিও মাসুদ রানার প্রচণ্ড আঘাতটা চুল পরিমাণে এদিক ওদিক হয়নি, একেবারে ডেড সেন্টারে ঠিক জায়গা মত পড়েছে, বেচারার দুর্ভাগ্য, স্টীলের পাত ভেদ করবার ক্ষমতা দেয়নি ভগবান তাকে।’ কয়েকটা টান দিল সে সরু চুরুটে। এখনও মাথাটা ধরে আছে, এছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি আমার। আমার কপাল ভাল, আমার আর সব সহযোগীরা ফ্যান সুর মত যখন তখন রঙ বদলায় না, আমার প্রতি ভালবাসায় বা বিশ্বস্ততায় কোন খাদ নেই ওদের।

‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, উ-সেন,’ কসমেটিক কেস থেকে সিগারেট বের করে ধরাল মিসেস গুপ্ত। রানা লক্ষ করল হাতটা কাঁপছে ওর। ‘তোমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি আমি। আমি জানতাম না মাসুদ রানা তোমাকে হত্যা করতে এসেছে রেঙ্গুনে। যখন আমার সামান্য ভুলে ঘটে গেল ঘটনাটা, এবং পরমুহূর্তে এসে হাজির হলো আমাদের মৃত্যুদূত, তখন এছাড়া আর কি করবার ছিল আমার, বলো?’ উ-সেনকে চুপ করে থাকতে দেখে কর্নেল শেখের দিকে ফিরল মিসেস গুপ্ত। ‘আমি বুঝতে পারছি, এদের সাথে আর কোন ভাবেই আপস হবে না আমার। এরা আমার দিকটা ভাবতে মোটেই প্রস্তুত নয়। কাজেই আবার একবার আমার প্রস্তাবটার কথা ভেবে দেখবার অনুরোধ করছি আপনাদের, কর্নেল। মাসুদ রানা এবং তার ছিনিয়ে নেয়া ফাইলটা এখন আমার হাতে, পেতে হলে আমার সাথে চুক্তি করতে হবে।

‘ধরো যদি আমি বলি মাসুদ রানাকে কব্জায় পাওয়ার জন্যে জেনারেল যতটা উৎসুক, আমিও ঠিক ততটাই—তাহলে?’ বলল উ-সেন। ‘হাজার হোক আমার ঘাড়টাই ভাঙার চেষ্টা করেছিল সে, কর্নেল বা জেনারেলের নয়। সেক্ষেত্রে তোমার বক্তব্য কি?’

বক্তব্য একই। আমার দরকার মার্কিন পাসপোর্ট, প্লেনের টিকেট, কিছু টাকা এবং নিরাপত্তা।’

‘সরোজ গুপ্তের প্রতি প্রেম?’

‘প্রেম মিছে মায়া।

‘বা বা বা! কেমন বোধ করছেন, মিস্টার সরোজ গুপ্ত? একেই ভালবেসেছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন আপনি। কেমন লাগছে এখন?’ কর্নেল শেখকে উসখুস করতে দেখে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে একটা হাত তুলল উ-সেন। ‘আমি জানি, মাসুদ রানাকে হাতে পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কি পরিমাণ উদ্‌গ্রীব। আপনার অনুভূতি আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছি, কর্নেল শেখ। আপনি চাইছেন, যদি সত্যিই ওর হাতে মাসুদ রানা বন্দী হয়ে থাকে তাহলে গোলমাল না করে ও যা চাইছে দিয়ে তাকে হস্তগত করা দরকার। কিন্তু আমার কিছু কথা আছে। আমি বিশ্বাস করি, কোন না কোন কৌশলে আটকে ফেলেছে ও মাসুদ রানাকে। কিন্তু তাই বলে ওর অন্যান্য কথা বিশ্বাস করবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আমি দেখতে পাই না। অন্য কোন মতলব আছে ওর। আরও কোন ক্ষতি করবার প্ল্যান এঁটেছে ওরা। মাসুদ রানাকে আপনাদের হাতে তুলে দেয়ার আর কোন কারণই দেখতে পাই না আমি একটি ছাড়া—সেটি হচ্ছে, উ-সেনকে হত্যা করে তৃপ্তি হয়নি ওদের, ওরা আপনাকে এবং জেনারেল এহতেশামকেও হত্যা করতে চায়।’

‘যদি তাই হয়,’ বলল কর্নেল শেখ, ‘তাহলে ওকে বন্দী করা আমাদের জন্যে আরও জরুরী প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে করে হোক ওকে আনতে হবে আমাদের হাতের মুঠোয়। তার জন্যে প্রয়োজন হলে মিসেস গুপ্তকে…’

