এক
ইয়েন ফ্যাঙকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা।
ঘুরে উঠল মাথাটা। অবাক হলো রানা ওষুধের প্রভাবের দ্রুততা দেখে। পরিষ্কার বুঝতে পারল, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়, যা করবার এক্ষুণি করতে হবে।
ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা মিসেস গুপ্তের উপর। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মিসেস গুপ্ত, আশ্চর্য গতিতে সরে গেল। হুমড়ি খেয়ে কপাটের গায়ে ধাক্কা খেল রানা। পড়ে যাচ্ছিল, কপাট ধরে সামলে নিল। ফিরল মিসেস গুপ্তের দিকে। ওয়ারড্রোবের গায়ে হেলান দিয়ে হাঁপাচ্ছে সে, ওর চোখে স্পষ্ট ভীতি দেখতে পেল রানা। সিরিঞ্জটা ফেলে দিয়েছে হাত থেকে। চোখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল এক গোছা চুল। প্রস্তুত রয়েছে সে রানার জন্যে। ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকায় সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে।
এগোল রানা। কিন্তু ইতোমধ্যেই অত্যন্ত শ্লথ হয়ে এসেছে ওর নড়াচড়া। অসম্ভব ঘুরছে মাথাটা। হাত পা নড়তে চাইছে না। মনে হচ্ছে সীসা দিয়ে তৈরি ওগুলো। মনে হচ্ছে পানির ভিতর দিয়ে এগোচ্ছে সে। হাত দুয়েক থাকতেই একটু কুঁজো হয়ে লাফ দিল মিসেস গুপ্ত। কাঁধ দিয়ে প্রচণ্ড এক গুঁতো দিল সে রানার সোলার প্লেক্সাসে। দুই হাতে ধরে ফেলল রানা ওর দুই বাহু কপালটা ওর বুকে ঠেসে ধরে ঠেলে নিয়ে চলেছে ওকে পিছন দিকে, সেই সাথে পা বাধিয়ে ল্যাং মারল মিসেস গুপ্ত ওর পায়ে। হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানা কার্পেটের উপর। ছুটে গেল হাত।
মন্থর বেগে জুডো চপ মারল রানা ওর ঘাড়ের পাশে। ককিয়ে উঠল একটু, তারপর এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে সরে গেল মিসেস গুপ্ত কয়েক হাত তফাতে। শাড়িটা খসে গেছে, ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার চোখের দিকে। হাঁপাচ্ছে।
আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই রানার। ইয়েন ফ্যাঙের চোখের উপর চোখ পড়ল রানার। বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে। হঠাৎ পিস্তলটার কথা মনে পড়ল। দেহের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে বহু কষ্টে ধীরে ধীরে পকেট থেকে পিস্তলটা বের করল রানা। তিন মন ওজন এখন নাইন এম. এম. ল্যুগারটার, সাইলেন্সারের ভারেই নেমে যেতে চাইছে মুখটা নিচের দিকে অনেক চেষ্টা করে পিস্তলের মুখটা ঘুরাল রানা মিসেস গুপ্তের দিকে। পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিসেস গুপ্ত। সোজা বুক লক্ষ্য করে টিপে দিল রানা ট্রিগার।
কই, গুলি তো বেরোল না!
