পাঁচ
হ্যান্ডব্যাগে মেয়েলি টুকিটাকি জিনিস আর রানার দেয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছাড়া কিছুই নেই। মেয়েটি সম্পর্কে জানা গেল না কিছুই। গায়ে হাত দিয়ে টের পেল রানা, ঘণ্টাখানেক আগে মারা গেছে মেয়েটা, রিগর মর্টিস শুরু হতে দেরি আছে, কিন্তু শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
রানার স্যুটকেস, ডেস্কের ড্রয়ারে যত কাগজপত্র, বিছানার তলা, এবং মেঝেতে বিছানো কার্পেটের তলা তন্নতন্ন করে সার্চ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষ মাথা ঘামাল না সে। হাজার খুঁজেও কিছুই পাওয়া যাবে না, জানে রানা। কিন্তু আপত্তিকর কিছু রেখেও তো যেতে পারে রানাকে বিপদে ফেলার জন্যে?
কেবিনের প্রত্যেকটা জিনিস পরীক্ষা করল রানা সুশৃঙ্খলভাবে। না। কিছুই প্ল্যান্ট করে রেখে যায়নি আততায়ী। একটা চুরুটের টুকরো পাওয়া গেল শুধু ঘরের কোণে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে বসে পড়ল রানা খাটের কিনারে।
কেন হত্যা করা হলো এই অসহায় মেয়েটিকে? কারা করল কাজটা? প্রশ্ন করা হয়েছিল মেয়েটাকে। কি প্রশ্ন? আব্বাস মির্জার আসল পরিচয় কি? কোথায় গিয়েছে সে? সে যখন আব্বাস মির্জাকে ছদ্মবেশে ওর বোটে করে শহরে যেতে দিয়েছে, তখন কিছু জানি না বললে চলবে না, নিশ্চয়ই সব জানে সে। আগে থেকে প্ল্যান করা ছিল সবকিছু।
বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে যে মোটা লোকটাকে বসিয়ে রেখেছিল রানা, কাজটা তারও হতে পারে। জ্ঞান ফিরে পেয়ে হয়তো সোজা চলে এসেছে এই ইয়টে, রানাকে না পেয়ে প্রতিশোধ নিয়ে গেছে এই মেয়েটির উপর। রানাকে হারিয়ে ফেলেছে সে, এই অপরাধ ঢাকবার জন্যেও করতে পারে কাজটা।
ছদ্মবেশ ধারণ করে ওদের ফাঁকি দিতে পারেনি রানা, তার মানে নিশ্চয়ই আশেপাশের কোন জাহাজ থেকে ইনফ্রা-রেড লেন্স লাগানো বিনকিউলার চোখে লাগিয়ে নজর রাখা হয়েছিল ওর উপর। রানাকে ইয়ট ছেড়ে যেতে দেখেছে ওরা, ফিরে আসতেও দেখেছে।
আচ্ছা! ওকে পুলিসের ঝামেলায় ফেলবার কৌশল নয়তো এটা?
কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা কথাটা নিয়ে, তারপর বাদ দিয়ে দিল সম্ভাবনাটা। আর যাই হোক ওকে পুলিসী ঝামেলায় ফেলবে না উ-সেনের দল। এর মধ্যে আবার তৃতীয় কোন দল নেই তো? সোফিয়া মেয়েটা কে? যতদূর মনে হয় উ-সেনের দলের নয়, হলে সামান্য কথায় ওর চেহারা ফ্যাকাসে করে দেয়া সম্ভব হত না রানার পক্ষে। কাজটা কি মেয়েটার দলের লোকের? বোঝা যাচ্ছে না। তবে এমন কারও, রানার সত্যিকার পরিচয় জানা যাদের জন্যে অত্যন্ত জরুরী।
যাক, আগের কাজ আগে।
উঠে পড়ল রানা। দড়ি খুলে ছেড়ে দিল নৌকোটা। জোরে একটা ঠেলা দিল পা দিয়ে। অন্ধকারের বুকে মিলিয়ে গেল সেটা স্রোতের টানে।
এইবার মেয়েটাকে বিদায় করতে হবে, তারপর প্রস্তুত থাকতে হবে আক্রমণ ঠেকাবার জন্যে। রানা জানে আক্রমণ আসবেই। ইয়ট ছেড়ে শহরে যাবার কারণ জানতেই হবে ওদের। অবলীলায় তুলে নিল রানা মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে। বিছানার চাদরে রক্তের ছোপ দেখতে পেল সে। লাল থকথকে রক্ত। হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা আক্রোশ ফুঁসে উঠল রানার বুকের ভেতর্! দপ দপ করছে মাথার মধ্যে শিরাগুলো। বুকের ভিতর প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল যেন একসাথে চারটে ক্রুদ্ধ বাঘ। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল ব্যথা হয়ে গেল ওর। নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না নিজের মধ্যে। অনেক কষ্টে সামলে নিল রানা। প্রচণ্ড আক্রোশটা রূপ নিল শীতল এক ভয়ঙ্কর হিংস্রতায়। দৃঢ়পায়ে চলে এল রানা ইয়টের পিছন দিকটায়। লাইফবোটের পাশে মৃতদেহটা শুইয়ে দিয়ে ব্লাউজ আর সারং খুলে ফেলল। দ্রুতহাতে কাপড় পরাল সে মৃতদেহে। তারপর হাত ধরে নামিয়ে দিল নিচে, আওয়াজ না করে যতটা সম্ভব আস্তে ছেড়ে দিল হাত দুটো। ছোট্ট একটা ছপাৎ শব্দ করে তলিয়ে গেল শরীরটা খাড়াভাবে। কোথাও বেধে না গেলে খুব সম্ভব একুশ মাইল দূরে গাল্ফ্ অফ মার্তাবানে ভেসে উঠবে লাশটা আগামীকাল।
লাশটা নামাতে গিয়ে ডেকের কিনারে শুয়ে পড়তে হয়েছিল রানাকে। কান পেতে শুয়ে রইল সে আরও এক মিনিট। ইয়টের গায়ে ছোট ছোট ঢেউয়ের মৃদু চাপড়ের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এবার চাদরের রক্ত ধুয়ে ফেললেই সমস্ত প্রমাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। উঠতে যাচ্ছিল রানা, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।
আসছে। অস্পষ্ট একটা কুল কুল শব্দ কানে এসেছে রানার। সাঁতার কেটে আসছে কেউ। হাত দশেক দূরে আছে এখনও, কিন্তু শুনতে ভুল হয়নি রানার। এইদিকেই আসছে।
ক্রূর এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। নিঃশব্দে সরে গেল সে লাইফবোটের আড়ালে। আসুক। দুটো মৃতদেহ চলে যাবে একই জায়গায়। জুতোর গোড়ালি থেকে ছোট্ট ছুরিটা চলে এল রানার ডানহাতে।
ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে রানা। দড়ি বেয়ে উঠে আসছে লোকটা। আবছামত দেখা যাচ্ছে মাথা আর কাঁধ। দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে এল। দাঁতে চেপে ধরা ছুরিটা হাতে নিল, তারপর রেলিং টপকে চলে এল এপাশে। কয়েক পা সরে এল লোকটা ঘন অন্ধকারের দিকে, রানার হাতের নাগালের মধ্যে। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। ডেকের উপর টুপটাপ পানি পড়ছে গা থেকে ঝরে, ছিটে আসছে রানার চোখেমুখে।
লাফ দিল রানা।
আঁতকে উঠল লোকটা। ঝট করে ফিরল রানার দিকে। ডান হাতটা উঠে গেল মাথার উপর। বামহাতে জুডো চপ মারল রানা লোকটার কবজি থেকে আট ইঞ্চি উপরে। ছিটকে পড়ে গেল ছুরিটা হাত থেকে খসে। ডেকের উপর খট খট শব্দ তুলে চলে গেল সেটা হাত দশেক দূরে।
ঝট করে সেঁটে গেল রানা লোকটার গায়ের সাথে। বামহাতে পেঁচিয়ে ধরে টানল সামনে, ডানহাতে ধরা ছুরিটার দিকে। নিঃশব্দে সারতে হবে কাজটা। চার ইঞ্চি ব্লেডের ছোট্ট ছুরিটা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল রানা লোকটার হৃৎপিণ্ড বরাবর, সেকেন্ডের দশ ভাগের একভাগ সময় লাগবে আর লোকটার ঢলে পড়তে, অন্তিম চিৎকারটা আটকে দেবে রানা ঠিক সময়মত মুখে হাত চেপে। কিন্তু থমকে গেল সে। চট করে সরিয়ে আনল ছুরি ধরা হাতটা।
বুদ্ধি দিয়ে বুঝে ওঠার আগেই রানার শরীর টের পেয়ে গেছে, কিছু একটা গোলমাল আছে। ওর বামহাত চেপে বসেছে একটা নরম স্তনের উপর, দ্বিতীয় স্তন চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ওর শক্ত পেশীবহুল বুকের চাপে, হালকা একটা শ্যাম্পুর পরিচিত গন্ধ এসেছে রানার নাকে।
মেয়ে। নগ্ন একটা মেয়ে। শুধু জাঙ্গিয়া পরা।
পরমুহূর্তে চিনতে পারল রানা- সোফিয়া। এঁকেবেঁকে ছটফট করছে, রানার বজ্র আলিঙ্গন থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে। কামড় দিল রানার হাতে। একহাতে কিল মারছে রানার পিঠে।
ছুরিটা আলগোছে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে রানা জুতোর গোড়ালিতে। ডানহাতে মুচড়ে ধরল সে মেয়েটার হাত। কানের কাছে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে খুন করতে এসেছিলে? আমাকে?’
মুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে গেল মেয়েটা। বলল, ‘ওহ্ আপনি! আমি ভেবেছিলাম ওদের হাতে পড়েছি। ছেড়ে দিন, কথা আছে আপনার সাথে। জলদি। প্লীজ, বোকামি করবেন না, আমি শত্রু নই, ফ্রেন্ড।’ ধস্তাধস্তি বন্ধ হয়ে গেছে মেয়েটার।
‘সে তো বুঝতেই পারছি। একেবারে বুযম-ফ্রেন্ড। পিছু পিছু ধাওয়া করে বেড়াচ্ছ কি মতলবে?’ হাত ছেড়ে দিল রানা। ‘ছুরি হাতে নিঃশব্দে ইয়টে উঠেছ কোন্ কথা বলতে? মৃত্যুর?’
‘আপনি জানেন না, কিছুক্ষণ আগেই আমি আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছি।’
‘তাই নাকি? কিভাবে?
‘নানকিং হোটেলের গেট থেকে আপনার পিছু পিছু লোক এসেছিল বটগাছ পর্যন্ত, রিভলভার বের করেছিল গুলি করবার জন্যে। ঠিক যখন নিশানা করছে, পিছন থেকে ছুরি মেরেছি আমি ওকে।’
‘আশ্চর্য!’ অবাক হলো রানা মেয়েটার নির্বিকার বক্তব্য শুনে। ‘কোথায় সে লোকটা?’
‘পড়ে আছে একটা কাঠের ভেলার ওপর।’
‘কেন করতে গেলে কাজটা?’
‘আপনাকে মেরে ফেললে আমাকে সাহায্য করবার আর কেউ থাকবে না।’
কথাগুলো দুর্বোধ্য ঠেকল রানার কাছে। বুঝল, মেয়েটির কাছ থেকে সব কথা আদায় করতেই হবে। মনে হচ্ছে ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে মেয়েটা। কতটা কি জানে জানতেই হবে ওর। বলল, ‘চলো কেবিনে গিয়ে শুনব তোমার কথা।
ভেকের উপর থেকে ছুরিটা তুলে নিতে যাচ্ছিল মেয়েটা, পা দিয়ে সরিয়ে দিল রানা ওটা, নিচু হয়ে ঝুঁকে তুলে নিল নিজে। কেবিনের দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বেলে দিল সে।
বিছানার দিকে চেয়ে একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরোল মেয়েটার মুখ থেকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে রয়েছে সে রক্তে ভেজা চাদরটার দিকে। বাথরূম থেকে একটা তোয়ালে দিল রানা মেয়েটাকে। রানাকে আড়াল করে গা মুছে ওড়নার মত করে তোয়ালেটা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করল।
‘এটা কিসের রক্ত বলতে পারো?’
‘পারি। মানুষের। বেশ্যা মেয়েটাকে খুন করেছ তুমি।’ বিস্ফারিত চোখে চাইল সোফিয়া রানার দিকে। মনে হলো ভয় পেয়েছে।
‘তোমারও একই অবস্থা হবে সত্যি কথা না বললে। বসো ওই চেয়ারটায়।’ ভয়ে ভয়ে আদেশ পালন করল মেয়েটা। ‘এবার বলো, তুমি কি করে জানলে ওটা বেশ্যা মেয়ের রক্ত?’
সোফিয়ার ছুরিটা পরীক্ষা করছে রানা গভীর মনোযোগ দিয়ে। এই ধরনের ছুরি আগে কোথাও দেখেছে রানা, কিন্তু মনে করতে পারল না। ব্যাল্যান্সটা চমৎকার, এটা দিয়ে ইচ্ছে করলে ত্রিশ ফুট দূর থেকেও একটা টিকটিকির মাথা গেঁথে ফেলতে পারবে রানা। ডগাটা বিশেষ এক ঢঙে বাঁকানো। হাতির দাঁতের হাতলের ভিতর যেখানটায় ছুরির ফলা এসে ঢুকেছে, সেইখানে তাজা রক্তের আভাস দেখতে পেল রানা। মেয়েটা সত্যি কথা বলছে কিনা জানা নেই রানার, কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই যে এই ছুরি দিয়ে কাউকে আঘাত করা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই রানার। সোফিয়ার দিকে ফিরল সে, ‘কই, উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
‘আমি দেখেছি মেয়েটাকে এই ইয়টে উঠতে।’
‘কি করে দেখলে?’
খানিক ইতস্তত করে নিরুত্তর থাকাই স্থির করল সোফিয়া।
‘কি করে দেখলে? আর দেখলেই যদি, বিশ মিনিটের মধ্যে ণ্ড্য ড্যাগনে পৌছুলে কি করে? তোমার কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, একটু স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলো।’
‘আমি অনুসরণ করেছিলাম আপনাদের।’
তার মানে আমার পেছনে যে আরেকজন লোক লেগেছে সেটাও জানা ছিল তোমার? শ্য ড্যাগনের মারামারিটাও দেখেছ তাহলে তুমি?’
মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।
‘কে তুমি? কি চাও আমার কাছে?’
‘সব কথা আপনাকে জানাতে আপত্তি নেই আমার, কিন্তু আপনি সঠিক লোক কিনা না জানলে একটি কথাও বলব না। ভুল করবার উপায় নেই, আমার। একটু ভুল হয়ে গেলেই সর্বনাশ ঘটে যাবে।’ সরাসরি চাইল সে রানার চোখের দিকে। ‘আপনি উ-সেনের বন্ধু?’
সতর্ক হয়ে গেল রানা। ‘তোমার এ প্রশ্নের কারণ?
‘কয়েকটা কারণ আছে, কিন্তু একটি কারণও ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না আপনার সত্যিকার পরিচয় না পেলে।’
‘তাহলে তো ভারি অসুবিধে,’ বলল রানা। ‘আমার সাথে অনেক কথা আছে বলছ, আবার বলছ আমার সত্যিকার পরিচয় না জানলে বলা যাবে না সে কথা-এ দুটোই পরস্পরবিরোধী কথা। আমার পরিচয় না জানলে আমার সাথে কথা থাকতে পারে না তোমার। তাছাড়া আমি উ-সেনের শত্রু কি বন্ধু তোমাকে বলতে যাব কোন্ ভরসায়? তোমার সত্যিকার পরিচয়ও তো জানি না আমি। কাজেই অবস্থাটা চালমাত হয়ে বসে আছে। তুমিও নিশ্চিত না হয়ে মুখ খুলবে না, আমিও না। অতএব, তুমি এবার আসতে পারো। অল্পক্ষণের মধ্যেই লোক এসে পড়বে আমার কাছে, তুমি যদি শত্রুপক্ষের মেয়ে হয়ে থাকো, তাহলে বিপদ হবে আমার।’
মনে মনে পর্যালোচনা করে দেখল মেয়েটা রানার বক্তব্য। খানিক পর মাথা নাড়ল। ‘ঠিকই, শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারলে বড় ভাল হত। বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও করছে, কিন্তু আমার সামান্যতম ভুলে কতবড় ক্ষতি হয়ে যাবে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’
‘সেই ক্ষেত্রে একটা কাজ করা যায়। অনেকটা খেলার মত। আমরা দুজন প্রশ্ন করে যেতে পারি একের পর এক, উত্তর দেয়া বা না দেয়া আমাদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে, কেউ জোরাজুরি করতে পারবে না। একজন একবারে একটার বেশি প্রশ্ন করতে পারবে না।’
ঠিক বুঝলাম না। একরাশ প্রশ্ন করে কি লাভ যদি আমরা কেউ উত্তর না দিই? তাছাড়া মিথ্যা বলছেন কিনা বুঝবার উপায় কি?’
‘সত্য মিথ্যা বোঝাটা যার যার বুদ্ধির ওপর নির্ভর করবে। ধরো, তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করলে। আমি যদি মনে করি এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার জন্য বিপজ্জনক, আমি উত্তর দেব না। কিন্তু যদি মনে করি এ প্রশ্নের উত্তর দিলে আমার কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই, সত্যি কথাটাই বলব। এটুকু সত্যতা আশা করব আমরা পরস্পরের কাছে। তাছাড়া প্রশ্নের চাতুরি দিয়ে সত্য মিথ্যা বুঝবার উপায় তো খোলা থাকল দুজনের জন্যেই।
এবার ব্যাপারটা বুঝল মেয়েটা। মৃদু হাসল। বলল, ‘এইভাবে আলাপ করতে গিয়ে হয়তো যা জানতে চাই জেনে ফেলতে পারব পরোক্ষভাবে, তাই না? ঠিক আছে প্রশ্ন করুন।
‘লেডিস ফার্স্ট।’
‘ঠিক আছে। আমার প্রথম প্রশ্ন: এই মেয়েটাকে খুন করেছেন কেন?’
‘আমি খুন করিনি।’
‘তাহলে কে খুন করেছে?’
উঁহুঁ। পর পর দুটো প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে। এবার আমার প্রশ্নের পালা। তবু তোমার প্রশ্নের উত্তরটা দিয়েই আমার প্রশ্ন শুরু করছি। উত্তর হচ্ছে: জানি না। এবার প্রশ্ন: বটগাছের নিচের মৃতদেহটা কি ভেলার ওপরই আছে, না পানিতে ফেলে দিয়েছ?’
‘ভেলার ওপরেই আছে। প্রশ্ন: আপনি কি উ-সেনের হয়ে কাজ করছেন?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: ইয়েন ফ্যাঙ বলে কাউকে চেনো?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: উ-সেনের লোক অনুসরণ করছে কেন আপনাকে?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: প্যাপন মং লাই বলে কাউকে চেনো তুমি?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: আপনি কি ভারতীয়?’
‘উত্তর: না। প্রশ্ন: তোমার মা এদেশী, না বাবা?’
‘উত্তর: বাবা। প্রশ্ন: উ-সেনের দলে যোগ দিতে এসেছেন?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: ছুরিটা কি আরাকানী?’
‘উত্তর: হ্যাঁ। প্রশ্ন: আপনি কি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের লোক?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: উ-সেনকে তুমি পছন্দ করো?’
‘উত্তর: ঘৃণা করি। প্রশ্ন: মেয়েমানুষের পোশাক পরে উ-সেনের লোককে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করেছিলেন কেন?’
‘উত্তর দেব না। প্রশ্ন: তাই দেখেই তুমি আমাকে মিত্র মনে করেছ?’
‘উত্তর: না! উ-সেনের লোককে মারতে দেখে। এবং আমার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে দেখে। প্রশ্ন: নানকিং হোটেলের মিসেস গুপ্ত কি আপনার মিত্র?’
‘উত্তর: জানি না। প্রশ্ন: যাকে ছুরি মেরেছ সে কি উ-সেনের লোক?’ উত্তর: হ্যাঁ। প্রশ্ন: কতক্ষণের মধ্যে এই ইয়টে লোক আশা করছেন?’
‘উত্তর: আগামী পাঁচ মিনিটের মধ্যে। আউট-বোর্ড ইঞ্জিনের শব্দ পাচ্ছি। প্রশ্ন: তোমার বয়স কত?’
‘উত্তর: বাইশ বছর। প্রশ্ন: আমাকে চিনতে পেরেছেন মনে হচ্ছে?’
‘উত্তর: পেরেছি। তোমার নাম সোফিয়া মং লাই। কোন্ ইয়ারে পড়ছ?’
‘উত্তর: থার্ড ইয়ারে। প্রশ্ন: বুঝলাম, আমার কাছ থেকে আপনার আর কিছু জানার নেই। সাহায্য পাচ্ছি আপনার?’
‘উত্তর: জানি না। প্রশ্ন: তোমার বাবা এখন রেঙ্গুনে?’
‘উত্তর: জানি না। অনেক খুঁজেও কোন হদিস পাচ্ছি না। প্রশ্ন: আমি যাকে খুঁজছি, আপনি কি সেই লোক?’
‘উত্তর: খুব সম্ভব। প্রশ্ন: আমি বা আমরা আসব, জানলে কি করে?’
‘উত্তর: বাবার কাছে। ধরা পড়ার আগের দিন বলেছিলেন। সেই থেকে অপেক্ষা করছি আমি। আমি জানি আমার বাবাকে উদ্ধার করার জন্যে পাঠানো হয়নি আপনাকে। সেইজন্যেই জোঁকের মত লেগে আছি আপনার পিছনে। আপনার কাজ আপনি করুন, আপনি প্রয়োজন বোধ করলে সাহায্য করতেও প্রস্তুত আছি আমি, যা চাইবেন তাই দিতে রাজি আছি, শুধু কথা দিন, ওই পশুদের কবল থেকে উদ্ধার করে দেবেন আমার বাবাকে। একবার বের করে আনতে পারলে আর ওদের সাধ্য নেই ওঁকে বন্দী করার। একশো আরাকানী যুবক রয়েছে এখন রেঙ্গুনে আমার হুকুমের প্রতীক্ষায়, প্রয়োজন হলে পাঁচ হাজার লোক দিতে পারব। লোকবল আছে আমার, কিন্তু ঠিক কোথায় এ বল প্রয়োগ করতে হবে জানা নেই। আমাকে এটুকু সাহায্য করতেই হবে। বলুন, করবেন?’
একেবারে কাছে এসে পড়েছে আউট-বোর্ড ইঞ্জিনের শব্দ। লাইট নিবিয়ে দিয়ে কেবিনের দরজা মেলে ধরল রানা। চাপাকণ্ঠে বলল, ‘কাল যাচ্ছি আমি উ-সেনের সাথে দেখা করতে। তোমার বাবার দেখা পাব কিনা জানি না, যদি পাই তাঁকে নিয়ে ফেরার চেষ্টা করব। দেখা না পেলেও সন্ধান বের করবার চেষ্টা করব, এটুকু কথা দিতে পারি। এর বেশি আর কিছুই করবার নেই আপাতত আমার।’ ছুরিটা ধরিয়ে দিল রানা সোফিয়ার হাতে। ‘যাও, এবার কেটে পড়ো। খুব সম্ভব প্রচুর মারধর করা হবে এখন আমাকে। তোমাকে যদি এই ইয়টে পায় তাহলে দুজনকেই খুন করে ফেলা হবে।’
‘কোনরকম সাহায্যে আসতে পারি আমি?’
‘তোমার একশো লোকের মধ্যে এমন কেউ আছে যে এই ইয়ট চালাতে পারে?’
‘অন্তত দশজন পাওয়া যাবে এরকম।’
‘গুড। কাল সন্ধের সময় আমি এই ইয়ট ছেড়ে চলে যাবার পর তোমার একশো লোককে চড়িয়ে দেবে এতে। এটাকে নিয়ে যেতে হবে আকিয়াবে। ওখানে নোঙর করে এই ইয়টের সমস্ত মালপত্র নিয়ে নিজেদের এলাকায় গিয়ে অপেক্ষা করতে বলবে ওদের।
‘কি আছে এই ইয়টে?’
‘অস্ত্র।’
‘সব লোককে পাঠিয়ে দেব, এখানে আমাদের লোক দরকার হবে না?’
‘না।’
‘আপনার নামটা জানতে পারি?’
‘আপাতত আমার নাম আব্বাস মির্জা। সত্যিকার পরিচয় এখন না জানলেও চলবে।’
‘ঠিক আছে, চললাম। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
অন্ধকারে মিশে গেল সোফিয়া মং লাই।