‘কিছুই দিতে হবে না।’ মুচকি হাসল উ-সেন। ‘মাসুদ রানা এখন আমাদের হাতের মুঠোতেই আছে। আপনার তিন হাতের মধ্যে বসে আছে সে, কর্নেল শেখ।’ আঁতকে উঠে এদিক ওদিক চাইল কর্নেল শেখ। রানার দিকে না চেয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বলল উ-সেন, ‘আপনার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমার পরিষ্কার কোন ধারণা নেই, মিস্টার মাসুদ রানা, সত্যিই ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে কিনা পরীক্ষা করবে ডাক্তার এক্ষুণি। ইতিমধ্যে যদি একচুল নড়াচড়া করেন তাহলে খুলি ফুটো হয়ে যাবে আপনার। দুটো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ম্যাগনাম তাক করে ধরা আছে আপনার মাথার দিকে।

.

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল কর্নেল শেখ। বলেন কি?’ আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার দিকে। এপাশ ওপাশ চাইল সে রানা যদি হঠাৎ আক্রমণ করে বসে তাহলে কিভাবে আত্মরক্ষা করবে বুঝে নেয়ার জন্যে। কর্নেলের ভয় সঞ্চারিত হয়েছে জেনারেলের মধ্যেও। উঠে দাঁড়িয়েছে সেও।

দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল স্যুই থি। হ্যাঁচকা টান দিল রানার দাড়ি ধরে চড়চড় করে ছিঁড়ে উঠে গেল কয়েকগুচ্ছ দাড়ি, জ্বালা করে উঠল রানার গাল ঠাশ ঠাশ দুটো চড় কষাল সে রানার গালে। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, ‘শুয়োরের বাচ্চা!’

উ-সেনের প্রতি মাত্রাধিক আসক্তির পরিচয় পেয়েছে রানা তার প্রতিটা সহযোগীর ব্যবহারে। চুম্বকের মত আশ্চর্য এক আকর্ষণ আছে লোকটার মধ্যে রানা লক্ষ্য করেছে, সে নিজেও বেশ খানিকটা দুর্বলতা বোধ করেছে এই আশ্চর্য লোকটার জন্যে। অন্ধ লোকটাকে হত্যা করে খুশি হতে পারেনি সে। যদিও সে জানে উ-সেনের প্রতি দুর্বলতা একটা অন্ধ বাঘের খাঁচায় ঢুকে তার জন্যে মমতা বোধ করবারই সমতুল্য-তবু লোকটার বিরুদ্ধে ক্রোধ বা ঘৃণার উদ্রেক করতে পারেনি সে নিজের মধ্যে। এখন মিসেস গুপ্তের কোন কথাই বিশ্বাসযোগ্য হবে না উ-সেনের কাছে, কিন্তু রানা জানে উ-সেন জীবিত আছে জানলে কিছুতেই দলের বিরুদ্ধে যেত না মিসেস গুপ্ত। এই আকর্ষণের উৎসটা কোথায় জানবার বড় ইচ্ছে হলো ওর। কেন এমন মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে ওকে ওর লোকজন?

‘মিস্টার মাসুদ রানা জানেন একটু নড়াচড়া করলেই মারা পড়বেন উনি, বলল উ-সেন। কিন্তু তবু একটু যেন বেশি স্থির মনে হচ্ছে ওঁকে। ফ্যান সু ওঁকে জানিয়ে দাও, তোমাদের খেলা শেষ হয়েছে।’

‘ভুল বুঝেছ, উ-সেন। মাসুদ রানা নড়াচড়া করছে না সত্যি সত্যিই নড়বার ক্ষমতা নেই বলে। লাইটিক ককটেল দিয়েছি আমি ওকে। নানান কথায় ওর বিশ্বাস উৎপাদন করেছিলাম, তাই কাবু করতে অসুবিধা হয়নি।’

‘ওকে বিশ্বাস করা কত বিপজ্জনক, দেখলেন তো, মিস্টার মাসুদ রানা? যাই হোক, ডাক্তার, দেখো দেখি একটু পরীক্ষা করে, ফ্যান সুর এই কথাটায় বিশ্বাস করা যায় কিনা?’

এগিয়ে এসে রানার একটা চোখ ফাঁক করুন হুয়াং দুই আঙুলে, সামান্য ঝুঁকে পরীক্ষা করল।

‘যায়। কিন্তু লাইটিকের প্রভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।’

মাথা ঝাঁকাল উ-সেন আপন মনে। ‘ব্যাপারটা বেশ ঘোরাল হয়ে উঠছে। কি বলেন, জেনারেল?’

