দশ
সিট্রন ডি.এস. নিয়ে বেরিয়ে এল রানা আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্ক থেকে রাস্তায়। একটা লাল রঙের ফিয়াট সিক্স-হানড্রেড ছোট্ট গর্জন তুলে স্টার্ট নিল কাছাকাছি একটা গলিমুখে।
এ রাস্তায় ও রাস্তায় ঘুরল রানা মিনিট দশেক। মনে মনে ভবিষ্যৎ কর্তব্য স্থির করছে সে। নানকিং হোটেলে লোক আছে উ-সেনের, এখন কি সেখানে যাওয়া ঠিক হবে? গুপ্ত দম্পতির সাথে রানার যে যোগ রয়েছে সেকথা জানা হয়ে গেছে উ-সেনের দলের, ওদের সাহায্য নেয়া কি ঠিক হবে? কি করবে রানা?
কর্তব্য পরে ঠিক করা যাবে, ভাবল রানা। এখন প্রথম কাজ ওদের সাবধান করে দেয়া।
কয়েকটা ব্যাপারে খটকা রয়ে গেছে রানার মনে, গোলমেলে ঠেকছে গোটাকতক ঘটনা। কিন্তু হাজার ভেবেও এর সমাধান বের করা যাবে না, বুঝতে পারছে সে। কাজেই মাথা থেকে দূর করে দিল সে বিক্ষিপ্ত
ভাবনাগুলো। আগের কাজ আগে।
মিনিট দশেক ঘোরাঘুরির পর যখন পরিষ্কার বুঝতে পারল লাল ফিয়াট ছাড়া আর কোন গাড়ি অনুসরণ করছে না, তখন একটা সিনেমা হলের সামনে সার বাঁধা গাড়ির ভিড়ে আরেক গাড়ির পেছনে সিট্রন ডি. এস-এর নাক ঠেকিয়ে দিয়ে নেমে এল সে। রাস্তায় অপেক্ষা করছে লাল ফিয়াট। রানা এগোতেই বামপাশের দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেল। উঠে বসল রানা। গাড়ি ছেড়ে দিল সোফিয়া মং লাই।
‘প্রথমেই চলো এমন কোন গোপন জায়গায় যেখানে টেলিফোন আছে।’ সোফিয়ার দিকে চাইল রানা। ‘আছে এরকম কোন নিরাপদ জায়গা?’
‘আছে।’
‘বার্মিজ পোশাকে কিন্তু চমৎকার লাগছে তোমাকে।
‘ধন্যবাদ।’ মিষ্টি করে হাসল সোফিয়া।
জেটির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল সোফিয়া। মিনিট দুয়েক চুপচাপ কাটল। সিগারেট ধরাল রানা। একবুক ধোঁয়া নিয়ে ছাড়ল আয়েস করে, ঝিরঝিরে হাওয়ায় প্রাণটা জুড়িয়ে গেল ওর, পনেরোতলা বিল্ডিং-এর দুঃস্বপ্ন দূর হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবার খবর জানতে চাইলে না?’
‘একা ফিরতে দেখেই বুঝতে পেরেছি বাবা এখানে নেই, থাকলে কিছুতেই একা আসতেন না আপনি।’ রানাকে অবাক হয়ে চাইতে দেখে বলল, ‘আমার মধ্যে দুর্ধর্ষ ভয়ঙ্কর, আদিম আরাকানীর রক্ত আছে-মানুষ চিনতে ভুল হয় না আমার। লক্ষ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার মধ্যে। তাছাড়া পনেরো তলার এক জানালা থেকে আরেক জানালায় যেতে দেখেছি আমি আপনাকে। সেটা দেখে, এবং তারপর আপনার হাতে ফাইল দেখে সহজেই অনুমান করতে পারছি কি ঝড় বয়ে গেছে ওখানে। কে জয়ী হয়েছে বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না।’ সোজাসুজি চাইল সোফিয়া রানা চোখে অকপট দৃষ্টিতে, ‘সন্ধান পেয়েছেন?’