রানা বুঝতে পারল, মনে মনে টিপেছিল সে ট্রিগারটা। আঙুলে কোন সাড়া নেই আর। দুটো মিসেস গুপ্ত দেখতে পাচ্ছে সে, হঠাৎ চারটা হয়ে গেল, পরমুহূর্তে আটটা, তারপর ষোলোটা—আবার একটা দেখা যাচ্ছে এখন। রানার মনে হচ্ছে সারা শরীর ওর সীসা দিয়ে তৈরি, ডুবে যাচ্ছে সে অতল সমুদ্রে। ডুবছে তো ডুবছেই, কোনদিন ভেসে উঠতে পারবে না সে আর। মনে মনে আরও বার কয়েক গুলি করে হত্যা করল সে মিসেস গুপ্তকে, তারপর খসে পড়ে গেল পিস্তলটা হাত থেকে। ঘরটা দুলছে চোখের সামনে, কেমন যেন উদাস হয়ে গেছে মনটা, যেন কিছুতেই কিছু এসে যায় না।
এগিয়ে এল মিসেস গুপ্ত, তুলে নিল পিস্তলটা, বসল রানার মাথার কাছে, বাম হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে যতদূর সম্ভব ফাঁক করল রানার একটা চোখ, তারপর সন্তুষ্ট হয়ে হাসল।
‘রীতিমত ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন। আমি ভাবছিলাম, হয়তো কোন বিশেষ কারণে ধরবে না ওষুধটা আপনাকে। হয়তো কোন ধরনের ইমিউনিটি রয়েছে আপনার শরীরে লাইটিক ককটেলের বিরুদ্ধে। এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। পঞ্চাশ গ্রাম প্রমেথাজাইনের সাথে একশো গ্রাম পেথিডিন মিশিয়ে সবটা আবার মেশাতে হয় পঞ্চাশ গ্রাম ক্লোরোপ্রমাজাইনের সাথে। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে এখুনি, খানিক বাদে বিন্দুমাত্র নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকবে না আপনার। চিন্তা চলবে মাথার ভিতর, কিন্তু প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকবে না। আশে পাশে কি ঘটছে টের ঠিকই পাবেন, কিন্তু সবকিছু আবছা ঠেকবে আপনার কাছে। যেন স্বপ্নের ঘোরে ঘটে যাচ্ছে সব।’ উঠে দাঁড়াল মিসেস গুপ্ত। বলল, ‘উফ্, অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। এক এক করে সেরে ফেলতে হবে এখন। কিছু মনে করবেন না, মিস্টার আব্বাস মির্জা, আপাতত কিছুক্ষণ মেঝেতেই শুয়ে থাকতে হবে আপনাকে। কাজ শেষ করে তারপর বাকি রাতটুকু প্রেম করব আমরা।’ রানার সর্বাঙ্গে দৃষ্টি বুলাল মিসেস গুপ্ত, হাসল, ‘নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারছেন, অসম্ভব যৌন উত্তেজনা আসছে এই ওষুধের প্রভাবে। আপনার নড়াচড়া করবার ক্ষমতা থাকবে না, কিন্তু ভয় নেই, আমি সাহায্য করব আপনাকে।’
অশ্লীল একটুকরো হাসি মিসেস গুপ্তের ঠোঁটে। পিস্তল হাতে এগিয়ে গেল সে ইয়েন ফ্যাঙের দিকে।
‘রক্তের দাগ থাকা চলবে না। কাজেই এমন ভাবে কাজটা করতে হবে যাতে এক ফোঁটা রক্ত কোথাও না লাগে। সরোজের বালিশ-চাদর শেষ, ওগুলো বদলি না করে উপায় নেই, কিন্তু এই পুরু কার্পেট যদি আমাকে বইতে হয় তাহলে বারোটা বেজে যাবে আমার।’ কথা বলতে বলতেই, যেন এমন কিছুই ব্যাপার না, এমনি ভঙ্গিতে ইয়েন ফ্যাঙের মাথার চাঁদিতে ধরল সে পিস্তলটা। আঁতকে উঠল ফ্যাঙ, নড়াচড়া করার চেষ্টা করল, কিন্তু নির্বিকার ভঙ্গিতে টিপে দিল মিসেস গুপ্ত ট্রিগার। দুপ করে একটা শব্দ হলো। একবার ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল ফ্যাঙের দেহটা। গুলিটা তালু ভেদ করে খাড়া ভাবে ঢুকে গেছে শরীরের ভিতর, গলা বেয়ে নেমে গেছে হয়তো পাকস্থলীতে—বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। অনেক খুঁজে বের করতে হবে পুলিসকে চুলের ভিতরের জখমটা। সন্তুষ্ট চিত্তে জখমটা একবার পরীক্ষা করে ফ্যাঙের মাথাটা সোজা রাখার জন্যে শরীরটা একটু নিচে নামিয়ে মাথাটা ঠেকিয়ে দিল মিসেস গুপ্ত ইজিচেয়ারের হাতলের সাথে। গুনগুন করে গান ধরেছে সে আপন মনে। রানার দিকে চোখ পড়তেই হাসল। ‘কি? উত্তেজিত বোধ করছেন না? দাঁড়ান, কাজটা সেরে নিই আগে।’ পাশের ঘরের দিকে চাইল মিসেস গুপ্ত।
‘আগে সরোজের ব্যবস্থাটা করে ফেলি, তারপর ধরব একে— ততক্ষণে একটু ঠাণ্ডা হয়ে নিক ব্যাটা।’
পাশের ঘরে চলে গেল মিসেস গুপ্ত। মিনিট পাঁচেক খুট খাট শব্দ শুনল রানা পাশের ঘর থেকে। তারপর দেখল বেরিয়ে আসছে সে সরোজ গুপ্তকে কোলে নিয়ে। রানা লক্ষ্য করল একটি দাড়িও নেই সরোজ গুপ্তের গালে। করিডরের দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল একবার, তারপর বেরিয়ে গেল মিসেস গুপ্ত। ছয়-সাত মিনিট পর ফিরে এল পাশের কোন কামরার খাট থেকে তোশক, বালিশ আর চাদর নিয়ে। বেডরুমের ভিতর আবার তিন-চার মিনিট খশখশ, মচমচ, খুটখাট শব্দ। এবার রক্তাক্ত চাদর, বালিশ আর তোশক নিয়ে বেরিয়ে এল সে বেডরূম থেকে। মহিলার গায়ে কি অসম্ভব শক্তি টের পেল রানা ভার বহনের অনায়াস ভঙ্গি দেখে। কয়েক মিনিট পর ফিরে এল মিসেস গুপ্ত খালি হাতে। রানার অসহায় অবস্থা দেখে হাসল খিলখিল করে। এগিয়ে গেল ইয়েন ফ্যাঙের দিকে। হাত-পা-মুখের বাঁধন খুলে বেল্ট ও টাই পরাল ফ্যাঙকে, তারপর অনায়াসে তুলে নিল লাশটা কাঁধের উপর। বেরিয়ে গেল করিডরে একবার সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মিনিট দশেক পর ফিরল এবার মিসেস গুপ্ত, হাঁপ ছাড়ল, হাতের তালু থেকে ধুলো ঝাড়ল তালি দিয়ে। হাসল রানার দিকে চেয়ে, দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল।
পিঠের নিচে এক হাত আর হাঁটুর নিচে অপর হাত ভরে দিয়ে কোলে তুলে নিল সে রানাকে। মুখটা নামিয়ে আলতো করে চুমো খেল রানার ঠোঁটে, তারপর নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল সরোজের বিছানায়। চোখ দুটো খোলা আছে রানার, সব দেখতে পাচ্ছে, সব শুনতে পাচ্ছে—কিন্তু মনে হচ্ছে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে সে আরও দ্রুত বেগে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে গেছে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে রানার কোলের কাছে বসে পড়ল মিসেস গুপ্ত। কনুইটা রানার বুকের ওপর রেখে হেলান দিল রানার গায়ে। অসম্ভব ব্যথা পাচ্ছে রানা, কিন্তু একবিন্দু নড়তে পারল না সে, কথা বলতে চেষ্টা করল, ঘড় ঘড় আওয়াজ হলো শুধু গলা দিয়ে। মুচকি হেসে কনুইটা সরিয়ে নিল মিসেস গুপ্ত বুকের ওপর থেকে। অর্ধেক খাওয়া সিগারেটটা ধরিয়ে দিল রানার ঠোঁটে। বলল, ‘পরীক্ষা করে দেখলাম। ব্যথার অনুভূতিটা ঠিকই রয়েছে, কিন্তু হাত-পা নড়ানো যাচ্ছে না, তাই না? এই ওষুধের মজাটাই এখানে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারবে না কেউ। আপনাকে মৃত বা অজ্ঞান ভাবতে পারবে না। বেশির ভাগ সময়ই ঝিমোবেন, কিন্তু কাঁধের উপর একটা টোকা দিলেই জেগে গিয়ে লোকজনের সন্দেহ দূর করবেন; অসুস্থ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবে না কেউ। অসুবিধা শুধু একটাই। বেশিক্ষণ থাকে না এই ওষুধের এফেক্ট, কয়েক ঘণ্টা পর পরই একটা করে ইঞ্জেকশন দিতে হয়। অবশ্য ডোজটা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়া যেত, কিন্তু তাতে ভয়ানক কোন জখম হয়ে যেতে পারে শরীরের ভিতর। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ডেলিভারী দিতে চাই আমি আপনাকে। রানার ঠোটে ঠোঁট ঘষল মিসেস গুপ্ত, এক এক করে খুলে ফেলল কোট, টাই, শার্ট, গেঞ্জি। এবার প্যান্ট ও জাঙ্গিয়াও নামিয়ে দিল। রানার আপাদমস্তক দেখল লোভাতুর দৃষ্টিতে। ঘড়ি দেখল।
চারটি ঘণ্টা সময় আছে এখন আমাদের হাতে। ভোর রাতে মেকাপ করতে বসব আপনাকে। বৃথা নষ্ট না করে আসুন সময়টা কাজে লাগানো যাক। বহুদিন এমন সুঠাম, ঋজু, দৃঢ় পুরুষের দেখা পাইনি।’ কামনা মদির দৃষ্টিতে আবার পরীক্ষা করল সে রানাকে আপাদমস্তক। উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। তারপর চলে এল বিছানায়। রানার বুকের ওপর
বিভীষিকাময় চারটি ঘণ্টা কেটে গেল শেষ পর্যন্ত। ভোর হয়ে আসতেই মুক্তি দিল মিসেস গুপ্ত রানাকে। সিরিঞ্জে করে ওষুধ নিয়ে এল আবার, রানাকে উপুড় করে ঢুকিয়ে দিল সূচটা ওর মেরুদণ্ডে। ভয়ঙ্কর ক্রোধ ছাড়া আর কোন অনুভূতি রইল না রানার ভিতর।
গোটা কয়েক বালিশ পিঠের কাছে দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসাল সে রানাকে, তারপর শেভিং ক্রীম আর ক্ষুর নিয়ে এল বাথরূম থেকে। অত্যন্ত অযত্নের সাথে রানার দাড়ি-গোঁফ কামাল মিসেস গুপ্ত, কয়েক জায়গায় কেটে গেল, ভ্রূক্ষেপও করল না, ঘ্যাচ ঘ্যাঁচ করে সোজা উল্টো যেমন খুশি ক্ষুর চালিয়ে সাফ করে দিল সব। তারপর বসল একরাশ নকল চুল দাড়ি নিয়ে। একটা দুটো করে লাগাতে শুরু করল নকল গোঁফ-দাড়ি। দাঁতের ফাঁকে জিভের উগা দেখা যাচ্ছে অতি-মনোযোগের ফলে। আধঘণ্টা পর সন্তুষ্ট চিত্তে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে পরীক্ষা করল সে রানাকে। কয়েকটা রঙিন পেনসিল দিয়ে কিছু জটিল দাগ টানল রানার কপালে, তারপর সরোজ গুপ্তের জামা কাপড় পরাতে শুরু করল ওর গায়ে। সারা রাতের পরিশ্রমের ফলে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে মিসেস গুপ্তের শরীর থেকে, এতক্ষণে খেয়াল পড়ল তার নিজের দিকে। চট করে স্নান সেরে এল বাথরূম থেকে। একটা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল।
‘আপনার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, কেন আপনাকে বন্দী করলাম, কি করব আপনাকে নিয়ে? আপনার কৌতূহল নিবৃত্ত করা আমার কর্তব্য। যদিও আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না রেখেই আমার যা খুশি তাই করব আমি, তবু নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার অধিকার আপনার আছে, এবং আমারও বলতে আপত্তি নেই। আসলে ব্যাপারটা আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার বিনিময়ে আমি নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিচ্ছি। কথাটা নিশ্চয়ই স্বার্থপরের মত শোনাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার মত এমন নীচ জঘন্য চরিত্রের মেয়েলোক পৃথিবীতে আর একটিও আছে কিনা সন্দেহ, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে যদি কখনও চিন্তা করবার সুযোগ পান তাহলে বুঝবেন, এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। উ-সেন বেঁচে থাকলে হয়তো কোন ব্যবস্থা করে নেয়া অসম্ভব হত না, আমার প্রতি দুর্বলতা ছিল ওর, কিন্তু ওর লোকজনের কাছে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আশা করি না আমি। বহুদিন সুযোগের অপেক্ষা করেছে হুয়াং আর স্যুই খি, দুচোখে দেখতে পারে না ওরা আমাকে—তার প্রমাণ নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছেন, দলের লোক হওয়া সত্ত্বেও একটা কথা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন বোধ করেনি, পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের খুন করবার জন্যে ইয়েন ফ্যাঙকে। আমাদের মধ্যেকার পারস্পরিক অপছন্দ আর রাখা ঢাকা নেই। ওদের শক্তি অনেক, ওদের সাথে টক্কর দিয়ে আমার পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। আপনাকে মিথ্যে বলেছিলাম, ভারতে গিয়ে আসলে নিস্তার পাব না আমি ওদের হাত থেকে। আরও অনেক দূরে সরে যেতে হবে আমাকে। এর একমাত্র উপায় হিসেবে আপনাকে বেছে নিয়েছি আমি। ওদের হাত থেকে নিস্তার পেতে হলে ওদের কাছেই ফিরে যেতে হবে আমাকে। কিন্তু ওদের কাছে আত্মসমর্পণ না করেও উপায় আছে আমার। আপনাকে তুলে দেব আমি পাকিস্তানী জেনারেলের হাতে, বিনিময়ে চাইব একটা আমেরিকান পাসপোর্ট এবং প্লেনের টিকেট।’
ফাইলটা তুলে নিল মিসেস গুপ্ত হাতে, পাতা উল্টে দেখল। মৃদু হাসি ফুটে উঠল ঠোটে। বলল, ‘এটা সাথে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। যাবার সময় রিসেপশনিস্টকে দিয়ে যাব, সাতদিন পর পোস্ট করবে সে এটা নির্দিষ্ট ঠিকানায়।’ কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানল মিসেস গুপ্ত। ‘ইয়েন ফ্যাঙকে মেরে ফেলার দরকার ছিল। সরোজ মারা গেছে একথা এখন আমি আর আপনি ছাড়া কেউ জানে না। বেশ কিছুক্ষণ খবরটা চেপে রাখতে চাই আমি। ওকে ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে যেত আগেই, তাহলে আর বারগেনিং-এর সুযোগ থাকত না।’ ঘড়ি দেখল মিসেস গুপ্ত, রানার দিকে চাইল, বলল, ‘ওষুধের প্রভাবটা এখন কি অবস্থায় আছে দেখে নিয়ে নাস্তার জন্যে বলব।’
হঠাৎ জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠেসে ধরল সে রানার হাতের তালুতে
হাতটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল রানা, অবাক হয়ে চেয়ে রইল হাতটার দিকে, একটা আঙুল নড়াবারও ক্ষমতা নেই ওর। ব্যথার চোটে চোখের পাপড়িগুলো কাঁপল শুধু বার কয়েক। সন্তুষ্ট চিত্তে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল মিসেস গুপ্ত অ্যাশট্রেতে। ফুঁ দিয়ে রানার হাতের তালু থেকে ছাইগুলো উড়িয়ে দিল। রানার মাথার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলল প্রচণ্ড ক্রোধ। কটমট করে চেয়ে রইল সে মিসেস গুপ্তের চোখের দিকে। রানার ভাবটা পরিষ্কার বুঝতে পেরে হাসল মিসেস গুপ্ত।