‘পিস্তল যখন আছে, ওকে গুলি করলেই তো সবকিছু সহজ হয়ে যায়?’ বলল জেনারেল। ‘ঘুমন্ত অবস্থাতেও ভয়ঙ্কর এই লোক। এর সম্পর্কে সব শুনেছি আমি শেখের কাছে। আমার মনে হয়, এক্ষুণি গুলি করা উচিত।

হাঃ হাঃ করে হাসল উ-সেন। ‘আপনি দেখছি ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গেছেন। কেন বাঙালীদের হাতে আপনারা তুলোধুনো হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে কিছুটা। আপনার মুখে এই কথা আশা করিনি আমি, জেনারেল। যাই হোক, ফ্যান সু, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারব তোমার এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য; তার আগে সত্যি করে বলো দেখি ঠিক কয়টার সময় শেষ ইঞ্জেকশনটা দিয়েছ?’

‘ঘণ্টা দুয়েক আগে হাফ ডোজ দিয়েছি। এদের সাথে কথা-বার্তায় পড়তা না পড়লে এখান থেকে বেরোতে ওর সাহায্য দরকার পড়তে পারে মনে করেছিলাম।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মিসেস গুপ্ত। ‘তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, মাসুদ রানা। তোমার সত্যিকার পরিচয় জানলে হয়তো এখানে এভাবে নিয়ে আসতাম না তোমাকে। এখন বুঝতে পারছি, তোমাকে বুদ্ধি দিয়ে পরাজিত করতে পারিনি আমি আসলে; তোমার মহত্ত্বের সুযোগ নিয়েছি মাত্র।’ কোলের উপর রাখা কসমেটিক কেসের ভিতর লাইটারটা রেখে দিয়ে ছোট বাক্সটা বের করে আনল সে নিতান্ত অবলীলাক্রমে। উ-সেনের দিকে ফিরে বলল, ‘আবার একবার নতি স্বীকার করছি আমি তোমার বুদ্ধির কাছে, উ-সেন। আমি বুঝতে পারছি, আমার প্ল্যান ভেস্তে গেছে, মাসুদ রানা এখন তোমাদের হাতের মুঠোয়, ফাইলটাও কোথায় আছে জেনে যাবে তোমরা ওর ওপর নির্যাতন চালালেই। তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কাজেই এখন বিদায় নিতে চাই আমি। অনুমতি দিলেই উঠতে পারি।

‘কী চমৎকার মহিলা, তাই না, কর্নেল?’ সব কটা দাঁত বেরিয়ে গেল উ-সেনের। ‘এর অস্বাভাবিক বুদ্ধির কথা বলেছি আপনাকে, অতুলনীয় সৌন্দর্য তো দেখতেই পাচ্ছেন চোখের সামনে; সেই সাথে অপূর্ব রস বোধের পরিচয় ও পাওয়া যাচ্ছে, তাই না?

‘রসিকতা আমি করছি না, উ-সেন।’ গম্ভীর মিসেস গুপ্তের চোখ মুখ। ‘স্যুই থি, উ-সেনকে বলো আমার হাতে কি দেখতে পাচ্ছ। কেউ আমার দিকে এক পা এগোলেই ফেলে দেব আমি এটা মাটিতে।’

হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল উ-সেন। প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ‘কি আছে ওর হাতে? ওর কসমেটিক কেসটা কেড়ে নেয়া হয়নি?’

ভীত চকিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাইল স্যুই থি। বলল, ‘না। ওর হাতে একটা পাতলা কাচের বল দেখা যাচ্ছে, আর কিছুই নেই।’

‘এই ছোট্ট বলের ভিতর এই ঘরের প্রত্যেককে খুন করার পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে ক্লোরিন গ্যাস আছে,’ বলল মিসেস গুপ্ত দৃপ্ত ভঙ্গিতে। ‘তুমিই দিয়েছিলে এটা আমাকে, উ-সেন।’ উঠে দাঁড়াল সে। ‘কেউ যদি বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, এই ঘরের কেউ যদি একটু নড়াচড়াও করে, হাত থেকে ফেলে দেব আমি বলটা। এর ফলে আমিও মারা যাব ঠিকই, তোমরাও কেউ বাঁচবে না।’

চোখের পাতা পর্যন্ত সাবধানে ফেলছে এখন ঘরের প্রতিটা লোক।

ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোল মিসেস গুপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *