রক্তের রঙ ১.১

এক

জলকল্লোল।

সাঁঝ হয়ে আসছে।

একা।

ডেকে বসে নিজের একাকীত্বকে অদ্ভুত নিবিড়ভাবে অনুভব করছে রানা। সূর্যাস্ত দেখে সবসময় কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে যায় ওর মন। একা থাকলে আরও। একটা দিন খসে গেল রানার জীবন থেকে-আরও একটা দিন। বড় অসহায়, ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেকে। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের বিশাল বিপুল আয়োজনের মধ্যে ওর স্থান কোথায়, মূল্যই বা কি? অথচ নিজেকে কত বড় করে দেখতে ভালবাসে মানুষ। সব অর্থহীন, সব ঝুটা।

ছোট্ট অ্যালিসক্যাফোর (ইয়ট) অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম অ্যালয়ের তৈরি খোলের গায়ে মৃদু চাপড় দিচ্ছে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ-কুল কুল ছলাৎ।

স্পীড বাইশ নট।

বিকেল থেকে সামান্য হাওয়া দিয়েছে উত্তর-পশ্চিম থেকে। সামান্য হাওয়াতেই চারফুটি ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা উঠে গেছে। রাতে ফসফরাসের আলো জ্বলবে সারা সমুদ্র জুড়ে। বেশ লাগবে দেখতে।

রোল করছে ইয়টটা ভালই লাগছে রানার। আলস্য আসছে দোল দোল দুলুনিতে।

টুইন ব্রাউন-বেভারি টার্বো সুপারচার্জার ফিট করা ফোরস্ট্রোক ডেইমলার বেঞ্জ ডিজেল ইঞ্জিনের মৃদু-গম্ভীর গর্জন, ঢেউয়ের ছল-ছলাৎ অবিরাম কলধ্বনি। আর সব চুপ। আশপাশে দুশো মাইলের মধ্যে একটি জনমানুষ নেই। একা।

বিশাল সমুদ্রের বুকে রানা একা। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু জল। সামুদ্রিক সোঁদা গন্ধ। ঢেউ। দূর সমুদ্রে হালকা কুয়াশার আভাস।

শীত শীত করছে ঠাণ্ডা হাওয়ায়। জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিল রানা।

হাওয়াটা বাড়বে নাকি আবার? আকাশের দিকে চাইল রানা। বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। অবশ্য ভয়ের কিছুই নেই। লিওপোল্ড রডরিক্সের তৈরি ইয়ট ডোবেনি আজ পর্যন্ত—তা সে যত বড় ঝড়ই উঠুক। তাছাড়া ‘ব্যালাস্ট’-এর কাজ করবে ইয়টের হোল্ডে ঠাসা কয়েক টন অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা বারুদের বাক্স। তাছাড়া বাংকারভর্তি আছে ডিজেল-চিন্তা কি?

ব্ল্যাক ডগের বোতল থেকে আরও দু’আউন্স তরল পদার্থ ঢালল রানা গ্লাসে। বরফ তুলে নিল কয়েক টুকরো। মনে মনে ধন্যবাদ দিল সোহেলকে। শালা ভোলেনি। এত অল্প সময়ে সবকিছু জোগাড়-যন্ত্র ব্যবস্থা করতেই জান বেরিয়ে যাবার কথা, এরই মধ্যে এক বোতল ব্ল্যাক ডগ ম্যানেজ করে দিয়েছে ও বুদ্ধি করে। এটা ছাড়া মুশকিলই হয়ে যেত রানার সময় কাটানো। অদ্ভুত নিঃসঙ্গ বোধ করছে সে, দম আটকে আসতে চাইছে থেকে থেকে। একেবারে একা।

অবশ্য সত্যিকার অর্থে একা ঠিক বলা যায় না। এক আশ্চর্য সঙ্গী জুটে গেছে ওর সাথে খুলনা থেকে শ’দুয়েক মাইল দক্ষিণে আসতেই। অ্যালবাট্রস পাখি একটা। পাখি না বলে আসলে উড়োজাহাজ বলা উচিত। একটা অস্টার প্লেনের সমান ওটার পাখার বিস্তার-কমপক্ষে ষোলো সতেরো ফিট। প্ৰকাণ্ড।

পৃথিবীর বৃহত্তম সামুদ্রিক পাখি এই অ্যালবাট্রস। সাদা গায়ে ঢেউ খেলানো খয়েরি দাগ, ডানা দুটো গাঢ় খয়েরি, পা দুটো হাঁসের পায়ের মত। সেই সকাল থেকে পিছু নিয়েছে, গ্লাইডারের মত নিঃশব্দে উড়ে চলেছে প্ৰকাণ্ড পাখিটা ইয়টের সাথে সাথে। ডানা ঝাপটানো নেই, শুধু পাখাদুটো মেলে দিয়ে ভেসে রয়েছে শূন্যে। মাঝে মাঝে ঝুপ করে ডাইভ দিয়ে নামছে সাগরজলে, এঁকেবেঁকে ছটফট করছে ওর ছুঁচোল ঠোঁটে ধরা সামুদ্রিক মাছ। খাওয়া সেরে ম্যালার্ডের মত পা টেনে টেনে খানিক সাঁতার কাটছে, ডিগবাজি খাচ্ছে, আবার উঠছে আকাশে।

ওঠাটা বড় অদ্ভুত। দুই ডানা মেলে ধরে পানির উপর থপ থপ পা ফেলে দৌড়ে চলে যাচ্ছে সত্তর আশি গজ, পা গুটিয়ে নিয়ে ভেসে পড়ছে বাতাসে, বারকয়েক পাক খেয়ে আকাশে উঠছে, তারপর আবার নিঃশব্দে অনুসরণ করছে ইয়টটাকে। বেশ ভাব হয়ে গেছে রানার সাথে।

শুনেছে রানা, একবারও পানিতে না নেমে শত শত মাইল উড়তে পারে এই পাখি জাহাজের পিছু পিছু। মারতে নেই, অমঙ্গল হয়। অ্যালবাট্রস নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক। কথাটা সত্যি হলেই ভাল। সৌভাগ্যের প্রতিটা বিন্দু প্রয়োজন পড়বে এবার ওর সফল হতে হলে।

সূর্যটা অনেকক্ষণ আগেই ডুবে গেছে সমুদ্রে। এবার লাল আভাটাও মুছে যাচ্ছে দ্রুত আকাশ থেকে। সাদা মেঘের গায়ের রঙগুলো কালচে হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামছে বঙ্গোপসাগরে নিঃশব্দ পায়ে।

নেভিগেশন লাইট জ্বেলে দিল রানা। পোর্ট সাইড, অর্থাৎ সামনের বামদিকে লাল আলো; আর স্টারবোর্ড সাইড, অর্থাৎ সামনের ডানদিকে সবুজ আলো; আর মাস্তুলের মাথায় সাদা আলো। কম্পাস দেখে কোর্সটা সামান্য একটু পরিবর্তন করে দিয়ে আবার এসে বসল ডেক চেয়ারে। আকাশে জ্বলে উঠেছে অসংখ্য তারা। একাদশীর ম্লান চাঁদটা উজ্জ্বলতর হচ্ছে ক্রমেই। সিগারেট ধরাল রানা। সমুদ্রের নীল জলরাশি এখন পেলিক্যান জেট ব্ল্যাক কালির মত দেখাচ্ছে।

আবছা আঁধার কেটে সমান গতিতে এগিয়ে চলেছে তিরিশ ফুট লম্বা অ্যালিসক্যাফো। ঢাকার, কর্মচাঞ্চল্য থেকে ঘণ্টায় পঁচিশ মাইল বেগে দূরে সরে যাচ্ছে রানা গত আঠারো ঘণ্টা ধরে। ঠিক একই বেগে এগিয়ে যাচ্ছে সে কোন্ বিপদের মুখে কে জানে! মাঝপথে ও এখন। আরও আঠারো ঘণ্টা-তারপর ‘ইয়ানগন’। ১৭৫৩ সালে ব্রহ্মদেশের রাজা আলোম্পার তৈরি তাঁর সাধের রাজধানী, ইয়ানগন। মানে, রেঙ্গুন।

হ্যাঁ, রেঙ্গুন। বিশ্ববিখ্যাত রহস্যময়ী বন্দরনগরী, রেঙ্গুন। বার্মার রাজধানী, প্যাগোড়া নগরী রেঙ্গুন। এককালের ভয়ঙ্কর দস্যু উ-সেনের প্রধান ঘাঁটি, রেঙ্গুন।

মেজর জেনারেল রাহাত খানের ধারণা ওখানেই জমে উঠেছে বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্যে এক বিচিত্র নাটক। এ নাটকের মাঝখানেই যবনিকা টানতে হবে রানাকে। একা। যে করে হোক ধ্বংস করে দিতে হবে এই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। কিন্তু কি করে? জবাব দিতে পারেননি মেজর জেনারেল, বলেছেন, সে আমি জানি না।

মুচকি হাসল রানা। ওর ওপর অগাধ বিশ্বাস বুড়োর। কিন্তু এবার আদেশ দিতে গিয়ে কেঁপে গিয়েছিল বুড়োর কণ্ঠস্বর। ভাঙন ধরেছে বুড়োর আত্মবিশ্বাসে। কাঁচা-পাকা ভুরু জোড়ার নিচে শান দেয়া ছুরির মত চকচকে চোখ দুটোতে উদ্বেগ আর আশঙ্কার ছায়া দেখতে পেয়েছে রানা। ঘাবড়ে গেছে আসলে বুড়ো।

.

গতকাল বিকেল চারটে পর্যন্ত কিছুই জানত না রানা। বি.সি.আই-এর ছায়াও মাড়ায়নি সে কয়েকমাস। দিব্যি আছে নিজের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে। একটার পর একটা কেস সমাধান করে চলেছে দ্রুতবেগে। বেশির ভাগই সহজ সব কেস। গুগুলোর মোটামুটি একটা ছক তৈরি করে কাজের ভার চাপিয়ে দেয় সে সালমা আর গিলটি মিঞার উপর-ওরাই করে। দু’একটা জটিল আর বিপজ্জনক কেস হাতে এলে একটু তাজা হয়ে ওঠে রানা, উৎসাহ নিয়ে কাজ করে। ক’দিন বেশ আনন্দেই কাটে, তারপর আবার যে কে সেই, কুঁড়ের বাদশা। সপ্তাহে তিনদিনের বেশি অফিসেই যায় না সে। কোনরকম বিজ্ঞাপন নেই, খরিদ্দার আকর্ষণের চেষ্টা তদবির নেই, চুপচাপ। কিন্তু ইদানীং মুখে মুখে নাম ছড়িয়ে পড়ায় একটু অসুবিধা হয়ে গেছে ওর-ফি-এর পরিমাণ দ্বিগুণ করে দিয়েও মক্কেল ঠেকাতে পারছে না।

এইটাই রানার কাভার। মেজর জেনারেলের আদেশ, এভাবেই প্রতীক্ষা করতে হবে ওকে আগামী অ্যাসাইনমেন্টের জন্যে, আনুষ্ঠানিকভাবে বি.সি. আই-এ অফিস করা চলবে না।

‘তুমি নিজের ব্যবসা নিয়েই যেমন ছিলে তেমনি থাকো। যখন দরকার হবে ডাকব আমি। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সাথে বাহ্যত কোন সংস্রব থাকবে না তোমার কিন্তু মাসে মাসে বেতন ঠিকই জমা হয়ে যাবে তোমার অ্যাকাউন্টে। তুমি, আমি আর সোহেল ছাড়া কেউ জানবে না আসল কথা। সবাই জানুক, চাকরি ছেড়ে দিয়েছ তুমি।’

ঠিক আছে। ‘রানা এজেন্সি-প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার্স’ টিকে গেল। ভালই লাগে রানার। কত বিচিত্র সব সমস্যা নিয়ে আসে মানুষ ওর কাছে, মানুষের মনের কত গোপন গভীর রহস্যের উন্মোচন হচ্ছে ওর চোখের সামনে-কত ব্যাকুলতা, লোভ, ক্রোধ, নীচতা, পাপ, মোহ, প্ৰেম এমনভাবে, এত কাছে থেকে মানুষকে জানবার সুযোগ পায়নি সে কখনও আগে। কিন্তু মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠে ওর মনটা। ভয়ঙ্করের সুহৃদ সে। বিপদ আর মৃত্যুর হাতছানি ছাড়া হাঁপিয়ে ওঠে ওর রোমাঞ্চপ্রিয় মন।