‘মান্দালয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে তোমার বাবাকে।’
মাথা ঝাঁকাল সোফিয়া। কোন কথা না বলে গাড়ি চালানোয় মন দিল। দশ মিনিটে পৌছে গেল ওরা নদীর ধারের একটা দোতলা বাড়িতে। সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলার চিলেকোঠায় উঠে এল রানা সোফিয়ার পিছু পিছু। ছোট্ট একটা ঘর, বাথরূম আছে অ্যাটাচড। সিঙ্গল একটা খাট দেয়ালের গায়ে লাগানো, আলনায় ভাঁজ করা দামী কাপড়, অন্তর্বাস ঝুলছে। টেবিলের উপর টুকিটাকি প্রসাধনী। তেপায়ার উপর দাঁড়িয়ে নদীর দিকে চেয়ে রয়েছে একটা শক্তিশালী টেলিস্কোপ। রানা বুঝতে পারল কিভাবে রানার ছদ্মবেশের কথা জেনেছিল সোফিয়া। খাটের মাথার কাছে তেপায়ার উপর রাখা টেলিফোনটা দেখে খুশি হলো রানা সবচেয়ে বেশি। বসে পড়ল সে খাটের কিনারে। বলল, ‘কাল ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচলে কি করে?’
ডেকের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আপনাদের সব কথা শুনেছিলাম আমি কাল।’ হাসল সোফিয়া। ফলে জামা-কাপড় জুতোর দু’শো গজের মধ্যে যাইনি।’ একটু যেন লজ্জা পেল, ‘ওই রকম ন্যাংটো হয়েই ফিরে এসেছিলাম এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে
ফাইলটা খুলল রানা। দশ মিনিট ধরে উল্টে গেল একটার পর একটা পাতা। মাঝে মাঝে মন দিয়ে পড়ল কয়েকটা পৃষ্ঠা, বাকিগুলো উল্টে গেল চোখ বুলিয়েই। গোটা কয়েক নকশা রয়েছে ফাইলে, নকশাগুলোর উপরে কয়েকটা বিভিন্ন রঙের চিহ্ন রয়েছে কেবল-কোন্ অঞ্চলের নক্সা বুঝতে পারল না রানা। কিন্তু মনে মনে মুখস্থ করে ফেলল প্রতিটা দাগ। কয়েকটা কাগজে বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ সাহায্যের স্বীকৃতি রয়েছে। এগুলো পড়তে পড়তে মেজর জেনারেল রাহাত খানের মুখের চেহারা কি আকার ধারণ করবে ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলল রানা। বন্ধ করে দিল ফাইল।
‘আপনার নির্দেশমত আমার একশো লোককে পাঠিয়ে দিয়েছি আকিয়াবের পথে…
‘শুনেছি খবরটা।’
‘এইবার?’ প্রশ্ন করল সোফিয়া। ‘এখন কি করতে হবে আমাকে?’
মান্দালয়ে যেতে হবে।’ সহজ উত্তর দিল রানা।
‘আর আপনি?’
‘ভাবছি।’ বলল রানা গম্ভীরভাবে। ‘আমার ওপর হুকুম আছে, কাজ শেষ হলেই নানকিং হোটেলের সেই মহিলার হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। গোপনে পাচার করবে সে আমাকে রেঙ্গুন থেকে ব্যাংকক। আমার কাজ শেষ।
‘এখন সেই মহিলার কাছে চলেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে আমার বাবাকে উদ্ধার করব কি করে?’ চিন্তিত হয়ে পড়ল সোফিয়া। হুকুম যদি থাকে তাহলে তো মানতেই হবে তা আপনাকে। ‘
‘সেই সাথে আমাকে এ-ও বলে দেয়া হয়েছে, যা ভাল বোঝো অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে।’
‘কি ভাবছেন?’
‘ভাবছি, বিবাহিতা মহিলার কাছে আত্মসমর্পণ করব, না, অবিবাহিতা মহিলার কাছে…
হাসল সোফিয়া। বলল, ‘কোনটা বেশি লোভনীয় মনে হচ্ছে?’
‘শেষেরটা।’
চট করে রানার দিকে চাইল সোফিয়া। ‘তার মানে সাহায্য পাচ্ছি আপনার?’ রানাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ। আপনি বাঁচালেন আমাকে। নানকিং হোটেলে যাচ্ছেন না তাহলে?’
‘যাচ্ছি, কিন্তু পাচার হচ্ছি না। এই ফাইলটা তুলে দেব শুধু ওদের হাতে।’
আমার আকুল অনুরোধ ছাড়া আর কোন কারণ আছে এই মত পরিবর্তনের?
‘আছে। পাঁচটা কারণ আছে।’
‘কি সেগুলো?’
‘জানতে চাইছ কেন?’
‘একসাথে কাজ করতে হলে পরস্পরের ভাবনা-চিন্তা জানা দরকার।’
‘আমার একমাত্র ভাবনা এবং চিন্তা হচ্ছে কি করে তোমার সাথে ভাব করা যায়। তোমাকে ইয়টে দেখার পর থেকে মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে রয়েছে।’
‘এড়িয়ে যাচ্ছেন আমার প্রশ্ন।’
‘ঠিক আছে, শোনো তাহলে। প্রথমত, আমাকে পাচার করবার যে পদ্ধতির কথা শুনলাম, সেটা আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। দ্বিতীয়ত, ওরা জেনে গেছে যে আমি গতকাল নানকিং হোটেলে একা ডিনার খাইনি, কার সাথে খেয়েছি খুব সম্ভব তাও জেনে গেছে-কাজেই এখন ওদের সাহায্য নেয়াটা রিস্কি। তৃতীয়ত, আমি মনে করি, আমার কাজের মাত্র চারভাগের এক ভাগ সারা হয়েছে। বাকিটুকু সারতে হলে তোমার বাবার সাহায্য দরকার আমার। সাহায্য পেতে হলে প্রথমে তাকে মুক্ত করতে হবে। চতুর্থত, আজকের পৃথিবীতে সহজ সরল সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর মেয়ে দুর্লভ। মেয়েটাকে ভাল লেগে গেছে আমার। তার মুখে হাসি ফোটাতে পারলে ধন্য মনে করব নিজেকে।’
রানাকে থামতে দেখে জিজ্ঞেস করল সোফিয়া, ‘আর পঞ্চম কারণ?’
‘আর কোন কারণ নেই। একটা বেশি হাতে রেখেছিলাম, যদি কাজে লেগে যায়।
মৃদু হাসল সোফিয়া। আজকে কি কি ঘটল উ-সেনের ওখানে? সামান্য একটু অংশ দেখতে পেয়েছি আমি, সবটা জানতে ইচ্ছে করছে। বলতে আপত্তি আছে?’ একটা চেয়ার টেনে রানার মুখোমুখি বসল সে।
‘দাঁড়াও, টেলিফোনটা সেরে নিই আগে।’
গাইড থেকে নম্বর বের করে রিং করল রানা নানকিং হোটেলে। রিসিভারের ওপর রুমাল চেপে ধরে বলল, ‘পাঁচশো আশি নম্বর স্যুইটের মিস্টার অথবা মিসেস সরোজ গুপ্তকে দিন।’
রিং দিচ্ছে রিসেপশনিস্ট, শুনতে পাচ্ছে রানা। পুরানো আমলের টেলিফোন সিস্টেম। বার দশেক রিং হওয়ার পর রিসিভার তুলল কেউ
রিসেপশনিস্ট বলছে, ‘মিসেস গুপ্ত বলছেন?’
একটু ইতস্তত করার পর উত্তর এল, ‘উনি তো নেই এখানে, সিনেমায় গেছেন।’
রিসেপশনিস্ট বলল, ‘মিস্টার গুপ্ত বলছেন তো?
আবার সামান্য দ্বিধা, তারপর উত্তর: ‘হ্যাঁ।’
কি যেন বলতে যাচ্ছিল সোফিয়া, ঠোটের ওপর আঙুল রেখে চুপ করতে নির্দেশ দিল ওকে রানা। চুপ হয়ে গেল সোফিয়া।
রিসেপশনিস্ট বলল, ‘আপনার টেলিফোন। কথা বলুন।
রানাই প্রথম কথা বলল। ইংরেজিতে। ‘মিস্টার গুপ্ত? আমি আব্বাস মির্জা বলছি। কেউ শুনছে না তো?’
‘না। কি ব্যাপার?’
‘বিপদে পড়েছি, সাহায্য দরকার আমার। আসব?’
‘চলে আসুন।
‘কখন এলে সুবিধা হয় আপনাদের?’
‘এক্ষুণি চলে আসুন। আমার মিসেস গেছে সিনেমায়। চলে আসুন, গল্প করা যাবে।
‘এক্ষুণি?’ চিন্তিত রানার চোখ মুখ। ঘড়ি দেখল। ‘এক্ষুণি তো আসতে পারছি না, ভাই। মাত্র খেতে বসেছি। এখন বাজে দশটা, আমি সোয়া এগারোটা নাগাদ পৌঁছুব, বড়জোর সাড়ে এগারোটা হবে।’
সাড়ে এগারোটায় আমার মিসেসও ফিরবে। দুজন একসাথে এই ঘরে ঢোকা ঠিক হবে না। এগারোটার মধ্যেই চলে আসার চেষ্টা করুন। সেটাই ভাল হবে। দরজা খোলাই থাকবে, নক না করে সোজা ঢুকে পড়বেন। কেমন?’
‘ঠিক আছে, ঠিক এগারোটায় পৌছুব আমি। রাখলাম।’
রিসিভারটা নামিয়ে রেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল রানা। পিস্তলটা বিছানার উপর রেখে দিয়ে রওনা হবার উপক্রম করল।
অবাক হয়ে রানার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল সোফিয়া, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘নানকিং হোটেল।’
পৌঁছুতে মাত্র পনেরো মিনিট লাগবে। এগারোটার তো এক ঘণ্টা বাকি আছে।’
‘ভাবছি, আগেই চলে যাই। শুভস্য শীঘ্রম।’
রওনা দিচ্ছিল রানা, চট করে ওর একটা হাত ধরে ফেলল সোফিয়া। ‘কি হয়েছে? কোন বিপদ? আমার কাছে গোপন করছেন কেন?’
‘গোপন করছি কোথায়?’ হেসে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রানা। ‘ফিরে আসব আধ ঘণ্টার মধ্যেই।’ আবার এগোবার চেষ্টা করল।
হ্যাঁচকা টান দিয়ে থামাল ওকে সোফিয়া। ‘আমি যাব সাথে?’
‘না।’
‘কি হয়েছে? এত গম্ভীর কেন? বলতেই হবে আমাকে। না বললে আমিও যাব সাথে।’ বাচ্চা মেয়ের মত গোঁ ধরল সোফিয়া। ‘আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ভয়ানক কিছু ঘটেছে।’
মৃদু হাসল রানা। বুঝতে পারছি, মেয়েটা শুধু সহজ সরল সুন্দর ও ভয়ঙ্করই নয়, বুদ্ধিমতিও।’ হাল ছেড়ে দিল সে। ‘বলো, কি জানতে চাও?’
টেলিফোনে মিথ্যে কথা বললেন কেন?’
‘কারণ, যে টেলিফোন ধরেছিল সে সরোজ গুপ্ত নয়। অন্য লোক।’
সোফিয়ার দুই চোখে বিস্ময়। ‘সেই জন্যেই নির্ধারিত সময়ের আগেই আচমকা গিয়ে হাজির হতে চাইছেন?’ রানাকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে দেখে বলল, ‘মারামারি হবে মনে হচ্ছে। খুনোখুনিও হতে পারে। আমাকে সাথে নিলে সুবিধে হতে পারে আপনার।’
‘তুমি এখনও এক্সপোজ্ড হওনি ওদের কাছে। স্কার্ট ছেড়ে সারং ধরায় চট করে চিনতেও পারবে না। এটা একটা মস্তবড় অ্যাডভান্টেজ। তোমার আপাতত আড়ালে থাকাই ভাল।’
কথাটার যৌক্তিকতা বুঝতে পারল সোফিয়া। বলল, ‘এই বিপদের মধ্যে না গেলেই কি নয়? আপনার কি ধারণা সত্যিই বিপদে পড়েছে গুপ্ত দম্পতি?’
‘হ্যাঁ। বেশি দেরি হয়ে গেলে বিপদের মাত্রা বাড়বে বই কমবে না। আমি এখানেই তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট করব। চলি।’
হঠাৎ দুই হাতে রানার গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো সোফিয়া রানার ঠোঁটে-প্রথমে অপটু আড়ষ্টভাবে, দ্বিতীয়বার হৃদয়ের আবেগ মিশিয়ে। মৃদু মধুর শ্যাম্পুর গন্ধটা পেল রানা আবার। রানার বুকের সাথে সেঁটে গালে গলায় বন্য জন্তুর মত গাল ঘষল, কপাল ঘষল সোফিয়া। তারপর যেমন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি হঠাৎই ছেড়ে দিল সে রানাকে।
ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল রানা। কানে বাজছে সোফিয়ার সাবধানবাণী-সাবধানে থেকো, প্লীজ। তোমাকে আমার দরকার।
.
নানকিং হোটেল। ছয়তলার লম্বা করিডর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে রানা ৫৮০ নম্বর স্যুইটের দিকে। জনশূন্য করিডর।
প্রথমে নিঃশব্দে চৈষ্টা করে দেখল রানা হ্যান্ডেলে চাপ দিয়ে। খুলল না দরজা। ভেতর থেকে বন্ধ। গুনে গুনে তিনটে টোকা দিল-রানা। পায়ের শব্দ পাওয়া গেল ভেতরে।
‘কে?’ গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ ।
‘বেয়ারা। আপনার হুইস্কির বোতল, স্যার।’ জবাব দিল রানা।
চাবি ঘোরানোর শব্দ হলো। হ্যান্ডেলটা নিচু হতেই প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিল রানা দরজার গায়ে। অস্ফুট একটা আর্তধ্বনি শুনতে পেল সে। ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল রানা।
বামহাতটা ডানহাতে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়েন ফ্যাঙ। রানাকে দেখেই ভয়ানকভাবে আঁতকে উঠল। ডানহাতটা চলে গেল ওর জ্যাকেটের পকেটে।
দুই পা এগিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নক আউট পাঞ্চ কষাল রানা ফ্যাঙের নাকের ওপর। হুড়মুড় করে দেয়ালের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেলো সে। প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল রানা ওর ওপর। সেলাইমেশিনের স্পীডে দুই হাতে ঘুসি চালাল রানা ওর নাকে, মুখে, বুকে, পেটে। পকেট থেকে একটা সাইলেন্সার ফিট করা ল্যুগার বেরিয়ে এসেছিল ওর ডান হাতে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে ওর দশ সেকেন্ডের মধ্যেই। একটানা পনেরো সেকেন্ড মেশিন চালিয়ে থামল রানা।
মাটিতে শুয়ে আছে ফ্যাঙ। মুখটা আর চিনবার উপায় নেই, দলিত মথিত রক্তাক্ত এক মাংসপিণ্ড মনে হচ্ছে। সামনের তিনটে দাঁত অদৃশ্য হয়ে গেছে ওর।
একটানে একটা ইজিচেয়ারের উপর তুলে দিল রানা ফ্যাঙের জ্ঞানহীন দেহটা। ওরই বেল্ট, টাই আর রুমাল দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধল ওর মুখ, হাত, পা। পিস্তলটা তুলে নিয়ে রাখল নিজের পকেটে।
এতক্ষণ একটি শব্দ পাওয়া যায়নি পাশের বেডরূম থেকে। ব্যস্ততা সত্ত্বেও নিজের অজান্তেই কান পেতে শুনবার চেষ্টা করেছে রানা এতক্ষণ। এবার এসে দাঁড়াল বেডরূমের দরজায়। চিত হয়ে শুয়ে আছে সরোজ গুপ্ত। পাশে পড়ে আছে একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা।
খোলা চোখ দুটোতে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ রয়েছে এখনও। যদিও সব আতঙ্কের ঊর্ধ্বে চলে গেছে সে এখন।