‘এই ওষুধের আর একটা গুণ, মনের ভাবটা চেপে রাখতে পারবেন না। আপনি রেগে গেছেন আমার ওপর, অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক, আমার বক্তব্য শোনার পর রেগে যাওয়া ছাড়া উপায় কি?’ টেলিফোনের রিসিভার কানে তুলে নিল মিসেস গুপ্ত। ‘গুড মর্নিং। আমি মিসেস গুপ্ত বলছি। হঠাৎ শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে আমার স্বামীর, বেড়ে গেছে আর্থিটিস। আজই মান্দালয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের। না না, চিন্তার কিছুই নেই। ডাক্তার লাগবে না। আগেও তো দেখেছেন, মাঝে মাঝেই হয় এরকম। এমন কিছুই নয়। বিশ্রাম ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই এখন।….হ্যাঁ, খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যাই হোক, নাস্তা খেয়েই রওনা হচ্ছি আমরা, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ভাল হয়। সোজা রেল স্টেশন।…নাস্তার পর। গুড। থ্যাংকিউ।
আরেকটা সিগারেট ধরাল মিসেস গুপ্ত, তারপর ফাইলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি একটু ঘুরে আসছি। আশেপাশের অবস্থাটা বুঝে নিতে হবে একটু–এটারও ব্যবস্থা করে আসি সেই সাথে।’ হাতের ফাইল দিয়ে চুলকাল পিঠটা। তবে একটা ব্যাপারে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার, মিস্টার আব্বাস মির্জা, কোন রকম গোলমাল করার চেষ্টা করে লাভ নেই। কোন উপায় নেই আপনার। সম্পূর্ণভাবে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে আপনি এখন। কাজেই দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে হাল ছেড়ে দেয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শরীর যখন চলছে না, তখন মনে মনে হাজারো প্ল্যান এঁটে কি লাভ? শুধু শুধুই কষ্ট বাড়ানো। তার চেয়ে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন বরং।
রানার কাপড়-চোপড় ভাঁজ করে একটা সুটকেসে ভরে ফেলল মিসেস গুপ্ত, তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আধশোয়া হয়ে বসে রইল রানা। মাথাটা ঘুরছে এখনও, মনে হচ্ছে শূন্যে ঝুলে রয়েছে সে। চিন্তার গতিও যেন মন্থর হয়ে এসেছে।
রানার পরিচয় জানা নেই ফ্যান সু গুপ্তের—জানা থাকলে আরও অনেক কিছু দাবি করতে পারত সে কর্নেল শেখের কাছে, রানাকে বন্দী করার বিনিময়ে বহু কিছুই দিতে প্রস্তুত থাকত পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স। পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, ঠিক পথেই চলেছে এই মেয়েলোকটা, যা চায় তা ঠিকই আদায় করে নিতে পারবে জেনারেল এহতেশামের মাধ্যমে, ডক্টর হুয়াং বা স্যুই থি আটকাতে পারবে না ওকে হাজার ইচ্ছে থাকলেও। মনে মনে মিসেস গুপ্তের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না রানা। যা করছে এটাই মিসেস গুপ্তের বাঁচবার একমাত্র পথ।
হাত দুটো মুঠো পাকাবার চেষ্টা করল রানা, কোন সাড়া নেই। আগামী কয়েক ঘণ্টা থাকবেও না। এই অবস্থায় কি করতে পারে
সে? কিভাবে মুক্ত করবে নিজেকে? গত রাতে রানাকে ফিরে না যেতে দেখে কি ভাববে সোফিয়া? কি করবে? ওকি এখানে খোঁজ নিতে আসবে? এলেই বা কি, দেখবে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গুপ্ত চলে যাচ্ছে হোটেল ছেড়ে, টেরও পাবে না সরোজ গুপ্তের ছদ্মবেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রানাকে। তাছাড়া টের পেলেও যে কোন সাহায্য করতে পারবে তা মনে হয় না।
একটা খটাং শব্দ শুনে চমকে উঠল রানা। আশ্চর্য! মনে মনেই চমকাল সে, বাইরে তার কোন প্রকাশ হলো না। ঘাড় ফেরাতে পারছে না বলে দেখতে পাচ্ছে না রানা কে এল। এত তাড়াতাড়ি ফিরবে না মিসেস গুপ্ত। তাহলে কে?
না। সোফিয়া না। বেয়ারা। ট্রলিতে করে ঠেলে নিয়ে এসেছে চা-নাস্তা। এক এক করে নামিয়ে রাখছে টেবিলের উপর। রানার দিকে একবার চেয়ে নিজের কাজে মন দিল সে। সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল রানা।
টেবিলটা সাজিয়ে রানার দিকে ফিরল বেয়ারা, বলল, ‘নাস্তা দিয়ে গেলাম, স্যার। মেম সাহেব এখুনি এসে পড়বেন।’
‘হেল্প মি!’ বলল রানা। কিন্তু গলা দিয়ে অস্পষ্ট একটা শব্দ বেরোল শুধু।
‘কি বললেন?’ কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল বেয়ারা।
রানা বুঝল কথা দিয়ে কিছুই বোঝাতে পারবে না সে। অস্বাভাবিক কিছু একটা করতে হবে ওর সন্দেহ উৎপাদন করতে হলে। এমন ভাবে সে বসে আছে যে একটু বাঁয়ে সরতে পারলেই মেঝেতে পড়ে যাওয়া সম্ভব হবে। প্রাণপণ চেষ্টায় একটু কাত হলো রানা। ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছে সে বিছানা থেকে।
রানাকে উত্তর দিতে না দেখে বেয়ারা ভেবেছিল শুনতে ভুল করেছিল সে, চলে যাচ্ছিল, কিন্তু রানাকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে এল। ধরে ফেলার আগেই পড়ে গেল রানা মেঝেতে মুখ থুবড়ে। ঠিক এমনি সময়ে ঘরে এসে ঢুকল মিসেস গুপ্ত।
‘কি হয়েছে?’ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল মিসেস গুপ্ত। ব্যাপার বুঝতে পেরে বেয়ারাকে বলল, ‘একটু ধরতে হবে। তুমি পায়ের দিকটা ধরো।
‘কি যেন বলতে চেষ্টা করছিলেন উনি, ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ বলল বেয়ারা। মনে হচ্ছিল খুব কষ্ট হচ্ছে ওনার।’
‘অসুখটা বেড়েছে।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল মিসেস গুপ্ত। দুজন মিলে তুলে দিল রানাকে বিছানায়। রানার প্রতি মায়া ঝরে পড়ছে মিসেস গুপ্তের দৃষ্টিতে। বলল, ‘ইশ্ দেখো তো, কপালটা ফুলে গেছে কি রকম! এত অস্থির হলে কি চলে? বিশ্রাম দরকার এখন তোমার। চুপচাপ শুয়ে থাকো, দু’দিনে ঠিক হয়ে যাবে।’ বেয়ারার দিকে চেয়ে বলল, ‘কাল সারা রাত ছট ফট করেছে বেচারা। ওর মনে হয়েছে চারদিক থেকে গোলমাল শুনতে পাচ্ছে।’
‘গোলমাল!’ অবাক হলো বেয়ারা। ‘গোলমাল হবে কি করে? পাঁচশো তিনে এক ফ্যামিলি আছে, তাছাড়া পুরো ফ্লোরই তো খালি।
‘আমি তা জানি, কিন্তু ওনাকে বোঝাবে কে বলো?’ হাসল মিসেস গুপ্ত। ‘চা-টা গরম আছে তো?’
‘একেবারে গরম, ম্যাডাম, তিন মিনিট আগে ঢালা হয়েছে ফুটন্ত পানি।’
‘গুড। নাস্তাটা সেরেই রওয়ানা হব আমরা, তখন তোমার সাহায্য দরকার পড়বে।’
‘ঠিক আছে, ম্যাডাম। ‘
বেরিয়ে গেল বেয়ারা। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল মিসেস গুপ্ত। ফুটন্ত চায়ের পটটা হাতে তুলে নিয়ে বিছানার পাশে এসে বসল।
‘বারণ করা সত্ত্বেও চেষ্টার ত্রুটি রাখছ না তুমি, আব্বাস মির্জা। পেলে কোন সাহায্য বেয়ারার কাছ থেকে?’ বাঁকা করে হাসল মিসেস গুপ্ত। ‘চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। নাও, চা খাও!’
মুখটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু নড়াতে পারল না। পটের নলটা রানার দুই ঠোঁটের মাঝখানে ভরে দিয়ে কাত করল মিসেস গুপ্ত। ঠোঁট, জিভ পুড়ে গেল রানার, গাল বেয়ে নামল ফুটন্ত চা। চট করে একটা তোয়ালে টান দিয়ে নিয়ে মুছে দিল মিসেস গুপ্ত বাইরের চাটুকু, জামা কাপড় নষ্ট হতে দিল না। তারপর হাসল মধুর করে।
‘অভিজ্ঞতাটা যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু যারা আগুন নিয়ে খেলা করে তাদের আগুনের তাপটা জানা থাকা দরকার। বশ্যতা স্বীকার না করে উপায় নেই তোমার, আব্বাস মির্জা।’