হঠাৎ ফোন এল সোহেলের। আবাল্য-বন্ধু প্রিয়তম মাসুদ রানাকে অনেকদিন না দেখে কলজেটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে, আগামী আধঘণ্টার মধ্যে দেখা না পেলে ফেটেই যাবে। গোটা কয়েক সদ্য উদ্ভাবিত গালি দিয়ে নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার। চলল রানা।

সোহেলের কামরায় ঢুকতেই আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। ক্লিক্ করে শব্দ হলো।

‘শালা ভোম্ভোট, রটনটট-কালিসি করার জায়গা পাও না!’ একটা চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছিল রানা। বাধা দিল সোহেল।

‘এখানে না, দোস্ত। ব্যাপারেশন ক্যাটাভ্যারাস। খোদ বুঢ়া মিঞা…’ বাম পাশের দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করল সোহেল।

রানা দেখল, দেয়াল-আলমারির দরজা দুটো খুলে গেছে। ওটা পাশের ঘরের দরজা।

কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে একবার ভুরু কুঁচকে রানাকে আপাদমস্তক দেখলেন মেজর জেনারেল, তারপর দাঁতে চেপে ধরা পাইপটা হাতে নিয়ে আবছা ইঙ্গিত করলেন বসবার জন্যে। বসে পড়ল রানা। পাঁচ মিনিট চুপচাপ। নিবিষ্টমনে একটা ফাইলে কি যেন দেখছেন বৃদ্ধ, মাঝে মাঝে পাতা ওল্টাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ভুলেই গেছেন রানার কথা।

ঘরটার চারপাশে দৃষ্টি বোলাল রানা। সেই পরিচিত পরিবেশ ফিরে এসেছে আবার। ইলেকট্রনিক দেয়াল ঘড়িতে বাজছে সাড়ে চারটা। সাউন্ড- প্রুফ ঘরটায় পিন-পতন স্তব্ধতা। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশে ঘুরে ঘুরে উড়ছে কয়েকটা চিল। পড়ন্ত বিকেলের রোদ পড়েছে পুরু কার্পেটের উপর। জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হয়ে এক চিলতে রোদ রঙধনু সৃষ্টি করেছে দেয়ালের গায়ে। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে এই ঘরে-ঘড়িটা মিথ্যা।

মেজর জেনারেল বসে আছেন সেই পিঠ-উঁচু রিভলভিং চেয়ারটায়। নীল সার্জের স্যুট, সাদা শার্ট, ব্রিটিশ কায়দায় বাঁধা লাল রঙের দামী টাই। বেশ ছোকরা ছোকরা লাগছে প্রায় তিন কুড়ি বছর বয়সের ঋজু রাশভারী চিরকুমার বৃদ্ধকে। ওঁর ঠিক পেছনেই সারা দেয়াল জুড়ে একটা ম্যাপ। একেকটা বোতাম টিপলে একেক দেশের ম্যাপ ভেসে ওঠে এই দেয়ালের গায়ে।

আজকের ম্যাপটা গোলমেলে। তিনটে দেশের ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু জায়গাটা ঠিক্ চেনা যাচ্ছে না। অসংখ্য শুঁয়োপোকা দেখে বোঝা যাচ্ছে, পার্বত্য এলাকা। নিজের অজান্তেই ছড়ানো ছিটানো নামগুলো পড়তে শুরু করল রানা। হাকা, গাংগাও, পলেতোয়া, ফালাম, টাও, মলাইক, উইটুং, শেরমুন, মালিয়ানপুই, রোনিপারা, লইংকলাংপারা, চিন হিস, মাউন্ট ভিক্টোরিয়া, লুসাই হিল্স, মিজো হিল্স … থমকে গেল রানার চোখ। পরিষ্কার বুঝতে পারল, চট্টগ্রাম, আসাম ও বার্মার অংশবিশেষ দেখতে পাচ্ছে সে দেয়ালের গায়ে। দ্রুততর হলো রানার চিন্তা। দৃষ্টিটা ফিরে এল বৃদ্ধের মুখে। নিবিষ্টমনে ফাইল ঘাঁটছেন তিনি। হঠাৎ চোখ তুললেন।

‘কেমন আছ, রানা?’

‘ভাল, স্যার।’

‘গোয়েন্দাগিরি চলছে কেমন? খুব ব্যস্ত?

‘না, স্যার। ব্যবসা ভালই চলছে, কিন্তু ব্যস্ততা নেই। জটিল কেস না পেলে সময় কাটতেই চায় না। হাঁপিয়ে উঠেছি।’

‘তাই নাকি? তাহলে কিছুদিন ঘুরে এসো রেঙ্গুন থেকে।’

চট করে ম্যাপের উপর ঘুরে এল একবার রানার দৃষ্টিটা। মৃদু হাসলেন মেজর জেনারেল রানার চিন্তার গতি বুঝতে পেরে।

ওটা হচ্ছে ঘটনাস্থল। কিন্তু চাবিকাঠি রয়েছে রেঙ্গুনে। আজ রাত বারোটায় রওনা হচ্ছ তুমি।’

রানার চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে আবার কথা বললেন মেজর জেনারেল।

‘হ্যাঁ। খুলে বলছি। তার আগে বলো দেখি ‘মুসলিম বাংলা’ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?’

‘ভাল করে ভেবে দেখিনি, স্যার। বাজারে জোর গুজব…’

‘গুজব? এটাকে গুজব বলে মনে করো তুমি, রানা?’,

একটু থমকে গেল রানা কথাটা শুনে। বলল, ‘রেডিয়োর নব ঘুরিয়েছি অনেক, কিন্তু ওই নামের কোন বেতারকেন্দ্র খুঁজে পাইনি, স্যার।’

‘মুসলিম বাংলা’র প্রসঙ্গ তোলায় সত্যিই অবাক হয়েছে রানা। বলল, ‘যাই হোক, আমার ধারণা, ব্যাপারটার মধ্যে কিছু সত্যতা যদি থেকেও থাকে, অনেক বেশি অতিরঞ্জিত হয়েছে লোকের মুখে মুখে।’

‘তাই হলেই ভাল।’ মাথা নাড়লেন মেজর জেনারেল। ‘কিন্তু আমি এর মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। দু’একটা নমুনা ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। দ্রব্যমূল্য হু হু করে বাড়ছে, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে পাকিস্তান, ভুট্টোর মুখে ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে মুসলিম বাংলা’র কথা, কে বা কারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে আমাদের পাটের গুদাম, চিঠিতে হুমকি আসছে দেশপ্রেমিক নেতাদের কাছে, লুট হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা ব্যাংক…আমার মনে হয় এসবই কোন ভয়ঙ্কর আঘাতের প্রাথমিক নমুনা মাত্র। খুব শিগির যদি ভয়ানক গোলমাল রেধে যায়, আমি অবাক হব না। আমার ধারণা, প্রায় প্রস্তুত হয়ে গেছে ‘মুসলিম বাংলা গেরিলা ফৌজ’। ‘

‘কিন্তু স্যার, ব্যাপারটা শুধু অসম্ভব নয়, উদ্ভট ঠেকছে আমার কাছে। গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হলে গণ-সমর্থন চাই। যে-কোন দেশের গেরিলার সবচেয়ে বড় ডিফেন্স হচ্ছে জনসাধারণ। প্রয়োজন হলেই মিশে যেতে পারে, নিরাপদ আশ্রয় পায় ওরা জনসাধারণের কাছে। এই একটি মাত্র কারণে ক্ষ্যাপা কুকুর হয়ে উঠেছিল পাকিস্তান আর্মি। আকস্মিকভাবে তুমুল আক্রমণ আসছে, অথচ মুকুত কাঁহাঁ’ জানা ছিল না ওদের। ফলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবার দশা হয়েছিল, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে, নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি, পদে পদে হোঁচট খেয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশের সামনে। সেই গণ-সমর্থন কোথায় পাবে এরা?’

‘ধর্মের দোহাই দিয়ে জনসাধারণের সমর্থন পাবে না ভাবছ?’

‘অসম্ভব। ওভাবে আর বোকা বানানো যাবে না এদেশের মানুষকে ইসলাম বিপন্ন বলে…’

‘ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করে?’

‘ওদিক থেকে যে একেবারে অসম্ভব তা বলব না, স্যার। কিন্তু তাতে সময় লাগবে অনেক। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ভারতের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব, বিপুল সমর্থন, আর অকৃপণ সাহায্যের কথা এত সহজে ভুলবে না এদেশের মানুষ। মানুষের মন থেকে কৃতজ্ঞতা আর সম্প্রীতির রেশটুকু মুছে ফেলতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে ওদের। কেবল স্যাবোটাজে জনসাধারণের সমর্থন আসবে না। টিকতেই পারবে না। সত্যিই স্যার, উদ্ভট…’

‘হ্যাঁ। উদ্ভট পরিকল্পনা বলতে পারো, কিন্তু অসম্ভব নয়। সারা দেশজুড়ে অরাজকতা সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট। আমার ধারণা এই অরাজকতার সুযোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করবে কোন বিশেষ মহল। বিরুদ্ধভাবাপন্ন বিশ্ব-শক্তির প্রত্যক্ষ হাত দেখতে পাচ্ছি এর পিছনে। নইলে অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ, বেতারকেন্দ্রের ট্র্যান্সমিটার ইত্যাদি কোথা থেকে আসছে ওদের? বার্মা ও ভারত সরকার এমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে কেন? সীমান্তে কারফিউ দেয়ার কথা দেখনি কাগজে?’ এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন রাহাত খান। ‘এক মহাপরিকল্পনা রচনা করেছে ইয়াহিয়া ও তার দোসররা মিলে, আমার যতদূর বিশ্বাস। ‘

‘প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে, স্যার?’ সতর্কতার সাথে প্রশ্ন করল রানা।

‘না।’ সাফ জবাব দিলেন বৃদ্ধ। ‘প্রত্যক্ষ কিছুই হাতে আসেনি আমাদের। কিছু কিছু আভাস দেখে অনুমান করে নিতে হচ্ছে। আসলে সবটাই অনুমান। তোমার প্রধান কাজ হচ্ছে এই অনুমানের মধ্যে সত্যতার পরিমাণ কতটুকু তা যাচাই করে দেখা!’

‘আর্মি পাঠানো হচ্ছে?’ কাজের কথায় এল রানা।

‘কোথায় পাঠাব? ওদের ঘাঁটিই তো লোকেট করা যায়নি এখন পর্যন্ত ভারত, বাংলাদেশ ও বার্মার সীমান্তে নয়শো বর্গমাইল জঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে ঠিক কোন জায়গাটায় ওদের ট্রেনিং সেন্টার, জানা যাচ্ছে না। লোক পাঠালে ফেরত আসে না সে লোক। একমাত্র লোক, যে সঠিক লোকেশনটা জানত এবং জানাতে যাচ্ছিল, প্যাপন মং লাই, সে-ও নিখোঁজ হয়েছে সপ্তাহখানেক হলো। তাই বার্মিজ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সহযোগিতায় জটিল একটা জাল পাততে হয়েছে আমাদের।’

‘প্যাপন মং লাই লোকটা কে?’

‘অত্যন্ত প্রতাপশালী এক আরাকানী উপজাতীর সর্দার। গেরিলাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে রেঙ্গুন থেকে যোগাযোগ করেছিল সে আমাদের সাথে। কিন্তু পরদিনই গায়েব করে ফেলা হয়েছে তাকে।

‘ব্যাপারটা ট্র্যাপ হতে পারে না, স্যার?’ সাবধানে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘খুব সম্ভব ট্র্যাপ নয়, তবু সেটাকেও একটা পসিবিলিটি বলে ধরতে হবে তোমাকে।’

লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে আমার?’

‘না।’ পাইপটা ধরিয়ে নিলেন মেজর জেনারেল আবার। খানিকক্ষণ আনমনে টানলেন, চোখের নিচটা বাম হাতের কনিষ্ঠা দিয়ে চুলকালেন, তারপর বললেন, ‘সেজন্যে মাসুদ রানাকে পাঠাবার প্রয়োজন পড়ে না। উ- সেনকে মনে আছে তোমার?’

চমকে গেল রানা।

‘সেই ভয়ঙ্কর বার্মিজ দস্যু, উ-সেন? মনে আছে, স্যার। প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছে বছর তিনেক হলো।’

‘মারা যায়নি। আমাদের তথ্যে ভুল ছিল। বেঁচে আছে এবং বহাল তবিয়তেই আছে। তোমার এবারের টার্গেট উ-সেন।’

আশ্চর্য হয়ে গেল রানা। হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ বোকার মত। সংবিৎ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মুসলিম বাংলার সাথে দস্যু উ-সেনের কি সম্পর্ক স্যার?’

‘টাকার সম্পর্ক। প্রচুর ডলারের বিনিময়ে ওর সহযোগিতা কিনে নিয়েছে পাকিস্তান। ওর প্রকাণ্ড নেট-ওয়ার্ক এখন কাজ করছে ‘মুসলিম বাংলা গেরিলা ফৌজে’র অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, এমন কি মানুষ সরবরাহ করার কাজে। অনেকটা লিয়াজো ও রিক্রুটিং অফিসারের কাজ করছে সে। সরাসরি গেরিলা ফৌজে যোগ দেয়ার উপায় নেই, প্রথমে ওর ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহ করতে হবে তোমাকে।

‘আমি কি ওদের দলে যোগ দিতে চলেছি?’

তুমি একা নও। হাজারতিনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সুন্দরবনের এক গোপন আস্তানায় লুকিয়ে রেখে ওদের মুখপাত্র হিসেবে তুমি একা যাচ্ছ উ-সেনের সাথে দেখা করতে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা-বারুদ নিয়ে যাচ্ছ তুমি তোমার সততা এবং ‘মুসলিম বাংলা’র প্রতি নিষ্ঠার প্রমাণ স্বরূপ। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বার্মিজ ইন্টেলিজেন্সের মারফত কৌশলে কন্ট্রাক্ট করা হয়েছে উ-সেনের সাথে, আজই রাত বারোটায় রওনা হচ্ছ তুমি। খুব সম্ভব পাকিস্তানী কোন জেনারেলের সাথে দেখা হয়ে যাবে তোমার রেঙ্গুনে। কপাল ভাল হলে মাহমুদ আলী বা গোলাম আযমকেও পেয়ে যেতে পারো।’

‘আমার কাজটা কি, স্যার?’

‘প্রথম কাজ প্রাণে বেঁচে থাকা। দ্বিতীয় কাজ শত্রু ধ্বংস করা। বার্মিজ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসকে সরে থাকতে বলেছি। কিভাবে কি করবে সেসব নির্ভর করবে পরিস্থিতির গতি প্রকৃতির উপর। যেমন ভাল বুঝবে, করবে। তবে আমি আশা করব, সাতদিনের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে ঊ-সেনের দল, মারা যাবে ‘মুসলিম বাংলা’ আন্দোলনের দু’একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্ণধার, গেরিলা ট্রেনিং সেন্টারের অবস্থান হাতে আসবে আমার।’ পাইপটা নামিয়ে রাখলেন মেজর জেনারেল টেবিলের উপর। ডান হাতটা সামান্য একটু নড়ল ডানদিকে। অর্থাৎ-বক্তব্য শেষ, এবার তুমি আসতে পারো। সরাসরি চাইলেন বৃদ্ধ রানার চোখে। ‘কিছু প্রশ্ন আছে?’

‘শত্রুপক্ষ কে? কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি আমরা?’

তুমি জানতে চাইছ, যেহেতু ‘মুসলিম বাংলা গেরিলা ফৌজে’র সাথে কিছু ভারতীয় মিজো, নাগা ও বর্মী বিদ্রোহী যোগ দিয়েছে, আমরা তাদের সাথেও লড়ছি কিনা? উত্তরটা হচ্ছে, হ্যাঁ। ওরা যৌথভাবে কাজ করছে। ওদের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে এক এক করে প্রত্যেকের সমস্যার সমাধান করবে। যাই হোক, বাংলাদেশের মাটিতে যেই আসুক, ভারতীয় হোক, বর্মী হোক, আর পাকিস্তানী হোক—যদি দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে চায়, আমরা তাদের শত্রু।’

‘বুঝলাম স্যার, কাউকে ছেড়ে কথা বলব না। এখন কিভাবে যাচ্ছি, কিভাবে কন্ট্যাক্ট করছি উ-সেনকে, ইত্যাদি ব্যাপারে একটু ডিটেইল্স্ …

তোমাকে কন্ট্যাক্ট করতে হবে না, ওরাই খুঁজে নেবে তোমাকে। আর অন্যান্য ব্যাপারগুলো বিস্তারিত জানতে পারবে সোহেলের কাছে।

‘ঠিক আছে, স্যার।’ উঠে দাঁড়াল রানা।

সরাসরি রানার চোখের উপর চোখ রাখলেন মেজর জেনারেল।

‘উ-সেন কতটা ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী সে কথা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই আশা করি। রেঙ্গুনে বসে ওর বিরুদ্ধাচরণ করবার ক্ষমতা পৃথিবীর কুখ্যাত দস্যুদল টং বা মাফিয়ারও নেই।’ উদ্বেগ আর আশঙ্কার ছায়া দেখতে পেল রানা বৃদ্ধের চোখে। ‘কাজেই প্রয়োজন হলে যেন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারো, তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে রেঙ্গুনে। নানকিং হোটেলে তোমার সাথে এক ছুতোয় পরিচয় করে নেবে এক ভারতীয় দম্পতি, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সরোজ গুপ্ত। তোমার মিশন সম্পর্কে কিছুই জানে না ওরা, জানাবার প্রয়োজনও নেই। কাজ শেষ হলেই নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেবে তুমি নিজেকে মিসেস গুপ্তর হাতে।’

হঠাৎ চোখজোড়া সঙ্কুচিত হয়ে গেল রানার। পরমুহূর্তে চমকে উঠল সে। দ্বিগুণ হয়ে গেল হার্টবিট।

কি ওটা!

মেজর জেনারেলের শেষের কথাগুলো এখনও বাজছে কানে…কিন্তু একলাফে ঢাকা থেকে ফিরে এসেছে মনটা চারশো মাইল দক্ষিণের বর্তমান বাস্তবে।

আলো!

বামদিক থেকে একটা লাল আলো এগিয়ে আসছে ইয়টের দিকে। দ্রুত। নিঃশব্দে।

কিসের আলো? জাহাজ? প্লেন?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটল রানা ব্রিজের দিকে। দূরবীন অ্যাডজাস্ট করতে করতেই বেশ অনেকটা কাছে চলে এল আলোটা। মাইল দেড়েক হবে এখান থেকে বড়জোর। চট করে নেভিগেশন লাইট নিবিয়ে দিল রানা। ভাল করে কিছু বুঝে উঠবার আগেই এক মাইলের মধ্যে এসে পড়ল আলোটা। আবছামত দেখতে পাচ্ছে রানা।

হেলিকপ্টার!

এই অন্ধকার সমুদ্রের বুকে হেলিকপ্টার কেন? বার্মার কোস্টাল সিকিউরিটি গার্ড। পুলিস? আর্মি? না চোরাচালানী?

এইদিকেই আসছে। রোটর ব্লেডের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে রানা এখন। হেম্ ঘুরিয়ে কোর্স পরিবর্তন করল রানা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি। স্পীড বাড়িয়ে দিল, থারটি নটস্! কিন্তু কোন লাভ হলো না। অনেক কাছে এসে গেছে।

দপ করে জ্বলে উঠল চোখ-ধাঁধানো সার্চলাইট।

সমুদ্রের বুকে কি যেন খুঁজছে হেলিকপ্টার,। এই ইয়টটাকে? ব্যাপার কি? রানার পজিশন জানল কি করে ওরা?

খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে স্থির হলো সার্চ লাইটের আলো ইয়টের উপর। একশো গজ উপরে এসে দাঁড়াল হেলিকপ্টার। রোটর ব্লেডের কর্কশ আওয়াজে কানে তালা লাগবার জোগাড়। ধীরে ধীরে নেমে আসছে ওটা নিচে।

কর্কশ কণ্ঠে আদেশ এল লাউড স্পীকারে ।

‘থামাও ইয়ট। নোঙর ফেলো। নইলে গুলি করব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *